বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের প্রবেশদ্বার শওকত আলী
১
নব্বই দশকের গোড়ার দিকেই বলা যায়, তারিখটাই উল্লেখ করা যাক না কেন, মার্চ ১৯৯২, বাংলাদেশের ছোট কাগজ নিসর্গ শওকত আলী সংখ্যা প্রকাশ করে। সরকার আশরাফ সম্পাদিত এই পত্রিকা শাহবাগের সেই সময়ের আজিজ সুপার মার্কেটের এক কোণে থাকা ছোট্ট পাঠক সমাবেশ থেকে সংগ্রহ করি। বলতে গেলে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া আমার এটাই প্রথম কোনো লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ করা। নিসর্গ পত্রিকার এই সংখ্যা একই সঙ্গে অনেক দুয়ার খুলে দেয়। এর সম্পাদকীয়তে জানতে পারি, হাসান আজিজুল হককে নিয়ে সংখ্যা করেছে বিজ্ঞাপনপর্ব, আর শামসুর রাহমানকে নিয়ে মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে নিয়ে একটি সংখ্যার কাজ করতে যাচ্ছে লিরিক পত্রিকা। এতে তন্নিষ্ঠ বা সিরিয়াস সাহিত্যের একটা সংজ্ঞাও দেওয়া হয়, ‘সমাজের ক্ষতগুলোকে কলমের নিবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যিনি বে-আব্রুভাবে তুলে ধরেন, সমাজের সত্যমিথ্যাগুলো সহজ সরল ভাষায় যিনি পাঠককে জানাতে পারেন—তিনিই সিরিয়াস সাহিত্যিক।’ পরে সুবিমল মিশ্রের খোঁজ পেলে দেখি তাঁর মুখেও ছিল প্রায় একই কথা। সুবিমলের মত হলো, তাঁর লেখা পড়ে কেউ পিঠ চাপড়ে দেওয়ার বদলে মুখে থুতু দিক এবং বলুক—এই লোকটা উপদংশসর্বস্ব সভ্যতার ঘাগুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার করে দিয়েছে।—এই যে সিরিয়াস, যেটাকে আমরা বাংলায় তন্নিষ্ঠ বলি, এর অবস্থান বাজার ও পাঠকের চাহিদামতো সরবরাহকৃত জনপ্রিয় মনোরঞ্জনকারী লেখার বিপরীতে। আরও পরে রোলাঁ বার্তের সূত্রে জানা হয়—তিনি দুধরনের লেখার কথা বলেছেন—রিডারলি টেক্সট ও রাইটারলি টেক্সট। রিডারলি টেক্সট পাঠক অবলীলায় প্রায় পড়তে পারেন, পড়তে পড়তে তেমন ভাবতে হয় না, কারণ সে লেখা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এমন ধারাবাহিকতা থাকে। আর রাইটারলি টেক্সট এই ধারাবাহিকতা ভেঙে দেয়। এতে থাকে নানান অস্পষ্টতা আর এর ভাষা হয় ইঙ্গিতময়। এখানে পাঠকের জন্য এমন কিছু শূন্যস্থান থাকে, যা পাঠক তার নিজের ভাবনা কল্পনা চিন্তা দিয়ে ভরাট করে। রোলাঁ বার্থ মনে করেন, জগতের সেরা লেখাগুলো বেশির ভাগই রাইটারলি টেক্সটের অন্তর্ভুক্ত। সেদিক থেকে তন্নিষ্ঠ সাহিত্যের সঙ্গে মূলত রাইটারলি টেক্সট মিলে যায়। তিনি লেখক বা রাইটার এবং অথর বা গ্রন্থকারেরও একটা ভেদ করেছিলেন। আমরা যেমন দেখি কবিতার বই, আর কাব্যগ্রন্থের তফাত করতে বলা হয়, নানান রকমের কবিতা জড়ো করে করা, যাতে ভাবগত