উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর
সতেরো শ সাতান্ন সালে পলাশীর প্রহসনের ফলে ভারতবর্ষ ইংরেজদের অধীন হয়ে পড়লে, তখনকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এতটাই বিধ্বস্ত ছিল যে সমাজে প্রভাবশালীদের একটা বড় অংশ তাকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে বিদেশি শাসন একেবারে প্রতিবাদহীনভাবে স্বীকৃত হয়নি। সাধারণ প্রজাদের মধ্যে অসন্তোষ লেগেই ছিল। ইতিমধ্যে পলাশীর যুদ্ধের পর মাত্র ১২ বছরের মাথায় যে দুর্বিষহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, ইতিহাসে তা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে কুখ্যাত হয়ে আছে। যার পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দমঠ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন ঘটনার ১০০ বছর পরে। অর্থাৎ উনিশ শতকের গোড়ার দিকে। ওই ইংরেজদের দেওয়া পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার কিছু মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, রাজনৈতিক চেতনা বাড়াতে সাহায্য করেছিল, যা একসময় বিদ্রোহের জন্ম দেয়। যদিও সাঁওতাল বিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহের মতো ঘটনাগুলো আগেই ঘটে গিয়েছিল, যা এলিট শ্রেণিকে খুব একটা নাড়া দিতে সক্ষম হয়নি। তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং সাধারণ প্রজাদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধিতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে বাঙালি পাঠককে সচকিত করে দিয়ে, কবির ভাষায় ‘উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর’ কথাটাকে আক্ষরিক অর্থে সত্য করে দিয়ে যে কবির আবির্ভাব হয়েছিল, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। অনেক দিক থেকেই বাংলা কবিতায় নতুনের স্পর্শ এনেছিলেন তিনি। নতুন স্বাদের রাজনৈতিক কবিতাও বাংলা সাহিত্যে তাঁরই অবদান। পূর্ববর্তী কবিদের তুলনায় তাঁর রাজনীতি-মনস্কতা অনেকটাই বেশি ছিল। নজরুল রাজনীতির সংস্পর্শে যে উদ্দীপ্ত হতেন, কিশোর বয়সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিতে চলে যাওয়া তার একটি প্রমাণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে পৃথিবীব্যাপী হতাশা, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পরিবেশে বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম এক ধূমকেতুর নাম। রাজনীতি-সচেতনতা ও জনমূল-সংলগ্নতা নজরুলের কবি-চৈতন্যে এনেছিল নতুন মাত্রা। প্রকাশিত প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’র পর ১৯১৯ সালে তাঁর ‘ব্যথার দান’ গল্পে যে দেশপ্রেম ফুটে উঠেছিল, তার জন্য কলকাতার একটা প্রেস গল্পটি ছাপতে রাজি হয়নি। শুধু দেশপ্রেম নয়, নজরুলের এই গল্পের আন্তর্জাতিকতা বাংলা সাহিত্যের জন্য একটি নতুন দিক বলতে হবে। গল্পের দুই প্রধান চরিত্র যোগ দিয়েছিল ‘লাল ফৌজে’। এ ‘লাল ফৌজ’ মূলত রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লবকে বাঁচানোর জন্য রুশ দেশের ভেতরে মজুর শ্রেণির পার্টি ও সোভিয়েত রাষ্ট্রের নেতৃত্বে জনগণ যে সৈন্যদল গঠন করেছিল, তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘লাল ফৌজ’। সেই সময়ে ব্রিটিশ-ভারতের গভর্নমেন্ট লালের আতঙ্কে শঙ্কিত হয়ে চারদিক থেকে আটঘাট বেঁধে ফেলেছিল যেন অক্টোবর বিপ্লবের ছোঁয়া কোনোভাবেই ভারতে প্রবেশ করতে না পারে। সেই লাল ফৌজে ব্রিটিশ ভারতের লোকেরা যোগ দেবে, সেটা যদি গল্পের ভেতরেও হয়, পুলিশের পক্ষে তা হজম করা কঠিন। তাই কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ গল্পটা পত্রিকায় প্রকাশ করার সময় ‘লাল ফৌজ’ কেটে ‘মুক্তি সৈন্যদের দল’ বসিয়ে দিয়েছিলেন।
বেঙ্গলি ডবল কোম্পানিতে যোগদান করার যে ডাক নজরুল ইসলামের কানে পৌঁছেছিল, সেটা তাঁর কাছে নিছক একটা যুদ্ধ ছিল না, তাঁর কাছে ওটা ছিল দেশপ্রেমের আহ্বান। নইলে ক্লাসের সবাই যখন ভাবছিল, পরীক্ষা দিলে স্কলারশিপ পাওয়া যাবে, সেখানে তিনি কী কারণে সব ছেড়ে চলে গেলেন! তরুণ সৈনিকেরা দেখা যায় প্রায়ই উদ্দাম স্বভাব নিয়ে ফিরে আসেন। আর সেখান থেকে নজরুল ফিরে এলেন দেশপ্রেমে ভরপুর হয়ে
