কাঙাল হরিনাথের খোঁজে


কুষ্টিয়ায় বেড়াতে এসে আমরা সাধারণত রবীন্দ্র-কুঠিবাড়ি কিংবা লালনের আখড়া দেখে ফিরে আসি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এবং লালনের সমকালে আরও এক কীর্তিমান মানুষের জন্ম হয়েছে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি গ্রামে। তাঁর নাম কাঙাল হরিনাথ। হয়তো কেউ কেউ তাঁকে জানি। তবে নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি প্রায় অপরিচিত বললে অত্যুক্তি হবে না। তাঁর আসল নাম হরিনাথ মজুমদার। তবে কাঙাল হরিনাথ এবং ফিকির চাঁদ ছদ্মনামে বেশি পরিচিত।

সম্প্রতি একদিন বিকালে আমরা কয়েকজন বন্ধু খুঁজে বের করি তাঁর বসতবাড়ি। কুষ্টিয়া থেকে এখানকার দূরত্ব ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হবে হয়তো। কুমারখালী শহরের প্রায় কাছেই কুণ্ডুপাড়া। বন্ধু সোহেল কামরুল, তায়েফ উদ্দিন নয়ন, সাইফুল ইসলাম মিলন, শরীফুল ইসলাম, প্রসেনজিৎ এবং হেলালসহ বিকাল ৪টা নাগাদ সেখানে পৌঁছাই। প্রথমে যাই তাঁর বাস্তুভিটায়। আমাদের কথাবার্তার শব্দ পেয়ে একজন ভদ্রলোক ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। নাম দেবাশীষ মজুমদার। তিনি কাঙাল হরিনাথের পঞ্চম বংশধর স্বর্গীয় অশোক মজুমদারের ছোট ছেলে। জরাজীর্ণ মাটির ঘরে বসে তিনি হয়তো কিছু একটা করছিলেন। কাছে এসে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানালেন। নিজেই আগ্রহভরে ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছেন সবকিছু। দেয়ালে ঝোলানো ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকার জীর্ণদশা। ঘরের দেয়ালে এবং কাঠের দরজায় লেখা আছে ‘কাঙাল কুটির’। ভগ্নপ্রায় বাস্তুভিটা দেখে হতাশ হতে হয়। ইটগুলো খসে পড়ছে। দেয়াল ভাঙা। দরজা-জানালার অবস্থাও প্রায় একই। ধুলিমলিন দেয়াল ও মেঝে। ভাঙা ইটের ফাঁকে সুযোগ পেয়ে গজিয়েছে আগাছা। 

বাংলা পিডিয়ার তথ্যমতে, কাঙাল হরিনাথ [১৮৩৩—১৮৯৬] একাধারে সাংবাদিক, সাহিত্যিক এবং বাউল গান রচয়িতা। শৈশবে স্থানীয় ইংরেজি স্কুলে হরিনাথের লেখাপড়া শুরু হয়, কিন্তু আর্থিক কারণে তা বেশিদূর এগোয়নি। ১৮৫৫ সালে বন্ধুদের সহায়তায় তিনি নিজ গ্রামে একটি ভার্নাকুলার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামের সাধারণ লোকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশে সেখানে অবৈতনিক শিক্ষকতা শুরু করেন। পরের বছর তাঁরই সাহায্যে কৃষ্ণনাথ মজুমদার কুমারখালিতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।

গ্রামের সাধারণ মানুষের উন্নতির জন্য এবং তাদের শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে হরিনাথ সারাজীবন আন্দোলন করেছেন। অত্যাচারিত এবং অসহায় কৃষক সম্প্রদায়কে রক্ষার উদ্দেশে তিনি সাংবাদিকতা পেশা গ্রহণ করেন। প্রথমে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় লিখতেন। পরে ১৮৬৩ সালে নিজেই ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি পরে পাক্ষিক ও শেষে এক পয়সা মূল্যের সাপ্তাহিকে পরিণত হয়। এতে সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও কৃষকদের প্রতি তখনকার নীলকর ও জমিদারদের শোষণ-অত্যাচারের কথা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করা হতো। ফলে ব্রিটিশ সরকার এবং স্থানীয় জমিদারদের পক্ষ থেকে তাঁকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু তিনি নির্ভীকভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করে যান। এসব কারণে পত্রিকাটি তখন বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে।

দেয়ালে ঝোলানো ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকার জীর্ণদশা। ঘরের দেয়ালে এবং কাঠের দরজায় লেখা আছে ‘কাঙাল কুটির’। ভগ্নপ্রায় বাস্তুভিটা দেখে হতাশ হতে হয়। ইটগুলো খসে পড়ছে। দেয়াল ভাঙা। দরজা-জানালার অবস্থাও প্রায় একই। ধুলিমলিন দেয়াল ও মেঝে। ভাঙা ইটের ফাঁকে সুযোগ পেয়ে গজিয়েছে আগাছা...