তেমন ঐক্য নেই, সেটি হলো একজন কবির কবিতার বই, তা মূলত খণ্ড খণ্ড কবিতার বই; আর কাব্যগ্রন্থ হলো তাতে থাকা প্রতিটি কবিতা একটি সুসংহত ভাবের বাহন হয়ে দেখা দেয়। পৃথিবীতে তেমন কাব্যগ্রন্থ যেকোনো ভাষায়ই অপেক্ষাকৃত কম। বাংলা সাহিত্যে যেমন রবীন্দ্রনাথের বলাকা গতিবাদ ধারণ করা কবিতার সন্নিবেশ। ফলে সেটি, কাব্যগ্রন্থ। জীবনানন্দের রূপসী বাংলাও তা-ই, বাংলার ত্রস্ত্র নীলিমাকে পাওয়া যায় এর কবিতাগুলোতে।
নিসর্গের সেই সম্পাদকীয়তে জানা গিয়েছিল যে, শওকত আলীকে নিয়ে যে সংখ্যা হবে, তা করতে বিরত রাখার জন্য চেষ্টা করেছিল কেউ কেউ। বোঝা যায়, কিছু লোক শওকত আলীকে তেমন তন্নিষ্ঠ বা সিরিয়াস লেখক মনে করেন না, যাকে নিয়ে কোনো পত্রিকার আস্ত একটা সংখ্যা করা যায়। ফলে শুরু থেকেই তর্কটা জারি যে, শওকত আলী কতটা তন্নিষ্ঠ লেখক বা কতটা নন?—এ কথার বরাতে উত্তরটা দেওয়া যায় যে, শওকত আলী পড়ুন। বিশেষ করে তাঁর যাত্রা, দক্ষিণায়নের দিন [ত্রয়ী উপন্যাস—দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত, পূর্বদিন পূবরাত্রি], প্রদোষে প্রাকৃতজন, সম্বল, ওয়ারিশ, উত্তরের খেপ-এর মতো উপন্যাস এবং তাঁর ছোটগল্পগুলো পড়লে লেখক হিসেবে তিনি কতটা তন্নিষ্ঠ, সেটি পাঠকের কাছে স্পষ্ট হবে।
আমাদের কারও কারও একটা ধারণা আছে যে, প্রেম নিয়ে লেখা মানেই তন্নিষ্ঠ সাহিত্য নয়। যে-লেখা বিশেষ করে রাজনীতি ইতিহাস ও মনোবিশ্লেষণে ভরা, যে-লেখায় সমাজ রাষ্ট্র ইতিহাস দর্শনের দেখা মেলে, সেসবই তন্নিষ্ঠ লেখা। সবচেয়ে বড় কথা একটি প্রকৃত প্রেমের উপন্যাস লেখা এবং প্রেমকে নতুন চোখে দেখা ও দেখানো যারপরনাই কঠিন কাজ। প্রেম-যৌনতানির্ভর লেখা মানেই সিরিয়াস কিছু নয়—এমন আগাম ধারণা নিয়ে পড়া গল্প-উপন্যাস সাহিত্য পাঠের উদ্দেশ্যটাইকে সম্পন্ন করে না। কী সে উদ্দেশ্য? উদ্দেশ্য মূলত দুটি—সাহিত্য পড়ার ভেতর দিয়ে জীবনবোধ [সেন্স অব লাইফ] আরেকটি হলো ভাষাবোধ [সেন্স অব ল্যাঙ্গুয়েজ]—এ দুটিকে উন্নততর করা। সাহিত্য পড়ার ভেতর দিয়ে পাঠক মূলত এই দুয়ে ঋদ্ধ হয়ে একটি আনন্দলোক তৈরি করতে পারে। বলা বাহুল্য, এ আনন্দ মানে আস্বাদের আনন্দ, ফুর্তির বা আমোদের নয়। ভারতীয় কাব্যাদর্শে আনন্দ শব্দটি বোধ করি ইংরেজি ‘প্লেইজারের’ চেয়ে বহুমাত্রিক।
শুরুতে লেখক হিসেবে শওকত আলীর পরিসর ও অবস্থানটাও একটু দেখে নেওয়া যেতে পারে—
