রাজস্থানের ঐশ্বর্য ভাণ্ডারে
রাও বিকাজির মাঝে মাঝে খুব অভিমান হয়। রাজবংশে এমন কেন নিয়ম থাকতে হবে যেখানে পরিবারের প্রথম পুত্রসন্তানই পরবর্তীকালে রাজার মুকুট পাবে আর কনিষ্ঠ ভ্রাতারা তাঁর আজ্ঞাবহ হয়ে থাকবে! পিতা মহারাজা রাও জোধা ইতিমধ্যেই বিশাল এক প্রাসাদ দুর্গ নির্মাণ করেছেন রাজস্থানে। নিজের নামে সে এলাকার নাম দিয়েছেন যোধপুর। রাথোর রাজাদের সব সময়ই কোনো না কোনো যুদ্ধবিগ্রহে দিন গুজরান করতে হয়। তাই রাজস্থানের প্রায় সব রাজার প্রাসাদ থাকে দুর্ভেদ্য দুর্গের ভেতরে। যুবরাজ রাও বিকাজি মহারাজার দ্বিতীয় পুত্রসন্তান। মান-অভিমানের পাল্লা ভারী হবার সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজে চলে যাবেন অনেক দূরে নিজেদের এক পরগনায়, যেখানে জনবসতি নেই। মরুভূমি, তাই নেই জলের ব্যবস্থা, নেই কোনো সুযোগ-সুবিধা। স্বাধীনচেতা যুবরাজ রাও বিকাজি চলে এলেন সেই মরু প্রান্তরে, ১৪৭২ সালে। ধীরে ধীরে গড়লেন নিজস্ব পরগনা আর নাম দিলেন ‘বিকানের’। এর প্রায় পাঁচ বছর পর ধীরে ধীরে নির্মাণ করলেন নিজস্ব দুর্গ। ভারতের রাজস্থানে সাধারণত দুর্গ নির্মিত হয় উঁচু পাহাড়ের ওপর, যাতে শত্রুপক্ষ সহজে আক্রমণ করতে না পারে। কিন্তু এই অনন্যসাধারণ দুর্গ নির্মিত হলো সমতলভূমিতে। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আজ অবধি এই দুর্গ কেউ দখল করতে পারেনি। শুধু এক দিনের জন্য দখল করেছিলেন সম্রাট বাবরের দ্বিতীয় পুত্র কামরান মির্জা, ১৫৩৪ সালে। এক দিনের মাথায় আবার তা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
রাও বিকাজি নিজের মতো একটি জনপদ গড়ে তুলেছিলেন। যেখানে মাইলের পর মাইল শুষ্ক মরুভূমি ছাড়া আর কিছুই ছিল না, সেখানে এখন গাছপালা আর মানুষের সমারোহ, সমৃদ্ধ জনপদ একটি।
বিকানের দুর্গ আমার ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় একেবারে প্রথমে। কারণ রাও বিকাজির মতো স্বাধীনচেতা মানুষ যে পিতার রাজ্যপাট পরিত্যাগ করে বিরান মরুভূমিতে নিজস্ব জায়গা করে একা টিকে থাকতে পেরেছিল, এর চেয়ে বড় সাহসিকতা আর হয় না।
বাইরে থেকে দুর্গটি দেখতে আর দশটা সাধারণ দুর্গের মতো, আগাগোড়া গোলাপি স্যান্ডস্টোনে তৈরি। এই পাথর কাছাকাছি জায়গায় পাওয়া যায় বলে ঘরবাড়ি বা প্রাসাদ দুর্গ নির্মাণের সময় এর ব্যবহার হয় অহরহ।
দুর্গ প্রাচীরের ভেতরে খোলা আকাশের নিচে স্থির দাঁড়িয়ে মোগল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত দুর্গ। বাইরে থেকে দেখতে খুব সাধারণ স্থাপত্য বলে মনে হয়। রাও বিকাজি এই দুর্গের নাম রেখেছিলেন ‘জুনাগড় দুর্গ’।
