সাহেব-বাবুর বৈঠকখানায় বাংলা নাটক

ঔপনিবেশিকতা ও আধুনিকতা

উনিশ শতকে কলকাতা শহরে ইংরেজ সাহেব আর বাঙালি বাবুদের বৈঠকখানা তথা বাগানবাড়িতে [লেবেদেফের ব্যক্তিগত উদ্যোগের বাইরে] গোষ্ঠীভিত্তিক আধুনিক বাংলা নাটক [‘শখের থিয়েটার’] চর্চার সূত্রপাত হয়েছিল। রাজনৈতিক ইতিহাস অনুযায়ী যুগবিভাজনের আলোকে এ হলো ঔপনিবেশিক বাংলা নাটক। আবার, পাশ্চাত্য জ্ঞানতাত্ত্বিক যুগবিভাজনের আলোকে এ হলো আধুনিক বাংলা নাটক। তবে প্রশ্ন হলো, বর্তমানে অতি গুরুত্বের সাথে ঔপনিবেশিক/আধুনিক বাংলা নাট্যের ঠিকুজি সন্ধান এত প্রয়োজন কেন? প্রথমত, অবিভক্ত বাংলায় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা ব্রিটিশ রাজের সাংস্কৃতিক উপনিবেশায়নের প্রক্রিয়া তালাশ করার প্রয়োজনে। দ্বিতীয়ত, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অতি প্রতাপশালী ধারণা হিসাবে ‘আধুনিকতা’ বুঝবার প্রয়োজনে। তৃতীয়ত, আধুনিকতা বিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে জানা যায় এই প্রত্যয়টির সাথেই জড়াজড়ি করে তৈরি হওয়া জাতীয়তাবাদ বিষয়ক প্রতাপশালী ধ্যান-ধারণার [ডিসকোর্স] স্বরূপ। কেননা উনিশ শতকে কলকাতাকেন্দ্রিক এই সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যেই ক্রমশ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে আত্মপরিচয়ের রাজনীতি। এই পরিচয়ের রাজনীতির মধ্যে আমরা  বিশেষভাবে দেখতে পাই, ‘ভদ্রলোক’ বলে একটি নতুন উত্থিত ক্ষমতাবান শ্রেণির বিভ্রান্ত ভূমিকা। উনিশ শতকের বাংলায় ইংরেজ ‘সাহেব’দের সহযোগী বর্গ এই ভদ্রলোকেরাই ‘বাবু’ হিসাবে অভিহিত হয়। তৎকালীন বৃহৎবঙ্গের বিপুল জনতরঙ্গ—বিশেষত কৃষকের জীবন স্পন্দন থেকে বিচ্ছিন্ন এই অভিজাত শ্রেণির সমান্তরালে [কখনো পরিপূরকভাবে, কখনো সম্পূরকভাবে, কখনো তাদের জঠর থেকেই উদ্ভুত] বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি কালক্রমে নিজস্ব ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এই প্রেক্ষাপটেই, ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে কলকাতায় এই নতুনধারার নাট্যচর্চার সূত্রপাত। তবে এই নাট্যচর্চা যদি নিছক বিনোদনমূলক অবসর সংস্কৃতির মাধ্যম হয়ে থাকত, তাহলে এই লেখার কোনো প্রয়োজন থাকত না। বরং ‘শখের থিয়েটার’ পরিভাষা ও প্রসঙ্গটি বড়জোর এই জাতীয় লেখার তুচ্ছ কোনো ফুটনোট হতে পারত। বস্তুত, উনিশ শতকে একটি নব্য শ্রেণির গঠন, সমাজের রূপান্তর ও নতুন রাজনীতির বিকাশ ক্রমশ যে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল তার সমুদয় আলামত তৎকালীন ঔপনিবেশিক নাটচর্চার বিভিন্ন ঘটনায় ধরা পড়ে। উনিশ শতকে কলকাতার নাট্যঘটনা তাই এই অঞ্চলের বর্তমান নাট্য, সাহিত্য, শিল্পকলা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, এমনকি ভারতবর্ষ ভেঙে তিনটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জটিল ইতিহাসকে কেবল সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতেই বুঝতে সাহায্য করে না। বরং সেই ইতিহাসের বীজভূমি হিসাবে তৎকালীন সাংস্কৃতিক জমিন আদিগন্ত উন্মোচনও করে। এখানে আমার প্রস্তাব হলো, উনিশ শতকে ইংরেজ সাহেব আর বাঙালি বাবুর বৈঠকখানায় বিকশিত আধুনিক নাটক যতটা না চিত্তবিনোদনের শিল্পমাধ্যম হয়ে উঠেছিল, তার চেয়ে বেশি হয়ে উঠেছিল তৎকালীন অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতার নির্ণায়ক, সর্বোপরি ক্ষমতাবানদের কুস্তিখেলার ক্ষেত্র। পুরো উনিশ শতক জুড়ে সাহেব-বাবুর অংশগ্রহণে মঞ্চস্থ হয়ে চলছিল ঔপনিবেশিকতা, আধুনিকতা, শ্রেণি ও জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত একটি ধারাবাহিক হাসির নাটক যার নাম হতে পারে ‘ভ্রান্তিবিলাস’। তাই সে যুগের নাটকের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যাখ্যা উৎপাদন এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং এর উল্টো। উনিশ শতকের প্রতাপশালী আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামোর জীবননাটক উন্মোচনই এই লেখার প্রধান অভিমুখ। সেই প্রয়োজনে, উনিশ শতকের কলকাতা শহরের নাট্যক্ষেত্র থেকে একে একে চারটি নির্বাচিত ঘটনা তুলে ধরবো। তারপর ঘটনাগুলো ভেঙে ভেঙে পাঠ করবো। সবশেষে তর্কের নিষ্পত্তি ঘটিয়ে প্রণীত সিদ্ধান্ত হাজির করবো।    

