কামুর ‘অবরোধ’ নাটকে গণমানুষের স্বপ্ন
আলবেয়ার কামুর সেই বিখ্যাত উক্তি দিয়ে লেখাটি শুরু করা যাক—‘আমার সামনে দিয়ে হাঁটবে না, হয়তো আমি অনুসরণ করতে পারব না, আমার পেছনে হাঁটবে না, কারণ আমার নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা নেই, আমার পাশাপাশি হাঁটতে পারো এবং আমার বন্ধু হতে পারো।’ কামু তাঁর এই উচ্চারণে প্রতিটা শব্দের সঙ্গেই ছিলেন সৎ এবং অঙ্গীকারবদ্ধ। তাঁর এই মন্তব্যে স্পষ্টতই সাম্যের সন্ধান পাই। তিনি সাহিত্যে গণমানুষের মুক্তির কথা বলেছেন। মানুষের প্রকৃতগত সহজাত শক্তির কথা বলেছেন। জীবনের নির্মম পরাজয়ের কথা তুলে ধরেছেন। আবার পাশাপাশি জীবনের অ্যাবসার্ডিটি তত্ত্বকেও প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর ‘অবরোধ’ [The state of siege] নাটকটিও এর ব্যতিক্রম নয়। নাটকটিতে মানুষের শক্তি এবং স্বপ্নকে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন কামু। মানবতার জন্য আর মানুষের মুক্তির আন্দোলনে সাহিত্যের ভাষাকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। বক্তৃতা নয়, বরং কাজ দিয়েই মানুষ তাঁর নিজের নিয়তির গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে বলে কামুর বিশ্বাস। সে কারণে তাঁর অদৃষ্টবাদের ওপর বিশ্বাস খুব একটা ছিল না। কামু নিজেই মনে করতেন, ‘কেউ কেউ ঘুমের মধ্যে কথা বলে আবার কেউ যখন কথা বলে তখন অন্যরা ঘুমায়।’
১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত কামু পূর্ব এবং পশ্চিমের কুটিল রাজনীতির তত্ত্ব এবং বিতর্ক থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। ১৯৪৮ সালের পর ফরাসি বাম ঘরানা ভাবসম্পন্ন রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকেও তিনি নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রেখেছিলেন। পশ্চিমা বিশ্বে কামু তখন পরিচিত হয়ে ওঠেন, ‘গণতন্ত্রমনস্ক বুদ্ধিজীবী এবং সাহিত্যিক’ হিসেবে। লক্ষণীয়, ১৯৪৮ সালের পর কামুর চিন্তা এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসের গতিপথও পরিবর্তন হয়েছিল। সেই নতুন গতিপথে আমরা নতুন চেহারায় তাঁকে আবিষ্কার করার সুযোগ পাই। লক্ষ করলে দেখা যাবে দি প্লেগ এবং দি স্ট্রেনজার তাঁর এই দুই জনপ্রিয় উপন্যাসে রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং সমাজের অবকাঠামোর অবস্থান ছিল এক রকম, আবার ১৯৪৮ সালের পর তাঁর লেখা কয়েকটি নাটক এবং প্রবন্ধের ভাষায় যুক্ত হয় কিছুটা ভিন্ন সুর।
এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, কামুর অবরোধ, গুপ্ত হত্যা বা বিদ্রোহ এই নাটকগুলো তৎকালীন সময়ের ফরাসি বুদ্ধিজীবীদের জাগতিক চিন্তাধারা এবং পাশাপাশি রাজনৈতিক ভাবনাকে অত্যন্ত ব্যঙ্গাত্মকভাবে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছিল। স্মর্তব্য, কামুর মন আর মননে এই বুদ্ধিবৃত্তিক নতুনধারাটি দানা বাঁধতে শুরু করেছিল ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে। তখনই কামু চিন্তা এবং প্রকাশে তৎকালীন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ চিন্তক, যেমন—ফ্রান্সিস মরিয়াক, জ্যঁ পল সার্ত্রে, আঁদ্রে ব্রেতোর ভাবনায় সমাজতান্ত্রিকধারায় প্রচলিত মতবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। পরে সার্ত্রে, সিমন দ্য বেভোয়াসহ অনেক বামপন্থী লেখক এবং বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে কামুর সেই আদর্শগত তর্ক জারি ছিল। কামু নাটকগুলোর মাধ্যমে তৎকালীন যুদ্ধোত্তর সময়ে সমাজতন্ত্রের সামাজিক প্রয়োগ এবং নৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন।
কামু বিস্ময়ের চোখে আবিষ্কার করলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেসব রাষ্ট্র আর সমাজের নীতিনির্ধারকেরা নাস্তিকতার ধুয়া তুলে জার্মানির নাৎসিকে ক্ষমতায় এনেছিল, তারাই আবার যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে খুব কৌশলে পৃথিবীকে নতুনভাবে শোষণ করতে শুরু করে দিল। যে আশা আর স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিকামী জনতা জার্মানির হিটলারের চিন্তাগত এবং চেতনাগত জায়গায় আঘাত করেছিল, যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মানুষের সেই স্বপ্ন সুদূর পরাহতই থেকে গেল। দেখা গেল, জাতিসংঘ থেকে শুরু করে গোটা পৃথিবীর শাসক আর বুদ্ধিজীবীরা ধীরে ধীরে হয়ে উঠল সাম্রাজ্যবাদীদের খোঁয়াড়। পাশাপাশি বামপন্থীরাও তাদের মূল আদশর্গত অবস্থান থেকে বিচ্যুত হতে শুরু করল। যার ফল দাঁড়ালো, সাম্রাজ্যবাদীদের উত্থান, আবার একই সঙ্গে শোনা গেল মানবতাবাদীদের আত্মার হাহাকার। এসব বিবেচনা থেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পৃথিবীতে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠায় বিশ্বনেতৃবৃন্দ কতটুকু আন্তরিক হতে পারবেন, এই নিয়ে কামুর ব্যাপক সংশয় ছিল। এই ধোঁয়াটে রাজনৈতিক অবস্থান থেকে মুক্তি পেতে কামুর আস্থা ছিল মানুষের শক্তিতে। তিনি মনে করতেন, শান্তির জন্য লালায়িত মানুষ যে বিশ্বাসকে বুকে নিয়ে নিত্য ঘুরে বেড়ায়, সেই বিশ্বাসের বাস্তবায়ন হওয়া জরুরি। একদিকে মানুষের বিশ্বাস আর তাদের চাওয়া-পাওয়ার খতিয়ান, অন্যদিকে কূটরাজনৈতিক চাল। এই দুটো সমান্তরাল ধারাকে একটি বিন্দুতে মেলাবার চেষ্টা করেছেন অবরোধসহ আরও কিছু নাটকে।
নোবেল প্রাইজ পাওয়া পর আলবেয়ার কামু © ছবি: উইকিপিডিয়া থেকে [সূত্র: Gunnar Lantz]
এবার অবরোধ নাটকটিতে আসা যাক। সন্দেহ নেই সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় নাটকটি গুরুত্বপূর্ণ । জানা যায়, নাটকটির প্রথম পর্দা উঠেছিল ফ্রান্সের বিখ্যাত নাট্যমঞ্চ মারিগু নাট্যশালায় [Marigû Theater] ১৯৪৮ সালের ২৭ অক্টোবর। নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন জ্যঁ লুই বাহোও [Jean Louis Barrault]। আর নাটকটির সার্বিক দায়িত্বে বাহোয়ের সঙ্গী ছিলেন আলবেয়ার কামু নিজেই। অবরোধ মঞ্চায়নের পরপরই কামু নিজের এই নাটক নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলেন। এই উচ্ছ্বাসের প্রমাণ মেলে তাঁর বক্তব্যে—‘যখন নাটকটি প্যারিসের মঞ্চে প্রথম মঞ্চস্থ হলো, তখন নাট্য সমালোচকের কণ্ঠে এই নিয়ে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য শোনা গেল না। সত্যিকার অর্থে খুব কম নাটকই আছে, যা মঞ্চস্থ হয় অথচ কোনো সমালোচনা হয় না।’ এর মানে হলো কামু হয়তো ধরেই নিয়েছিলেন, অবরোধ নাটকটির সত্যভাষণ দর্শকেরা বুকে তুলে নিয়েছেন এবং সাহিত্য সমালোচকগণ কামুর বার্তাটি খুব সহজেই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু আদতে তা আংশিক সত্য ছিল। কারণ, পরবর্তী সময়ে নাটকটি নিয়ে প্যারিসের শিল্প-সাহিত্য পাড়ায় প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হয়েছে।