কলেজে পড়ার সময় বহু তরুণের মতো আমিও আন্দোলনে শামিল হয়েছি, আর তাতে কারাবাসেও যেতে হয়েছে। স্বল্পকালে হলেও কারাবাসের অভিজ্ঞতা নানান দিকে নজর দিতে শিখিয়েছে। তেভাগা আন্দোলনে যাঁরা শরিক ছিলেন সেই সব মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করার সুযোগ হয়। ক্রিমিনালদের সঙ্গেও গল্পগুজব হতো। সবাই ক্রিমিনাল ছিল তা নয়। ময়মনসিংহ অঞ্চলের কৃষক আন্দোলনে শরিক হাজংদের নানান ধরনের ফৌজদারী মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে জেলে সাজা খাটানো হয়েছিলো—তাঁদের সঙ্গে প্রায়ই আলাপ হতো।
কারাবাস শেষে কলেজের পাট চুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় গৃহশিক্ষকতার সুবাদে ঢাকার মধ্যবিত্ত পরিবারে নাগরিক জীবনযাপনের টানাপোড়েনের ঘটনা চোখে পড়ে। তরুণদের রাজনীতি আর সংস্কৃতিচর্চা ও লেখালেখি অথবা প্রেম ভালোবাসা কিংবা প্রতারণা বা স্বার্থপরতা সংক্রান্ত বহু কিছু জানার সুযোগও ঐ সময়ে হয়। তারপর ঠাকুরগাঁও কলেজে শিক্ষকতা করার সময় ঐ অঞ্চলের গরিব কৃষিজীবী মানুষের সঙ্গেও মেলামেশা করতে ভালো লাগতো। বিশেষ করে আদিবাসী রাজবংশী আর সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সঙ্গে। ঠাকুরগাঁও আর দিনাজপুর যাওয়া আসার পথে বাস ড্রাইভার হেলপারদের সঙ্গে পরিচিত হই, বন্ধুত্বও হয় অনেকের সঙ্গে। কর্মজীবনে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা হওয়ার ফলে আমার এই ধারণা জন্মায় যে আমরা, ভদ্রলোকরা, এঁদের থেকে আলাদা। এঁদের চিন্তাভাবনা, জীবনযাপন, সবই অন্যরকম, যার নাগাল সহজে পাওয়া যায় না। অথচ পুরো সমাজটা দাঁড়িয়ে এঁদেরই ওপর।
শওকত আলীর লেখার ভেতর দিয়ে প্রথম যেটি ঘটে তা হলো: যে অঞ্চলটায় আমরা বাস করি, বাংলাদেশ; যে পরিচয়ে বাস করি, বাঙালি এবং বাংলাদেশি, তার উৎস থেকে ধারাগতি, আদতে পরম্পরার সঙ্গে পরিচয়। প্রদোষে প্রাকৃতজন পড়া শুরু করলেই যেকোনো পাঠক টের পাবেন [বিশেষ করে তিনি যদি বাঙালি হন] তিনি এমন এক অতীতের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যাচ্ছেন, যা সুগভীরভাবে আজও তার ভেতরে ক্রিয়া করে চলেছে। এ কাজটাই শওকত আলী অন্যভাবে করেন তাঁর ত্রয়ী উপন্যাস/ট্রিলজি হিসেবে খ্যাত দক্ষিণায়নের দিন [ত্রয়ী উপন্যাস—দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত, পূর্বদিন পূবরাত্রি]-এ। বলা বাহুল্য নয়, যে ইতিহাসের ধারায় আগের প্রসঙ্গের ওপর উপন্যাস তিনি ধারাবাহিকভাবে লেখেননি। আগেরটা পরে, পরেরটা আগে—এমন করে সারা জীবনই তিনি লিখে গেছেন। যেমন, মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস যাত্রা প্রকাশিত হয় উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে লেখা অবশেষে প্রপাতের আগে। দেশভাগের পটভূমিতে ওয়ারিশ লেখা হয় তারও পরে। অনেকটা আত্মজৈবনিকতার রং পাওয়া বসত আবার ওয়ারিশেরও পরে। দলিল লেখেন নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে। এক