রোমাঞ্চকর সিকিমের মায়া-মমতায়
দিনের বেলায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, চারদিকে আঁধার করে আসা ঘন জঙ্গলের ঠাসবুনট। একটা গাছ আরেকটা গাছের ডাল পাতার সাথে বিনুনি বেঁধে আছে। আচ্ছা, ঝিঁঝিঁ পোকা কি দিনের বেলায় ডাকে? বাংলার কোনো মুলুকে তো এমন শুনিনি। তার ওপর আবার পাহাড়ি জঙ্গল, বেশ একটা রোমাঞ্চকর পরিস্থিতি। তার চেয়েও বিস্ময়কর হলো এই পাহাড়ের গায়ে মণিমুক্তা আটকে আছে। বানিয়ে বানিয়ে নয়, সত্যি। পাহাড়ে চড়ে যেতে হবে আমাকে রাজপ্রাসাদে, একসময়কার সিকিমের রাজার সবচেয়ে পুরোনো অক্ষত রাজপ্রাসাদ। কিন্তু প্রাসাদে যেতে হলে এই মণিমুক্তার পথ পেরোতে হবেই। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে ট্রেক করতে করতে পায়ের নিচে মাদার অব পার্লের মতো চকচকে, দাগ কাটা পাথরখণ্ডের গায়ে পা দিয়ে তবেই চলতে হবে। কী পাথর এগুলো, তা-ও জানি না। ভারতের সিকিম রাজ্যের পাহাড়ে এত এত মণিমুক্তা লুকিয়ে আছে জানলে কয়েকটা ট্রাক সাথে করে নিয়ে আসতাম।
একেকটা গাছে শেওলা জমে পুরু হয়ে গেছে, সবুজ মখমল কাপড়ে বেশ একটা জামার মতো হয়েছে। এ রাজ্যে সারা বছরই ঠান্ডা থাকে। সবে শিলিগুড়ি থেকে এসেছি, বেশ গরম ছিল সেখানে। আর বাংলা থেকে এই এত দূরেও একটা গাছ জুড়ে স্বর্ণলতার ঝোপ দেখে মনে হলো, বনের মধ্যে কেউ গা ভরতি গয়না পরে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নাড়িয়ে ডাকছে। নাকের নোলক কাঁপছে তিরতির করে, কানের দুলের ঝিকিমিকিতে ঝলসে যাচ্ছে বনাঞ্চল। রূপ তো আসলে আগলে রাখতে হয়, হুট করে এই জনমানবহীন জঙ্গলের পথে এসে পড়লে তবেই না দেখা হয় দু’চোখ মেলে। চোখের জনমভর অপেক্ষা হয় সার্থক।
এই বনে কত নাম জানা, না জানা গাছ আছে, সব গাছ আমি চিনি না। সবচেয়ে পরিচিত দুটো গাছ হলো দেবদারু আর ওক। এই জঙ্গলের কোনায় কোনায় বিভিন্ন রঙের অর্কিড ফুটে আছে, গায়ে শিশিরের মতো বৃষ্টির জল চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে৷ অনেক অনেক বছর ধরে আঁকড়ে আছে বনভূমিকে। হাইড্রেনজা ফুল দেখে তো আঁতকে উঠেছি। আমরা একে বিদেশি দামি ফুল হিসেবে চিনি আর সে কিনা সিকিমের পথেঘাটে আমাদের আকন্দ ফুলের মতো ছড়িয়ে আছে। রডোডেনড্রন ফুলকে লুকিয়ে রাখাই যায় না। চারদিক উজ্জ্বল লাল, গোলাপি আভা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে। ফুসিয়া