অবরোধ একটি রাজনৈতিক নাটক। ভ্লাদিমির নবোকভের ১৯৮৪ বা শেকসপিয়ারের জুলিয়াস সিজার-এর মতো এই নাটকটিও সমাজ এবং রাষ্ট্র পরিচালনার নানা রকম ফাঁকফোকরকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং পাঠকের চিন্তায় নতুন খোরাক জোগায়। এই নাটকের ভাষা, ভাবনা এবং বাণী আজও সমানভাবে আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রকে আলোড়িত করে। নাটকটির নৈতিক অবস্থান একদিকে যেমন দক্ষিণপন্থী গোঁড়া ক্ষমতা দখলকারীদের বিরুদ্ধে, পাশাপাশি পুঁজিবাদ এবং ধনতন্ত্রের মন্ত্রে আচ্ছন্ন হয়ে সমাজকে যারা কুক্ষিগত করে রাখতে চায়, তাদেরও বিরুদ্ধে। আবার সমাজতন্ত্রের নামে সমাজ এবং রাষ্ট্রকে যারা শোষণ করে, নাটকটি তাদের বিরুদ্ধেও।
নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম প্লেগ এবং দিয়েগো। প্লেগ একজন স্বৈরাচারী আর দিয়েগো হলেন প্রতিবাদী এবং মানবতাবাদী। প্লেগ স্পেনের কদিয়ে [Cadiæ] শহরের অন্যতম এক ত্রাস। তার ব্যক্তিগত সচিবের কাজ হলো সারাক্ষণ নোটবুকে কদিয়ে শহরের মানুষের নানা রকম চরিত্র টুকে রাখা আর তালিকা বানানো। সেই তালিকা প্লেগের হাতে তুলে দেওয়া। সেই তালিকা ধরে ধরে অপছন্দের মানুষদের গোপনে মেরে ফেলাই হলো প্লেগের কাজ। প্লেগ ধীরে ধীরে শহরের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে এবং শহরের কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যতম হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি কদিয়ে শহরের প্রতিবাদী যুবকের নাম দিয়েগো। মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ তিনি। সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যেতে দিয়েগোর চেষ্টার অন্ত নেই। দিয়েগোর মুখ দিয়েই কামু সমাজের অনেক অনাচারের কথা নির্দ্বিধায় তুলে ধরেছেন। সে কারণে চরিত্রটি এই নাটকে বেশ বলিষ্ঠভাবে ফুটে উঠেছে। নাটকের নায়কের ভূমিকায় দিয়েগো সমাজের নানা রকম অবিচারের বিরুদ্ধে সব সময়ই সোচ্চার। তিনি প্রেমে পড়েন ভিকতোরিয়া নামের এক নারীর। সেই নারীও দিয়েগোর প্রতিবাদী কণ্ঠের অন্যতম সহযোদ্ধা। ভিকতোরিয়ার বাবা আবার সেই শহরের বিচারক। একদিকে দিয়েগো এবং ভিকতোরিয়ার সম্পর্ক অন্যদিকে কদিয়ে শহরে স্বৈরাচার আর দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের সংগ্রাম। তখন দুটো শ্রেণির মুখোমুখি সংঘাত শুরু হয় এই নাটকটিতে। কামু স্পষ্টতই তাঁর এই নাটক দিয়ে সমাজের দুটো শ্রেণিকে তুলে ধরেছেন।
নাটকটি মোট তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগেই রয়েছে প্লেগের একনায়কসুলভ চেহারার উলঙ্গ প্রকাশ। এই পর্বেই আমরা আবিষ্কার করি এক ক্ষমতালোভী রাষ্ট্রনায়ককে, যে কিনা একটি শহরের অধিপতি হতে চায়। শহরের একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আর এই একনায়কতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন স্বৈরাচারী মতবাদ। প্লেগ এক বক্তৃতায় বলেন, ‘জেনে রাখো। এখানে আবেগ নিষিদ্ধ। তোমাদের ভালোবাসায় মোড়া আকাঙ্ক্ষা, প্রেমিকার মিষ্টি চেহারা—এসব এখানে অচল। যদি চাও, এর পরিবর্তে আমি তোমাদের দিব একটি চমৎকার রাজনৈতিক সংগঠন।’
চলুন, এই ফাঁকে অবরোধ নাটকটির নাট্যমঞ্চে ঘুরে আসা যাক। মঞ্চের পর্দা ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যায় স্পেনের কদিয়ে শহরের বসন্তের এক রাত। আকাশের তারাগুলো থেকে থেকে খসে পড়ছে। সেই তারার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে জোড়ায় জোড়ায় কপোত-কপোতির দল। এমন সময় হঠাৎ করে আকাশে ধূমকেতুর বিস্ফোরণে সবার চোখ আকাশে! চারদিকে বিকট শব্দ! সেই শব্দে শহরের আমজনতা সবাই ভয়ার্ত চোখে একে অপরকে ধরে কাঁপছে। ঠিক এমন সময় মহাশক্তিধর ভীমের মতো মঞ্চ কাঁপিয়ে আগমন ঘটে প্লেগ নামের এক অতি ক্ষমতালোভী স্বৈরশাসকের। সঙ্গে রয়েছে তার অতি ক্ষীণকায় এক সচিব এবং দেহরক্ষী। তার কাজ হলো প্লেগকে কূট পরামর্শ দেওয়া আর শহরের খুঁটিনাটি অবগত করা। প্লেগ ইতিমধ্যে শহরের সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। মঞ্চের এ-মাথা থেকে ও-মাথায় সে পায়চারি করছে আর মানুষকে নানাভাবে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছে। শহরে বসবাসরত বাসিন্দাদের নাগরিক অধিকার বলতে তখন আর কিছুই নেই। মানুষে মানুষে ভালোবাসার সম্পর্ক সুদূর পরাহত। যে-ই সত্যি কথা বলছে, তার টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে। স্বাধীনতা শব্দটির সঠিক অর্থ এই শহরের মানুষ জানে না। প্লেগ নামের এক অতি বিরাটকায় দৈত্যের মতো মানুষটি মঞ্চ কাঁপিয়ে দম্ভের সাথে ঘুরছে আর হাতির মতো লাফাচ্ছে। ক্ষমতার জন্য সে পাগল! বিরুদ্ধে যে-ই কথা বলবে, তার কপালে লেখা রয়েছে নিশ্চিত মৃত্যু!
আলবেয়ার কামুর অবরোধ নাটকের একটি দৃশ্য [১৯৫৫] © ছবি: উইকিপিডিয়া থেকে [সূত্র: Mirko Japelj]
কামুর এই নাটক অনেকটাই তাঁর উপন্যাস প্লেগ-এর আদলে নির্মিত। কামু নিজেও সে কথা স্বীকার করেছেন। কামুর মতে, ‘বিষয় এক হলেও নাটকটির চরিত্র এবং বাণী উপন্যাস থেকে আলাদা। প্লেগ উপন্যাসে প্রতীকী একটি শক্তি দিয়ে যন্ত্রণাকাতর একটি সমাজকে চিত্রণ করা হয়েছে। কিন্তু অবরোধ নাটকে দেখানো হয়েছে একটি অপশক্তির বিরুদ্ধে মানুষের বিদ্রোহ আর লড়াই। নাটকে দেখা যাচ্ছে, একটি শক্তিশালী ভিতকে কীভাবে সাধারণ মানুষ তাদের নিজেদের শক্তি দিয়ে নাড়িয়ে দিতে পারে। উপন্যাস প্লেগ এবং নাটক অবরোধ দুটোতেই যেখানে মিল রয়েছে, সেটি হলো অপশক্তির বিরুদ্ধে সচেতন মানুষের লড়াই। নাটকটি নিয়ে কামু বলছেন, ‘আমি এই নাটক দিয়ে সরাসরি একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি। তারা কেউ ডানপন্থী, আবার কেউ বামপন্থী। দুদিক থেকেই তারা সংঘবদ্ধ। এই দুপক্ষই রাষ্ট্রের ক্ষমতার জোরে রাষ্ট্রকে শোষণ করছে।’
দিয়েগোর কণ্ঠ দিয়ে কামু সমাজের অনেক অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছেন। সন্দেহ নেই তখন নাটকটির মাধ্যমে আমরা ব্যক্তি কামুর রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থানের সন্ধান পাই। সমাজ পরিবর্তন এত সহজেই হয় না। দেখতে পাই নাটকের নায়ক দিয়েগোর মতো একজন বিপ্লবীকেও সমাজ পরিবর্তনের লড়াই চালিয়ে যেতে কতই না হিমশিম খেতে হয়! সমাজ আর অন্ধবিশ্বাসের মূলে আঘাত করতেও তাকে কত রকম সমস্যায় জর্জরিত হতে হয়! এসব কারণে দিয়েগোর মনেও সংশয়ের সুর বেজে ওঠে। ‘এই লড়াই কত দূর টিকবে!’ সমাজের মূলের কত গভীরে দিয়েগো এই লড়াইকে নিয়ে যেতে পারবে, সেই নিয়েও তার ছিল পাহাড়সমান ভয় আর উৎকণ্ঠা।
নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে গিয়ে আলবেয়ার কামু বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘লেখকের দায়িত্ব দুই ধরনের। সমাজের প্রচলিত মিথ্যাকে অস্বীকার করা এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।’ মানুষের অন্তরের সুখটাই হলো আসল। মানুষ যদি মানবিক না হয়, অন্তরাত্মায় যদি সুখ বা শান্তিকে স্থান দিতে না-ই পারে, তাহলে এত যুদ্ধ আর রক্তক্ষয়ের কী মানে? কামু মনে করেন, ‘সুখ বিষয়টা আপেক্ষিক। সুখ দ্রুত ফুরিয়ে যায়। মানুষ মূলত মৃত একটি অবস্থানে আছে। মৃত্যু নিশ্চিত ও মহাবিশ্বের নীরবতা জানা সত্ত্বেও আমরা নিত্যই বুকে হাহাকার নিয়ে ঘুরে বেড়াই।’ কামু তাঁর নাটক আর উপন্যাসে স্পষ্ট করেই জীবনের এই এবসারডিটি তত্ত্বকে ফুটিয়ে তুলেছেন। সে কারণেই হয়তো তিনি বলতে পেরেছেন, ‘হায়! একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর প্রতিটি মানুষই তার চেহারার জন্য দায়ী।’ সন্দেহ নেই এখানে কামু তাঁর এবসার্ড তত্ত্ব দিয়ে আমাদের জীবনকে বিচার করেছেন। যা সত্য এবং বাস্তব, তা মানুষকে মেনে নিতেই হবে। তিনি মানুষকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। আমরা কীভাবে বসবাস করব আর দুঃখগুলোকে জীবনের অংশ করে নিতে পারব, সেই প্রশ্নগুলো আমাদের আত্মায় তৈরি করতে সাহায্য করেছেন।
অবরোধ নাটকটির প্রতিটি চরিত্র আমাদের চলমান সমাজ ও রাষ্ট্রের অনিবার্য অংশ। নাটকের প্রতিটি সংলাপ রাষ্ট্রের প্রকৃত স্বরূপকে উন্মোচন করে। মানুষের অসহায়ত্বের কথা বলে, নিপীড়নের কথা বলে। কোনো প্রতীকী সম্ভাষণ নয় বরং সরাসরি আক্রমণ এই নাটকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। এই আক্রমণ দেশ, সরকার আর ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে। কামু যে কথাগুলো আকারে-ইঙ্গিতে উপন্যাসে বলেছিলেন, সে কথাগুলো তিনি নাটকে স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেছেন। কামু নিজেই সে কথা বলেছেন, ‘আমার এই নাটকের চরিত্রগুলো রূপক ভাবলে খুব বোকামো হবে’। যে কারণে এই নাটকে অভিনয় করতে গিয়ে নাট্যমঞ্চে অভিনেতাকে অতিরিক্ত কোনো অভিনয় করতে হয়নি। কোনো চরিত্রকে নতুন অভিব্যক্তি দিয়ে দর্শকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হয়নি। কারণ, চরিত্রগুলো খুব চেনা। চরিত্রগুলো একটি রাষ্ট্রের আয়না।
কামু জীবনের ওপর আস্থাশীল। নতুন জীবনে মানুষ ফিরে আসবে আর ফিরে পাবে—এই বিষয়ে কামু নিশ্চিত। তিনি মানুষের শক্তির ওপর আশাবাদী। এই আশাবাদী সত্তা নিয়েই তিনি জীবনের মাত্র ৪৬টি বছর বেঁচে ছিলেন। আশাবাদী ছিলেন বলেই হয়তো তিনি বলেছিলেন, ‘শরৎ হলো বসন্তের দ্বিতীয় রূপ। শরতের প্রতিটি পাতা তখন একেকটি ফুলে পরিণত হয়।’
কামুর মূল ইচ্ছা ছিল নাটকের ভাষা ব্যবহার করে বিংশ শতাব্দীতে গজিয়ে ওঠা নব্য সাম্রাজ্যবাদীদের মূল ধরে টান দেওয়া। অনেক সাহিত্য সমালোচক মনে করেন, প্লেগ উপন্যাস দিয়ে কামু যে কাজটি করতে পারেননি, অবরোধ নাটকটি দিয়ে তিনি সে কাজটি করেছিলেন।