অসীম রায়ের ‘সমন্বয়বাদী ঐতিহ্যে’ ইটনের দু’নক্তা

 

পূর্ব বাংলায় ইসলামের বিস্ময়কর উত্থান নিয়ে যে দুটি গবেষণাকর্ম দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা, সমালোচনা তথা চর্চায় প্রাধান্য বিস্তার করে আসছে, সে দুটি হলো অসীম রায় ও রিচার্ড ম্যাক্সওয়েল ইটনের [রিচার্ড এম. ইটন নামেই সমধিক পরিচিত]। ১৯৮৩ সালে অসীম রায় The Islamic Syncretistic Tradition in Bengal নামের থিসিস দিয়ে এই বিষয়ে পূর্বের সব গৎবাঁধা ধারণা যেমনমুসলিম শাসকেরা তরবারির জোরে এখানে ইসলাম প্রচার করেছেন বা ধর্মপ্রচারক সুফি-দরবেশদের দ্বারা অথবা ইসলামের সাম্যের ধারণায় আকৃষ্ট হয়ে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা দলে দলে ইসলাম কবুল করেছেন ইত্যাদিকে যুক্তি-তর্ক-তথ্য-তত্ত্ব দিয়ে ধূলিস্মাৎ করে দিয়ে নতুন নতুন কথা দিয়ে রীতিমতো সাড়া ফেলে দেন রায়। এর বছর দশেক পরে ১৯৯৩ সালে রিচার্ড এম. ইটন The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760 নামের আরেকটি থিসিস দিয়ে যাবতীয় আলো কেড়ে নেন। তিনি তার নতুন বইয়ে অবশ্য অসীম রায়ের জ্ঞানের সিলসিলা ধরেই এগিয়ে তাকে আরও বর্ধিত করেছেন নতুন নতুন তথ্য, তত্ত্ব, মানচিত্র আর পরিসংখ্যান দিয়ে। রায়ের গবেষণা যে গোড়াতেই ইটনের দৃষ্টি কেড়েছিল, তার চিহ্নও রয়ে যায় যখন দেখা যায় যে, ইটন ১৯৮৫ সালেই রায়ের বইটির একটি বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা লেখেন দি এশিয়ান স্টাডিজ জার্নাল এ [ভলিউম ৪৪, নং ২ (ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৫), পৃ. ৪৪২-৪৪৪]  প্রকাশিত। তাৎপর্য বিবেচনায় এর একটি অনুবাদ নিম্নে সংযোজিত হলো।

অনুবাদ: মিল্লাত হোসেন

 

বাংলা মোটামুটিভাবে একটা ইসলামিক ভাষা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জাতিগোষ্ঠী এই ভাষাতেই কথা বলে। আর এই ভাষার রয়েছে অন্তত পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রসারিত একটি সমৃদ্ধ ইসলামি সাহিত্যিক ঐতিহ্য। অসীম রায়ের এই বই প্রকাশের আগে মুসলিম বাংলা সাহিত্যের ওপর যতটুকু পাণ্ডিত্য প্রকাশিত, তা তুলনায় সামান্যই। অতীতে এই প্রবণতার অন্যতম কারণ ছিল বাঙালি মুসলিম অভিজাতেরা সাহিত্যিক অনুপ্রেরণার জন্য উর্দু ও ফার্সি ভাষার দিকেই তাকিয়ে থাকতেন। রায় লিখেছেন, বাংলার মুসলমানরা এ ক্ষেত্রে নিজেদের জন্য গড়া মিথেরই যৌক্তিক শিকার হয়েছিল। তাদের দাবি ছিলআসল না হলেও তারা এক ভিনদেশী সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী এবং বাদবাকিরা যেন তাদের সেভাবেই বিবেচনা করে [পৃ: ৬৫]। স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি হওয়ার পর অবশ্য এর সবই বদলে গেছে। ঢাকায় বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির প্রভাবে অনেক বাঙালিই আগ্রহ ভরে তাকিয়েছে তাদের মধ্যযুগীয় মুসলিম কবিদের সাহিত্য সৃষ্টির প্রতি, যা দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত হয়েই ছিল। এর ভেতর দিয়ে উত্থাপন করেছে প্রাক-আধুনিক বাংলার সাংস্কৃতিক বিবর্তনের প্রকৃতি সম্পর্কে নানান অনুসন্ধানমূলক প্রশ্ন।