ঘটনা : ১ 
ইংরেজ সাহেবের নাট্যশালায় বাঙালি বাবুর প্রবেশ

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তারের প্রক্রিয়ায় ইংরেজ সাহেবদের জন্য কলকাতায় ইংলিশ থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়। রুস্তম ভারুচার তথ্য মারফতজানা যায় আঠারো শতকের শেষার্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা, সৈন্য, কেরানি ও পণ্ডিত প্রভৃতির চিত্তবিনোদনের প্রধান ক্ষেত্র হয়ে ওঠে কলকাতার ইংলিশ থিয়েটার। সেখানে অভিনয়শিল্পী থেকে দর্শক এমনকি অডিটোরিয়ামের দারোয়ান থেকে ঝাড়ুদার সবাই ছিলেন ইংরেজ। এই পরিস্থিতিতে, ইংরেজদের শাসনব্যবস্থার উপজাত একটি নতুন নেটিভ অভিজাত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল। শাসকশ্রেণীর সাংস্কৃতিক জগতে বহুদিন ধরেই প্রবেশ না করতে পারার ফলে স্থানীয় অভিজাতদের মধ্যে সাংস্কৃতিক অতৃপ্তির একটি টেনশনও তৈরি হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে প্রথম বাজিমাৎ করেন রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর। পরবর্তীতে, ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী আনুগত্যের পুরস্কারস্বরূপ তাঁকে ‘প্রিন্স’ খেতাবেও ভূষিত করে। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮১৩ সালে ব্যক্তিগত চাঁদা দেয়ার মাধ্যমে ইংরেজদের নাট্য উপভোগের উদ্দেশ্যে অডিটোরিয়ামে প্রবেশের জন্য সদস্যপদ ক্রয় করেন। সাহেবের বৈঠকখানায় বাঙালি বাবুর প্রবেশাধিকার প্রাপ্তি সেই সময় একটি সাড়া জাগানো ঘটনা হয়ে উঠেছিল। বাঙালি বাবুদের সাংস্কৃতিক উল্লম্ফনের নিরিখে এই ঘটনা ছিল একটি নাটকীয় বাঁকবদল।

ঘটনা : ২ 
সাহেবদের কায়দায় বাবুদের নাট্যমঞ্চায়ন

১৮৩৫ সাল। আরেক অভিজাত বাঙালি বাবু নবীনচন্দ্র বসুর বাড়ি। পুরো বাড়িজুড়ে মঞ্চস্থ হয় নাটক বিদ্যাসুন্দর। এই ঘটনার আগে ১৮৩১ সালে বাবু প্রসন্ন কুমার ঠাকুর হিন্দু থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে নবীন বাবুদের পথ দেখিয়ে ছিলেন। একই পথ ধরে এই প্রযোজনা দেখার জন্য বাবুশ্রেণির বাঙালিদের সাংস্কৃতিক হৃৎপিণ্ডে রীতিমত কম্পন শুরু হয়েছিল। কারণ সেই প্রযোজনায় তৎকালীন প্রায় ১৩০০০ পাউন্ড বা দুইলাখেরও বেশি টাকা ব্যয় হয়েছিল। এই প্রযোজনার প্রতি বাঙালি অভিজাত শ্রেণির অতি উৎসাহের আরো কারণ ছিল। নাটকটির বিভিন্ন দৃশ্য নবীনবাবুর বাড়ির আনাচে-কানাচেও প্রদর্শিত হয়েছে। এমনকি, বাড়ির বাগান ও ড্রইং রুমও অভিনয়ের মঞ্চে পরিণত হয়েছিল। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সমগ্র প্রযোজনাটিতে ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা নানা ধরনের নাট্য-প্রযুক্তিরও প্রয়োগ ঘটেছিল। ফলে বাড়িটি যেন একটা এনভায়রনমেন্টাল স্পেকট্যাকল বা নাট্যে বর্ণিত দৃশ্যের বাস্তবধর্মী পরিবেশের একেবারে প্রতিরূপ হয়ে উঠেছিল। বাস্তববাদী দৃশ্যসজ্জার মাধ্যমে হুবহু প্রতিরূপায়ণের এই মডেলটি দর্শক হিসাবে উপস্থিত বাঙালি বাবুদের একেবারে মোহমুগ্ধ করেছিলো। বিশেষ করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রতাপচন্দ্র সিংহ এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে পরবর্তীতে তারা আধুনিক বাংলা নাটকের ব্যক্তিগত উদ্যোগে মঞ্চায়নের যে শৌখিন ধারা গড়ে ওঠে সেগুলোতে বেশ পৃষ্ঠপোষকতাও দিয়েছেন। ভারুচার কাছ থেকে ওপরে বর্ণিত তথ্যের পাশাপাশি আমরা আরো একটি বিশেষ তথ্য পাই। যতটা না বিদ্যাসুন্দর নাটকের গল্প বা পাণ্ডুলিপিতে বাবুরা আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছিলেন নাটক উপস্থাপনের কৃৎকৌশল দেখে।

ঘটনা : ৩
সাহেবের মঞ্চে সাহেবী ভাষায় বাবুর অভিনয়

১৮৪০ সালে কলকাতার সাঁ সুচি থিয়েটারের প্রযোজনা শেক্সপীয়রের ওথেলো ট্র্যাজেডির নামচরিত্রের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বৈষ্ণবচন্দ্র আঢ্য নামের এক ‘নেটিভ জেন্টলম্যান’। ক্যালকাটা স্টার পত্রিকা বর্ণবাদী ভাষায় তাঁকে উল্লেখ করেছিলেন ‘আ রিয়েল আনপেইন্টেড নিগার’। অনুবাদে নয় বরং সরাসরি ইংরেজি নাটকে এই বাঙালি বাবুর কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্রে অভিনয় করতে পারার গৌরবে তাঁর সগোত্রীয় ভদ্রলোকেরা সেই সময় ‘সিগনিফিকেন্ট ট্রিয়াম্ফ’ বা সবিশেষ উল্লাসও প্রকাশ করেছিলেন। ক্যালকাটা স্টারের রিপোর্ট থেকে জানা যায়—‘হিজ ডেব্যু হ্যাজ সেট দি হোল ওয়ার্ল্ড অফ ক্যালকাটা অ্যাগগ’ অর্থাৎ ইংরেজের মঞ্চে, ইংরেজ মহাকবির রচিত চরিত্রে, ইংরেজি ভাষায় এই বাঙালি যুবকের অভিনয়ের ঘটনায় ‘সমগ্র’ কলকাতায় কম্পন সৃষ্টি হয়েছিল।

