কেন কম পঠিত হয় আহসান হাবীবের কবিতা?

 

আমরা একে অন্যের শক্তিকে হয় অবমূল্যায়ন করি নয়তো অতি মূল্যায়ন করি। খুব কম মানুষ আছে যার অন্যের সম্পর্কে যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারে। এটা একটা বিশেষ গুণ। উঁচু মাপের মহৎ মানুষেরাই তা পারে। 
—আন্দ্রেই তারকোভস্কি
 

সাহিত্যের আড্ডায় নতুন ধরনের কবিতা, নতুন ধরনের গল্প-উপন্যাস লেখার কথা প্রায়ই বলা হয়। কিন্তু পুরোপুরি নতুন বলে কি কিছু আছে? আর যদি থেকেও থাকে, সেই নতুনের পরিণতি তো শেষ পর্যন্ত পুরোনো হওয়া। অর্থাৎ বিশ্লেষণের বিষয়, যে কাজটাকে নতুন দাবি করা হচ্ছে, তা কত দিন নতুন থাকবে? কিংবা এই নতুনের সঙ্গে পুরোনো কতখানি যুক্ত আছে? পুরোনো হয়ে গেলেই কি তা গুরুত্বহীন? রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ দাশের কবিতাও তো পুরোনো হয়েছে, কিন্তু আমরা তো আগ্রহ নিয়ে পড়ি। আজও তো স্মরণ করি শত শত বছর আগের ভারতচন্দ্রের স্মরণীয় কিছু লাইন—‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে কিংবা পুরাণে-কোরানে দেখ সকলি ঈশ্বর। আজও তো আমাদের স্পর্শ করে তলস্তয়, দস্তইয়েফস্কি, কাফকা, বোর্হেসের সাহিত্য। তাহলে সাহিত্যে নতুন আর পুরোনো আসলে কী? মহাকালের হিসাবে, নতুন আর পুরোনো বলে কি সত্যিই কিছু আছে?

কবির কাজ তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমকালীন অভিজ্ঞতা আর চিরন্তন অনুভূতিকে সঙ্গী করে কবিতাকে আপডেট করা। গুরুত্বপূর্ণ কবিরা মূলত কবিতাকে আপডেট করেন, এই আপডেট করাকেই বলা হয় নতুন কিছু করা। আপডেট করতে হয় পূর্ববর্তী কবিদের ওপর ভর করে নিজের সমকালকে বুঝে নিয়ে। পূর্ববর্তী কবিদের বাদ দিয়ে কখনোই কবিতা আপডেট করা যায় না। এ ক্ষেত্রে চিন্তার গভীরতা আর অভিনবত্বই হয়তো একজন কবিকে অপর কবি থেকে এগিয়ে রাখে! নতুনত্ব বা আপডেটকরণ আসলে পুরোনো অনুভূতির জগৎকে-জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিগত বা প্রকাশভঙ্গির ভিন্নতা আনয়ন।

এই যে কবিতা নিয়ে এত-এত কথা লিখলাম, তার সবই মনে হলো কবি আহসান হাবীবকে নিয়ে লিখতে বসে। আহসান হাবীবের প্রথম কবিতার বই রাত্রি শেষ প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত বাংলার কলকাতায় কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র কমরেড পাবলিশার্স থেকে। দ্বিতীয় কবিতার বই ছায়া হরিণ বের হয় ১৫ বছর পর। এরপর প্রকাশিত হয় সারা দুপুর [১৯৬৪], আশায় বসতি [১৯৭৪], মেঘ বলে চৈত্রে যাবো [১৯৭৬], দুহাতে দুই আদিম পাথর [১৯৮০], প্রেমের কবিতা [১৯৮১] এবং শেষ কাব্যগ্রন্থ বিদীর্ণ দর্পণে মুখ [১৯৮৫]। এই আটটি কবিতার বইয়ে কবিতার সংখ্যা ২৩৭। এ ছাড়া তিনি উপন্যাস, প্রবন্ধ, শিশু-কিশোর উপযোগী ছড়া, কবিতা ও গল্প রচনা করেছেন। করেছেন অনুবাদ।

