দস্তইয়েফস্কির ‘অজ্ঞাতবাসের পত্র’

 

ফিওদর দস্তইয়েফস্কির জুয়াড়ি পড়েছিলাম অনেক আগে। এবার তাঁর আরেকটি ঔপন্যাসিকার ইংরেজি অনুবাদের পিডিএফ Notes From Underground পড়তে গিয়ে দেখি, বেশ সাবলীল অনুবাদ। তরতর করে পড়বার মতো। অজ্ঞাতবাসের পত্র নামে খন্দকার মজহারুল করিমের বাংলা অনুবাদ বইটাও পেয়ে গেলাম পুরোনো বইয়ের অনলাইন শপিংয়ে। এক লহমায় পড়ে ফেললাম। অদ্ভুত আনন্দ পেলাম। বইটির প্রথমাংশ তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। পরের অংশ সেই তত্ত্বের প্রামাণিক কাহিনি। জর্জ বার্নার্ড যেমন তত্ত্বকে নাট্যরূপ দিয়েছেন, অনেকটা সেই আদলে ভাবা যায়। অজ্ঞাতবাসী নিজেই উপন্যাসের ধারা বর্ণনাকারী। তার ধারণা অতিশয় সচেতন হওয়া একধরনের ব্যাধি অজ্ঞাতবাসী নিজে সেই ব্যাধিতে আক্রান্ত। সমাজের তীব্র সমালোচক সে। আবার সমাজের সঙ্গে মিশতে না পারার ভোগান্তি নিয়ে তার আহাজারি আছে। সেই আহাজারি নিজে আবার উপভোগও করে। তিক্ত আত্মসমালোচনায় নিজেকে বারবার বিদ্ধ করে সে। সে মনে করে, দুইয়ে দুইয়ে চার এ রকম কাটকাট গাণিতিক যুক্তির প্রায়োগিক মূল্যে মানুষ সমাজ চলে না।

১৮৬৩ সালে রচিত হয় নিকোলাই চেরনিশেভস্কির [Nikolay Chernyshevsky] মতাদর্শভিত্তিক উপন্যাস কী করতে হবে? [What Is To Be Done]। এই গ্রন্থে নিকোলাই প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন ব্যক্তিস্বার্থের পরিকল্পিত এবং যুক্তিগ্রাহ্য একটা ইউটোপিয়ার কথা ভেবেছেন। তাঁর সময়ের সমাজবাদীদের ধারণাও ছিল যে, মানুষ নিজের সত্যিকারের স্বার্থ বুঝতে পারলে যুক্তির প্রায়োগিক চর্চায় ক্রমশ পূর্ণতার দিকে যাবে। এই ইউটোপিয়ান সমাজবাদী ধারণার প্রতিক্রিয়ায় দস্তইয়েফস্কির এই ঔপন্যাসিকা।

এই গ্রন্থে অজ্ঞাতবাসে অভ্যস্ত লোকটির নাম আমরা জানি না। সে বরং মানুষকে অযৌক্তিক জীব হিসেবেই গণ্য করেছে। তার ধারণা, যাদের ধীশক্তি সীমিত তারা খুব দূরের জিনিস নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। কাঁধের ওপর যে সমস্যা জেঁকে বসে, তা নিয়ে সদা ব্যস্ত থাকে তারা। এই যুক্তিতে অজ্ঞাতবাসী নিজের অলস যাপনে আগ্রহী। এটা তার শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা হলেও মানসিক নিষ্ক্রিয়তা বলা চলে না। সে সমাজের আমজনতা থেকে আলাদা এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অনেক বেশি সচেতন সক্রিয়। এই আত্মতৃপ্তি তাকে ধর্ষকামী করে তোলে। সে নিজেই বলে: সহজভাবে কারও মন খারাপ করে দিতে পারলে কী যে মজা লাগত! আবার তাকে মর্ষকামীও বলা যায়। সে বলে, দাঁতের যন্ত্রণার মধ্যেও আনন্দ আছে। মানুষ যে গোঙায়, বিলাপ করে, তার মধ্যে বিদ্বেষ আছে। বিদ্বেষের মধ্য দিয়েই মানুষ নিজের ভোগান্তির আনন্দকে সমাজে ছড়িয়ে দেয়। অজ্ঞাতবাসীর ভোগান্তি তার নিজের অস্তিত্বকে আত্মোপলব্ধির দোরগোড়ায় নিয়ে আসে। মানুষের অস্তিত্ব তার সারসত্তার পূর্বগামী। ফলে যুক্তির চেয়ে মানুষের স্বাধীন আকাঙ্ক্ষা মেটানোই সহজাত। সেই দিক থেকে এটিকে অস্তিত্ববাদী উপন্যাস বলা যেতে পারে।