হরিনাথের জীবনে কখনও সচ্ছলতা ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও পত্রিকা প্রকাশের সুবিধার্থে তিনি ১৮৭৩ সালে একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন। রাজশাহীর রাণী স্বর্ণকুমারী দেবীর অর্থানুকূল্যে দীর্ঘ ১৮ বছর পত্রিকা প্রকাশের পর আর্থিক কারণে এবং সরকারের মুদ্রণ বিধির কারণে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে হয়।

কাঙাল হরিনাথের গ্রামবার্ত্তা প্রবেশিকা। ছবি © ফারুক সুমন

হরিনাথ ছিলেন ফকির লালনের শিষ্য। তিনি অধ্যাত্মবাদ প্রচারের জন্য ১৮৮০ সালে ‘কাঙাল ফিকির চাঁদের দল’ নামে একটি বাউল দল গঠন করেন। বাউল গানের ক্ষেত্রে হরিনাথের অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি অসংখ্য বাউল গান রচনা করেন এবং সেগুলো খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সহজ ভাষায় ও সহজ সুরে গভীর ভাবোদ্দীপক গান রচনা করতেন এবং সেগুলো সদলে গেয়ে বেড়াতেন। গানে ‘কাঙাল’ নামে ভণিতা করতেন বলে এক সময় কাঙাল শব্দটি তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো, পার কর আমারে’ তাঁর একটি বিখ্যাত গান। ১২৯০—১৩০০ বঙ্গাব্দের মধ্যে তিনি কাঙাল ফিকির চাঁদ ফকিরের গীতাবলী নামে ১৬ খণ্ডে বাউল সঙ্গীত প্রকাশ করেন। হরিনাথ শুধু গানেই নয়, গদ্য ও পদ্য রচনায়ও পারদর্শী ছিলেন।

কাঙাল হরিনাথের লেখা গান আমরা এখনো মুগ্ধ হয়ে শুনি। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য কিছু গান:

১। ওহে [হরি] দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল, পার কর আমারে
২। দেখ ভাই জলের বুদ বুদ্, কিবা, অদ্ভুত, দুনিয়ার সব আজব খেলা
৩। যদি ডাকার মতন পরিতাম ডাক্ তে
৪। অরূপের রূপের ফাঁদে পড়ে কাঁদে, প্রাণ আমার দিবানিশি
৫। দিন ত ফুরায়ে গেল, সেদিন এল
৬। বচ্ছে ভবনদীর নিরবধি খরধার
৭। তাঁরে পাবিনে কখন ওরে মন, নাহি থিতালে
৮। অনন্ত রূপের সিন্ধু উঠলি উঠিল গো

সাহিত্যচর্চায় হরিনাথের শিষ্যদের মধ্যে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, দীনেন্দ্রনাথ রায় এবং  জলধর সেন পরে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। হরিনাথের মোট গ্রন্থ ১৮টি। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো বিজয়বসন্ত [১৮৫৯], চারুচরিত্র [১৮৬৩], কবিতাকৌমুদী [১৮৬৬], বিজয়া [১৮৬৯], কবিকল্প [১৮৭০], অক্রূর সংবাদ [১৮৭৩], সাবিত্রী নাটিকা [১৮৭৪], চিত্তচপলা [১৮৭৬], কাঙালের ব্রহ্মাণ্ডবেদ [১৮৮৭-৯৫], মাতৃমহিমা [১৮৯৬] ইত্যাদি। মৃত্যুর পর তাঁর রচনাসমগ্র হরিনাথ গ্রন্থাবলী [১৯০১] নামে প্রকাশিত হয়।

১৮৯৬ সালের ১৬ এপ্রিল তাঁর মৃত্যু হয়। কাঙাল হরিনাথের উত্তর প্রজন্ম দেবাশীষ মজুমদারের ভাষ্যমতে, কাঙাল হরিনাথের শেষ ইচ্ছে ছিল মৃত্যুর পরে তাঁকে যেন পুরোপুরি পোড়ানো না হয়। তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী হাতের কনিষ্ঠা, মাথার খুলি আর বাম পায়ের বুড়ো আঙুলের ছাইভস্ম নিজের পূজার ঘরে সমাহিত করা হয়। 

