পুরুষপ্রধান রামায়ণের কন্যাগণ!

 

বাল্মীকি-রামায়ণ পুরুষপ্রধান কাব্য। এটি রামের ক্ষত্রিয়পৌরুষ এবং একই পরিমণ্ডলে ব্রাহ্মণ-ঋষির মতাদর্শিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠারই রূপকল্প। দাম্পত্য ও ক্ষমতার উত্তরাধিকার প্রসঙ্গের বীজ নিয়ে ধর্মবোধের চর্চানৈতিক সমাজ ও রাষ্ট্রশাসন পদ্ধতির আবরণে কাহিনির মহীরুহ বিস্তার। ফলে জীবনের কেন্দ্রে আন্তরিক ঘূর্ণাবর্ত থাকলেও প্রবল বহির্মুখী টান স্পষ্ট, এতে নারীর অংশগ্রহণ সীমিত। রামায়ণে নারী আছে; তারা আছে রামের পক্ষে, বিপক্ষে বা নিরপেক্ষ মতাদর্শিক কাহিনিবিস্তারে; তারা কন্যা, জায়া বা জননী এবং সর্বক্ষেত্রেই পিতা, স্বামী বা কোনো অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণে। মনুসংহিতার সুস্পষ্ট প্রভাব আছে এই কাব্যের নারী-আদর্শ নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠায়। পিতামাতার সন্তান হিসেবে কন্যা স্ত্রীলিঙ্গ; সামাজিক কার্যকারণে তার নিয়তি অন্য পুরুষের সঙ্গে সংযোগ বা সংসর্গ, এ জন্যই অবিবাহিত নারীমাত্রই পুরুষের কাম্য হতে পারে—‘সর্ব্বন্ কাময়তে যস্মাৎ’—এই সূত্রেও নামকরণ হয় কন্যা; দশ বছরের নারী; পুরুষসংযোগ অর্থাৎ যৌনসম্পর্ক স্থাপিত হয়নি এমন নারীঅক্ষতযোনি, এই সূত্রে অনূঢ়া, কুমারী। পিতামাতার নিকট কন্যার পরিচয় বিয়ের পরেও থাকে অপরিবর্তনীয়, তেমনিভাবে কোনো দেশ বা জাতি পরিচয়ের ক্ষেত্রেও অনড় থাকে যেমন কৈকেয়ী, কৌশল্যা, বৈদেহী। পিতার নামের সঙ্গে জড়িয়েও কন্যার নামকরণ হতে পারে, যেমন জানকী; একই ধরনের ভিন্নমাত্রার উদাহরণ জাহ্নবী, ভাগীরথী। বাংলা ভাষায় অবশ্য বিয়ের অব্যবহিত পরে অর্থাৎ নববধূও কন্যা। বর্তমান নিবন্ধে সংস্কৃত ও বাংলা উদ্ধৃতির জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তী অনূদিত মহর্ষি বাল্মীকিকৃত রামায়ণম্ [নিউলাইট, কলকাতা, ১৯৯৬] গ্রন্থ।

 

এক

যোদ্ধা, রাজা ও ব্রাহ্মণকর্তৃত্বের প্রেক্ষাপটে পিতা পুত্র স্বামী নিয়ে স্বীকৃত পুরুষতান্ত্রিক বলয়; স্বর্গমর্ত্যপাতালে তাদেরই আধিপত্য। তবে পুত্র বা পুরুষ উৎপাদিত হবে কীভাবে? এ জন্যই নারী বা কন্যার আবশ্যিক প্রয়োজনের সঙ্গে অনিবার্য হয়ে ওঠে সামাজিক দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে নারীর জয় বা অবস্থান নিশ্চিত হয় সামান্যই; এমন কর্তৃত্বের প্রেক্ষাপটেই কন্যা ক্ষেত্রস্বরূপ, উৎপাদন যন্ত্রবিশেষ; কন্যাশুল্ক, বীর্যশুল্কা, কানীন, কন্যাদূষণ, কন্যাদান, কন্যাকাল, কন্যাহরণ, আসুর বিয়ে, অরক্ষণীয়া প্রভৃতি শব্দগুলো সামাজিক বাস্তবতার স্মারক যা কন্যার অনুকূলে নয়। কন্যার পিতা ও পুত্রের পিতায় পার্থক্য মেরুদূর অথচ একই কেন্দ্রে তাদের বসবাস। পুত্রের বংশধর হওয়া, আর কন্যার গোত্রান্তরিত হওয়ার মধ্যে আছে অর্থনীতি, সামাজিক দ্বন্দ্বসম্প্রীতি ও সংঘর্ষ; এ জন্য পিতামাতা পুত্র চায়, কন্যা নয়। অর্থনীতি-ধর্মনীতি মিলেমিশে কন্যার জন্য তৈরি করেছে অরক্ষণীয়া পরিস্থিতি; এই প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাবান ক্ষত্রিয়েরাই নয়, ঊর্ধরেতা ঋষিরাও ভুক্তভোগী পিতা কিংবা কন্যাদূষণের জন্য দায়ী। একই কেন্দ্রে অবস্থান করে ভোক্তা, উপভোক্তা এবং ভুক্তভোগী। এ কারণেই যেন অস্বীকারের মাধ্যমে আত্মগোপন করছে পুরুষমনস্তত্ত্ব; কন্যারা থেকেও নাই।

কন্যার থেকেও না থাকার দৃষ্টান্ত আছে রাম-পরিবারে; একেবারেই কেন্দ্রে, সে দশরথ-কন্যা শান্তা। ক্ষত্রিয় পৌরুষ, পুরুষতান্ত্রিক বংশরক্ষা, ধর্মনৈতিক স্বর্গবাসের কার্যকারণে পুত্র অত্যাবশ্যক। বিভিন্ন ধরনের বিয়ে ও অসংখ্য স্ত্রীর সমাবেশ সত্ত্বেও পুত্র জন্মাতে ব্যর্থ হয় দশরথ। পুত্রলাভের একটি কৃত্য সম্পর্কে অবহিতির প্রয়োজনে দশরথকে তার মন্ত্রী সুমন্ত্র গোপনে সনৎকুমারকথিত একটি কাহিনি শোনায়। পুত্রপ্রাপ্তির এই ভবিষ্যমুখী পৌরাণিক কাহিনি একদা সনৎকুমার বলেছিল ঋষিদের। ঋষি কাশ্যপপুত্র বিভাণ্ডক, তার পুত্র হবে ঋষ্যশৃঙ্গ এবং শুদ্ধতার প্রতিমূর্তি ঋষ্যশৃঙ্গ প্রতিপালিত হবে অরণ্যে। ব্রহ্মচর্যই হবে তার জীবনধারা। এইকালে অঙ্গদেশের রাজা রোমপাদের অসদাচরণের কারণে রাজ্যে সৃষ্টি হবে দৈবদুর্যোগ তথা অনাবৃষ্টি। প্রায়শ্চিত্তের জন্য ব্রাহ্মণেরা ঋষ্যশৃঙ্গকে রাজ্যে এনে তার সঙ্গে রাজকন্যা শান্তার বিয়ের উপদেশ প্রদান করবে [আদিকাণ্ড: ৯.১৩]। ব্রাহ্মণেরা অসবর্ণ বিয়ের নির্দেশনা দিচ্ছে? বলা হচ্ছে, এই সম্প্রদান হবে শাস্ত্রবিধি অনুসারে। তাহলে কন্যাদানে ক্ষত্রিয়ে-ব্রাহ্মণে কোনো সমস্যা নাই! নাকি লুকিয়ে আছে অন্য কোনো সূত্র, তথ্য বা বাস্তবতা? সিদ্ধান্ত হয় ঋষ্যশৃঙ্গকে আনার জন্য ব্যবহার করা হবে রূপাজীবী বা বারাঙ্গনাদেরএরা কন্যা-সাধারণী। সেই অনুসারে ঋষ্যশৃঙ্গের আগমন, বৃষ্টিপাত ও শান্তার বিয়ে সম্পন্ন হয়। রোমপাদের অঙ্গরাজ্যে ঋষ্যশৃঙ্গের দায়িত্ব অনাবৃষ্টি দূরীকরণ পর্যন্ত, এর প্রতিদানে সে পেয়েছে শান্তাকে। সনৎকুমারের কাহিনি অনুসারে এই জামাতা তথা ঋষ্যশৃঙ্গই পুত্রপ্রাপ্তির ব্যবস্থা করে দেবে দশরথকে। এখানে জামাতা শব্দটি আছে কিন্তু তাতে ঋষ্যশৃঙ্গকে দশরথের জামাতা বোঝায় না। তাহলে শান্তা কীভাবে দশরথের কন্যা হলো? এর উত্তর আছে কাহিনির পরিবর্ধিত দ্বিতীয়াংশে। এই কাহিনিতে কন্যা দুই ধরনেরকন্যা-সাধারণী বা বেশ্যা; গার্হস্থ্য বা দাম্পত্য জীবনাকাঙ্ক্ষী কন্যা। কন্যা-সাধারণী কামফাঁদ বিশেষ। কিন্তু ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে কন্যাদান ও বৃষ্টিপাতের সম্পর্ক কী? এর উত্তর সম্ভবত যৌনতা ও উৎপাদনের তাৎপর্যেই নিহিত আছে। ফলে দুই ধরনের কন্যাই যৌন-উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত এবং তা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুকূল।

ঋষ্যশৃঙ্গ-শান্তাকথা বৃষ্টিপাত ও বিয়েতে শেষ হয়নি, তাতে যুক্ত হয়েছে দশরথও। তা না হলে কীভাবে দশরথের পুত্রকামনা সফল হবে! এই সংযুক্তি অঙ্গরাজের সঙ্গে দশরথের বন্ধুত্ব এবং দশরথেরও একটি কন্যাসন্তান জন্মানোর কথকতার মাধ্যমে পূর্ণতা পায়—‘কন্যা চাস্য মহাভাগা শান্তা নাম ভবিষ্যতি [আদিকাণ্ড: ১১.৩] এই প্রথম জানা গেল রাজা দশরথ নিঃসন্তান হবে না; এবং শান্তা নামে এক কন্যা থাকবে। লক্ষণীয়, দশরথের বর্তমান সমস্যা পুত্রসন্তান প্রাপ্তি নিয়ে এবং তার যে একটি কন্যা আছে এমন উল্লেখ বা ইঙ্গিত কাহিনিতে নাই। শান্তা রোমপাদের কন্যা হিসেবেই উল্লিখিত হয়েছে কাহিনির প্রথমাংশে। কাহিনির দ্বিতীয়াংশের সূচনাতেও রাজা দশরথ অঙ্গরাজের নিকট উপস্থিত হয়ে নিজেকে নিঃসন্তান ঘোষণা করেছে। অবশ্য শব্দটি অনপত্য হওয়ায় সংশয় থেকেই যায়, কেননা অপত্য শব্দে নির্বিশেষ সন্তান বা কেবল পুত্র বোঝাতে পারে। কিন্তু অপত্য শব্দে বিশেষভাবে কন্যা বোঝায় না। কিন্তু যখন বলা হয় আহরেত ত্বয়াজ্ঞপ্তঃ সন্তানার্থং কুলস্য চ [আদিকাণ্ড: ১১.৫], বিশেষভাবে পুত্রই নির্দেশ করে, কেননা পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোতে কুল পুত্রই রক্ষা করতে পারে। এ ছাড়া বিশেষ স্বর্গপ্রাপ্তির জন্যও প্রয়োজন হয় পুত্রের। ফলে সামাজিক, ধর্মীয় বা রাজ্যশাসন ব্যবস্থায় রাজা দশরথের কন্যা থাকা আর নিঃসন্তান হওয়ার মধ্যে কোনো মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্য তৈরি করে না। রাজা দশরথের আকুতি জেনে রোমপাদ পুত্রসহ শান্তাকে স্বামী ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে অযোধ্যায় পাঠানোর অঙ্গীকার করে; এরপর রাজা দশরথ স্বর্গকামনায় পুত্রের জন্য যজ্ঞ করবে, ফল হিসেবে লাভ করবে চারটি পুত্র। সত্যযুগের পুরাণ কাহিনির দ্বিতীয়াংশের শেষের দিকে বলা হয়েছে শান্তা দশরথের কন্যা। তবে কাহিনিটি সুমন্ত্র রাজা দশরথকে বলেছে অত্যন্ত গোপনে। এই গোপনীয়তার তাৎপর্য অকথিত।

সুমন্ত্রকথিত পুরাণকাহিনি শুনে অঙ্গরাজ্যে গেলে রোমপাদ ঋষ্যশৃঙ্গের নিকট দশরথকে বন্ধু সম্বোধনে উপস্থাপন ও পরিচয় করিয়ে দেয়। [আদিকাণ্ড: ১১.১৭]। ঋষ্যশৃঙ্গ এ সময়ও রোমপাদের জামাতা, সেই মতে অযোধ্যায় যাওয়ার অনুমতিদান তার কর্তৃত্বেই সম্পন্ন হয়। দুই রাজা আলিঙ্গনবদ্ধ হয় কৃতজ্ঞতা, সৌজন্যবশত বা বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে। দশরথ অযোধ্যায় এসে নিজে উপস্থিত থেকে ঋষ্যশৃঙ্গ-শান্তাকে অন্তঃপুরে অন্যান্য নারীর সঙ্গে পরিচয় তথা সংবর্ধিত করে। লক্ষণীয়, বিশেষভাবে সংবর্ধনা বা পরিচয়পর্বের কার্যকারণেই অপরিচিতের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হওয়া উচিত। তাই হয়েছে, প্রথম সাক্ষাতের কারণে অন্তঃপুরবাসিনীরা শান্তা-ঋষ্যশৃঙ্গকে ভেবেছে নববিবাহিত অথচ তাদের একটি পুত্রসন্তানের উল্লেখ আছে বর্তমান সর্গের ৬-সংখ্যক শ্লোকে। লক্ষণীয়, অন্তঃপুরবাসিনীরা সন্তানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেনি। এমন হতে পারে, প্রথম সাক্ষাতের কারণে নববিবাহিত ভেবেছে, অবশ্য সন্তানের প্রসঙ্গটি তাতে মীমাংসিত হয় না। তবু যা বোঝা গেল, অন্তঃপুরে এরা নতুন অর্থাৎ পূর্বপরিচিত নয় এবং এখন পর্যন্ত তারা বলেনি শান্তা দশরথের কন্যা অথবা উপস্থিত নারীদের মধ্যে কেউ শান্তার মাতা এমনও বোঝা যায়নি। শান্তা-ঋষ্যশৃঙ্গ অযোধ্যায় বিশেষ কাজে এসেছে; দশরথের বংশধারা রক্ষার জন্য প্রথমে অশ্বমেধ, পরে পুত্রেষ্টিযজ্ঞঋষ্যশৃঙ্গ হবে তার পুরোহিত। যজ্ঞের দ্বারা রাজা দশরথের মনোবাঞ্ছা পূরণ হয় স্বয়ং বিষ্ণু বিভক্ত হয়ে চার পুত্ররূপে আবির্ভূত হওয়ার পরিকল্পনায়। যজ্ঞাগ্নি থেকে আবির্ভূত দৈবপুরুষ প্রদত্ত পায়স গ্রহণ করে দশরথের সবর্ণা তিন পত্নী; এরা মহিষীকৌশল্যা, সুমিত্রা ও কৈকেয়ী। এর মধ্যে প্রথম ও তৃতীয়জন দেশ বা রাজ্যের নামানুসারে চিহ্নিত, সুমিত্রা কেবল ব্যক্তি নাম। কোশলের রাজকন্যা কৌশল্যা, কেকয় দেশের রাজকন্যা কৈকেয়ী; তিনজনই হয়তো রাজকন্যা বা ক্ষত্রিয়কন্যা অর্থাৎ সবর্ণা। তবে এরা সমভাগে পায়স পায়নি; এর প্রভাব পড়ে পুত্রের জন্ম ও শক্তিমত্তায়। পায়স ভাগাভাগি রাজার উত্তম মহিষীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল এমনটাও বলা হয়েছে [আদিকাণ্ড: ১৬.৩০-৩১], তাতে অনুমিত হয় রাজার স্ত্রীর অভাব ছিল না। শান্তা কি এমন অসংখ্য স্ত্রী অথবা গণনাবহির্ভূত কোনো নারীর পরিত্যক্ত সন্তান? অসম্ভব নয়। পুরাকাহিনিতে আছে দশরথের একটি কন্যা হবে, তার নাম শান্তা। কিন্তু শান্তাকে রোমপাদের পালিত কন্যারূপে প্রদানের স্পষ্ট উল্লেখ নাই, যদিও বলা আছে দুই রাজার বন্ধুত্বের কথা। আমরা দেখেছি, শান্তা রোমপাদের কন্যা এবং বিয়ের সময় কন্যাদানের ব্যাপারটিও সংঘটিত হয়েছে রোমপাদের দ্বারা। রোমপাদের শান্তা ব্যতীত আর কোনো সন্তানাদির তথ্য জানা যায় না,সন্তানাদি তো দশরথেরও নাইপ্রশ্ন থেকেই যায়, কেন তবে শান্তাকে দত্তক দেওয়া হলো? কেবল বন্ধুত্বের দায়? প্রশ্ন জাগতেই পারে, শান্তার প্রতি দশরথের দায়িত্ববোধ কি পিতার মতোই ছিল? কেন দীর্ঘকাল স্মরণ হয়নি, বিশেষত সুমন্ত্রের পুরাকাহিনি বর্ণনার আগে, শান্তা নামের কন্যার কথা? এই সব মন-মানসিকতার পেছনে কতটা আছে রাজতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্র? এই পরিত্যাগ বা প্রদানের প্রেক্ষাপটে শান্তার মূল্য কোথায়? এসব প্রশ্নের উত্তর সহজ পথে রামায়ণে নাই, কেবল পরিত্যাগের জটিল ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হয়।

 

দুই

মাতৃগর্ভজাত নয় এমন কন্যা অযোনিজা; এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে দৈব সংস্কার। সীতা অযোনিজা কন্যা। রাজা জনকের তত্ত্বাবধানে থাকা হরধনু দেখার আগ্রহে রাম-লক্ষ্মণকে নিয়ে বিশ্বামিত্র উপস্থিত হয় মিথিলায়। সেখানেই জানা যায়, রাজা জনক একদিন লাঙ্গলের দ্বারা কৃষিক্ষেত্র কর্ষণ ও শোধনের সময় লাঙ্গলের অগ্রভাগে যে কন্যকা বা কন্যা লাভ করে তারই নাম সীতা। সম্ভবত আদিতে সীতা চিহ্নিত হয়েছিল কৃষিদেবী হিসেবে; তা না হলে সীতা পরিত্যক্ত এক কন্যা মাত্র এবং তাতে সামাজিক জটিলতা বাড়ে। বিদ্যমান বিশ্বাসে অযোনিজা হলেও সীতা প্রত্যক্ষত নারী, জনক কর্তৃক পালিতা; জনকই তার পিতৃত্বের দাবিদার। মিথিলারাজ নিজের কন্যা হিসেবেই বড় করেছে সীতাকে অর্থাৎ কুমারী কন্যা তথা দেবী ছিল রাজা জনকের পারিবারিক অধিকারভুক্ত বা সৌভাগ্যের অংশবিশেষ। কৃষিনির্ভর ক্ষত্রিয় আধিপত্যের সমাজে সীতার প্রতি অন্যদের আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক, কেননা ভূপতিমাত্রই নিয়ন্ত্রণ করতে চায় ভূমি ও কৃষি। এভাবে সীতা হয়ে পড়ে বীর্যশুল্কাক্ষমতাবানই পাবে তাকে। নারীকে পত্নীত্বে বরণের অধিকার লাভ এবং তার জন্য যুদ্ধ ভারতবর্ষে অস্বাভাবিক নয়, কেননা নারীও ভূমিতুল্য। সীতা বীর্যশুল্কা হওয়ায় এবং সংরক্ষিত শৈবধনুতে গুণ সংযোজনে ব্যর্থ ও প্রত্যাখ্যাত ক্ষত্রিয়েরা শুরু করে যুদ্ধের উৎপীড়ন। রাজা জনকের ইচ্ছা রাম শৈবধনুকটি দেখুক, গুণ সংযোজনে সমর্থ হলে সীতাকে পাবে: যদ্যসা ধনুষো রামঃ কুর্যাদারোপণং মুনে। সুতামযোনিজাং সীতাং দদ্যাং দাশনথেরহম্\ [আদিকাণ্ড: ৬৬.২৬]। রাম গুণ সংযোজনকালে ভেঙেই ফেলে ধনুকটি। এই শক্তি প্রদর্শন বা বীর্যবত্তার দ্বারা সীতা রামের অধিকৃত হয়; রাজা জনক সেই কথা জানায় বিশ্বামিত্রকে: মম সত্যা প্রতিজ্ঞা সা বীর্যশুল্কেতি কৌশিক। সীতা প্রাণৈর্বহুমতা দেয়ারামা মে সুতা\ [আদিকাণ্ড: ৬৬.২৩]

প্রচলিত কৃষিসংস্কারে সীতা সৌভাগ্যের প্রতিমূর্তি। রাজা জনকের হাল চাষ, প্রান্তিক কৃষিদেবতা শিবের ধনুক সংরক্ষণের মাধ্যমে হল বা সীতার তাৎপর্য উদ্ঘাটিত হয়। ভারতীয় কন্যারত্ন ও অযোনিজা দেবীর সংমিশ্রণে সৃষ্ট সীতা নামক নারী বা কন্যা। এ জন্য তাকে কেন্দ্র করে কর্তৃত্বের একধরনের ভারসাম্য-পরীক্ষা চলেছে; রাম তাকে লাভ করেছে শক্তি তথা বীর্যবত্তার দ্বারা। তবে সীতা বীর্যশুল্কা হলেও স্বয়ম্বরা হয়নি; এই পর্যন্ত তার কোনো কণ্ঠস্বরও নাই। এই প্রসঙ্গে সীতা যেন সাধারণ রাজকন্যা মাত্র, মহলবাসী, শারীরিক সৌন্দর্যে মূল্যবান! সীতার প্রতি রামের আকর্ষণ অবশ্য হরধনু ভাঙার হুজুগে পৌরুষকেন্দ্রিক হলেও কৃষিকর্তৃত্বের মনস্তত্ত্বে সামাজিক। এ জন্য হরধনু ভেঙেই সীতাকে পায়নি রাম, সামাজিক কুল ও বর্ণগত ঐতিহ্য মিলিয়ে দুই পরিবারে গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতে বিশেষত পুরোহিতদের বৈদিক বিধিবিধান মেনে এই বিয়ে সম্পন্ন হয়। পিতা বা পরিবারের কর্তৃত্বের বাইরে সীতা বা তার অন্যান্য জ্ঞাতি বোনেরও এখানে কোনো বক্তব্যের সুযোগ নাই। বীর্যবান আদর্শ বর পাওয়া গেছে রামসহ চারজন, জনক ও তার ভাইয়ের মিলিয়ে কন্যাও আছে চারজন; ফলে সবারই সম্প্রদান হলো। কন্যার পিতারা এমন বিয়ে দিতে পেরে যেভাবে ধন্য হয়েছে তা পুরুষতান্ত্রিক সমাজমনস্তত্ত্বের অনুকূলকন্যার পিতা দায়বদ্ধ, দুর্বল। কন্যাজয়ের স্বীকৃতি আছে আদিকাণ্ডের ৬৮.৮ [সর্গ ৬৮, শ্লোক ৮] শ্লোকে; বিয়ে দিতে পেরে ধন্য হওয়ার স্বীকৃতি ৬৯.১২ শ্লোকে; বরের পিতার সামান্য মূল্য প্রদানেই বিস্মিত বা আপ্লুত হওয়ার তথ্য আছে ৬৯.১৬ সংখ্যক শ্লোকে।

রাম-সীতা প্রমুখের বিয়েতে রাজপুরোহিতেরা বংশগৌরব বা ঐতিহ্যধারা বর্ণনায় কেবল পিতা-পুত্রপরম্পরাই জানাতে থাকে, তাতে থাকে না কন্যার উল্লেখ অথচ দৃশ্যমান ও গুরুত্বপূর্ণ চার কন্যার বিয়ে চাক্ষুষ করছি আমরা! কন্যা অপ্রয়োজনীয়, কেননা কন্যা পিতৃধারার অংশ নয়। তাহলে কি কন্যা বিয়ের পর স্বামীবংশের অংশ? সেখানে স্থান আরও সংকীর্ণ; ফলে নারী কোনো অবস্থাতেই বংশধারার অংশভুক্ত হয় না। অসীম শূন্যতা অপেক্ষা করে নারী তথা কন্যার জন্য; তার গোত্রান্তর ঘটে কিন্তু অস্তিত্বের স্থিতি আসে না। এই সামগ্রিক অস্বীকারের বাস্তবতা উচ্চবর্ণে প্রবল; তাতে ভ্রূণমোচন বা কন্যা হত্যা কিংবা পরিত্যাগ অসম্ভব নয়। ভিন্নপ্রান্তিক ভাবনায় বলাই যায, এমনি এক দৃষ্টান্ত প্রান্তরে পরিত্যক্ত সীতা! তাহলে পুরুষেরা কন্যা সংগ্রহ করে কীভাবে? এ জন্যই সম্ভবত তাদের করতে হয়েছে প্রান্তযাত্রা। রাজারা দখল করেছে প্রান্তিক রাজ্য, সেখান থেকেই সংগৃহীত হয়েছে কন্যারত্ন অবশ্য, সীতার বিয়ে হচ্ছে বিধি মেনে, পরস্পর জেনে নিচ্ছে বংশগৌরব। জনক বীর্যশুল্কা সীতাকে দান করে রামের হাতে এবং দ্বিতীয়া কন্যা ঊর্মিলাকে লক্ষ্মণের হাতে। এখানে দান শব্দটিও তাৎপর্যময়। এরপর জনকভ্রাতা কুশধ্বজের দুটি কন্যাকন্যা দুটির নাম আপাতত নেইতাদের বিয়ে সম্পন্ন হলো ভরত ও শত্রুঘ্নের সঙ্গে। পরে জানা যায়, কন্যা দুটির নাম মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তি। সীতা পালিতা হলেও অগ্রজা, তবে ঊর্মিলা জনকের ঔরসজাতা। এই বিয়ের মাধ্যমে কন্যাদের গোত্রান্তর হলো, জীবনপরিচয়ও পাল্টে গেলএখন তারা কন্যা নয়, বধূ; সুনির্দিষ্টভাবে কারো অধিকারভুক্ত বা স্ত্রী। এখন থেকে জনক-কন্যা জানকী হিসেবে চিহ্নিত হবে কখনো কখনো, মূল পরিচয় হবে রামের স্ত্রী, বিশেষ ক্ষেত্রে কেবলই সীতা। কিন্তু ঊর্মিলা চলে যাবে অন্তরালে; মাণ্ডবী বা শ্রুতকীর্তির আর কোনো প্রয়োজনই থাকবে না। তারা মহলবাসী অসংখ্য নারীদের অংশমাত্র! একমাত্র সীতাই ভাগ্যবতী, তা পুরুষতান্ত্রিক পিতৃকর্তৃত্বের প্রেক্ষাপটে কন্যা ও স্ত্রীর কূটাভাসে ধৃত: মনস্বী তদ্গতামনাস্তস্যা হৃদি সমর্পিতঃ। প্রিয়া তু সীতা রামস্য দারাঃ পিতৃকৃতা ইতি\ [১.৭৭.২৬] রামের হৃদয়ে সীতা সমর্পিত হলো। সীতা স্বেচ্ছাবিবাহিতা না হওয়ায় এবং পিতার দ্বারা সমর্পিত হওয়ায় রামের অত্যন্ত প্রিয় হলো। পিতার আদর্শ কন্যা এমনই, পিতার নির্দেশিত বিয়ের দ্বারা সুখস্বাচ্ছন্দ্যে থাকে!

পিতার নির্দেশ মেনে বিয়ে করার কারণেই সীতা নন্দিত ও সুখী হবে! কিন্তু বাস্তবে সুখ নিশ্চিত হয়নি সীতার জীবনে। নিশ্চিত হয়েছে রামের বনবাসের সিদ্ধান্ত, সঙ্গে যাবেই সদাসহচরী স্ত্রী সীতা। বনের ভয়ংকর পরিবেশের জানিয়ে রাম নিরস্ত করতে চাইলে সীতা পিতৃগৃহে অর্থাৎ কন্যাকাবস্থায় বনবাসের বিষয়ে কোনো এক তপস্বিনীর মাধ্যমে অবহিতির কথা জানায়। [অযোধ্যাকাণ্ড: ২৯.১৩]। পিতৃপরিবারে কন্যার অন্যতম শিক্ষাযেকোনো অবস্থায় স্বামীর সঙ্গেই স্ত্রীর জীবন বাঁধা! এই শিক্ষা নারীরাই দেয়, যেমন দিয়েছে সীতার মাতা, তেমনি দিয়েছে বনবাসযাত্রায় অত্রিমুনির স্ত্রী অনুসূয়া। সীতা আত্মজীবনের একাংশ উন্মোচন করে অনুসূয়ার কাছে, তাতে আছে কন্যাকালীন পরিচয়:

মিথিলার রাজা ছিলেন জনক।...তিনি লাঙ্গল হাতে নিয়ে জমিতে কৃষিকার্য করতে গেছিলেন। তখন আমি মাটি ভেদ করে উঠলাম। হয়ে গেলাম রাজার কন্যা। মুঠো করে বীজ ছড়াতে তিনি ব্যস্ত ছিলেন। তখন সর্বাঙ্গ ধূলিতে-মাখা আমাকে দেখে জনক বিস্মিত হলেন। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। স্নেহে আমায় কোলে তুলে নিলেন এই তো আমার মেয়ে বলে তিনি আমার ওপর স্নেহ ঢেলে দিলেন। এই সময়ে মানুষের কণ্ঠে আকাশে দৈববাণী হলো, মহারাজ, ধর্মানুসারে এইই তোমার কন্যা। মিথিলাপতি আমার ধার্মিক পিতা তখন আমাকে পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। লাভ করলেন বিপুল সমৃদ্ধি। তিনি পুণ্যশীলা জ্যেষ্ঠা মহিষীকে বাঞ্ছিতদ্রব্যের মতো আমায় দিয়ে দিলেন। স্নিগ্ধ মাতৃস্নেহে তাঁর দ্বারা প্রতিপালিত হতে লাগলাম। [অযোধ্যাকাণ্ড: ১১৮.২৭-৩৩]

এখানে পরিত্যক্ত কন্যার দৃষ্টান্ত অস্পষ্ট নয়। নিঃসন্তান বলেই রাজা জনকের নিকট কন্যার অধিক গুরুত্ব, এমনি গুরুত্ব পেয়েছে শান্তা রোমপাদের নিকট। কিন্তু দশরথের প্রথম সন্তান কন্যা হওয়ায়, বন্ধ্যাত্বের জন্য সামাজিক তাচ্ছিল্যের আশঙ্কা না থাকায় সহজেই প্রত্যাখ্যান বা পরিত্যাগ করতে পেরেছে শান্তাকে। দুই কন্যাই কৃষি ও বৃষ্টিপাতের কার্যকারণে যুক্ত; শান্তার গুরুত্ব ঋষ্যশৃঙ্গের দ্বারা নির্ধারিত হলেও সীতার একক দৈব গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ঋষ্যশৃঙ্গের শুদ্ধতা, অশ্বমেধ ও পুত্রেষ্টিযজ্ঞের দ্বারা বৃষ্টিপাত সৃষ্টি বা পুত্রলাভ সবই উৎপাদনসংক্রান্ত ব্যাপার; এর সঙ্গে প্রান্তিক কৃষিদেবতার ধনুকের যোগও তাৎপর্যময়। এই সব দৈব ব্যাপারের বাইরে শান্তা বা সীতাকে মানুষীকন্যা নির্মাণের কালেই স্পষ্ট হয় সামাজিক রূঢ় বাস্তবতা। সীতার বিয়ের প্রসঙ্গে পিতার দুরবস্থা সামাজিক মানদণ্ডে নির্ণীত:

কিছুকাল পরে পতিমিলনের তথা আমার বিয়ের বয়স হয়েছে। আমার বাবা চিন্তান্বিত হলেন। গরীবের বিত্তনাশ হলে যে রকম চিন্তা হয়, বাবারও হলো তা-ই। ভূতলে ইন্দ্রের মতো হলেও তিনি যদি কন্যার পিতা হন তাঁরই সমান বা তাঁর চেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তির কাছেও তিনি অসম্মান পেয়ে থাকেন। সেই অসম্মান তাঁর নিজের ক্ষেত্রে দূরে নয় দেখে রাজা জনক চিন্তার সমুদ্রে ডুবে গেলেন। নৌকা না পেয়ে যেন পারে যেতে পারলেন না। [অযোধ্যাকাণ্ড: ১১৮.৩৪-৩৬]

কন্যাদায় সমাজসৃষ্ট পরিস্থিতি। সমাজের বিধিবিধানের ভেতরেই লুকিয়ে আছে কন্যার পিতার অসম্মানের বীজ। নারীজীবনের নিয়তি নির্ধারিত হয়েছে বিয়ে বা পতিসঙ্গের মাধ্যমে। এর ব্যতিক্রমে ভয়ংকর পাপ; এ জন্য নির্ধারিত আছে কন্যার বিয়ের বয়স এবং তা অবশ্যই রজস্বলা হওয়ার পূর্বে। কন্যার বৈধভাবে ঋতুধর্ম পালন অর্থাৎ যৌনসংসর্গ আবশ্যিক; তা কন্যা কুলত্যাগিনী হতে পারে, তাতে কন্যার দোষ হবে না। এ ক্ষেত্রে বিবাহপূর্ব কন্যার সমগ্র দায় পিতারমনুসংহিতায় আছে স্পষ্ট নির্দেশনা। কন্যার পিতা হিসেবে রাজা জনকের জন্য যে উপমান ব্যবহৃত হয়েছে, তা নির্বিশেষ সামাজিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অনুসরণ। কিন্তু কেন এই উৎকণ্ঠা? সমাজ বিয়ের বয়স নির্ধারণ করেছে, তেমনি কঠিন বাঁধনে রেখেছে বর্ণনাশ্রমে; উপযুক্ত বর বা পুরুষ পাওয়াও দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ। ফলে ব্যভিচার, পুরুষতান্ত্রিক আক্রমণ ও ধর্ম মান্য করার বাধ্যবাধকতায় বিপর্যস্ত থাকে কন্যার পিতা।

কন্যার বিয়ের বয়স সুনির্দিষ্ট হলেও কন্যার প্রতি সামাজিক আকর্ষণ অনেকাংশে দেহ-বাস্তবতায় নির্ধারিত। দেহ প্রথমত সৌন্দর্যধারণা দেয়; দ্বিতীয়ত দেয় সৌভাগ্যের নির্দেশনা। রামায়ণের সমাজ বিশ্বাস করে দেহগঠনে চিহ্নিত হয় সৌভাগ্যলক্ষণ। ফলে নারী-পুরুষের দেহগঠনে পার্থক্য প্রাকৃতিক হলেও এর মূল্য তৈরি হয় সামাজিক কার্যকারণে। কন্যার দেহ অনেকটাই সামাজিক নির্মাণ। সৌন্দর্যবতী কন্যার জন্য যেমন পুরুষের আকর্ষণ থাকে, এর বিপরীতটা ঘটে অসুন্দরের প্রতি। এই সৌন্দর্যেরও আছে সামাজিক নিরিখ। পিতামাতা কন্যার যে দেহপ্রকৃতির জন্য সর্বাংশে দায়ী নয় তার ভার বহন করতে বাধ্য। অন্যভাবে দেখলে সুন্দর সৃষ্টি করবে সুন্দর এমন দৃষ্টিভঙ্গির কারণেও অতিরিক্ত চাপ পড়ে কথিত সুন্দরীর ওপর। এমন কন্যা সংগ্রহ প্রাকৃতিক নির্বাচনের অতিরিক্ত সামাজিক কাঠামোর অংশ, যার সঙ্গে পুরুষের উপভোগ ও সন্তান উৎপাদনের আকাঙ্ক্ষা সরাসরি যুক্ত। ফলে কন্যা পূর্বনির্ধারিতভাবে যৌন-অনুষঙ্গ, সন্তান উৎপাদনের দেহযন্ত্রবিশেষ। সামগ্রিক মূল্য অস্বীকৃত হলেও পুরুষতন্ত্র কন্যার সৌভাগ্য দ্বারা পুষ্ট হতে চায়। প্রবাদ তো আছেই স্ত্রীর ভাগ্যে স্বামীর সম্পদ। সীতার সৃষ্টি হয়েছে এমন পরিবেশেই। যুদ্ধকাণ্ডে মায়াসৃষ্টির দ্বারা রাম-লক্ষ্মণ নিহতের দৃশ্য প্রদর্শন করে রাবণ মনোবল ভেঙে দিতে চেয়েছে সীতার। রামের মৃত্যুদৃশ্য দেখার পর সীতা স্মৃতি-উদ্ধার করছে যেখানে সামুদ্রিক লক্ষণ-বিচার অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা তাকে বলেছিল পুত্রবতী রাজরানি হওয়ার কথা। কী সেই দেহলক্ষণ? নিশ্চয়ই বিয়ের আগেই প্রকাশ পেয়েছিল সেই দেহলক্ষণ? তাহলে বিয়ের সময় সীতার বয়স কত ছিল? বিভিন্ন হিসাব মিলিয়ে বোঝা যায় বিয়ের সময় সীতার বয়স ছিল ছয় বছর বা তার আশপাশে। এবার দেখা যাক ওই বালিকার দেহে কী কী চিহ্ন ছিল। রাজরানি হওয়ার মতো পদ্মচিহ্ন ছিল পায়ে; শরীরের কোথাও বৈধব্যযোগের চিহ্ন ছিল না; চুল ছিল কালো, সূক্ষ্ম ও সমান; ভ্রূযুগল পরস্পর বিচ্ছিন্ন; হাঁটু দুটি গোলাকার, লোমশূন্য; দাঁত সুবিন্যস্ত; কপালের হাড়, দুই চোখ, দুই হাত, দুই পা, দুই গলফ্ ও দুই ঊরু ছিল সমানভাবে প্রশস্ত; নখ স্নিগ্ধ ও আঙুলগুলো সমানভাবে প্রসারিত। দেহবর্ণ উজ্জ্বল, গায়ের লোম কোমল এবং পায়ের দশটি আঙুল ও পদতল অর্থাৎ এই বারোটি প্রত্যঙ্গ সমানভাবে মাটি স্পর্শ করে। এই পর্যন্ত সাধারণ; কিন্তু যখন স্থূল, উদ্ধত স্তনের বর্ণনা দেওয়া হয় তখন তা বালিকার দেহ থাকে না। কেবল ভারি স্তনই নয়, স্তনবৃন্তের অন্তর্মুখীনতাকেও বলা হয়েছে সৌভাগ্যলক্ষণ। গভীর নাভি ছিল সীতার, এটাও রাজরানি হওয়ার মতো দেহলক্ষণ। এগুলো বলেছিল কন্যালাক্ষণিকা বিদুঃ’—কন্যালক্ষণবেত্তারা। [যুদ্ধকাণ্ড: ৪৮.৬-১৩]। স্পষ্টতই কন্যাদেহ নির্মিত হয়েছে সামাজিক চাহিদার দ্বারা, এই সমাজ পুরুষের এবং তাতে কামদৃষ্টি অস্পষ্ট নয়। এমন নারীদেহই ভারতবর্ষে সৌন্দর্যের মাপকাঠি। সুন্দর না হলে কি পুরুষের বিশেষত রাজার চোখে আকর্ষণীয় হওয়া যায়? যায় না। তাই রাজরানির দেহ ভিন্ন রকম। এই প্রেক্ষাপটেই কন্যার অস্তিত্ব নিয়ে পিতারা সংকটে পড়ে, সীতাও একসময় জানিয়েছে সেকথা। জানা কথা, শক্তি প্রদর্শিত সমাজে বা অরণ্যে আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী!

 

তিন

সামাজিক কর্তৃত্বের কার্যকারণেই নির্ধারিত হয়েছে কন্যার ওপর পুরুষের আধিপত্য। রামায়ণে অবিবাহিত নারীকে কামনা করা অর্থাৎ যৌনাচারের জন্য আহ্বান জানাতে পুরুষেরা দ্বিধান্বিত নয়, ব্যাপারটা তার সামাজিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। এর বাইরে আছে শক্তি বা কর্তৃত্বের অনৈতিক বহিঃপ্রকাশবলাৎকার বা ধর্ষণ। এইসব কর্মকাণ্ড রাজকীয় বা পৌরুষ হিসেবে গৃহীত, কখনো নন্দিতও হয়েছে। আদিকাণ্ডে বিশ্বামিত্রের উচ্চারণে জানা যায়, মহাতপস্বী কুশের কুলীনায়াং যুক্তায়াং অর্থাৎ কুলীনকুলসম্ভবা সুযোগ্যা স্ত্রী বৈদর্ভীর গর্ভে চারটি পুত্র জন্মায়, এর মধ্যে অন্যতম কুশনাভ। পিতার নির্দেশে চার পুত্রই রাজধর্ম গ্রহণ করে, কুশনাভ ছিল রাজর্ষি। তার স্ত্রী ঘৃতাচীর গর্ভে জন্ম নেয় শতকন্যা। এই কন্যাদের প্রসঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে কন্যা ও পুত্রদের স্বভাব ও কর্মপার্থক্যের সুনির্দিষ্ট বিভাজন। পুত্রেরা ব্যস্ত বেদ পাঠ, যুদ্ধবিদ্যা গ্রহণ ও রাজ্য প্রতিষ্ঠায়; কিন্তু কন্যাদের কাজ ভিন্ন:

যৌবনবতী, রূপবতী ঐ কন্যাগণ অলঙ্কারে শোভিতা হয়ে একদিন উদ্যানে বেড়াতে এলেন। বর্ষাকালের বিদ্যুতের মতো তাঁদের দেখাচ্ছিলো। সুন্দর অলঙ্কারে সজ্জিতা তারা। সেখানে নৃত, গীত এবং বাদ্যের দ্বারা পরম আনন্দে মেতে ছিলো। তারা ছিলো সর্বাঙ্গসুন্দরী। রূপে তারা জগতে অতুলনীয়। উদ্যানে তারা যখন এলো, মনে হচ্ছিলো মেঘের আড়ালে শোভা পাচ্ছে তারারাজি। [আদিকাণ্ড: ৩২.১২-১৪]

কন্যার সম্পদ দেহসৌন্দর্য, এটি কন্যারত্নের অন্যতম লক্ষণ। কন্যারা ব্যস্ত থাকবে আমোদ-প্রমোদে। কোন উদ্দেশ্য সফল হবে তাতে? কোনো কীর্তিমান পুরুষ পছন্দ করবে তাদের! রত্ন যেমন সংগৃহীত হয় বীরত্বের দ্বারাএজন্য কন্যা বীর্যশুল্কা! এই সফলতার মনস্তত্ত্ব ও কারিগরি নিশ্চিতভাবে পুরুষতান্ত্রিক। কন্যাদের কোনো রাষ্ট্রকর্ম নাই, তাদের অংশগ্রহণ নাই অর্থনীতি বা সমাজভাবনায়। তারা জীবনের সফলতা খুঁজে পাবে শরীরের সৌন্দর্যে, পুরুষের মনোহরণ, বিয়ে ও সন্তান লাভের দ্বারা! এই মনস্তত্ত্বচালিত বায়ু আকৃষ্ট হয়েছে শতকন্যার প্রতি; এই আকর্ষণের কেন্দ্র কামনাযৌনতার প্রলোভন। কামনার উৎসস্থলরূপে নারীমাত্রই কন্যা; বায়ু সেই কথাই স্মরণ করাতে চায়: আমি তোমাদের সকলকে পেতে চাই। তোমরা আমার পত্নী হয়ে যাও। মানুষের ভাব তোমরা ত্যাগ করো। দীর্ঘ আয়ু তোমরা লাভ করবে। বিশেষত মানুষের যৌবন নিত্যচঞ্চল। অক্ষয় যৌবন পেয়ে তোমরা দেবীত্ব লাভ করবে। [আদিকাণ্ড: ৩২. ১৬-১৭]। বায়ুর লোভ ভোগ, উপভোগের; অবশ্যই পুরুষ আধিপত্যে। এরই কার্যকারণে কন্যামাত্র অরক্ষণীয়া! জ্ঞাতিসম্পর্কের বাইরে যেকোনো পুরুষ তাকে দাবি করতে পারে। বায়ুর দাবিও তাই সামাজিক তো বটে, পৌরুষীয়ও। বায়ুর এমন কাজের জন্য নিন্দা করা হয়নি, বরং প্রশংসা করা হয়েছে কর্মনিপুণতার। কিন্তু কন্যারা স্বয়ম্বরা হতে সম্মত ছিল না। তাদের সামনে দুটি প্রতিবন্ধকতা; প্রথমত, মনুষ্যভাব ত্যাগ; দ্বিতীয়ত, পিতৃতন্ত্র অস্বীকার। দুটিই অসম্ভব, কেননা এই দুটির দ্বারাই তাদের মনোজগৎ অধিকৃত। এ জন্য অপহাস্য ততো বাক্যং অর্থাৎ বায়ুর কথা শুনে উপহাসের সঙ্গে প্রত্যুত্তর করে:

হে দেবপ্রধান, আপনি সকল প্রাণীর অন্তরে বিচরণ করেন। আপনার প্রভাব আমরা সবাই জানি। আপনি আমাদের অপমান করছেন কেন? হে দেবমুখ্য, আমরা রাজা কুশনাভের কন্যা। আমরা আপনাকে স্থানচ্যুত করতে পারি। কিন্তু, আমরা এখন তপস্যা করছি। হে দুষ্টচিত্ত, সত্যবাদী পিতাকে অবজ্ঞা করে আমরা নিজেরাই পতিগ্রহণ করে স্বয়ম্বরা হবো, এমন সময় আমাদের যেন না আসে। পিতাই আমাদের প্রভু। পরমদেবতা। পিতা যাঁকে দেবেন, তিনিই হবেন আমাদের পতি। [আদিকাণ্ড: ৩২.১৯-২২]

কন্যাদের এমন অশ্রুতপূর্ব ব্যক্তিত্বময় প্রতিবাদ এবং পিতৃতান্ত্রিক বক্তব্য শোনার পর বায়ু তাদের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভেঙে খর্বাকৃতি করে দেয়। কিন্তু কেন এই অত্যাচার? প্রথমত কন্যারা দুর্বল, অবলা; দ্বিতীয়ত বায়ুর পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের মানসিকতা বা অহংকার। এখানে পরিলক্ষিত হয় পুরুষতান্ত্রিকতারও স্তরভেদ। পিতার নাম নিয়েও কন্যারা রক্ষা পায়নি। ভগ্ন অবস্থা দেখে কুশনাভের জিজ্ঞাসার প্রত্যুত্তরে কন্যারা জানায়:

রাজন, সর্বত্র গতিশীল বায়ু অন্যায় পথ অবলম্বন করে আমাদের ধর্ষণ করতে ইচ্ছা করেছিলো। ধর্মের দিকে চেয়ে দেখলো না। আমরা তাকে বলেছিলাম, আমাদের বাবা রয়েছেন। আপনার কল্যাণ হোক। আমরা স্বাধীনভাবে নেই। আমাদের বাবাকে আপনি অনুরোধ করুন। তিনি আমাদের দান করবেন। সে পাপবশত আমাদের কথা শুনলো না। এই কথা বলার পর বায়ু আমাদের সবাইকে দেহে আঘাত করেছে। [আদিকাণ্ড: ৩৩.২-৪]

বায়ু কি কন্যাদের বিয়ে করতে চায়নি? বিয়ে করতে চাইলেও বলপ্রয়োগের মনস্তত্ত্ব এখানে ধর্ষণ নামে অভিহিত। পিতৃতন্ত্র কাঙ্ক্ষিত, কন্যার জন্য অনড় বাস্তবতা কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে জয়ী হতে চেয়েছে কামনাকেন্দ্রিক পুরুষতান্ত্রিক অহংকার। এ জন্যই যেন কুশনাভ তথা পিতা-কুশনাভ তার কন্যাদের অনুরোধ করে বায়ুর আচরণ ক্ষমার জন্য, কেননা ক্ষমাই ধর্ম। সম্ভবত এর মাধ্যমেই প্রকাশ পায় কন্যার পিতার দুর্বল সমাজমনস্তত্ত্ব। কন্যা একধরনের দায়; কেননা, তাকে বিয়ে দিতে হয়, যেমনটা বলা হয়েছে: মন্ত্রজ্ঞো মন্ত্রয়ামাস প্রদানং সহ মন্ত্রিভিঃ। দেশে কালে চ কর্তব্যং সদৃশে প্রতিপাদনম্\ [আদিকাণ্ড: ৩৩.১০]। এই ঘটনার পর মন্ত্রজ্ঞ রাজা কন্যাদের বিয়ের ব্যাপারে মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে, কেননা দেশকাল বিবেচনা করে যোগ্য পাত্রে কন্যাদের সমর্পণ করা মানুষের কর্তব্য। কন্যা ও কন্যার বিয়ে নিয়ে পিতা বা পরিবারের সামাজিক চাপ এখানে স্পষ্ট।

কুশনাভ-কন্যাদের প্রায়-সমধর্মী একটি উপাখ্যান আছে উত্তরকাণ্ডে। অযোধ্যায় ফিরে রাম আরোহণ করেছে সিংহাসনে। তখন বিভিন্ন মুনি-ঋষির আগমন ঘটেছে রাজদরবারে; এসেছে অগস্ত্য, শুনিয়েছে পুলস্ত্যের কাহিনি। একদা পুলস্ত্য বেদ অধ্যয়ন ও তপস্যায় মগ্ন হলে বিভিন্ন কন্যকা এসে তপস্যায় বিঘ্ন ঘটাতে থাকে। এই কন্যকার ব্যাখ্যা আছে: ঋষিপন্নগকন্যাশ্চ রাজর্শিতনয়াশ্চ [উত্তরকাণ্ড: ২.৯] অর্থাৎ ঋষি, সাপ ও রাজকন্যারা সেখানে আসে; সঙ্গে থাকে অপ্সরাও। সাপ কি প্রাণিবিশেষ? কোনো গোত্র হওয়াও অসম্ভব নয়। কন্যারা সেই তৃণবিন্দুর আশ্রমে খেলা বা হাস্য-গীতবাদ্যে আমোদ করায় তপস্যায় বিঘ্ন ঘটে পুলস্ত্যের। এতে মুনিবর ক্ষিপ্ত হয়ে অভিশাপের ভঙ্গিতে বলে: যামে দর্শনমাগেচ্ছেৎ সা গর্ভং ধারয়িস্যতি [উত্তরকাণ্ড: ২.১৩]এরপর থেকে যে কন্যা পুলস্ত্যের সামনে যাবে সে হবে গর্ভবতী। এই অভিশাপের তাৎপর্য কী? আমরা কি কোনো ধর্ষণকামী মুনিবরকে দেখছি, যার নাকি ঊর্ধরেতা হওয়ার কথা! সুন্দর প্রকৃতি, শান্তিপূর্ণ তপস্যার জন্য উৎকৃষ্ট স্থান; কন্যারা সেখানে এসেছে অথচ এই সাধকের প্রথমেই মনে এল কন্যাদের গর্ভবতী করার কথা! মুনির পুরুষতান্ত্রিক মন আধিপত্যের সক্রিয়তায় চালিত হয়েছে ধর্ষক মানসিকতা দ্বারা, ভেবেছে সর্বোচ্চ শাস্তির এই এক পথ। কন্যাদের গর্ভবতী হওয়ার বয়স অথচ কন্যারা চলাফেরা করছে স্বাধীনভাবে, এটাই যেন রুদ্ধ করতে চায় মুনিবর পুলস্ত্য। কন্যাকে শাস্তি দাওধর্ষণ করো, গর্ভবতী করে দাওতারা অতঃপর গৃহবন্দি হবে, হারিয়ে যাবে প্রাণপ্রাচুর্য, প্রাকৃতিক উচ্ছ্বাস। ভয়ংকর ধর্ষক-মন নিয়েই আবির্ভূত হয়েছে আর্যশুদ্ধতার প্রতিমূর্তি পুলস্ত্য।

ব্রহ্মশাপের ভয়ে কন্যাদের আশ্রমে যাতায়াত বন্ধ। কিন্তু রাজর্ষি তৃণবিন্দুকন্যার এমন অভিশাপের ব্যাপার অজ্ঞাত থাকায় পুলস্ত্যের মুখোমুখি হওয়ার পরেই শারীরিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। একাকী কন্যার দর্শন লাভের পর গর্ভবতী হওয়া অলৌকিক ঘটনাই বটে, অভিশাপের ফল এমনি করেই প্রকটিত হয়! হয়তো একে প্রত্যক্ষ ধর্ষণ বলা যাবে না, নিশ্চয়ই মানসিক ধর্ষণ। কন্যা নিজেই বুঝতে পারে না কী সর্বনাশ হলো তার; পিতা তৃণবিন্দুও প্রশ্ন করে, কেমন করে হলো শরীরের এই অবস্থা! এমন তো হওয়ার কথা নয়—‘কিং ত্বমেতত্ত্বসদৃশং ধারয়স্যাত্মনো বপুঃ [উত্তরকাণ্ড: ২.১৯] অর্থাৎ বিয়ে হয়নি, স্বামীসংসর্গ নাই, তবু গর্ভবতী! কন্যাও অবুঝ, কেবল বলে, সে গিয়েছিল পুলস্ত্যের আশ্রমে সখীদের অন্বেষণে, একা। এবার তৃণবিন্দু বুঝতে পারে এমন ঘটেছে পুলস্ত্যের প্রভাবে। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা; পুলস্ত্যকেই কন্যাদান করে তৃণবিন্দু। এই দান বর্ণে ও রাজক্ষমতায় অমিল হলেও ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যের কার্যকারণে অস্বাভাবিক নয়। বিস্তারপ্রবণতার দ্বারা ঋষিব্রাহ্মণেরা রাজপরিমণ্ডল ও প্রান্তের জনগোষ্ঠীতে বিবাহ বা বিবাহবহির্ভূত কন্যাদূষণের অন্যতম হোতা; কেন্দ্রভুক্ত বর্ণসঙ্করতাও এই মানসিকতার দ্বারা নির্ধারিত:

ভগবান, আমার এই মেয়ে সাধ্বী। দাক্ষিণ্য প্রভৃতি গুণে গুণান্বিতা। হে মহর্ষি, কৃপা করে আপনি এই স্বয়মাগতা কন্যাকে ভিক্ষারূপে গ্রহণ করুন। আপনি তপস্যানিরত। স্বভাবতই আপনার ইন্দ্রিয়সকল শ্রান্ত হয়ে পড়েছে। আমার এই মেয়ে সদাসর্বদা আপনার শুশ্রূষাকর্মে রতা থাকবে। এতে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। ধর্মাত্মা রাজর্ষি তৃণবিন্দু এভাবে প্রার্থনা জানালে ব্রহ্মর্ষি তাকে আশ্বস্ত করলেন। তাঁর মেয়েকে গ্রহণ করতে সম্মত হয়ে বললেন, তাই হোক। কন্যাকে দান করে তৃণবিন্দু এবার নিজের আশ্রমে ফিরে এলেন। এদিকে তাঁর মেয়ে তখন পতির সন্তুষ্টিবিধান করে সেখানে বসবাস করতে লাগলেন। তৃণবিন্দুকন্যার চরিত্র ও সদাচারে মহাতেজা মুনি পুলস্ত্য তুষ্ট হলেন। আনন্দভরে তাকে বললেনসুন্দরি, তোমার গুণে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। দেবি, এজন্যে আমি তোমাকে একটি পুত্র প্রদান করার ইচ্ছা করি। সেই পুত্র হবে আমারই মতো। পিতৃকুল এবং মাতৃকুলউভয় কুলেরই সে প্রতিষ্ঠা বর্ধন করবে। প্রসিদ্ধ হবে পৌলস্ত্য নামে। [উত্তরকাণ্ড: ২.২৫-৩০]

উদ্ধৃতিটি আরেকবার পাঠ করা যাক! কন্যার পিতার দুরবস্থা স্পষ্ট, যদিও সে রাজর্ষি এবং পুলস্ত্য বসবাস করে তারই রাজ্যের আশ্রমে। বিয়ের পূর্বেই গর্ভবতী হওয়া কন্যাকে নিয়ে পিতা বিব্রত, এ জন্যই কন্যাদান করতে হলো দোষীকেই। কোন প্রয়োজনে এই প্রদান? পুলস্ত্যের ইন্দ্রিয়গুলো দুর্বল হয়ে গেছে, কন্যাটি তাকে সাহায্য করতে পারবে! কোন ইন্দ্রিয় দুর্বল হয়েছে? প্রকৃতপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই ইন্দ্রিয়দুর্বলতার। অচিরেই পুলস্ত্য কন্যাটির সেবাশুশ্রূষায় সন্তুষ্ট এবং পুত্র প্রদানে আগ্রহী হয়। প্রশ্ন জাগে, পুত্রদানের প্রসঙ্গ আসছে কেন, কন্যাটি তো আগেই গর্ভবতী! মূলত ঋষিদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে করুণা ও আত্মবিস্তারের প্রকল্পের অংশ হিসেবে রচিত হয়েছে এমন উপাখ্যান, যেখানে কন্যারাই প্রধানত ভুক্তভোগী এবং তা শরীরীভাবে।

শরীর রক্ষা কন্যাজীবনের প্রধানতম সংকট। আত্মরক্ষার কোনো সুযোগ নাই অধীনস্থ ও অধিকৃতের বাস্তবতায়। এই সূত্রেই কন্যা অরক্ষণীয়া! সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্রক্ষমতা সর্বত্র অধিকার ও অধীনস্থ করার কলাকৌশল। যেপথে কন্যা সৃষ্ট সেপথেই বিলয়, অথচ সংরক্ষণের কত রীতিনীতি বজ্র-আঁটুনি! এই সব কারিগরিই নির্দেশ করে কন্যার অসহায়তা। উত্তরকাণ্ডে অহল্যা-গৌতম-ইন্দ্রের উপাখ্যানেও এই প্রবণতা স্পষ্ট। ব্রহ্মা সৌন্দর্যের সারভূত রূপ হিসেবে সৃষ্টি করে অহল্যাকে। বলা হয়েছে: হলং নামেহ বৈরূপ্যং হল্যং তৎপ্রভবং ভবেৎ [উত্তরকাণ্ড: ৩০.২৪]জগতে কুরূপতাকে বলে হল, তা থেকে যে জন্মায় সে হল্য। যে নারীতে হল্য তথা নিন্দনীয় রূপ নাই, তাকেই বলে অহল্যা। ব্রহ্মা এই নারী তথা অহল্যাকে সৃষ্টি করার পর ইন্দ্র নিজের ক্ষমতা, পদাধিকারে তাকে পেতে চাইল অর্থাৎ ব্রহ্মার অনুমতির অপেক্ষা করল না। এটি ক্ষমতাবানের সাধারণ প্রবণতাসকল শ্রেষ্ঠ রাজার, তদুপরি বীরভোগ্যা বসুন্ধরা! ব্রহ্মা এই অবস্থায় অহল্যাকে দান করে ইন্দ্রিয়সংযমী ও তপস্যাসিদ্ধ মহামুনি গৌতমকে। ব্রহ্মার এই মনস্তত্ত্ব জটিলতায় আক্রান্ত। সে অহল্যাকে কোনো যুবকের হাতে সমর্পণ করেনি, উপযুক্ত মনে করেছে ইন্দ্রিয়সংযমী বৃদ্ধকে। এটিও ক্ষমতার আরেক কেন্দ্রসব ভালো ব্রাহ্মণভোগ্যএমন মনস্তত্ত্ব-আক্রান্ত। এতে ক্ষুব্ধ হয় ক্ষত্রিয়শক্তি ইন্দ্র এবং অহল্যার সঙ্গে স্থাপন করে অনৈতিক শারীরিক সম্পর্ক যাতে সায় ছিল অহল্যার। এতে কি মুনি গৌতমের ইন্দ্রিয়সংযমের প্রতিক্রিয়া দেখা গেল? যাহোক, ক্ষতি হলো কন্যা অহল্যারই। অরজার কাহিনিও অরক্ষণীয়া কন্যা ও বিব্রত পিতার। ইক্ষ্বাকু বংশধর রাজা দণ্ড একদা গিয়েছে শুক্রচার্যের আশ্রমে। সেখানে সে সুন্দরী এক কন্যার প্রতি কামাবিষ্ট হয়। কামোত্তেজিত দণ্ডের মনোভাব বুঝে কন্যাটি জানায়:

রাজেন্দ্র, অরজা আমি। অক্লেশে যিনি মহৎ কর্ম করেন সেই ভার্গবের জ্যেষ্ঠা কন্যা। আশ্রমেই আমি বাস করি। রাজন, বলপূর্বক আপনি আমাকে স্পর্শ করবেন না। কেননা পিতার অধীনস্থা কুমারী কন্যা আমি। বিশেষ করে আমার মহাত্মা পিতা হলেন আপনার গুরু। তাঁর শিষ্য আপনি। মহান তপস্বী তিনি কুপিত হয়ে যদি আপনাকে অভিসম্পাত করেন তাহলে মহাবিপদে পড়বেন। নরশ্রেষ্ঠ, আমাতে আপনার একান্ত অভিলাষ থেকে থাকলে ধর্মসঙ্গত পথে আমার অতিতেজস্বী পিতার কাছ হতেই আমাকে প্রার্থনা করুন। অন্যথায় ভীষণ ফলভোগ করতে হবে। [উত্তরকাণ্ড: ৮০.৮-১১]

অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠ বক্তব্য অরজার। কিন্তু কামোত্তেজিত অবিবেচক পুরুষ দণ্ড, যুক্তিবুদ্ধি হারিয়ে কেবল শারীরিক মিলনের আহ্বান জানায় এবং বলপূর্বক লিপ্ত হয় মৈথুনকর্মে। ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়ন্ত্রিত যৌনাচার প্রায়শই রাজচরিত্রের বৈশিষ্ট্যরূপে রামায়ণে উল্লিখিত। আশ্রমে বা আশ্রমের বাইরে এ ধরনের বলাৎকার ঘটেছে একাধিক। এতে কন্যাদের অসহায়তা, পিতার বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হওয়ার দৃষ্টান্তও আমরা লক্ষ করি। বর্তমান ক্ষেত্রেও অসহায় কন্যা পিতার ক্ষমতার উল্লেখে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। দণ্ডের কর্মের জন্য শুক্রাচার্য ক্ষুব্ধ; একই সঙ্গে কন্যাও তিরস্কৃত হয়। কেন? পিতার বিব্রতকর পরিস্থিতির দায় কিছুটা চেপে বসে কন্যার কাঁধেও, এটি পুরুষতান্ত্রিক মনোভারেরই অংশ: ...অরজাকে বললেন, দুর্বুদ্ধি, নিজের মনকে একাগ্র করে সমাহিতচিত্তে আশ্রমেই অবস্থান করো। অরজে, নিশ্চিন্ত হয়ে যোজনব্যাপী বিস্তৃত মনোহর সরোবরে বাস করে নিজের অপরাধক্ষয়ের জন্যে সময়ের অপেক্ষা করো। [উত্তরকাণ্ড: ৮১.১৩-১৪]। বলাৎকার কার অপরাধ? কন্যার প্রতি স্নেহ ও অপরাধবোধের এক জটিল মনস্তত্ত্ব সক্রিয় আছে এখানে। কন্যা তাই বহুমুখী অবদমন ও অপরাধের চক্রে আবদ্ধ।

 