ঘটনা : ৪
সাহেবদের নাট্যমঞ্চের রূপ-রীতি বাবুদের আত্মসাৎ

কলকাতায় সাহেবদের অনুকরণে বাবুশ্রেণির একচেটিয়া নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা ও অভিজাতশ্রেণির বিনোদনমাধ্যম হিসাবে ঔপনিবেশিক/আধুনিক নাট্যচর্চা কুক্ষিগত করে রাখার ফলে নতুন উত্থিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকাঙ্ক্ষার সাথে সেই সময় একটা দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে ১৮৫০’র দশকের পর থেকে বাবুশ্রেণির সাংস্কৃতিক একাধিপত্য নিয়ে নানা প্রশ্ন ও ঝুঁকি দেখা দেয়। এই প্রেক্ষাপটে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত করে বাণিজ্যিকভাবে নাট্য প্রদর্শনীর জন্য বাবুদের চৈতন্যের ছায়ায় নতুন মধ্যবিত্তশ্রেণির কেউ কেউ এগিয়ে আসেন। এভাবে ১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। কিন্তু কৌতূহলের ব্যাপার হলো সাহেবদের দেখানো পথে বাবুশ্রেণির একচেটিয়া নাট্যচর্চার বিরোধিতা করে যে নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হয় এর পাশ্চাত্য মঞ্চস্থাপত্যরীতি (প্রসেনিয়াম স্টেজ) ছিল ঐতিহ্যবাহী দেশজ নাট্যপরিবেশনার উপস্থাপন ও আসরকেন্দ্রিক দেখার একেবারেই বিপরীত। হাস্যকর ব্যাপার হলো, জাতীয় পরিচয়বাহী এই ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ নির্মিত হয়েছিল কলকাতার শ্বেতাঙ্গ কলোনিতে অবস্থিত সাহেবদের বিনোদনকেন্দ্র ‘লাইসিয়াম থিয়েটারে’র অনুকরণে। কলকাতার লাইসিয়াম থিয়েটার আবার লন্ডন লাইসিয়াম থিয়েটারের নকলে নির্মিত হয়েছিল। লন্ডনের লাইসিয়াম থিয়েটার আবার গ্রিক-হেলেনীয় স্থাপত্যরীতির অনুপ্রেরণায় নির্মিত হয়েছিল। নকলের নকল করে তারা নিজেদের নাট্যশালা নির্মাণ করে একে আবার ‘জাতীয়’ বলেও দাবি করেছিলেন।

ঘটনাবলী বিশ্লেষণের ধারা

এখন প্রশ্ন হলো, উনিশ শতকের শুরু থেকে প্রায় শেষ অবধি এমন ঘটনাগুলো ঘটবার পেছনে কারণ কী? ইত্যাদি ঘটনার অর্থ-তাৎপর্যইবা কী? তা ছাড়া, বর্ণিত ঘটনাবলীর পরম্পরা বর্তমান সাংস্কৃতিক জীবনে কী উত্তরাধিকার জারি রেখেছে তা অনুধাবনের সুবিধার্থে আমরা এখানে এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজব। পাশাপাশি একটি সত্য ভুলে যেতে চাই না। চিন্তার ভুবনে, তর্কের জমিনে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রক্রিয়া আরো একগুচ্ছ নতুন প্রশ্নেরই জন্ম দেয়। জ্ঞানচর্চায় এটাই দস্তুর।

প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ঘটনার কারণ ধরণ ও অর্থ-তাৎপর্য বোঝার প্রয়োজনে আমাদের সর্বাগ্রে খুঁজতে হবে ঘটনার নায়ক কারা এবং তাদের পরিচয় কী? এই মৌলিক প্রশ্নের ফয়সালা করতে হলে উনিশ শতকের বর্ণিত নাট্যঘটনাগুলোর প্রধান প্রধান কুশীলব দ্বারকানাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে বৈষ্ণবচন্দ্র, নবীন বসু এবং ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা বাবু শ্রেণির ঠিকুজি সন্ধান প্রয়োজন। কারণ, মিশেল ফুকোর ভাবনা অনুসরণ করে বলা যায় ‘জ্ঞান/ক্ষমতা’ সম্পর্কের আলোচনায় কোনো বিষয় বুঝতে স্বয়ং সেই বিষয়কেই বাদ দিতে হয়। কেননা একটি ঐতিহাসিক কাঠামোর মধ্যে কোনো একটি বিষয় কিভাবে বিধিবদ্ধ হয় তার বিবরণ তৈরি করতে পারলেই সেই বিষয় সম্পর্কে বিশ্লেষণে উপনীত হওয়া যায়। ফুকোর অনুসরণে দ্বারকানাথ ঠাকুরদের বিষয়-আশয় বিশ্লেষণের লক্ষ্যে স্বয়ং দ্বারকানাথদের জন্ম-মৃত্যুর সন-তারিখ ও পিতামাতার বৃত্তান্ত তুলে ধরার পন্থা বর্জন করবো। বরং মনোনিবেশ করবো কিভাবে দ্বারকানাথ বাবুরা বাংলার ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিক কাঠামোতে একটি বিশেষ শ্রেণির প্রতীক ও প্রতিভূ হয়ে উঠেছিলেন সেই বিবরণ নির্মাণের দিকে। তা ছাড়া মার্কসবাদী চিন্তার ঘরানা থেকে আমাদের সবারই জানা আছে সামাজিক শ্রেণিকে বুঝতে হলে ইতিহাসের প্রক্রিয়ায় বুঝতে হয়। কারণ শ্রেণি একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। ইতিহাসের বাইরে সামাজিক শ্রেণিকে হয়তো চিন্তা করা সম্ভব কিন্তু চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। 

