শিল্পী রামকিঙ্করের সঙ্গে একদিন!

 

হাতে চমৎকার একটা বই পেয়েছি, শিল্পী রামকিঙ্কর আলাপচারি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশ্বভারতীর অধ্যাপক সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এমন দু-একটা বই যদি আপনার হাতের কাছে থাকে, তাহলে দুর্বিষহ করোনাকালকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে লকডাউন থেকেও কোনো আপত্তি নেই। সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বভারতীর বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের অধ্যাপক হওয়ার সুবাদে শিল্পী রামকিঙ্করের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। শিল্পীর সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতা থেকেই এই গ্রন্থের জন্ম। সন্দেহ নেই শিল্পী রামকিঙ্কর আলাপচারি গ্রন্থের প্রতিটা পাতায় শিল্পী রামকিঙ্করকে আবিষ্কার করার প্রাণান্ত চেষ্টা গ্রন্থটি অতিমাত্রায় পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য এবং গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।

গ্রন্থটির ভেতর প্রবেশের পূর্বে শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজের ওপর একটু জানা প্রয়োজন বলে মনে করি। শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজকে বলা হয় আধুনিক ভারতের ভাস্কর্য নির্মাতাদের একজন। প্রকৃতিগত শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে তিনি তা তাঁর শিল্পের আঁচড়ে তুলে এনেছিলেন। ভাস্কর্য গড়নের মধ্য দিয়ে তিনি বিমূর্ত ছবি তৈরিতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আধুনিক পশ্চিমের চারুকলা এবং ধ্রুপদি ভারতীয় চারুকলার অনন্য মিশেল ছিল তাঁর চিত্রশিল্পের মূল বিষয়বস্তু। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম, রবীন্দ্রভারতী কর্তৃক ডিলিট ও ভারতের রাষ্ট্রীয় খেতাব পদ্মভূষণ লাভ করেছেন।

বিশ্বশিল্পের নানা রং বারবার তাঁর অন্তরাত্মায়, শিল্পচেতনায় প্রতিফলিত হয়েছে। কবিগুরুর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা প্রান্তরের নানা জায়গায় শিল্পী রামকিঙ্করের কাজের দেখা মিলবে। তাঁর আঁকা ছবি আর ভাস্কর্য মানেই যেন প্রকৃতি এবং শিল্পের এক আত্মিক প্রকাশ। বলার অপেক্ষা রাখে না শিল্পী রামকিঙ্কর ভাস্কর্যশিল্পে শান্তিনিকেতন তো বটেই, গোটা ভারতের অন্যতম পুরোধা। শান্তিনিকেতনে তাঁর জীবন ছিল বৈচিত্র্যে ভরপুর। কখনো তিনি ছন্নছাড়া আবার কখনো সবকিছু ছেড়েটেরে দিয়ে নিজ কাজের এক ধ্যানি কারিগর। তখন তাঁকে দেখে চেনা যায় না। মনে হয় তিনি বুঝি সম্পূর্ণ ভিনগ্রহের এক অচেনা বাসিন্দা!

রামকিঙ্করের জন্ম বাকুরায়, ১৯০৬ সালে। ছেলেবেলা থেকেই তিনি আঁকিয়ে। কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি ছবি আঁকায় বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। প্রবাসী এবং মডার্ন রিভিউ-এর সম্পাদক সাহিত্যিক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রথম এই প্রতিভাকে আবিষ্কার করেছিলেন বাকুরায় এবং শান্তিনিকেতনের তৎকালীন শিক্ষক নন্দনাল বসুর সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছিলেন। সেটা ছিল ১৯২৫ সালের কথা। রামকিঙ্করের নিজের ভাষায় সেই স্মৃতি তুলে ধরেছেন, শান্তিনিকেতনে নন্দনাল বসু তখন কলাভবনের শিক্ষক রূপে ছিলেন। রামানন্দ বাবু আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে এলেন। নন্দনাল বাবু আমার ছবি দেখে বলেছিলেন, এ তো হয়ে গেছে আর কেন? তারপর কিছুক্ষণ থেমে বলেছিলেন, আচ্ছা, ২-৩ বছর থাক তো? আমার সেই ২-৩ বছর আজও আর শেষ হলো না।

১৫৮ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি হাতে নিলে শেষ না করে আর ওঠা যায় না। গ্রন্থটির নাম দেখেই হয়তো অনেকে অনুমান করবেন যে গ্রন্থটি বুঝি শুধুই শিল্পীর সঙ্গে চারুকলা নিয়ে গুরুগম্ভীর কঠিন কথাবার্তা। কিন্তু গ্রন্থটির ভেতরে প্রবেশ করলে এই ভুল আপনার ভাঙবে। একজন শিল্পী রামকিঙ্করের পাশাপাশি সেখানে আপনি খুঁজে পাবেন একজন মানুষ রামকিঙ্করকে। লেখক তাঁর বইটির ভূমিকাতেও সে কথা কবুল করেছেন। এই গ্রন্থে শিল্পী রামকিঙ্করের সঙ্গে মানুষ রামকিঙ্করকেও খুঁজে পাওয়া যাবে। যদি যায় তবেই আমি ধন্য।

