শীৎকার
এক
প্রেম অন্ধকার। নিকষ কালো। ঘুটঘুটে অন্ধ-কেবল অন্ধত্ব। বস্তুত কলাকৈবল্যবাদীদের আনুকূল্যে প্রেম নামক শব্দটি বেঁচে আছে। প্রেম পুঁজিবাদে হাস্যকর অভিধায় চিহ্নিত। ফলত কলাবাণিজ্যে প্রেম অনিবার্যতা নিয়ে প্রবল প্রতাপ। যদিচ নারী-পুরুষভেদে প্রেম সর্বজনীন মানবসভ্যতার অনুষঙ্গ। পুঁজি প্রতাপে সংকীর্ণ সংজ্ঞায় চিহ্নিত বিশ্বব্যাপী।
দুই
মিলন যদি দুটি বস্তুর ঘটে, তবে দুদিকেই সমক্রিয়া চলমান। বিচিত্র বঙ্গে কেবল নয়, গ্লোবাল জুড়েই পুরুষ নামক উদ্যত অহংকারটি মিলনে অধিকতর সক্রিয়। এটি অত্যন্ত অশ্লীল ভেবে তপন চক্রবর্তী বিষয়টি নিয়ে বেশি দূর যেতে পারেনি। সে অনিবার্যতায় তপন চক্রবর্তীর নারী সঙ্গম কড়ে আঙুলের প্রথমটাতেই পড়ে থাকে। বিষয়টি নিয়ে ভাবতেই তার মধ্যচিত্ত মন ও মনন বিবিধ জৈব রাসায়নিক সূত্রে নিস্পৃহ করে তোলে। তপন মনে মনে একটা চিত্রনাট্য নির্মাণ করে রাখে। তার নারীকে প্রথমেই সম্মান জানাবে পদধূলি নিয়ে, তারপর দুজন দুজনকে প্রগাঢ় চুম্বনে সঙ্গমে যাবে। এমতাবস্থায় তপন সর্বদা কল্পলোকের বাসিন্দা হয়েও ভাবে, এটাই পৌরুষিত আচরণ। এর আগে-পরে কোনো সত্য-মিথ্যা নেই। সামান্যতম অনীহা অথবা কলার অংশ হিসেবে তার কাঙ্ক্ষিত নারী যদি না করে বসে, অনীহা দেখায় বিন্দুমাত্র তপন কখনোই জোর করবে না। চক্রবর্তী সর্বদা নারীকে অ্যাকটিভ দেখতে চায়। বলা বাহুল্য, স্বীয় অক্ষমদার বিপরীতে নারীকে চায় প্রবল সক্রিয়তায়। চিত্রনাট্য হিসেবে এটিকেই ধ্রুবজ্ঞানে তপন নারীদেহ মাগজিক বিক্রিয়ায় একটা ঘোরে থাকে।
তিন
তপন চক্রবর্তীর যাপন নারীসঙ্গমহীন। অথচ নপুংসক নয়। প্রাযুক্তিক গড্ডল থেকে দূরে থাকা তপন একধরনের আত্মগর্বে ঢেকুর তোলে—এই জনপদে থিকথিক করা পোকার মতো নয় সে। নিজেকে উত্তম মানুষ এবং সভ্যতার পুরুষ হিসেবে কতিপয় ডগমেটিকতায় ভাসে। কিছুটা আত্মরতিও বটে। যদিচ কোনো ধর্মে তার আস্থা নেই, তবু পবিত্রতা মানে নিষ্কলুষতা মানে একধরনের কৌমার্য অহং তাকে চালিত করে। অন্তর্মুখীনতার যাপনকাল দুর্বিষহ ঠেকলে, মাঝে মাঝেই নারীর সৌন্দর্য মুগ্ধতার প্রকাশভঙ্গি বড়ই হাস্যকর ঠেকে, বিচিত্র বঙ্গের নারীকুলের নিকট ফলত মন গুরুত্বহীন সত্তায় পরিণত তার নিউরনে।
এরপরেও পৃথিবীতে মাঝে মাঝে বিচিত্র অভিযোজন ঘটে। সেমত এক দৃশ্যে লুবু নামক সন্তানহীন নারীর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব জমে ওঠে। আসলে জমে ওঠে না। দৃশ্যত জমে ওঠে বন্ধুত্ব অদৃশ্যে থাকে লুবুর অপ্রাপ্তি বিতৃষ্ণ জীবনের গল্প। গল্পগুলোর উপসংহারে তপনের করুণা-সহমর্মিতা তাদেরকে কাছে টানে। বিদ্রোহের উসকানিতে তপন সেরা কাঁচামাল।
