কবিতার একটি উজ্জ্বল মিথ ও নাচের শব্দ

 

সুরাইয়া খানম, ষাট দশকের এক উজ্জ্বলতম তারা। বাংলাদেশের ষাট দশকের কবিতায় তাঁর পদচারণা ছিল দৃঢ়, যেন উজ্জ্বল এক তারা মধ্যগগনে। সবখানেই সফল এক মানুষের চলার শব্দ যার চকিত পদচারণাতেই চারপাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠত, সে ছিল সুরাইয়া খানম। ম্যাট্রিক পাস করার পর সুরাইয়া খানম করাচিতে পড়াশোনা করেন। সেখানেই সর্বকনিষ্ঠ প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। সেখান থেকে কমনওলেথ স্কলারশিপ নিয়ে কেমব্রিজে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পাস করেন। এশিয়ার ভেতর প্রথম কেমব্রিজ স্কলার ছিলেন তিনি। ছিল ট্রিপল অনার্স। মুক্তিযুদ্ধকালীন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ব্রিটেনের রাজপথে দাঁড়িয়েছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর কেমব্রিজ থেকে ফিরে এসে ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।

ইংরেজি বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের কাছে দ্রুতই পরিচিত এবং প্রিয় মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। কেননা তিনি ছিলেন প্রতিভার সমান অপূর্ব সুন্দরী। তখন সাহিত্য মহলেও তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে; কারণ, ইংরেজি বিভাগের এই বিদুষী শিক্ষক কবিতা লেখেন। তা-ও ইংরেজিতে নয়, বাংলায়। ফলে অনেকেই তাঁকে নিয়ে কৌতূহলী হলেও তাঁর ছিল আরেক শক্তিমান ক্ষণজন্মা কবি আবুল হাসানের সাথে সখ্য। এ সখ্যভাব ছিল নিবিড়, গাঢ়। তার চাইতে তিন বছরের ছোট আবুল হাসান মাত্র ২৮ বছর বেঁচে ছিলেন। তাঁদের দুজনের প্রেম আজও এক মিথ হয়ে আছে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে।  কিন্তু আবুল হাসান এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে সে সখ্যে চিরকালের জন্য ছেদ পড়ে। তত দিনে তাঁর প্রথম এবং একমাত্র কবিতার বই নাচের শব্দ [১৯৭৫] প্রকাশিত হয়েছে। সে কাব্যগ্রন্থে তিনি কবিতায় তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি জানান দিয়েছেন। একদিকে অধ্যাপনা, অন্যদিকে প্রেমিক আবুল হাসানের অনিরাময়যোগ্য ব্যাধিতে অবসাদগ্রস্ত কবি সেভাবে কবিতায় মনোনিবেশ করতে পারছিলেন না। অস্থিরতা নিয়ে চলছিল জীবন, তার ভেতরই ১৯৭৫ সালে ২৬ নভেম্বরে কবি আবুল হাসানের মৃত্যুতে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। শেষাবধি আর কোনো লেখা বা কাব্যগ্রন্থ সেভাবে প্রকাশিত হয়নি তাঁর।

১৯৭৪ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ঢাবিতে শিক্ষকতা করে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব অ্যরিজোনাতে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। পিএইচডি শেষ করে অ্যরিজোনার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখানকার টুসান শহরে বিয়ে-থা করে সেটেলড হন, স্বামী সৈয়দ সালাহউদ্দিনের সাথে। ২০০৩ সালে সৈয়দ সালাহউদ্দিন মারা যান। ২০০৬ সালে তাঁদের একমাত্র মেয়ে সৈয়দা সালিলা খানমকে রেখে সুরাইয়া খানম মারা যান। আর পেছনে থেকে যায় তাঁর একমাত্র কাব্যগ্রন্থ নাচের শব্দ এবং ক্ষণজন্মা কবি আবুল হাসানের সাথে তাঁর প্রেমের মিথ।

নাচের শব্দ বইটি ৪ ফর্মার, প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালের জুনে। দ্বিতীয় মুদ্রণ হয় ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সালে, চারুলিপি প্রকাশন থেকে। উৎসর্গ করা হয় কবি আবুল হাসানকে। কাব্যগ্রন্থটিতে সংকলিত ৫২টি কবিতা। প্রতিটি কবিতাতেই তার দীপ্ত উচ্চারণ, ঝকঝকে স্মার্টনেস তার কবিতার পাঠককে চমৎকৃত করে। প্রস্তুতিও ছিল বেশ উপস্থাপনায়, ছন্দে, টান টান বুননে। ভ্রষ্টলগ্ন কবিতাতে তারই আভাস পাওয়া যায়