অর্থে ১৯৪৭ থেকে ১৯৯০ সাল অব্দি বাংলাদেশের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতার উপন্যাসায়ন [নভেলাইজেশান] করেছেন তিনি। এমনকি তাঁর অপেক্ষাকৃত গৌণ রচনা বলে যদি কিছু উপন্যাসকে চিহ্নিত করতে চাই, সেসবেও তিনি ব্যক্তি-মানুষকে সমাজ শ্রেণি রাজনীতির বিবর্তনের ভেতরেই গেঁথে দেন, তা সে রচনা প্রেমকাহিনী বা ভালোবাসা কারে কয় হোক, বা অপেক্ষা হোক বা পতন বা বাসর ও মধুচন্দ্রিমা-ই হোক।
বাঙালির আত্মপরিচয় যেমন খুঁজেছেন প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসের ভেতর দিয়ে, তেমন পর্যবেক্ষণ করেছেন বাঙালির আত্মবিকাশকে এর আগে-পরে লেখা সব উপন্যাসের ভেতর। সেটি বেশির ভাগ অর্থে বাঙালি মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ হলেও ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে মূলধারার অংশ হয়েই থাকে। তিনি মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক-সামাজিক চেতনার পর্যবেক্ষণ করেন উপন্যাসে, কিন্তু ছোটগল্পে তাঁর নজর চলে যায় সমাজের প্রান্তিক হতদরিদ্র মানুষের জীবনে। সেখানে শ্রেণিদ্বন্দ্ব, শোষণ আর প্রতিবাদের প্রগাঢ় আততি আমরা টের পাই। এটা বেশ লক্ষণীয় বাংলা যে, উপন্যাসের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ নিম্নবিত্ত গ্রামের সাধারণ মানুষদের প্রায় আনেননি, কিন্তু তার ছোটগল্পের বড় অংশজুড়ে আছে গ্রাম নদী নিসর্গে ছেয়ে থাকা সাধারণ মানুষ। শওকত আলীর ক্ষেত্রে উপন্যাসে যে একেবারেই তা আসেনি তা নয়। মাদারডাঙ্গার কথা উপন্যাসটি এর দৃষ্টান্ত।
ছাত্রজীবনে বামপন্থী রাজনীতি, জেলে থাকা নিশ্চয়ই তাঁকে জীবনের অন্য নিরিখ তৈরি করে দিয়েছিল। এ দেশের প্রাণভোমরা কোথায়—সেটি তিনি তাঁর মতো করে বুঝে নিয়েছিলেন, দেখে নিতে চেয়েছিলেন। এই দেখাকে লেখায় আনার কাজটিই করে গেছেন। এতে জীবনের গূঢ় গভীর অনুভব যে আসেনি তা তো নয়। এক দক্ষিণায়নের দিনের রাখীর জীবনই শওকত আলী জীবনবীক্ষাকে দেখিয়ে দেয়। রাখীর স্বামী জামানের আত্মস্বার্থ আর শিশ্নদোরপরায়ণ জীবনের বিপরীতে গণমানুষের সংগ্রামে যুক্ত হওয়া রাখী নানান অর্থে বাংলাদেশের উপন্যাসের এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এমন বেশ কিছু চরিত্র তিনি হাজির করেছেন তাঁর তন্নিষ্ঠ উপন্যাসগুলোতে।