ফুলকে আমার ঝুমকোলতা বলতে ইচ্ছে করে, জেরেনিয়ামকে ফুটতে দেখেছি শৌখিন বাগানে, এখন এখানে প্রকৃতির কোলে। এত ফুল, এত ফুলের মর্যাদা দেবার দায় প্রকৃতিকেই মানায়। ঘরে, বাগানে, ছাদে নয়। ফুটে উঠলে বনের হাসি হয়, ঝরে পড়লে গাছের নিচে আসন পাতে। আমাদের শহুরে শো অফের মতো প্রথমে ফুলদানিতে তারপর আস্তাকুঁড়ে নয়।
তাই যে, দিনরজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে।
পেমাইয়াংতসে মনাস্টেরি © ছবি: লেখক
এবারে সিকিম আসার গল্পটা অন্য ভ্রমণের মতো নয়। ডুয়ার্স থেকে ফেরার পথে ভাবলাম সান্দাকফু যাই। দার্জিলিং হয়ে যেতে হবে। দার্জিলিংয়ে নেমে শুনি সান্দাকফুর রাস্তা বন্ধ, আবহাওয়া খারাপ। কোনো ভ্রমণার্থী যাচ্ছে না। কোনো গাড়িও যাচ্ছে না সেখানে। ভ্রমণে এমন সংবাদ শুনে আমি অভ্যস্ত। তাই পথ পরিবর্তন করতে একটুও অদ্ভুত লাগে না। পথ সব সময়ই আমার জন্য বেঁধে দেয় বন্ধনহীন গ্রন্থি। পথ হারানোর মতো বিরল ঘটনা ঝোলায় নিয়ে ঘুরি বলে এযাত্রায় সান্দাকফু ট্রেক আমায় সইতে পারল না। হাতে চার দিন সময়, ফিরে যেতেও ইচ্ছে করছিল না ডেরায়।
তাই সোজা চলে এলুম পেলিং। সিকিমের ছিমছাম, প্রায় জনমানবহীন ছোট একটা শহর। সকালে শেয়ার ট্যাক্সিতে চড়ে মন চলল পেলিং নগরী। সিকিমের অন্যান্য জায়গায় বেড়ালেও পেলিং আগে আসা হয়নি। পথের বাঁকে বাঁকে চা-বাগান, পাহাড়ি সবুজ খাদ, নেপালি মানুষের মনের কোমলতা—সব কিছুই পেলিংয়ে আছে। গাঢ় নীল আকাশের সাথে পাল্লা দিয়ে পথে বাড়ছে চা-বাগান আর বনভূমির আকুলতা। সুনসান পথে মিলতে পারে কয়েক দশক আগে কবির ঝরে পড়া কিছু পঙ্ক্তি। একটু শীতল হাওয়া, একটু উষ্ণতা, একটু পাহাড়ের গন্ধ—সবকিছু মিলিয়ে একটা আগাম নির্মল আনন্দ আমাকে ডাকে। পেলিং পৌঁছালাম বিকেল চারটায়। ঝেঁপে বৃষ্টি এসেছে। আগে থেকে অনলাইনে যে হোটেলে বুকিং দেওয়া ছিল, তার সামনে ট্যাক্সি আমাকে নামিয়ে উধাও হয়ে গেল। এখন চারপাশে সুনসান নীরবতা, সামনে-পেছনে সবুজ পাহাড় আর একমাত্র ভবন বলতে হোটেলটা। অনেক ডাকাডাকি করেও হোটেলের কাউকে পেলাম না। আশপাশে কিচ্ছুটি নেই, একটা ছোট মদের দোকান ছাড়া। আমার হাঁকাহাঁকিতে মদের দোকান থেকে দোকানি এসে হোটেল মালিককে মোবাইলে কল করল। কথা বলে জানলাম হোটেল বন্ধ এবং আগামী এক সপ্তাহে খুলছে না, এখন অফ সিজন, কোনো ট্যুরিস্ট নেই। এ তো মহা জ্বালা, থাকব কোথায়, মদের দোকানে?
