আহমদ রফিকের ‘একুশের দিনলিপি’
‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’—ভাষা আন্দোলনের সময় এই ‘ওরা’ কে ছিল, নিশ্চয় বলে দিতে হবে না। পাকিস্তান ভাগ না হইলে নিশ্চয় এত দিন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমাদের উর্দুতে অভ্যস্ত হতে বাধ্য করা হতো। এবং আমাদের এলিট সমাজ তা গ্রহণ তো করতই, নিজেদের ক্ষমতাবলে গ্রামে-গঞ্জের ভাষাকেও, যাকে আমরা বলছি আঞ্চলিক, তাকেও গলা টিপে ধরত। বাংলা ভাষার বৈচিত্র্যের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়তা যে নিশ্চিত রং হারাত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু বাঙালি যে সাহসী জাতি হিসেবে নিজেকে বিশ্বমঞ্চে চেনাল, এটার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তারা দিয়েছে ভাষা আন্দোলনে। মাতৃভাষার প্রশ্নে এভাবে একতাবদ্ধ হওয়া, পৃথিবীর ইতিহাসে তার নজির খুব হাতে গোনা। তার আগে কি বাঙালির বীরত্বের কোনো চিহ্ন নেই? এই প্রশ্ন আসতেই পারে। একটা জাতির বিশেষ পরিচয় তার ভাষা। মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া আর কোনো জাতির ভাগ্যে জোটেনি।
দেশভাগের আগ পর্যন্ত বাঙালির রাজনৈতিক জীবন কাটছে দোনোমনায়। অবশ্য ব্যতিক্রম যে ছিল না, তা নয়। কিন্তু নেতৃত্বের অভাব এবং ঐতিহাসিক কিছু প্রশ্নে এই দেশের জনগণ কখনো একতাবদ্ধ হতে পারেনি। অর্থাৎ, বায়ান্নর আগ পর্যন্ত। এমনকি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই আন্দোলনের পরও ভাষা প্রশ্নে বিভাজন যে রয়েছে, তা এই নতুন শতাব্দীতে আরও বেশি ঠাহর করা যাচ্ছে। অথচ, বায়ান্ন এমন এক প্রয়োজনীতা ছিল, যা না হলে বাংলাদেশ নামের অস্তিত্ব তৈরি হতো কি না সন্দেহ।
এখন এক ‘ওরা’কে আমরা গ্রহণ করিনি, তাড়িয়েছি—সেই চেতনার বয়ে নিয়ে যাচ্ছি ঠিক; শ্রদ্ধায় হোক বা দায়িত্বের খাতিরে। কিন্তু আরও অনেক ‘ওরা’ যে বাংলা ভাষার দিকে অস্ত্র তাক করে নেই, এ কথা তো বলা যায় না। ভাষা এগোয় গ্রহণ-বর্জনের ভেতর দিয়ে। ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পরে এসে বলা যাক তো, শিক্ষা থেকে জনজীবনের সমস্ত কর্মক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি? কেন পারিনি? তাহলে ভাষা আন্দোলন কি কেবল ঐতিহাসিক এক সত্য ছাড়া আর কিছুই নয়?
পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের হিন্দি ও ইংরেজির আধিপত্যের চাপ সহ্য করতে হচ্ছে। তেমনি ভারতের আরও যেসব অঞ্চলে বাংলাভাষী রয়েছে এবং অন্যান্য প্রদেশের ভাষাকেও একই রকম পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। একটা জাতির মুখের ভাষাকে যখন কেড়ে নেওয়া হয়, তখন সে কেবল অনাথই নয়, আত্মপরিচয়হীনও হয়ে পড়ে। উর্দু দিয়ে পাকিস্তান সে কাজটাই করতে চেয়েছিল বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে।
যে জনজোয়ার বায়ান্নয় দেখা গেল তা একাত্তরের বীজ। সেই বীজই ক্রমে চারা থেকে পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষে রূপান্তর হয়ে এনে দিল রক্তে রাঙা স্বাধীনতা। কিন্তু শহীদ দিবস যেন এখন স্রেফ এক উদযাপনমুখরতায় রূপ নিয়েছে। ২১শে ফেব্রুয়ারির ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ যেন দিবসভিত্তিক চেতনায় পর্যবসিত হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও বাংলা ভাষা নিয়ে যে বৃহত্তর কাজ হওয়ার দরকার ছিল, তেমন উল্লেখযোগ্য কাজ আজও হয়নি।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও প্রাবন্ধিক আহমদ রফিকের ‘একুশের দিনলিপি’ পড়তে গিয়ে বারবার এসব চিন্তায় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। বইটি হাতে এসেছে বেশি দিন হয়নি। নামে দিনলিপি থাকলেও ডায়েরির মতো করে ঘটনার বিবরণ দেননি তিনি। ভাষা আন্দোলনের একেবারে প্রাক-সময় থেকে বাংলার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি পাওয়ার মতো ঘটনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্যনির্ভর বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধের সংকলন এটি। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন আহমদ রফিক। খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন সেই সময়কার ঘটনা। ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষী বলা যায় তাঁকে। যার ফলে একেবারে চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা যেমন তাঁর রয়েছে, তেমনি বায়ান্নতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনারও ভিন্ন আঙ্গিকের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