বাবুদের শ্রেণি-পরিচয়

বর্তমানে কথ্যভাষায় ভদ্রলোক শ্রেণি বলতে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকেই বোঝানো হয়। কিন্তু ইতিহাস বলে ভারতবর্ষে, বিশেষত, বাংলায় ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে একটি দেশীয় অভিজাত শ্রেণি হিসাবে ভদ্রলোকদের উদ্ভব ঘটেছিল। ইংরেজিতে ভদ্রলোক বলতে বোঝানো হয় ‘ওয়েল ম্যানারড পার্সন’। অর্থাৎ, আচারে বা কেতায় যে খুব চোস্ত। তবে ঐতিহাসিক বিচারে, কেতাদুরস্ত ব্যক্তি মাত্রই ভদ্রলোক বলে গণ্য হবেন না। কারণ ভদ্রলোক একটি সামাজিক বর্গ। সামগ্রিকভাবে ভদ্রলোকদের একটি শ্রেণি-পরিচয় রয়েছে। আনুমানিক ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে ঔপনিবেশিক আমলে বাংলায় ভদ্রলোক শ্রেণির উদ্ভব। মূলত ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে এই অভিজাত সামাজিক শ্রেণির বিকাশ ঘটে। তবে প্রাক-ঔপনিবেশিক বা প্রাগাধুনিক যুগে, সংস্কৃত পরিভাষা ‘ভদ্র’ অর্থে অনেক গুণের সমাহারকেই বোঝানো হত। বিশেষত ‘সম্পত্তিবান’ এবং আচরণগত দিক থেকে ‘মার্জিত’ বোঝাতে সংস্কৃত ভাষার ‘ভদ্র’ শব্দটি ব্যবহারের অধিক প্রচলন ছিল। পলাশির যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্রমশ দণ্ডমুণ্ডের কর্তারূপে ইংরেজ উপনিবেশের বিস্তারকে প্রবল করে তোলে। ইতিহাসের এই বিশেষ পর্যায়ে ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক উপাদান হিসাবে বাংলায় ভদ্রলোক শ্রেণির বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছিল। এবং উনিশ শতকের মাঝামাঝি এটা একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সামাজিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত ভদ্রলোকশ্রেণির প্রথম সমালোচনা হাজির করেন ভবানিচরণ বন্দোপাধ্যায় [১৭৪৭-১৮৪৮]। তাঁর নববাবুবিলাস [১৮২৫] এবং নববিবিবিলাস [১৮৩১] প্রভৃতি প্রহসনধর্মী রচনায় এই অভিজাত ভদ্রলোক শ্রেণিকে সরস ভাষায় ও তীক্ষ্ণ ভঙ্গিতে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছেন। তিনি এদেরকে ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি তারা যে ইংরেজদের সংস্পর্শে এসে ক্রমশ সম্পত্তিবান হচ্ছেন তাও দেখিয়ে দেন। ক্রমান্বয়ে আমরা দেখব যারা ভূসম্পত্তির অধিকারী এবং প্রশাসনিক কার্যাধিকারী—এই শ্রেণিটিই উনিশ শতকে সার্বিকভাবে ভদ্রলোক পরিচয়ে পরিগঠিত হচ্ছেন। তাদের উপাধি হয় বাবু। অর্থাৎ ইংরেজ সাহেবদের দোসর শ্রেণি হিসেবেই বাঙালিদের মধ্যে গড়ে ওঠে এই বাবু শ্রেণি। দ্বারকানাথ ঠাকুর, বৈষ্ণবচন্দ্র আঢ্য, নবীনচন্দ্র বসু, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রতাপচন্দ্র সিংহসহ সকলেই ছিলেন এই ভদ্রলোক শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত বাবু উপাধিভূষিত। 

ভদ্রলোক শ্রেণির আত্মপ্রকাশের নেপথ্যে আত্মসমর্পণ

ওপরে বর্ণিত ঘটনাবলি বস্তুত এই শ্রেণির নিজেদের আত্মপ্রকাশের উপায় খোঁজার উদাহরণ হিসাবে পাঠ করা যায়। ঔপনিবেশিক প্রভুদের আচরিত জীবনধারা নকল করার মাধ্যমে উপনিবেশিত জনগণের মধ্যে গজিয়ে ওঠা এই বাবুশ্রেণি নিজেদের আভিজাত্য ও ক্ষমতা ব্যক্ত করার উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন নাট্যকলা। অর্থাৎ বাঙালি বাবুদের ইংরেজ সাহেব হওয়ার বাসনা চরিতার্থের সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার নাম হলো উনিশ শতকের আধুনিক/ঔপনিবেশিক বাংলা নাট্য। রুস্তম ভারুচার মতে, আধুনিক বাংলা নাট্যের প্রারম্ভিক ইতিহাস হলো উপনিবেশিত জনগণের সাংস্কৃতিক আত্মসমর্পণ। ভারুচার বক্তব্যের সারবত্তা হলো, দাসত্ব বরণের প্রক্রিয়ায় উনিশ শতকে আধুনিক বাংলা নাট্যের সূত্রপাত। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার প্রখ্যাত নাট্য গবেষক অধ্যাপক রুস্তম ভারুচার বক্তব্যে সত্য যেমন আছে, তেমনি সমস্যাও আছে। সমস্যা যতটা না চিন্তার, তার চেয়ে বেশি একটি বিশেষ ক্ষেত্রে চিন্তার সাধারণীকরণের। যেমন তিনি বলেছেন, ‘কালচারাল সাবসারভিয়েন্স অফ কলোনাইজড’।এখানে ‘কলোনাইজড’ বলতে ভারুচার শব্দটিকে আমি অনুবাদ করেছি ‘উপনিবেশিত জনগণ’। কারণ, তার আলোচনার এই সিদ্ধান্তমূলক বাক্যটিতে উপনিবেশিত অর্থ যে সকল জনগণকেই ইঙ্গিত করে, তা পাঠকের কাছে আর ব্যাখ্য করার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু এক্ষেত্রে সাধারণীকরণের ফলে ভারুচার বক্তব্য যে অস্পষ্টতা তৈরি করে তা দূর করা প্রয়োজন। আধুনিক বাংলা নাট্যে সাংস্কৃতিক দাসত্বের আলামত স্পষ্ট দেখা দেয় বটে কিন্তু উপনিবেশিত জনগণের সকলেই তো আর সাংস্কৃতিক ক্রীতদাসে পরিণত হয়নি। ভারুচা যা স্পষ্ট করেননি তা হলো, উপনিবেশিত জনগণের সমগ্র অংশ নয়, বরং সেই জনগণের মধ্যে অতিক্ষুদ্র একটি অংশ ওই ভদ্রলোক বাবুশ্রেণি ইংরেজ ঔপনিবেশিক প্রভুদের চরণে সাংস্কৃতিকভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।