লোকটির অহেতুক বাগাড়ম্বর তার নিষ্ক্রিয়তাকে আরও জটিল করে তোলে। এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে অপমান করেছিল। সেই প্রতিশোধ নিতে টাকা ধার করে অভারকোট কিনে পড়ে নেয় সে। যে পার্কে এই কর্মকর্তার সঙ্গে তার দেখা হয়, সেখানে ওই কর্তাব্যক্তি তার দিকে ফিরেও তাকায় না। সে নিজেও কিছু করতে পারে না। সাহস পায় না বা ইচ্ছে পোষণও করে না। এটা তার নিষ্ক্রিয়তার ধরন। বাগাড়ম্বরসর্বস্ব জীবন নিয়ে পরিতুষ্টি আর অতুষ্টির দ্রবণে তার ব্যক্তিত্ব বরং জলো হতে থাকে।

উচ্চ ক্ষমতাধর বন্ধু জেভারকভের বিদায় অনুষ্ঠানে সে যেচে চাঁদা দিয়ে অংশগ্রহণ করতে চায়। যদিও সামর্থ্য নেই। জেভারকভসহ অনুষ্ঠানের অন্য বন্ধুদের সঙ্গে সে যোগাযোগই রাখেনি এতকাল। একটা ঠুনকো আভিজাত্যের মোহ তাকে তাড়িত করে। জেভারকভের সামাজিক মর্যাদা তাকে ঈর্ষান্বিত করে সম্ভবত। কিন্তু ওখানে নিজের জ্ঞান ফলাতে গিয়ে সে অপমান করে বসে বন্ধুদের। বন্ধুরা কিন্তু তাকে এড়ানোর যথাসাধ্য চেষ্টাও করে। তার জবরদস্ত অনুরোধে অনুষ্ঠানে তার আগমন তারা ঠেকাতে পারেনি। সমাজের মানুষগুলোকে সে যেমন নিম্নবুদ্ধিবৃত্তির মনে করে, তেমনি সমাজের প্রতিনিধি এই বন্ধুদেরও মনে করে বৌদ্ধিকভাবে খর্বকায়। ভেতরে ভেতরে এদেরকে সে মনে করে হাস্যকর। তর্কাতর্কির প্রতিক্রিয়ায় আরও বহুগুণ অপমান নিয়ে ফিরতে হয় তাকে। পকেটে টাকা না থাকার কারণে লজ্জাজনকভাবে হাত পাততে হয় বন্ধু সিমনভের কাছে। মুখের ওপর টাকা ছুড়ে মেরে বন্ধুরা বেরিয়ে যায় নিকটস্থ গণিকালয়ে। অপমানের নানা রকম মানসিক প্রভাব তাকে পীড়ন করতে থাকে। সে ভাবে:

হয় ওরা সবাই হাঁটু গেড়ে নিচু হয়ে আমার বন্ধুত্বের জন্য আবেদন জানাবে, না হয় আমি সোজা চড় মারব জেভারকভের মুখে।

চড় মারা তো দূরের কথা, ওদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগও হয় না তার। দেখা হয় লিসার সঙ্গে। সে বারবনিতা। তবু প্রেম, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং এসবের পরিণতি হিসেবে বিয়ে সন্তানের সপক্ষে অসাধারণ কথা শোনায় সে লিসাকে। তাকে নিজের ঠিকানাটাও দিয়ে আসে। কিন্তু অজ্ঞাতবাসে ফিরে এসেই তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মেয়েটি যদি সত্যিই ফিরে আসেসেই ভয়ে আত্মপীড়নে ভুগতে থাকে সে। সত্যিই লিসা এলো একদিন। সে জানাল, ওখান থেকে সে ফিরে আসতে চায়। কিন্তু অজ্ঞাতবাসী তাকে প্রায় অপমান করে ফিরিয়ে দিল। হাতে গুঁজে দিল সেদিনের মৌজ-মাস্তির টাকা। মেয়েটি টাকা রেখে ফিরে গেল। আত্মপীড়নে মেয়েটিকে খোঁজ করেও আর তাকে ফিরে পায়নি সে। অজ্ঞাতবাসীর চরিত্রের মাধ্যমে উপন্যাসের প্রচল হিরোর ধারণা ভেঙে যায়। তাকে বরং অ্যান্টিহিরোর মর্যাদায় দেখতে পাই আমরা।