চার

ব্রহ্মক্ষত্রিয় পরিমণ্ডলে পুরুষের আগ্রাসী কামনায় বিপর্যস্ত কন্যাদের দৃষ্টান্ত আছে একাধিক। প্রান্তে, বিশেষত রাক্ষসসমাজেও কন্যার জীবন সমধর্মী পুরুষতান্ত্রিক আক্রমণের শিকার। এ কারণে কন্যার পিতা সর্বদাই বিব্রত, আতঙ্কিত এবং অধিকতর সুপাত্র তথা ক্ষমতাধর পুরুষের সন্ধানে ব্যস্ত। রাক্ষস সুমালী একদা আপন কন্যা কৈকসীকে নিয়ে এসেছিল রসাতল থেকে মর্ত্যলোকে। বিশ্রবাপুত্র কুবেরকে দেখতে পেয়ে সুমালীর ইচ্ছা জাগে নিজ কন্যাকে তার হাতে সমর্পণের। পিতা হিসেবে নিজ কন্যার প্রতি সুমালীর বক্তব্য শোনা যাক:

পুত্রি, এটিই হলো তোমার বিবাহের উপযুক্ত কাল। কেননা যৌবন অতিক্রান্ত হচ্ছে। পাছে তুমি প্রত্যাখ্যান করো এই সংশয়ে কোনো শ্রেষ্ঠ বর তোমাকে বরণ করে নিচ্ছে না। ধর্মবুদ্ধিসম্পন্ন আমরা তোমার জন্য বহু যত্ন-প্রয়াস নিয়েছি কেননা তুমি সর্বগুণসমন্বিতা। সাক্ষাৎ লক্ষ্মীরূপা তুমি। হে কন্যা, সম্মানার্থী সকল ব্যক্তির কাছেই কন্যার পিতা হওয়া দুঃখের কারণ, যেহেতু আগে থেকে বোঝা যায় না যে, কেমন পুরুষ কন্যাকে বরণ করবে। স্বীয় মাতৃকুল, আপন পিতৃকুল এবং যে কুলে কন্যাকে সম্প্রদান করা হবে সেই পতিকুলকন্যা এই তিনকুলেই সংশয়াপন্ন হয়ে থাকে। [উত্তরকাণ্ড: ৯.৭-১০]

সুমালীর বক্তব্যের সঙ্গে সীতার জবানিতে শোনা রাজা জনকের বক্তব্য মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। দুই ক্ষেত্রেই কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার দুরবস্থা স্পষ্ট। সীতার সঙ্গে কৈকশীর পার্থক্য প্রথমত বয়সের, দ্বিতীয়ত স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতায়। কৈকশী যৌবনে পদার্পণ করেছে কিন্তু বিয়ে হয়নি, এটি রাক্ষস পরিমণ্ডলের ব্যাপার। আবার কোনো পাণিপ্রার্থীকে প্রত্যাখ্যান করার স্বাধীনতাও তার প্রসঙ্গে স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ। এই দুটি প্রবণতাই কোনো ঋষি বা ক্ষত্রিয় পরিমণ্ডলে দেখা যায়নি; কথিত আর্যানুসারী সমাজে কন্যারা প্রায় কণ্ঠস্বরহীন।

কন্যার জীবনধারা নির্ধারণে পিতার কর্তৃত্ব সমাজে স্বীকৃত; পিতাই কন্যাকে সমর্পণ করে কোনো পুরুষের হাতে। বর্তমান ক্ষেত্রে পিতা সুমালী পুরুষ নির্ধারণ করছে, কন্যাকে আহ্বান করছে সে যেন নিজেই পুরুষটির নিকট নিজেকে সমর্পণ করে। এ যেন স্বয়ংবরার বিশেষ পদ্ধতি: পুত্রি, প্রজাপতি-কুলোদ্ভব, শ্রেষ্ঠ-গুণান্বিত এবং পুলস্ত্যতনয় মুনিবর বিশ্রবার সন্নিকটে তুমি স্বয়ং উপস্থিত হয়ে তাঁকে পতিত্বে বরণে করে তাঁর সেবায় নিযুক্ত হও। [উত্তরকাণ্ড: ৯.১১]। এটি কেবল ব্রহ্মক্ষত্রিয় মেলবন্ধন নয়, কেন্দ্র-প্রান্তের ভিন্ন জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ বা সমন্বয়ের দৃষ্টান্ত বা প্রকল্প। কন্যার মাধ্যমে পিতা সম্পৃক্ত হয় গুরুত্বপূর্ণ বংশ বা গোষ্ঠীর সঙ্গে। পিতার নির্দেশ মেনে কৈকসী উপস্থিত হয়েছে বিশ্রবার সামনে; ঋষি বিশ্রবা দেখেছে কৈকসীর দেহসৌকর্যচন্দ্রোপম মুখশ্রী, ভারি নিতম্ব এবং জানতে চেয়েছে কন্যাটির পরিচয় ও আগমনের কারণ। কৈকসী ব্যক্তিত্ববান, তার কণ্ঠস্বর স্পষ্ট; সে আত্মপরিচয় প্রদানের পর পিতার নির্দেশনা না জানিয়ে বিশ্রবাকে অনুরোধ করেছে সে যেন আত্মপ্রভাবে বা ধ্যানের দ্বারা আগমনের কারণ জেনে নেয়। ধ্যানপ্রাপ্ত তথ্যে বিশ্রবা জানায়: সুতাভিলাষো মত্তস্তে মত্তমাতঙ্গগামিনি’—হে মাতঙ্গগামিনি, আমা হতে তোমার সন্তানাভিলাষ হয়েছে [উত্তরকাণ্ড: ৯.২২]। নারী-পুরুষের সংযোগ বা বিয়ের উদ্দেশ্য এখানে স্পষ্ট। তবে উচ্চারণে কোনো সংবেদনা নেই, নারী বা পুরুষটি যেন কেবল সন্তান জন্মদানের যন্ত্র। অবশ্য কৈকসীর আগমনের কালটি সঠিক ছিল না—‘দারুণায়ান্তু বেলায়াং [উত্তরকাণ্ড: ৯.২২]নিদারুণ বেলা হওয়ায় সন্তান জন্মাবে ভয়ংকর। কৈকসী অবশ্য এমন সন্তান চায়নি, পরে বিশ্রবা সান্ত্বনা দেয় অন্তত একজন পুত্র হবে বংশধর, ধর্মাত্মা। এভাবেই জন্ম হলো রাবণ বিভীষণ প্রমুখের।

কৈকসীপুত্র রাবণ, ব্রহ্মার বরে শক্তিমান অথচ পরিণত হয় অশুভ পীড়কে। তার প্রধান কাজ রাজ্য দখল ও নারী অপহরণ। সে অপহরণ করেছে শত শত নৃপতি, ঋষি, দেবতা, দানব, নাগ, গন্ধর্ব, দৈত্য কন্যাদের। রূপবতী কন্যা দেখলেই রক্ষক বন্ধু-বান্ধবকে হত্যা করে অপহরণ করছে সে। [উত্তরকাণ্ড: ২৪.১-৬]। অপহরণ করেছে পতিব্রতা নারীদেরও। এবার নারী মাত্রেই অরক্ষণীয়া। এইসব নিপীড়নমূলক কার্যকারণে সে নিজের অজান্তে হত্যা করে সূর্পণখার স্বামীকেও। রাবণের নারীর প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ বন্ধে সচেষ্ট হয় বিভীষণ। রাবণের আত্মীয়, সম্পর্কে বোন কুম্ভীনসীকে অপহরণ করে মধু এবং তা ঘটেছে রাবণের পাপে, এমনই ধারণা বিভীষণের। এই প্রেক্ষাপটে বিভীষণ ভিন্নতর মতাদর্শ তথা কন্যানীতিও উপস্থাপন করে। কুম্ভীনসীকে অপহরণ করলেও ক্ষমা করা হয়েছে মধুকে, কেননা তাতে সংযুক্ত নতুন নারীনৈতিকতা:

রাজন, যদিও সে (কুম্ভীনসী) অন্তঃপুর মধ্যে সুরক্ষিতা ছিলো তবু মধু তাকে আক্রমণপূর্বক হরণ করেছে। মহারাজ, এ বৃত্তান্ত শুনেও তাকে (মধু) আমরা ক্ষমা করেছি। বিনাশ করিনি। কেননা, কন্যার বিবাহকাল সমাগত হলে তাকে যোগ্য পতির হাতে ভ্রাতৃগণ দ্বারা সমর্পণ করতে হয়। তাই দুর্বুদ্ধিপরায়ণ আপনার পাপকার্যের ফল বলে একে ভুগতে হবে। [উত্তরকাণ্ড: ২৫.২৭-২৮]

এটি রামপক্ষ ধর্মাত্মা বিভীষণের বক্তব্য! তার বক্তব্যের সারসত্য প্রথমত, কন্যাদের বিয়ের একটি নির্দিষ্ট সময় আছে, তা অতিক্রান্ত হওয়ার পর কোনো পুরুষের দ্বারা আক্রান্ত হলে আক্রান্তকারীকে দোষ দেওয়া যায় না। এমন বক্তব্য আছে মনুসংহিতায়। কন্যাকে নির্দিষ্ট সময়ে বিয়ে দেওয়া অভিভাবকের অবশ্যকর্তব্য এবং এই বয়স কন্যার রজস্বলা হওয়ার আগেই নির্দিষ্ট, এর ব্যতিক্রমে অভিভাবকের পাপ হয়। দ্বিতীয় ব্যাপারটি নৈতিক; রাবণ অন্যের কন্যাদের পীড়ন করছে, তাই তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। যে অরাজকতা রাজা করছে তা উৎসাহিত করছে অন্য প্রজা বা অন্য ক্ষমতাবানকেও। তবে প্রশ্ন জাগে, একজনের পাপে অন্যে ভুগবে? দুটি ক্ষেত্রে কন্যাই আক্রমণের শিকার। রাবণ অবশ্য কুম্ভীনসীর বিয়ে মেনে নিয়েছে, দেখা গেল কুম্ভীনসীও পক্ষাবলম্বন করছে স্বামীর। এই অপহরণ যেন কুম্ভীনসীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে এল।

কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার দুরবস্থার কাহিনি রামায়ণে অনেকগুলো এবং এগুলো কেন্দ্র-প্রান্তে সমধর্মী। এমনি একটি ঘটনা রাবণের স্ত্রী মন্দোদরীকে নিয়ে। একদিন রাবণ শিকারের উদ্দেশ্যে অরণ্যে গেলে সেখানে সাক্ষাৎ ঘটে দিতিপুত্র ময়ের সঙ্গে। ময় জানায়, অপ্সরা হেমার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল এবং হেমার গর্ভজাত কন্যা মন্দোদরী। হেমা স্বর্গে ফিরে গেলে হেমা-বিচ্ছিন্ন ময় সকন্যা বনবাসী। তবু সে কন্যাদায়গ্রস্ত বিব্রত পিতা:

