ভয়ের চাবি
করোনাভাইরাসে সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ের পর অফিস খুলেছে। তবে ঢেউয়ের আগের অফিস আর এখনকার অফিস এক নয়। আতিকের মনে হয় নতুন অফিসে নতুন চাকরি নিয়েছে। আগের চেয়ে পার্থক্য অনেক। এক-তৃতীয়াংশ কর্মী হঠাৎ করেই নেই। বেশির ভাগের চাকরি গেছে হোম অফিস করার সময়ই। কারণ হিসেবে ‘ব্যয়-সংকোচন’-এর অজুহাতটা দেখানো হয়েছে। বাসায় বসে আতিকদের বাড়তি কর্মঘণ্টা অফিসের কাজ করতে হয়েছে, নাওয়া-খাওয়ার খবর থাকত না। কাজের চাপের সঙ্গে যোগ হলো, ‘চাকরি আছে, চাকরি নেই’ দ্বন্দ্ব। অফিসে না থাকার কারণে স্পষ্ট হওয়া যেত না, কার চাকরি আছে, কার চাকরি নেই। এইচআর বিভাগ থেকে ইমেইল আসত, আজ অমুক নেই।
ইমেইলের মাধ্যমে শুধু ফলাফলটা জানা যেত। কিন্তু কে কে বিবেচনাধীন আছে তা বোঝা যেত না। অফিসে থাকলে আবার এসব তথ্য জানা যায়। যাহোক, সবার মধ্যে আতঙ্ক, ‘আমার চাকরি আছে তো?’
করোনাকাল চলছে প্রায় এক বছর হয়ে গেল। বছরের শুরুতে সাধারণত আতিকদের প্রমোশন হয়, বেতন বাড়ে। এবার কিচ্ছু হলো না। কেউ এ নিয়ে টুঁ শব্দটি করল না, অধিকারের কথা বাদ দিয়ে সবাই ভাবছে, চাকরি আছে কি না তা নিয়ে। শুধুই কি প্রমোশন ও ইনক্রিমেন্ট আটকে গেছে! করোনার নামে গত বছর দুটো ঈদ বোনাসও তো দিল না অফিস। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধেও আওয়াজ ওঠেনি। তখন আতিকদের কথা ছিল, ‘বোনাস না দিক, চাকরি থাকলেই হলো।’ অফিসও তা জানে, তাই তো সুযোগ বুঝে কোপগুলো বসিয়ে দিচ্ছে। তারা জানে, তাদের কর্মীরা মনে মনে বলছে, ‘ভিক্ষা চাই না, কুকুর সামলাও’।
বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবিধা হলো, বেতনটা সময়মতো হাতে আসে। করোনাকালে কত প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার হিসাব নেই! অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা ঠিকমতো বেতন পাচ্ছে না। সেখানে আতিকদের অফিস এখনো বেতনটা মাস শেষ হওয়ার আগেই পরিশোধ করে যাচ্ছে। এমন সুবিধা আর কোথায় পাবে তারা! অফিস এটা মানবিক দিক বিবেচনা করে করে যাচ্ছে, নাকি এটিও একটি স্ট্র্যাটেজি, কে জানে!
পার্থক্য আরও আছে। আজকাল অফিসের সবার অফিসের কাজের প্রতি সচেতনতা বেড়েছে। সবাই ঠিক নটায় অফিসে ঢুকে যাচ্ছে। অনেকে তো নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চলে আসছে। অনেকে কর্মঘণ্টা শেষ হওয়ার পরও থেকে যান। কী এক ভয়ের চাবি মেরে দিয়েছে অফিস—সব সোজা! এক চাবিতে কত্তো মুনাফা!