অজ্ঞাতবাসী মধ্যবিত্তের মতো আত্মমর্যাদা নিয়ে অতি সচেতন, আত্মতুষ্ট এবং নিজের অবস্থান ডিঙানোর কার্যক্রমে অনীহা পোষণকারী। অথচ ভেতরে গোঙানি আছে তার, আছে বিলাপ এবং পরিপার্শ্ব নিয়ে নিজের ভেতরে মুখর সমালোচনা। প্রেম-ভালোবাসা, বিয়েএসব নিয়ে যে আদর্শিক মানবিকতায় উজ্জীবিত করে সে লিসাকে, তা লিসা অকপটে বিশ্বাস করে। আশ্রয়ের আশায় সমর্পিত হতেই সে এসেছিল। প্রেম বিয়ের বিষয়ে অজ্ঞাতবাসের লোকটি যা বলে, তা নিজে হয়তো সে বিশ্বাসও করে।

অজ্ঞাতবাসীর চরিত্র যৌথ মনস্তত্ত্বের আকর। ধর্ষকাম এবং মর্ষকাম সমন্বিত শক্তি নিয়ে তার চরিত্রের স্ববিরোধ তৈরি করেছে। মানসিকভাবে সে আত্মসচেতন এবং গভীরভাবে ক্রিয়াশীল। কর্মতৎপরতায় শারীরিকভাবে সে ভূমিকা রাখতে পারে না। একটা আত্মনির্যাতনে নিজের কাছে নিজেই উপভোগ্য হয়ে ওঠে। পীড়নমুক্তির উপায় ছিল কার্যসম্পাদন করা। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে সে অপমান করে প্রতিশোধ নিতে পারে না। জেভারকভের মুখে মারতে পারে না চড়। আর লিসা সম্পর্কে সে বলে:

একজন নারীর কাছে ভালোবাসা শুধু সূক্ষ্ম হৃদয়বৃত্তি নয়, অনেক বেশি কিছু, সে ধ্বংসের সীমানায় দাঁড়িয়ে ত্রাণের জন্য ভালোবাসা চেয়েছে।

অজ্ঞাতবাসী এই সচেতন উপলব্ধির পরও নির্মমভাবে ফিরিয়েছে লিসাকে। সস্তা সুখের চেয়ে মহিমান্বিত বেদনাকে বেছে নিয়ে তার হাহাকারও যেন পরিতৃপ্তিদায়ক দার্শনিক সান্ত্বনায় নিষ্কৃতি পায়।

এখন কথা হলো, যিশুখ্রিস্ট শারীরিক পীড়নের মধ্য দিয়ে খ্রিস্টান জাতির পাপ স্খলনের দায় নিয়েছিলেন। এভাবেই মুক্তির দূত হয়ে মানুষের জন্য রক্ত ঢেলে নিজের মহিমা প্রোজ্জ্বল করেছেন। অজ্ঞাতবাসী আত্মপীড়নের যিশু। তার মুক্তি নাই। কারণ, সে মনে করে, মানুষ পরস্পরবিরোধী সত্তা। স্খলনই তার ভবিতব্য। এর পেছনে সে যুক্তিও দেয়। বলে: সবচেয়ে সভ্য মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে কুশলী নরঘাতকদের দেখা মেলে। আরও বলে: নিজের চারদিকে তাকালেই বুঝবেন। ঝরনাধারার মতো রক্তপাত হচ্ছেকিন্তু সে এমন উল্লাসের সঙ্গে, যেন রক্ত নয়, শ্যাম্পেনের ছড়াছড়ি। তার মতে আকাঙ্ক্ষা, স্বাধীন ইচ্ছা আর পছন্দ ছাড়া মানুষ স্রেফ যন্ত্র। কেন এভাবে চিন্তা করে সে? কেননা স্বাধীন ইচ্ছা, অবাধ আকাঙ্ক্ষার পরিপূরণ এসব কখনো যুক্তির অনুবর্তী নয়, যুক্তি তো আকাঙ্ক্ষার স্বাধীনতাকে একটা নৈতিক দেয়ালে বেঁধে দেয়। তাই ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার চরিতার্থতায় মানুষ নিজ স্বার্থবিরোধী হয়ে ওঠে কখনো কখনো। কিন্তু দস্তইয়েফস্কি ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্নে নিজের অজ্ঞাতে স্বেচ্ছাচারের ন্যায়ারোপণ করলেন। মতাদর্শের বিরুদ্ধে আরেকটি মতাদর্শ এমনভাবে জারি করলেন, যা আপাতনিরীহ কিন্তু নৃশংস হয়ে উঠবার সম্ভাবনায় টইটুম্বুর। আজকের বিশ্ব-প্রেক্ষাপটে যা কিনা প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় নতুনভাবে যাচাই হতে পারে।

