বাবার স্মৃতি ও একটি অপ্রকাশিত কবিতা

 

বাবা সম্পর্কে কিছু লিখতে বললে ইদানীং কোনো কিছুই আমার পর পর সাজানো আসে না। কেন জানি দূরে আরও দূরে সরে যায়। চশমার আবছায়া কাচ বারবার মুছি। যেন কিছুতেই সঠিক চ্যানেলটা ধরতে পারছি না। যেন সেই পুরোনো দিনগুলো ফিরে এসেছে, যখন বাঁশের মাথায় সিলভারের হাঁড়িকুড়ি দিয়ে ডিশ ধরার চেষ্টা। যা কিছুক্ষণ বাদেই সংযোগ হারিয়ে হাসিমুখে ঝিরঝির করতে থাকে। বাবা সে রকম মাঝে মাঝে আমার স্মৃ্তি বেয়ে বেয়ে নেমে আসে, মাঝে মাঝে সাদাকালো ঝিরঝির একটানা অর্থহীন শব্দে পরিণত হয়। তাতেও কিছু বোঝা যায় না, ঘুমে কী জাগরণে!

তাঁর সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক ধারণা রাখা দরকার, যা অনেকেই হয়তো জানেন। তাঁর ছিল তিন মাইল লম্বা একটি নাম। বাবার পুরো নাম সৈয়দ আল হাশেমী আবু জাফর মুহম্মাদ বখত সিকান্‌দার। এই নামেরই অংশ কবি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রেখেছিলেন নিজে। আমার বাবা সিকান্‌দার আবু জাফর সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে ১৯১৮ সালের ৩০ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। বিডি উচ্চ বিদ্যালয় এবং কলকাতার রিপন কলেজ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ইতিহাসের ধারায় এক বর্ণিল চরিত্র। জাতীয় এবং রাষ্ট্রীয়ভাবেও বারবার সমাদৃত। কবিতা, সংগীত, সুর সংযোজন, নাটক, উপন্যাস, রম্যলেখা এবং সাংবাদিকতা তাঁর একান্ত সৃষ্টিশীলতার এলাকা। সমকাল [মাসিক] তিনি ১৯৫৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সম্পাদনা করেন। সিকান্‌দার আবু জাফর তাঁর নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যেই বিশিষ্ট। সংগঠক হিসেবে তাঁর দায়িত্বশীলতা অনন্য, যা কেবল লেখার ক্ষমতা থাকলেই হয় না। তিনি যা লিখেছেন তা লেখার আনন্দেই লিখে গেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, যা লিখেছি তা কবিতা হয়েছে কি না, তা নিয়েও আমার তেমন কোনো দুশ্চিন্তা নেই। এই চিন্তাহীন অনর্গলতা সিকান্‌দার আবু জাফরের শুধু শিল্পী-বৈশিষ্ট্য নয়, তাঁর ব্যক্তি-বৈশিষ্ট্যও বটে। নিজের কবিতা সম্পর্কে তাঁর মত, ব্যক্তিগতভাবে আমি মাটিতে শিকড় মেলে দাঁড়াবার চেষ্টাতেই বেশি ভরসা পাই। তিনি বরাবর প্রচারবিমুখ ছিলেন।

সমকাল তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এই সমকালের প্রশ্রয়ে প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিক একটা ঐক্যবদ্ধ শক্তির স্বাদ পেয়েছিলেন। সমকাল শতাধিক সংখ্যা সিকান্‌দার আবু জাফরের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। মতিঝিল থেকে প্রকাশিত সমকালের বিনিময় মূল্য ছিল এক টাকা মাত্র। এতকাল পরেও পুরোনো সমকালের গায়ে ছাপানো এই মূল্যমান দেখে অবাক হতে হয়। তিনি আদৌ বৈষয়িক ছিলেন না। তিনি নিজেকে বলতেন সাহিত্যকর্মী। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার পর হারিয়ে যাবার ভয়ে সমকাল পত্রিকার বেশ কিছু সংখ্যা একত্রে বাঁধাই করেছিলেন। ফলে বেশ কিছু সংখ্যা একত্রে দেখার সুযোগ হয় আমার।

বহু নামিদামি লেখক, কবির কোলাহল ছিল সমকালের পাতায়। ঋদ্ধ ছিল সূচিপত্রশহীদ কাদরী, সৈয়দ আলী আহসান, হায়াৎ মামুদ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, মুন্সী প্রেমচন্দ, সুফিয়া কামাল, বুলবুল ওসমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদসহ আরও অসংখ্য কবি ও গল্পকার। বলাই বাহুল্য, তৎকালীন প্রায় সকলেই সমকালের লেখক তালিকায় ছিলেন। এভাবে লিখে তাঁদের নাম শেষ হবার নয়। কী অসাধ্য সাধন করে গেছেন তিনি ঐকান্তিক চেষ্টায়, যা অনুকরণের চেষ্টা করাও বৃথা। নাট্যকার হিসেবে তিনি জীবদ্দশাতেই সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর রচিত নাটক মহাকবি আলাওল এবং সিরাজ-উদ-দৌলা প্রথম শ্রেণির নাটক হিসেবে সমাদৃত ছিল। সিরাজ-উদ-দৌলা নাটকটি জাতীয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং এখনো আছে। আমার সৌভাগ্য, তাঁর নাটক সিরাজ-উদ-দৌলা উচ্চ মাধ্যমিকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এ যেন এক জীবন্ত ইতিহাসকে আঙুল দিয়ে বইয়ের পাতায় স্পর্শ করা। চরিত্রগুলো সারা শ্রেণিকক্ষে ঘুরে বেড়াত। এ এক অনুচ্চারিত অনুভূতি।

সিকান্‌দার আবু জাফর ছিলেন চল্লিশ দশকের কবি। অথচ তাঁর কবিতার বই বের হয়েছিল বিলম্বে। একত্রে তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। তিনি তেমন অতীত ভ্রামাণিক ছিলেন না, বরং তাঁর কবিতার বিষয় ছিল দেশ ও সমাজের বর্তমান প্রেক্ষাপট। অর্থাৎ তিনি যখন যে অবস্থায় ছিলেন সেই প্রেক্ষাপট। তাঁর লেখার অনুষঙ্গ নিসর্গ নয়, বরং মানুষ আর মানুষের আর্তনাদ নিপীড়নের বিরুদ্ধেই তাঁর কলম উচ্চকিত ছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত আচরণের সম্মুখে তিনি সমুচিত অহংকারে বাংলা ছাড়ো কবিতাটি প্রকাশ করেছিলেন, যা কালোত্তীর্ণ কবিতা। এবং বহু বাচিকশিল্পীর পছন্দের তালিকায় শীর্ষে।

তাঁর বাংলা ছাড়ো কবিতা সত্যিকার অর্থেই পাকিস্তানিদের বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল। আমরা আজ কোরাসে তাঁকে পাই। গানে, গল্পে, নাটকে, আবৃত্তিতে পাই। পাই সমকালে। অধুনা অনেকেই দশকওয়ারি সংকলন বের করেন এই মুক্তিযোদ্ধা শব্দসৈনিককে বেমালুম স্মৃতির বাইরে রেখে। দশকের ধার কি সিকান্‌দার আবু জাফর ধারেন!...