রায়ের বই, যা এই প্রক্রিয়ারই অংশবিশেষ, তা মূলত ষোলো থেকে উনিশ শতকের মধ্যে রচিত পুঁথি নামে সমধিক পরিচিত অপ্রকাশিত সংখ্যাতীত মুসলিম বাংলা সাহিত্যকর্মের ওপর ভিত্তি করে রচিত। যেগুলোর বড় অংশই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। এই চর্চার একটি দ্বিমুখী লক্ষ দেখা যায়। প্রথমত এটা ব্যাখ্যা করতে চায় ঠিক কীভাবে এখানে একটা বিরাটসংখ্যক মুসলিম বিশ্বাসীর উদ্ভব ঘটে যারা ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বাধার কারণে মূল বিদেশি ইসলামি ঐতিহ্য থেকে বঞ্চিতই থেকে গেছে এবং দ্বিতীয়ত বিশ্লেষণ করতে চায় এই ধর্মীয় এবং আধা-ধর্মীয় সাহিত্যরাশি থেকে উদ্ভূত সমন্বয়বাদী ঐতিহ্যের ধরনধারণকে [পৃ. ৭]। বাংলায় ইসলামের অনুপ্রবেশ সম্পর্কে রায় একটি তিন ধাপ সংবলিত প্রক্রিয়ার পক্ষে যুক্তি দেন। সেটা হলোপ্রথমত এই অঞ্চলে এক নবউদ্ভিন্ন ইসলামি মহান ঐতিহ্যের অনুপ্রবেশ ঘটে যা হিন্দু মহীয়ানক্ষুদ্র ঐতিহ্যের মধ্যকার পরম্পরা চুরমার করে দিয়ে বিরাটসংখ্যক নিম্নবর্গের আধ্যাত্মিক না হলেও সামাজিক আনুগত্যের কেবলা বদলে দিতে সমর্থ হয়েছে। এটি মুসলিম ধর্মান্তরিত জনসাধারণের মধ্যে একটি সংকটের সৃষ্টি করেছিল, যারা এখন কেবল হিন্দু মহান ঐতিহ্য থেকেই নয় বরং অভিজাত বা আশরাফ মুসলিমদের ভাষাগত বর্ণবৈষম্য দ্বারা বিস্তৃত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অপরায়ন এর মাধ্যমে ইসলাম থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে [পৃ. ৭০]। এখানেই মঞ্চে আবির্ভূত হন রায় এর গবেষণার প্রধান কুশীলবমধ্যযুগের মুসলমান বাংলা সাহিত্যস্রষ্টাগণ। লেখকের যুক্তি হচ্ছেতাদের ব্রতই ছিল এই মানুষদের সাথে ইসলামের বোঝাপড়া ঘটিয়ে দেওয়া। আর তারা খুব সচেতনভাবে ইতিমধ্যে নানান দেবদেবীর আরাধনা, বৈষ্ণব ভক্তিবাদ আর তন্ত্রমন্ত্রের ঘেরাটোপে আবদ্ধ বাঙালি প্রতিবেশের মাঝে চারিয়ে দেন ইসলামি ইতিহাস, ঐতিহ্য, কিংবদন্তি, সৃষ্টিতত্ত্ব এবং অধ্যাত্মবাদের মতো ব্যাপারগুলোকে। এই বইটির প্রধান বিষয়বস্তু গঠিত হয়েছে এই সব সাহিত্যিকের দ্বারা সৃজিত সমন্বয়বাদী ঐতিহ্যগুলোকে নিয়ে। রায়ের পরিকল্পনার তৃতীয় পর্যায় অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া ও পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলনগুলো, যা এই সব ঐতিহ্যের ওপর জোরালো আক্রমণ শানায়, সেই বিষয়গুলো এই বইয়ের আওতার বাইরেই থেকে গেছে।

ধারণাগতভাবে, রায়ের সমন্বয়বাদ এর অধ্যয়ন ইসলাম এবং হিন্দুধর্ম উভয়কেই বাংলার পুরো মধ্যযুগীয় ইতিহাসজুড়েই প্রায় অপরিবর্তিত ছিল এবং যা তাদের আদর্শ অবস্থায় দুটি পৃথক, একেবারে বায়ুরোধী পাত্রের মতো ও সম্পূর্ণ স্বাধীন সত্তা হিসেবে কাজ করেএমনতর কিছু সুসংস্কৃত বিমূর্ততা হিসেবে দেখতে চায়। এইভাবে রায়ের মধ্যস্থতাকারীগণ তাদের উদ্দিষ্ট জনতার জন্য সমন্বয়বাদী তত্ত্বকথা নির্মাণের সময় বেশ সচেতন এবং ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রাগুক্ত উভয় পাত্র থেকে অক্লেশে ধারকর্জ করেছেন বলেই মনে হচ্ছে। সে যাই হোক, কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন এই বলে যে, এই মুখবন্ধ করা পাত্রগুলো আসলে কতটা সিল করা ছিল, বা আমরা আজ যেভাবে তাদের সম্পর্কে ভাবি, সেই সময়েও তারা সেভাবেই বিরাজমান ছিল কি না। জোসেফ ওকনেল মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব পদাবলীর অধ্যয়ন থেকে যুক্তিসঙ্গতভাবেই দেখিয়েছেন যে মধ্যযুগীয় বাংলায় হিন্দু শব্দটি কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়কে বোঝাত না, বরং আদিবাসী সমাজকেই বোঝাত, আদতে যা ভিনদেশীদের বিপ্রতীপ কিছুকেই বোঝাত [জার্নাল অব দ্য আমেরিকান ওরিয়েন্টাল সোসাইটি ৯৩, নং ৩:৩৪২]। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে মনে হবে রায় যেন তাঁর বিশ্লেষণে অদ্ভুতভাবে বিংশ শতাব্দীর বিভাগগুলো ব্যবহার করছেন।

বাংলায় দেবীর মহিমা প্রকাশের ব্যাপারগুলো বাংলা মঙ্গল-কাব্য সাহিত্যে যে রূপে পাওয়া যায়, রায়ের লেখায় হিন্দুধর্ম এবং ইসলাম-এর মতো বিচ্ছিন্ন এবং অপরিবর্তিত দুই মুখবন্ধ পাত্রের মধ্যে একটিকে খাঁটি বাঙালি মূল্যবোধ ও ধারণার একটি ডুবোচর হিসেবে টিকে থাকাটাকে সচেতনভাবে দেখাবার প্রয়াসটা সম্ভবত সেই রূপে প্রতিফলিত হয়নি। সমন্বয়বাদী তত্ত্বের ওপর রায়ের নির্ভরতাও তার সংস্কৃতি বিশ্লেষণের মহীয়ান ও ক্ষুদ্র ঐতিহ্য ধাঁচের ব্যবহার থেকে উৎসারিত, যে তত্ত্বের উপযোগিতা নিয়ে বিগত কয়েক দশক ধরেই পণ্ডিতেরা নানান গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তদুপরি, লেখককে একই সাথে দুটি মহীয়ান এবং দুটি ছোট ঐতিহ্যের সাথে মোকাবিলা করতে হওয়ায় এর গতিও অনেকটাই শ্লথ হয়ে পড়েছে। রায়ের অধ্যয়নের প্রধান কুশীলব কবিকুল, যারা প্রকৃতপক্ষে পঞ্চদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সুবিশাল সময়কাল ধরে বিস্তৃত ছিলেন এবং সময় ও স্থানের মধ্যে তাঁদের অবস্থানটি বেশ অস্পষ্ট হলেও সেটা এই ধারণা দেয় যেউনিশ শতকের সংস্কার আন্দোলনগুলোর আবির্ভাব পূর্ব পর্যন্ত তারা একটি একক, সমতল, অস্থায়ী ভূমি দখল করে রেখেছিলেন। আর রায়ের ঊনত্রিশ পৃষ্ঠাব্যাপী বিস্তৃত গ্রন্থপঞ্জি, যা একদিক থেকে বইটির অন্যতম প্রধান শক্তি, তাতেও কিছু ত্রুটি রয়েছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক উৎস, যার ওপর রায় ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছিলেন, সৈয়দ সুলতানের মহাকাব্য নবী-বংশ এর উল্লেখের ক্ষেত্রে লেখকের বেশ কিছু খণ্ডিত পাণ্ডুলিপি না বলে প্রকাশিত সংস্করণটির (২ খণ্ড, সম্পাদক আহমদ শরীফ, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৭৮) কথা উদ্ধৃত করা উচিত ছিল। আবার সেই পাণ্ডুলিপিগুলোর অবস্থানও আমাদের জানানো হয়নি। এ ছাড়া, গ্রন্থপঞ্জিতে লেখকদের পুরো নাম বাদ দিয়ে শুধু আদ্যাক্ষর দেওয়া হয়েছে (উদাহরণস্বরূপ, এম. এ. খান বা আর. আহমেদ কিংবা এম. ইসলাম), যা গ্রন্থপঞ্জিতে পণ্ডিতদের নামোল্লেখের সঠিক তরিকা নয়।

এই ত্রুটিগুলো সত্ত্বেও, বইটি এমন একটি ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখার জন্য দীর্ঘকাল ধরেই চর্চায় থাকবে যে বিষয়টি এখন পর্যন্ত দুঃখজনকভাবে অবহেলিত হয়েই আছে।