ব্যর্থ বিপ্লবের বেইমানদের খোঁজে...
বেশ্যার দালালেরা গ্রিক ট্র্যাজেডি লেখে না কেন—এ প্রশ্নবোধক নামেই আফসান চৌধুরীর একটি উপন্যাস আছে। এর একেবারে শেষে এসে অবশ্য নিজেই দিয়েছেন উত্তর। যেখানে চরিত্রের বয়ানে লিখছেন—‘আর আমি বেশ্যার দালাল, বেশ্যার দালালি করেও খেতে পারব না। আমাকে শেষ পর্যন্ত কেবলমাত্র জলিলের চাকর হয়ে থাকতে হবে। এই জন্য বলছি, বেশ্যার দালালদের আর যা-ই হোক গ্রিক ট্র্যাজেডি লেখা উচিত না।’
আফসান চৌধুরী গ্রিক ট্র্যাজেডি লেখেন না। তুলে ধরেন বাংলা-বাঙালির বিবর্তনের নানা অধ্যায়। মেলান ভারত-পাকি-বাংলার ভাগ-বিয়োগের নানা সমীকরণ। এর সবই করেন ইতিহাসকার হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, সমাজচিন্তক হিসেবে, রাষ্ট্রভাবুক হিসেবে। কিন্তু গবেষণায়, প্রবন্ধে, নিবন্ধে তো প্রাণ খুলে বলবার সুযোগ নেই। তাই কখনো-সখনো উপন্যাসে আশ্রয় নিয়ে থাকেন। সেখানে বিষয়ে-ভাষায় নিরীক্ষাপ্রবণতা ঔপন্যাসিক আফসান অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করতে পেরেছেন। তিনি বাক্য-শব্দ-বিবরণে, চরিত্র-দুশ্চরিত্র মিলিয়ে ভদ্রতার মুখোশ খুলে ফেলে সবকিছু উদোম করে দেখাতে চান। সমাজ-দেশ-রাষ্ট্র-রাজনীতির প্রকৃত চেহারা উন্মোচন করে দেন। সুশীল হাতে কলম নিয়ে মানুষকে দেবতা বা অবতার বানিয়ে দিতে রাজি নন। যে মানুষ যা, তাকে সেভাবেই চিত্রণ করেন কথাশিল্পী আফসান। তবে নিজেকে ফেরেশতা হিসেবে জাহির করার যে প্রবলতর প্রবণতা রয়েছে মানবমনে, তা নিয়ে বিদ্রূপ করার সুযোগ কখনোই ছাড়েন না। তাঁর উপন্যাস ‘বিশ্বাসঘাতকগণ’ থেকেই তা স্পষ্ট। আমাদের আলোচ্য আসলে এ বইখানি।
আফসান চৌধুরীর প্রথম উপন্যাস ‘বিশ্বাসঘাতকগণ’। সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার নামে একাত্তরের পরপরই স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বহারা, চরমপন্থার যে রাজনীতি, যে হঠকারিতা, যে আত্মঘাত—তা থেকেই কাহিনির জমিন গড়েছেন আফসান। তাঁর লক্ষ্য নরম বাম-খ্যাত সিপিবি ধারার দলগুলো নয়; তিনি লিখেছেন গরম বামদের নিয়ে। এমন ধারার গরম বাম কিন্তু মাঠঘাটে এখনো বর্তমান। তাই আশির দশকে লেখা উপন্যাসটি আজও সমান প্রাসঙ্গিক। গত পাঁচ দশকে ছদ্ম বাম রাজনীতির যে চর্চা, তা নিয়েই উপাখ্যান রচনা করেছেন আফসান চৌধুরী।
বিশ শতকের শুরু থেকে প্রথম ৫০ বছরে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন অনেকটাই বাস্তবিক ধারায় ছিল। তারপর তাতে মিশে যায় কল্পনা, বিমূর্ত, রোমাঞ্চ—এমন নানা উপকরণ। পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশকে সে ঝাপটা লেগেছিল পৃথিবীজোড়া। প্রথমত বিপ্লবের পথ ধরে চীনে মাওবাদীদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার সাফল্য তখন সামনে। দ্বিতীয়ত, তার কয়েক বছরের মাথায় লাতিন আমেরিকায় চে গেভারার রাজনীতি, সংগ্রাম আর আত্মদান। এতে লাখ লাখ তরুণ মন আলোড়িত হয়। আগপাছ না ভেবে তাদের অনেকেই তাই দলে দলে লাল পতাকা হাতে মাঠে চলে আসে। ‘বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস’, ‘লাঙল যার জমি তার’, ‘দেশের মুক্তির পর, মানুষের মুক্তি’—এসব স্লোগানে আকৃষ্ট হয় মেধাবী যুবা; জীবনে রোমাঞ্চের দেখা পায় বিত্তবানের সন্তান। অন্যদিকে অভাবতাড়িতরা তো অনেক সহজেই স্বপ্নবান হয় সাম্যবাদের ডাকে।
পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশে তা আরও গতি দেয় পশ্চিম-বাংলার চারু মজুমদারের নকশাল আন্দোলন। এমনকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘর পোড়ার দগ্ধ সময়েও আলু পোড়া দেওয়ার মতো করে তৎপর হয় একটি গোষ্ঠী। একাত্তরের পরে এই বাংলায় তারা আরও সক্রিয় হয়। সেই সময় চিত্র নিয়েই আফসান চৌধুরীর উপন্যাস ‘বিশ্বাসঘাতকগণ’।
বাংলাদেশে চরমপন্থার যে রাজনীতি সেখানে দেখা যায়—গ্রামগঞ্জের সামন্তপ্রভু, জোতদার, তালুকদারদের সম্পদ কেড়ে নিয়ে গরিবের দুয়ারে বিলি-বণ্টনের চেষ্টা। তাই কৃষক, শ্রমিকেরা তত্ত্ব নয়; প্রাপ্তিতে মত্ত হয়ে গরম বামদের সাথী হয়ে যায়। তত্ত্ববাগীশেরা মাও সেতুংয়ের মতো করে গ্রামের পর গ্রাম সাম্যবাদের মশাল জ্বেলে শহরের পুঁজিবাদ বিতাড়ন করবেন, কেন্দ্র নিজেদের অধিকারে নেবেন—এজাতীয় চেতনায় রোমাঞ্চিত করেন শহরের কবি-কবিভাবনার তরুণদেরও। তারা নিজেদের দেহ মিলিয়ে দেয় পার্টির দেহে। যেখানে ব্যক্তির কোনো জীবন নাই, পরিবার নাই, ঘর নাই—সোজা কথা সমষ্টির চিন্তাই সবকিছু। তাই পার্টির কথায় সহজেই কেউ ত্যাগ করে গৃহ, কেউ ছাড়ে পরিবার, কেউ আর যায় না খেতখামারে, কেউ আর মাড়ায় না বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা। চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য—কিছুই আর টানে না তাদের। তারা যেন বা পরিণত হয় লোহায়। কেবল সাম্যবাদ নামের চুম্বক টেনে নিয়ে যায় তাদের। বেলা গড়ায়, দিন যায়, পার্টি বড় হয়। কিন্তু একদা দেখা যায় বিপত্তি—কেউ আর কর্মী হয়ে থাকতে চান না। নিজেই হতে চান নেতা।
এতে দল ভেঙে ভেঙে টুকরো হতে থাকে। দলের নামের ডানে প্রথম বন্ধনীতে নিজের নাম নিতে উৎসাহ তবু বাড়ে বৈ কমে না। কিন্তু যত মত, তত পথও মেনে নিতে রাজি থাকেন না কেউ। নিজেরাই দলে-উপদলে দ্বন্দ্বে-সংঘাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পুঁজিতন্ত্র, গণতন্ত্র হটানোর কারবার পেছনে পড়ে যায়। মরণঘাতী আত্মকলহ দেখে অনেকেই ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে যায়। তাদের কেউ কেউ ঘরে ফিরে