নজরুলের দেশপ্রেম, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বরাবরই তাঁকে বিদ্রোহী করে তুলছে। বেঙ্গলি ডবল কোম্পানিতে যোগদান করার যে ডাক নজরুল ইসলামের কানে পৌঁছেছিল, সেটা তাঁর কাছে নিছক একটা যুদ্ধ ছিল না, তাঁর কাছে ওটা ছিল দেশপ্রেমের আহ্বান। নইলে ক্লাসের সবাই যখন ভাবছিল, পরীক্ষা দিলে স্কলারশিপ পাওয়া যাবে, সেখানে তিনি কী কারণে সব ছেড়ে চলে গেলেন! তরুণ সৈনিকেরা দেখা যায় প্রায়ই উদ্দাম স্বভাব নিয়ে ফিরে আসেন। আর সেখান থেকে নজরুল ফিরে এলেন দেশপ্রেমে ভরপুর হয়ে। সাধারণ সৈনিকের মতো শুধু যুদ্ধ তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না কখনো। তাই তো রাজনীতির সব রকম অনুষঙ্গ তাঁকে আকৃষ্ট করেছে। করাচিতে তাঁদের ব্যারাকে যেকোনো রাজনৈতিক লেখাপত্র বা সাহিত্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। নিয়ম ছিল অত্যন্ত কঠোর, তবু এসব ব্যবস্থা নজরুলের কাছে হার মেনেছিল। তিনি এমন গোপন পথ খুলেছিলেন যে, যার সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে নিষিদ্ধ পত্রপত্রিকা অবলীলাক্রমে প্রবেশ করত। সিডিশন কমিটির রিপোর্ট তাঁদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল কিন্তু জমাদার রায় সেই রিপোর্ট নজরুলের কাছে দেখেছিলেন। রুশ বিপ্লব সম্বন্ধেও নিষিদ্ধ সাহিত্য নজরুলের হাতে এসেছিল সব বাধা পেরিয়ে।
ব্রিটিশ আমলে বাঙালিদের ফৌজে ভর্তি করা হতো না। ভারতের ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট রক্ত গরম বাঙালির হাতে অস্ত্র দিয়ে তাদের বিশ্বাস করতে পারত না। বাঙালিদের ব্যবহার করা হতো ব্রিটিশ সরকারের কেরানি হিসেবে। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অনেক লেখালেখি হতে লাগল যে বাঙালিদেরও সৈন্যদলে ভর্তি করা হোক। শেষ পর্যন্ত ১৯১৭ সালে ভারতের ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট একটি বেঙ্গলি ডবল কোম্পানি গঠন করতে রাজি হলো।
নজরুল যুদ্ধবিদ্যা শিখেছিলেন কারণ ভারতবর্ষে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী গঠন করে, দেশ থেকে ইংরেজদের তাড়াবেন, এই ছিল তাঁর বাসনা। তবে পল্টন থেকে ফিরে এসে সৈন্যবাহিনী গঠন করে দেশ স্বাধীন করতে না পারলেও তিনি তাঁর কলমটি অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। নবযুগ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে তিনি গরম গরম সব প্রবন্ধ লিখতে শুরু করলেন। যে কারণে পরপর তিনবার সরকার পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশককে সতর্ক করেছিল।
অসত্য অমঙ্গল অকল্যাণের গ্রাস থেকে তিনি মুক্ত করতে চেয়েছেন স্বদেশের মাটি আর মানুষকে। যুদ্ধোত্তর বিরুদ্ধ প্রতিবেশে দাঁড়িয়েও তিনি গেয়েছেন জীবনের জয়গান, উচ্চারণ করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য বিদ্রোহের বাণী।
তিনিই প্রথম ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানান। ১৯২০ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায় প্রথম কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ামাত্রই ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। ওই দিন বিজলী পত্রিকা দুবার ছাপতে হয়েছিল। যার সংখ্যা ছিল ২৯ হাজার। কমরেড মুজাফ্ফর আহমদের মতে, সেদিন কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটা পড়েছিল। কবিতাটিতে দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে ‘চির উন্নত মম শির’ হিসেবে বিরাজমান। বল বীর/ বল উন্নত মম শির!/ শির নেহারি আমারি,/ নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর!/ বল বীর/ বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি/ চন্দ্র সূর্য গ্রহতারা ছাড়ি/ ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,/ খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া/ উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর!"