তিনি যে ছোটগল্পগুলো লিখেছেন, তাতেও লেখক হিসেবে তন্নিষ্ঠতা কম নয়। যদিও অনেকেই বেশির ভাগ ছোটগল্প যৌনতার ভিয়ানে পরিবেশিত বলে একটা ‘ভুল-পাঠ’ তৈরি করে নিয়েছেন। ‘রঙ্গিনী’, ‘ফাগুয়ার পর’, ‘ভগবানের ডাক’, ‘পুশনা’, ‘কপিলদাস মুর্মুর শেষ কাজ’, ‘তৃতীয় রাত্রি’, ‘আর না কান্দে মা’, ‘নবজাতক’, ‘লেলিহান স্বাদ’, ‘ভবনদী’, ‘নয়নতারা কোথায় রে’, ‘পুনর্বার বেয়নেট’, ‘অচেনা’, ‘অন্ধকারের গান’, ‘দুই গাজুয়া’, ‘ডাকিনী’ প্রভৃতি ছোটগল্প বাংলা ছোটগল্পের ‘তান্ত্রিকসাধনা’র সিদ্ধিকে মনে করায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ বসু থেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, কি সমসাময়িক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজদের মতো লেখকদের সমানতালে তাঁকে স্মরণ করায়। পাশাপাশি সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস থেকে কায়েস আহমেদ হয়ে শহীদুল জহির অব্দি বাংলা ছোটগল্পের সমৃদ্ধ স্রোতের অন্যতম তরঙ্গের নাম হয়ে ওঠেন শওকত আলী। ছোটগল্পের বই প্রকাশিত হয়েছিল পাঁচটি—উন্মূল বাসনা, লেলিহান স্বাদ, শুন হে লখিন্দর, বাবা আপনে যান ও দিনগুজরান। তাঁর গল্পের সংখ্যা সত্তরের কাছাকাছি। অন্যদিকে আছে বত্রিশটির মতো উপন্যাস। ১৯৬৩ সালে পিঙ্গল আকাশ প্রকাশের ভেতর দিয়ে তাঁর শুরু।
২
শওকত আলী সম্পর্কে কেউ কেউ ধারণা করেন, তিনি খুব ‘একাডেমির সচেতনতায়’ গল্প-উপন্যাসগুলো লিখেছেন। মানে, খুব ভারসাম্যময় লেখা তার, মেপেজুখে লেখা। ভাষাগত দিক থেকে পুরোটাই সহজ প্রাঞ্জল সাবলীল। ততটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই ভাষায় ও কাঠামোতে। তাঁর ভাষা তন্নিষ্ঠ পাঠকের ভাষাবোধে তেমন কোনো আলোড়ন তোলে না। ফলে লেখক হিসেবে তাঁর সামগ্রিক চেষ্টাই বলতে গেলে একরকমের খামতি থেকে গেছে।—এসব অভিযোগ-অনুযোগ যদিও তেমনটা নথিবদ্ধ নয়, বা লিখিত হয়নি, কিন্তু মুখে মুখে ছড়ানো।
আমরা অনেকেই খেয়াল করি না যে, ঔপন্যাসিক মানেই ভাষাশিল্পী নয়, বা ভাষাশিল্পী হলেই উপন্যাস রচনা করা যায়। দুর্বোধ্যতা অতিজটিল গঠনই উপন্যাসের প্রধান দিক হতে পারে না। বলা হয়, তলস্তয়ের সুবিশাল উপন্যাস যুদ্ধ ও শান্তিতে একটি বাক্যও নেই, যা অস্পষ্ট বা দুর্বোধ্য। অন্যদিকে জেমস জয়েস, মার্সেল প্রুস্ত, রবার্ট মুসিল বা হারমেন ব্রচের রচনার ভাষাগত জটিলতায় সেগুলো পড়ে ওঠা পর্বত আরোহণের মতো পরিশ্রমসাধ্য। ইউরোপীয় নিরিখের কথা বাদই দিলাম, বাংলা ভাষায়ই কমলকুমার ও অমিয়ভূষণ মজুমদারের লেখা পড়তে পাঠককে নিজের মতো করে ভাষাভেদ করার মনটায় ধার দিতে হয়। দেবেশ রায় বা রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাও কোনোভাবেই সুখপাঠ্য নয় তাঁদের ভাষার জটিলতায়। অন্যদিকে অসীম রায় থেকে রবিশংকর বল, হাসান আজিজুল হক থেকে শহীদুল জহির তন্নিষ্ঠ লেখক হলেও পাঠককে মজিয়ে দিতে পারেন। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় পারেন আরেক ধরনে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কি মতি নন্দীর আছে ভাষাগত দিকে আলাদা মাত্রা। লেখার ক্ষেত্রে ভাষা বড়ই ‘ভাইটাল’। শওকত আলীর ভাষা সেদিক থেকে নতুনত্ব যেমন ধারণ করে না, তেমন প্রাচীনত্বকেও নয় [প্রদোষে প্রাকৃতজনের ভাষা আলাদা বিবেচনায় আনতে হবে]। তিনি তাঁর সমকালের বাংলা গদ্যের মূল কাঠামো মেনেই এগিয়েছেন। ভাষায় ততটা ভাঙচুর ঘটাননি। এই সঙ্গে বলা যায়, তারাশঙ্কর যেমন বিপুল পরিমাণ রচনার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে সেরা কিছু উপন্যাস ও ছোটগল্পের স্রষ্টা, শওকত আলীও বাংলাদেশের সাহিত্যে অন্য অনেকের তুলনায় সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি তন্নিষ্ঠ উপন্যাসের লেখক। কথাটা ইলিয়াস ও মাহমুদুল হককে মাথায় রেখেও বলা। অন্যদিকে ইলিয়াসের বহির্মুখিতা ও মাহমুদুল হকের অন্তর্মুখিতার যেন মাঝামাঝি ধরনের গড়ন পেয়েছে শওকত আলীর উপন্যাসগুলো, মানে গণপরিসর ও মনোজগৎ—দুয়ের ঠাঁই আছে সেখানে। বিশেষ করে শওকত আলী ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পাশাপাশি পড়লে বোঝা যায়, প্রায় একই বিষয় দুজনে দুভাবে লিখেছেন। বিষয়ের বিস্তারে প্রসারে তাঁরা প্রায় একই। আদতে দুজনের রাজনৈতিক মতাদর্শ, সাহিত্যরুচিও ছিল অনেকটা কাছাকাছি। একদিক থেকে ধরলে ইলিয়াস তো শওকত আলীরই [তাঁরা প্রায় সমসাময়িক হলেও] উত্তরসাধক।
ফলে বাংলাদেশের সাহিত্যের যে কজন তন্নিষ্ঠ লেখক ও তাঁদের তৈরি রচনাবলি, তাতে প্রবেশ করতে হলে শওকত আলীর রচনা হয়ে ওঠে একধরনের প্রবেশদ্বার। কেননা উপন্যাস লিখতে হলে যে ইতিহাস, রাজনীতির ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে হবু তন্নিষ্ঠ লেখক ও পাঠককে যেতে হয়, শওকত আলীর গল্প-উপন্যাস তাতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। প্রদোষে প্রাকৃতজন থেকে উপন্যাসের মাধ্যমে বাঙালি জীবনের বিবর্তনকে বিষয় হিসেবে হাজির করে করে একের পর এক উপন্যাস লিখে সেসবকে তিনি যদি তাঁর ত্রয়ী উপন্যাস দক্ষিণায়নের দিনের সঙ্গে জুড়ে দিতে পারতেন, তাহলে আমরা হয়তো বাংলাদেশের বৃহত্তম মহাবয়ানের [গ্রান্ড ন্যারেটিভ] মুখোমুখি দাঁড়াতে পারতাম।
আমাদের জানা আছে, গত শতকের প্রায় ষাটের দশক থেকেই ‘উপন্যাসের মৃত্যু হয়েছে, উপন্যাসের আর কিছু করার নেই’—এমন একটা শোর তন্নিষ্ঠ সাহিত্য সমালোচকেরাও তুলেছিলেন। যেমন, জর্জ স্টেইনারের মতে—
The novel embodies the linguistic conventions, the psychology, the habits of sensibility, the code of erotic and economic power relations, of precisely that middle-class civilization which is now passing.
