এপিটাফ

প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেনএখনও ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর পরে।
                    -জীবনানন্দ দাশ

জন্মের পঁচিশতম বছরে আমি মরে গেলাম। কিন্তু পরবর্তী দশ বছর পর্যন্ত আমার সৎকার হয়নি। আমিই শুধু জেনেছিলাম আমি মরে গেছি। মৃত্যুর পরও এমন তরতাজা শরীর আমাকে হতাশ করেছিল, কারণ আমার বিবেকহীন পেটটা তখনো খেয়ে যাচ্ছিল, পা দুটো মাথায় নিয়ে ঘুরছিল একটা আস্ত শরীর। এটা সহজ চোখে একটা বিস্ময়, তাই আমাকে বলতে হবে অনেক কিছুই।

চিলের থাবা থেকে পলায়নরত ইঁদুরের হৃদ্‌পিণ্ড আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর পরেও

আমি খোদাই করে চলেছি আমার সমাধি প্রস্তর। ক্ষয়ে যাচ্ছে পাথর-শরীর গোটা গোটা বর্ণে; আমার জন্ম, মৃত্যু, জীবন, সময়, ক্ষয়িষ্ণু অক্ষয় পাথরে! ভবিষ্যতে প্রস্তরযুগের নিদর্শন হিসেবে এটাকে মূল্যায়ন করা হলেও আমি অবাক হবো না। কারণ, একজন খোদাইশিল্পীর জন্য এটা হবে একটা মর্যাদাপূর্ণ ব্যাপার। মৃত্যুর পরে যার অস্তিত্ব এই মুহূর্তে টিকে রয়েছে প্রস্তরবক্ষে। আমার ভাগ্যে ঝুলছিল দুটো মৃত্যু। যার প্রথমটা একান্তই আমার। আর দ্বিতীয়টা ছিল আমার শরীরের। তাই সবকিছু শেষ হওয়ার পর আমি এক দিনও সময় নষ্ট করিনি। কিন্তু শরীরের ওপর আমার হাত ছিল না। ওটা ছুটছিল পূর্বপুরুষদের একটা মহান দায়িত্ব উত্তরপুরুষের কাছে পৌঁছে দিতে।

বংশানুক্রমের পার্চমেন্ট অনুযায়ী, আমি মরে যাব এক কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে, কাশতে কাশতে, দম নিতে না পেরে। যেভাবে মরেছিল আমার  দাদা আর পঞ্চান্ন বছরের আব্বা। এটা ছিল আগুনের মতো ক্ষমাহীন, বিশেষ দণ্ডের মতো অলঙ্ঘনীয়। আমি ভেসে যাচ্ছি স্রোতে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বহুকাল ধরে।

আমার কাজ হলো শীতভীতি, কাশি, কফ, হাঁপানি বয়ে বেড়ানো, একেবারে যেভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে আমার ওপর এসে পড়েছে, এবং বংশের শেষ জীবন্ত ফসিল হিসেবে এমন একজনের ভেতরে এগুলোকে ঢুকিয়ে দেওয়া, যে পরম নিষ্ঠার সাথে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরবে ভবিষ্যতের জন্য। এই রোগগ্রস্ত স্বল্পায়ুর ক্রমবিকাশ, যেখানে পূর্বপুরুষদের একধরনের দাম্ভিকতা ছড়িয়ে রয়েছে, যদিও তাদের সামনে হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আধুনিক প্রতিষেধক! দম্ভের রাক্ষস আমাকেও গ্রাস করেছে, এগিয়ে যাচ্ছে একাকী, একগুঁয়ে এক দাম্ভিক ফসিল।

দাদা ছিলেন গ্রামের নামকরা কবিরাজ। আমার কাছে ছিলেন সবচেয়ে রহস্যময় ও বিভ্রান্তিকর এক বুড়ো। পাকা কলার খোসার মধ্যে তিনি পান আর সুপারি মিশিয়ে সর্বরোগের ওষুধ বানাতেন। আর কলাগুলো থেঁতলা করে রাখতেন তার থুথুদানিতে। ফলে থেঁতলানো পাকা কলা আর পাকা কফ, যা তিনি জমিয়ে রেখেছিলেন তার হাপর টানা বুকের মধ্যে বছরের পর বছর, সেগুলো এমনভাবে মিশে থাকত যে বোঝাই যেত না কোনগুলো থেঁতলানো কলা আর কোনগুলো বয়স্ক দুর্গন্ধময় কফ। রোগীরা দূরদূরান্ত থেকে কাঁদি কাঁদি পাকা কলা আনত, দাদা সেগুলোকে খোসা ছাড়িয়ে থেঁতলা করে রাখতেন থুথুদানিতে, আর আমি এক জিভ লোভ নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকতাম।