বাইরে এখন টিপটিপ বৃষ্টি। পাহাড়ি এলাকা কখন মেঘ, কখন বাদল ঝরাবে কেউ জানে না। মদের দোকানি তখন বলল, ‘আপনি খানিক এগিয়ে একটি নির্মাণাধীন ভবন পাবেন, সেটা হোটেল ছিল। তাদের জিজ্ঞেস করুন যদি রুম পাওয়া যায়।’
সে জায়গা অবধি যেতে যেতে কোনো মানুষের দেখা পেলাম না। সেখানেও বিস্তর ডাকাডাকি করার পর একজন নারী বেরিয়ে এলেন। বললেন, ‘হোটেল তো বন্ধ, আমরা রেনোভেশনের কাজ করছি।’
আমি বললাম, ‘আমি কিছু জানি না, যেহেতু এটা হোটেল আর রুম আছে, অতএব একটা রুম আমাকে দাও। দেখছ না বৃষ্টি শুরু হয়েছে, আর পুরোই ভিজে গিয়েছি। এখন এখান থেকে আমি আর কোথাও নড়ছি না।’
আমাকে দোতলায় একটা রুম দেওয়া হলো, খুব যত্ন করে পরিষ্কার করে গুছিয়ে দেওয়া হলো। খাবার চা-কফি—সবকিছুরই ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো।
আশপাশে জনমানুষের চিহ্নহীন, সবুজ পাহাড়ে ঘেরা, বনভূমির মাতাল ঘ্রাণ, কখনো মেঘ, কখনো বৃষ্টি আর সম্পূর্ণ একা একটা হোটেলে রাজার হালে চার দিন থাকার চেয়ে বড় রিল্যাক্সেশন আর হয় না। যে পাশে মেঘ ডাকে ছুটে যাও, যে পাশ দিয়ে বুনো হাওয়া ছড়ায় ফুলের গন্ধ, সে পাশেই বসে থাক দিনভর।
হোটেল মালিক, মহানুভব নারীর নাম ইয়াংডেন, স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক। প্রথম দিন আমার মতোই আমি ছিলাম, দ্বিতীয় দিন থেকে সন্ধ্যা হলেই ইয়াংডেন চলে আসত আড্ডা দিতে আমার রুমে। ইয়াংডেন স্বামী আর দুই সন্তান নিয়ে হোটেলের নিচতলায় থাকে। ফুটফরমাশ খাটার জন্য ১৪/১৫ বছরের একটা ছেলে আছে, সানি। সেই আমাকে এটাসেটা এগিয়ে দেয়।
রাবদেন্তসে প্রাসাদ প্রাঙ্গণ © ছবি: লেখক
পেলিং এলে সাধারণ ট্যুরিস্ট যায় স্কাই ওয়াক বা হেলি প্যাড দেখতে। এসবে আমার একটুও মন টানে না। আমি জানি আমাকে কোথায় যেতে হবে। সিকিম রাজ্যের প্রথম রাজপ্রাসাদ ছিল ইয়াকসামে। এখন রাজপ্রাসাদের অবশিষ্টাংশ বলে কিছুই আর নেই। এর আটাশ বছর পর যে রাজপ্রাসাদটি পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত হয়েছে, তার নাম ‘রাবদেন্তসে’। আমি এখন যেদিকে যাচ্ছি। রাবদান্তসে রাজপ্রাসাদ নির্মাণের সাথে সাথে সিকিমের রাজধানীও সরিয়ে আনা হয় এখানে। যেহেতু ইয়াকসাম আগেই দেখে ফেলেছি, তাই রাবদেন্তসে আমায় হাতছানি দিচ্ছে। সিকিমের নির্জন পরিবেশ আমার খুব প্রিয়। পাহাড়ের গায়ে গা লাগিয়ে দু-একটা বাড়িঘর আর অবারিত সবুজ পাহাড়ের ঢেউ খেলানো লহরি দেখার জন্যই বারবার চলে আসি। কখনো সাদা মেঘ ঢেকে দেয় পাহাড়ের সূক্ষ্ম গয়নাগুলো, আবার বেশ আয়েশে সূর্যস্নান করায় পাহাড়কে, সবই মেঘের উদার ইচ্ছা, শখ। শখ কি আমারও কম! আমি শখের পাল্লায় পড়ে কোথায় কোথায় যে চলে যাই! আর মনের বাঁধন নেই বলে মন কখন কোথায় কোথায়, ছুটে বেড়ায় আর সেই ছুটে চলা মনের পিছু পিছু আমিও ছুটি গন্তব্যের সুগন্ধ মাখতে।