সেই অনিবার্যতায় লুবু তপনের বাসায় আসে। হাত ধরা ও চুমুতে সীমাবদ্ধ প্রথম দিনের দৃশ্যটি হাস্যকর। দুপুরে কিছু না খাইয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটি নারীর সঙ্গে শুধু গল্প করলে যে ক্ষুধা নিবারিত হয় না—এই সাধারণ জ্ঞানের ধারেকাছেও তপন ছিল না। শুধু শেষ বিকেলের রোদে লুবুকে রিকশায় উঠিয়ে দিতে গিয়ে একটি শ্লেষযুক্ত কাঠ হাসির বিনিময়ে দাঁত কেলিয়ে তপন বলে—বাই। মাস দুয়েক পর পুনরায় লুবু তপনের খালি বাসায়। বন্ধুত্বের অধিকারে কিংবা সহমর্মিতার অধিকারে তপন লুবুকে প্ররোচিত করে।
এবারও প্রায় একই রকম চিত্রনাট্য। কেবল যোগ হয়েছে মধ্যাহ্ন আহারের প্যাকেট। সংলাপ পুরাতন। প্রথমবারের দীক্ষা তপনের এমত—লুবু রাজি ছিল। মুখে অনুচ্চস্বরে নিষেধ করলেও। আসলে তাকে জড়িয়ে ঠোঁটে একটা গভীর চুমু দিলেই সাড়া মিলত এবং তাদের কাঙ্ক্ষিত মিলন ঘটত। আফসোসের শেষ সীমায় গিয়ে তপন দ্বিতীয়বার প্রস্তুতি নেয়। আর দ্বিতীয় পর্বে লুবু যথারীতি অনীহা এবং না না শব্দে তাকে বাধা দিলে তপনের বোধোদয় ঘটে—কোথাও তার অসম্পূর্ণতা কিংবা আচরণগত সমস্যা বর্তমান। ফলে এবারও মৃদু হাস্যে বাই বলে লুবুকে রিকশায় তুলে দেয়।
দ্বিতীয়বারের ব্যর্থতা তপনের পৌরুষত্বকে আঘাত করে। বিচিত্র বঙ্গে নারীকুল মূলত মর্ষকামী বলে এখানে পুরুষই উৎকট অ্যাকটিভ। শতকরা নব্বই জনই বিয়ের প্রথম রাতে স্ত্রীকে ধর্ষণ করে। তারা ভাবে, নারীটি তার নিজস্ব। সুতরাং মালিকের ইচ্ছাই প্রধান। তপন কখনো এটা করবে না। তপন ভাবে তবে বন্ধুত্ব কোথায়? যত না তার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, তারও অধিক প্রতি নারীর ক্রিয়াশীল বাসনা। এ ক্ষেত্রে চক্রবর্তী নিজেকে ভাবে, লুবু নিজেই টেনে নেবে তার বুকে। এই ভাবনার মূলে তাদের তিন বছরের কথোপকথনসহ নানাবিধ আচরণ; যার পুরোটাই ভার্চ্যুয়াল জগৎকেন্দ্রিক।
নিরিবিলি একলা ঘরে পাশাপাশি শুয়ে-বসে নারীটির সঙ্গে চূড়ান্ত মিলন হলো না—বিষয়টি বেদম হাস্যকর। যেহেতু দুজনের কাঙ্ক্ষা ছিল মিলনের। নইলে লুবুকে প্ররোচিত করে অবসর সময় তার বাসায় আসতে বলত না এবং লুবুও খামোখা এই পরিবেশে কখনোই আসত না। দ্বিতীয়বারের ব্যর্থতায়ও তপন ভেঙে পড়েনি। পুনরায় সে লুবুকে প্ররোচিত করে শেষবারের মতো আসতে এবং নিজেই প্রবল মানসিক প্রস্তুতি নেয় চূড়ান্ত মিলনের। লুবু দোদুল্যমান। তপন অনড়। প্ররোচনার সংলাপ কাব্যিক। যৌক্তিক এবং ইহজাগতিক। লুবু শেষ পর্যন্ত শেষবার দেখা করার শর্তে তৃতীয়বার তপন চক্রবর্তীর ব্যাচেলর বাসায় হাজির।
