সাহিত্য ও জীবনের একাদর্শিক মানুষ অমিতাভ পাল

 

তাঁর সামনে নিজেকে কসাইয়ের দোকানে ঝুলে থাকা মাংসের মতো মনে হতো। যেকোনো সময় আংটা থেকে নামিয়ে চাপাতি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করবে। যে কাউকে গল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে চালান করা আর সমালোচনার ক্ষুরধার ছুরিতে কেটে টুকরো টুকরো করতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন বলে সম্ভবত সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে কেউ এমন মন্তব্য করেছিল। কবি ও গল্পকার অমিতাভ পালের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য এই বক্তব্য। তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে মেলামেশা করা যে কারোর মাঝেই এমন অনিরাপত্তাবোধ আর অস্বস্তি তৈরি হবার কথা। অন্তত আমার বরাবরই তেমনই মনে হয়েছে। তাঁর শাণিত চোখ, সমালোচনা, বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণের নিচে কাটা পড়ত ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, সময়, সভ্যতাসহ যেকোনো কিছুই।  

এই অমিতাভ পাল আমাকে অনুরোধ করতেন(?) তাঁর গল্প-কবিতা নিয়ে সবিস্তারে লিখতে! কী অবিশ্বাস্য! আমি যখন তাঁর গল্পের ভূয়সী প্রশংসা করতাম, তিনি বলতেন, লেখেন না হিজল, দুই পাতা লেইখা দেন, আমি আমার মায়েরে দেখাব। তাতে যদি আমার মা বুঝতে পারেতার ছেলে কত বড় লেখক! জীবনে এই একটা কাজই তো করলাম। আর সবহানে ব্যর্থ। আমি বলতাম, লিখব দাদা, আমি সিরিয়াসলি লিখব। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুব বিক্ষিপ্ত অবস্থায় আছি, একটু গোছায়া নেই। হায়, আমার সেই গোছানো কি আজও শেষ হলো? না। কিন্তু এরই মাঝে অমিতাভ পাল আমাদের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে অনন্তলোকে চলে গেছেন। আর কারও কাছে নয়, মায়ের কাছে বড় হয়ে উঠতে চাওয়া শিশু অমিতাভের প্রবল অভিমান আমি আঁচ করতে পারি।

সেই অভিমান অপরাধবোধের জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসেছে আমার কাঁধে। আমি তো এ জীবনে এই পাথরভার নামাতে পারব না। আরও আরও ভালোবাসা প্রকাশের সুযোগ না দিয়েই চলে গেছেন তিনি। আমাদের বেঁচে থাকা অপরাধবোধের কাঁটায় ভরে তুলতেই প্রতিশোধ নেওয়ার মতো হুট করে চলে গেছেন।

অমিতাভের প্রস্থান ঘিরে মনে পড়ে খাঁচা নিয়ে লেখা তাঁরই এক মর্মন্তুদ গল্পের কথা। খাঁচাবন্দি একদল পাখি, যারা মুক্ত হয়ে আকাশে ডানা মেলতে চায়। সেই চাওয়া থেকেই খাঁচার শিক ঠোকরাতে থাকে তারা। কিন্তু, তাদের ঠোঁট মোটেও গরাদ ভাঙার মতো শক্ত ছিল না। ফলে ঠোকরাতে গিয়ে ভেঙেচুরে যায় পাখিদের ঠোঁট। কিন্তু হাল ছাড়ে না সেই পাখির দল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম শিক ঠোকরাতে থাকে তারা। অবশেষে সেই দিন এসে হাজির হয়, অভিযোজনে অভিযোজনে সত্যিই এক প্রজন্মের ঠোঁট এত শক্ত হয়ে ওঠে যে, অনায়াসেই তারা সেই খাঁচার শিক ভেঙে ফেলে। কিন্তু হায়, তারা তো খেয়ালই করেনি, একদিকে যখন ঠোঁটের শক্তি বাড়ছিল, অন্যদিকে সমানতালে নিঃশেষ হয়ে যাছিল তাদের সেই সব অলীক ডানার ওড়ার ক্ষমতা। ডানাগুলো ছোট হতে হতে একেবারে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ফলে একদিন খাঁচা ভেঙে ফেললেও তাদের আর ডানা মেলে উড়ে যাওয়া হয় না। ডানা ছাড়া সমস্ত দুনিয়াই তাদের জন্য হয়ে পড়ে বিশাল এক খাঁচা।