তার কাপড়ের থলেটা যেটা স্পর্শ করার সাহস ও সুযোগ আমি কখনো পাইনি। ওটা ছিল আমার একমাত্র আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু, রহস্যে ভরা আর পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থানে সুরক্ষিত। কোমরে প্যাঁচানো নাইলনের সুতোর সাথে ওটা ঝুলত লুঙ্গির ভেতরে, তার দুই ঊরুর মধ্যবর্তী উপত্যকায়। হাঁটার সময় একটা নির্দিষ্ট বিরতি নিয়ে বিশেষ জায়গার লুঙ্গি এমনভাবে ফুলে ফুলে উঠত, যেন তার বিশেষ বস্তুটি লজ্জার মাথা খেয়ে খোশমেজাজে দোল খেতে খেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি এখন তাকে জিজ্ঞেস করি দাদা, তোমার থলের মধ্যে কী? তিনি আমার মস্তিষ্কে নেমে আসেন বাঁশের মুড়োর লাঠিতে ভর দিয়ে খকখক করে কাশতে কাশতে। আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুকে তিনি দুই ঊরুর ভঙ্গিল পর্বতের ভাঁজে লুকাতে লুকাতে বলেন শালো, তুমার বউয়ের ভাতারের বড়শি!

কিন্তু আমার হৃদয় তৃপ্ত হয় না। বলো দাদা, কফ মেশানো কলাগুলো কি ওটা জাগাতে পারে? পর্বতের ভাঁজ থেকে হঠাৎ একটা হুলো বিড়াল বেরিয়ে এসে ম্যাঁও ম্যাঁও করে। যেন জনসম্মুখে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে জাদুকরের কারসাজি। জাদুকর উত্তর দেন না, তিনি হাতড়ে বেড়ান জাদুর থলেটা, শুধু কাশতে কাশতে সম্ভ্রম বাঁচানোর চেষ্টা করেন। পরে অবশ্য জানতে পেরেছি কফ মেশানো ওই কলাগুলো নাকি পুরুষের যৌন দুর্বলতার অব্যর্থ ওষুধ! আমি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে জাদুকরের মাটিতে লুটিয়ে পড়া লুঙ্গি তুলে কোমরে পেঁচিয়ে দিয়ে শেষ রক্ষা করি।

জাদুকর তোমার হাত কি সত্যিই একা একা চলে? আমার মস্তিষ্কবিকৃত ফুফু আমার মাথার ঘন জঙ্গল ভেদ করে কপালের ওপর আছড়ে পড়ে আব্বা রে, আমারে সাপে কামড় দেছে গো। জাদুকর ঘাবড়ে যান। তিনি বাঁশের লাঠিতে ভর দিয়ে পাছাটাকে ঊর্ধ্বমুখী আর ওজনহীন করে আমার নাকের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসেন। আমি দেখতে থাকি তিনি হাঁপাচ্ছেন, তার তুলো রাশি হাতটা সর সর করে উঠে যাচ্ছে ফুফুর শরীরে। জাদুকর দম ধরে আছেন, থলের ভেতর থেকে বের করে আনছেন বিচিত্র সব মাদুলি আর বহু ঠ্যাংবিশিষ্ট শিকড়-বাকড়। ফুফুর মুখ থেকে সাদা সাদা ফেনা পড়ছে আমার চোখের ওপর। আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, তবে বুঝতে পারছি জাদুকর অক্সিজেন-শূন্যতায় খাবি খাচ্ছেন..। কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি বাবা ও মেয়ের মৃতদেহের চারপাশে।