জনতার সংগ্রাম চলবেই/ আমাদের সংগ্রাম চলবেই অসামান্য কথার এই গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন সুরকার শেখ লুৎফর রহমান। এই গানটি দেশের প্রতিটি সংকটে গীত হয়েছে; উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে, মুক্তিযুদ্ধে, স্বাধীন বাংলায়। এটি তাঁর সর্বাধিক প্রচারিত কবিতা-গান। ব্যক্তিগতভাবে বাবাকে ঘনিষ্ঠভাবে না পেলেও যতটুকু পেয়েছি তা আমাকে অশেষ করেছে। তাঁর কবিতা তো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ম্যানিফেস্টো। একজন সিকান্‌দার আবু জাফরের বর্ণনাবহুল কর্মজীবন এক ক্যানভাসে এঁকে ফেলা প্রায় অসম্ভব।

১৯৭৫ সালের ৫ আগস্ট এই অকুতোভয় অসাম্প্রদায়িক কবি শ্বাসকষ্টজনিত কারণে হাসপাতালের এক সাধারণ বেডে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি চলে গেছেন, আমার হাতে রয়ে গেছে তাঁর লেখা অপ্রকাশিত সেই কবিতা, যা তিনি নিজে সুর করেছিলেন নিজ কণ্ঠে রেকর্ড করেছিলেন এবং ১৯৭৩ সালে আমার প্রথম জন্মদিনে নিজের হাতে লিখে উপহার দেবার জন্য কাঠের ফ্রেমে বাঁধিয়ে এনেছিলেন। তাঁর এক বছরের শিশুকন্যাকে তিনি এভাবেই শুভেচ্ছা জানাতে চেয়েছিলেন। এখানেই তিনি এক অসাধারণ কবি, এক অনন্য পিতা। বাবার সাথে তেমন আলাপ হয়নি। কথা ভালোমতো শেখার আগেই বাবা খুব অসময়ে চলে গেলেন। এতে করে হলো কী, তিনি আমার তিন বছর বয়সেই আটকে রইলেন। তাঁর আর বয়স বাড়েনি।

তাড়াহুড়ায় আমার জন্য এক হারমোনিয়াম ছাড়া আর কিছুই বাবা রেখে যাননি। না কোনো ঘর, না জমানো স্বপ্ন, কুঁচি দেওয়া ফ্রক, সম্পর্ক, কিচ্ছু না। ফলে একা সত্যিকার সংগ্রামে পড়লাম। সত্যিকার মানুষ দুচোখে চিনলাম। কারা কেন ভালো ছিলেন, কারা কেন আর খোঁজ নেন না, একটু একটু করে বুঝতাম তখন। জীবন তুমি কত কিছু নিয়ে গেলে, কোনো কিছুই না দিয়ে।

সরল অঙ্ক করতে করতে বাবাকে চাইতাম। আমার সব সরল মিলত, আইনের গরল মিলত না। বাবাকে যে এনে দিতে পারে, তাকে মুখে মুখে সমস্ত টাকা-পয়সা দিয়ে দিতাম। আমার একটা মাটির হাতি-ব্যাংকে শব্দ করা টাকা থাকত। কিন্তু কেউ আর তাঁকে এনে দিতে পারেনি বিধায় আমার টাকারা বাড়তেই থাকল। আরও আরও টাকা হোক। বাবাকে যে সত্যি সত্যি এনে দেবে, সব টাকা তাকেই দিয়ে দেব।

এই দেয়া-থোয়া নিয়ে এক গল্প আছে। মায়ের মুখে শোনা। বাবা তখন বেঁচে আছেন দিব্যি। আমি আড়াই বছরের। জামা-জুতো পরে বেড়াতে যাবার সময় গেটের বাইরে দেখি, আমারই বয়সী এক বাচ্চা মেয়ে হাত পেতে ভিক্ষা করছে। তার গায়ে কোনো ফ্রক নেই। ফ্রক নেই কেন!...আমি নিজের গায়ের ফ্রকটাই খুলে দেবার চেষ্টা করছিলাম। বাবা দৌড়ে এসে আমার জামা লাগিয়ে দিলেন। ঘর থেকে আমারই আরেকটা জামা বাচ্চাটিকে দিলেন, তবে আমার মন শান্ত হলো। আমার কথা ছিল, ওর গায়ে জামা নেই কেন বাবু [বাবাকে বাবু বলতাম]? বাবা হেসে মাকে বলতেন, তোমার মেয়ে দেখো সবাইকে সবকিছু দিয়ে দেবে। নিজের কিছুই রাখবে না। কত্ত পুরোনো কথা। আসলে তাঁকে ঘিরেই আমার যত পুরোনো ঘ্রাণ, মরচে পড়া সিন্দুক খুলে বারবার উঁকি দেয়; যাকে দেখা হয়নি।

