কেমন আছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান?
দুনিয়ার আর দশটা দেশে যেমন সংখ্যালঘুর সংকট নিয়ে রাজনীতি হয়। তাদের বানানো হয় ভোটব্যাংক। তার বাইরে নয় পশ্চিমবঙ্গও। তাই তো ভোট এলে সুসময় আসে যেন মুসলমানদের। প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে যায়। ভোট শেষ হলে পরেও আজকাল থাকে তার রেশ। ইমাম, মুয়াজ্জিনরা পান সরকারি ভাতা; বিশেষ স্বীকৃতি পায় উর্দু ভাষা; সুবিধা পায় মাদ্রাসা। কিন্তু মূলধারার শিক্ষায়, চাকরিতে পেছনেই রয়ে যায় বাংলার মুসলমানরা।
তখন ভারতে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটে গেছে। এই উপমহাদেশে হিন্দু আর মুসলিম—এ দুই ধর্মাবলম্বী বিবেচনায় আলাদা দুই মানচিত্র চূড়ান্ত। ভাগ হয়েছে বাংলা। পাকিস্তানে বাঙালি হিন্দু সংখ্যালঘু। ভারতে একই পরিস্থিতিতে পড়েছে বাঙালি মুসলমান। বাংলার সরকারে মুসলিম লীগ থাকলেও দলটির নেতাদের জন্য খোদ কলকাতা নিরাপদ রইল না। তরুণ রাজনীতিক শেখ মুজিবুর রহমান তাই চলে আসবেন ঢাকায়। বিদায় নিতে গেছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে। তাঁকেও পাকিস্তান যাত্রার আহ্বান করলেন মুজিব। জবাবে তিনি বললেন, ‘যেতে তো হবেই, তবে এখন এই হতভাগা মুসলমানদের জন্য কিছু একটা না করে যাই কী করে?’ মিলন দত্ত বিরচিত ‘কেমন আছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান’ বইটির নামকরণ দেখেই মনে পড়ে যায় বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে থাকা এই ঘটনা। একদা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে আদতেই পাকিস্তান চলে যেতে হয়। কিন্তু তখনো বাপের ভিটা পশ্চিমবঙ্গেই রয়ে যায় অনেক অনেক মুসলমান।
মিলন দত্তের রচনায় যেনবা সোহরাওয়ার্দীর সেই ‘হতভাগা’দের পরম্পরা উঠে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি-অবাঙালি মুসলমানের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতির বহুরৈখিক চিত্র আয়নার প্রতিফলনে কিংবা আতশি কাচের প্রতিসরণে তুলে ধরেছেন তিনি। যেখানে মিলছে যে, ঠিক শিকড়ের টানে নয়, কোনো উপায় নেই বলেই গ্রামের গরিব মুসলমান কৃষক পাকিস্তান যাত্রা করেনি। নিশ্চয়তা ছিল বলেই সেই যাত্রার সুবিধা নিয়েছে অভিজাত, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি। যেনবা আশরাফরা পেছনে ফেলে গেল আতরাফদের। সেই অনভিজাত কেউ কেউ কিন্তু তিন পুরুষে এসে ভাগ্য বদলাতে পেরেছেন, হতে পেরেছেন শরাফত। উপমা টানি আলোচ্য বই থেকেই—‘চাষি বাঙালি মুসলমান ব্যবসায়ী হয়ে উঠছেন। যেমন পশ্চিমবঙ্গে বিড়ির উৎপাদন এবং বাণিজ্যের পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করেন বাঙালি মুসলমানরা। তাঁরা অনেকেই রাজ্যের বিশিষ্ট ধনী ব্যক্তি হিসেবে মান্যতা পান।’
দুনিয়ার আর দশটা দেশে যেমন সংখ্যালঘুর সংকট নিয়ে রাজনীতি হয়। তাদের বানানো হয় ভোটব্যাংক। তার বাইরে নয় পশ্চিমবঙ্গও। তাই তো ভোট এলে সুসময় আসে যেন মুসলমানদের। প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে যায়। ভোট শেষ হলে পরেও আজকাল থাকে তার রেশ। ইমাম, মুয়াজ্জিনরা পান সরকারি ভাতা; বিশেষ স্বীকৃতি পায় উর্দু ভাষা; সুবিধা পায় মাদ্রাসা। কিন্তু মূলধারার শিক্ষায়, চাকরিতে পেছনেই রয়ে যায় বাংলার মুসলমানরা। আজও পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম শিশুদের ৪৭ শতাংশের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শেষ করে তাদের শিক্ষাজীবন। অন্যদিকে বাংলাদেশে বর্ণপরিচয়ে এখনো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে ধারা, তা অনুসরণ করা হয় অনেকাংশে। অথচ ‘মুসলমানের বর্ণপরিচয়’ শীর্ষক অধ্যায়ে মিলন দত্ত জানাচ্ছেন, ‘এক মত/এক পথ/ইসলামী/শরীয়ত।/কিছু চাও/তোল হাত,/ক’রে নাও/ মোনাজাত।’ পশ্চিমবঙ্গের কিছু জেলায় এভাবেই প্রথম পাঠ নিচ্ছে মুসলমান শিশুরা।
কিন্তু মূলধারায় যারা ভালো করে, তারা কেমন আছে—এ বিষয়ে তেমন কিছু লেখেননি মিলন দত্ত। সাম্প্রতিক এক প্রসঙ্গ টেনে বিষয়টিতে আলো ফেলতে চাই। যেখানে উচ্চমাধ্যমিকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে সর্বাধিক নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছেন মুর্শিদাবাদের রুমানা সুলতানা। অথচ ফল ঘোষণার সময় উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের প্রধান মহুয়া দাস সেই মেধাবীর পরিচয়ে বলেন, ‘মুসলিম কন্যা’। সংখ্যালঘুর কৃতিত্বও যে সংখ্যাগুরুরা সোজা হিসেবে নেয় না, সেটাই যেন এ ঘটনায় উপস্থাপিত হয়েছে। আশার কথা হচ্ছে, কলকাতার সুশীল সমাজসহ রাজনীতির মহল থেকেও এই নেতিবাচক উপস্থাপনার সমালোচনা হয়েছে। আর শিক্ষায় যে নারীরাও এগিয়ে চলেছে, সেটাও ফলাফল থেকে প্রমাণিত হয়েছে। বইটির আগামী সংস্করণে হয়তো বিষয়টির অবতারণা করা হবে।
বইয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানের সংকটের নানা দিকই প্রাধান্য পেয়েছে। উচ্চশিক্ষা, পেশা, সরকারি সহায়তা—এমন বিষয়ের কিছু অগ্রগতিও আছে। কিন্তু বইটির যে মূল সীমাবদ্ধতা, সেটা লেখক নিজেই দিয়েছেন প্রস্তাবনা অংশে। সেখানে তিনি বলছেন, ‘প্রায় ত্রিশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজকে বোঝার চেষ্টা করার পরও সবটা যে বুঝে উঠতে পেরেছি, এমন দাবি আজ করি না। সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের কারও পক্ষে সংখ্যালঘুর সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা বুঝে ফেলা সহজ নয়। সংখ্যালঘুর কিছু গোপন অভিমান থাকে, লুকানো ব্যথা থাকে, থেকে যায় কিছু একান্ত ক্রোধ, হতাশা―তার অনেকটা হয়তো ছুঁতে পারি, অনেকটা পারিনি।’
শিক্ষার কথা তো হলো, সংস্কৃতির বিচারে যদি আসা যায়, তবে কতটা এগোতে পেরেছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান? কলকাতার বড় পর্দা বলুন, ছোট পর্দা বলুন—সেখানে যেসব বাংলা কাহিনিচিত্র উপস্থাপিত হয়, সেখানে বাঙালি মুসলমান যুবক মানেই চোখে সুরমা, গলায় রুমাল; নয়তো মুখে দাড়ি, মাথায় টুপির কোনো মানুষ। এটা আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠের চোখে সংখ্যালঘুকে দেখা। বাংলাদেশে বসে আমাদের প্রায়ই দৃষ্টিকটু মনে হয় এটা। এই দৃষ্টি আবার একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আলোচ্য বইয়ে থাকা জ্যোতি বসুর একটি অভিজ্ঞতার বয়ানই তার প্রমাণ রাখছে। যেখানে সাবেক এই মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য সরকারের তখনকার তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে নির্দেশনা দিচ্ছেন এভাবে, ‘বুদ্ধ, আমি দেখছি, বাংলাদেশের মুসলমান ছেলেমেয়েরা কত সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত আর অন্যান্য গান করছে। এখানে তো মুসলমানরা আছেন, তাঁদের মধ্যে তো এসব দেখি না। এসব দেখো।’ বাঙালি মুসলমান বাংলাদেশে এক রকম। আবার পশ্চিমবঙ্গে আরেক রকম। আত্মপরিচয়ের সংকটে থাকা সংখ্যালঘু যে সংকোচনের পথ বেছে নেয়, এ কি তারই আলামত? আবার তুলনামূলক উদারবাদী সুফিবাদ থেকে কট্টর ওয়াহাবি ধারায় ঝুঁকে পড়ার যে প্রবণতা পশ্চিমবঙ্গে, তার গভীরতর কারণ স্পষ্ট করতে পারেননি মিলন দত্ত। কিন্তু ললিতকলার চর্চা থেকে দূরে থাকা নিয়ে এক ধরনের হাহাকার রয়েছে নানাজনের। তবে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মূলধারায় প্রতিষ্ঠিত যারা প্রগতিবাদিতার নামে নিজের মুসলিম সমাজ ভুলে যান। তাদের এগিয়ে নিতে কোনো ভূমিকা রাখেন না। তাদের বিষয় আসেনি বইখানিতে।
