অ্যালার্ম
ইশতিয়াকের ৮:০৫ এর অ্যালার্ম বেজে উঠেছে।
এখন রাত। ইশতিয়াক অ্যালার্ম বন্ধ করল। তবে শব্দটা আমার মাথায় এখনো ঘুরছে। কারণ, চারদিকে আর তেমন কোনো শব্দ নেই। আমার বাসা রাস্তা থেকে একটু ভেতরের দিকে। পাশের ফ্ল্যাটের লোক নেই চার মাস। এই বিল্ডিংয়ের দুপাশে দুটি ফাঁকা প্লট। সন্ধ্যার পর থেকে লাগাতার বৃষ্টি। সব মিলিয়ে সন্ধ্যা থেকেই নির্জনতা জাঁকিয়ে বসেছে।
ইশতিয়াকের অ্যালার্ম দিনে চারবার বাজে। সকাল ৬:৩৫, ৭:৪০, রাত ৮:০৫, ১০:৪০। সকালে ঘুম ভাঙা, জ্যাম এড়িয়ে বাসা থেকে বেরোনো, ওষুধ খাওয়া, রাতের সব কাজকর্ম শেষ করে ঘুমোনোর প্রস্তুতি এসব অ্যালার্মের হিসেবে বাধা। যত জরুরি কাজই থাকুক, ১১টার মধ্যে শুতে যেতে হবে। কোথাও যেন ভুল না হয়, সে কারণে অ্যালার্ম। প্রায়ই অ্যালার্ম বাজার সময় ইশতিয়াক বাথরুমে থাকে। তখন ওটা বাজতেই থাকে। আমি বন্ধ করি না। কারণ, একদিন বন্ধ করেছিলাম। তারপর ইশতিয়াকের একটা ওষুধ মিস হয়ে যায়। এরপর থেকে ইশতিয়াক আশপাশে না থাকলেও আমি অ্যালার্ম বন্ধ করি না। সে বাথরুম থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে তোয়ালেতে হাত মুছে অ্যালার্ম বন্ধ করে। দেখা যায় তার মুখ, জুলপি, কনুইয়ে পানি।
কিন্তু আজ রাতটা অন্য রকম। আজ সে আধশোয়া হয়ে বিছানায় বসে টিভি দেখছে। টিভির সাউন্ড মিউট করা। শুধু স্ক্রলের খবরগুলো পড়া যাচ্ছে। এই চ্যানেলের স্ক্রল সবটুকু শেষ হলে সে অন্য কোনো চ্যানেলে যাবে। এর মধ্যেই অ্যালার্ম বেজে উঠল। তার মোবাইলে অ্যালার্মের টোন ওয়েক মি আপ। যেনতেন টোন না, হঠাৎ করে শুনলে আত্মা লাফিয়ে ওঠে। একটু পরে অবশ্য সহনীয় হয়ে যায়। তবে অন্যমনস্ক থাকলে প্রথমে একটা ধাক্কা লাগে। সুইডেনের এক শিল্পী এই সুরের স্রষ্টা। লোকটার নাম অ্যাভিচি-ট্যাভিচি জাতীয় কিছু একটা। এটা তার আসল নাম না। লোকটা তরুণ বয়সে মারা গেছে। আত্মহত্যা। ইশতিয়াক বলেছে। ইশতিয়াক মাঝে মাঝে এ ধরনের গল্প নিয়ে আসে। অ্যাভিচি নামের এই শিল্পীর গল্পটা তেমন। সে কোথাও আলাপটা শুনেছে। অফিসে বা কোনো আড্ডায়। অন্যদের আলাপ-আলোচনায় শোনা এসব ব্যাপারে সে মাঝে মাঝে বেশ উত্তেজিত থাকে।
আজ ইশতিয়াক টিভি দেখছে আধশোয়া হয়ে। এ রকম সে কখনোই করে না। যতক্ষণ জেগে থাকে বসে থাকার চেষ্টা করে। অফিসের কাজ করে কিংবা ল্যাপটপে কিছু দেখে। টিভি সে খুব কম দেখে। তবে নিয়ম করে গান শোনে। গান শোনা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। গতকাল রাতে শুনেছে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায় ‘তুমি কি কেবলই ছবি’। বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একই গান শুনেছে। সম্ভবত মুখস্থ করেছে। একসময় আমার মনে হলো, সারা জীবন ধরে হেমন্ত ‘নও ছবি, নও ছবি, নও শুধু ছবি’ বলেছেন। বেশ কয়েকটা গান ইশতিয়াকের মুখস্থ। এগুলোর মধ্যে একটা শ্রীকান্তের ‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’। বিয়ের দুদিন পর এক রাতে সে গানটা শুনিয়েছিল।