চার
অক্টোবরের বাদলবিঘ্নিত এক দুপুর। তপন চক্রবর্তীর বাসায় লাল টিপের শাদা শাড়ি পরিহিত বিচিত্র বঙ্গের মনীষা কৈরালা। লুবুর শ্বেত সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে তার চোখে-মুখে স্পষ্টতই আনন্দের ঝিলিক। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে লুবু তার মসৃণ গ্রীবায় একধরনের মাদকতায় আচ্ছন্ন করে—দেহ থেকে কল্পনাতীত ঘ্রাণে মাতাল তপন চক্রবর্তী। দরোজা বন্ধ করেই তপন লুবুকে দুহাতে জড়িয়ে শূন্যে তুলে হাঁটতে থাকে তার কক্ষের দিকে। তার প্রতিটি পদক্ষেপ আচরণ প্রকৃত পুরুষের দৃপ্ততায় ক্ষিপ্র এক ছন্দ আনে। তপন স্বয়ং বিস্মিত। লুবুও এই সাহসে ততধিক বিস্মিত। এবারও লুবুকে যথেষ্ট ইতিবাচক মনে হয়। লুবুর আচরণ এবারও নৈব নৈবচ। কিন্তু তপনের এবারের প্রতিজ্ঞা কঠিন। ফলে কোলে তুলে নিয়ে যাবতীয় প্রাথমিক ক্রিয়াতে তৎপর চঞ্চল তপন প্রবল স্পৃহায় চুমুতে ভরিয়ে তোলে। নিরাভরণ করার পূর্বে সফেদ নাভিমূলে মৃদু দংশন আর স্তনের বোঁটায় তার নখের আঁচড় চলমান। চিত হয়ে শুয়ে থাকা লুবুকে উত্তেজিত করার সমস্ত প্রাক্কর্ম চলমান অবস্থায় যখন চূড়ান্ত মুহূর্তের আকাঙ্ক্ষিত মিলনে তপন কেবল লুবুর সালোয়ারের ফিতা খুলে ফেলে এবং যখন নিজের ট্রাউজার খুলে একটি চূড়ান্ত যৌনতার দিকে এগিয়ে যাবে এবং মাত্র যখন লুবুর ঊর্ধ্বাঙ্গ নিরাভরণ দুটি স্তনে তির তির এবং একটি কামকলা ভঙ্গিতে উদ্গ্রীব লুবু সেই...হঠাৎ মেয়েটি চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল বিব্রত তপন একঝটকায় দূরে সরে যায়। ভয়ংকর আতঙ্কে অস্থির তপন তখন কান্নারতা লুবুকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে অসহায় ভঙ্গিতে বারবার সান্ত্বনা দিতে থাকে, কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করতে থাকে। ততক্ষণে শ্রান্ত, ক্লান্ত লুবু তাকে ঠেলে বাথরুমে ঢুকে পড়ে।
গলটি একটা নতুন ধারায় সন্দেহ নেই। আখ্যানের বাতুলতা নেই। তবে এ গল্পে ভিন্নজগতের একটা দারুন ইঙ্গিত দিয়েও, কোথায় যেন শিৎকারেরই অনুপস্থিতি।
শাখাওয়াত বকুল
জুলাই ০৪, ২০২১ ২৩:৪১