নজরুলের রাজনৈতিক ভাবনায় যথেষ্ট অস্থিরতা ছিল। সে সময়ে তা অনেকেরই ছিল, কারণ সে সময় ১৯২০ থেকে ১৯৪০—এই দুই দশক অখণ্ড ভারতের রাজনীতিতে ছিল বহু ভাষার আবর্ত। অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে পড়তেন। কংগ্রেসের রাজনীতি, সাম্যবাদের আদর্শ, সশস্ত্র বিপ্লববাদের লক্ষ্য—এই তিনের প্রতিই বিভিন্ন সময়ে আকর্ষণ দেখা গেছে নজরুলের। সে সময়ে মুসলিম লীগও ছিল। কিন্তু নজরুল সেখানে যোগ দেননি। চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে পরিচয় ছিল তাঁর। কংগ্রেস থেকে উদ্ভূত লেবার স্বরাজ পার্টির সদস্য ছিলেন তিনি। স্বরাজ দলের প্রার্থী হয়ে ভোটেও দাঁড়িয়েছিলেন একবার। যদিও হেরে যান। আবার কংগ্রেসের সঙ্গেও ছিলেন। পরে মুজফ্ফর আহমদের সান্নিধ্যে পৌঁছে সাম্যবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, যদিও পার্টি সদস্য ছিলেন না। তবে পার্টির জন্য বিশ্ব ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক কবিতার বঙ্গানুবাদ করেছিলেন নজরুল। কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক গণসংগীত লিখেছিলেন ফরাসি শ্রমিক—ইউজিন পাতিয়ের। গানটির ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন অপটন সিনক্লেয়ার। সেটাকে ‘অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত’ নাম দিয়ে বঙ্গানুবাদ করেন নজরুল। ‘নব ভিত্তি পরে নব নবীন জগৎ হবে উত্থিত রে! শোন অত্যাচারী! শোন রে সঞ্চয়ী! ছিনু সর্বহারা, হব সর্বজয়ী। ’ (গণবাণী,২১ এপ্রিল, ১৯২৭)।
সর্বপ্রথম ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। সেখানে তিনি লেখেন, ‘স্বরাজ টরাজ বুঝি না। কেননা এ কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশ বিদেশির অধীনে থাকবে না। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তারা শুনবে না, আমাদের এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে। এ কথা পরিষ্কার যে, শুধু স্বাধীনতা নয়, দরকার ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’। আর আবেদন-নিবেদনে এই পূর্ণ স্বাধীনতা মোটেই সম্ভব নয়।’ নজরুল একেবারে খাঁটি সত্যটা চাঁছাছোলা ভাষায় ঘোষণা করেছেন এখানে
‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ১৯২২-এর ২২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ লেখার জন্য কারারুদ্ধ হন নজরুল। লিখেছিলেন, ‘দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি পূজা/ দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্তমাগে দশভুজা।’ ‘বিষের বাঁশী’তে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি উচ্চারণ করেছেন। বাজেয়াপ্ত হয়েছিল ‘বিষের বাঁশী’ [১৯২৪]। তা ছাড়া নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তাঁর ‘ভাঙার গান’ [১৯২৪], প্রলয় শিখা [১৯৩১], চন্দ্রবিন্দু [১৯৩১]। প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘যুগবাণী’ [১৯২২], আর ‘দুর্দিনের যাত্রী’ [১৯২৬] বাজেয়াপ্ত হয়। কারারুদ্ধ হয়ে বিচারের সময় আদালতে দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন নজরুল, তা-ও এক জ্বলন্ত রাজনৈতিক কবিতা। শান্তিকামী মানুষের মাথার ওপরে ইংরেজ-শাসকদের দুঃশাসন, লুটপাট ও এ দেশেরই পদলেহী দালালরা অশান্তি ও রক্তের প্লাবন নামিয়ে দিয়েছিল যখন, সেই সময়ে ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বনকারী কবির কবিতায় উচ্চারিত হয়, ‘জাগো অনশন বন্দী ওঠ রে যত, জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত জাগো’।
সর্বপ্রথম ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। সেখানে তিনি লেখেন, ‘স্বরাজ টরাজ বুঝি না। কেননা এ কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশ বিদেশির অধীনে থাকবে না। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তারা শুনবে না, আমাদের এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে। এ কথা পরিষ্কার যে, শুধু স্বাধীনতা নয়, দরকার ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’। আর আবেদন-নিবেদনে এই পূর্ণ স্বাধীনতা মোটেই সম্ভব নয়।’ নজরুল একেবারে খাঁটি সত্যটা চাঁছাছোলা ভাষায় ঘোষণা করেছেন এখানে।
‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতাটি তারই একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। এই কবিতায় বারবার উচ্চারিত হয়েছে ‘স্বরাজ’ শব্দটি, কিছুটা ব্যঙ্গের ভঙ্গিতে লেখা হয়েছে “রবে না কো’ ম্যালেরিয়া মহামারী,/ স্বরাজ আসিছে চড়ে জুরি-গাড়ি, চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে মেয়ে!/ মাতা কয়, ওরে চুপ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্ চেয়ে!/ ক্ষুধাতুর শিশু চায়-না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন!/ বেলা বয়ে যায়, খায়নি কো বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন!/ কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়, স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!...গান্ধীর স্বরাজের অর্থ দেশের স্বাধীনতা ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গান্ধী বলেছিলেন, এক বছরের মধ্যে এ দেশে স্বায়ত্তশাসন ও স্বরাজ এসে যাবে। এই বলে দেশের মানুষকে আশা দিয়েছিলেন এবং আন্দোলন বন্ধ রেখেছিলেন। ফলে বিরূপ হয়েছিল দেশবাসী।
নজরুলের রাজনৈতিক কবিতার একটি প্রধান দিক হলো, বিদ্রূপ ভঙ্গিতে লেখা ব্যঙ্গ-হাস্যমিশ্রিত রচনা। সেগুলো ‘চন্দ্রবিন্দু’ নামক সংকলনে একত্র করা হয় এবং প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সংকলনটি বাজেয়াপ্ত হয় ১৯৩১ সালে। এই সংকলনে আছে ‘ডেমিনিয়ান স্ট্যাটাস’, ‘লিগ-অব নেশন’, ‘দে গরুর গা দুইয়ে’, ‘রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স’, ‘সাহেব ও মেমসাহেব’, আইমন কমিশনের রিপোর্ট : প্রথম ভাগ ‘ভারতের যাহা দেখিলেন’, এবং দ্বিতীয় ভাগ ‘ভারতের যাহা দেখাইলেন’, ‘প্রাথমিক শিক্ষা বিল’ প্রভৃতি।
চিত্তরঞ্জন দাশ হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে মুসলমানদের জন্য অধিক কর্মসংস্থান সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে যে প্রস্তাব করেছিলেন, চিত্তরঞ্জনের অনুরাগী হওয়া সত্ত্বেও তা পছন্দ করতে পারেননি নজরুল। ‘চন্দ্রবিন্দুতে’ প্যাক্ট কবিতাটিতে তিনি লিখেছিলেন ‘বদনা গাড়ুতে গলাগলি করে, নব প্যাক্টের আশনাই,/ মুসলমানের হাতে নাই ছুরি, হিন্দুর হাতে বাঁশ নাই। ’
তিনি কবিতায় শোষকের বিরুদ্ধে, জুলুমের প্রতিবাদে বন্দি, কারারুদ্ধ মজলুমের বা বিপ্লবীর শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ার এক দুর্দান্ত আহ্বান জানিয়েছেন সেই উত্তাল সময়টায়।
কবির কাছে তাঁর দেশ খুব বেশি জীবন্ত ও বাঙ্ময়। কারণ, দেশ তাঁর সমস্ত সত্তার মধ্যে ছিল ব্যাপ্ত ও প্রসারিত। আর সেই দেশ যখন হয় সংকটে পতিত, তখনই কবি হয়ে ওঠেন বিপ্লবী, তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে রাজনীতির অনুষঙ্গ। তাই কবির কবিতায় তাঁর স্বদেশ, তার প্রকৃতি এবং মানুষ ধরা দিয়েছে প্রবল হয়ে। শাসককে করেছে শঙ্কিত। আর তিনি হয়ে উঠেছেন দ্রোহের কবি। নজরুলের তুল্য এতটা দ্রোহী, মুক্তিকামী কবি সারা বিশ্বে আর একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায় না।
তথ্যসূত্র
১. নজরুল রচনাবলী: জন্মশতবর্ষ সংস্করণ, সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম, প্রথম খণ্ড, বংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৩।
২. ইংরেজ শাসনে বাজেয়াপ্ত বই: সম্পাদনা: বিষ্ণু বসু, অশোক কুমার মিত্র, এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা, ১৯৯৭।
৩. নিষিদ্ধ নজরুল: শিশির কর, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৮৭।
৪. বিজলী, সম্পাদক: নলিনীকান্ত সরকার, সাহিত্য পত্রিকা, কলকাতা, ৬ জানুয়ারি ১৯২০।
৫. গণবাণী, সম্পাদক: মুজফ্ফর আহমদ, সাহিত্য পত্রিকা, কলকাতা, ২১ এপ্রিল ১৯২৭।
৬. কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা: মুজফ্ফর আহমদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রা. লিমিটেড, দিল্লি, ১৯৬৫।