বাঙালির হইহুল্লোড়

 

শব্দ হলো প্রাণের লক্ষণ, সৃষ্টির সগৌরব ঘোষণা। শব্দ হয় বিরক্তির, শব্দ হয় হতাশার, বেদনার; শব্দ হয় উল্লাসের, উচ্ছ্বাসের, বিজয়ের। আন্তরিকতা দেখানোর শব্দ, শত্রুকে ভয় দেখানো কিংবা বিপদে সাহস সঞ্চারণের শব্দ হয় ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা লয়ের। এই শব্দ হলো তরঙ্গের অনুভূত রূপ; বর্ণমালার শব্দ নয়। শিশু ভূমিষ্ঠ হয়ে সুতীব্র চিৎকারে জানান দেয় তার আগমনী বার্তা; মানুষের মৃত্যুতে আত্মীয়-পরিজনের বিলাপের ধ্বনিতে শোকাহত হয় আকাশ-বাতাস। এই মাতম কখনো সুর হয়ে ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের গহিন কোণ ‘…সোয়াচান পাখি, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি অথবা ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি কখনো অনুরণন তোলে রক্তকণিকায় চল্‌ চল্‌ চল্‌, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল…’ বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুযায়ী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি এক বিকট বিস্ফোরণ অর্থাৎ প্রচণ্ড শব্দের মাধ্যমে। আবার পৃথিবী ধ্বংস হবে এক শিঙ্গার ফুৎকারের মর্মভেদী শব্দের মাধ্যমে বলে আমরা বিশ্বাস করি। শব্দের মাধ্যমে শুরু শেষের এই চক্কর বাঙালির জীবনজুড়েই আবির্ভূত হয় নানান রূপ, রস মাহাত্ম্য নিয়ে।

এই শব্দ বা শব্দদূষণ কখন যে বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়েছে, তা নির্ণয়ে নিবিড় গবেষণার প্রয়োজন। বাঙালি জীবনের প্রতিটি অনুষ্ঠানে, পার্বণে, উপলক্ষে হইহুল্লোড় থাকবেই। গ্রামবাংলার বিয়েবাড়িতে মাইকের ব্যবহার গৃহস্থের সমৃদ্ধি, আনন্দ বা হুল্লোড় প্রকাশের অনুষঙ্গ। একসময় বর্ধিষ্ণু পরিবারে বিয়ে উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দু-তিন দিন মাইক না বাজলে তাদের সামাজিক অবস্থান ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিত। রাতভর মাইকে বেজে চলত গুনাইবিবি কিংবা কমলার বনবাসের পালা। দিনের বেলায় প্রতিবেশী আত্মীয় মহিলাদের ঐতিহ্যবাহী গানের সুর বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে কর্ণকুহরে আঘাত করে যায় অবিরত। মাঝে মধ্যে চলত শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতীদের সুরো-বেসুরো সঙ্গীত। আনন্দের এই বিরামহীনতা কখনো বিরক্তি উৎপাদন করে। আবার বর্ষাকালে নৌকা সাজিয়ে মাইক বাজিয়ে বিয়ে করতে যাওয়ার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় রীতিমতো মোগলাই আভিজাত্য। ইদানীং যোগ হয়েছে নির্বাচনী প্রচারাভিযান। গ্রামীণ সড়কগুলোও যান চলাচলের উপযোগী হওয়ায় মাইক বাজিয়ে একেবারে ঘরের কোনায় পৌঁছে যায়। গৃহস্থের সুবিধা-অসুবিধা, বৃদ্ধ কিংবা বাচ্চাদের ঘুম অথবা অসুস্থতার কোনো তোয়াক্কা না করেই চলে জনপ্রিয়তা প্রচারের এই শব্দযন্ত্রণা।

গ্রামবাংলার শব্দসমৃদ্ধ অন্যতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হলো নৌকাবাইচ। ব্রিটিশ আমলের একজন এই দেশীয় আমলা গুরুসদয় নৌকাবাইচের অনবদ্য বিবরণ দিয়েছেন। আলাপন বন্দ্যোপাধ্যয়ের ভাষায় বর্ণিত হয় এইভাবে

