তলস্তোয়ের লেখা নিয়ে দস্তইয়েফস্কির আলোচনা
রুশ সাহিত্যের স্বর্ণযুগের দুই প্রধান লেখক ফিওদর দস্তইয়েফস্কি ও লেভ তলস্তোয় মধ্যে বয়সের পার্থক্য মাত্র সাত বছর। দস্তইয়েফস্কির জন্ম ১৮২১ সালে, তলস্তোয়ের ১৮২৮ সালে। উভয়ের সাড়া–জাগানো উপন্যাসগুলি রচিত হয়েছিল প্রায় কাছাকাছি সময়েই। কিন্তু দুজনের কখনোই মুখোমুখি সাক্ষাৎ ঘটেনি।
এর একটা কারণ হতে পারে এই যে, দস্তইয়েফস্কির জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে রাশিয়ার সে সময়ের রাজধানী সাংকৎ পিতেরবুর্গে, আর তলস্তোয় প্রায় সারা জীবনই কাটিয়েছেন মস্কোর অদূরবর্তী ইয়াসনায়া পালিয়ানা নামের পল্লীতে।
শুধু যে সাক্ষাৎ ঘটেনি তা নয়, পরস্পর সম্পর্কে কেউই তেমন কিছু লেখেননি।
১৮৮১ সালে দস্তইয়েফস্কির মৃত্যুর পর তলস্তোয় তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুপরীর কড়চা উপন্যাসের প্রসংশা করেছিলেন—এটুকু ছাড়া দস্তইয়েফস্কি তলস্তোয়ের আর কোনো লিখিত বক্তব্যের খবর আমার জানা নেই।
কিন্তু দস্তইয়েফস্কি তাঁর লেখকের ডায়রি জার্নালে তলস্তোয়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস শৈশব ও কৈশোর এবং আনা কারেনিনা সম্পর্কে অল্প কিছু কথা লিখেছেন।
[শৈশব ও কৈশোর' সম্পর্কে এই লেখাটি ১৮৭৭ সালের জানুয়ারি মাসের।]
—অনুবাদকের নোট
নামকরণ দিবসে একটি বালক
কাউন্ট তলস্তোয়ের শৈশব ও কৈশোর বইটির কথা কি আপনাদের মনে আছে? বইটিতে আছে ছোট্ট এক বালক, পুরো নভেলাটিরই নায়ক সে। কিন্তু সে তার ভাই ভালোদিয়ার মতো, কিংবা আর সব ছেলেমেয়ের মতো নেহাতই একটা বালক নয়। বয়স সবে বারো ছুঁই ছুঁই, কিন্তু এর মধ্যেই তার অন্তরে ও মাথায় এমন সব চিন্তা ও অনুভূতি উঁকি দিয়ে গেছে, যা এই বয়সী ছেলেমেয়েদের বেলায় সাধারণত ঘটে না।
প্রবল আবেগের সঙ্গে সে নিজের স্বপ্ন ও অনুভূতির মধ্যে ডুবে থাকে এবং জানে যে সেগুলি নিজের মধ্যে রেখে দেওয়াই ভালো। বিশুদ্ধতার প্রতি তার লাজুক অনুভূতি এবং উচ্চমন্যতার কারণে সে সেগুলি লুকিয়ে রাখে। সে তার ভাইকে ঈর্ষা করে, তাকে সে নিজের চেয়ে অতুলনীয় রকমের শ্রেয় মনে করে; বিশেষত সব বিষয়ে ভাইয়ের দক্ষতা ও নিপুণতা এবং তার সুশ্রী চেহারা তাকে ঈর্ষান্বিত করে; আবার সে গোপনে অনুভব করে যে তার ভাই সব ব্যাপারেই তার অনেক নিচে। কিন্তু নিজের এই ভাবনাকে সে নীচতা মনে করে; তাই সব সময়ই তা সরিয়ে রাখে।
সে প্রায়শই আয়নায় নিজেকে দেখে এবং ভাবে যে সে জঘন্য রকমের কুশ্রী। তার মনে এমন ভাবনা জাগে যে কেউ তাকে ভালোবাসে না, লোকজন তাকে অপছন্দ করে... সংক্ষেপে বললে, সে বেশ অস্বাভাবিক ধরনের এক বালক, অথচ জন্মেছে উচ্চ-মধ্য স্তরের ভূস্বামী পরিবারে; সেই পরিবার তার কবি ও ইতিহাস-রচয়িতাকে খুঁজে পেয়েছে কাউন্ট লেভ তলস্তোয়ের মধ্যে, পেয়েছে সম্পূর্ণভাবে, পরিপূর্ণভাবে, এবং পুশকিনের অভিপ্রায় অনুসারে।
এবং তার ফলে তাদের বাড়িতে কয়েকজন অতিথির আগমন ঘটেছে; মস্কোতে তাদের বিশাল পারিবারিক বাড়িটাতে; দিনটি হলো বালকটির বোনের নামকরণ দিবস। বড়দের সঙ্গে ছোট ছেলেমেয়েরাও এসেছে। খেলাধুলা ও নাচ শুরু হয়েছে। আমাদের নায়কটি আড়ষ্ঠ; সে হলো সবচেয়ে অপটু নাচিয়ে।
কিন্তু সে নিজের ক্ষিপ্র রসবোধ দেখাতে চায়, কিন্তু ব্যর্থ হয়; ব্যর্থ হয় কত কত সুন্দরী মেয়ের সামনে; তার মনে সেই স্থায়ী ভাবনা, সেই স্থায়ী সংশয় যে, সে সবার চেয়ে অধম। হতাশা থেকে তার মনে জেগে ওঠে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার সংকল্প এবং সে অস্বাভাবিক কাণ্ড করে বসে। তার চেয়ে বয়সে বড় ও হামবড়াই ছেলেদের সামনে, সবগুলো মেয়ের সামনে, সে হঠাৎ করে তার সামনে খুলে যাওয়া একটা গভীর খাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছা বোধ করে ভূতগ্রস্তের মতো, নিজের গৃহশিক্ষকের দিকে চেয়ে জিব বের করে ভ্যাংচায় এবং তাকে ভীষণ জোরে ঘুষি মেরে বসে। তখন তার মনে হয়, সবাইকে সে দেখিয়ে দিল কেমন ছেলে সে! একটা কিছু সে করতে পেরেছে! তারপর তাকে সেখান তাড়িয়ে দেওয়া হয়, আটকে রাখা হয় স্টোররুমে।
তখন বালকটির মনে হয়, তার জীবনটা চিরতরে ধ্বংস হয়ে গেল; সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে: সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে, যোগ দিয়েছে সৈন্যবাহিনীতে; যুদ্ধে গিয়ে ডজন ডজন তুর্কি সৈন্য মেরেছে, তারপর আহত হয়েছে। ‘বিজয়! কোথায় আমাদের রক্ষাকারী?’ সবাই তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় আর চিৎকার করে। এখন সে মস্কোতে, ব্যান্ডেজ বাঁধা হাত নিয়ে তভেরস্কোই বুলভার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে: সম্রাটের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে... হঠাৎ এই চিন্তা তাকে পেয়ে বসে যে এক্ষুনি দরজা খুলে যাবে, গৃহশিক্ষক ছড়িহাতে এসে ঢুকবেন। এই চিন্তায় তার স্বপ্ন উবে যায়। শুরু হয় নতুন নতুন স্বপ্ন।
হঠাৎ তার মনে হয়, তাকে সবাই কেন ঘৃণা করে সেটা সে জেনে গেছে: খুব সম্ভব সে একটা অনাথ শিশু, কিন্তু এই কথাটা কেউ তাকে কখনো জানায়নি। তার চিন্তাগুলো বাড়তে বাড়তে একটা ঘূর্ণিবায়ুতে পরিণত হয়: এখন সে মারা যাচ্ছে; সবাই স্টোররুমে ঢুকে দেখতে পেল তার মৃতদেহ পড়ে আছে। সবাই দুঃখ করে বলছে: ‘আহারে বেচারা!’ তার বাবা গৃহশিক্ষককে বলছেন, ‘সে তো ভালো ছেলে ছিল। আপনিই তার জীবনটা ধ্বংস করেছেন।’
কান্নায় স্বপ্নচারী বালকটির কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে...
পুরো ঘটনাটির অবসান ঘটে ছেলেটির জ্বরে আক্রান্ত হওয়া আর প্রলাপ বকার মধ্য দিয়ে। শিশুর মন নিয়ে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনোস্তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ, লেখা হয়েছে খুব সুন্দরভাবে।
আমি এই ঘটনাটি তলস্তোয়ের ‘শৈশব’ থেকে বেছে নিয়েছি। কারণ উভয় ঘটনার মধ্যে মিল আছে, আবার এক বিশাল পার্থক্যও আছে। কোনো সন্দেহ নেই যে মিশা নামের ছেলেটি তার নামকরণ দিবসে শুধুই ক্রোধ আর ভয় থেকে আত্মহত্যা করেনি। ক্রোধ আর তীব্র ভয়, দুটি অনুভূতিই আত্মহত্যার কারণ হিসেবে বড় বেশি সরল। অবশ্য শাস্তির ভয়ের একটা প্রভাব হয়তো সত্যিই ছিল, বিশেষত ছেলেটি যখন ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনুভূতিটা নিশ্চয়ই আরও অনেক জটিল ছিল, আর এটা খুবই স্বাভাবিক যে যা ঘটেছে তার সঙ্গে তলস্তোয়ের বর্ণিত ঘটনার কোথাও একটা ভীষণ মিল ছিল।
তলস্তোয়ের প্রতিকৃতি © ইলিয়া ইয়েফিমোভিচ রেপিন । নিউ ওয়ার্ল্ড এনসাইক্লোপিডিয়ার সৌজন্যে
আমি যে এই পর্যবেক্ষণ এত বিশদভাবে তুলে ধরলাম, তার একটা কারণ আছে। জনৈক ‘কে’ আমার কাছে লেখা একটি চিঠিতে একটি শিশুর মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনা করেছেন; সেও বারো বছর বয়সী এক বালক। এবং এটা খুবই সম্ভব যে সেই বালকটির ক্ষেত্রেও একই রকমের ঘটনা ঘটেছিল। আমি সেই চিঠির কিছু অংশ একটি শব্দও পরিবর্তন না করে এখানে উদ্ধৃত করছি। বিষয়টা ইন্টারেস্টিং।
নভেম্বরের ৮ তারিখে দুপুরের খাবরের পর সারা শহরে একটা খবর ছড়িয়ে পড়ল; একটি আত্মহত্যার খবর। বারো বছর বয়সী এক বালক, জুনিয়র হাইস্কুলের ছাত্র, গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
ঘটনাটা ঘটেছে এইভাবে: সেদিন ছেলেটি পড়া করেনি, তার শাস্তিস্বরূপ শিক্ষক তাকে স্কুল ছুটির পর থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ক্লাসরুমে আটকে রেখেছিলেন। ছেলেটি সেখানে পায়চারি করতে থাকে; হঠাৎ সে একটা পুলি ও রশি দেখতে পায় এবং গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। এক দপ্তরি শ্রেণিকক্ষগুলোর মেঝে ধোয়ামোছা করছিল, ওই শ্রেণিকক্ষে ঢুকে সে ছেলেটিকে দেখতে পায় এবং ছুটে যায় স্কুলের পরিদর্শকের কাছে। পরিদর্শক ছুটে গিয়ে ছেলেটিকে ফাঁসমুক্ত করেন, কিন্তু ছেলেটিকে আর বাঁচানো সম্ভব হয় না...
এই আত্মহত্যার কারণ কী ছিল? ছেলেটি কখনো ডানপিটে ছিল না, কেউ কখনো তাকে খারাপ ব্যবহার করতে দেখেনি; সে মোটের উপর ভালো ছাত্র ছিল; কিন্তু আত্মহত্যার আগের ক্লাসটিতে সে শিক্ষকের কাছে অসন্তোষজনক নম্বর পেয়েছিল, সেই কারণে শিক্ষক তাঁকে শাস্তি দিয়েছিলেন... লোকে বলে, ছেলেটির বাবা খুব কঠোর ছিলেন, সেদিন ছেলেটির সবার সঙ্গে নিজের নামকরণ দিবস পালন করার কথা ছিল। কোমলমতি ছেলেটি হয়তো ততক্ষণে শিশুসুলভ আনন্দের সঙ্গে স্বপ্ন দেখছিল, বাসায় ফিরলে মা, বাবা ও ছোট ছোট ভাইবোনেরা তাকে কীভাবে অভ্যর্থনা জানাবে...
কিন্তু কীসের বাড়ি ফেরা! ফাঁকা স্কুলভবনে একা বসে থাকতে হচ্ছে তাকে! সে বসে বসে ভাবছে, বাবা কী ভীষণ রেগে যাবেন; কী লজ্জা, কী অপমান! হয়তো-বা শাস্তিও পেতে হবে। সে জানত, এইসব থেকে বাঁচার একটা বিকল্প উপায় আত্মহত্যা [আমাদের এই যুগে কোন শিশু এটা জানে না?]
মৃত ছেলেটির জন্য আমাদের ভীষণ মায়া হয়, করুণা জাগে স্কুলটির ইন্সপেক্টরের জন্য; তিনি একজন চমৎকার মানুষ, চমৎকার শিক্ষক; সব শিক্ষার্থী তাঁকে ভীষণ ভালোবাসে। স্কুলটার কথা ভেবে ভয় পেতে হয়; এমন স্কুল, যার চার দেয়ালের মধ্যে অমন একটা ঘটনা ঘটতে পারে। মৃত ছেলেটির ক্লাসমেটরা যখন জানতে পেরেছে কী ঘটেছে, তখন তাদের অনুভূতি কেমন হয়েছে? কেমন লেগেছে অন্যান্য ক্লাসগুলোর শিক্ষার্থীদের, যাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটরা সবে প্রিপাটেরি ক্লাসে পড়ে?
এই ধরনের বিদ্যাশিক্ষা কি বড্ড বেশি কঠোর নয়? পরীক্ষার ভালো নম্বর ও মেধাতালিকায় স্থান না–পাওয়ার কারণে যদি শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নেয়, তাহলে কি এসবের উপরে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয় না? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি অতিরিক্ত আনুষ্ঠানিকতা আর সংবেদনহীনতায় আক্রান্ত নয়?
যে ছেলেটি তার নামকরণ দিবসে আত্মহত্যা করে, তার জন্য আমাদের নিশ্চয়ই ভীষণ বেদনা বোধ হয়; কিন্তু আমি এই হৃদয়বিদারক ঘটনা এবং এর সম্ভাব্য কারণগুলো নিয়ে বিশদ মন্তব্য করব না; বিশেষ করে পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর, অতি মাত্রায় কঠোরতা ইত্যাদি নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাব না। আত্মহত্যার ঘটনা ছাড়াই এই সমস্ত কিছু আনুষ্ঠানিকভাবে রয়ে গেছে; অতএব কারণটা এখানে নিহিত নয়।
আমি এই ঘটনাটি তলস্তোয়ের ‘শৈশব’ থেকে বেছে নিয়েছি। কারণ উভয় ঘটনার মধ্যে মিল আছে, আবার এক বিশাল পার্থক্যও আছে। কোনো সন্দেহ নেই যে মিশা নামের ছেলেটি তার নামকরণ দিবসে শুধুই ক্রোধ আর ভয় থেকে আত্মহত্যা করেনি। ক্রোধ আর তীব্র ভয়, দুটি অনুভূতিই আত্মহত্যার কারণ হিসেবে বড় বেশি সরল। অবশ্য শাস্তির ভয়ের একটা প্রভাব হয়তো সত্যিই ছিল, বিশেষত ছেলেটি যখন ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনুভূতিটা নিশ্চয়ই আরও অনেক জটিল ছিল, আর এটা খুবই স্বাভাবিক যে যা ঘটেছে তার সঙ্গে তলস্তোয়ের বর্ণিত ঘটনার কোথাও একটা ভীষণ মিল ছিল।
নিজের নামকরণ দিবসে বালকটির আত্মহত্যার ঘটনায় একটি বিশেষ দিক উঠে এসেছে সম্পূর্ণভাবে আমাদের এই সময় থেকেই। কাউন্ট তলস্তোয়ের বালকটি হৃদয়ে শ্রান্ত আবেগ আর চোখে তিক্ত অশ্রু নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারত, সবাই এসে স্কুলঘরটিতে ঢুকে তার মৃতদেহ দেখে তার জন্য করুণা ও ভালোবাসা অনুভব করতে শুরু করেছে, আর এই ঘটনার জন্য সবাই নিজেদেরই দোষারোপ করছে। এমনকি সে আত্মহত্যা করার স্বপ্ন দেখতেও পারত, কিন্তু তা শুধুই স্বপ্নের মধ্যে।
সেটা চাপা পড়া এবং অবচেতন কতকগুলি শিশুসুলভ প্রশ্ন, নিপীড়নমূলক অবিচারের তীব্র বোধ; নিজের তুচ্ছতা ও গুরুত্বহীনতা সম্পর্কে নিদারুণ যন্ত্রণাক্লিষ্ট, অকালপরিপক্ব, কষ্টকর এক অনুভূতি; মারাত্মক শক্তি নিয়ে জেগে ওঠা এই প্রশ্ন: ‘সবাই আমাকে অপছন্দ করে কেন?’
এখানে তীব্র এক আকাঙ্ক্ষা আছে লোকজনের করুণা আদায় করার, যা সকলের ভালোবাসা আদায় করার মতোই এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এইসব আছে এবং আরও ধরনের জটিল ও সূক্ষ্ম বিষয় আছে। বিষয়টা হলো, আত্মহত্যার ঘটনাটিতে এইসব এবং আরও নানা রকমের সূক্ষ্ম ব্যাপার-স্যাপার অবশ্যই ছিল; কিন্তু এক নতুন ধরনের বাস্তবতার কিছু দিকও ছিল, যা মস্কোর মধ্যশ্রেণির ভূস্বামী পরিবারটির প্রসন্ন, নির্বিকার বাস্তবতার থেকে ভিন্ন, যে পরিবারের জীবনযাপনের রীতিনীতি মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত, যাদের ইতিহাস-রচয়িতা হলেন কাউন্ট লেভ তলস্তোয়, যিনি আবির্ভুত হয়েছেন দৃশ্যত এমন এক সময়ে, যখন পুরোনো ভূস্বামীদের জীবনযাপনের রীতিনীতির বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত রুশ অভিজাত শ্রেণির সাবেকি কাঠামো উপনীত হয়েছে নতুন, এখনো-অজানা এক র্যাডিকেল সংকটে; কিংবা তা অন্ততপক্ষে পৌঁছেছে এমন এক বিন্দুতে, যখন তাকে সম্পূর্ণ এক নতুন আকার ধারণ করতে হবে, গ্রহণ করতে হবে এখনও-অস্পষ্ট, প্রায়-সম্পূর্ণ অপরিচিত রূপ।
নিজের নামকরণ দিবসে বালকটির আত্মহত্যার ঘটনায় একটি বিশেষ দিক উঠে এসেছে সম্পূর্ণভাবে আমাদের এই সময় থেকেই। কাউন্ট তলস্তোয়ের বালকটি হৃদয়ে শ্রান্ত আবেগ আর চোখে তিক্ত অশ্রু নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারত, সবাই এসে স্কুলঘরটিতে ঢুকে তার মৃতদেহ দেখে তার জন্য করুণা ও ভালোবাসা অনুভব করতে শুরু করেছে, আর এই ঘটনার জন্য সবাই নিজেদেরই দোষারোপ করছে। এমনকি সে আত্মহত্যা করার স্বপ্ন দেখতেও পারত, কিন্তু তা শুধুই স্বপ্নের মধ্যে। অভিজাত পরিবারটির ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা জীবনযাপন পদ্ধতি এমনকি বারো বছর বয়সী বালকটিকেও সেভাবেই গড়ে তুলে থাকবে, তার অমন স্বপ্নকে সত্য হতে দেবে না; অন্য এক বালক এই স্বপ্ন দেখেছে, এবং তারপর সেও এই স্বপ্ন দেখেছে।