আধুনিক কবিতার অন্তর্গত জীবনদর্শন ও প্রকরণ আহসান হাবীবের কবিতায় প্রথম থেকেই স্থান পেয়েছে। মধ্যবিত্তের সংকট ও জীবনযন্ত্রণা ছিল তাঁর কবিতার মুখ্য বিষয়। বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংগ্রাম ও সমকালীন যুগ-যন্ত্রণা তাঁর কবিতায় শিল্পসম্মতভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিতে নাগরিক মননের ছাপ স্পষ্ট। হুমায়ুন আজাদের ভাষায়, আহসান হাবীবের প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাত্রি শেষ বেরোয় ১৯৪৭-এ এবং এ কাব্যেই সর্বপ্রথম একজন মুসলমান কবি ব্যাপক বিশ-শতকী চেতনাসহ আত্মপ্রকাশ করেন।

লক্ষণীয় বিষয়, ৪৭-এ পরবর্তীকালে বাংলা কবিতায়, বিশেষ করে পূর্ব বাংলা অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আদর্শ নির্মাণের আবহাওয়া সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ চল্লিশের দশকে কলকাতাকেন্দ্রিকতা পরিহার করে ঢাকা তথা পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য নিজস্ব চেহারা লাভ করে। সমালোচকদের মতে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত বর্তমান বাংলাদেশের কবিতায় তখন তিনটি ধারা সক্রিয় ছিল। ধারা তিনটি হচ্ছে: ১. প্রগতিশীল মতাদর্শ ২. রক্ষণশীল পাকিস্তানি বা ধর্মী-মনোভঙ্গিসম্পন্ন মতাদর্শ এবং ৩. মানবতাবাদী মতাদর্শ। এই তিন ধারার ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের কবিতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, আবুল হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান, সিকান্দার আবু জাফর প্রমুখ।

আহসান হাবীব বাংলা কবিতার তিরিশি আধুনিকতাকে আত্মস্থ করে বেড়ে উঠলেও কবিতার ভাষা এবং প্রকাশভঙ্গিতে বাংলাদেশের মানুষ ও জনজীবনকে কবিতার উপাদান হিসেবে নিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের কবিতা থেকে নিজের কবিতাকে প্রথম থেকেই আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের ভৌগোলিক আবহ, ভাষা, কথনভঙ্গি তাঁর কবিতাতে সাবলীলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ শুরুতেই বাংলাদেশের কবিতাকে আলাদা করে যাঁরা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে আহসান হাবীব অন্যতম। আহসান হাবীব নিজ মাটির পরিচয় কবিতায় উচ্চারণে ছিলেন সাবলীল। নিজেই তাঁর কবি হওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে নিজের কবিতার পঙ্ক্তিতে লিখেছেন:

শহর পিরোজপুর
সরকারি স্কুলের খেলার মাঠ
পশ্চিমে প্রশাসকদের বাড়িঘর
পূর্বে স্কুল-বাড়ি, সামনে বাগান,
তার সামনে পুকুর,
উত্তরে আদালত কাছারি,
দক্ষিণে উকিল মোক্তার ইত্যাদি,
মাঠে রাত নয়টার অন্ধকার,
দুহাঁটুতে জোড়া হাত
তার ওপর কপাল
আমি একদিন কেঁদেছিলাম।

৪৭-এ পরবর্তীকালে বাংলা কবিতায়, বিশেষ করে পূর্ব বাংলা অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আদর্শ নির্মাণের আবহাওয়া সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ চল্লিশের দশকে কলকাতাকেন্দ্রিকতা পরিহার করে ঢাকা তথা পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য নিজস্ব চেহারা লাভ করে। সমালোচকদের মতে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত বর্তমান বাংলাদেশের কবিতায় তখন তিনটি ধারা সক্রিয় ছিল। ধারা তিনটি হচ্ছে: ১. প্রগতিশীল মতাদর্শ ২. রক্ষণশীল পাকিস্তানি বা ধর্মী-মনোভঙ্গিসম্পন্ন মতাদর্শ এবং ৩. মানবতাবাদী মতাদর্শ।