কল্পনা করুন, একশত হস্ত দীর্ঘ সঙ্কীর্ণপরিসর উন্নতফণা ক্ষিপ্রগতি দীর্ঘকায় ফণিনীর মতই যেন জীবন্ত একটি খোলা নৌকা,বেগবত্তা, বিজীগিষা তেজস্ক্রিয়তা তীব্রতার মূর্ত-প্রতীক-স্বরূপ অতিদীর্ঘ অতিসঙ্কীর্ণ ক্রমোন্নত স্পন্দমান সূচ্যগ্রাকার গগনস্পর্শী অত্যুচ্চ তাহার গলুই,প্রতি নৌকায় দুই সারি করিয়া প্রতি সারিতে পঁচিশ জন ছোট ছোট বৈঠাধারী সবল মাল্লা,নৌকার মধ্যভাগে ঢুলী করতালবাদক,গগনারোহী গলুইয়ের উপর সারি বাঁধিয়া দণ্ডায়মান পাঁচ জন দীর্ঘ বৈঠাধারী দীর্ঘকার শুভ্র পরিচ্ছদ-পরিহিত অগ্রচালক,তাহাদিগের গলদেশ হইতে লম্বমান দীর্ঘ উত্তরীয় বাতাসে উড়িতেছেনৌকার মধ্যভাগে মন্দিরাকৃতি মণ্ডপের উপর উচ্চ-ধ্বজের নিশাননৌকার পশ্চাদ্ভাগে শুভ্রবস্ত্রপরিহিত কর্ণধারের পিছনেও আর একটি নিশান বাতাসে উড়িতেছে,নদীবক্ষে প্রতিবিম্বিত সেই অতি-দীর্ঘকায় নৌকার পশ্চাদ্ভাগ হইতে আরম্ভ করিয়া গলুই পর্য্যন্ত আগাগোড়া কৃষ্ণ কাঠের উপর শুভ্র আলিপনার বিচিত্র শোভায় অঙ্কিত মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! নৌকার মধ্যভাগে দাঁড়াইয়া ঢুলী ঢোল বাজাইতেছে, সারিওয়ালা সারি-গান গাহিতেছে,পঞ্চাশ জন মাল্লা সারির গানের তালে তালে ক্ষিপ্রগতিতে জলে সজোরে বৈঠা টানিতেছেপ্রতি টানের পর নৌকার পার্শ্বদেহে বৈঠার গোড়া দিয়া আঘাত করিতেছে এবং সারির ধূয়া আবৃত্তি করিতেছে,বৈঠা-বিক্ষেপের বৈঠার আঘাতের তালে তালে ঢোল করতালের শব্দ সারির সুরের সঙ্গে মিশিয়া এক অনির্বচনীয় মধুর ঐকতানের সৃষ্টি করিতেছে। সারি-গানের বৈঠা বিক্ষেপের তালে তালে হালে মাঝি নাচিতেছে, মধ্যভাগে ঢুলী নাচিতেছে,গলুইতে দীর্ঘকায় অগ্রচালকদের পশ্চাতে তিন জন নাচিয়া নাচিয়া দীর্ঘ বৈঠা লম্বা টানে টানিতেছে এবং পুরোভাগের দুই জন লম্বা বৈঠা আকাশে উত্তোলন করিয়া নাচিয়া নাচিয়া সারির পুনরাবৃত্তি করিতেছেএবং থাকিয়া থাকিয়া প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকারোহীদের প্রতি আস্ফালন-বাণী নিক্ষেপ করিতেছে। ছোট বৈঠাগুলির লম্বা টানের এবং পঞ্চাশোর্ধ্ব লোকের মুহুর্মুহু সমতালে অগ্রঝোঁকের বেগে প্রসারিত হইয়া প্রত্যেকটি প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা যেন বিজীগিষার উল্লাসে কাঁপিতে কাঁপিতে জীবন্ত তীরের মত ছুটিয়া চলিয়াছে। আর, নদীর উভয় তীরে লক্ষ লক্ষ লোক নিজ নিজ দলের নৌকাকে উত্তেজিত স্বরে চীৎকার করিয়া উৎসাহিত করিতেছে। সেই উদ্দীপনাময়, গৌরবময় দৃশ্য জীবনে একবার দেখিলে ভুলিবার নয়। একাধারে অনুপম সৌন্দৰ্য্যময়, নৃত্যময় বৈচিত্র্যময় পৌরুষ-জলকেলির এই দৃশ্য জগতে অদ্বিতীয়।

বাংলার গ্রামীণ জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা, পৌষমেলা, চৈত্রসংক্রান্তি মেলা, জামাই মেলা, এই মেলা-সেই মেলা। এই মেলা কেবল কিছু পণ্যের পসরা সাজিয়ে বিক্রির জন্য বসে থাকা নয়। মেলা বসার স্থানের আশপাশের এলাকায় সাজ সাজ রব পড়ে যায়। আত্মীয়স্বজনের সমাগমে পুরো এলাকা ভরে ওঠে উৎসবের মৌতাত আর খুশির গমগমিতে। মেলার মজাটাই হলো ক্ষ্যাপা-হুল্লোড়ে। হ্যারি বেলাফন্টের বিখ্যাত জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েল সঙ্গীতে শব্দের মধ্যে যেমন খুঁজে পাওয়া যায় প্রাণের স্পন্দন

Sounds of laughter everywhere
And the dancing girls sway to and fro
I must declare my heart is there,
Though I have been from Maine to Mexico.