আমার সমাধিপ্রস্তর ধীরে ধীরে ইতিহাসের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। আমার আর বসার সময় নেই। সার্কাস প্যান্ডেলটা এতক্ষণে ভরে উঠেছে হাজারো দর্শকে, কিন্তু আমি যেন ঢুকে পড়েছি একটা বিলুপ্ত কলোসিয়ামের দর্শক সারিতে। হিংস্র সিংহটা একটা ছড়ির ইশারায় অসহায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, দড়ির ওপর দিয়ে বুকে ভয় আর মুখে কৌতুক ফুটিয়ে হেঁটে যাচ্ছে খর্বকায় জোকারগুলো। ঘূর্ণায়মান চাকায় হাত-পা বাধা তরুণীটা একাধারে ভয়ার্ত ও কামার্ত চিৎকার করছে। যার বুকের দুটো পর্বত জরি কাপড়ে ঢাকা। ধারালো ছুরিগুলো বিঁধছে তার শরীরের চারপাশে চাকার বিভিন্ন অংশে। আমার পাশের আসনের যুবকটা বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে আমার কাঁধে হাতটা রেখে উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে চিৎকার করছে বাড়ার মাথা, আরেট্টু হলি ছুরিডা ঢুকে যেতু বুকের মদ্দিরে! আমিও তার কাঁধে হাত রাখি, কিন্তু কোনো উত্তর দিই না। আমরা অনুভব করি নিজেদের হৃদ্‌পিণ্ডের অস্থিরতাকে। আমাদের শরীরের তাপমাত্রা বয়ে যায় একই ফারেনহাইটে। কিন্তু সময় বড় পরসুখে কাতর, যে তিন যুগের ব্যবধান গড়ে দিয়ে আমাদের পরিণত করবে পিতা ও পুত্রে। আমি সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি শার্ট খোলা, উত্তেজিত, দৃঢ় বুকের আব্বার দিকে, যেখানে বাস্তবের দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবি আর দূরত্ব নেই।

আব্বা ছিলেন একেবারে নিরস। সামাজিক আব্বা বাস্তবতার আদর্শ উদাহরণকে তিনি ধারণ করেছিলেন। চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ে তাকে আব্বা বলে ডাকত। তিনি বিয়ে করেছিলেন আমার মাকে একটা দুধওয়ালা গাইসহ। আব্বা দাদার মতো বয়ে বেড়াতেন হাঁপানি আর শীতভীতি। ছেলে-মেয়েদের সাথে তার দূরত্ব ছিল অনেকটা সমান্তরাল রেখার মতো। ফলে খুব পাশাপাশি থাকার সত্ত্বেও কোনো পক্ষ সেই দূরত্বকে কখনোই অতিক্রম করতে পারেনি। গোঁফ-দাড়ি গজাতে শুরু করার পর, আমার সাথে তার দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল আরও বেশি। প্রথমবার দাড়ি কামিয়ে, তেলাপিয়া মাছের মতো মুখ নিয়ে তার সামনে দাঁড়ানোর পর বুঝেছিলাম, এখন তিনি গরুকে আদর করেন, গাছ লাগান, আর মাছ পোষেন।

আমার সার্কাস ভক্ত আব্বা ছেলে-মেয়ের গা থেকে বাচ্চা শব্দটা উঠে যাওয়ার পর গভীর শূন্যতায় পতিত হয়েছিলেন। আর সেই শূন্যতার ক্যাথারসিস তাকে নিয়ে গিয়েছিল গরু, গাছ আর মাছের কাছে। তিনি খৈল, কুড়া, বিচালি মাখিয়ে গরুটাকে খাওয়াচ্ছেন, গোসল করাচ্ছেন, গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, মাছি তাড়াচ্ছেন...। আর সামনে যোজন দূরত্ব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আব্বার ফুটফুটে বাচ্চারা বীভৎস লম্বা লম্বা ব্যাটা হয়ে!