আমরা এবার ঘরে প্রবেশ করি। এই সেই ‘এম এন প্রেস’। যার সাহায্যে প্রকাশিত হয়েছিল কাঙাল হরিনাথ ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকা। তিনি এ পত্রিকার মাধ্যমে তৎকালীন ব্রিটিশ এবং জমিদারদের অন্যায়-অত্যাচারের খবর প্রকাশ করতেন। আমরা প্রেসের সাথে দাঁড়িয়ে ছবি তুলি। কীভাবে প্রেসটি চালানো হতো দেবাশীষ তা আমাদের দেখালেন। কাঙাল হরিনাথের সহস্তে লেখা গানের কাগজ আমাদের দেখালেন। এগুলো তারা সযত্নে ল্যামিনেট করে রেখেছেন। ঐতিহাসিক ছাপার যন্ত্র এম এন প্রেস, কিছু যন্ত্রাংশ, বাংলা টাইপ অক্ষর, ছবি ও পাণ্ডুলিপি ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তবে ঘরে ঢুকে মনে হয়েছে এটা যেন কোনো পরিত্যক্ত ভৌতিক বাড়ি। গুছিয়ে রাখা হয়নি তেমন। শুকনো পাতায় ধুলি জমেছে। মাকড়সাও স্বাধীনভাবে সেখানে জাল বুনেছে।

বসতবাড়ি দেখা শেষে আমরা এবার জাদুঘর দেখতে যাই। ১০ মিনিটের দূরত্বে জাদুঘরটির নাম—‘কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর’। প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত জাদুঘরটি বেশ নান্দনিক। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় জাদুঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশের সুযোগ পাইনি। উপস্থিত লোকজনের কাছে জেনেছি, এখানে ঐতিহাসিক ছাপার যন্ত্র এম এন প্রেসের মডেল, কিছু যন্ত্রাংশ, বাংলা টাইপ অক্ষর, ছবি ও কিছু পাণ্ডুলিপি কালের সাক্ষী হয়ে আছে। সাংবাদিক কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরের দুইতলা ভবনে ছোট-বড় ১৫টি কক্ষ। সামনে রয়েছে শানবাঁধানো মুক্তমঞ্চ এবং কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ভাস্কর্য। 

কথিত আছে যে, হরিনাথ মজুমদারের সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। থাকবেই-বা কেন। তিনি যে জমিদার কিংবা ব্রিটিশদের অন্যায়-অত্যাচারের সংবাদ লিখতেন। ঠাকুর বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলে ফকির লালনের সহযোগিতায় একাধিকবার সমঝোতা হয়। এভাবেই সচল থাকে এমএন প্রেস। ভালো লাগছে এই ভেবে, কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের মতো একজন বাউল সাধক, সাহিত্যিক, সাংবাদিকের স্মৃতিধন্য জায়গা আমরা ছুঁয়ে এসেছি। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।


সম্পাদকীয় নোট

তর্ক বাংলার ডাকবাক্সে প্রেরিত প্রথম রচনা এটি। ফারুক সুমনের লেখা কাঙাল হরিনাথের খোঁজে। লেখককে তর্ক বাংলার পক্ষ থেকে অভিনন্দন। লেখার ভাষা সরল, বয়ান প্রাঞ্জল ও পড়তে সহজবোধ্য। তবে রচনার ক্ষেত্রে তত্ত্বীয় গভীর বিশ্লেষণের অভাব বোধ করেছি। দুটো কারণে আমরা লেখাটি প্রকাশ করছি। প্রথমত আমাদের সম্পাদকীয় নিয়ম মেনে লেখাটি পাঠানো হয়েছে। আমরা আনন্দিত। তর্ক বাংলায় এটিই প্রথম সাবমিশন পোস্ট। দ্বিতীয়ত, কাঙাল হরিনাথ বাংলা সংবাদপত্র ও সাহিত্যান্দোলনের এক কিংবদন্তী নাম। বলা যায় তার সম্পাদিত গ্রামবার্ত্তা প্রবেশিকা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্মারক। বস্তুত তিনি রবীন্দ্র বিকাশ যুগের একজন লড়াকু লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক।