আত্মজীবনীটি কেন অসমাপ্ত রয়ে গেল?
সেন্ট্রাল চীনের উহান শহরে আমার কিছুদিনের বসবাস ছিল। টানা বৃষ্টি আর শীতের তীব্রতায় প্রায়ই জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে উঠত। এই শহরে সূর্যের দেখা মেলা ভার। একদিন জানালার কাচ ভেদ করে এক টুকরো নরম রোদ উঁকি মেরেছিল আমার অফিস রুমের দেয়ালে। সেদিন সকালেই পড়েছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁর সহকারী হাজী গোলাম মোরশেদের গণমাধ্যমে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকার। তাঁকে কীভাবে দেখেন আপনি—
এমন প্রশ্নে মোরশেদের জবাব, ‘বঙ্গবন্ধু মূল্যায়নের জিনিস নন। উনি তো কাঁসা, পিতল, সোনা আর রুপা নন। যখন একা একা ভাবি, বুক ভেসে যায়। শেখ মুজিবুর রহমান মানুষ নাকি ফেরেস্তা ছিলেন?’ বঙ্গবন্ধু বাঙালির দেবদূত। সংগত কারণেই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী [২০১২] আমাদের জাতীয় রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ আকরগ্রন্থ। [রশিদ, ২০১৩]
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধিকার আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। তাঁর জীবনদর্শন ছিল বাংলার গণমানুষের মুক্তি। আর তাই তো বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা দিতে সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে। ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রাজবন্দি থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনী লেখা শুরু করেন এবং ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ঢাকা সেনানিবাসে আটক থাকার সময় লেখা বন্ধ হয়ে যায়। এ জীবনীগ্রন্থে মূলত ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ঘটনাবলি স্থান পেয়েছে। বস্তুত অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থ বাঙালির মানসচেতনায় সময়ের একটি দলিল। আর এই গ্রন্থে একদিকে প্রকাশ পেয়েছে নির্ভীক, আপসহীন এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, গভীর উপলব্ধি ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ; অন্যদিকে বর্ণিত হয়েছে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের আত্মপরিচয়, কীভাবে আমরা একটা স্বাধীন জাতি হতে পেরেছি, তার পেছনের ইতিহাস।
হারুন-অর রশিদ [২০১৩] বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর কালকে মোটাদাগে তিনটি পর্বে ভাগ করেছেন। প্রথম পর্ব [১৯২০-১৯৪২], তাঁর জন্ম থেকে শুরু করে ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করা পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্ব [১৯৪২-১৯৪৭], কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি ও বেকার হোস্টেলে থাকা থেকে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় ফিরে আসার পূর্ব পর্যন্ত। তৃতীয় পর্ব [১৯৪৭-১৯৫৪], ভারত বিভক্তি ও পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধুর ঢাকা আগমন থেকে ১৯৫৪ সালের শেষের দিকে বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে গঠিত ‘কেবিনেট অব ট্যালেন্টস’-এ আইনমন্ত্রী হিসেবে সোহরাওয়ার্দীর যোগদান এবং যুক্তফ্রন্টের নেতা হিসেবে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন পর্যন্ত। আগেই উল্লেখ করেছি, তিনি কারাবন্দি জীবনের ফাঁকে ফাঁকে লিখে গেছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনী। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও ফ্যাসিবাদ রুখতে গিয়ে শ্রাবণের এক বর্ষণমুখর সকালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। আর আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, শেখ হাসিনা এই আত্মজীবনীর ভূমিকা কারাবন্দি অবস্থায় লিখেছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান ছেলেবেলা থেকেই অসীম সাহস আর নেতৃত্ব দেওয়ার সহজাত গুণ নিয়ে বেড়ে উঠেছেন। স্কুলে থাকতেই বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে তিনি এভাবে লিপিবদ্ধ করেন, ‘১৯৩৮ সালের ঘটনা। শেরেবাংলা তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। তাঁরা গোপালগঞ্জে আসবেন। বিরাট সভার আয়োজন করা হয়েছে। এগজিবিশন হবে ঠিক হয়েছে। বাংলার এই দুই নেতা একসঙ্গে গোপালগঞ্জে আসবেন। মুসলমানদের মধ্যে বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি হলো। স্কুলের ছাত্র আমরা তখন। … আমি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলাম দল-মতনির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে। পরে দেখা গেল, হিন্দু ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে সরে পড়তে লাগল। ব্যাপার কী বুঝতে পারছি না। এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, সেও ছাত্র, সে আমাকে বলল, কংগ্রেস থেকে নিষেধ করেছে আমাদের যোগদান করতে। যাতে বিরূপ সংবর্ধনা হয়, তারও চেষ্টা করা হবে। … আমি এ খবর শুনে আশ্চর্য হলাম। কারণ, আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোনো জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। একসাথে গান বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ানো—সবই চলত।’
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধিকার আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। তাঁর জীবনদর্শন ছিল বাংলার গণমানুষের মুক্তি। আর তাই তো বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা দিতে সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে। ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রাজবন্দি থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনী লেখা শুরু করেন এবং ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ঢাকা সেনানিবাসে আটক থাকার সময় লেখা বন্ধ হয়ে যায়।
তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনায় উঠে আসেন ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রলীগ গঠনের মাধ্যমে। তাঁর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল ছাত্রদের মধ্যে। এক মাসের ভেতর আমি প্রায় সকল জেলায় কমিটি করতে সক্ষম হলাম। যদিও নইমউদ্দিন কনভেনর ছিল, কিন্তু সকল কিছুই প্রায় আমাকেই করতে হতো। একদল সহকর্মী পেয়েছিলাম, যারা সত্যিকারের নিঃস্বার্থ কর্মী’। [পৃ. ৮৯]
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল মূলত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের তুমুল কর্তৃত্ববাদের কারণে তৎকালীন অনেক নেতা দল ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী উদারপন্থী নেতারাও তখন সেখানে নিজেদের অবহেলিত মনে করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় সত্য, তবে ‘মুসলিম’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত হোক, এটা প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সচিব শেখ মুজিবুর রহমান চাননি। এ ব্যাপারে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে পরিষ্কার করে জানান দেন, ‘পাকিস্তান হয়ে গেছে, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা শুধু মেনিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনো আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছেন, তারা চিন্তা-ভাবনা করেই করেছেন’। [পৃ. ১২১] শেষতক, ১৯৫৫ সালে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে আওয়ামী লীগ তার নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। তাই এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রাজনীতিতে তিনি যে ধর্মনিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন, এ ছিল তারই প্রতিফলন। [রশিদ, ২০১২]
একই সঙ্গে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেই ভিত্তি করেছিলেন। স্বাধীনতার পরেও তিনি এই ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন। ১৯৭২ সালের ৪ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনার জন্য আয়োজিত সম্মেলনে তিনি ঘোষণা করেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার স্ব-স্ব অধিকার অব্যাহত থাকবে। ... ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ এর পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-কে সন্নিবেশ করা হয়। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের সাউথ এশিয়া সেন্টার আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় নোবেলজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম স্পষ্ট সমর্থক, যেখান থেকে বিশ্ব শিখতে পারে। বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের সকল দেশ বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও দর্শন থেকে দিকনির্দেশনা এবং অনুপ্রেরণা নিতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে মানুষের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থাকবে না, তা বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন না। বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার যে ধারণা দিয়েছিলেন, তা ধর্মনিরপেক্ষতার পশ্চিমা সংস্করণ থেকে আলাদা ছিল।’
এই কথা অস্বীকার করার জো নেই যে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সৃজিত হয়েছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়। আর ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের রয়েছে বিশেষ অবদান। তিনি নিজেই ছিলেন ভাষাসৈনিক, নেতৃত্ব দিয়েছেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তাঁর বর্ণনায় তা ছিল এমন, ‘আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করল’। [পৃ. ৯১] এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকাকে প্রকাশ না করা কিংবা খাটো করে দেখানোর অপচেষ্টা ছিল দীর্ঘদিন। কিন্তু ইতিহাসের শক্তি অসীম। আর তাই তো ইতিহাসের স্রষ্টা আজ স্বমহিমায় ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশের পর ভাষা আন্দোলনে তাঁর বৃহৎ অবদান স্পষ্ট হয়।
তাঁর ৫৪ বছরের জীবনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ সময় কারাগারেই কাটাতে হয়েছিল। স্বভাবতই পরিবার থেকে বেশ বিচ্ছিন্ন থাকতেন তিনি, যা তাঁকে ভীষণভাবে পীড়া দিত। একবার বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা কারাগার থেকে জাহাজে করে খুলনায় নেওয়া হচ্ছিল। ওই একই সময় অপর জাহাজে তাঁকে দেখতে ঢাকায় রওনা হয়েছিলেন তাঁর বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানেরা। এমনটি হতে পারে তা বঙ্গবন্ধুর ভাবনার মধ্যেও ওই সময় ছিল। বিষয়টি তিনি আত্মজীবনীতে এভাবে বর্ণনা করেন, ‘যা ভয় করেছিলাম তাই হলো। পূর্বের রাতে আমার মা, আব্বা, রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা হয়ে গেছেন আমাকে দেখতে। এক জাহাজে আমি এসেছি। আর এক জাহাজে ওরা ঢাকা গিয়েছে। দুই জাহাজের দেখাও হয়েছে একই নদীতে। শুধু দেখা হলো না আমাদের। এক বৎসর দেখি না ওদের। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বাড়িতে আর কাউকেও খবর দিলাম না। কিছুদিন পূর্বে রেণু লিখেছিল, ঢাকায় আসবে আমাকে দেখতে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হবে বুঝতে পারি নাই’। [পৃ. ১৭৬]
অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তাঁর বর্ণনায় তা ছিল এমন, ‘আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করল’।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান © শিল্পী নাসির আলী মামুন : ফটোজিয়াম
মহান নেতার রাজনৈতিক আদর্শ ছিল ত্যাগের। যার খেসারতও দিয়েছেন তিনি। এমনকি দীর্ঘ কারাবাসের কারণে নিজের সন্তানের কাছেও অচেনা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর লেখা থেকে উদ্ধৃতি: ‘একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, “হাচু আপা, হাচু আপা তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।” আমি আর রেণু দু’জনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, “আমি তোমারও আব্বা।” কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়! আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনাবিচারে বন্দী করে রাখা আর আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝাবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।’ [পৃ. ২০৯]
অসমাপ্ত আত্মজীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি ছিলেন সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করার অকুতোভয় এক বিচক্ষণ রাজনৈতিক ব্যক্তি। অথচ তাঁর চিন্তার বৃহৎ অংশজুড়েই ছিল জনমানুষের জন্য কল্যাণভাবনা। তাঁর কথায়, ‘যেকোনো মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত না, তারা জীবনে কোনো ভালো কাজ করতে পারেনি—এ বিশ্বাস আমার ছিল’। [পৃ. ১২৮] তাঁর জীবনব্যাপী একটিই সাধনা করেছেন, বাঙালির মুক্তির জন্য নিজকে উৎসর্গ করা। ধাপে ধাপে প্রতিটি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ’৫৪-তে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬৬-তে ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা এবং ’৬৮-তে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। ১৯৬৯ সালে ছাত্র-জনতা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাকে কারামুক্ত করে এবং তারপরই ছাত্ররা তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করেন। ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও তাঁকে ক্ষমতা থেকে নিবৃত্ত রাখা হয়। গোটা পূর্ব পাকিস্তান তখন যেন অগ্নিগর্ভ ভিসুভিয়াস!
সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। মুক্তিপাগল মানুষকে জানালেন মুক্তির বারতা, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ তাঁর সেই ভাষণের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা অন্তর্নিহিত ছিল। পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা আছে। মার্কিন সাময়িকী নিউজউইকের ভাষায়, ‘রাজনীতির’ এই ‘কবি’ বাংলার মানুষের ওপর নানা অত্যাচার-নির্যাতন-শোষণের নির্মমতা এবং তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য হাতিয়ারের মতো শব্দ বারবার ব্যবহার করে নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন। এবং তা মানুষের রক্তে বিদ্রোহের গতিবেগ তৈরি করে দিয়েছিল।
একটি ভাষণ কীভাবে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে, কীভাবে দেশমাতৃকার স্বাধীনতাসংগ্রামে জীবন বাজি রেখে নেমে পড়ার প্রেরণা জোগায়, কীভাবে একটি ভাষণ লক্ষ লক্ষ মানুষকে মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তার উজ্জ্বল উদাহরণ। তাই এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, ৭ মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার প্রকৃত ‘ঘোষণা’। স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল মা কিংবা প্রিয়তমার আঁচলের মতো একটি পতাকা! সে কারণেই বঙ্গবন্ধু আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে জুলিয়াস সিজারের অভিব্যক্তির মতোই ‘…constant as the northern star।’ তিনিই বাংলাদেশের ধ্রুবতারা কিংবা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মতো বিশ্বনেতার ভাষ্যানুযায়ী, ‘…ব্যক্তিত্ব এবং সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়।’ তবে জাতি হিসেবে আমরা অকৃতজ্ঞ, আমরা পিতৃহত্যা করে উল্লাস করেছি। হয়তো সে কারণেই নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট বলেছিলেন, ‘মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না, যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হারুন-অর-রশিদ ‘টিপিক্যাল রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ ফরমেটের বাইরে গিয়ে তাঁর গ্রন্থ ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ’-এ অসম্ভব আবেগ দিয়ে শেষ করেছেন এমন করে, “বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ অসমাপ্ত আত্মজীবনী আমাদের জাতীয় মুক্তি বা জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্বের ‘মাস্টার পিস’ বা ‘বেস্ট ট্রিটিজ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সবার মতো আমারও শুধু আক্ষেপ! কেন এটি অসমাপ্ত রয়ে গেল?”
তাই তো, কেন এটি অসমাপ্ত রয়ে গেল?
তথ্যনির্দেশ
১. রশিদ, হারুন-অর [২০১২]. বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন: বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা, ঢাকা: নিউ এজ পাবলিকেশন্স।
২. রশিদ, হারুন-অর [২০১৩]. বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ, ঢাকা: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড।