চিনির স্যুটকেস

 

আপনাদের স্যুটকেসের যদি কিছু ডিটেল দিতেন, স্যার। মানে কোন ফ্লাইট থেকে মিসিং হলো, স্যুটকেসের রং, হার্ড না সফট বডি, কী ছিল ভিতরে ইত্যাদি। আমরা তো লন্ডন থেকে এসেছি, বি এ 201 এ, যেটা ১১:৩০ এ ল্যান্ড করল, স্যুটকেসটা লাগেজে দেওয়া হয়েছিল। সব মিলিয়ে তিনটা স্যুটকেস ছিল আমাদের, দুটা আসলো, একটা মিসিং। যেটা পাচ্ছি না সেটা আসলে একটা ছোট স্যুটকেস হ্যান্ড লাগেজ হিসেবে আনলেই হতো, তাহলে আর এই ঝক্কি পোহাতে হতো না। এখন বেকার একটা ভ্যাজাল হলো, এত লম্বা জার্নি করে এসব এখন ভালো লাগে না, প্রায় দুই ঘণ্টা হতে চলল প্লেন থেকে নেমেছি।

তা ঠিক স্যার, আমরা খুবই দুঃখিত। লাগেজ হারালে কিছুটা ঝামেলা হয়। ওই যে দেখছেন লোকগুলো ওখানে দাঁড়ানো, ওনারা আজ ভোরে কাতার থেকে এসেছেন। ওনারা ঢাকায় থাকেন না, বাড়ি যাবেন কিন্তু একজনের লাগেজ মিসিং। সকাল থেকে অপেক্ষা করতেছেন এখানে। ওনাদের লাগেজ বিকালের ফ্লাইটে কাতার থেকে আসতেছে, না আসা পর্যন্ত ওনাদের এখানেই বসে থাকতে হবে। স্যার তো আশা করি ঢাকার বাসিন্দা, ইনশাল্লাহ ঝামেলা কম হবেহে, হে, হে। ইয়ে স্যার, স্যুটকেসের রংটা আর কী ছিল যদি একটু বলতেন।

ও আচ্ছা, হ্যাঁ, সরি, কালারটা যেন কী ছিলো শিল্পী, আমার তো আবার রং মনে থাকে না। স্যুটকেসটা ছিলো কমলা রঙের, বডিটা খুব শক্ত, প্লাস্টিক টাইপ, এখনকার নতুন স্যুটকেসের মতো লাইট না। শিল্পীর উত্তরে আশ্বস্ত হই। সত্যি কথা বলতে কি, এই জার্নিতে আমার তেমন কোনো ভূমিকা নাই। দেশে আসার প্ল্যান করা, কয়দিন থাকবো, টিকিট করা, আত্মীয়স্বজনের জন্য গিফট কেনা, স্যুটকেস গোছানোসবই শিল্পী করেছিল। আমি শুধু শেষের দিকের কিছু টিপিকাল পুরুষের কাজপাসপোর্ট, টিকিট গুছানো, লাগেজ ওজন করা, ট্রলি ঠেলাএইসবের মধ্যেই নিজের দায়িত্ব সীমিত রেখেছিলাম। তবু এয়ারপোর্টের লস্ট এন্ড ফাউন্ড ডিপার্টমেন্টের এই তরুণ অফিসার আমাকে পরিবারের একমাত্র পুরুষ পেয়ে সব প্রশ্ন আমাকেই করছেন। উনি ধরেই নিয়েছেন, আমি সব জানি, আমার পরিবারের সব স্যুটকেসের অধিকারী আমি।

থ্যাংক ইউ ম্যাডাম, খুবই ক্লিয়ার ইনফরমেশন। আমি ইনপুট দিচ্ছিঅরেঞ্জ, হার্ড বডি, কেবিন সাইজ। দুই-একটা জিনিসের কথা যদি বলতে পারেন, আসলে একই রকম অনেক স্যুটকেস থাকে তো। আমি অসহায় মুখে শিল্পীর দিকে তাকাই। স্যুটকেসের ডেসক্রিপশন যা-ও বা দিতে পারতাম, ভিতরে কী ছিল সেই বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই নাই। শিল্পীরও কি মনে আছে কোন স্যুটকেসে কী রেখেছিলো?