আধুনিক, অস্তিত্ববাদী, উৎকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির এক লেখক ছিলেন তিনি। তাঁর মানসকাঠামোতে বোদলেয়ারিয়ান ও কাফকায়েস্ক চিন্তাপদ্ধতির প্রভাব ছিল। এক নিরন্তর চিত্তবিক্ষেপ, উষ্মা ও বিদ্রূপের ভেতর দিয়ে অস্তিত্ববাদী উন্মূলতার স্বাদ নিয়েছিলেন তিনি। তবে তা উন্মূলতাই; কখনোই ছিন্নমূল নয়। আর সে কারণেই অস্তিত্বের অসহনীয় লঘুতা তাঁকে পলে পলে বিক্ষিপ্ত করত।

অমিতাভ পালের লেখায় যেমন আমরা এসব চিন্তারীতির প্রবাহ দেখতে পাব, একই সঙ্গে তা পাব তাঁর জীবনযাপন পদ্ধতির মাঝেও। ফলে, ব্যক্তি অমিতাভ পালও একটি টেক্সট আকারে হাজির হয় আমাদের সামনে। যে টেক্সটকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না

গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু পরে কোনো সময় বাকি কাজটা করার জন্য তক্কে তক্কে ছিলেন অমিতাভ। খুব গোপনে আরেকটি ডানা ঠিকই লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। সেই ডানা, মরণের ডানা। তাতে ভর দিয়ে শেষমেশ ঠিকই উড়ে গেছে অমিতাভ, আমাদের সঙ্গে এক ভয়াবহ ডার্ক ট্র্যাজেডি করে।

কিন্তু অকপট সেই সব কথা, যা আমি অমিতাভদাকে বলতাম, সেগুলো তো আবারও উচ্চারণ করতে পারি। ফলে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আমার বিবেচনায় আশি ও পরবর্তী কালখণ্ডের মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ছোটগল্পকার অমিতাভ পাল। তাঁর গল্পগ্রন্থ- `রাতপঞ্জি' ও 'অসচরাচর' এর অনন্য নিদর্শন। কিন্তু আমাদের সাহিত্যিক পরিমণ্ডল তাঁকে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দেয়নি। এক দীর্ঘ 'নীরবতার ষড়যন্ত্র' তাঁকে রেখে দিয়েছে আড়ালে। এর পেছনে অমিতাভ পালের স্বভাবজাত খারিজি আর ক্ষেপাটে মানসিকতাও প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। [কিন্তু এমন না হয়ে যে তিনি পারেন না! সত্যি বলতে, বামন সমাজের ওপর বিরক্তি থেকে তেমনটা করতে পারার মতো সৃজনীশক্তি, মেধা আর উচ্চতা তাঁর ছিল।] এই মানসিকতার কারণে অনেকেই অনিরাপত্তাবোধ, অস্বস্তিতে ভুগে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে গেছে, আর তিনি ক্রমে ক্রমে আরও বন্ধুহীন হয়ে পড়েছিলেন। সব মিলিয়ে জীবন, সাহিত্যসমাজ নিয়ে গভীর ক্ষোভ আর অভিমান জমাট হয়ে ছিল এ শিল্পীর মধ্যে।