বিচ্ছিন্নতার ফলস্বরূপ আধুনিকতা

ভদ্রলোক শ্রেণির এই সাংস্কৃতিক আত্মসমর্পণকে আধুনিকতার এলিয়েনেশন ইফেক্ট বা বিচ্ছিন্নতার প্রভাব হিসাবে দেখা যেতে পারে। কারণ নতুন ঔপনিবেশিক নাট্যচর্চায় উনিশ শতকে বাংলা অঞ্চলে প্রচলিত কথকতা, যাত্রা, পাঁচালি, পালা প্রভৃতি প্রায় শতাধিক জনপ্রিয় দেশজ নাট্যের আঙ্গিকগুলো বাবুরা বর্জন করেছিলেন। ফলে কলকাতার বাবু শ্রেণির নাটকের সাথে প্রাগাধুনিক অর্থাৎ গ্রামীণ কৃষি-সমাজের যূথবদ্ধ জনজীবনে আচরিত ধর্মকৃত্যবাহিত পরিবেশনাগুলোর একটি স্পষ্ট বিচ্ছেদ ঘটে। বিশাল জনজীবনের নাট্যসংস্কৃতি থেকে এই বিচ্ছেদ জনিত কারণে সৃষ্ট আধুনিকতার ফাটল অর্থাৎ সাহেব-বাবুর বৈঠকখানা থেকেই উনিশ শতকের বাংলা নাটকের সূত্রপাত। একই বিষয়ে নানা চিন্তার বিচ্ছুরণের প্রয়োজনে ঘুরিয়ে বলা যায়, উনিশ শতকের বাংলা নাটকের আধুনিকতা হলো কলকাতা শহরের নগণ্যসংখ্যক বাবু শ্রেণির একটি বিচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি। এবং কৃষক সমাজের সংস্কৃতির তুলনায় এই অভিব্যক্তিকে বলা যেতে পারে ভদ্রলোকশ্রেণির ফ্রগজাম্প বা উল্লম্ফন।

একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ

এখন প্রশ্ন হলো, বাবুরা কেন এই খেলায় জড়িয়েছিলেন? এর উত্তর খুঁজতে এই পর্যায়ে আমরা অনেকের দোহাই দিব। প্রথমত, আবারও রুস্তম ভারুচা। ভারুচা অন্যত্র বাংলার ভদ্রলোক শ্রেণির ‘বাবু’ সর্বনাম আড়াল করে তাদের আখ্যায়িত করেছেন দেশীয় আলোকিত [এনলাইটেন] শ্রেণি হিসাবে। ভারুচার মতে, এই শ্রেণিটি নিজেদের গরিমা [প্রেস্টিজ] ব্যক্ত করার জন্য উনিশ শতকে তাদের ঔপনিবেশিক প্রভুদের নাটক অবলম্বন করেছিলেন। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস হলো, বাংলার বাবুদের চর্চিত নাটকের সবটাই ছিল বিলাতের অনুকরণ। ইংল্যান্ডের তৎকালীন ড্রুরি লেন আর কভেন্ট গার্ডেনের আলোকসজ্জা, একমুখী দর্শক বসবার ‘ফোর্থ ওয়াল’ প্রথাভিত্তিক প্রসেনিয়াম মঞ্চায়ন রীতি আর চরিত্রাভিনেতাদের প্রহেলিকাময় প্রবেশ-প্রস্থানের বিধি-বিধান সেই সময়ে সবেগে নকল করা হচ্ছিল। এভাবে উনিশ শতকের কলকাতায় ইংরেজ সাহেবদের বৈঠকখানা থেকে বাঙালি বাবুদের বৈঠকখানায় বিস্তার লাভ করে বাংলা নাটক। এই প্রসঙ্গে তখনকার বাংলা নাটক তথা সাংস্কৃতিক চর্চার আধুনিকতার স্বরূপ সম্পর্কে আরো কয়েকটি সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করা যেতে পারে। উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক আধুনিকতা হলো একটি বিচ্ছিন্ন কিন্তু প্রতাপশালী শ্রেণির ক্ষমতা ও আভিজাত্যের অভিব্যক্তি। তা ছাড়া, তৎকালীন বাংলায় আধুনিকতার আরো একটি বৈশিষ্ঠ্য হলো পাশ্চাত্যের/ইংরেজের জীবনবীক্ষণের ষোল আনা নকল। বলা বাহুল্য, বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে লক্ষণীয় আধুনিকতা হলো কৃত্রিম আধুনিকতা। তদুপরি, ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী থেকে উপনিবেশিত ক্ষমতাবানগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবাহিত হওয়ার ফলে বলা যায় ওই আধুনিকতা হলো নাটক ও সাংস্কৃতিকতার মোলায়েম প্রলেপমাখা শোষণমূলক সৌন্দর্যচর্চার নমুনামাত্র। কলকাতায় বাবুদের নাটক থেকে প্রতীয়মান হয় [বিলাতি] ঔপনিবেশিকতা এবং [বঙ্গীয়] আধুনিকতা মূলত অবিচ্ছেদ্য। এই আধুনিকতা সাম্রাজ্যের কেন্দ্র থেকে প্রান্তে নকল সংস্করণ আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। উনিশ শতকের বাবুদের সাংস্কৃতিক চর্চার বিশেষ ঘটনাগুলো বিবেচনায় নিলে এই বক্তব্যের সপক্ষে তার আর বেশি প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। ফলে আমরা বলতে পারি—যা ঔপনিবেশিকতা, আদতে তা-ই আধুনিকতা। সাম্রাজ্যবাদের ছদ্মবেশে প্রগতি ও যুক্তির মাহাত্ম্য বর্ণনা করে এটি বিশ্বজনীন এক সাংস্কৃতিক বাধ্যবাধকতা হয়ে ওঠে। 