ছোট স্যুটকেস তো, তেমন কিছু ছিলো না। আমাদের মেয়ের কিছু ক্যাজুয়াল জামাকাপড় ছিলো, ও সাধারণত এই স্যুটকেসটা ব্যবহার করে, আর, ও হ্যাঁ, ওতে দুই প্যাকেট কোকোনাট সুগার ছিলো, এটা মনে আছে। শিল্পীর কথায় আমি আর অফিসার দুজনেই অবাক। কোকোনাট সুগার আবার কী জিনিস। আমরা এই জিনিস দেশে আনছিলামই বা কেনো? অফিসার ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কোকোনাট সুগার? মানে নারিকেল থেকে যে চিনি হয় শুনি নাই তো কোনো দিন। ওনার সাথে আমিও যোগ করলাম, তাই তো কোকোনাট সুগার আবার কী জিনিস? কার জন্য নিয়েছো? এগুলো কি নতুন লাইফস্টাইল চয়েসের খাবার নাকি? শিল্পীর মুখ দেখেই বুঝলাম, আমাদের কথার উত্তর সে এখন দিবে না, তাই আমি চুপ হয়ে গেলাম। ওর কাছে থেকে ছোট উত্তর এলো, কোকোনাট সুগারই, আপনি ডেসক্রিপশন এ অ্যাড করতে পারেন। ঠিক আছে ম্যাডাম। স্যার, একটা ফোন নাম্বার যদি দিতেন, স্যুটকেস ট্রেস করে ফোন করবো আপনাদের। এমন ফ্যাসাদে আমার মনে হয় অনেক দিন পড়ি নাই। পুরুষ হিসেবে দিনক্ষণ, জন্মতারিখ, বিবাহবার্ষিকী, ফোন নম্বর মনে না রাখাটা আমার লিঙ্গগত অধিকার। তার ওপর আমার এখনো দেশের মোবাইল সিম কেনা হয় নাই। কার নম্বর দেই? শিল্পী আবার এগিয়ে এসে একটা নম্বর দিলো, নাম দিলো তার বড় বোনের, যার বাসায় আমরা এখন যাচ্ছি।

অফিসার ভদ্রলোক কম্পিউটারের বাটন অনেকক্ষণ ধরে খটখট করে টিপলেন। তারপর ঘড়ঘড় শব্দ করা একটা প্রিন্টার দিয়ে কী যেন প্রিন্ট করলেন, এবং অবশেষে বললেন, স্যার আপনাদের লাগেজ হারানোর কমপ্লেইন করা হয়ে গেছে। প্লিজ, এই ফরমটা যত্ন করে রেখে দিবেন, এখানে আপনাদের কমপ্লেইন নম্বর আছে। আপনাদের লাগেজ কালেক্ট করতে এই নম্বর আর পাসপোর্ট লাগবে। স্যার, কোনো চিন্তা করবেন না। আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে ফোন করে আমরা জানিয়ে দিবো স্যুটকেসের স্টেটাস। ইনশাল্লাহ স্যার, যত মুসিবত তত আসান। আমাদের এখানে লাগেজ হারায় যেমন বেশি, পাওয়াও যায় তাড়াতাড়ি। এই যে স্যার আপনার বাঁয়ে তালা মারা রুমটা দেখেন, এটা আমাদের লাগেজ রাখার রুম। হাজার হাজার লস্ট এন্ড ফাউন্ড লাগেজ এখানে জমা আছে। আমরা এদের বলি বেওয়ারিশ লাগেজ, এগুলা তিন মাসের মধ্যে কেউ নিতে আসে নাই। আমরা চাইলে এগুলা খুলে দেখতে পারি, কিন্তু দেখি না। বেওয়ারিশ লাগেজ, স্যার, বেওয়ারিশ লাশের মতো, ধরতে ভয় লাগে। হে, হে, কিন্তু আপনাদের স্যুটকেসের ভাগ্য এমন হবে না। আমার ফোন করতেই আপনারা চলে আসবেন, ম্যাডামের কোকোনাট সুগার লাগবে তো। অফিসারের কথায় কিছুটা অবাক হলাম। বিদেশ থেকে আসা লাগেজভেতরে কত জিনিস, কত স্বপ্ন, কত ভালোবাসা, কত লম্বা লিস্টের সমীকরণ। সেই লাগেজ খুঁজে পাওয়ার পর মানুষ নিতে আসবে না কেন? নাকি বিমান কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো যোগাযোগ করে না? এইসব প্রশ্ন আর করলাম না।

স্যুটকেস হারানোর ব্যাপারটা আমাদের যাত্রার কিছুটা ছন্দপতন ঘটালেও এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আত্মীয়স্বজনের পেয়ে, ঢাকার রাস্তার যেমন খুশি তেমন চলোর চক্করে, আর ক্ষুধা-ক্লান্তির চাপে এ নিয়ে আর বিশেষ কথা বলতে বা চিন্তা করতে ইচ্ছা করছিলো না। এসেছি পনেরো দিনের ছুটিতে, এখন স্যুটকেস যদি বেশি দেরি করে আসে, তাহলে হয়তো যাওয়ারই সময় হয়ে যাবে। আর ঢাকার জ্যাম ঠেলে কে আবার এয়ারপোর্টে আসবে এই জিনিস কালেক্ট করতে? ওই স্যুটকেসটাই যা দামিস্যামসোনাইট কোম্পানির, ভেতরের জিনিস তো আহামরি কিছু না। আমি ব্যাপারটা সংসারের আর দশটা আটপৌরে বিষয়ের মতো শিল্পীর ওপরই ছেড়ে দিবো। আমার বহু কাজ আছে ঢাকায়।

ঢাকার পৌঁছানোর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সত্যি সত্যি এয়ারপোর্ট থেকে ফোন এসেছে। স্যুটকেসের সন্ধান হয়েছে। স্যুটকেস ভুল করে লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্টেই রয়ে গেছে, বিমানে তোলা হয় নাই। স্যুটকেস আসবে লন্ডন-ঢাকার পরের ফ্লাইটে, মঙ্গলবারে। মঙ্গলবার আমার পক্ষে এয়ারপোর্ট যাওয়া সম্ভব হবে না; কারণ, আমি ওই দিন ভোরে আমার গ্রামের বাড়ি যাবো। এগুলো আগে থেকে প্ল্যান করা, এখন আর বদলানো যাবে না। শিল্পী সেটা জানে। আর ওর নিজেরও কত প্ল্যান আছে, কে আনতে যাবে স্যুটকেস? এয়ারপোর্ট নাকি করোনার কারণে লাগেজ হোম ডেলিভারি দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, সেই সার্ভিস এখনো চালু হয় নাই। কী যে একটা ঝামেলা, অফিসার তো বলেই দিয়েছিলো পাসপোর্ট নিয়ে আমাদের যেতে হবে, অন্য কেউ গেলে হবে না। দেখি শিল্পীকে জিজ্ঞেস করে ওর কী প্ল্যান। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যুটকেসটা কীভাবে কালেক্ট করবো আমরা কিছু ভেবেছো? আমি তো থাকবো না মঙ্গলবার।

স্যুটকেস আনতে আমি যাবো। আনতেই হবে। শিল্পীর এমন একরোখা শীতল উত্তর শুনে আমি একটু বিরক্ত হলাম। মনে হচ্ছে স্যুটকেসটা তার একার সম্পদ, আর তার ভেতরে কোহিনুর আছে। আমি বিরক্তি চেপেই বললাম, মঙ্গলবার না তুমি তোমার ফ্রেন্ডদের সাথে সারা দিনের জন্য ঢাকার কাছে কোন রিসোর্টে যাবে। ওরা না ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে? শিল্পী ঠান্ডা গলায় বললো বুধবার ভোরে নিয়ে আসবো স্যুটকেস। মঙ্গলবার হবে না। ওহ হো, তাই তো। অফিসার তো আমাদের বলেছিলেন যে তিন মাসের মধ্যে লাগেজ নেয়া যায়, আমি কেন যেন বোকার মতো মঙ্গলবার মঙ্গলবার ভাবছিলাম। আমি শিল্পীর হাত আলতো করে ধরে বললাম, জানি না আমি কেন তোমার মতো তাড়াতাড়ি চিন্তা করতে পারি না। তুমি ছাড়া আমার পক্ষে চলাই দায়। শেষের কথাটা যে সম্পূর্ণ সত্যি না সেটা আমরা দুজনেই জানি। শিল্পী আর আমি বহু পথ একাই পার হয়েছি, আর এখনো আমাদের দুজনের দেহ আর মনের পথ অনেক সময় ভিন্ন ভিন্ন পথে চলে। তবে কিছু ছকে বাঁধা ভাষা মাঝে মাঝে ব্যবহার করতে মন্দ লাগে না।

মঙ্গলবার ভোরে আমি দেশের বাড়ির উদ্দেশে রওনা করলাম, ফিরবো শুক্রবার। শিল্পী বুধবার সকালে স্যুটকেস নিয়ে আসবে। আশ্চর্য হলো হারানো স্যুটকেস পাওয়ার কথা ভাবতেই এখন একটা ছেলেমানুষি শিহরণ জাগছে। হারানো স্যুটকেস ফেরত পেলে কি তাকে অচেনা লাগে? হারানো স্যুটকেস থেকে কি প্রেম হয় যেমনটা দেখেছি সত্যজিতের মুভিতে, অবশ্য ওটা তো হারানো না, বদল। স্যুটকেসের ভিতরের সবকিছু কি ঠিকঠাক থাকবে? অনেক সময় তো শুনি মূল্যবান কিছু থাকলে নাকি তা গায়েব হয়ে যায়। এখন মনে হচ্ছে মূল্যবান কিছু থাকলে ভালো হতো, বেশ একটা টেনশন করা যেত।

বুধবার দুপুর পর্যন্ত শিল্পী যখন ফোন করলো না তখন নিজেই ফোন করলাম ওকে, স্যুটকেসের খবর নিতে। শিল্পী, স্যুটকেসটা কি পেয়েছো? সকালে তো আনার কথা ছিলো। তুমি তো কিছু জানালে না। ব্যস্ত ছিলে হয়তো। স্যুটকেস আর লাগবে না। ওটা আনতে আমি যাবো না। শিল্পীর কথার মাথা-মুন্ডু কিছুই বুঝলাম না আমি। এইসব হেঁয়ালি উত্তর আমার মোটেও ভালো লাগে না। আমিও একটু কঠিন হয়েই বললাম, যদি খুব কষ্ট না হয়, তাহলে কারণটা একটু খুলে বলবে? তুমি তো গতকাল পর্যন্ত ডিটারমাইন্ড ছিলে।

স্যুটকেসের ভেতরের দুই প্যাকেট কোকোনাট সুগার আমার ছোটবেলার ফ্রেন্ড রুবির জন্য ছিলো। রুবির মা এক বছর ধরে মাউথ ক্যানসারে আক্রান্ত। ওর বড় ভাই কানাডা থেকে কোকোনাট সুগার এনে দিয়েছিলেন তাই দিয়ে ওরা খালাম্মাকে সুজি, সেমাই রান্না করে দিতেন। ওনার শাদা চিনি খাওয়া নিষেধ, আর মিষ্টি ওনার খুব প্রিয়। দেশে আসার কিছু দিন আগে রুবি আমাকে ফেসবুকে জিজ্ঞেস করেছিল আমি কোকোনাট সুগার চিনি কি না, ওর মায়ের জন্য আনতে পারবো কি না। আমি আমাজনের এক ক্লিকেই কোকোনাট সুগার পেয়ে যাই। গতকাল রাতে রুবির আম্মা মারা গেছেন। ওদের আর কোকোনাট সুগারের দরকার নেই। আমাদের স্যুটকেস বেওয়ারিশ হয়ে থাকে। আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে শিল্পী ফোন রেখে দিলো।