২০০৩ সালের ডিসেম্বরের কোনো এক সন্ধ্যায় পল্টন ফুটপাত থেকে কিনেছিলাম আহসান হাবীবকে নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ। বইটি সম্পাদনা করেছিলেন রোকনুজ্জামান খান। প্রকাশিত হয়েছিল আহসান হাবীবের মৃত্যুর পর ১৯৮৭ সালের এপ্রিলে। বইটির বেশির ভাগ লেখাই স্মৃতিচারণামূলক। সেখানে লিখেছিলেন আবু জাফর শামসুদ্দীন, শামসুর রাহমান, সরদার ফজলুল করিম, মাহমুদুল হক, রশিদ করিম, হুমায়ূন আহমেদ, সেলিম আল দীন থেকে শুরু করে বিখ্যাত সব লেখক। বইটি পড়তে গিয়ে লক্ষ করলাম, তৎকালীন নবীন-প্রবীণ প্রায় সমস্ত কবি-সাহিত্যিকই কোনো না কোনোভাবে ছিলেন তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত। অসংখ্য নবীন কবি-সাহিত্যিকের প্রথম কবিতা, গল্প বা প্রবন্ধ ছেপেছিলেন তিনি তাঁর সম্পাদিত সাহিত্য সাময়িকীতে, যাঁরা অনেকেই পরে প্রথম সারির লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বলা চলে, আহসান হাবীব বাংলাদেশে বুদ্ধদেব বসুর জায়গায় অবস্থান করছিলেন। তাঁর সম্পাদিত সাহিত্য পাতায় কবিতা ছাপা হওয়া মানে ছিল কবি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া। গ্রহণ-বর্জনের সংস্কারমুক্ত ক্ষমতা ছিল তাঁর। বহু প্রথিতযশা লেখকের লেখাও প্রকাশযোগ্য মনে করেননি। অনুসন্ধানী, সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে সমবেদী ও সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন তিনি। অনবদ্য গুণের জন্য সাহিত্য সম্পাদনার ইতিহাসে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। আজও স্মরণীয়, আলোচ্য তাঁর সাহিত্য সম্পাদনা। আহসান হাবীব তাঁর সময়ের তরুণদের কাছে ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয়।

দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে তিনি কলকাতা থেকে দেশে ফিরে দৈনিক ইত্তেহাদ-এর সাহিত্য পাতা সম্পাদনা শুরু করেন। পাশাপাশি সম্পাদনা করেন চলচ্চিত্রকার-কথাসাহিত্যিক জহির রায়হানের সাপ্তাহিক প্রবাহ। একসময় কথাবিতান নামে একটি প্রকাশনা সংস্থাও গড়ে তোলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালুর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় তাঁরই প্রকাশনা থেকে। ১৯৬৪ সালে যোগ দেন সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায়, স্বাধীনতার পর যা হয়েছিল দৈনিক বাংলা। আমৃত্যু অর্থাৎ ২১ বছর ধরে সফলভাবে তিনি ওই দায়িত্ব পালন করেছেন। শামসুর রাহমান তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, শেষের দিকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন শক্তিশালী তরুণ কবিদের প্রতিযোগী।

শামসুর রাহমানের কথার সূত্র ধরেই বলা যায়, আহসান হাবীব আমৃত্যু উত্তরণের এক একটি ধাপ পেরিয়ে আশির দশকের কবিদেরও প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে তারুণ্যে উজ্জ্বল ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও নিজেকে নবায়ন করতে জানতেন। ফলে তাঁর কবিতা কখনো বুড়িয়ে যায়নি, তাঁর কবিতাতে এমন অনেক পঙ্‌ক্তি রয়েছে, যা পড়লে মনে হয় তিনি আজও আমাদের সঙ্গে কবিতা লিখছেন। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৮৫ সালের শেষ দিকে প্রকাশিত হয় অনূদিত গ্রন্থ খসড়া। যেখানে রয়েছে হুয়ান র‌্যামন হিমেনেথ-এর প্লাতেরো অ্যান্ড আই এবং শাহেদ সোহরাওয়ার্দির এসেজ ইন ভার্স-এর অনুবাদ। টানা গদ্যে অনূদিত প্লাতেরো অ্যান্ড আই বইটির কিছু কিছু অংশ একসময় মাঝে মাঝেই আমার পড়া হতো। শোনা যায়, পরবর্তী সময়ে অনেকেই টানা গদ্যের কবিতা লেখার ক্ষেত্রে এ বইটি দিয়ে কিছুটা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