বাবা রোজ লেখালেখির পর, গানের সুর করার সময় আমাকে কোলে নিয়ে বসতেন। কিন্তু তখন আমি খেলতে যাব। আর বাবা চেপে ধরে রাখবেন, রাখবেনই। তারপর চলবে গান শেখানো। কঠিন কঠিন সব গান। বলো কথা দেব কেমন করে, চিরদিন তোমায় ভালোবাসব। বাবা শেখাচ্ছেন... বলো বাবা, জনতার সংগ্রাম চলবেই।

জনতা সংগাম চলবেই। [আমি ভালো করে বলতে পারি না]

আমাদের সংগ্রাম চলবেই’, আমাদের সংগাম চলবেইইই। মানে আবেগের চোটে অনেকগুলো । তাই দিয়ে বাবার সাথে তারস্বরে গলা মিলানো। আর ছিল খরবায়ু বয় বেগে গানটা গাওয়া। বাবা খুব জোরে হেঁইয়ো টান দিতেন আর আমি খুব ঘাড় কাত করে হাইয়ো হাইয়ো করতে করতে হেসেই মরতাম। আর সারা দিন বাবা মেয়ে কুটকুট করে গল্প বাবা, নানুবাড়ি যাও না কেন? [আসলে নানুবাড়ি পাশেই। সারা দিন নানুবাড়ি যাই।]

ধোঁয়া...মশাআআ আমি মুখ কুঁচকে বলতাম।

কাহিনি হচ্ছে নানুবাড়ির উঠোনে প্রচুর গাছ, তাই মশা তাড়ানোর জন্য সন্ধ্যাবেলায় শুকনো পাতা পুড়িয়ে ধোঁয়া দেয়া হতো। তো তখন খুব চোখ চুলকিয়ে কান্না পেত। অথচ সারা দিন লক্ষবার নানুবাড়ি তিড়িংবিড়িং যাচ্ছি, খাচ্ছিকোনো অসুবিধা নেই।

বাবা মজা করে বলতেন, আরও যাবে নানুবাড়ি?

যাব না বাবা, নানুবাসায় ধোঁয়াআ মশাআআ...হেসে আমি বাবার গলা ধরে ঝুলতাম। আহা, এই সব আনন্দ-কথা একটা ক্যাসেটে বন্দি ছিল। তাঁর আর মেয়ের কণ্ঠস্বর। এই দুর্লভ ক্যাসেটটা এখন নেই। বাবা এখনো সেই তিন বছরের মেয়ের বুকের ভেতর বন্দি।

যাব বললেই কি যাওয়া যায়? যায় না...তাই না বাবা?

প্রতিবার ৫ আগস্ট চলে যায় দ্রুত। সারা দিন লিখতে ইচ্ছে হয় না। রাত বারোটা বাজার আগে লিখতে শুরু করি। আজ ছেচল্লিশ বছর বাবা নেই আশপাশে। কী একটা জীবন কাটালাম! অনেকেরই তাঁকে জানা নেই। দেশের নতুন প্রজন্ম অনেকেই জানেন না। এ বড় দুঃখজনক।

তাঁর বাংলা ছাড়ো কবিতা সত্যিকার অর্থেই পাকিস্তানিদের বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল। আমরা আজ কোরাসে তাঁকে পাই। গানে, গল্পে, নাটকে, আবৃত্তিতে পাই। পাই সমকালেঅধুনা অনেকেই দশকওয়ারি সংকলন বের করেন এই মুক্তিযোদ্ধা শব্দসৈনিককে বেমালুম স্মৃতির বাইরে রেখে। দশকের ধার কি সিকান্‌দার আবু জাফর ধারেন! এই ঘাসপাতা কবিদের জন্য করুণা।

যে-কাল গেছে নিদারুণ সে-সময়ের সর্বগ্রাসী শিখা তাঁর স্পর্ধা মতো আমাকেই পুড়িয়ে পুড়িয়ে রেখে গেছে অনন্য পুরাকাল। তাতে কান পাতলে বাবার জলদকণ্ঠ শোনা যায়। তিনি এক হাতে লিখছেন আর থেমে থেমে পড়ছেন। এ দৃশ্য আমার নিজের চোখে দেখা তো নয়, তবু কেন বারবার দেখি। এই কবিতাটা নিজ হাতে লিখে দিয়েছিলেন আমার প্রথম জন্মদিনে। তাঁর হাতের লেখা কবিতাটা খুঁজে পাই না। কিন্তু যে কণ্ঠটা বুকের ভেতরে খোদাই হয়ে আছে, কে তারে হারায়।

 

অপ্রকাশিত কবিতা

সিকান্‌দার আবু জাফর

বড় অবেলায় তুমি এসেছো
আমারও জীবন ভরিয়া
ওগো কলকল ছলহাসিনী
যবে জীবনের ছবি ফেলেছি শূন্য করিয়া
ওগো জ্বলজ্বল তারাভাসিনী। 

যখন মরণ তিমিরাঞ্চল উড়ায়ে,
নিতেছে প্রাণের সৌর ফসল কুড়ায়ে
তুমি জীবন শেষের দুরূহ দিবসগুলিতে
এসেছো শংকানাশিনী। 

তোমার দু’হাতে পৃথিবী যে দেবো তুলিয়া
হয়তো আমার সে পুণ্য আর হবে না
তবু ঝরা মমতার পথে তুমি দিশা হারাবে
শত মরণেও সে আমার তবু স’বে না। 

সান্ত্বনা শুনি তোমার শোণিতে শোণিতে
উৎসব হবে আমার নামের ধ্বনিতে
তুমি জীবন শেষের দুরূহ দিবসগুলিতে
এসেছো শংকানাশিনী।। 

[রচনাকাল ১৯৭৩ সাল]

 

তত দিনে অনেক সময় হলো তিনি চলে গেছেন। বাবার অল্প কিছু ব্যবহার্য জিনিস বাসায় আলমারিতে গুছিয়ে রাখা ছিল। কিন্তু ছোটবেলায় তা দেখার অনুমতিই ছিল না। মাঝে মাঝে আম্মা আলমারি খুলে রেখে ভুলে অন্য কাজে চলে যেতেন। অমনি আমি পেয়ে যেতাম, খুল্ যা সিম্ সিম্ এর আনন্দ। তখন যা কিছু দেখতাম হাতে ধরে ধরে পরে তা লিখে রাখতাম। একবার আলমারি দেখার পর রম্য করে সাধু ভাষায় লিখেছিলাম...

অনেক অনেক কাল আগের কথা, একদা এক স্টিলের আলমারিতে এক জোড়া পায়জামা পাঞ্জাবি বাস করিত। তাহারা ছিলো ধবধবে প্রবল ইস্তিরি যুক্ত নিপাট ভাঁজে ভাঁজ। এই স্টিলের আলমারিটি এতকাল ব্যবহৃত হলেও তাহার মধ্যে যে এরকম ছাপা ছাড়া সাদা রং পাজামা-পাঞ্জাবি থাকিতে পারে তাহা কাহারো জানা ছিলো না।

ধরা যাক এই পাঞ্জাবিটির মালিক বেশ উঁচালম্বা মানুষ ছিলেন। হাতা প্রায়ই গুটিয়ে রাখিতেন কেননা হাতায় স্পষ্ট দাগ; আয়রনে যায় না। পায়জামার নিচটা একেবারে ফকফকা; কোনো দাগ নাই। অর্থাৎ তিনি পোষাকের তুলনায় লম্বা ছিলেন। তার বেতের চেয়ার, টেবিল আর ক্লিপবোর্ডে কয়েক দিস্তা কাগজ আটকানো থাকিত। তিনি রোজ সকালের ভিটামিন-ডি খাইতে খাইতে পাতার পর পাতা লিখতেন। হলদেটে কাগজের পলকা পৃষ্ঠাগুলো সেভাবেই আটকানো।

এরপর উক্ত আলমারি থেকে একে একে বাহির হইতে লাগিল। ঝোলা, আচকান, চেকের লুঙ্গি, ভেলভেটের টুপি, সাদা সুতির চাদর, কুরুশ কাটার টুপিসহ নেপালি টুপি। যিনি এই সমস্ত টুপির মালিক তাকে বাস্তবে টুপিসহকারে কখনই বাইরে দেখা যাইত না। টুপির সাথে বন্ধুত্ব ছিলো না তার।

এ ছাড়া ছিলো কাঠের পাইপ। সোনালি বর্ডার দেয়া কাঠে পাইপটি সুদৃশ্য। কাঠের পাইপখানা ঠোঁটে পুরিয়া তিনি যখন টান দিতেন তখন পাইপের অভ্যন্তরে অবস্থিত চূর্ণ করা তামাকেরা যত্রত্ত্র জ্বলিতে থাকিত। এর ফলে অবাধ স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হইত। এই স্ফুলিঙ্গের আলো কর্তার গালে কখনও তীব্র, কখন ম্রিয়মাণভাবে জ্বলিত। এই আলোটুকু কেবলই প্রস্থানরত কাউকে মনে করাইতো।

যাইবার পর এতকাল পরে তার পরনের এবং ব্যবহার্য জিনিস দেখিয়া নানা প্রশ্ন আমার মনে উদয় হইতে লাগিল। কিন্তু এই বিষয়ে মুখ খুলিবার কোন উপায় নাই। বরং ভাঁজ করা কাপড়গুলি ফের গুছাইয়া আলমারির তাকে গছাইয়া দিয়া আসাই ভালো। সবকিছু জায়গা মতো রেখে আসার সময় হঠাৎ ফের আলমারির দরজা ঘটাং শব্দে খুলিলাম। নাহ, কোন শব্দ নেই। যেখানে যেখানে যা যা থাকার সব ঠিকঠাকই আছে। নিশ্চয়ই আমার শুনিতে কিছু ভুল হইয়াছে। আলমারির অন্দর হইতে কেউ নিশ্চয়ই আমাকে বাবা বলিয়া ডাকিয়া উঠিতে পারে না। একেবারেই না...।

কবি সিকান্‌দার আবু জাফরের রচনাবলি নিয়ে লেখা এক পর্বে শেষ করা সম্ভব নয়, তাঁর গতি-প্রকৃতি বহুমাত্রিক। তাঁকে নিয়ে উপেক্ষা আছে। আলোচনা নেই। সবই সত্য। তিনি নিজেও নিজেকে লুকিয়ে রাখার পক্ষে ছিলেন। দল করতেন না। এভাবেই তাঁর আলাদা ইমেজ, তাঁর আলাদা বলিষ্ঠতা। তবু তিনি অপরিহার্য এবং অপ্রতিরোধ্য। কোনো নাম না জানা প্রসন্ন প্রহরে, বা বৈরী বৃষ্টিতে এই হারিয়ে ফেলা কবিকে খুঁজে পাবার সামর্থ্য আমার নেই, ফিরে পাবারও।