স্টেইনারের মতে, উপন্যাসের সবচেয়ে ফলনশীল কাল ছিল ১৮৩০ থেকে ১৯৩০, অর্থাৎ বালজাক থেকে প্রুস্ত ও জয়েসের কাল অব্দি, কিন্তু ষাটের দশকে এসে সে সময় চলে গেছে। দুটো বিশ্বযুদ্ধ এবং ইউরোপীয় অর্থনৈতিক আধিপত্যের ক্ষয় উপন্যাসকেও ক্ষয়িত করে দিয়েছে।—এদিকটি বিচার করলে দেখা যাবে, বাংলা উপন্যাস তো তাহলে উপন্যাসের যখন সব সম্ভাবনা নির্বাপিত, ঠিক তখন জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। বিভূতি-তারাশঙ্কর-মানিক—এই তিন বাড়ুজ্জের হাতে বাংলা উপন্যাসে জয়যাত্রা শুরু হয়েছে তখন। এরই ধারাবাহিকতায়ই পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তানে, পরে বাংলাদেশে উপন্যাসচর্চা গতি পায়। সেই গতিশীলতায় যাঁরা ভূমিকা পালন করেছেন, শওকত আলী তাঁদের অন্যতম।
ইউরো-আমেরিকান নিরিখ, তা-ও একজন মার্কিন সাহিত্য সমালোচকের বরাতে আমরা এই উপমহাদেশের ক্ষেত্রে খাটতে দেখি না। কারণ, যেখানে ইউরোপের উপন্যাস লেখার সমাপ্তি, ঠিক সেখান থেকে ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য প্রচেষ্টার সূচনা হয়। কেবল তা-ই নয়, লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে আসে নতুন সাহিত্যের জোয়ার। হুয়ান রুলফো, আলেহো কার্পেন্তিয়ের, হুলিয়ো কোর্তাজারেরা পথ তৈরি করে দেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, কার্লোস ফুয়েন্তেস আর মারিও ভার্গাস ইয়োসাদের জন্য। অন্যদিকে ইউরোপে গুন্টার গ্রাস, মিলান কুন্দেরা, জোসে সারামাগোদের হাতে ভিন্ন আদল পায় উপন্যাস, পাশাপাশি ভি এস নাইপল কি সালমান রুশদিদের হাতে ‘পোস্ট কলোনিয়াল’ উপন্যাসের ভিন্ন মানদণ্ড তৈরি হয়ে গেছে। হাজির হচ্ছেন আরও কত না লেখক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড বার্থলেমে থেকে টমাস পিনচন হয়ে ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসের হাতে উপন্যাসের আগের বহু কিছু গুঁড়িয়ে নতুন করে গড়ে ওঠে। আমরা এরই সমান্তরালে শওকত আলীর উপন্যাসকে আমাদের জায়গা থেকে পাঠ করতে পারি। তাতে কেবল ‘কীভাবে’র প্রশ্নেই নয়, ‘কী’-র প্রশ্নেও দেখি, এখানে লেখা হচ্ছে এমন উপন্যাস ইউরো-আমেরিকান জগতে সে উপন্যাস লেখার কথাই ভাবা যায় না। শওকত আলীদের প্রজন্মই বাংলা ও বাংলাদেশের উপন্যাসের আলাদা নিরিখ তৈরি করে দিয়েছেন। আর সেখানে ব্যক্তি-লেখক শওকত আলীর ভূমিকার কিছু দিক আমরা ইতিমধ্যে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
শওকত আলী বাংলাদেশের বাংলা গল্প-উপন্যাসের একটি স্তম্ভের নাম। বাংলাদেশের উপন্যাসের নাড়ির টানে যারা তাঁর রচনার কাছে যাবেন, তাদের লাভের ভাণ্ডারে অনেক কিছুই যোগ হবে। আর যারা যাবেন না, তারা বাংলাদেশের বাংলা উপন্যাসের একটি বড় দিক থেকে নিজেদের বঞ্চিত করবেন।