আহসান হাবীবের কিছু কবিতায় যেভাবে নাটকীয় সংলাপ বা কথ্যভঙ্গি উচ্চারিত হয়েছে, তা কম-বেশি তাঁর পরবর্তী কবিদের কাউকে কাউকে অনুপ্রাণিত করেছে। অন্যভাবে বললে পরবর্তী কেউ কেউ কোনো কোনো কবিতায় তাঁর নির্মাণকেই নিজেদের মতো করে আপডেট করেছেন। এই কবিদের মধ্যে রয়েছেন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক বা আবু জাফর ওবায়দুল্লাহযাঁদের কিছু কবিতার কথা বলা যেতে পারে, যার পূর্বসূরি হচ্ছে আহসান হাবীবের কয়েকটি কবিতা। কবি আবিদ আনোয়ারের মতে, সৈয়দ শামসুল হকের নবী মুনশীর সনেটগুচ্ছ, পরানের গহীন ভিতর, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নূরলদীনের সারাজীবন ইত্যাদি কাব্য ও কাব্যনাট্যে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তার আদি উৎস আহসান হাবীব। পাঠকের বিবেচনার জন্য কথ্যভঙ্গিতে লেখা আহসান হাবীবের কয়েকটি কবিতার কিছু পঙ্‌ক্তি তুলে ধরা হলো

আসমানের তারা সাক্ষী 
সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই
নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী
পুবের পুকুর, তার ঝাঁকড়া ডুমুরের ডালে স্থিরদৃষ্টি
মাছরাঙা আমাকে চেনে
আমি কোনো অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি কোনো ভিনদেশী পথিক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই।
আমি কোনো আগন্তুক নই, আমি
ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে
এখানেই থাকি আর
এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা—
সারা দেশে। 
আমি কোনো আগন্তুক নই। এই
খররৌদ্র জলজ বাতাস মেঘ ক্লান্ত বিকেলের
পাখিরা আমাকে চেনে
তারা জানে আমি কোনো অনাত্মীয় নই।

[আমি কোনো আগন্তুক নই]

 

কিংবা,

আদাব সালাম অন্তে সমাচার এই
যে, হুজুর কাল ফজরের অনেক আগেই
তামাম মুরুব্বীদের দোয়ার বরকতে
সহি-সালামতে
এসে নিজের বাটিতে পৌছেচি। এখন
সে কারণ
পত্রযোগে শতকোটি সালাম নিবেন
আর সবিশেষ সংবাদাদি পত্রে জানিবেন।

পুরনো লাঙল আর কাস্তে হাতে লয়ে
কসম খেয়েছি আর বলেছি হে ভাই,
এই সবে, এই গুলো আবার শানাই
আবার জিগরফাটা রক্ত দিয়ে লাল
বানাই। এগুলো হোক ঢাল তরোয়াল
তাদের গর্দান কাটা, যারা আচম্বিত
আমাদের জিন্দিগীর শান কেড়ে নিতে
ফন্দি করে। তাহাদের পথে আজ হতে
এই কাঁটা দিলাম।

[হকনাম ভরসা]

কিংবা,

জী হুজুর, আমি সেই হুজ্জত সরদার
জান নিয়ে বেঁচে আছি পাক-পরওয়ার
খোদাবন্দ করিমের পরম ফজলে। 
তবে কিনা অর্ধাহারে অনাহারে আজ
হয়েছে এমন হাল। হাড়-মাংসহীন
আমি সেই খাকছার হুজ্জত কমিন।

[ছহি জঙ্গনামা]

এ পঙ্ক্তিগুলো পড়লে এটাও স্পষ্ট হয় যে, আহসান হাবীব বাংলা কবিতার তিরিশি আধুনিকতাকে গ্রহণ করলেও, নিজের গণমানুষের ভাষা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করেননি। নিজস্ব ঐতিহ্যকে বরং কবিতায় নবায়ন করে গেছেন। আহসান হাবীব কথ্যভঙ্গিকে কবিতায় নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কথ্যভঙ্গিকে তিনি কখনো ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হিসেবে ব্যবহার করেছেন, কখনো আবার পরিশীলিত করে নাগরিক প্রেমের কবিতাতে ব্যবহার করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কথোপকথনকে প্রেমের কবিতায় যেভাবে উপস্থাপন করেছিলেন তাঁর প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের কবিদের মধ্যেও পড়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে, হয়তো আহসান হাবীবের দোতলার ল্যান্ডিং মুখোমুখি দুজন কবিতাটি দিয়েই অনুপ্রাণিত হয়ে পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছিলেন তাঁর কথোপকথন বইয়ের কবিতাগুলো, যা একসময় আবৃত্তিকারদের মাধ্যমে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। কবিতাটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো

মুখোমুখি ফ্ল্যাট
একজন সিঁড়িতে, একজন দরজায়
: আপনারা যাচ্ছেন বুঝি?
: চলে যাচ্ছি, মালপত্র উঠে গেছে সব।
: বছর দুয়েক হল, তাই নয়?
: তারো বেশী। আপনার ডাক নাম শানু, ভালো নাম?
: শাহানা, আপনার?
: মাবু।
: জানি।
: মাহবুব হোসেন। আপনি খুব ভালো সেলাই জানেন।
: কে বলেছে। আপনার তো অনার্স ফাইন্যাল, তাই নয়?
: এবার ফাইন্যাল।
: ফিজিক্স-এ অনার্স।
: কী আশ্চর্য! আপনি কেন ছাড়লেন হঠাৎ?
: মা চান না। মানে ছেলেদের সঙ্গে বসে…
: সে যাক গে, পা সেরেছে?
: কী করে জানলেন?
: এই আর কি! সেরে গেছে?
: ও কিছু না, পযাসেজটা পিছলে ছিল মানে…
: সত্যি নয়। উচুঁ থেকে পড়ে গিয়ে…
: ধ্যাৎ। খাবার টেবিলে রোজ মাকে অতো জ্বালানো কি ভালো?
: মা বলেছে?
: শুনতে পাই। বছর দুয়েক হল, তাই নয়?
: তারো বেশী। আপনার টবের গাছে ফুল এসেছে?
: নেবেন? না থাক। রিকসা এল, মা এলেন, যাই।
: আপনি সন্ধ্যে বেলা ওভাবে কখনও পড়বেন না,
চোখ যাবে, যাই।
: হলুদ শার্টের মাঝখানে বোতাম নেই, লাগিয়ে নেবেন, যাই।
: যান, আপনার মা আসছেন। মা ডাকছেন, যাই।

[দোতলার ল্যান্ডিং মুখোমুখি দুজন]

 

বরং একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়, যুগের পর যুগ পঠিত হওয়ার মতো গুণ কি আহসান হাবীবের কবিতায় রয়েছে? যেভাবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, জসীমউদ্‌দীন, শামসুর রাহমান বা আরও কেউ কেউ আজও বাঙালি পাঠকের মধ্যে সক্রিয় আছেন, সেভাবে কি আহসান হাবীবের কবিতা টিকে আছে? স্কুলের পাঠ্যবই কি পারে কবিতার কাটতি বাড়াতে? একটা সময় ছিল যখন মনে করা হতো স্কুলপাঠ্য বইয়ের কবি মানেই বড় কবি, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ ধারণা আজ প্রতিষ্ঠিত যে সমকালে অনেক গৌণ কবির কবিতাও নানান কারণে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে!

অনেক দিন পড়িনি আহসান হাবীবের কবিতা। তাঁর কবিতা নিয়ে ওইভাবে আলোচনাও হয় না কারও সঙ্গে। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে থাকার কারণে আহসান হাবীবের বেশ কিছু উৎকৃষ্ট শিশুতোষ বা কিশোর কবিতা পরিচিত সাধারণ পাঠকদের মধ্যে। এরপরও তাঁর কবিতার বই যে সাধারণ পাঠক আগ্রহ নিয়ে পড়েন, এটা বলা যাবে না। পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত তাঁর একটি কবিতার কিছু লাইন হচ্ছে এমন

আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
মেঘনা নদীর ঢেউয়ের বুকে
তালের নৌকা বেয়ে
আমি বেড়াই হেসে খেলে—
আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে।
[আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে: আহসান হাবীব]