আরও একটি বিষয় নিয়ে আগ্রহী ছিলাম পাঠক হিসেবে। সেটা হলো, সংখ্যালঘুর ভূমিসংকট। আমাদের দেশে হিন্দু সম্পত্তি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা কাটেনি প্রায় সাড়ে সাত দশকেও। এর সূচনা ভারত-পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই। সংখ্যালঘু মুসলিমদের একটি অংশ শুরু থেকেই লোভাতুর চোখ দেয় সংখ্যালঘুর ভূমিতে। তারপর দাঙ্গা, যুদ্ধ, ভোটের রাজনীতি—নানা কারণে হিন্দুরা দেশ ছেড়েছে। পেছনে ফেলে আসা তাদের সম্পদ দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। কখনোবা সম্পদ হাতাতেই তাদের বিতাড়িত করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুদের এমন বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে কি না, এ বিষয়টি জানা যায়নি বই পড়ে। তবে বাংলা-ভাগে বাঙালির বিড়ম্বনায় অবশ্যই দুই বাংলা চলে আসবে। কিন্তু একটা বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, পুর্ববঙ্গ আর সেই জায়গায় নেই। সে বাংলাদেশ—৫০ বছর বয়সী স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। তাই ভারতের সংখ্যালঘুর অবস্থার বিপরীতে বাংলাদেশকে দেখতে হবে; রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তুলনা হতে পারে না। অবশ্য মিলন দত্ত পুরো ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের কিছু কিছু চিত্রও তুলে ধরেছেন পশ্চিমবঙ্গের বিষয়টি তুলনা করতে।
আলোচ্য বইখানিতে পরিসংখ্যানের মাধ্যমে মুসলমানদের পরিস্থিতি উপস্থাপনে জোর দিয়েছেন। ফলে সরস গদ্যের দিকে নজর রাখতে পারেননি। যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এনজিওধারার প্রকাশনা মনে হতে পারে পাঠকের কাছে। তাই পাঠের চেয়ে তথ্যসূত্র হিসেবে ‘কেমন আছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান’ বেশি সমাদর পাবে গবেষক মহলে।
বইয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানের সংকটের নানা দিকই প্রাধান্য পেয়েছে। উচ্চশিক্ষা, পেশা, সরকারি সহায়তা—এমন বিষয়ের কিছু অগ্রগতিও আছে। কিন্তু বইটির যে মূল সীমাবদ্ধতা, সেটা লেখক নিজেই দিয়েছেন প্রস্তাবনা অংশে। সেখানে তিনি বলছেন, ‘প্রায় ত্রিশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজকে বোঝার চেষ্টা করার পরও সবটা যে বুঝে উঠতে পেরেছি, এমন দাবি আজ করি না। সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের কারও পক্ষে সংখ্যালঘুর সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা বুঝে ফেলা সহজ নয়। সংখ্যালঘুর কিছু গোপন অভিমান থাকে, লুকানো ব্যথা থাকে, থেকে যায় কিছু একান্ত ক্রোধ, হতাশা―তার অনেকটা হয়তো ছুঁতে পারি, অনেকটা পারিনি।’
তাই বুঝি প্রস্তাবনায়ই লেখক আশা করছেন, ‘আহমদ ছফা যেমনটা লিখেছিলেন “বাঙালি মুসলমানের মন”―হয়তো কোনো দিন এ বাংলার কোনো মুসলমান বুদ্ধিজীবী রচনা করবেন “পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানের মন”। আমরা অপেক্ষা করব।’ সেই অপেক্ষার সময়ে পাঠকের খোরাক মেটাতে দারুণ কাজে দেবে মিলন দত্তের বইখানি। পাঠকের পঙ্তিতে বসে সেই নিশ্চয়তা দিয়ে যাচ্ছি এর নবাগত পাঠকদের।