সাংস্কৃতিক আধিপত্য ও সম্মতির রসায়ন

সমাজতাত্ত্বিক আলাঁ তোরেইঁ আধুনিকতাকে এর এই বাধ্যবাধকতার কারণে সমালোচনা করেছেন। তোরেইঁ [পাশ্চাত্য] আধুনিকতা ধারণাটিকে বুঝতে চেয়েছেন মানুষের স্বতন্ত্র ব্যক্তি হওয়ার কর্মকাণ্ডের সূত্রে। তাঁর মতে, কর্তায় পরিণত হয়ে আধুনিক ব্যক্তি-মানুষ নানা বন্ধন থেকে মুক্ত হতে নিরন্তর সংগ্রাম করে।১০ কিন্তু উনিশ শতকে বাংলার বেশ কয়েকজন ভদ্রলোক বাবুর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে [ওপরে বর্ণিত সে যুগের নাট্যচর্চার চারটি ঘটনায়] কি স্বতন্ত্র ব্যক্তিরূপে কোনো একজন বাবুরও মুক্তির চর্চা লক্ষ্য করা যায়? না। সে তো যায়ই না বরং আমরা তাদের পরানুকরণবৃত্তি ও পরাধীনতাই দেখতে পাই। এর জন্য কেবল বাবুশ্রেণি নিজেরাই দোষী নয়। তাদের কেন সর্বাংশে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না, আন্তনিও গ্রামসির ভাবনা১১ কাজে লাগিয়ে ব্যাপারটি ফয়সালা করা যেতে পারে। কোনো সমাজের প্রতাপশালী ভাবাদর্শ যেমন বোধ-বিশ্বাস, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, রসাস্বাদন, মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা ইত্যাদি সবকিছুই শাসকশ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী জীবন-বীক্ষণ দিয়ে গঠিত হয়। প্রতাপশালী ভাবাদর্শ শাসকশ্রেণির পক্ষে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা কায়েম রাখতে এবং সর্বময় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে এগুলোকে চিরন্তন, স্বাভাবিক ও সর্বমানবের জন্য অতিশয় কল্যাণকর বলে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ফলে অধস্তন জনগণ এ যে একটি কৃত্রিম ব্যবস্থা বা সমাজিক নির্মাণ তা বুঝে উঠতে পারে না। এই অজ্ঞানতার কারণে অধস্তনেরা সর্বদা শাসকশ্রেণির নির্মিত ফল্স কনশাসনেস বা ভ্রান্ত চৈতন্যের ঘোরে ঘুরপাক খায়। উপরে উল্লেখ করা চারটি ঘটনার উদাহরণ থেকে বলা যায়, উনিশ শতকে বাংলার বাবু শ্রেণি একই রকম ভ্রান্ত চেতনার ফাঁদে পড়েছিল। বাংলায় ইংরেজদের সাংস্কৃতিক উপনিবেশায়নের প্রথম ভিক্টিম এই ভদ্রলোক বাবুশ্রেণি। ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ভাবাদর্শ তৎকালীন ভদ্রলোকদের মধ্যে একটি ‘হেজিমনি’ [সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে সম্মতি আদায়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য] সৃষ্টি করেছিল। ইংরেজদের সংস্কৃতিকে ‘স্বাভাবিক’ ‘চিরন্তন সত্য’ ‘সর্বমানবের জন্য কল্যাণকর’ ভেবে ও মেনে বাবুশ্রেণির সম্মতি প্রদানের প্রক্রিয়া মূলত ঔপনিবেশিক প্রভুদের আধিপত্যেরই প্রক্রিয়া। যার অপর নাম সাংস্কৃতিক উপনিবেশায়ন। 

বাদামী চামড়া, সাদা মুখোশ

তবে উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় ভদ্রলোক বাবু শ্রেণির মধ্যে উৎপাদিত সম্মতির ব্যাপারটি গ্রামসি বর্ণিত পরিস্থিতির চেয়ে কিছুটা ভিন্ন ও জটিল। কারণ উপনিবেশের ভিতরে উপনিবেশিত জনগণের অন্তর্ভূক্ত একটি বিশেষ শ্রেণি হিসাবে ভদ্রলোক বাবুরাও এক প্রকার শাসক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় লিপ্ত ছিলেন। দাসের পরিচয় ছাড়িয়ে প্রভু হয়ে ওঠার ক্রিয়ায় [অর্থাৎ উনিশ শতকের নাট্যচর্চার মাধ্যমে] ভদ্রলোক বাবু শ্রেণি বস্তুত এক দোআঁশলা [হাইব্রিড] প্রভু হয়ে উঠেছিলেন। গোলাম থেকে সাহেব হতে গিয়ে তারা শেষপর্যন্ত হয়েছিলেন বাবু। এই লক্ষণটিকে ফ্রাঞ্জ ফাঁনোর চিন্তার অনুসরণে বলা যায় ‘ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্কস’।১২ একজন দাস মনের মধ্যে সবসময় নিজের প্রভুর মত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। তাই ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় কালো চামড়ার মানুষ সাদা মুখোশ পরে উদযাপনে মত্ত হয়। উনিশ শতকের কলকাতায় আধুনিক বাংলা নাটকের চর্চায় ভদ্রলোক বাবুগণ ঠিক একই কাজ করেছিলেন। বাবুদের এই আচরণ থেকে তাদের মনের হদিস পাওয়া যায়। এ হলো দাসের প্রভু হওয়ার বাসনার ইতিহাস। বাদামী চামড়ার বাবুশ্রেণির মুখে লাগানো সাদা রঙের ইংরেজ শাসকদের এই মুখোশটাই উনিশ শতকের বাংলা নাটক। সংক্ষেপে বললে, আধুনিকতার নকল সংস্করণ।