ধারণা করা যায়, অজ্ঞাতবাসী নিম্নমধ্যবিত্ত হলেও মধ্যবিত্তের কথাসর্বস্ব আত্ম-অহংকারের প্রতিনিধি হয়ে আছে। উচ্চবিত্তের সঙ্গে নিম্নবিত্তের একটা মানসিক ঐক্যের অপভ্রংশ চালু থাকে সমাজে। উচ্চবিত্তের কলকারখানায়, গৃহ আবাসে শ্রমিক বা দাসদাসী হিসেবে নিম্নবিত্তের একটা সহজ বিচরণ আছে। উচ্চবিত্তের যাপন-সংস্কৃতির বিকৃত সংস্করণ তাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। আত্মমর্যাদার ঠুনকো অহমিকা উচ্চবিত্তের থাকলেও কার্যসিদ্ধির প্রয়োজনে ওসব তারা ভুলে যায়। গ্লানিবোধে তাড়িত হয় না। ঠিক একই ব্যাপার ঘটে নিম্নবিত্তের বেলায়। এই দুই শ্রেণির যেকোনোটির অন্তর্ভুক্ত হলে অজ্ঞাতবাসী পারত প্রতিশোধ হিসেবে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে অপমান করতে, বন্ধু জেভারকভের মুখে থাপ্পড় মারতে বা অনুরূপ কিছু ঘটাতে। আর লক্ষ্য অন্য কিছু না হলে যৌন সম্ভোগের পর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিয়ে, সন্তানাদি নিয়ে এত এত আদর্শিক কথা শুনিয়ে কালক্ষেপণের প্রয়োজন পড়ত না তাদের। কারণ, সম্ভোগ লক্ষ্য হলে তা তো সম্পন্নই হলো। যেমন লিসার সঙ্গে অজ্ঞাতবাসীর যৌন সম্পর্কের ইঙ্গিত পাই যখন সে লিসার হাতে মাইনা হিসেবে পাঁচ রুবল তুলে দেয়। তাহলে আদর্শ-কথার ভণিতার কি দরকার ছিল? আর মনে এসব মানবিক বোধ জেগে উঠলে লিসা সত্যিকারের আশ্রয়ই পেত কথিত ওই দুই শ্রেণির কাছে। অন্তত তাকে ঘিরে অন্য কোনো উচ্চবিত্তীয় অথবা নিম্নবিত্তীয় স্বার্থ জড়িত হবার আগ পর্যন্ত।