আসে। কারও কারও সেই সৌভাগ্য হয় না। সাম্যবাদী বন্ধু বা শত্রুর হাতেই খতম হয়ে যায় তারা। অন্যদিকে নেতাদের কেউ কেউ ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দোস্তি পাতায়, সন্ধিতে সই করে এমপি-মন্ত্রী হওয়ার পথ বেছে নেয়। যাদের কপাল আরও খারাপ রাষ্ট্র আর জোতদারদের পাল্টা আঘাতে তাদের থাকতে হয় ফেরারি হয়েই। অতঃপর ঝড় থেমে গেলে, শান্ত হলে চরাচর, কেউ কেউ হতে পারেন এনজিওবাজ।
ব্যর্থ সাম্যবাদী আন্দোলনের কারণে যার হওয়ার কথা ছিল বুয়েট পাস ইঞ্জিনিয়ার, তিনি হন মোটর-মেকানিক। আবার এমন একটা গোষ্ঠীও থাকে পুরানো চরমপন্থার লুটের চর্চা ধরে রেখে ডাকাতিকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। এভাবে তারা পুরোনো মাঠেও থাকে আবার সংসারেও ফিরে। আর গ্রামের সেই গরিব-গুবরারা, ভুখার দল—যারা অভাব মোচনের স্বপ্ন নিয়ে গিয়েছিল রক্ত-পতাকার মিছিলে তারা অভিশপ্তের মতো অপাঙ্ক্তেয় হয়ে বাকি জীবন ধুঁকে ধুঁকে কাটায়। হয়তো নিজেরাও জানে না কত বড় বিশ্বাসঘাতকতার ভুক্তভোগী তারা। যারা বুঝতে পারে কাগুজে বয়ান আর বাস্তবতার ফারাক, বুঝতে পারে নেতাদের বেইমানি—তাদের মাথা এসব সহ্য করতে পারে না। তারা হয়ে ওঠে আধাআধি বা সম্পূর্ণ পাগল।
আমরা জানি, কবিতায় কল্পনা থাকে। বিজ্ঞান বাস্তবতায় ভরপুর। কবি ও বৈজ্ঞানিকের তফাত এখানেই। ঔপন্যাসিক আফসান যেন বিজ্ঞানের পথেই থাকতে চেয়েছেন। কাহিনির ছলে তিনি আসলে উগ্র বা চরমপন্থার বাম রাজনীতির নামে যে বেইমানি বহমান ছিল, তার তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরেছেন। তৃণমূলের চারণ অথচ সার্থক নাগরিক এই গবেষকের প্রতিফলন আছে তাঁর কথাসাহিত্যেও। বিষয়-ভাষণ-ভূমি সার্থকতা পেয়েছে আফসানের ভাষার যে শৈলী, তা কাহিনির সঙ্গে জুতসই হওয়ার কারণে। শব্দে-বাক্যে-অনুপ্রাসে ছড়িয়ে ছড়িয়ে আছে সূক্ষ্ম রসবোধ, সুতীক্ষ্ণ খোঁচা। আর আছে মন ভার করা হাহাকার। আফসান জানেন যথেষ্ট প্রহসনও। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় তাঁর বিশেষ দখল থাকায় সেটা আরও সুতীব্র হয়ে ওঠে। যা বাঙালি পাঠকদের বুঝে উঠতে খানিক সময় ব্যয় করা লাগে।
আফসানের বয়ানে ‘বিশ্বাসঘাতকগণ’ পাঠে দেশ-সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির এক উত্তেজনাভরা সময় পরিক্রমণ করতে পারবেন সমঝদার পাঠক। যার নায়ক-প্রতিনায়ক-খলনায়ক জলিল, গাজী, পাটোয়ারি, সামাদ, রহমান, শফিক, নেওয়াজ—জানা-অজানা আরও কত না নাম! এসব চরিত্র বাস্তবেই ছিল, কেউ কেউ বর্তমান ভিন্ন ভিন্ন নামে। তাদের কিন্তু সবাই চিনবেন, জানবেন। যাদের অনেকেই হালের পুঁজিবাদে পূজা দিয়ে যাচ্ছেন সামনের সারিতে থেকেই। সাম্যবাদের সব স্বপ্ন অনেক আগেই গঙ্গার বদলে বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে ভোগের নীতিতে শামিল হয়েছেন তারা।