এখন যেমন পাহাড়ে চড়ছি রাজপ্রাসাদ দেখব বলে। সাধারণ ট্যুরিস্ট আসে না বলে পাহাড়ের পথটা একদম সুনসান, নিজের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। সবে একপশলা ঝরিয়েছে মেঘ। বনানীতে সতেজতা আর আমার মনে গুনগুন করছে মেঘের সাথে গল্পের রেশ।
পাহাড়ি এলাকায় আমার সবচেয়ে পছন্দনীয় হলো পথ, সরু এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া পথ। কখনো পথে ওপরে বা নিচে চলার জন্য সিঁড়ির মতো মাটির ধাপ করা থাকে। আর সেই সিঁড়িতে বাস করে গোড়ালি ডোবানো সবুজ ঘাস, আমার পা ধুয়ে দেয় মমতায়।
শেওলায় ঢেকে যাওয়া গাছে গুঁড়ি, ঘন বুননের পাতাদের রাজত্বের মাঝ দিয়ে চলতে চলতে একসময় ঠিকই এই পাহাড় আর মেঘ আমায় নিয়ে যায় রাজবাড়ির সদর দরজায়। সেখানে এই প্রথম কোনো মানুষ দেখলাম এই পাহাড়ে। সিকিমের একটি পরিবার। পাহাড় চড়ার ক্লান্তি ঝরিয়ে নিচ্ছে একটু বিশ্রাম করে। দাদা, দাদি, বাবা, মায়ের সাথে এসেছে তিন বছর বয়সী ছোট্ট সাং। যেখানে দেয়ালের মতো ঢালু জায়গায় রাবদেন্তসের ইতিহাস লেখা আছে সেই জায়গায় মনের আনন্দে হাতের খেলনা গাড়ি চালাচ্ছে। ইতিহাস তো এই শিশুই গড়বে, হয়তোবা অন্য কোনো রাজার বেশে।
পাশে রাজবাড়ির বয়সী একটা স্তপা। দেয়ালের পলেস্তারা খসে গেছে। ঘাস জন্মেছে গায়ে।
এসব পাশ কাটিয়ে চললাম রাজবাড়ি দেখতে। এখনো খানিকটা পথ বাকি। অবশ্য রাজবাড়ির আঙিনা শুরু হতেই পাহাড়ি মৃত্তিকাময় পথ শেষ হয়ে গেল, শুরু হলো পাকা পথ। আর ওপরে ওঠার জন্য সিমেন্টে বাঁধানো সিঁড়ি।
রাবদেন্তসে প্রাসাদের স্তুপা © ছবি: লেখক
একদম ওপরে পাহাড়ের চূড়ায় অবারিত মেঘ, অবারিত ঘন সবুজ আর রাজবাড়ির ছাদহীন কয়েকটি দেয়াল। এদের পলেস্তারা নেই বলে হাহাকার করছে বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে। চারদিকে বাগান ঘিরে রেখেছে এই এক টুকরো রাজপ্রাসাদকে জাদুর কাঠি হয়ে। যেন ছুঁয়ে দিলেই এক্ষুনি প্রাণ পাবে রাজার প্রিয় আবাসন। খানিক এগোলে দোতলা ভবন, এখানেও একতলার পরে ছাদ নেই। তবে রাজপ্রাসাদের মধ্যমণি হয়ে এখনো আছে সাদা রঙের তিনটি স্তুপা। স্তুপা হলো কোনো সন্ত ব্যক্তির মৃত্যুর পর দেহ ভস্ম রাখার সৌধ, চৌকোনা অবয়ব যার কোনো দরজা-জানালা নেই, ভেতরে ঢোকারও ব্যবস্থা নেই। মাথার ওপরে দিকটা সরু বা ত্রিভুজাকৃতির।
স্তপার সামনে এখন কয়েকজন প্রার্থনা করছেন। স্তুপা নানা রঙের খাদা আর চেফান দিয়ে আবৃত। খাদা, চেফানে জংখা ভাষায় মন্ত্র লেখা।