ব্যক্তিত্বের ধরনের মতোই অমিতাভ পালের ছোটগল্পগুলোও ক্ষুরধার, শাণিত। একেবারেই ব্যতিক্রমী সব প্লট, আইডিয়া, চরিত্র সৃজন আর অনাস্বাদিত উপমান-উপমিতের মিথষ্ক্রিয়ায় নির্মিত তাঁর রত্নগর্ভ একেকটি গল্প। বয়ন আর সাইকিতে কিছুটা কাফকায়েস্ক রীতি অনুগামী হলেও গল্পকার হিসেবে শেষাবধি তিনি মৌলিকতার প্রত্যাশী। 

কবি অমিতাভ পালের বিদ্যুৎপ্রবাহী, পেশল, মগ্ন, অস্তিত্ব উন্মথিত ছোটগল্পগুলো বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে এক উজ্জ্বল সংযোজন। তিনি এমন একজন, যাঁকে নিয়ে অনায়াসেই আমরা গর্ব করতে পারি। লক্ষণীয় যে, যে কেউ অমিতাভ পালের টেক্সট নিয়ে কথা বলতে গেলেই তাঁর জীবনাচরণের প্রসঙ্গে চলে যান, এর মূল কারণ হলো অমিতাভের টেক্সট ও জীবনাচরণের মাঝে দ্বিচারিতা ছিল না। তাঁর জীবন ও সাহিত্যদর্শন ছিল একই। এই গুণ লেখক হিসেবে তাঁকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।

আধুনিক, অস্তিত্ববাদী, উৎকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির এক লেখক ছিলেন তিনি। তাঁর মানসকাঠামোতে বোদলেয়ারিয়ান ও কাফকায়েস্ক চিন্তাপদ্ধতির প্রভাব ছিল। এক নিরন্তর চিত্তবিক্ষেপ, উষ্মা ও বিদ্রূপের ভেতর দিয়ে অস্তিত্ববাদী উন্মূলতার স্বাদ নিয়েছিলেন তিনি। তবে তা উন্মূলতাই; কখনোই ছিন্নমূল নয়। আর সে কারণেই অস্তিত্বের অসহনীয় লঘুতা তাঁকে পলে পলে বিক্ষিপ্ত করত।

অমিতাভ পালের লেখায় যেমন আমরা এসব চিন্তারীতির প্রবাহ দেখতে পাব, একই সঙ্গে তা পাব তাঁর জীবনযাপন পদ্ধতির মাঝেও। ফলে, ব্যক্তি অমিতাভ পালও একটি টেক্সট আকারে হাজির হয় আমাদের সামনে। যে টেক্সটকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।

তো এই অমিতাভ পাল খেদের সঙ্গে সুহৃদদের বলতেন, তাঁর লেখাপত্র নিয়ে লিখতে, কথা বলতে। ব্যক্তিত্বের ধরনের সঙ্গে তাঁর এই প্রত্যাশা কি বিষম নয়? অবশ্যই বিষম হতো, যদি তাতে ন্যূনতম কাঙালপনা থাকত। কিন্তু, তা যে মোটেই ছিল না! চশমার ভেতরে থাকা চোখ তীক্ষ্ণ করে লিখতে বলার ভেতর দিয়ে তিনি আসলে আরেকটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতেন, যে পারলে লিখে দেখাও দেখি আমাকে কতটা ধারণ করতে পেরেছ! সেই চ্যালেঞ্জের ভেতর উদ্যত ছিল কসাইয়ের আরেকটা ছোরা, কেননা তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিল, দুর্বহ প্রাণের ভার তিনি যেভাবে বয়ে বেড়ান, চারপাশের আর কেউ ততটা গভীর ভার অনুভব করে না। ফলে তাঁকে মূল্যায়ন করতে যাওয়া যে কেউই ব্যর্থ হবে, আর তিনি বিদ্রূপের অট্টহাসিতে ফেটে ভর্ৎসনার ছোরা চালাবেন ওই ব্যক্তির ওপর, আর বলবেনকী? খুব তো বলছিলেন! এত সোজা না। হা হা হা

সত্য, সম্পর্ক, জীবন বা মৃত্যু নিয়ে এইভাবে খেলা করা এক শিল্পীর নাম অমিতাভ পাল। কোন সাহসে কেউ নিতে পারে তাঁর সেই চ্যালেঞ্জ!

অমিতাভ পাল জানতেন নিজের ব্যুৎপত্তির কথা। তিনি কাঙাল ছিলেন না। ছিলেন নিজের জগতের সত্যিকারের ঈশ্বর। আর ঈশ্বর চায় গ্রাহ্যতা পেতে। অমিতাভ পালও তাই চেয়েছিলেন। কেননা তিনি নিটশের জরথুস্ত্র নন। জরথুস্ত্র বলেছিলেন, আমাকে গ্রহণ করো না। প্রত্যাখ্যান করো। কেননা, তাই হবে আমাকে সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করা। অমিতাভ পাল, এমনটি চাননি। কারণ, তিনি নিরীশ্বর অস্তিত্ব ও আধুনিকতাবাদী। পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়েই তিনি নিজের গ্রাহ্যতাকে অনুভব করতে চেয়েছিলেন। তিনি অধিবিদ্যার লোক নন। কিন্তু আমরা তাঁকে সেই গ্রাহ্যতার স্বাদ অনুভব করাতে পারিনি। ফলে এক তুমুল বিক্ষোভ আর অভিমান জমাট বেঁধেছিল তাঁর মধ্যে।

তিনি তাঁর সমাজের ব্যাপারে যুগপৎ সংশয়ী ও আশাবাদী ছিলেন এই ভেবে যে, অন্তত কেউ কেউ হয়তো তাঁকে অনুধাবন করতে পারবে। কিন্তু না, তাঁর আশাবাদকে সাফল্যের সঙ্গে আমরা নস্যাৎ করতে পেরেছি। নৈরাশ্যের অতলে ডুবিয়ে দিতে পেরেছি তাঁকে। তাঁর অভিমানকে রূপান্তরিত হতে দিয়েছি চির-অভিমানে।

মৃত্যুর কয়েক দিন আগে কথা হয়েছিল অমিতাভদার সঙ্গে। জগৎ-সংসার আর সম্পর্কজনিত কারণে সে সময় চরম বিক্ষিপ্ত ছিলেন তিনি। সেদিন আলাপের শুরুতে হাসতে হাসতে সবকিছুকে তাচ্ছিল্য করতে থাকলেও একপর্যায়ে বালির বাঁধের মতন ভেঙে পড়েন জাঁদরেল অমিতাভ। মড়ার খুলিতে বাড়ি খাওয়া শ্মশানের হাওয়ার মতো হু হু আর্তিতে স্বগতোক্তির মতো বলতে থাকেন, আমি ঠইকা গেছি গা, হিজল। জীবন আমারে ঠকায়া দিয়া গেছে। আমি তো ধরা খাইয়া গেছি গা…’

এই ছিল অমিতাভ পালের সঙ্গে আমার শেষ কথোপকথন। জ্বরে পড়ে থাকায় সে সময় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হয়ে ওঠেনি। কথা ছিল সেরে ওঠার পর দেখা হবে। কোনো এক হেমন্তে মদের দোকানে বসে আমরা জীবন নিয়ে তুমুল খিস্তি করব। সে সুযোগ আর আসেনি। কিন্তু শেষ দিনের সেই কথাগুলোই জীবন নিয়ে অমিতাভ পালের চূড়ান্ত মূল্যায়ন হয়ে আমার কানে বেজে চলে। আমরা তো সবাই ধরা খাইয়া গেছি গা, অমিতাভদা

অমিতাভকে শ্মশানে পাঠিয়ে ভাঙা লন্ঠনের মতো আজও বেঁচে আছেন তাঁর মা। আমি কোন মুখে তাঁর সামনে গিয়ে বলব, কোন মুখে বলব যে, মা, আপনার ছেলে সত্যি সত্যিই অনেক বড় একজন লেখক