গত ১০০ বছরে বাংলায় মার্কসবাদের স্বপ্নভরা সাম্যবাদী সাহিত্য কম মেলেনি। সেখানে ঝলমলে এক নাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর রচনা পদ্মা নদীর মাঝি’র একেবারে শেষটা দিয়ে শুরু হয়েছিল বাংলা ভাষার মার্কসবাদী সাহিত্যের নতুন এক দিগন্ত। যেখানে তিনি লিখেছেন—
‘কপিলা আর কথা বলে না। ঘাটের খানিক তফাতে হোসেনের প্রকাণ্ড নৌকাটি নোঙর করা ছিল। একজন মাঝি ঘুমাইয়া ছিল নৌকায়। তাকে ডাকিয়া তুলিলে সে নৌকা তীরে ভিড়াইল। কুবের নীরবে নৌকায় উঠিয়া গেল। সঙ্গে গেল কপিলা।
ছইয়ের মধ্যে গিয়া সে বসিল। কুবেরকে ডাকিয়া বলিল, আমারে নিবা মাঝি লগে? হ, কপিলা চলুক সঙ্গে। একা অতদূরে কুবের পাড়ি দিতে পারবে না।’
মানিকের মার্কসবাদের যেখানে সূচনা, সেখানে ঠিক বিপরীতে আফসানের মাওবাদী উপন্যাস। বাংলায় বামধারার সমাপনী যেন টেনে দিয়েছেন তিনি। বুঝতে হলে ‘বিশ্বাসঘাতকগণ’ পাঠ করতে হবে একেবারে শেষ পাতে বসে। যেখানে বিবরণ এমন—
‘এখন তার নদী ভালো লাগছে। এখন নৌকার দোলা ভালো লাগছে। এখন ঘরে যাবার কথা ভাবতে ভালো লাগছে। এখন সে যাবে, তারপর ফয়সালা হবে। যদি না হয় তাহলেও যাবে। এ বছর যদি না হয়, আগামীতে যদি না হয়, কোনো দিন যদি না হয় তাহলেও যাবে। তার করার কিছুই নেই। সে, তারা, যাবেই। যাবে, নদীর মতো যাবে।’
মানিক আর আফসানে তফাত এক জায়গায়। বাংলার ঘরে ঘরে যেভাবে পদ্মা নদীর মাঝি পৌঁছে গেছে, বিশ্বাসঘাতকগণ তার সিকি ভাগও যায়নি। তবে রচনার তিন দশক পর এসে নতুন সংস্করণ এসেছে। যাতে এই উপন্যাস আস্বাদন করতে পারছে ফেসবুক-কালের পাঠকেরা। তবে এক জায়গায় এসে খটকা লাগতে পারে তাদের। চরমপন্থার বাম রাজনীতিতে প্রাণসংহার বেশি, যেটা নরমপন্থায় তুলনামূলক কম। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক সাম্যবাদী দলগুলোও ভাঙনে-বিভাজনে এক ডিগ্রি বেশি ছাড়া কম নয়। তারাও সেভাবে পারেনি তৃণমূলে সংগঠনকে নিয়ে যেতে। হতে পারেনি গণমুখী দল। তাদের অনেক নেতাও পুঁজিতান্ত্রিক দলে ভিড়ে ক্ষমতার স্বাদ নিয়েছেন। বাংলাদেশের মার্কসবাদীদেরও এসব বৈপরীত্য কেন? বিশ্বাসঘাতকগণ দিতে পারবে না এর উত্তর। তাই সমাধান পেতে এই সময়ে এসে লেখা আফসানের আরেক উপন্যাস ‘লাশের ব্যবসার চালচিত্র থেকে একটি বাক্য ধার নিতে পারি; যা হুবহু তুলে ধরছি—‘ক্ষুধা আর আহার যমজ ভাই তাই তারা দু’জনাই আসে ভিক্ষা আর ভরা পেটের লোভে।’ তাই মার্কসবাদ ও মাওবাদকে যমজ ধরে নেওয়া যায়। সেভাবে ‘বিশ্বাসঘাতকগণ’ অবশ্যই প্রত্যক্ষ চরমপন্থার কাহিনি, তা পরোক্ষে নরমপন্থার বামেরও উপাখ্যান। কারণ, বাংলাদেশে দুই পন্থার নেতারাই যে ইতিহাসে এখন অবধি ব্যর্থ বিপ্লবী!