আধুনিক সাংস্কৃতিকতার মুখোশ পরে ভদ্রলোক বাবুরা নিজেদের শ্রেণিগত অস্তিত্বের মধ্যে দুটো পরস্পরবিরোধী উপাদান আত্মসাৎ করেছিলেন। একটি হলো ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে তাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ। অপরটি হলো উপনিবেশিত জনগণের মধ্যে ভদ্রলোক শ্রেণির নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা। স্লাভো জিজেক থেকে ধার করে বলা যায়, বাবুদের নাটক তথা সাংস্কৃতিক চর্চার ঘটনাগুলো ভদ্রলোক শ্রেণির ‘আত্ম বৈধতাদান’ [সেল্ফ লেজিসলেশন] তুলে ধরে। বাবুদের নাট্যচর্চার এই ঘটনাগুলো কোনোভাবেই ‘আত্ম উপলব্ধি’ [সেল্ফ রিয়েলাইজেশন] থেকে ঘটেনি। উনিশ শতকে এভাবেই ভদ্রলোকদের মধ্যে নিজেদের শ্রেণিকে নিজে নিজে বৈধতাদানের পরাধীন তৎপরতা দেখা দিয়েছিল। আবারও জিজেক থেকে তাঁর পূর্বোক্ত চিন্তার ঋণ নিয়ে বলতে পারি, উনিশ শতকের এই শহুরে সাংস্কৃতিক তৎপরতা হলো আধুনিকতার অস্বস্তি, ব্যক্তির স্বায়ত্তশাসনের নামে দাসত্ব। মৌলিকভাবে এক শঙ্কা ও বিভ্রান্তি।১৩

দোদুল্যমান জাতীয়তাবাদ

স্লাভো জিজেকের ভাবনা পুনর্বিন্যাস করে বলা যায়, সাহেবদের মতো হয়ে উঠতে বাবুদের শ্রেণিগত সামষ্টিক আকাঙ্ক্ষার ভিতরে ক্রমশ একটি নৈতিক সংকট সৃষ্টি হচ্ছিল। এই সংকটের কারণ আত্মপরিচয়ের অভাববোধ। ফলে একটি আত্মোপলব্ধির পর্যায় আসে যা তাদের মনে এক প্রকার ‘উদ্বেগ’ তৈরি করে। এবং এই উদ্বেগের ফলস্বরূপ ভদ্রলোক শ্রেণির কারো কারো মধ্যে জাতীয়তাবাদী পরিচয়বোধের উন্মেষ ঘটেছিল। বাবুদের আধুনিক বাংলা নাট্যচর্চার মানচিত্রে এই উদ্বেগের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক নাম ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। উনিশ শতকের শেষভাগে একটি নাট্যশালার ‘ন্যাশনাল’ নামকরণের মধ্যে বাবুশ্রেণির একান্ত নিজস্ব পরিচয় ব্যক্ত করার যে উদ্দেশ্য তা প্রাথমিকভাবে স্পষ্ট হলেও, এই ঘটনা স্বভাবত কয়েকটি প্রশ্নেরও উদ্রেক করে। কারণ বাবুরা নিজেদের জাতীয় নাট্যশালার মাধ্যমে আত্মপরিচয় নির্মাণ করতে গিয়ে অপরের [ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকদের] নাট্যশালার ডিজাইন নকল করেছিলেন। প্রশ্ন হলো, অপরকে অনুকরণ করে নিজকে কিভাবে ব্যক্ত করা যায়? অপরকে স্তুতি করে নিজকে কিভাবে উদযাপন করা সম্ভব?১৪ ঔপনিবেশিক আধুনিকতার পরানুকরণের কারণে ভদ্রলোক শ্রেণির যৌথ অচেতন মন আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগছিল আর সেই সংকট থেকে সৃষ্ট উদ্বেগের কারণেই তখন এটা করা সম্ভব হয়েছিল। কেননা উদ্বিগ্ন চেহারা সবসময় মিশ্রিত চেহারা। আত্ম [বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণি] ও অপর [ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসক শ্রেণি]—এই উভয় অবয়ব একটি একক চেহারার রূপ নিলে তা দেখতে কেমন হয় এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ১৮৭২ সালে বাবুদের প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল থিয়েটার’। ঔপনিবেশিক বাস্তবতা সাংস্কৃতিক চর্চায় এভাবেই মিশলা অভিব্যক্তি তৈরি করে চলে। হোমি কে. ভাভা একেই বলেন ‘হাইব্রিডিটি’ বা ‘শংকরদশা’।১৫ বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণি যখন নিজের অপর স্বরূপ  ‘উৎকৃষ্ট’ পরিচয়ের অধিকারী ইংরেজ সাহেবদের থেকে ভিন্ন পরিচয় নির্মাণ করতে চেয়েছেন, তখন ভদ্রলোকেরা এমন কিছু করেছেন যা আদতে তাদের অপরপক্ষ থেকে ভিন্ন কিছু হয়নি। বরং প্রায় একই রকম কিছুই হয়েছে। যদিও এই একইরকমের মধ্যেও কিঞ্চিৎ ফাঁক রয়ে গেছে।১৬ এই হলো উনিশ শতকের বাংলা নাটকের সাহেব-বাবুর দোআঁশলা আত্মপ্রকাশ। সাংস্কৃতিক উপনিবেশায়নের প্রক্রিয়ায় দাসত্বে পর্যবসিত ভদ্রলোক বাবু শ্রেণির আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে দেখা দেওয়া উদ্বেগের নিরাময়রূপী দোদুল্যমান জাতীয়তাবাদী আত্মপরিচয় এবং কৃত্রিম আধুনিকতার নমুনাবিশেষ।   