এই গাছ, কবিতা শোন আমার
শোন পাথর, কবিতা শোন দেওয়াল,

এই শুয়োরের বাচ্চা, শুনে যা আমার কিস্যা
কুকুরের ছানা শোন কবিতা আমার।
..
লগ্ন যাচ্ছে;
ভ্রষ্ট লগ্নে শুনে যা আবার
অমল শব্দের ধ্বনি, প্রানের টংকার।

উদ্ধারের ইস্টিমার ছাড়ছে ঐ
শোন
ছাড়পত্র আমারই কবিতা।

টান টান আড়ষ্টতাহীন, ঝকঝকে কবিতা, শব্দোচ্চারণে তার সময়ের চাইতে অনেক সাহসী, নতুন স্বর। ইংরেজি সাহিত্য পড়ার কারণে বিভিন্ন সময়ের কবিতা আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল, ফলে কবিতা নিয়ে তাঁকে অতটা ভাবতে হয়নি। নিজস্ব ভাষা আর বাকপ্রতিমা নিয়ে সুরাইয়া খানম যে কবিতা লিখে গেছেন, তাতে তাঁর নিজ স্বর খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধা হয় নাই। তাঁর সময়ের অনেক কবির চাইতে সুরাইয়া খানমের কবিতা চিন্তার ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগামী। তলোয়ার কবিতায়

হে পুরুষ, নগ্ন তলোয়ার তুমি হতে চাও, পারো!
দ্বিখণ্ডিত করো যদি মুহূর্তেই সুধাভাণ্ড, করো!

গাঙচিল হলে তুমি চখা বুঝতে চখিরে!
এখানো দু’হাত দাও, বাঁধো বুকে তোমার সখিরে।

কিংবা পঙ্খিরাজের বাতাস কাটা কবিতায়—
ঐ যে আমি দেখেছিলাম—
      অগ্নি সবুজ আবার দাঁড়াও!

মাথায় দোলা দিয়ে বলো—
     আমি অবুঝ, আমায় বোঝাও!
...
পিছিয়ে বসে থেকো না আর, আবার তুমি বলগাহারা
যা হয় তা হোক, বলে বেরোও রাগী ঘাড়ের দুলিয়ে জটা!

কবিতার আছে এক অব্যাখ্যাত জগৎ, যা ব্যাখ্যা যায় না। অতীন্দ্রিয়, অনুভূতিশীল শব্দে বর্ণে ছন্দে একটা রূপকের ভেতর দিয়ে কবিতা এসে ধরা দেয় পাঠকের সন্মুখে। পাঠক তখন নিজের মতো করে আরেক জগৎ তৈরি করে নেয়। এই হলো কবিতার কুহকী ঘোর, যা কখনোই ছেড়ে যায় না কবিকে। কবি সেই ঘোরের ভেতরই লিখে থাকে।

উনিশ শতকে সারা বিশ্বের কবিতার মোড় ঘুরে গেছে রোমান্টিসিজম থেকে আধুনিকতার দিকে। ভিক্টোরিয়ান সৌন্দর্য থেকে বেরিয়ে ভাঙাচোরা মুখ নিয়ে কবিতাকে বাস্তবতার দিকে মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছেন টি এস এলিয়ট তাঁর ওয়েস্ট ল্যান্ড কবিতায়। ৪২৮ লাইনের এ কবিতা পরবর্তীকালে নোবেল প্রাইজ পায়। সেখানে সংস্কৃতি থেকে শুরু করে পুরো পৃথিবীর কবিতার ভাষা নতুন রূপ পেল। ইংরেজি কবিতার মোড় ঘুরে যায় পৃথিবীর দিকে। কবিতাকে শুধু আর ড্রয়িংরুম কিংবা এলিট কালচারের অংশ হয়ে থাকতে হলো না। কবিতায় স্থান পেল দৈনন্দিন মুষড়ে পড়া জীবনের বয়ানগাথা। প্রতিদিনের ক্ষয়ে আসা সময়ের আর্তনাদ প্রতিফলিত হলো কবিতায়। তা থেকে বাংলা কবিতাও অনুপ্রাণিত হলো। পঞ্চকবির কবিতার পর ষাটের দশকেই বাংলাদেশের কবিরা নিজেদের স্বরে প্রতিভাত হন। কবিরা লিখতে শুরু করেছিলেন নিজেদের স্বরে, দেশজ আবহে। পশ্চিম বাংলা থেকে আলাদা স্বরে। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মুস্তফা আনোয়ার, মোহাম্মদ রফিকসহ আরও উল্লেখযোগ্য কবিরা। পড়ন্ত ষাট দশকে কবিতায় আরও উজ্জ্বল সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হলেন সুরাইয়া খানম, আবুল হাসানের মতো প্রতিভাবান কবি। তাঁদের কবিতা স্থায়ী আসন করে নিল বাংলা সাহিত্যে। দেখা কবিতায়