দুর্গের ভেতরে নিচতলায় বিশাল বিশাল কক্ষ, যেখানে রাজা বা যুবরাজ অতিথিদের স্বাগত জানাতেন। দ্বিতীয় তলার মাঝখানে খোলা ছাদ আর ছাদের মাঝখানে ছোট জলাধারের ঠিক মধ্যখানে মর্মর পাথরের ছাদসহ বেদি। এই তলা মূলত রাজাদের ব্যবহারের জন্য ছিল। এই খোলা ছাদে হোলির সময়ে রং খেলা হতো। এই তলায় গোলাপি স্যান্ডস্টোন আর ওপরের তলায় সাদা রং করা, পাথরের দেয়ালে খোদাই করা নানা নকশার ঝারোখা বা জালি। এই ঝারোখার ফোকরে চোখ রেখে রানি ও রাজকন্যারা নিচের খোলা ছাদে অনুষ্ঠান দেখত। কঠিন পর্দাপ্রথার কারণে রাজস্থানি রাজবংশের নারীদের কখনোই অপরিচিত বা আধা পরিচিত পুরুষদের সামনে আসার অনুমতি ছিল না। যেকোনো প্রাসাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা আমার কাছে মনে হয় ঝারোখা। এত রহস্যময়! এপাশের জন জানে না ওপাশে কে তার দিকে চোখ রাখছে, অথচ এমনও হতে পারে, হাসি গানে আনন্দের মাঝে কোনো না কোনো রাজকন্যার কাউকে ভালো লেগে গেল! রাজস্থান মানেই শিল্পকলা আর নারীদের পোশাকে, রঙে, ভারী গয়নায় বৈচিত্র্য। এমন বৈচিত্র্য পথেঘাটেও মেলে অগুনতি।
আমি বিকানে এসেছি ফলোদি নামের ছোট একটা গ্রাম থেকে লোকাল বাসে চেপে। আমার পাশে বসা রাজস্থানি নারীর গলা অবধি ঘোমটা টানা। খুব কৌতূহল হচ্ছিল মুখটা দেখার। হাত ভরতি চুড়ি একেবারে বাহুর ওপর অবধি। গলায় জমকালো রুপোর হার বুকের অনেকখানি নিচে নেমেছে। শুধু মুখটাই দেখতে পাচ্ছি না। রাজস্থান মানেই নারীর ঘাঘরায় লাল, কমলা, রানি গোলাপি রঙের ছড়াছড়ি সে যে বয়সেরই হোক না কেন। একসময় হাওয়ার তোড়ে অবগুণ্ঠন খুলে গেল। মুখটা মায়া মায়া। মাথায় রুপোর কয়েক গাছি টায়রা পরা। সিঁথি থেকে ছোট ছোট বিনুনি আঁটোসাঁটো বাঁধা। সেই ছোট ছোট বিনুনিতে আবার নানান রঙের পুঁথি, ফিতা আটকে আছে। রুপোর গয়নায় সারা অঙ্গ ঝলমল করছে। গাঁয়ের সাধারণ নারীর সাজসজ্জার বাহার দেখে অবাক হই, কে জানে রানিদের সাজসজ্জা তাহলে কেমন ছিল!
এসব ভাবতে ভাবতে আমি প্রাসাদের কামরাগুলোর দিকে মনোযোগ দিলাম।
ছাদের চারপাশে বিভিন্ন সময়ের শাসক রাজাদের কক্ষ। একই কক্ষ পিতার মৃত্যুর পর পুত্র ব্যবহার করতেন না। সবার আলাদা আলাদা কক্ষ ছিল। ষোলোজন রাজা এই প্রাসাদে থেকেছিলেন পর পর। এর মধ্যে সবচেয়ে জমকালো হলো রাজা কারন রাও-এর কক্ষ। একসময় রাজা এটি ব্যবহার করলেও পরবর্তীকালে কক্ষটি রাজতিলক অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করা হতো। কক্ষের মাঝখানে রাজসিংহাসন, যেটি রুপোর তৈরি। এই কক্ষের দেয়াল আগাগোড়া ফুল লতাপাতার মিনিয়েচার চিত্রকর্ম দিয়ে ঢাকা। সাদা দেয়ালের ওপর লাল, সোনালি, সবুজ, হলুদ রং দিয়ে আঁকা চিত্র। আমি সমস্ত রাজস্থান ঘুরে এমন সূক্ষ্ম চিত্রকর্ম আর কোনো প্রাসাদে দেখিনি। এই কক্ষের ভেতরের ছাদ আর দেয়াল ২২ ক্যারেট স্বর্ণের আবরণের নকশায় তৈরি। এই রাজকীয় জৌলুশ হারিয়ে যায়নি সময়ের সাথে সাথে, আরও ঝকমক করছে হাজার হাজার সূক্ষ্ম নকশায়। চোখ ভরে এই ঐশ্বর্য নিলেও যেন শেষ হয় না। একই মহলের এক কোনার দরজাটি রুপার। সমস্ত শরীরে রূপ আর শিল্পীর আদরের পরশ নিয়ে অসামান্য খোদাইচিত্র নির্ণিমেষ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