অবশ্য আমি এই ঘটনাটি তুলে ধরছি শুধু সাম্প্রতিক কালের আত্মহত্যার মহামারির কথা মনে রেখেই নয়। বোঝাই যাচ্ছে, এখানে একটা-কিছু ঠিক নেই; রুশ জীবনপ্রণালির এক বিরাট অংশের কোনো পর্যবেক্ষকই নেই, কোনো ইতিহাসবিদও নেই। অন্ততপক্ষে এটা পরিষ্কার যে, আমাদের অভিজাত শ্রেণির উচ্চ-মধ্য স্তরের জীবন, যা আমাদের লেখকদের লেখাপত্রে খুব প্রাঞ্জলভাবে ফুটে উঠেছে, তা ইতিমধ্যেই সমগ্র রুশ জীবনের এক গুরুত্বহীন, তাৎপর্যহীন, ‘বিচ্ছিন্ন’ কোণে পরিণত হয়েছে।
তাহলে কে হবেন রুশ জীবনের অন্যান্য কোণগুলির ইতিহাস-রচয়িতা, যে সব কোণের সংখ্যা সাংঘাতিকভাবে প্রচুর? আর এত দীর্ঘ সময় ধরে যে নৈরাজ্য চলে আসছে, যা এই সময়ে আমাদের সমাজ জীবনে বিশেষভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে, যে সমাজ জীবনে এমনকি শেক্সপিয়রের মানের শিল্পীও একটি সাধারণ নিয়ম এবং দিকনির্দেশনা খুঁজে পাবেন না, সেই সমাজের সেই নৈরাজ্যের একটি ক্ষুদ্র অংশও তুলে ধরবেন, এমন ইতিহাস-রচয়িতা কে হবেন? দিক-নির্দেশনার কথা ভাবার স্বপ্নের কথা না-হয় ছেড়েই দিলাম। মূল ব্যাপারটা হলো, এই কাজটি করার মতো সামর্থ্যবান দৃশ্যত কেউই নেই; ব্যাপারটা এমন যেন আমাদের মহত্তম শিল্পীদের পক্ষেও সেই কাজ করা সময় এখনও আসেনি।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে রাশিয়ায় একটি জীবন যাপন প্রণালি লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে, ফলে পারিপারিক জীবনও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এক নতুন জীবন দানা বাঁধছে নতুন নতুন নীতি ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে। কে তা চিহ্নিত করবেন এবং আমাদের দেখাবেন? এই ভাঙন ও এই নতুনভাবে গড়ে ওঠার নিয়মগুলো খুব স্বল্পমাত্রায় হলেও সংজ্ঞায়িত করতে ও প্রকাশ করতে পারবেন কে? নাকি এখনও সে সময় আসেনি, আরও অনেক দেরি আছে?
কিন্তু যা পুরোনো, যা অতীত, আমরা কি তার সবকিছু লক্ষ করেছি? ♦
রুশ থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম
খুব সুন্দর লেখা।
সৌরভ দত্ত
জুলাই ০৬, ২০২১ ১২:৪২
'এস্তাপোবো(Astapovo) স্টেশন'টা কয়েকদিন থেকে মাথায় ঘুরছে। তারমধ্যে এই লেখাটি পেয়ে গেলাম। কী দারুণ অনুবাদ! অনুবাদকের প্রতি শ্রদ্ধা ও শুভকামনা রইল।
শ্যামল হুদা
জুলাই ২৭, ২০২১ ২২:৫৮
চমৎকার লাগলো । অনুবাদককে ধন্যবাদ ।
Syed Kamrul Hasan
জুলাই ০৫, ২০২১ ১৮:৩৩