অবয়ব দেখেছো কি
       মুক্তোর মতোন সেই উজ্জ্বল জ্বালা
       সুন্দর গৃহের?
...
দেহ তার ঢেকেছো কি
     আদরের মধুর হত্যায়
     ভাস্করের মতো তাকে ছেনেছুনে কেটেকুটে
            দিয়েছো কি নতুন প্রত্যয়?

সুরাইয়া খানম সেখানে জ্বলে জ্বলে একা এক নিঃসঙ্গ আত্মা যে নিজেকে মেলে ধরেছেন, যেন এক শুশ্রাষাগার

এই দেখো শরীর আমার।
এ যেন তোমার শান্ত শুদ্ধ নিকেতন,
এ যেন বিশ্রামাগার হে পথিক ক্লান্ত পথচারী
...
আমার উনুনে তেতে নাও 
তোমার যা কিছু আছে, সুস্থ হও!

সুরাইয়া খানম কবিতায় ব্যক্তিগত হয়েও নৈর্ব্যক্তিক। তাঁর কবিতার ভাষা সাধারণ কিন্তু প্রাণময়, রূপক কিংবা দার্শনিক চিন্তার জায়গাটা অনুপস্থিত। ছন্দের ক্ষেত্রে দারুণ সিদ্ধহস্ত। হয়তো প্রথম বই বলে তিনি ছন্দের ক্ষেত্রে মনোযোগী হয়েছিলেন। হিসাব কবিতায়

হাতে কি আছে?
বয়স? না?
হাতে কী আছে?
প্রেম? না?
হাতে কী আছে? 
জ্ঞান? না?
...
হাতে কী আছে?
মুত্য? না।
হাতে কী আছে?

নাচের শব্দ কবিতায় আরও আরও নিরীক্ষণ

জোড়া শালিখ নাচে যখন
      খয়েরি হলুদ শব্দ হয়

মানুষ পাখি মারে যখন
     লাল গোলাপি শব্দ হয়
মানুষ মানুষ মারে যখন 
      তখন নাচের কোন সময়?
কিংবা দলিল কবিতায়—

জীবন, জীবন, ভুবন আমার নেশার মদেই চূড়ান্ত চুর!
ঐ সুরাখানি পাত্রে ঢালতে পারলে 
       আহা রে আমিও শান্তি পেতাম।
…..

ঐ বেদখানি তোমাকে দিলেই-আহা সন্তান
     মুখ দেখতাম।

অথবা হলদে লতা কবিতায়—

এই যে আমি-হলদে লতা,
        আমায় দেখে হাত তালি দাও!

এই যে আমি: সবুজ ছিলাম
বিদ্যুতের বাকল ঘিরে, কপাট ঘিরে।

এক সুতীব্র নারীসত্তা তার কবিতাকে আর্তচিৎকারে দীর্ণ করে ছিঁড়েভুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। তার বিদীর্ণ আত্মা, প্রেম, দ্রোহ, ভালোবাসায় সিক্ত চোখ মৌন সত্তা ভুলে নিজেকে পাঠকের কাছে মেলে ধরে

তোমার নাচের শব্দ শুনি আমি আত্মার কান্নায়
জন্মের কাননে শুনি নৃত্যময় মুত্যুর বোধন, শুনি জন্ম!
কলহাস্যে আলিঙ্গনাবদ্ধ জননী-জননী। স্ফিংস ও আইসিস।
[নাচের শব্দ]

কিংবা অমর পূর্ণিমা কবিতায়

তুমি আমার বিশুদ্ধ জল, তুমি আমার পাপ
তোমায় ফেলে কলসি ভরে রাখবো মনস্তাপ?
...
এই আভাতে আমি আঁধার আমি হেমের অমা
তুমি আমার সমস্ত পাপ তুমি আমার ক্ষমা!

বারবার উচ্চারিত হয়েছে তাদের অব্যক্ত প্রেমের আকুল আর্তি, যা কিনা বিরহেই সমাপ্তি ঘটে। তাকে আজীবন লালন করে গেছেন কবি। তার অহঙ্কার কবিতায়

অসুস্থ মানুষ ছিলো, তবু তার হাত দিনরাত
তাপিত তাড়িত ছিল, তবু তারে প্রণিপাত,
খরতাপে মমতার মনোহর এ প্রপাত: কত রাত!