মেলায় ঢুকতেই প্রথমে যে শব্দটি কর্ণকুহরে আঘাত করে, তা হলো বাঁশি। বাঁশের তৈরি হরেক রকমের বাঁশি। আড়বাঁশি, সরলবাঁশি, কদবাঁশি, টিপরাবাঁশি, লয়াবাঁশি প্রভৃতি কত নাম! গাছের পাতা দিয়ে তৈরি পাতবাঁশি, আমের আঁটি দিয়ে ভেঁপুও দেখা যায় কখনো কখনো। আধুনিক কালের নতুন সংযোজন হলো টিনের, স্টিলের এবং পিতলের তৈরি বাঁশি। বাঁশির দোকানে বাঁশি বাজিয়ে ক্রেতাকে মুগ্ধ করছেন দোকানি, আবার ক্রেতাও পরীক্ষা করে নিচ্ছেন তাঁর ওস্তাদি। কেউ হয়তো তীব্র শব্দ উৎপাদন করতে করতে কান স্তব্ধ করে দিয়ে আপনাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। পাশেই কোনো গাছের নিচে আবার বানরের খেলা কিংবা ভেল্কি দেখানোর মজমা বসে গেছে। দর্শনার্থী জমানোর জন্য অবিরাম বাজিয়ে চলছে ডুগডুগি। এই শব্দসাগরে দর্শকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য হ্যান্ডমাইক ব্যবহার করছে কেউ। কেউবা আবার সার্কাসের কিংবা মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেলের মহড়ার প্রচার চালাতে ব্যবহার করছে বড় মাইক। বাদ্যযন্ত্রের দোকান দেখা যায় কোথাও কোথাও। সেখানে ঢাক-ঢোল, তবলা হারমোনিয়াম বাজানোর শব্দতরঙ্গ যোগ হয় ইথারে। সিলভার বা কাঁসা-পিতলের দোকানে পছন্দসই জিনিসটি হাতে বাঁজিয়ে নিচ্ছেন গৃহস্থ। ওদিকে কামারশালায় কর্মকারের হাপর হাতুড়ি পেটানোর শব্দ; গহনার দোকানে কিশোরীদের নিক্বণ চুড়ির রিনিক-ঝিনিক শব্দের সংমিশ্রণ বিরক্তিকর একঘেয়ে শব্দদূষণের মধ্যেও মনকে আন্দোলিত করে স্বপ্নিল রোমান্টিকতায়। প্রচণ্ড রোদ বা গরমেও কেউ ক্লান্ত হয় না এখানে। চারদিকে শুধু প্রাণের উপচে পড়া উপস্থিতি।

গ্রামের বাৎসরিক বা অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক এই শব্দদানব শহরে এসে প্রতিদিনের উপদ্রবে রূপ নেয়। অফিসে বিগড়ে যাওয়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের একটানা ভোঁ শব্দে কানে তালা ধরা অবস্থা। পেছনের রাস্তায় চলতে থাকা নির্মাণ কাজের শব্দ এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর দাবি আদায়ের স্লোগান আর একটানা মাইকের ঘোষণায় মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে ওঠে। অফিস থেকে পালিয়ে কোনোমতে রাস্তায় বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হবে ডাঙ্গার বাঘের তাড়া খেয়ে জলের কুমিরের রাজ্যে আত্মাহুতির জন্য ঝাঁপ দিয়ে পড়ার চিরায়ত প্রবাদের কথা। ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থেমে আছে। কয়েকটি রিকশা প্রতিযোগিতা করে এসে থামল এক পাশে। সেগুলোর ছোট ঘন্টার আওয়াজ অন্যের কর্ণকুহর অবধি পৌঁছাতে পারে কি না, তা নিয়ে চালকদের মনে দেখা দেয় প্রচণ্ড সন্দেহ। তাই তারা ঘন্টি না বাজিয়ে শুরু করে বাক্‌যুদ্ধ। এক দঙ্গল মোটরসাইকেল এসে বিরতিহীনভাবে হর্ন বাজিয়ে থেমে থাকা শকটগুলোর ফাঁকফোকর গলিয়ে সর্পিলভাবে এগিয়ে যায় আরও সম্মুখে। পেছনে থেমে থাকা গাড়িটি অকারণে হর্ন বাজিয়ে তার উপস্থিতি জানান দিলতিনিও সিরিয়ালে আছেন। হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে হোমরাচোমরা একটি গাড়ি এসে থামল নিকটেই। সামনে থাকা বাসের ইঞ্জিনের ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ চলছে অকাতরে। এমন সময় সিগন্যালের অন্যদিকে যেতে যেতে সুতীব্র চিৎকারে প্রাণে ভয়ের শিহরণ জাগিয়ে দিল একটি রোগী-পরিবাহী। আমার গাড়িতেও আছে-এমন একটি ভাব নিয়ে রোগী-পরিবাহীর সে-আর্তনাদে যোগ দিল পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিপত্তিশালী গাড়ির চালকও। সে তার সাইরেনও বাজিয়ে দিল। একটু মজা নেওয়ার জন্যই বোধ করি। এই গাড়িতে কেন এমন উচ্চ শব্দের হর্ন প্রয়োজন, তা ভাবতে ভাবতে বিরক্তি, হতাশা রাগের পারদ একসঙ্গে বাড়তে লাগল। বিপরীত দিক থেকে ভিআইপি প্রটোকলের একটি গাড়ি হুটার বাজাতে বাজাতে চলে গেল। মনে মনে ভাবছি সাইরেন বাজানো টহল পুলিশ ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এই মহাযজ্ঞে যোগ দিলেই ষোলোকলা পূর্ণ হয়। হঠাৎ অপেক্ষার অবসান। ট্রাফিক পুলিশের হাতে সবুজ বাতির সিগন্যাল দেখা দিল। একযোগে সকল গাড়ি চালক তাঁদের হর্ন বাজিয়ে চলতে শুরু করল। এমনকি সেই গাড়িটিও সাইরেন বাজাতে বাজাতে অগ্রসরমাণ গাড়ির মিছিলে যোগ দিল। সবাই সাইড চাচ্ছে আগে যাওয়ার জন্য। অসম্ভব এক প্রতিযোগিতা। শব্দ-যন্ত্রণার এক মহাসমুদ্র। আলোর ফাঁদে আত্মাহুতি দেওয়ার জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে পতঙ্গ যেমন ছুটে আসে, ঠিক তেমটি নিজের ক্ষতি হবে জেনে (কিংবা না জেনে) চালকগণ আপন-আনন্দে শব্দ তৈরি করে যায়। এটা কি শুধুই আগে যাওয়ার প্রবণতা, নাকি কোনো অসুস্থতা? নাকি সেই গল্পের মতো স্রোতের টানে গা ভাসিয়ে দেওয়া?

বাংলার গ্রামীণ জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা, পৌষমেলা, চৈত্রসংক্রান্তি মেলা, জামাই মেলা, এই মেলা-সেই মেলা। এই মেলা কেবল কিছু পণ্যের পসরা সাজিয়ে বিক্রির জন্য বসে থাকা নয়। মেলা বসার স্থানের আশপাশের এলাকায় সাজ সাজ রব পড়ে যায়। আত্মীয়স্বজনের সমাগমে পুরো এলাকা ভরে ওঠে উৎসবের মৌতাত আর খুশির গমগমিতে। মেলার মজাটাই হলো ক্ষ্যাপা-হুল্লোড়ে

দীর্ঘদিন যাবৎ এক রাজ্যজুড়ে চলছে ভয়াবহ শুষ্কতা। অনাবৃষ্টিতে চারদিকে পানির জন্য হাহাকার। বৃষ্টির কোনো লক্ষণ নেই। প্রজাদের কষ্টে তাড়িত হলেন রাজা। ডাকলেন রাজ-জ্যোতিষীসহ রাজ্যের বাঘা বাঘা সব জ্যোতিষীকে। অনেক গণনার ঘনঘটা। অবশেষে জ্যোতিষীদের মুখে কিঞ্চিৎ আশার আলো দেখা দিলবললেন, আগামী অমাবস্যা তিথিতে বৃষ্টি হবে মুহূর্তেই উল্লাসে ফেটে পড়ল জনতা; শামিল হলেন রাজাও। আনন্দে উদ্বেলিত জনতা হইচই করতে করতে বেরিয়ে গেল রাজসভা থেকে। তবে! রাজাকে একান্তে পেয়ে বললেন রাজজ্যোতিষীএকটি অশনিসংকেত রয়েছে উৎকণ্ঠায় রাজা বললেন…‘তবে তবে না করে তাড়াতাড়ি খুলে বলো জ্যোতিষী বললেন, বৃষ্টি হবে, তবে সে পানি যে পান করবে সে পাগল হয়ে যাবে রাজা আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন, তাহলে উপায়? জ্যোতিষীর পরামর্শ মতে রাজপরিবার উচ্চ পরিষদের জন্য সুপেয় পানি সংগ্রহ করা হলো। বলাই বাহুল্য, এই রূঢ় সত্যটি সাধারণ্যে অপ্রকাশিত থাকল। অবশেষে নির্ধারিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। রাজ্যের শিশু-বুড়ো, যুবক-যুবতী, নর-নারী সবাই ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো বৃষ্টিতে ভেজা এবং বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য। খুশিতে আত্মহারা সবাই বৃষ্টিতে ভিজল, গাইল জীবনের গান, নর্দন-কুর্তন করল, পান করল। ফলাফল যা হবার তাই হলো। সবাই পাগল হয়ে গেল। রাজা তাঁর পারিষদবর্গ প্রজাদের কথা ভেবে কিঞ্চিৎ দুঃখিত হলেন। অপরদিকে, প্রজাদের নানাবিধ দাবিদাওয়া, আবদার থেকে রক্ষা পাওয়া গেল ভেবে প্রশান্তির একটি সুখানুভূতিও তাঁদের সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। ওদিকে সৃষ্টিকর্তা তখন মুচকি হাসছেন। অর্থাৎ বাস্তব ফল হলো উল্টো। দুদিনেই রাজা মন্ত্রীর সেই আত্মতুষ্টি আতঙ্কে রূপ নিল। তাঁরা যেখানেই যান, যে-কথাই বলেন সবাই শুধু হাসাহাসি করে এবং তাঁদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে পাগল-পাগল বলে চিৎকার করে। রাজা প্রমাদ গুনলেন, এখন উপায়! আবার আহুত হলো উচ্চ পরিষদের বৈঠক। গভীর সলাপরামর্শ হলো। কিন্তু কূলকিনারা মেলে না। অবশেষে মন্ত্রী আবির্ভূত হলেন ত্রাতা হিসেবে। বললেন, মহারাজ, একটাই সহজ কার্যকর সমাধান আছে। এত মানুষকে চিকিৎসা করে সুস্থ করা সম্ভব নয়। বরং চলুন, বৃষ্টির পানি পান করে আমরাও ওদের দলে শামিল হই প্রথমে ক্রোধান্বিত হলেও অনেক ভেবে রাজা বললেন, তবে তাই হোক!

শহরে সর্বত্র কেবল শব্দ আর শব্দ। বিভিন্ন দিবস উদ্‌যাপন, রাজনৈতিক কিংবা প্রতিবাদী কর্মসূচিতে মাইক বাদকদলের ব্যবহার লক্ষণীয়। ঈদ-পার্বণে পিক-আপ ভ্যানে শব্দ-বর্ধক যন্ত্র নিয়ে উচ্চ শব্দে মিউজিক চালিয়ে কিশোরদের মহাসড়কে পরিভ্রমণ এক নয়া উপদ্রব। আরোহীদের সম্মিলিত হুল্লোড় এবং যান্ত্রিক শব্দের তীব্রতা এতই বেশি যে গাড়ির চালক কখনো বিপরীত দিক কিংবা পেছন থেকে আসা গাড়ির হর্ন শুনতে পায় না। প্রায়শ ঘটে মারাত্মক দুর্ঘটনা। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায়ও রয়েছে শব্দের উপস্থিতি। হিন্দুদের পুজার অন্যতম অনুষঙ্গ ঢাক শঙ্খের ধ্বনি। অন্যদিকে শীতের মৌসুমে ওয়াজ মাহফিলের আওয়াজ ভেসে বেড়ায় আকাশে-বাতাসে। ইথারে ইথারে ভাসে কেবল রংবেরঙের শব্দতরঙ্গের খেলা।

শব্দের প্রতি আফ্রিকানদেরও রয়েছে ভীষণ আকর্ষণ। স্মরণ করা যেতে পারে ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপের কথা। গ্যালারিতে সেবার ভুভুজেলা নামক এক তীব্র শব্দ উৎপাদক বাঁশি রীতিমতো ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। উৎপাত এতটাই মারাত্মক আকার ধারণ করে যে, কোনটি রেফারির বাঁশি আর কোনটা গ্যালারির বাঁশি, তা বোঝা দায় হয়ে পড়ে। ফলে খেলার গতি বিঘ্নিত হয় কখনো কখনো। এই বাঁশির প্রচণ্ড শব্দ শ্রবণশক্তির জন্য ক্ষতিকর দাবি করে স্টেডিয়ামে এর ব্যবহারকে ফিফা নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করে। কিন্তু আফ্রিকান ফুটবল সংস্থা একে আফ্রিকান ফুটবলের অনুষঙ্গ বিবেচনা করে। তাই বিভিন্ন মহলের বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিশ্বকাপ ফুটবলে ভুভুজেলা ব্যবহারের অনুমতি দেয়।

অভ্যস্ততা সহনশীলতা তৈরি করে। অর্থাৎ ক্রমাগত কোনো অনিবার্য পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষ খাপ খাইয়ে নেয় ধীরে ধীরে। বহুদিন পূর্বে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত অস্থায়ী নিবাস নাটকে রয়েছে চমৎকার উদাহরণ। ঢাকার হাজারীবাগ এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে আসে একটি পরিবার। বাসার বাইরে একটি দোকানে দিনব্যাপী এমনকি গভীর রাত পর্যন্ত মাইকে বাজে বাংলা ছায়াছবির গান। আর চারদিকে ট্যানারির বর্জ্য থেকে ভেসে আসা দুর্গন্ধ তো ছিলই। শব্দ দুর্গন্ধের যৌথ আক্রমণে প্রথম প্রথম পরিবারের সকলের অনিদ্রা দেখা দেয়। কিন্তু নাটকের শেষে দেখা যায় অন্য রকম দৃশ্য। পরিবারটি অন্যত্র বেড়াতে যায়। সেখানে শব্দ দুর্গন্ধহীন পরিবেশে ঘুমানোর জন্য তাঁদের চামড়ার ব্যাগ এবং ক্যাসেট প্লেয়ার খুঁজতে দেখা যায়। এখন নাগরিক যাত্রীদের তাই ঢাকার জিরো পয়েন্ট, শাহবাগ মোড়, সার্ক ফোয়ারার মোড় কিংবা মহাখালীর সড়ক সিগন্যালে বাসে বা গাড়িতে বসে দুপুরের ঘুম সেরে নিতে কোনো সমস্যাই হয় না। প্রচণ্ড গরমে ঠাসা-বাসের মধ্যে নাকে সুর তুলে দিয়ে ঘুমের দেশে হারিয়ে যান কোনো ক্লান্ত-শ্রান্ত যাত্রী। আবার প্রতিশোধ নেওয়া কিংবা ফিরিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনাও এই সহ্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। কেউ কেউ স্বজনের বিয়ে কিংবা অন্য কোনো উৎসবে শব্দের উৎপাত দ্বিগুণ আকারে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে পাশের বাড়িতে বিবাহ উপলক্ষে ৭২ ঘণ্টার একটানা তীব্র শব্দ যন্ত্রণা সহ্য করে যাচ্ছেন হাসিমুখে।