যারা এখন স্বেচ্ছায় অফিসে বাড়তি কাজ করে তাদেরই একজন আতিক। বয়স কম, কর্মক্ষম ও মেধাবী। তবে প্রতিবাদী একেবারেই নয়। ছাপোষা বলতে যা বোঝায়, সে—তাই। সে নেমেছে একটি ঝঞ্ঝাটমুক্ত ছিমছাম ভবিষ্যৎ নির্মাণে। বাবা-মার একমাত্র সন্তান আতিক। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় বাবা মারা যান। থাকার মধ্যে আছে শুধু মা। এ বছরই আতিকের বিয়ে করার কথা ছিল। দু-একটা মেয়ে দেখাও হয়েছিল। করোনাকাল এসে সব স্থবির করে দিল। অবস্থা এখন কিছুটা ভালো, তারপরও বিয়ের ভাবনা স্থগিত করতে হবে। আতিক তো প্রমোশনের আশায় ছিল, প্রমোশন তো দূরের কথা, একটা ইনক্রিমেন্টও পেল না। এই অবস্থায় ঘরে বউ আনা ঠিক হবে না। এই অফিসে চাকরির পাঁচ বছর হলো। এই পাঁচটি বছর কী পরিশ্রমটাই না করেছে সে! রাতদিন কাজ করেছে, দিনের পর দিন ডেঅফ মার গেছে। আর বার্ষিক ছুটি তো পড়ে পড়ে নষ্ট হয়েছে। কী পেল সে! উল্টো এখন চাকরি থাকবে কি না সেই ভয়ে মরতে হচ্ছে। হতাশ হয়ে পিছিয়ে পড়াও যাবে না। চাকরিটা টিকিয়ে রাখতে আরও বেশি কাজ করছে সে। অফিস যেন কোনো ত্রুটি খুঁজে না পায়।
পুরো অফিসে একটি প্রশ্নই প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনিত হয়, ‘ভাই, আমি কি লিস্টে আছি?’ কিন্তু কেউই এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পায় না। আর আশঙ্কা-সম্ভাবনা নিয়ে কানাঘুষা তো আছেই। ফলাফল প্রকাশ হলেই জানা যায় আসলেই কে থাকছে, আর কে যাচ্ছে। এইচআর থেকে কাউকে তলব করা হলেই ভয়ে গলা শুকিয়ে যায়। ডেকেই বুঝি চিঠি ধরিয়ে দেবে। সবাই ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করে—ডাক যেন না আসে।
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। এবার আতিককেই তলব করা হয়েছে। এই আতিক কী না করেছে অফিসের জন্য! জান দিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করেছে। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে শেষে কী মিলল—এইচআরের তলব! দশ মিনিট আগে এইচআরের সাইফুল ফোন করে বলেছেন, ‘আতিক সাহেব, একবার একটু এইচআর বিভাগে আসবেন।’ আতিক সাইফুলের কণ্ঠস্বর বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছে, ইতিবাচক টোন মনে হয়নি। আতিকের পা কাঁপছে। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। দুই ফ্লোর নিচেই এইচআর।
সিঁড়িগুলো অন্ধকার, আতিক নিচের দিকে নামছে। যেন গুহায় ঢুকছে সে, সে জানে না গুহার মধ্যে বাঘ আছে কি না। থাকলে সে শেষ। সে ঘামছে, চাকরিটা গেলে কী অবস্থা হবে তার! সিঁড়ি শেষ হওয়ার নাম নিচ্ছে না। দেড় তলা নেমেই মনে হচ্ছে বিশ-ত্রিশ তলা হেঁটে নেমেছে। আতিক কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এইচএর থেকে যদি না-ই করে দেয়, তাহলে সে অনুরোধ করবে—কোনোভাবে যদি রাখা যায়। প্রয়োজনে বেতন কম নেওয়ার প্রস্তাবও সে করবে।
সাইফুল ইসলাম ইশারায় আতিককে তার উল্টো দিকের চেয়ারে বসতে বলেন। শরীরের কাঁপুনি লুকাতে চেষ্টা করতে করতে আতিক বসে। সাইফুল একটা ফাইল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখায় ব্যস্ত। আতিকই শুরু করে, ‘সাইফুল ভাই, কী ব্যাপার?’ কথাটি বলে আতিক বুঝতে পারে, তার কথাও জড়িয়ে যাচ্ছে। সাইফুল গম্ভীর হয়ে ফাইল দেখে যাচ্ছেন। আতিকের দুশ্চিন্তার পারদ চরম মাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছে। একটু পর সাইফুল ফাইলটি পাশে রেখে বললেন, ‘আপনি গতকাল রাত দুইটার দিকে অফিসে ঢুকেছিলেন কেন?’ আতিক একথার কিছুই বুঝতে পারেনি,
—ভাই, বুঝিনি...কী বললেন?
সাইফুল টেবিল থেকে একটা কাগজ হাতে নিয়ে বললেন,
—পাঞ্চ মেশিন বলছে, গত রাত একটা পঞ্চান্ন মিনিটে আপনি অফিসে ঢুকেছেন। কেন?
আতিকের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। এ কেমন কথা! এ কেমন অভিযোগ! রাত দুইটায় সে কেন অফিসে ঢুকতে যাবে! সে বলার চেষ্টা করে,
—সাইফুল ভাই, আমি...আমি কেন এত রাতে অফিসে ঢুকতে যাব? আমি...আমি তো...
সে কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পারে না। সাইফুল আলোচনা গুটিয়ে আনেন, ‘আপনাকে কারণ দর্শানোর একটা নোটিশ ইমেইল করে দিচ্ছি। আপনি কারণটা লিখে পাঠান। সমস্যা নেই, অফিশিয়াল প্রসিডিউর, বুঝেনই তো।’ আতিক কিছুই বলে না, সাইফুলের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সাইফুল আবার ফাইল দেখায় মন দেন।
এখনই চাকরি যাচ্ছে না দেখে আতিক কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে। সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতে উঠতে সে ভাবে, ‘রাত দুইটায় অফিসে ঢোকার ব্যাপারটা কী?’ কিছুক্ষণ ভাবার পরই সে উত্তরটা খুঁজে পায়। গতকাল বাড়তি কাজ করতে করতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। ওই দুইটার মতোই বেজেছে বাড়ি যেতে। তার মানে সকালে সে যে অফিসে ঢুকেছে, সেই এন্ট্রি পাঞ্চ মিস করেছে মেশিন। রাতে যখন বের হলো—সেটাকে ধরেছে এন্ট্রি পাঞ্চ!