...

বুকে তার বল্লমের শাবলের কত ক্ষত, কত অপমান
তবু সে জাগিত রাত্রি গান শুনে, পীড়িত নারীর অভিধান।

অদ্ভুত স্বীকারোক্তি, দেহজ প্রেমকে তিনি লুকিয়ে রাখেননি। তাকে ব্যক্ত করেছেন, নিজেকে সমর্পণ করেছেন সমগ্র সত্তা দিয়ে, দ্রোহ দিয়ে, মমতা দিয়ে। সেখানেই তার অবিরাম শঙ্কা, বিষাদ ভরা ক্ষয়। অভিমানে সে ভালোবাসাকে দূর দূর করছেন আর আত্মদহনে দহিত পরাণের গান করছেন

ভালোবাসা, তোকে বড় ভয় আসিস না, দুয়ারে আবার!
এখানে শ্মশান বড়, বড় বড় মরহম দীর্ঘশ্বাস, বড় জ্বালা অপমান!
এ নয় বাসর তোর, এ আসর বড় বেমানান!
...
ভালোবাসা কোমল নিঃশ্বাস তুই ফেলিস না এই ভুল ফুলে
ভালোবাসা তোকে বড় ভয়, তুই আসিস না দুয়ারে আবার।
[শঙ্কাধ্বনি]

বারবার কবির বিরহী আত্মা নিজেকে রক্তাক্ত করছে, খুন হয়ে যাচ্ছে তার সব রঙিন উজ্জ্বল প্রেমের দিন! বারবার দহনে দগ্ধ আত্মার স্বরলিপি লিখে গেছেন। এ শুধু প্রেমের নয়, সৃষ্টির দহন যন্ত্রণা।

লজ্জা আমার শরশয্যা,
প্রেম আমার চিতা।
বিরহে পোড়া একাকী রাত এখন আমার মিতা।
[দহন]

কিংবা আত্মলীনা কবিতায়

সত্যের গোপন ঘ্রাণ রাখো বক্ষে
রাখো ঐ আত্মার অনল উষ্ণ
তেজস্বী মনন-মনস্বীতা,
নিজের দহনে এত দুঃখিত হয়ো না।

ছোট্ট এই তিন লাইনের কবিতাটি মনে রাখবার মতো। স্লোগানধর্মী কবিতার পাশাপাশি তখনকার প্রবণতা ছিল ছোট ছোট লাইনের কবিতা, ব্যক্তিজীবনের দহন উগ্রে দেওয়া মূল উপজীব্য। কোনো কোনো কবিতার কিছু কিছু লাইন জনধর্মী ছিল, অনেকের মুখে মুখে ঘুরত। সে থেকে সুরাইয়া খানমও ব্যতিক্রম নন। কখনো কবিতাকে নিয়ে ছন্দে খেলেছেন তিনি

বাঘটা যখন ক্ষেপেই যায়
হরিণ শিশু কামড়ে খায়।
তেজি পায়ে দুলকি যায়
রক্ত আরো রক্ত চায়।

পরের কথা শুনিস না,
নিজের বন তুই জ্বালিস না!
[বাঘ ও হরিণ]

ছন্দের এই মিলের কারণে এটি ঠিক কবিতা না হয়ে ছড়াই হয়ে গেছে। এ রকম কিছু কবিতা আছে, যা ছড়ার মতোই হয়ে যায় অবশেষে। কবিতার যে আধ্যাত্মিকতা কিংবা অব্যাখ্যাত অধিবাস্তবতার যে জগৎ, সেখানে প্রায় পৌঁছাতে পারেনি তাঁর কবিতা। দর্শনশূন্য, প্রগলভ, অতিরিক্ত আবেগমথিত বাক্যবিন্যাস শেষ পর্যন্ত তাঁর কবিতা পোয়েটিক এসেন্স থেকে বিচ্যুত থেকে যায়। এই বিচ্যুতি আছে তাঁর অনেক কবিতায়। মননধর্মিতা বা স্পিরিচুয়াল জার্নি কবিতায় অনুপস্থিত থাকে। কবিতাগুলো একজন কবির উন্মেষকালের কাব্যিক উদ্যাপন। কবিতার উজ্জ্বল উচ্ছলতা আছে বটে, কিন্তু জীবনদর্শন কিংবা জীবনজিজ্ঞাসা, ইতিহাসচেতনা নেই। হতে পারে তিনি কবিতায় সেভাবে আর মনোনিবেশ করেননি বলে এ রকমটা ঘটেছে। বুনো হাতি, রক্ত, শাড়ি, মায়া কাননসে ধরনেরই কবিতা, বক্তব্যনির্ভর আবেগমথিত। তবে দেবতার আহার, সবুজ নাগরা সে ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন, রপকাশ্রয়ী, ব্যঙ্গমিশ্রিত বাক্যবিন্যাস পাঠককে অবাক করে কিছুটা।