কারন মহল থেকে বের হলে আরেকটি খোলা ছাদ। এই ছাদের মেঝে নানা রঙের টাইলস দিয়ে মোড়া। এই ছাদে বসত বাইজিদের নাচের আসর। শুধু রাজা, মন্ত্রী বা তাদের বন্ধুবান্ধব নয়, ওপর তলায় স্যান্ডস্টোনের ঝারোখার ফোকরে চোখ রেখে রানি, রাজকন্যা আর তাদের সখীরাও এ নাচগান দেখতে পারতেন।
একই তলায় আরেকটি কক্ষ আমার খুব প্রিয়—বাদল মহল। আগাগোড়া নীল রঙে মোড়া। সারা কক্ষের দেয়াল ও ছাদে নীল আকাশের নানান মেঘ জমে আছে। আর মেঝের দিকের দেয়ালে নিচে বৃষ্টির ছটা এঁকে রাখা আছে। এই কক্ষ ব্যবহার করা হতো সংগীত সাধনার জন্য। মেঘের ঘরে বসে, বাদলের দিকে মুখ করে, বরষার মালহার গাইলে অভ্র কি চুপ করে থাকতে পারে! সাধকের সাথে সাথে ঝরিয়ে দেয় কয়েক পশলা এই মরুভূমিতে। আর দরজা খুললেই নাচমহলে নেচে উঠতে চাইবে তখন হাজার ঝংকারের নূপুর। বৃষ্টির শব্দ শোনার জন্য আর জলের ছটা মেঝেতে গড়িয়ে দেবার জন্য ছাদ থেকে তাম্র পাইপ নামিয়ে দেওয়া আছে মেঝে অবধি। খাটিয়ায় বসে শিল্পী গাইছেন রাগিণী আর মেঝে হয়ে যাচ্ছে বরষার জলে সরোবর। বরষার জলের রিমঝিম, তানপুরায় তাল আর কক্ষের ভেতরের নীল আবহাওয়া আমাকে মেঘের দেশে নিয়ে যায়। মরুভূমিতেও আমাকে ঘন বরষার সুখ চেনায়, লু হাওয়ায় আমার গায়ে স্নিগ্ধতা ছোঁয়ায়।
শুধু বাদল মহলের টানে আমি বারে বারে বিকানে আসি।
বাদল মহলের পরের মহলটি এ প্রাসাদের সবচেয়ে পুরোনো মহল—ফুল মহল। কারন মহলের মতো জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও এ মহলে থাকেন প্রাসাদের দেবতারা। পুজো-আচ্চা এ মহলের মূল সুর। দেয়ালে, ছাদে, দরজায় যথারীতি সূক্ষ্ম কারুকাজে চিত্রাঙ্কিত। প্রাসাদের সব দেয়ালের রং সাদা। অবশ্য চিত্রশিল্পের পর সাদা দেয়াল হয়ে যায় রঙিন পাখি, এ-ডালে ও-ডালে উড়ে উড়ে করে ডাকাডাকি। কারুকাজের সাথে সাথে ফুল মহলের কিছু দেয়াল মর্মর পাথর দিয়ে আবৃত। সেখানেও খোদাই সূক্ষ্ম কারুলতা।
ফুল মহলের পরেরটি অনুপ মহল। আমি বলি অনুপম মহল। এই নিরুপম মহল ছিল রাজার দরবার। মন্ত্রী বা বিদেশি অতিথিদের সাথে এ দরবারে বসতেন তিনি। নিচতলার কক্ষটিতে বসতেন জনসাধারণের সাথে দরবার করার সময়। তাই একে বলা হয় খাসমহল। এই মহলের আগাগোড়া স্বর্ণ আর ছোট-বড় আয়নায় মোড়া। দেখলেই মনে হয় ভারতবর্ষের যাবতীয় রাজকীয় ভাবনা জড়ো করে এই মহলের নকশা করা হয়েছে। স্বর্ণ আর লাল রঙে অঙ্কিত, নানান আরশি বসানো মহলে যখন ঝাড়বাতি জ্বলে উঠত, তখন সোনালি রোশনাই হয়ে যেত দ্বিগুণ। মহলের মাঝখানে লাল মখমলের তখতে বসে রাজা ভাবতেন রাজ্যের কথা, তার নিজের বীরত্বের গাথা।