কবিগুরু খুব ভালোবাসতেন শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজকে এবং তাঁর কাজকে। বিশ্বভারতীর খোলা প্রান্তরের দিকে আঙুল উঁচিয়ে একবার রামকিঙ্করকে বলেছিলেন, যেখানে খুশি ভাস্কর্য বানাও। শিল্পীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন কবি রবীন্দ্রনাথ। রামকিঙ্করও কবিগুরুর কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর সবটুকু ঢেলে দিয়েছিলেন

লেখক সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কথা রেখেছেন। একজন শিল্পীকে তিনি এই গ্রন্থে নিখুঁতভাবে নির্মাণ করেছেন। এই নির্মাণে রামকিঙ্কর বেইজ কখনো ছিলেন শিল্পী, কখনো ছিলেন আড্ডাবাজ মানুষ আবার কখনো তিনি ধ্যানমগ্ন এক অচেনা দ্বীপের বাসিন্দা। আমরা জানি, একজন প্রকৃত শিল্পীর আত্মপ্রকাশ ঘটে তাঁর ছেলেবেলা থেকেই। কেউ কেউ এই বিরল প্রতিভা নিয়েই এই পৃথিবীতে জন্মান। রামকিঙ্কর বেইজের ব্যতিক্রম নন। রামকিঙ্কর তাঁর ছেলেবেলার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, তখন আমি পাঁচ বছরে পড়েছি। বড় দাদা রামপদ মেঝেতে হাতের লেখা শেখাচ্ছেন। শেখাচ্ছেন, কিন্তু আমার চোখ দুটো আটকে আছে দেয়ালে-টাঙানো রাধাকৃষ্ণের পটে। কানে হাত পড়তেই অগত্যা চোখ নামাতে হয়। তখন থেকেই ছবি আমার চোখ টেনেছে।

গ্রন্থটির আরেকটি ভালো দিক হলো, রামকিঙ্করের জীবনের নানা রকম ঘটনা আর সময়ের হিসাবকে মাথায় রেখে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলা। সে কারণেই হয়তো গ্রন্থের প্রথম ভাগেই আমরা শিল্পী রামকিঙ্করকে তাঁর অস্থিমজ্জায় সামনাসামনি দেখতে পাই। বেঁটেখাটো আর মজবুত গড়নের মানুষ। বেশ কাটা কাটা চেহারা। চেহারা দেখে মনে হয় যেন পাথরে খোদাই করা কোনো ভাস্কর্য। বাকুড়ার গাছপালা, নদী, সাঁওতালপল্লি, ঝোপঝাড়, ঘন জঙ্গল, লাল মাটিএসব প্রকৃতির নির্যাস নিয়ে বেড়ে উঠেছেন এই শিল্পী। গ্রন্থটির পাতা যতই উল্টাই ধীরে ধীরে যেন অন্য রকম রামকিঙ্কর আবিষ্কৃত হতে থাকে। রামকিঙ্কর যখন শান্তিনিকেতনের কলাভবনে এলেন, তখন শুরু হয় তাঁর নতুন জীবন! তাঁকে কাজে উৎসাহিত করলেন শিল্পী নন্দলাল বসু এবং স্বয়ং কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুরুটা কীভাবে হয়েছিল? রামকিঙ্করের উত্তর, আশেপাশের এইসব, মাঠঘাট, গাঁয়ের মানুষ, সাঁওতাল এদের প্রতিদিনের জীবনএসব থেকেই। কী কান্ডকারখানা চলছে বছরজুড়ে বলো দেখি। চোখ কান খুলে রাখোআর দেখোদুচোখ ভরে দেখোনাও কত নেবে। একজন আর্টিস্ট তাঁর জীবনে কতটুকুই-বা নিতে পারে।

কবিগুরু খুব ভালোবাসতেন শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজকে এবং তাঁর কাজকে। বিশ্বভারতীর খোলা প্রান্তরের দিকে আঙুল উঁচিয়ে একবার রামকিঙ্করকে বলেছিলেন, যেখানে খুশি ভাস্কর্য বানাও। শিল্পীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন কবি রবীন্দ্রনাথ। রামকিঙ্করও কবিগুরুর কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর সবটুকু ঢেলে দিয়েছিলেন। তাঁর অন্তরাত্মায় যে শিল্পীসত্তাটি ঘাপটি মেরে বসে ছিল, শান্তিনিকেতনে এসে সেই শিল্পীসত্তাটি যেন স্রোতস্বিনী নদীর মতো বয়ে চলল। রামকিঙ্করের খুব শখ ছিল শান্তিনিকেতনে কবিগুরু আর গান্ধীর একটি ভাস্কর্য তৈরি করতে। কাজ অনেক দূর এগিয়েও নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যা হলো শেষ দিকে এসে, আশ্রম সচিব সুরেন কর জানালেন, অর্থ নেই। রামকিঙ্করকে কাজ থেকে পিছিয়ে যেতে হলো। তাঁর ইচ্ছা ছিল খুব বড় করে স্ট্যান্ডিং ফিগার-এর দুটো ভাস্কর্য তিনি করবেন। অবশ্য সেই শখ তাঁর পূর্ণ হয়েছিল যখন তিনি সাঁওতাল পরিবার নিয়ে কাজে হাত দিলেন। গুরুদেব সব সময়ই শিল্পী রামকিঙ্করকে কাজে উৎসাহ দিতেন। আমরা জানি, কবিগুরু চাইতেন তাঁর শান্তিনিকেতনে যে কাজগুলো হয়, তা যেন ইউরোপ-আমেরিকার মতো বড় বড় দেশের সঙ্গে তুলনীয় হয়। রামকিঙ্করকেও তিনি বলতেন বড় ফিগারের কাজ করতে। দেখিস না য়ুরোপে কেমন বড় কাজ করে, বেশ জোর প্রকাশ পায় তাতে।