তৎকালীন দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে— বাংলা নাকি উর্দু; এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারেও এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক বৈপরীত্য ছিল। বিশেষ করে বাংলার বুদ্ধিজীবী মহলে। সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বাংলা এগিয়ে থাকলেও শাসকের ভূমিকায় থাকা পাকিস্তানের যে অন্যায় দাবি, তা মেনে নিতেও এখানকার অনেকের সমস্যা ছিল না। তবে ‘পূর্ব-পাকিস্তানের’ অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিকেও দেখা গেছে উর্দুর পক্ষে কথা বলতে।
আহমদ রফিকের ভাষায়, ‘বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা নিয়ে সমস্যা খুবই জটিল এক বিষয়। কারো মতে দুর্বোধ্য কারণে তাদের এই বিপরীতযাত্রা যা বাঙালি হিন্দুর সঙ্গে মানসিক-সাংস্কৃতিক দূরত্ব তৈরি করেছিল।’
একুশের দিনলিপি’র প্রথম প্রবন্ধ ‘দিনলিপির পূর্বপাঠ’ থেকে তখনকার ভাষা প্রশ্নে এই দেশের এলিট সমাজের সমস্যার আরেকটু উদ্ধৃতি দেওয়া যাক, ‘যত সমস্যা শিক্ষিত শ্রেণীকে নিয়ে। তাদের মধ্যে নানা স্বার্থের জোয়ার ভাটার টান। সেখানে খেলা করে বিশ্বাসের নানা ঢেউ। মাতৃভাষা নিয়ে শিক্ষিত শ্রেণীর মানসিক দ্বন্দ্বে জ্বালানি যোগ করেছে স্বাতন্ত্র্যবাদী ও সম্প্রদায়বাদী রাজনীতি…।’
বাঙালি মুসলমান স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করেও নিজেদের এই সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। সাংস্কৃতিকভাবে নিজেদের ঐতিহ্যকে ভুলে তারা এখন কিছুটা ভারতীয় এবং কিছুটা আরবীয় কায়দায় চলতে পারার মধ্য দিয়ে নিজেদের খুঁজে ফেরে। শিক্ষায় হোক বা অফিস আদালতে, ইংরেজির আধিপত্যে বাংলা দ্বিতীয় ভাষা হয়ে আছে। এই ইতিহাসবিমুখতা দিয়ে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারেনি। এর দায় অসচেতন জনগণের ওপর যতটুকু বর্তায়, তার চেয়ে ঢের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা কর্তাদের।
একুশের দিনলিপি বইটিতে নিজ সন্তানের হাতে মাতৃভাষা বাংলার দূষিত ও শোষিত হওয়ার খেদ ঝরেছে আহমদ রফিকের কলমে। উল্লেখ করা যাক এই বইয়ের শেষ প্রবন্ধ ‘শহীদ দিবসের স্বীকৃতি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ থেকে। বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি এনে দেওয়ার জন্য দুজন প্রবাসী বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালামকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। এই দুই মহৎ ব্যক্তি না হলে হয়তো বিশ্ববাসী জানত না, বাংলাদেশ নামক এক দেশের মানুষ মাতৃভাষা রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছে। বিশ্বে এই ঘটনা যে অদ্বিতীয়! জাতিসংঘের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্বীকৃতিদানের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। পরে ইউনেসকোর অধিবেশনে প্রস্তাব পেশের সময় বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের জটিলতায় পড়তে হয় তাঁদের। এ ঘটনার বিস্তারিত পাঠের জন্য বইটি পড়ার আহ্বান থাকল পাঠকদের কাছে।
বায়ান্নর আন্দোলনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছেন আহমদ রফিক। ঢাকা শহরের মধ্যে ভাষার জন্য যে আন্দোলন, তা কেমন ছাপ ফেলেছিল জেলা শহর ও গ্রামে, সে বিষয়েও বিস্তারিত জানিয়েছেন তিনি। শহীদ দিবস নিয়ে এই দেশের শাসকদের অপরাজনীতির বিষয় নিয়েও কথা বলেছেন। স্বাধীনতার পর স্বৈরশাসকদের সময়ে বায়ান্নর চেতনাকে কলুষিত করা হয়েছিল। তখনো অনেক বুদ্ধিজীবী তা দেখে এড়িয়ে গেছেন। এসবের বিস্তারিত না জানালেও এই বইয়ের বিভিন্ন প্রবন্ধে তার কিছু কিছু বয়ান করেছেন আহমদ রফিক। বলতেই হচ্ছে, ভাষা আন্দোলন নিয়ে আগ্রহীদের মোক্ষম সূত্র হতে পারে একুশের দিনলিপি।
যে জাতির ইতিহাস হারিয়ে গেছে, সে জাতি অনাথ। শাসকপক্ষ সব সময় চেয়েছে এই দেশের মানুষের ইতিহাস মুছে দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা অটুট রাখতে। এখনো তাই হচ্ছে। যার ফলে আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে গড়ে উঠেছে ইতিহাসবিমুখতা। ভাষা আন্দোলন বলতে আমরা কেবল জানি, বায়ান্নয় বাংলা ভাষার দাবিতে সালাম, রফিক, জব্বার শহীদ হয়েছেন। কিন্তু কীভাবে এই আন্দোলন দানা বাঁধল, পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের সময়েও কীভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হলো, তা জানি না। সে ক্ষেত্রে আহমদ রফিক যেন ইতিহাসের দায়বদ্ধতা থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন বায়ান্নর সময়কার দিনগুলো। তরুণ প্রজন্ম তো বটেই, আগামী প্রজন্মকেও ইতিহাসে উৎসাহিত করতে বায়ান্ন সম্পর্কে জানা প্রয়োজন, আর এ ক্ষেত্রে একুশের দিনলিপি বইটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।