আব্বা মরার আগের দিন পুকুরের মাছগুলো মরে ভেসে উঠেছিল। সেবার এমন শীত পড়ল যে লেপ-কাঁথাকে মনে হলো একটা আস্ত বরফের চাঙ। বেঁচে থাকার সহজাত লড়াইয়ে শরীরটা ঠকঠক করে কাঁপলেও ভেতরটা গরম হতো না। শীতের দিনে আব্বা শরীর গরম রাখার জন্য সালসাজাতীয় একধরনের সিরাপ খেতেন। সিরাপের গায়ে সাদা স্লিপে বড় ফন্টে গাঢ় কালো কালিতে লেখা থাকত বিদ্যুৎ সালসা: ইহা তাপ, শক্তি ও বীর্যবর্ধক! তাই এমন কনকনে শীতে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন পানিতে ঝিম মেরে থাকা মাছগুলোর জন্য। বাজার তন্নতন্ন করে এনেছিলেন পানির তাপবর্ধক ওষুধ! মাছগুলো মরে ভেসে উঠছিল একটার পর একটা, যেন গরম বালির মধ্যে থেকে হঠাৎ খই ফুটতে শুরু করেছে। আব্বাকে এমন শোকাচ্ছন্ন  হতে দেখিনি কখনো। তিনি রাত অবধি পায়চারি করে গেলেন ধনুক-বাঁকা শরীর নিয়ে। মৃত্যুর সময় ছেলে-মেয়েরা তার পাশেই ছিল দাঁড়িয়ে। তিনি শ্বাস নিতে পারছেন না। প্রচণ্ড গরম লাগছে তার। ঘামে ভিজে গেছে সমস্ত শরীর। তিনি কী যেন বলার চেষ্টা করছেন। চুন...পানি...মাছ...। তার শেষ অস্পষ্ট শব্দগুলো থেকে ছেলে-মেয়েরা মনোযোগ দিয়ে শিখছে পানি বিশুদ্ধকরণ প্রণালি!

প্রতিটি শীতের রাতে একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ঘুমোতে যেতাম। যেন এ জন্যই আমি জন্মেছিলাম। জন্মের আগেই আমাকে বাছাই করা হয়েছিল। বিগত পুরুষেরা তাকিয়ে ছিল আমার সফলতার দিকে। তাই রাতগুলোতে আমার প্রস্তুতি থাকত নিরেট। চমৎকার একটা নৈশভোজ সারতাম বিবেকহীন পেটকে ফাঁকি দিতে। অন্ধকার আর ঠান্ডাকে জেঁকে বসতে দিতাম বুকের ওপর। জীবনের সবকিছুকে ফালি ফালি করে কাটতাম যতক্ষণ না সেটা শূন্যে পৌঁছায়। নিজেকে মনে হতো এক টুকরো মেঘ, যে ঘনত্বের অভাবে ফাঁপা আর দারুণ সাদা হয়ে দিগ্বিদিক ছুটছে কিংবা সুন্দরভাবে বলতে গেলে ভেসে বেড়াচ্ছে। তারপর আমার মস্তিষ্কে পাকা কফ ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলত। অক্ষম হাপরটা লাঙল পোড়ানোর মতো বাতাস টানতে ব্যর্থ হতো। কাঁদি কাঁদি কলা ঝুলত আমার চোখের পাতায়। স্পর্শকাতর দাঁতগুলো খুলে পড়ত ঝরঝর করে। আর মাছগুলো ঠোকর দিয়ে ছিঁড়ত আমার সমস্ত শরীর। আমি দেখতে পেতাম বিছানা থেকে একটা হলুদ রঙের পথ বয়ে চলে গেছে ডাকুয়ার বিল পেরিয়ে কিংবা সেটা আদৌও হয়তো কোনো বিল ছিল না। দেখতাম একটা বয়স্ক জীর্ণ হাত ইশারায় আমাকে ডাকছে। আমি ওই হাতকে অনুসরণ করে এগিয়ে যেতাম, কিন্তু যখন পথের সামনের সেই পিত্তরাজ গাছটা আমার পথ আটকাত, যার তলায় আমি হাঁটতে শিখেছিলাম ওর তেতো কিন্তু ভীষণ লাল ফল খেতে খেতে, তখন বুঝতাম পরের সকালটা আমাকে নৃশংসভাবে হতাশ করবে।