হারালি কেন সবুজ নাগরা? চলতে পারতিস বেশ
এখন কেঁদে লাভ কি আছে, যুবক নিরুদ্দেশ।

ঘাঘরা দোলায় আঁধার মাথায় বাজছিলো যে শিস
সে ডাক শুনে ঘরের থেকে বেরিয়েছিলি, কেন?

কেঁদে কি লাভ, এখন মেলা ভেঙে গেছে, যুবক নিরুদ্দেশ।
[সবুজ নাগরা]

তবে মাতৃবন্দনা কবিতা সিরিজে তাঁর এক দৃপ্ত পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়, যেন অযুত সময়ের সাক্ষী হতে চলেছে এই কবিতা সিরিজটি। এখানে তিনি বেশ ঋদ্ধ, ধীর, সুদূরপিয়াসী, সমুদ্রগামী এক দীর্ঘ যাত্রার প্রস্তুতি

আমি স্ফিঙ্কস
সিংহের সাধনা আমি, মোহাবিষ্ট মধ্যবিত্ত নই
ধর্মের প্রগাঢ় কর্মযোগে আমি যুগে যুগে আন্দোলিত হই।

আমার থাবায় ফোটে সভ্যতার নতুন অক্ষর
বসত খামার নারী নদী ও মমতা—আমার অত্মায় নাচে অমর 
কবিতা
বীতশ্রদ্ধ বিবেকে টালমাটাল দেউলে জাহাজ
আমি দিই সমৃদ্ধ বন্দরে এনে—ভরে দেই প্রাণের সম্ভার।

প্রশ্ন করো, অন্ধকার সময়ের জারজ সন্তান!
প্রশ্ন করো, মরুচারী পিপাসার্ত অমৃতের প্রাণ।
[মাতৃবন্দনা ২]

আমার অত্মায় জাগে মৃত্যুঞ্জয়ী ওসিরিস-শষ্যের সন্তান;
আমি আসি
আমি আসি
কালো মানুষেরই পাশাপাশি।
ক্ষুধাতুর লজ্জাগুলি মুড়ে দিতে আমি ধানের কাতান।

তোমার নাচের শব্দ শুনি আমি আত্মার কান্নায়
জন্মের কাননে শুনি নৃত্যময় মৃত্যুর বোধন, শুনি জন্ম
কলহাস্যে আলিঙ্গনাবদ্ধা জননী-জননী: স্ফিঙ্কস ও আইসিস।
[মাতৃবন্দনা ৩]

মাতৃবন্দনা সিরিজের তিনটি কবিতা অনেক সমৃদ্ধ, দূরের যাত্রায় তার দৃষ্টি। সাম্পান তার ভেসেছে সমুদ্রে, ঢেউয়ের পরে ঢেউ এসেও সে যাত্রা যেন কেউ থামাতে পারে না। অনন্তকালের এই যাত্রা বাংলাদেশের সাহিত্যর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকল। আমরা পাঠক তাঁর কবিতার নাচের শব্দের ধ্বনি কান পেতে শুনি। সময়ের সাথে সাথে অজর অক্ষরগুলি আমাদেরকে জাগিয়ে রাখে কিছুক্ষণ, নিদ্রাহীন রাতের তারা সুরাইয়া খানম নিভে নিভে জ্বলে ওঠে অনন্তকাল। কারণ, তার হাড়ের মিনারে জেগেছিল যে আতরের সুগন্ধি, তার মৌতাতে মগ্ন থাকি পাঠক আমি কিছুক্ষণ। ভাবি, সৃষ্টির উন্মাদনা ছিল বলেই এতটা বছর পরেও এই আমি তাকে পড়ছি, ভাবছিকিছুটা সময়। তেমনি আরেক নতুন কবি এসেও তাঁর গ্রন্থখানি তুলে নেবে হাতে হয়তো, হয়তোবা না। সেটা সময়ই নির্ধারণ করে দেবে। আমরা সময়ের সন্তান সময়েই লীন হয়ে যাব, থেকে যাবে রক্তাক্ত অক্ষরলিপি।