উচ্চমাত্রার শব্দ আবার দূষণ তৈরি করে। গবেষকদের মতে (ডেভিস, ১৯৯৯) শব্দদূষণ হলো এমন কিছু, যা শরীরকে খুঁজে নেয় এবং জোরপূর্বক মস্তিষ্কে প্রবেশ করে; এই অবৈধ অনুপ্রবেশ কেবল কর্ণকুহরের মধ্য দিয়ে নয়, বরং অস্থি, মাংস এমনকি শরীরের গহ্বর বা নালির মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে সকল অঙ্গ ভরে-এর অনিন্দ্য সুন্দর ব্যাখ্যা।

এই হইচই সংস্কৃতির একটি ভয়ঙ্কর অন্ধকার দিক রয়েছে। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় Sonic Doom: How Noise Pollution Kills Thousands Each Year শীর্ষক একটি নিবন্ধে উল্লেখ করা হয় যে, সড়কের শব্দদূষণ থেকে হৃদাক্রমণ হয়। বলা যায়, উচ্চমাত্রার শব্দের সংস্পর্শে থাকার ব্যাপ্তি হৃদযন্ত্রসংক্রান্ত রোগের ঝুঁকি পরস্পরের সমানুপাতিক। যুক্তরাজ্য এবং নরওয়ের প্রায় লাখ ৫৬ হাজার রোগীর স্বাস্থ্যতথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকগণ উপসংহারে উপনীত হন যে, দীর্ঘদিন একটানা সড়কের শব্দদূষণের সংস্পর্শ মানুষের রক্তের রাসায়নিক গঠনকে প্রভাবিত করে এর সর্বোচ্চ সহনশীলতার বাইরে পৌঁছে দেয়। এমনকি লন্ডন স্কুল অব মেডিসিনের এক সমীক্ষায় টাইপ-২ ধরনের ডায়াবেটিস রোগের পেছনে একটানা শব্দদূষণের সংস্পর্শে থাকার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গেছে। শব্দদূষণের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে শিশুদের স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া এবং আচরণগত ভারসাম্যহীনতার। ইউরোপীয় পরিবেশ সংস্থার দাবি, শব্দদূষণের কারণে ইউরোপে প্রতিবছর ১০ হাজার অপরিপক্ব মৃত্যু, ৯ লাখ উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগী, শব্দদূষণসংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে ৪৩ হাজার মানুষ হাসপাতাল ভর্তি হয়ে থাকে। অপরদিকে, কেবল যুক্তরাজ্যে প্রতিবছর শব্দদূষণের জন্য ক্ষতি ২০ বিলিয়ন পাউন্ড। উচ্চ রক্তচাপ এবং শ্রবণশক্তির লোপ আবার অসহিষ্ণুতার উদ্রেক করে। এই নিরিখে জীবন জীবিকার সন্ধানে দিবস রজনী নিয়োজিত থাকা ঢাকাবাসীর এই অসুস্থতার মাত্রা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা বলাই বাহুল্য।