১৬৭০ সালে সিকিমের দ্বিতীয় রাজা তেনসাং নামগিয়াল এই প্রাসাদটি এক দুর্গম স্থানে নির্মাণ করেন। শত্রুপক্ষের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই নাকি এমন ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
কালের সাথে পা মিলিয়ে চলতে চলতে একসময় রাজার প্রাসাদ হারিয়ে যায়, রাজা রানি রাজ্য হারায় আর পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকে, এই বিশাল উঁচু প্রাসাদ।
আর এই সবুজ উদ্যানেই রানি ঘুরে বেড়াতেন, মেঘের মনের সাথে লুকোচুরি খেলতেন আর রাজা মহা ব্যস্ত থাকলেও মেঘের মনের আনাগোনা ঠিকই মনে মনে মিলিয়ে নিতেন। কারণ, এখানে কখনো প্রাসাদের সারা শরীর ঝলমলিয়ে ওঠে সোনার আভায়, এক ইন্দ্রপুরীর মতো আবার কখন চঞ্চল মেঘ পুরোটাই নিজের শরীর দিয়ে ঢেকে দিয়ে এক আশ্চর্য খেলা খেলে। এই বনাঞ্চলের আনাচকানাচে ছড়িয়ে আছে পাখির গান আর ফুলের রূপ। আমি এই বনের বেশির ভাগ পাখি চিনি না। না চিনলেই-বা কী, একেক পাখির কন্ঠ ঠিক আলাদা করে পিছু পিছু ছুটে চলা যায়।
এ রকম একটা সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে যায় রাজার প্রাসাদে। কিন্তু আমার আশ মেটে না। পৃথিবীর এই উঁচু জগতের মায়ায় আচ্ছন্ন আমি। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু না হলে আমাকে ক্রেন দিয়েও নামানো সম্ভব ছিল না। শীতের দিনের বৃষ্টিতে তাই এক জায়গায় একটু ছাদ পেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এখান থেকে নামবার পথও একই। সেই ঘন জঙ্গলের গাঢ় হতে আসা মেঘের লুটোপুটি আর খানিক পথ আলো, খানিক আঁধারের মিলন খেলা।
আজ ঘুরে বেড়াবার জন্য একটা ট্যাক্সি বুক করেছিলাম। ট্যাক্সি নিয়ে চললাম এখানকার সবচেয়ে পুরোনো মনাস্টেরি দেখতে, পেমাইয়াংসে মনাস্টেরি। এই মনাস্টেরি বা মঠটি ১৬৪৭ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। লামা লাতসান চেম্পো নামে একজন বৌদ্ধ ধর্মযাজক মঠটি নির্মাণ করেছিলেন।
পেমাইয়াংতসে মনাস্টেরিতে আগত ভক্ত © ছবি: লেখক
মঠে যাবার পথে আমি দেখলাম, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জলপ্রপাত। পেলিংয়ের পথে বাঁকে বাঁকে জলপ্রপাত আর নদী। অনেক উঁচু সবুজ পাহাড় থেকে দীঘল কেশের মতো রূপালী জল আছড়ে পড়ছে বিশাল বিশাল পাথরের ওপর। চারদিকে সবুজ আর এর মাঝে রূপকথার রূপালী জলের আকুলতা সবুজের সাথে মিলেমিশে জীবন উদযাপনের। এই সবে যেন পাহাড়ি ঝরনা খোপা খুলে দিয়েছে আরেকটি ঘনঘটা বাঁধানোর আশায়। এক ভূমি থেকে আরও নিচের অদেখা জগতে বয়ে চলেছে প্রবল তালে, এক অমোঘ সঙ্গীতের নেশায়। বা এমনও হতে পারে, সমতলে কোনো সঙ্গীর সীমাহীন ডাকে সাড়া দিতে দিতে।