আমি নিজেও টিভির স্ক্রলে আটকে গেছি। জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস কী যেন বলেছেন। ইশতিয়াক এসে বলল, ‘চা নাও, তরী।’
সে কখন উঠে গেছে আমি লক্ষ করিনি। মাঝে মাঝে সে অসময়ে চা খায়। মেজাজ খুব ভালো কিংবা শরীর খুব ক্লান্ত হলে। চায়ের কাপ নিয়ে আমি তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে একটা হাসি দিলাম। চা বানানোর কাজটা ইশতিয়াক নিজে করে। যেভাবে গুছিয়ে কাজটা করে সেটা একটা আর্ট। আমার চা বানানো তার পছন্দ না। আমার কাজের মধ্যে তাড়াহুড়োর ছাপ স্পষ্ট। চায়ে তেতো কিংবা কাঁচা কাঁচা ভাব কোনোটাই থাকা যাবে না। চা নামানোর এই মোক্ষম মুহূর্তটাই আমি নাকি ধরতে পারি না।
চায়ে চুমুক দিয়ে লক্ষ করলাম, আমার মাথায় ‘নও ছবি, নও ছবি, নও শুধু ছবি’ লাইনটা ঘুরছে। এটা আমার সমস্যা। মাথায় কোনো শব্দ, কথা, গালি, গানের লাইন ঢুকলে সেটা সহজে বের হয় না। অবিরত ঘুরতে থাকে। ইন্টারমিডিয়েটে কলেজ ফাংশনে আমার ক্লাসমেট রাশেদ ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতাটা আবৃত্তি করেছিল। দুদিন ওর জোর দিয়ে বলা ‘হারামজাদা’শব্দটা আমার মাথা থেকে বিদায় হয়নি। সত্যি বলছি।
চায়ের কাপ হাতে নিয়েই ইশতিয়াক হাই তুলছে। সে আজ খুব বেশি রকম ক্লান্ত। এত নিয়মকানুন মেনে চলেও দিন দিন তার ক্লান্তি বেড়েই চলেছে। কোনো গান ছত্রিশবার শুনেও লাভ হচ্ছে না। বললাম, ‘এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসছে আজকে?’
ইশতিয়াক বলল, ‘আর বলো না। আজ মতিঝিল অফিসে গিয়ে চার-পাঁচ ঘণ্টা বসে থাকতে হলো। তার ওপর ফেরার পথে এত জ্যাম! বেহুদা।’
তাকে মাঝে মাঝেই এই বেহুদা কাজটা করতে হয়। কাপটা টেবিলে রেখে সে আস্তে করে শুয়ে পড়ল। বলল, ‘আমি দশ মিনিট একটা শর্ট ন্যাপ নেব। ডেকে দিয়ো।’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা।’
ইশতিয়াক আমাকে ডাকার কথা বললেও অ্যালার্ম দিয়ে রাখল। হয়তো পনেরো কিংবা আঠারো মিনিট পরে অ্যালার্মটা বাজবে। সে মাঝে মাঝে এ ধরনের অ্যালার্ম দেয়। তারপর একেবারে গভীর ঘুম। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে চা শেষ করলাম। ইশতিয়াক দেখতে খুব সুন্দর। ঘুমালে তার চোখ আরও সুন্দর হয়ে যায়। গালগুলো একটু নেমে গিয়ে তাকে দুঃখী দুঃখী দেখায়। মানুষ ঘুমালে দেখতে শিশুদের মতো হয়ে যায়।
কয়েক দিন ধরে আমি ইশতিয়াকের ওপর খুব বিরক্ত। কেন জানি না। আমাদের বিয়ে হয়েছে এগারো মাস। পারিবারিকভাবে। প্রথম প্রথম দুজনের প্রতি দুজনের প্রতি পাগলপারা কৌতূহল। হৃৎপিন্ড লাফিয়ে ওঠা আগ্রহ। প্রথম দিকে বেশ পাগলামি ছিল। এখন কমে গেছে। দুজন দুজনকে কাছ থেকে দেখছি। ইশতিয়াক হয়তো আমাকে, আমি নিশ্চিতভাবে ইশতিয়াককে। এই দেখার মধ্য দিয়ে কী যেন হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে, আরও দু বছর এগারো মাস ঠিক এই রকমভাবেই কাটা সম্ভব না। কোনোভাবেই না।
ইশতিয়াক খুব গোছানো মানুষ। এত গোছানো যে আমার নিজেকে নিয়ে মাঝে মাঝে লজ্জা লাগে। আমি এমন নিখুঁত নই। ইশতিয়াকের দুটো মোজার দুটোই সব সময় একসঙ্গে থাকবে, মোবাইল চার্জার এদিক-ওদিক হাতড়াতে হবে না, শার্টের কলার থাকবে ঝকঝকে, ওষুধের বাক্সে কখনো অপ্রয়োজনীয় ওষুধ থাকবে না। তাকে দেখে মনে হয় রোবট কোম্পানিগুলোর ভালো রোবট বানানোর জন্য এ রকম একটা মডেল দরকার।
এত নিখুঁত হওয়ার পরও আমার মনে হয় সে কিছু ব্যাপার ধরতে পারে না। বড় বড় বিষয়। মানে আমার কাছে। ধর্তব্য বিষয়গুলো তর্কসাপেক্ষ। আমাদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো দিন কোনো কথাবার্তা হয়নি। তবে আমি কিছু একটা অনুভব করি। একবার ইশতিয়াকের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইশতিয়াক বাবার ডাক্তার দেখানোর জন্য চাচাতো ভাই রফিককে চার হাজার সাত শ টাকা পাঠাল। রফিক তার চাচাকে সদরে নিয়ে ডাক্তার দেখাবে। এই চার হাজার সাত শ কেন সোজাসুজি পাঁচ, সাত কিংবা দশ নয় তার উত্তর আমি জানি। কিন্তু উত্তরটা আমার ভালো লাগে না। ইশতিয়াকের টাকাপয়সার সমস্যা নেই। ডাক্তার দেখানো, ওষুধ কেনা এবং যাতায়াত খরচ বাবদ চার হাজার সাত শ টাকাতে ঠিকঠাক হয়ে যাবে। এর বেশি লাগলে সে টাকাও পাঠাবে তা আমি জানি। তবু আমার একটু খচখচ লাগে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার হিসাব দেখলে আমার জ্বর জ্বর লাগে। আমাদের পাড়ায় একটা মেয়ে হ্যারাসড হয়েছে। আমার গা শিউরে উঠেছে। ইশতিয়াককে ঘটনাটা বলতেই নির্বিকার হয়ে বলল, ‘দ্যাখো, ওই মেয়ে নিজেই কী করতে গেছিল ওইখানে!’
আমি অস্থির হয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ‘বারো-তেরো বছরের একটা মেয়ে।’
ইশতিয়াক বলল, ‘আরে তুমি তো আজকালকার টিনেজ মেয়েদের চেনো না। তোমার থেকে বেশি বোঝে ওরা।’
আর দুয়েকটা কথার পরও ইশতিয়াক নিজের জায়গা থেকে সরে আসে না। আমিও আর তর্ক করি না। বিরক্তিতে আমার মুখে থু থু জমে। বেসিনে গিয়ে থু থু ফেলি, ট্যাপ থেকে পানি ছাড়ি। সেই পাক খাওয়া পানির দিকে তাকিয়ে ভাবি ইশতিয়াক আর দশজনের মতোই।
গত এগারো মাসে ইশতিয়াকের সঙ্গে থেকে নিজেকে অনেক বেশি মাংস মাংস বলে মনে হয় আমার। মাংস ব্যাপারটা খারাপ না। বিবাহিত মানুষদের মধ্যে মাংস, আত্মা, মন সবই থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবু যত দেখি ততই মনে হয় ইশতিয়াক মাংস যত চেনে মন তত চেনে না। আমাদের যোগাযোগের ধরনটাও তেমন। আমার জায়গায় যে মেয়েই থাকুক, ব্যাপারটা একই হতো। ইশতিয়াক এমনই।
শুধু যে এসব কারণে বিরক্তি, তা নয়। আমার বিরক্ত হওয়ার অভ্যেস পুরোনো। আমি ঘন ঘন বিরক্ত হই না। অনেক দিন পরে হয়তো হঠাৎ খুব বিরক্ত হই। বিরক্তিটা জমে জমে চূড়ান্তে পৌঁছায়। তীব্র রাগে পরিণত হয়। তখন কিছু একটা ঘটে। কী ঘটে তা বলতে পারব না। কারণ, তখন আমার কিছু মনে থাকে না। কী করি না করি তার ঠিক থাকে না। তাই নিজের বিরক্ত হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আমি নিজেই বেশ ভীত। শেষবার এমন রেগেছিলাম ছয়-সাত বছর আগে।
আমরা দু ভাই বোন। আমার ভাই ছোট রুম্মান। আমার তেরো বছরের ছোট। আমাদের আরেকটা ভাই ছিল। ওর নাম টুটুল। আমার আট বছরের ছোট। দু বছর বয়সে টুটুল একটা দুর্ঘটনায় মারা যায়। আমার আম্মা পড়ালেখা করা মানুষ হয়েও জিন-পরীতে বিশ্বাস করেন। তিনি ওই দুর্ঘটনা কিংবা অসুস্থতা যেটাই হোক, টুটুলের মৃত্যুর কারণ হিসেবে জিনের আছরকে দায়ী করেন। ঠিক কীভাবে ও মারা গিয়েছিল মনে নেই। যাহোক, এখন আমরা দু ভাইবোন। একটু আদরে বড় হওয়ার কারণেই কি না জানি না, আমার রাগটা অদ্ভুত।
এই মাত্রাছাড়া রাগের জন্য আব্বা-আম্মাকে দুয়েকজন পরামর্শ দিয়েছিলেন আমাকে ডাক্তার দেখানোর। তারা ওসবে পাত্তা না দিলেও হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খেয়েছি অনেক দিন। সঙ্গে নিয়ম মেনে পেঁয়াজ, লবণ, চিনি, গরমমসলা এসব বছরের পর বছর বাদ। এগুলোতে কাজ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তাহলে ইদানীং ইশতিয়াকের ওপর এত বিরক্ত লাগত না।
আমার বান্ধবী রুবার পিরিয়ডের সমস্যা ছিল। ডাক্তার তার মাকে বলল, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ের সঙ্গে পিরিয়ডের কী সম্পর্ক তা ওই ডাক্তারই জানে! রুবার বিয়ে দেওয়া হলো। সমস্যা একই রইল। তখন ডাক্তার বলল, একটা বাচ্চা হলে ঠিক হয়ে যাবে। বাচ্চা হওয়ার পরও রুবার সমস্যা একই রইল। ডাক্তার বলল, আরেকটা বাচ্চা নিলে অনেকের এই সমস্যা ঠিক হয়ে যায়। জানি না রুবার এত দিনে কয়টা বাচ্চা হয়েছে। ওর সঙ্গে কয়েক বছর ধরে যোগাযোগ নেই।
রুবার ডাক্তারের মতোই আমার আব্বা-আম্মাও ভাবতেন, বিয়েশাদি হলে আমার রাগ সমস্যার সমাধান হবে। ঘাড়ে বোঝা পড়বে। বোঝা টানতে গিয়ে সোজা হয়ে যাব। কিন্তু বোঝার পরিমাণ মনে হয় কম হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত সংসার খারাপ লাগছে না। সমস্ত কাজকর্ম করে হাতে প্রচুর সময় থাকে। গল্পের বই পড়ি, মুভি দেখি, কাচের বোতল রং করি, গাছ লাগাই, পাখিকে খাবার দেই, শখ করে হাতে কেটে জামা বানাই। ইশতিয়াকের টিফিন ক্যারিয়ারে যত্নের সঙ্গে খাবার গুছিয়ে দিই। আমার মাথায় এই একলা সময়গুলো প্রচুর চিন্তা চলতে থাকে। স্মৃতি থেকে শুরু করে কত ভাবনাকে যে আমি উল্টেপাল্টে দেখি। অস্থিরও লাগে।
কোথাও কোনো সমস্যা নেই। তারপরও কেন যেন আমার পুরোনো রাগটা ফিরে আসছে। রাগটা হওয়া উচিত নয়। ইশতিয়াক এত নিয়ম মেনে চলে কারণ ওর মেডিকেল কন্ডিশনে স্ট্রোক করার মতো যথেষ্ট উপাদান আছে। ওর বয়সী লোকরা আজকাল ঢাকা শহরে টপটপ করে মরে যাচ্ছে। এই তো দুমাস আগে ওর কলিগ হাসিব স্ট্রোক করে ঘুমের মধ্যে মরে গেল। এই কথাটা ইশতিয়াক আমাকে বলেছে। বলার সময় ইশতিয়াকের মতো হিসেবি মানুষের কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসের অভাব। যেন সে বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে।
ওর ওপর আমার বিরক্তি বাড়ছে বুঝতে পারলাম হঠাৎ করেই। দুরাত স্বপ্নে দেখলাম তার মুখের ওপর বালিশ চেপে ধরেছি। প্রথম দিন খুব অস্বস্তি লাগল। দ্বিতীয় দিন কেমন যেন ভয় করতে লাগল, কেন এমন স্বপ্ন দেখছি। তাই আজ ইশতিয়াক ঘুমানোর পর যখন হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম, অসুরের মতো শক্তি দিয়ে আমি ইশতিয়াকের মুখের ওপর বালিশ চেপে ধরেছি, প্রথমে মনে হলো স্বপ্নই দেখছি। কিন্তু একটু পর বুঝলাম, স্বপ্ন না। কেমন করে, কতক্ষণ ধরে এই অবস্থায় আছি, তা-ও জানি না। হয়তো বেশ কয়েক মিনিট। কারণ, ইশতিয়াকের কোনো সাড়াশব্দ নেই। হাত-পা শিথিল। কপালের পাশ দিয়ে ঘাম নেমেছে। দৃশ্যটা আমার খুব চেনা লাগে। এইভাবে এত কাছ থেকে এমন দৃশ্য আগেও কোথায় দেখেছি। আমি নিশ্চিত। এই বালিশটা নীল। সেটা ছিল লাল রঙের ফুলতোলা। একটা মিষ্টি মিষ্টি তেলের গন্ধ। কে যেন চিৎকার করছিল। একটা বাচ্চা, অবিরত বিরক্তিকর সুরে কেঁদে যাচ্ছিল। আমার মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছিলাম না। তখন বালিশটা তুলে নিই...হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেদিন ছিল দুপুর। এর বেশি কিছু আমার মনে পড়ে না। আমি এখন খুব ক্লান্ত। হাত-পা ছেড়ে খাটের এক পাশে হেলান দিয়ে বসি।
কতক্ষণ সময় গেছে কে জানে। মনে হচ্ছে অনেক দিন এভাবে বসে আছি। এখানে বসে থাকলেও আমি আসলে চেষ্টা করছি অনেক আগের একটা সময়ে ফিরে যেতে। আজকের মতো সেদিনের পৃথিবীতেও কেউ কোথাও ছিল না। বিরক্তিকর কান্নাটা যখন থামাতে পেরেছি তখন এমনই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি আর কান্না ছাড়া কেউ ছিল না সেখানে। আমি অবাক হয়ে নীল বালিশে রাখা ছোট মুখটার দিকে তাকিয়ে আছি। তখন আর কান্না নেই। প্রায় নির্জন দুপুরে সারা বাড়িতে কোনো আওয়াজ নেই। জানালা দিয়ে রোদে এসে পড়েছে নিথর মুখে। সময় থমকে আছে সেখানে। সেখান থেকে ছিটকে বর্তমানে ফিরে আসি বিকট একটা অ্যালার্মের শব্দে। ইশতিয়াকের অ্যালার্ম। বাজতেই থাকে। উহ। মাথা চেপে ধরি। হাতড়ে হাতড়ে কোথাও ওর মোবাইলটা খুঁজে পাই না। ওটা বাজতেই থাকে। কোথায়, কোথায়? অবশেষে পাওয়া যায় ওয়্যারড্রোবের ওপর। ঘামে ভেজা হাতে মোবাইল কমান্ড নেয় না। কামিজের কিনারা দিয়ে হাত মুছে কাঁপা কাঁপা ডান হাতের বুড়ো আঙুলে অ্যালার্ম ডিসমিস করি। এই কয়েক সেকেন্ডকে মনে হচ্ছে অনন্তকাল। কিন্তু ওয়েক মি আপ টিউনটা তবু কোথায় যেন বাজতে থাকে। বাজতেই থাকে। ইশতিয়াকের মাথা থেকে নীল বালিশটা সরিয়ে আমার মাথার ওপর চেপে ধরি। কিন্তু অ্যালার্মটা বন্ধ হয় না মাথার ভেতরে। কেউ একজন সেখানে অন্তহীন ওয়েক মি আপ বাজিয়ে যাচ্ছে।
ভালো লাগলো। শক্তিশালী লেখা। অভিনন্দন।
শাহাদাত হোসেন
অক্টোবর ১৪, ২০২১ ০৫:৪০