ঢাকাস্থ ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের একটি পরিসংখ্যান থেকে এই সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের বহির্বিভাগে চিকিৎসা গ্রহণকারী রোগীর সংখ্যা ২০০১ সালে ছিল ১৭,৮৩৬ জন; ২০১১ সালে ৬০,১১৯ জন এবং ২০২১ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৯,৪৬০ জনে। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ১,২২,৯৩১ জন। করোনা পরিস্থিতির কারণে বহির্বিভাগে চিকিৎসা গ্রহণকারীর সংখ্যা ২০২০ সালে কিছুটা কমলেও ২০২১ সালে তা পুনরায় বৃদ্ধি পেয়েছে লক্ষণীয়ভাবে। অপরদিকে, একই সময়ে অর্থাৎ ২০০১, ২০১১ ২০২১ সালে উক্ত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩,৯২৫, ১৬,৪৭১ ২৬,০০৭ জন। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ২৬,৪৬৯ জন রোগী উক্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়। একইভাবে ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতির কারণে একটু হ্রাস পেয়ে ১৮,৩৬১ হলেও ২০২১ সালে বৃদ্ধি পায় দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে। কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান এরূপ হলে সারা দেশের অবস্থা কী ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের আওতায় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা থাকলেও এর প্রয়োগ খুবই সীমিত কিংবা নেই বললেই চলে। অনেকটা কাজীর গরুর মতো; কাগজে আছে, গোয়ালে নেই। মেট্রোপলিটন এলাকায় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পুলিশ কমিশনারের ওপর অর্পিত। অন্যান্য ক্ষেত্রে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ মাত্রাতিরিক্ত শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্র ব্যবহারে বিধি-নিষেধ আরোপের কতিপয় ক্ষমতা জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই শব্দের মাত্রা পরিমাপের কোনো উপকরণ বা পরিমাপক সরবরাহ করা হয়নি। তাঁদের জন্য কোনো প্রশিক্ষণের সুযোগও রাখা হয়নি। তা ছাড়া, অননুমোদিতভাবে মাত্রাতিরিক্ত শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্র ব্যবহারকারী সম্পর্কে তথ্য প্রদানের জন্য জনসাধারণের প্রতি নির্দেশনা রয়েছে এই বিধিমালায়। নাগরিকদের অভিযোগে অতিষ্ঠ হয়ে কোনো একটি জেলায় এই বিধিমালার আওতায় শব্দ নিয়ন্ত্রণের আদেশের বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়। সাধারণ মানুষ বিষয়টিকে সাধুবাদ জানালেও কোনো প্রকার তথ্য তাঁদের নিকট থেকে পাওয়া যায়নি। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জেলা শহর এর নিকটবর্তী কতিপয় স্থানে গভীর রাতে অননুমোদিত শব্দ উৎপাদনকারী কতগুলো অনুষ্ঠানের শব্দযন্ত্র বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তাঁদের সতর্ক করে দেওয়া হয়। কিন্তু গভীর রাতে বহুদূর থেকে ভেসে আসা শব্দের সঠিক উৎস নির্ণয় করতে না পারায় সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি। মজার বিষয় হলো সার্কাস, যাত্রা, নাটক, ভ্যারাইটি শো জাতীয় অনুষ্ঠানের প্রকোপ দেখা যায় সাধারণত শীতকালে। সে-সময়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ভয়ানক পেরেশানিতে থাকে। কোথাও কোথাও আরও এক ধাপ এগিয়ে; অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠ দখল করেই চলে এমন আয়োজন। পরীক্ষা নাকি যাত্রা-সার্কাসঅগ্রাধিকার ক্রম বাছাই করতে শিক্ষার্থীরা তখন গলদঘর্ম হয়ে পড়ে। সন্তানের শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন নিরীহ প্রজাতির কতিপয় অভিভাবকের মাথার চুল ছেঁড়া ব্যতীত গত্যন্তর থাকে না।

গবেষণায় জানা যায়, আজ থেকে প্রায় ২৬০০ বছর পূর্বে বর্তমান ইতালির কসেঞ্জা প্রদেশের সিবারিসে সে-সময়ে রাজত্বকারী গ্রিকরা প্রথম শব্দদূষণ প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন করে। তখন কুমার, কামার এবং এই জাতীয় শব্দ উৎপাদনকারী কারিগরদের শহরের বাইরে বসবাস করতে হতো। ভোররাতে ডেকে ওঠে বলে শহরে মোরগ পালন সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়। সমৃদ্ধ গৃহস্থ কিংবা উচ্চ পদমর্যাদার ক্ষমতাবান মানুষজন সড়ক থেকে বেশ কিছুটা দূরে গৃহ নির্মাণ করতেন। সড়ক গৃহের মাঝখানের এই ফাকা জায়গা বাফারিং জোন হিসেবে কাজ করত। অর্থাৎ সড়কে শকট চলাচলে উৎপন্ন শব্দতরঙ্গ ক্রমান্বয়ে ম্রিয়মাণ হয়ে যেত। গৃহকর্তা দিতেন আরামদায়ক ঘুম। পণ্য পরিবহনের জন্য সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ফলাফল হয় উল্টো। নগরবাসীদের মধ্যে বিশেষ করে শিশু বৃদ্ধদের মধ্যে নিদ্রাহীনতা দেখা দেয়। ভাবতেই অবাক লাগছেএত বছর পূর্বে ইতালির মানুষ শব্দদূষণ সম্পর্কে চিন্তা করেছে অথচ বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষের যুগে আমাদের অবস্থান কোথায়?