বড় ফিগারের কাজের প্রতি কবিগুরুর বিশেষ অনুরাগ ছিল। রামকিঙ্কর তাঁর কথা রেখেছিলেন।

গ্রন্থটির আরেকটি ভালো লাগার বিষয় হলো, রামকিঙ্করের চরিত্রটির সাবলীল রূপায়ণ। রামকিঙ্কর প্রকৃতিতে যেমন ছিলেন, ঠিক সেভাবেই তাঁকে যেন বইয়ের পাতায় অপরিসীম দক্ষতায় বন্দি করা হয়েছে। এই জন্য বইটি আরও বেশি সুখপাঠ্য হতে বাধ্য। একজন শিল্পীর বহুমুখী চরিত্র তুলে ধরা সহজ কাজ নয়।  শিল্পীদের পাগলামোর নানান খবর আমরা কমবেশি জানি। রামকিঙ্করও এর ঊর্ধ্বে নন। বইটিতে ঠিক এমন একটি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। একটি ছবি এক্সিবিশনে রামকিঙ্কর হলেন প্রধান অতিথি। তাঁকে দিয়েই ফিতা কেটে উদ্বোধন করা হবে। কিন্তু রামকিঙ্কর ফিতা কাটতে রাজি নন। তারপর উদ্যোক্তারা বললেন, তাহলে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালিয়ে উদ্বোধন করা হোক। কিন্তু তাতেও রামকিঙ্কর নিজের কানে ধরে বললেন, পারবেন না। শেষ পর্যন্ত রামকিঙ্কর নিজের একটা পথ বাতলে দিলেন। ছবি আঁকতে আঁকতেই তিনি অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন। বিষয়টার নতুনত্বে সবাই খুব খুশি হলো। কিন্তু ঘটনা ঘটল এর কিছুক্ষণ পরেই। রামকিঙ্কর আপন মনে ছবি আঁকছেন। এমন সময় রাজ্যমন্ত্রী অনুষ্ঠানে এসে হাজির। আয়োজকেরা রামকিঙ্করকে ডাকছেন মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য। কিন্তু রামকিঙ্কর তাঁর ছবি আঁকায় মগ্ন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে একরকম জোর করে মন্ত্রীর সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। রামকিঙ্কর মন্ত্রীকে দেখে চিৎকার করে বললেন, না না, এঁকে আমি বর্ধমানে দেখেছিবর্ধমানে দেখেছি।

শিল্পী রামকিঙ্কর একজন বড় মাপের শিল্পী শুধু নন, তিনি বড় মাপের একজন মানুষও। তাঁর মনটা যেমন মাটির মতো, তেমনি হৃদয়টাও আকাশের মতো উদার। শহরের রঙচং মাখা আধুনিক কেতা তিনি কখনোই রপ্ত করতে পারেননি। তাঁর ভাষায়, আমিও ওদের স্বজাতওঁরাও, সাঁওতাল, চাষি মুটে মজুর। ওদের ভাষাটা আমি বুঝি। দেখো, ভদ্রলোকদের অনেক সময় ঠিক বুঝি না। বুঝতে পারিও না। ওখানে সুর বড় কম।

শিল্পী রামকিঙ্করকে কবিগুরু বলেছিলেন, যখন কিছু দেখবে বাঘের মতো ঘাড় মটকে ধরবে, পেছনে আর তাকাবে না। শিল্পী রামকিঙ্কর কখনোই পেছনের দিকে তাকাননি। শিল্প নির্মাণই ছিল তাঁর একমাত্র আরাধনা।

লেখক সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহৎ কাজটি করে আমাদেরকে ঋদ্ধ করেছেন। গ্রন্থটিতে রয়েছে শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজের আঁকা রঙিন একটি ছবির অ্যালবাম, যা হতে পারে রামকিঙ্কর ভক্তদের এক বাড়তি পাওনা। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে শিল্পী রামকিঙ্করের সতীর্থ বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে। প্রকাশ করেছে দেজ পাবলিশিং, কলকাতা।