অজ্ঞাতবাসী মধ্যবিত্তের মতো আত্মমর্যাদা নিয়ে অতি সচেতন, আত্মতুষ্ট এবং নিজের অবস্থান ডিঙানোর কার্যক্রমে অনীহা পোষণকারী। অথচ ভেতরে গোঙানি আছে তার, আছে বিলাপ এবং পরিপার্শ্ব নিয়ে নিজের ভেতরে মুখর সমালোচনা। প্রেম-ভালোবাসা, বিয়েএসব নিয়ে যে আদর্শিক মানবিকতায় উজ্জীবিত করে সে লিসাকে, তা লিসা অকপটে বিশ্বাস করে। আশ্রয়ের আশায় সমর্পিত হতেই সে এসেছিল। প্রেম বিয়ের বিষয়ে অজ্ঞাতবাসের লোকটি যা বলে, তা নিজে হয়তো সে বিশ্বাসও করে। কিন্তু মেয়েটিকে গ্রহণের বেলায় তার অতি আত্মসচেতনতা তাকে কাপুরুষ বানিয়ে ফেলে। নিজ কুঠুরিতে তার আত্মকাম, আত্মপীড়ন পরপীড়নের বৈরী মনস্তত্ত্ব সঙ্গে নিয়ে জোরালোভাবে সংগঠিত। তা বিঘ্নিত হবার ভয়ে সে সাহসী হয়ে উঠতে পারে না। লিসাকে চলে যেতে বাধ্য করে। লিসার চলে যাওয়া বেদনা জাগায়। আরও বড় বেদনা অজ্ঞাতবাসের লোকটিকে নিয়ে। গভীর যন্ত্রণায় লিসাকে ফিরিয়ে আনতে বের হয় সে। কিন্তু ব্যর্থতাই শেষ পরিণাম। লোকটির প্রতি তিতিবিরক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। লিসা আশাহত। আর অজ্ঞাতবাসের লোকটি নিজের লালিত মনস্তত্ত্বের কাছে পরাহত, অনিবার্য অসহায়। তাই তার যুক্তিবুদ্ধিহীনতা বা ইরেশনালিটি একটা তড়পানো বাস্তবতা। তৃপ্তি-অতৃপ্তির নির্মম দোলাচল।

তবে মানুষের এই ইরেশনালিটি তথা অযৌক্তিক মনোবৃত্তি আপেক্ষিক, ব্যক্তিসাপেক্ষ এবং একটা পর্যায়মূলক বা পরিস্থিতিকেন্দ্রিক ব্যাপার মনে হয় আমার কাছে। দস্তইয়েফস্কি যেভাবে সর্বজনীন করে তুলতে চেয়েছেন, সে রকম কিছু নয়। মানুষ মূলত বিপথগামী কিন্তু সুপথের নিদর্শন সমাজ-সংসারে, আমাদের চিন্তায় বিরাজিত থাকে। আমাদের মনস্কামনা তাকে লালন করে। নেতৃত্বের অভাব এবং যুগচেতনায় তাকে সন্নিবেশ করার পরিবেশের অপ্রতুলতা সেই সুপথ থেকে দূরে রাখে আমাদের। অধিক সচেতনতাকে অজ্ঞাতবাসী ব্যাধি বলে আখ্যা দিয়েছে, সেটা আমরা জানি। আবার যুক্তি ডিঙানো বিচারবুদ্ধিহীন আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছার অবাধ স্বাধীনতাকে কাহিনির আবর্তে নিজের জীবনযাপনে যেভাবে যাচাই করেছে সে, সেটাও খুব স্বাভাবিক বলে ঠাওর হয় না। মনে হয় অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব। এখন দস্তইয়েফস্কির এই গ্রন্থের উপযোগিতা হলো, এই অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব ব্যক্তি ছাপিয়ে আজকের বিশ্বে একটা সামষ্টিক সামাজিক প্রণোদনায় উপনীত হয়েছে। জনতার যৌথ অবচেতনায়ই বলি আর রাষ্ট্রের ক্ষমতায়নের জবরদস্তির নিরিখেই বলি, যাচ্ছেতাই করবার আকাঙ্ক্ষাজাত অবাধ স্বাধীনতা এতটা প্রবল যে, স্বাভাবিক যুক্তি থেকে উদ্ভূত সামান্য নীতিবোধও টুটে গেছে। স্ববিরোধের অনন্য মাত্রায় উপনীত পৃথিবী এখন। রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকায়। দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধের অবসানে অজ্ঞাতবাসীর মতো এখনো আমরা দেখি যেন রক্ত নয় শ্যাম্পেনের ছড়াছড়ি এই শ্যাম্পেনের ছড়াছড়ি যার ইশারায়, তারও যেন আছে এক অজ্ঞাতবাস। তাই আমরা তাকে জানি না। শুধু জানি পীড়নে সেও বিলাপ করে, আহ, ওহ করে আনন্দ পায়। আবার নিপীড়নের জন্য সে নিজেই দায়ী, তখন তার উল্লাস। সে তাই ধর্ষকামী এবং মর্ষকামী একই সঙ্গে। কে এই অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের অজ্ঞাতবাসী? রাষ্ট্র, গোটা বিশ্ব নাকি সামগ্রিকভাবে আমরা সবাই?