ইউরোপ কিংবা আমেরিকা নয়, ঘরের কোণে অবস্থিত থাইল্যান্ডের আর্থসামাজিক অবস্থাও আমাদের মতোই ছিল একসময়। দুসপ্তাহের প্রশিক্ষণের জন্য এই থাইল্যান্ডের উত্তরের একটি শহর চিয়াংমাইয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল একবার। ফেরার পথে খুব ভোরে হোটেল ছেড়ে বিমানবন্দরে আসছি। রাস্তা ফাঁকা, কদাচ বাতাসে শিস কেটে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে তার গন্তব্যে। একটি ক্রসিংয়ে এসে আমাদের গাড়ি সিগন্যালে দাঁড়িয়ে পড়ল। বিপরীত কিংবা ডান-বাম কোনো দিক থেকেই কোনো গাড়ি আসছিল না। সঙ্গে সঙ্গেই স্মৃতি আমাকে চির-অভ্যস্ত ঢাকার রাস্তায় ফিরিয়ে নিল; যেখানে অটোমেটিক সিগন্যাল কাজ করে না। এমনকি ট্রাফিক পুলিশের সিগন্যাল অমান্য করে এবং তাঁকে ধমক দিয়ে চলে যায় গাড়িচালক। অথচ এখানে নিয়ম প্রতিপালনে কী চমৎকার নিষ্ঠা! ফাঁকা রাস্তার সিগন্যালে বসেই এক সহকর্মী বললেন আশ্চর্যের বিষয় হলো এই দুই সপ্তাহে আমি একটি গাড়ির চালককেও হর্ন বাজাতে শুনলাম না অন্য সব উন্নত দেশের মতো সেখানে হর্ন বাজানো হয় গাড়ির চালক কোনো আইন অমান্য করলে তাঁকে সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এবং নিতান্ত বাধ্য হলে; অন্যথায় নয়। অপরদিকে, আমাদের দেশের গাড়িচালক গাড়ি চালাতে জানুক বা না জানুক, একটি বিষয় খুব ভালো করে জানেগাড়ির সামনে কিছু পড়লে হর্ন বাজাও, সাত খুন মাফ হয়ে যাবে। তাই ট্রাফিক সিগন্যালে বা রাস্তায় প্রয়োজন হোক বা না হোক শোনা যায় অযাচিত, অপ্রয়োজনীয় অনাবশ্যক শব্দদূষণের প্রতিযোগিতা।

জাতীয় জীবনে আমাদের অসহিষ্ণুতার একটি কারণ কি তাহলে এই ধ্বংসাত্মক শব্দ উৎপাদনের সংস্কৃতি? আওয়াজ বা শব্দ বিষয়ে এই অনর্থক হুল্লোড়ের কারণে রাগ হয়ে থাকলে রাগ নিবারণে সুকুমার রায়ের রাগের ওষুধ গল্পের কেদারবাবুর পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে।

কেদারবাবু ভীষণ রগচটা মানুষ। কথায়-কথায়, কারণে-অকারণে রাগ করেন। রাগত অবস্থায় তাঁর কাণ্ডজ্ঞানহীনতা দেখে একদিন বিদ্যেবোঝাই মাস্টারমশাই উপদেশ দিলেন শুনেছি, খুব ধীরে ধীরে এক, দুই, তিন করে দশ গুনলে রাগটা নাকি শান্ত হয়ে আসে। কিন্তু তোমার যেমন রাগ, তাতে দশ-বারোতে কুলোবে না, তুমি একেবারে একশো পর্যন্ত গুনে দেখো। একদিন অপরাহ্ণে স্কুল ছুটির সময় মাঠের পাশ দিয়ে কেদারবাবু যাচ্ছিলেন। মাঠে খেলতে থাকা বালকদের একটি মার্বেল হঠাৎ এসে ঠন করে আঘাত করে তাঁর পায়ের টিবিয়া নামক মাংসবিহীন হাড্ডিতে, সরাসরি। কেদারবাবু গেলেন খেপে। হাতের ছাতা উঁচিয়ে আক্রমণের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গেলেন। চোখের পলকে বালকেরা হাওয়া। তৎক্ষণাৎ মাস্টারমশাইয়ের তত্ত্বটি পরীক্ষা করে দেখার একটি মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেলেন। তিনি শুরু করলেন,

এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ-

স্কুলের মাঝখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে অঙ্ক বলছে, তাই দেখে স্কুলের দারোয়ান ব্যস্ত হয়ে কয়েকজন লোক ডেকে আনল। একজন বলল, কী হয়েছে মশাই?কেদারবাবু বললেন, ষোলো-সতেরো-আঠারো-উনিশ-কুড়ি-

সবাই বলতে লাগলো, কী? লোকটা পাগল হলো নাকি? আরে, ও মশাই, বলি অমনধারা কচ্ছেন কেন?কেদারবাবু মনে মনে ভয়ানক চটলেও তিনি গুনেই চলেছেন, ত্রিশ-একত্রিশ-বত্রিশ-তেত্রিশ-আবার খানিক বাদে আর একজন জিজ্ঞাসা করলো, মশাই, আপনার কি অসুখ করেছে? কবিরাজ মশাইকে ডাকতে হবে?

কেদারবাবু রেগে আগুন হয়ে বললেন, উনষাট-ষাট-একষট্টি-বাষট্টি-তেষট্টি-দেখতে দেখতে লোকের ভিড় জমে গেল, চারদিকে গোলমাল, হইচই। তাই শুনে মাস্টারবাবু দেখতে এলেন, ব্যাপারখানা কী!

ততক্ষণে কেদারবাবুর গোনা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তিনি দুই চোখ লাল করে লাঠি ঘোরাচ্ছেন আর বলছেন, ছিয়ানব্বই-সাতানব্বই-আটানব্বই-নিরানব্বই-একশো কোন হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া মিথ্যাবাদী বলেছিল একশো গুনলে রাগ থামে? বলেই ডানে বাঁয়ে দুমদাম লাঠির ঘা।