এ কবিতা দিয়ে আহসান হাবীবকে নিশ্চয় প্রকৃত মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়; বরং একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়, যুগের পর যুগ পঠিত হওয়ার মতো গুণ কি আহসান হাবীবের কবিতায় রয়েছে? যেভাবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, জসীমউদ্‌দীন, শামসুর রাহমান বা আরও কেউ কেউ আজও বাঙালি পাঠকের মধ্যে সক্রিয় আছেন, সেভাবে কি আহসান হাবীবের কবিতা টিকে আছে? স্কুলের পাঠ্যবই কি পারে কবিতার কাটতি বাড়াতে? একটা সময় ছিল যখন মনে করা হতো স্কুলপাঠ্য বইয়ের কবি মানেই বড় কবি, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ ধারণা আজ প্রতিষ্ঠিত যে সমকালে অনেক গৌণ কবির কবিতাও নানান কারণে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে! সে যা-ই হোক, ধান ভানতে শিবের গীত না গাই, বরং অনুসন্ধানের চেষ্টা করে দেখা যাক, আহসান হাবীবের মতো একজন প্রথম সারির কবি কেন আজ পঠিত হচ্ছেন কম। কেন তাঁর কবিতা আজকের তরুণ কবি কিংবা সাধারণ পাঠকদের কাছে পাঠ্যবইয়ের বাইরে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। এ ক্ষেত্রে মোটাদাগে বলা যেতে পারেআহসান হাবীবের কবিতা আজকের বাস্তবতায় পাঠকমনের সামাজিক চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। বাঙালির উৎসব, সংগ্রাম, শোক, সাফল্য বা ধর্মাচরণকোনোটাতেই তাঁর কবিতা সাধারণের মধ্যে ব্যবহারোপযোগী হয়ে উঠছে না। এমনকি আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতাও তাঁর কবিতাকে প্রাসঙ্গিক করছে না। তাঁর আধুনিকতা তিরিশি আধুনিকতার বাইরে গিয়ে বৃহৎ কোনো পজিশন তৈরি করতে পারেনি, যেমনটা ফররুখ আহমদ বা জসীমউদ্দীনের কবিতার মধ্যে রয়েছে। তিনি অনেক খ্যাতিমান কবির মতোই আজ কেবল যেন একাডেমিক অঙ্গনেই থেকে যাচ্ছেন, জন্ম-মৃত্যুতে বিশেষ মহলে স্মরণযোগ্য হয়ে আছেন, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।

একজন কবি কম পঠিত হলেই কি তিনি গুরুত্বহীন হয়ে যান? আহসান হাবীবের কবিতাকে কি চাইলেই যেকোনো কবির পক্ষে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব? কেউ প্রত্যাখ্যান করতে চাইলে এর ফল কি হিতে বিপরীত হবে না! অপরিণত বয়সের স্বাভাবিক উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথ একবার মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরে, পরিণত অভিজ্ঞতায় পৌঁছে, নতমস্তকে স্বীকার করেছেন প্রত্যাখ্যান করার ভুল। পাউন্ডের সঙ্গে গলা মিলিয়ে এলিয়টের মন্তব্যআধুনিক কবিরা মিলটন পড়লে আর কবি হতে পারবে না। আর মিলটনের হাতে ইংরেজি ভাষার যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপ্রতিশোধ্য। কিন্তু ১১ বছর পরে ওই এলিয়টকেই লিখতে হয়েছিল দ্বিতীয় দফার প্রবন্ধ। লিখতে হয়েছিল, তাঁর কবিতার অনুশীলনে লাভবান হবে কবিরা।  আহসান হাবীব মহাকাব্য লেখেননি, খণ্ড কবিতাই লিখেছেন আজীবন। তারপরও বলব, এসব কবিতা যদি আজকের কবিরা না পড়েন, তবে তাঁরা পাঠক ও লেখক হিসেবে নিজেদের বঞ্চিতই করবেন!

       সহায়ক গ্রন্থ

১. আহসান হাবীব রচনাবলী ১, সম্পাদনা:আহমদ রফিক,  প্রকাশক: বাংলা একাডেমী, প্রকাশকাল: ১৯৯৫, ঢাকা।
২. আহসান হাবীব স্মারক-গ্রন্থ, সম্পাদনা: রোকনুজ্জামান খান, প্রকাশক:  আহসান হাবীব স্মৃতি কমিটি, প্রকাশকাল: ১৯৮৭, ঢাকা।
৩. আধুনিক কবি ও কবিতা: হাসান হাফিজুর রহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, প্রকাশক: সময়, প্রকাশকাল:২০০০, ঢাকা।
৪. চিত্রকল্প ও বিচিত্র গদ্য: আবিদ আনোয়ার, প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী, প্রকাশকাল: ২০০৫, ঢাকা।
৫. হাজার বছরের বাংলা কবিতা: মাসুদুল হক, প্রকাশক: ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, প্রকাশকাল: ২০০৮, ঢাকা।