শেষ বিচারে ভ্রান্তিবিলাস

অবিভক্ত বাংলার রাজধানী শহর কলকাতায় উনিশ শতকের বাংলা নাটকের চারটি নির্বাচিত ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখতে পাই তৎকালীন ঔপনিবেশিক সমাজের মুখ্য দুই কুশীলব ইংরেজ সাহেব আর বাঙালি বাবুর ক্ষমতা চর্চার খেলা। আর্থ-রাজনৈতিক ময়দানে বিশেষত বলপ্রয়োগ আর সাংস্কৃতিক মঞ্চে সাধারণত সম্মতি আদায়—এই দুই হাতিয়ার নিয়েই সাহেবগণ খেলায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সাংস্কৃতিক মঞ্চে বাবুগণ খেলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন সৃষ্টি ছাড়া অনুকরণের নেশায়, ভ্রান্ত মর্যাদার বোধে বুঁদ হয়ে। উনিশ শতকে বাংলা নাটকের আধুনিক মঞ্চে ভদ্রলোকশ্রেণির বাবুদের এই আবির্ভাব-ক্রিয়াকে ‘ভ্রান্তিবিলাস’ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উইলিয়াম শেক্সপীয়রের কমেডি অব এররস-এর গদ্যানুবাদ করে নাম দিয়েছিলেন ভ্রান্তিবিলাস। এখানে আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করার বিষয় হলো বিদ্যাসাগর ‘কমেডি’ শব্দটিকে অনুবাদ করেছেন ‘বিলাস’ এবং ‘এররস’কে ‘ভ্রান্তি’। এই সূত্রে উল্লেখ করা যায় স্লাভো জিজেকের ‘কমেডি বিটুইন দি আগলি অ্যান্ড দি সাবলাইম’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধের প্রসঙ্গ। এই লেখায় তিনি জার্মান দার্শনিক হেগেল ও আধুনিকতার গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা হাজির করেছেন।১৭ জিজেকের উপরোক্ত লেখার ভাবনায় আলোড়িত হয়ে শেষ বিচারে বলা যায়, সাংস্কৃতিক দাসরূপী ‘অতি কুৎসিত’ [দি আগলি] বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণির বাবুদের এবং সাংস্কৃতিক অধিপতিরূপী ‘পরম সুন্দর’ [দি সাবলাইম] ইংরেজ সাহেবদের মধ্যকার এই ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক সম্পর্কটি বস্তুত একটি হাসির নাটক হয়ে উঠেছিল। সেই ইতিহাস ফিরে দেখে, বাংলার আধুনিক সমাজ বাস্তবতারূপী এই  নাটকের নাম দেওয়া যায় কমেডি অব এররস অথবা ভ্রান্তিবিলাস। তবে ‘একরূপী আধুনিকতা’র [সিঙ্গুলার মডার্নিটি] এই ভ্রান্তিবিলাস পেরিয়ে ঔপনিবেশিক ‘আধুনিকতার বহু-বিচিত্র রূপ’ [হেটেরোজেনাস মডার্নস]১৮ খুঁজতে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখের জীবন ও কাজ হতে পারে আমাদের ভবিষ্যতের চারণভূমি।  

 

টীকা ও তথ্যসূত্র

১.   Bharucha, Rustom. Rehearsals of Revolution: The Political Theatre of Bengal. Honolulu: University of Hawaii Press, 1983. p.8
২.   পূর্বোক্ত, পৃ.৯
৩.   পূর্বোক্ত, পৃ.৮
৪.  
Chatterjee, Sudipto. “The Nation Staged: Nationalist Discourse in Late Nineteenth-Century Bengali Theatre” in (Post) Colonial Stages: Critical & Creative Views on Drama, Theatre & Performance. Edited by Helen Gilbert, West Yorkshire: Dangaroo Press, 1999. p.11
৫.   ডিসকোর্স, সত্য, জ্ঞান উৎপাদন ও ক্ষমতাচর্চার জটিল অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক প্রভৃতি বিস্তারিত জানতে পাঠ করা যেতে পারে: Foucault, Michel. Power/knowledge: selected interviews and other writings, 1972-1977edited by Colin Gordon; translated by Colin Gordon ... [et al.]. New York; London: Harvester Wheatsheaf, 1980.
৬.   ভারতের মহারাজা সায়াজি রাও ইউনিভার্সিটি অব বরোদায় সুনেত্রা মিত্র অধ্যাপক ড. রাজকুমার হেন্সের তত্ত্বাবধানে ইতিহাস বিভাগে একটি পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন ২০০৭ সালের জুন মাসে। উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত গুজরাটি থিয়েটার ও বাংলা থিয়েটারে পরিবর্তনের হাওয়া কীভাবে লেগেছিলো তাই নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে তাঁর থিসিসে বাংলার ভদ্রলোক সংক্রান্ত বিশেষ বিবরণ হাজির করেছেন। বিস্তারিত জানতে দেখুন: Mitra, Sunetra. The winds of change the process of professionalisation of Bengali and Gujarati theatre A comparative study 1850 1940. Department of History, Maharaja Sayajirao University of Baroda, 30/06/2007. Accessed February 26, 2021.  http://hdl.handle.net/10603/58544
৭.   Bharucha, পূর্বোক্ত, পৃ.৯
৮.   পূর্বোক্ত
৯.   পূর্বোক্ত 
১০.   বিস্তারিত জানতে পাঠ করা যেতে পারে: Touraine, Alain. Critique of modernity. Translated by David Macey. Oxford: Blackwell, 1995.
১১.  আন্তনিও গ্রামসির ভাবাদর্শ ও হেজিমনিসহ ক্রিটিকাল চিন্তা ও চিন্তাপদ্ধতির হদিস নিতে তাঁর কারাগারে লেখা নোটগুলোর পাশাপাশি পাঠ করা যেতে পারে: Adamson, Walter L. Hegemony and revolution: a study of Antonio Gramsci's political and cultural theory. Berkeley; London: University of California Press, 1980.
১২.  বিশ্বব্যাপী অত্যাচারের রোগনির্ণয়বিদ্যা আত্মস্থ করতে এবং ঔপনিবেশিক দশায় নিপতিত জনগণের আত্মসত্তা ও মনের গতিপ্রকৃতি জানার জন্য জিয়াউদ্দিন সরদার ও হোমি ভাভার ভূমিকাসমেত ফানোঁর বিখ্যাত বইটির এই সংস্করণ বিশেষভাবে পড়া যেতে পারে: Fanon, Frantz. Black Skin, White Masks. London: Pluto, 2008.
১৩.  বিস্তারিত জানতে পাঠ করা যেতে পারে: Žižek, Slavoj. “Comedy between the Ugly and the Sublime” in Hegel on philosophy, history, and modernity. Edited by Rachel Zuckert and James Kreines, Cambridge: Cambridge University Press, 2017. pp. 213-229
১৪.  Chatterjee, পূর্বোক্ত
১৫.  বিস্তারিত জানতে পাঠ করা যেতে পারে:  Bhabha, Homi K. The Location of Culture. London: Routledge, 1994.
১৬.  Chatterjee, পূর্বোক্ত
১৭.  বিস্তারিত জানতে: Žižek, পূর্বোক্ত
১৮. Dube, Saurabh. Subjects of Modernity. Manchester: Manchester University Press, 2017. p.23,  Accessed March 2, 2021. https://openresearchlibrary.org