আমার মা ছিল একটা দুধপাগল মেয়ে। তার বিয়ে হয়েছিল এমন এক পরিবারে যেখানে জীবন ছিল অনেকটা যাযাবরের মতো। জীবন আর সময় আলাদা দিকে ছুটত সেখানে। পৃথিবীর এক অন্ধকার কোণে বসে পরিবারটা তত দিনে দুটো পাগল আর একটা ভবঘুরে জন্ম দিয়েছে। প্রথম যেদিন মা এ পরিবারে এসেছিল, তখন এক পাশে ছিল তার অপরিচিত স্বামী আরেক পাশে চিরপরিচিত দুধেল গাইটা। আমার দাদি নতুন পুত্রবধূর ঘোমটা দেওয়া মুখটা দেখার আগেই গাইটার কাছে ছুটে গিয়েছিল। তারপর গাইয়ের মুখের মধ্যে আঙুল পুরে দিয়ে দাঁত গুনতে গুনতে একটা হইচই বাধিয়ে দিয়েছিল এ তো দেখচি আশি বচরের বুড়ি! কথাটা এমনভাবে ছড়িয়েছিল গ্রামের মানুষ হুমরি খেয়ে পড়ল গাইটার ওপর। একটা বুড়ি মাগি কীভাবে ছকেজি কেজি দুধ দেয়! দাদি যখন গাইটার পেটের তলায় বসে সরিষার তেল দিয়ে ওলানটা প্রস্তুত করত, তখন চারপাশে ভিড় জমে যেত। দাদির অত্যাচারী আঙুলের চাপে সরিষার তেলে চুবানো সোনায় মোড়ানো বাট থেকে ধবধবে সাদা দুধ ঝরে পড়ত আর ভরিয়ে তুলত বালতিটাকে।

মাকে জীবনটা কাটিয়ে দিতে হয়েছিল একজন সার্কাস ভক্ত ও সালসাসক্ত পুরুষের সঙ্গে। তাদের দাম্পত্য সুখ-দুঃখ নির্ভর করত এক বোতল সালসার কর্মশক্তির ওপর। কিন্তু আমি তো এখানে এ বিষয়ে সব কথা বলে দেব না। শুধু খোদাই করে যাব তার গুনগুন করে গাওয়া গানটা।

সোনার মতন গা খান বন্ধু

চোখ তোমার কানা।

ঘাড়েতে লাঙল-জোয়াল

জমিন পাইলা না।

জন্মের বছর সাতেকের মধ্যেই আমাকে আমার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আমি বেড়ে উঠছিলাম বাতাসের মধ্যে। বাতাসের ঘোলে পড়ে উড়ে যাচ্ছিলাম আমার ব্যস্ত শৈশবে। ওই সময় থেকে আমার বয়সের চেয়ে জীবন বাড়তে শুরু করেছিল। নিছক সাদামাটা দিনগুলোতে অনেক কিছুই ঘটে যেত তখন। আমার পা দুটো তখন ছিল শিকলমুক্ত পাখি। আমার রুচি তখন পাকা গাব, খেজুরের রস আর শাপলার ঢ্যাপে। আমার স্বপ্ন তখন খোলা মাঠ, দমকা বাতাস আর উড়ন্ত ঘুড়ির অস্থিরতা ঘিরে। আমার ভালোবাসা তখন চুঁইশালিকের বাচ্চার চিকন, নরম, হলুদ ঠোঁটে। আমার বেদনা তখন পায়ের নিচের পচা শামুক আর বাবলা কাঁটায়। বাড়ির সামনে একটা চমৎকার বিস্তীর্ণ মাঠ ছিল। বলতে গেলে শুধু আমার কাছেই চমৎকার লাগত। কেননা মাঠটাকে সারা বছর গালিগালাজ শুনতে হতো। মাঠের চারপাশে বাড়িগুলো এমনভাবে বেড়ে চলেছিল, যেন সেটা এক গভীর ষড়যন্ত্রের মধ্যে পড়েছে। তাই সারা বছর মাঠটাও তাণ্ডব চালাত গ্রামের ওপর। পাটের মৌসুমে শুঁয়াপোকায় ছেয়ে যেত সমস্ত গ্রাম। লক্ষ লক্ষ শুঁয়াপোকার পেলব তরঙ্গে তখন গ্রামটা যেন ভাসত। আবার ফসল কাটার পর ধুলোয় অন্ধকার হয়ে যেত সবকিছু। তখন কাউকেই আলাদা করে যেন চেনা যেত না। আর গরমের রাতগুলোতে, যখন সবাই ক্লান্তি আর বিরক্তি নিয়ে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়ত, তখন কেন্নোর দল তাদের কানের শীতল গোলকধাঁধায় শুয়ে শুয়ে হাই তুলত।

আমার বয়স এখন পঁয়ত্রিশ, এবং খুব শিগগির আমি দশম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করব। তাই দ্রুতই শেষ করতে হবে এই প্রস্তরলিখন। আমার ফুসফুস সংগ্রাম করছে বাতাসের সাথে। গলা দিয়ে বের হতে শুরু করেছে হলুদ রক্তিম দুর্গন্ধযুক্ত কফ, আর আমি পূর্বাভাস পাচ্ছি শতাব্দীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রার। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, আমি হয়ে পড়েছি সন্দেহমুক্ত। তাই এখন আমার প্রথম মৃত্যুর বিষয়টা ভেঙে বলার সময় এসেছে। যেখানে আমার ভূমিকা ছিল একজন ডাক্তারের। যে সকল পরীক্ষা শেষে স্বাক্ষর করেছিল মৃত্যুসনদে। সেখানে তার পর্যবেক্ষণ ছিল...অ্যাবসেন্স অব হোপ, মিসিং অব ড্রিম, মিনিংলেস অব লাইফ অ্যান্ড কজ অব হাই লেভেল হেরিডিটি-সেনট্রিক প্রেসার এবং পরের কয়েকটি শব্দ, যেগুলো আগে থেকেই সব মৃত্যুসনদে প্রিন্টেড ভার্সনে থাকে, সকল পরীক্ষা সম্পন্ন করিয়া ব্যক্তিকে (২৫) মৃত বলিয়া ঘোষণা করিতেছি।

আমার জীবন থেমে গেল পঁচিশ বছরে। আমাকে গ্রাস করল অর্থহীনতা, জীবনের প্রতি অনাগ্রহ আমাকে করল মন্থর। শৈশব-কৈশোরের কুমির আমাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল গভীর জলে। সময় আমাকে প্রতিদিন এগিয়ে নিয়ে চলল গতকাল, গত পরশু, গত মাস, গত বছরের পথে। মায়ের মুখের আঁচিলটা দেখতে দেখতে দৃশ্যমান হলো আমার মুখে। আব্বার ক্যাঙারুর মতো লাফিয়ে হাঁটার ছন্দটা অজান্তেই অনুসরণ করতে শুরু করল পা দুটো। পশ্চাদ্দেশে অনুভব করতে লাগলাম একটা শক্ত গোল মাংসপিণ্ড। দাদা যেটাকে বলত বান্দরের লেজ। ওটার পীড়ায় তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়খানায় ব্যয় করতেন। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে, যখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার সবকিছু থেমে গেছে, আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি নিজের ওপর। আমাকে চালিত করছে বিগত ধুলোকণা। শরীরের বিভিন্ন অংশ প্রতিস্থাপিত হয়ে যাচ্ছে। আমি ক্রমশ যাচ্ছি পিছিয়ে...। তাই সবকিছু শেষ হওয়ার পরে আমি ঘোষণা করেছি আমার আত্মিক মৃত্যুকে।

শতাব্দীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পূর্বাভাসে, অতীতের ষড়যন্ত্রের গিনিপিগ হিসেবে আমি কামড়ে ধরেছি এই প্রস্তরখণ্ড। আমি চাটছি এর লোনা স্বাদ, মুখের লালায় ভিজিয়ে ভিজিয়ে গড়ে তুলছি একান্ত সখ্য, কিন্তু আমাকে এখন কিছু স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। কারণ, অভিযোগের তীক্ষ্ণ তীর আমার দিকে ধেয়ে আসছে। আমার আব্বা তীরের আগা শান দিচ্ছেন, দাদা ধনুকের ছিলাটা বেঁধে নিচ্ছেন, তার আব্বা মনোযোগ দিয়ে মেপে নিচ্ছেন লক্ষ্যবস্তু ও তার মধ্যকার দূরত্ব। কারণ, বিশস্ত বাহক হয়ে গেছে গুপ্ত ঘাতক! মহান দায়িত্বের একজন নির্বাচিত দূত হিসেবে, আমার অবশ্যপালনীয় হলো ক্ষয়-ক্ষতি এড়িয়ে শেষ পর্যন্ত সবকিছু বয়ে নিয়ে যাওয়া এবং সংবিধানের অলিখিত কিন্তু অলঙ্ঘনীয় অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একজন যোগ্য বাহকের হাতে এগুলো তুলে দেওয়া।

এখন জিজ্ঞাসাবাদের চরম পর্যায়ে, আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, আমি পঁচিশ বছর বয়সে গ্রহণ করেছি আত্মিক মৃত্যুকে। আমার কাঁধে অর্পিত মহান দায়িত্বকে থোড়াই কেয়ার করে সম্পূর্ণ সচেতন ও সুস্থ মস্তিষ্কে অবহেলা করেছি। নিজের স্বাতন্ত্র্যের ওপর অন্যের দখলদারত্ব রুখতে স্বেচ্ছামৃত্যুর মাধ্যমে, আরও পরিষ্কারভাবে বললে, নিজ স্বার্থে কয়েক প্রজন্ম ধরে চলে আসা একটা সম্ভ্রান্ত প্রবাহকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র করেছি। যার রয়েছে একটা বর্ণাঢ্য ঐতিহাসিক ও সামাজিক তাৎপর্য। আমি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংবিধানের অলঙ্ঘনীয় অনুচ্ছেদ করেছি লঙ্ঘন। আমি সৃষ্টি করিনি ভবিষ্যতের কোনো মহান বাহক। আমি প্রতারণা করেছি আমার প্রপিতামহের সঙ্গে। আমি অসম্মান করেছি দাদাকে। আমি ধ্বংস করেছি আব্বার স্বপ্নকে। আমি অসুখী করেছি আমার মাকে।

আর এখন চার সদস্যের বিচারিক বেঞ্চে রায় ঘোষণার সময় এসেছে। পিতার রায়: দোষী। মন্তব্য: এমন সন্তানের পিতা হওয়া আমার জন্য অত্যন্ত কলঙ্কজনক। বংশের পূর্বপুরুষগণের সামনে সে আমার সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। আমার আর মুখ দেখাবার উপায় নেই। একজন আশাহত পিতা হিসেবে আমি আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করছি।

পিতামহের রায়: দোষী। মন্তব্য: সে একটা সম্ভ্রান্ত বংশের বিধান লঙ্ঘন করেছে। আমার মূল্যবান থলে নিয়ে করেছে জঘন্য উপহাস। আমার বিশেষ ক্ষমতাকে করেছে সন্দেহ, এবং সবচেয়ে বড় কথা, আসামির পশ্চাদ্দেশে আমার দেওয়া উপহার বান্দরের লেজ সে ডাক্তারের কাছে গিয়ে কেটে ফেলেছে। বংশের গৌরবসূচক চিহ্নকে করেছে অপমানিত। তাই কঠোর শাস্তি ভিন্ন কোনো পথ নেই।

মাতার রায়: ঘোমটা এক হাত টেনে ওজনদার বিচারকদের কঠোর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল: দোষী। মন্তব্য: বয়স অল্প। এখনো ছেলেমানুষি ছাড়তে পারেনি। না বুঝে একটা বড় ভুল করে ফেলেছে। আপনারা বুজুর্গ মানুষ চাইলেই একটা মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিতে পারেন।

প্রপিতামহের রায়: দোষী। মন্তব্য: সকল বিচারকের পর্যবেক্ষণে আসামি দোষী প্রমাণিত হইয়াছে। প্রধান বিচারক হিসেবে আমার পর্যবেক্ষণও তাহাই। বিচারের আনুষ্ঠানিকতা অনুযায়ী এই রায়ের বিষয়ে আসামির কিছু বলার আছে কি না জানা আবশ্যক। আসামি মুখে একরাশ হাসি ছড়িয়ে বলল: দোষী!

আমি আমার সমাধিপ্রস্তর লিখনের একেবারে শেষ অংশে রয়েছি। আমার খোদাই কর্ম প্রায় শেষ। এখন এটার সৌন্দর্যবর্ধনের শেষ আঁচড় হিসেবে আমি চূড়ান্ত রায়টা খোদাই করে যাব। সকল সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আসামি দোষী সাব্যস্ত হইয়াছে। তাহার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ আসামি স্বয়ং নিজের মুখে স্বীকার করিয়াছে। তাই কাজী বংশের ধারা অনুযায়ী, আসন্ন শীতের কোনো এক কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে আসামির মৃত্যুদণ্ড ধার্য করা হইল।