মোগল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত বলে প্রতিটি মহলের দরজা আর স্তম্ভ মসজিদের মিহরাবের আদলে গড়া আর বাকি যাবতীয় চিত্রকর্ম ভারতীয়, মোগল ধারায় করা হয়েছে।
অনুপ মহলের রূপ সারা দিন বসে দেখেও শেষ করা যাবে না।
প্রাসাদের বেশির ভাগ দরজা আখরোট কাঠে তৈরি। কিছু দরজায় নানা রঙের সূক্ষ্ম চিত্রকর্ম করা, কিছু দরজা খোদাই করা। অনেক মহলে দরজাই নেই। সেখানে সারা বছরে রোদ, হাওয়া খেলে যায়।
এত এত রংমহলের ওপর তলার মহলে থাকতেন রাজা-রানিরা। অনুপ মহল বা কারন মহলের মতো জৌলুশ এই মহলগুলোতে বহাল রাখার সাথে সাথে রাখা হয়েছে পাথরের দেয়ালে খোদাই করা অগুনতি ঝারোখা। বেশির ভাগ মহলের দেয়ালে সূক্ষ্ম চিত্রকর্ম, সেই লাল লাল ফুল, সবুজ পাতা, সোনালি লতা। এক অদ্ভুত রাজকীয় আবহাওয়া। এই রাজোচিত সমারোহ আমি ভারতের অন্য কোনো প্রাসাদে দেখিনি।
ছাদ থেকে নিচের সবুজ বাগান অনেক দূর অবধি দেখা যায়। তারও ওপারে দুর্গের দেয়াল। দেয়ালের ওপাশে জমজমাট বিকানের শহর যেখানে দোকানে দোকানে বিক্রি হচ্ছে ভারত-বিখ্যাত বিকানের চানাচুর। জিলিপির কারিগর হাতের কেরামতিতে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ভাজছেন জিলিপি। এদিকের বাজারে রঙিন চুড়ি আর চুনরি কিনতে এসেছেন সুন্দরীরা। চায়ের দোকানে দিকরাদের অবসরযাপন। মারওয়ারি ভাষায় চলে গালগল্প। বিকেল হলো এখন, এখন অলস বেলা।
ছাদ থেকে একেবারে নিচতলায় চলে আসা যায়। নিচতলায় একটি মিউজিয়াম করা হয়েছে যেখানে রাজাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র রাখা আছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই যুদ্ধের হাতিয়ার। একটি ছোটখাটো প্রাইভেট প্লেনও আছে। মূল দরবার হল মিউজিয়ামের পাশে।
বিশাল দরবার হলটির দেয়ালে স্যান্ডস্টোনের ওপর লতাপাতা খোদাই করা। গোলাপি আভা ঠিকরে বেরোচ্ছে। মাঝখানে চন্দন কাঠের সিংহাসন যার বয়স প্রায় ৯০০ বছর। আমি কাছে গিয়ে খুশবু নিতে চাইছিলাম কিন্তু অত কাছে যাওয়া বারণ।
প্রাসাদ দুর্গ থেকে বের হতে হতে বিকেল গড়িয়ে পড়ল। দুর্গের স্যান্ডস্টোনের গায়ে সোনালি রং আসমান থেকে ছড়িয়ে পড়ছে। হাওয়াও একটু একটু শীতল হচ্ছে। দুর্গ প্রাঙ্গণের পাখিদের ঘরে ফেরার সময় হলো। সময় হলো আমারও অন্য কোনো গন্তব্যে যাবার।
তবে রাজস্থানের প্রত্যন্ত এলাকার এই অনন্যসাধারণ প্রাসাদ দুর্গ আমার চোখে বারে বারে যে ঘোর লাগিয়ে দেয়, সে ঘোর মেটে না। বারে বারে ফিরে আসতে হয় বাদল মহলে ঝিরিঝিরি শব্দের টানে, অনুপ মহলের শিল্পের মোহে।