উত্তাল জলকে আরও নির্মল হতে দেখতে দেখতে একসময় পৌঁছে যাই মনাস্টেরির দোরগোড়ায়। বাইরে থেকে দেখতে অন্যান্য তিব্বতি ধাঁচের মনাস্টেরির মতো। সাদা দেয়াল আর ছাদের ওপর আরেকটি ছোট চারচালা সোনালি ছাদ। দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় তিব্বতি নকশার পেইন্টিং করা।
মনাস্টেরি আমার কাছে সব সময়ই অনেকগুলো রঙের মেলা আর শিল্পের অনন্য চর্চা বলে মনে হয়। এত সুন্দর নকশা করা থাকে দেয়ালে ছাদে থামে দরজা জানালায় যে সারা দিন লেগে যাবে শুধু নকশা দেখতেই। এই অসামান্য রাজকীয় কারুকাজ সময়ের সাথে ম্লান হয়ে যায়নি।
বাইরের বারান্দায় লাল থাম। এ মনাস্টেরির সব ভিক্ষুই কঠোর সাধনার পর ভিক্ষু হতে পেরেছেন। মনাস্টেরিতে প্রবেশ করার আগেই খয়েরি বসনে কয়েকজন খুদে ভিক্ষুর সাথে দেখা হয়ে গেল। মূল ভবনের প্রার্থনা ঘরে তখন জ্যেষ্ঠ ভিক্ষুদের প্রার্থনা চলছে। কাঠের মেঝের ওপর আসন পেতে একই সুরে মন্ত্রপাঠ করছেন। মাঝে মাঝে একজন ড্রামে একটা ঘা দিয়ে যাচ্ছেন, আরেকজন পিতলের ঘণ্টা বাজাচ্ছেন। কাছের গ্রাম থেকে চারজন ভক্ত এসে বসেছেন। আমিও বসে পড়লাম তাঁদের সাথে। মনাস্টেরির দেয়ালজুড়ে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর বিভিন্ন ইতিহাস আঁকা। নানান রঙের এই ইতিহাস প্রায় পাঁচ শ বছর ধরে ঠায় গল্প বলে যাচ্ছে, এতটুকু ক্লান্ত হয়নি।
ভক্তদের মাঝে দুজন নারী। দুজনই স্থানীয় পোশাক পরিহিত আর হাতে প্রেয়ার হুইল, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তারাও প্রার্থনার মন্ত্র পড়ছেন। এদের সাথে আসা পুরুষ ভদ্রলোক আমাকে এক মগ আগুন গরম চা আর কিছু নিমকি এগিয়ে দিলেন খাওয়ার জন্য। আতিথেয়তা আমি সব জায়গায় পেয়ে থাকি এবং এই শীত-বরষার দিনে চা নিমকিকে যে অবহেলা করবে, তার স্থান নির্ঘাত নরকে হবে। আর আমি কখনোই নরকে যেতে চাই না। আমার ডান পাশে এই প্রার্থনা ঘরের একদম শেষ প্রান্তে গৌতম বুদ্ধ আমায় দেখে মুচকি হাসলেন। তার গায়ের রং সোনালি। বেশ আসন করে বসে ভক্তদের প্রার্থনা শুনছেন আর উত্তরও কি দিচ্ছেন না? নিশ্চয়ই দিচ্ছেন।
খানিক পরে আমি উঠে পড়লাম। এই মনাস্টেরির পেছনে ভিক্ষুদের বাসভবন। এরা নিজেদের কাজ নিজেরাই করেন। কয়েকজন ভক্ত ভিক্ষুদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন। খুদে ভিক্ষুরা তা গ্রহণ করছেন। এই শীতেও বাচ্চাগুলো বেশ একটা হাতকাটা জামা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের জীবন কঠোর অনুশাসনে বাঁধা—সময়মতো খাওয়া, সময়মতো প্রার্থনা, ঘুম। এই অনুশাসন না থাকলে ভিক্ষুর অনন্যসাধারণ জীবন যাপন করা যায় না।
পেমাইয়াংতসে মনাস্টেরিতে লেখক © ছবি: লেখক
মনাস্টেরি থেকে বের হয়ে চললাম রিমবি নদী দেখতে। পাহাড়ি এলাকার নদী দেখার আনন্দ হলো অনেক উঁচু থেকে দেখতে এক রকম আবার নিচে নেমে আসলে অন্য রকম লাগে। রিমবির জন্ম হয়েছে পাহাড়ে, পাহাড়ি ঝর্নার গা বেয়ে নিচে নামতে শুরু করেছিল সে। পথে দেখা মিলেছে অনেকের সাথে কিন্তু সে এক জায়গায় আটকে থাকেনি। প্রতিবেশী গাছকে আশ্রয় দিয়েছে, মেঘের সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলেছে, বড় বড় পাহাড়ি পাথরকে পাশ কাটিয়ে পার হয়েছে, একটুও রাগ না করে, একটুও বিরক্ত না হয়ে সে মানুষের আরাধ্য হয়েছে। শুধু মেঘ থাকলেই কি পাহাড়ের চলে, অবাধ জলাধার ছাড়া আমাদের অন্নদান কে করবে!
পাহাড়ি সবুজের সাথে মিলিয়ে মাঝে মাঝে সবুজ পান্না রঙের হয়ে যায় রিনবির জল। তবে আমাদের দেশের মতো অত গভীর নয় এ নদী। স্রোতের টান আছে আর আছে মানুষের জন্য টান। অবলীলায় অবলম্বন হয়ে রয়।
কখনো দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয় পাখির ডানার মতো, কখনো পাহাড়ের সাথে অনুরাগে আছড়ে পড়ে পাহাড়ের গায়ে। পাহাড় আর নদীর ভালোবাসা চিরকালের।
সন্ধ্যা হওয়ার বেশি দেরি নেই। এখানে সন্ধ্যা হওয়া মানেই পথঘাট ফাঁকা, সবাই যে যার বাড়িতে চলে যায়। অবশ্য সারা দিনে ছয়-সাতজন মানুষ ছাড়া আর কাউকে দেখিনি এ পথে। এই নির্জন পাহাড়ি এলাকা ধীরে ধীরে আমায় বেঁধে ফেলেছে এক অদেখা, অজানা মমতায়। যেমন করে চারাগাছ আস্তে আস্তে মাটি আঁকড়ে মহীরুহ হয়ে যায়, তেমনি এই মায়ার টান।
আমায় হোটেলে ফিরতে হবে। হোটেলে বারান্দা থেকে খুব সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় দেখা যায়। অবশ্য ভাগ্যের হাতে তার চাবি। কারণ, মেঘে ঢাকা থাকে প্রায় সময়ই।
হোটেলে ফিরে দেখি ইয়াংডেন অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমার রুমে দুজনের জন্য চা নিয়ে এল। বড় শহরে থাকতে কেমন লাগে ওর জানার খুব ইচ্ছে। কিন্তু আমার যে এই বনজঙ্গলে ঘেরা ছোট পাহাড়ি শহর বা গ্রাম খুব ভালো লাগে, তা কে বোঝাবে ওকে।
আমার ভ্রমণকাহিনির বদলে শুনি ওর সিকিমের জীবনযাত্রার গল্প।
ফেরার দিন ইয়াংডেন স্কুলে যাবার আগে আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল, উপহার।
ইয়াংডেনের হোটেলে অনেক ভ্রমণার্থী থেকেছে কিন্তু বন্ধু নাকি শুধু আমাকেই মনে হয়েছে তার।
পথই আমার বন্ধু, পথেই মেলে বন্ধু।
অসাধারণ লেখনি আচ্ছন্ন করা,,
ATAUR Issa
নভেম্বর ০৩, ২০২১ ১১:৩৪