কন্যার যোগ্য পতিসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়ে আমি বহির্গত হয়েছি। সম্মানাকাঙ্ক্ষী সকল ব্যক্তির পক্ষেই কন্যার পিতা হওয়া অতি দুঃখকর। পিতৃকুল ও পতিকুলদুই কুলকেই কন্যা সতত সংশয়াশ্রিত করে।... [উত্তরকাণ্ড: ১২.১১-১২]

এমন কথা সকল পিতাই বলছে রামায়ণে। কেন? একটা কারণ হতে পারে কন্যারা অনবরত আক্রান্ত হয়েছে ক্ষমতাবান পুরুষদের দ্বারা। পুরুষের ক্ষমতার কাছে কন্যার শারীরিক মানসিক শুদ্ধতার যেমন মূল্য হয়নি, তেমনি কন্যার পরিবার বা গোষ্ঠী হেনস্তার শিকার হয়েছে অনবরত। এ জন্যই কন্যাপক্ষ অনবরত সন্ধান করছে অধিকতর ক্ষমতাবান পুরুষ। বর্তমান ক্ষেত্রে যেমন রাবণসে রাজা। ময় নিজের কন্যাকে রাবণের হাতে অর্পণ করতে চায় এবং তা অগ্নি প্রজ্বালনপূর্বক যথারীতি বিয়ের মাধ্যমে। ময় এটাও জানত রাবণ শাপগ্রস্ত, তবু এই বিয়ে দিতে সে আগ্রহী কেননা রাবণ ব্রহ্মার কুলোদ্ভব সন্তান। বোঝা যায় কন্যাদানের জন্য বংশগৌরব একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

এই পর্যন্ত কোনো উপাখ্যান বা কাহিনিতে কন্যা-নিপীড়নের জন্য পুরুষদের গুরুতর শাস্তি বা প্রতিবিধান হয়নি। কেবল ঋষি ভার্গব সামান্য প্রতিজ্ঞা করেছে প্রতিবিধানের, তবু কন্যাকেও দোষারোপের পর পাঠিয়ে দিয়েছে অন্তরালে। উত্তরকাণ্ডে রাবণ রাজ্যলাভের পর হিমালয়ে অরণ্যে বেড়াতে গিয়ে তপস্যামগ্ন এক কন্যা দেখতে পায়। কামমোহিত রাবণ জানতে পারে কন্যাটি ব্রহ্মর্ষি কুশধ্বজের কন্যা বেদবতী। বড় হওয়ার পর দেব, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস নাগেরা তাকে পাওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু কুশধ্বজ তাকে কাউকেই সম্প্রদান করেনি, তার ইচ্ছে ছিল কন্যার বিয়ে হবে ত্রিলোকস্বামী দেবেশ্বর বিষ্ণুর সঙ্গে। [উত্তরকাণ্ড: ১৭.১০-১২]। রামায়ণে ক্ষমতাবান পুরুষের সঙ্গে কন্যার বিয়ে দেওয়া সাধারণ প্রবণতা। এর মাধ্যমে অধিকতর কর্তৃত্বের বলয়ে অনুপ্রবিষ্ট হওয়ার সুযোগ যেমন ঘটে, তেমনি কন্যার সুখ-সুবিধা নিশ্চিত হয়। রাবণ জানতে পারে স্ত্রী প্রাপ্তির প্রতিবন্ধকতায় ক্ষুব্ধ হয়ে দৈত্যরাজ শম্ভু হত্যা করেছে কুশধ্বজকে। কন্যা লাভের জন্য ক্ষমতাবানদের হানাহানির প্রেক্ষাপটে কন্যাপক্ষের আত্মরক্ষার জন্য সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাধরের প্রতি আকর্ষণ স্বাভাবিক। পিতার মৃত্যুর পর বেদবতী পিতার প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়ন অর্থাৎ নারায়ণকে পাওয়ার জন্য পালন করছে কঠোর ব্রত। কিন্তু কামপীড়িত রাবণ কেশাকর্ষণে বলপ্রয়োগ করে। বেদবতীর ভাষায় ধর্ষিতা হওয়ার প্রেক্ষাপটেও ব্রত বিনষ্টির ভয়ে রাবণকে অভিশাপ দেয়নি সে, তবে আগামী জন্মে সতীসাধ্বী অযোনিজা কন্যারূপে জন্মানোর আশাবাদ নিয়ে প্রবেশ করে জ্বলন্ত আগুনে। এরপর রাবণ এই কন্যাকে পেয়েছে পদ্মের ভেতর এবং নিজ প্রাসাদে নেওয়ার পর কন্যা-লক্ষণবিদ অমাত্য জানায় এই কন্যা গৃহে থাকলে সমূহ বিপদ। একথা শুনে রাবণ কন্যাকে নিক্ষেপ করে সাগরে। এই কন্যা পুনরায় জনকের যজ্ঞমণ্ডপের মধ্যবর্তী ভূমিতে উপস্থিত হয়, জনক সেখানে হলকর্ষণের সময় কন্যাটিকে সীতারূপে লাভ করে। সীতার নতুনতর জন্মবৃত্তান্ত জানা গেল; সে সত্যযুগে ছিল বেদবতী, ত্রেতাযুগে সীতা। [উত্তরকাণ্ড: ১৭.৪৩-৪৪]। প্রতিলোমে অত্যাচার বা বলাৎকার মেনে নেয়নি ব্রহ্মক্ষত্রিয় সমাজ; রাবণ সবংশে ধ্বংস হওয়াতে বিদ্যমান সেই দৃষ্টান্ত। নারী তথা কন্যা সংরক্ষণ এবং তার মূল্য দিতে পারে কেবল ক্ষমতাবানই!

 

পাঁচ

ব্রহ্মক্ষত্রিয় পরিমণ্ডলে নারীর স্বাধীন চিন্তা, প্রেম বা যৌনাকাঙ্ক্ষার প্রকাশ দুর্লভ। তারা সুকঠিন পিতৃতান্ত্রিক বন্ধনে আবদ্ধ। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে কন্যারা অধিকতর স্বাধীন, তাদের প্রায়শ মতপ্রকাশের উপযোগী বয়সে অবিবাহিতও দেখা যায়। রাজর্ষি কুশনাভের শতকন্যার বিয়ে হয় ঋষি চূলীর ঔরসে গন্ধর্বী সোমদার গর্ভজাত সন্তান ব্রহ্মদত্তের সঙ্গে। প্রসঙ্গক্রমে ব্রহ্মদত্ত সোমদাপুত্ররূপে অভিহিত। সোমদার সেবায় সন্তুষ্ট ঋষি সোমদারই আগ্রহে বিয়ে করে ব্রহ্মবিধিতে। বিয়ের ব্যাপারে অসংকোচ মতপ্রকাশ হতে পারে গন্ধর্ব সমাজে নারীস্বাধীনতার অধিকতর ব্যাপ্তির দৃষ্টান্ত। এটা একটা দিক। অন্যদিকে, বলা হয়েছে সোমদা বুদ্ধিমতী ও বিদুষী। তাহলে বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ হচ্ছে ব্রাহ্মণ্য সমাজে অন্তর্ভুক্ত হওয়া? মূলত ব্রহ্মক্ষত্রিয়ের আধিপত্য প্রবণতার দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে অনুলোম-প্রতিলোম বিয়ের ধারণা। ব্রাহ্মণ বৈধ বা অবৈধভাবে সবর্ণে ও নিম্নবর্ণের কন্যা গ্রহণ করতে পারে, গুরুতর পাপ হয় না; কিন্তু বিপরীতক্রমে বিয়ে বা সম্পর্ক অসামাজিকতা ও পাপের ধারণায় দণ্ডনীয় অপরাধ। যজ্ঞপন্থী বেদ-অনুসারী ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্রহ্মক্ষত্রিয়েরা মিলিতভাবে বিস্তারপ্রবণতায় বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যবহার করেছে সচেতনভাবে। কন্যারা অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে গোষ্ঠীসম্পর্ক বা রাজনীতির সেতুবন্ধ হিসেবেও। রাজকন্যা বা প্রান্তিক কোনো জনগোষ্ঠীর কন্যার সঙ্গে বিয়ে বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের দ্বারা সন্তান উৎপাদন করছে ব্রাহ্মণ ঋষি-মহর্ষিরা। সোমদার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছে ঋষির ঔরসজাত পুত্রের দ্বারা। সোমদাপুত্র ব্রহ্মদত্ত রাজর্ষি কুশনাভের শতকন্যাকে বিয়ে করতে সমর্থ হয়। ব্যাপারটি দৈব, ব্রাহ্মণ্য বা ঋষিক্ষমতার অংশ হিসেবেও বিবেচ্য, কেননা কন্যাদের বিয়ের পরেই কুব্জভাব কেটে সুস্থতা ফিরে আসে।

বিশ্বামিত্রের কাহিনিতে জানা যায়, পুরাকালে নিঃসন্তান যক্ষ সুকেতু ব্রতপালনের দ্বারা ব্রহ্মার বরে লাভ করে তাড়কা নামে কন্যারত্ন [আদিকাণ্ড: ২৫.৬]। এতে অনুমিত হয় নিঃসন্তান হওয়ার চেয়ে কন্যা লাভ সামাজিকভাবে স্বস্তিকর। অর্থাৎ চাহিদা পুত্রের, তবে বন্ধ্যাত্বের চেয়ে কন্যা ভালো! বর্তমান ক্ষেত্রে কন্যাটি অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে কন্যারত্ন অভিধায়। কাকে বলে কন্যারত্ন? যে কন্যা বা নারীর সামাজিক মূল্য স্বীকৃত হয়; এই মূল্য অবশ্যই পিতার পরিবার থেকে পতির পরিবারেও পৌঁছায়। তাড়কার ক্ষেত্রে কন্যারত্নের পরিচয় তার শক্তিমত্তায়; ব্রহ্মা তাকে হাজার হাতির শক্তিও দান করে, যা তার পিতাকে দেওয়া হয়নি। এত শক্তিমতী হওয়া সত্ত্বেও তাড়কা তার স্বামী, পুত্র ও নিজেকে ব্রহ্মক্ষত্রিয়ের কবল থেকে রক্ষা করতে পারেনি। তাড়কা নিহত হয়েছে বিশ্বামিত্রের নির্দেশে রামের হাতে। রামায়ণ মানছে প্রান্তেই আছে কন্যাদের অধিকতর স্বস্তিকর বিচরণক্ষমতা। তবে তা নেতিবাচকভাবে। নারীর স্বাধীন মতপ্রকাশ, প্রেম বা যৌনাকাঙ্ক্ষা মেনে নেয়নি পুরুষতন্ত্র তথা ব্রহ্মক্ষত্রিয় মতাদর্শ। এ কারণেই রাক্ষসকন্যারা প্রায়শ অতি কামুকী, ব্যভিচারিণী। এমনি দৃষ্টান্ত সূর্পণখা। সূর্পণখার বিয়ে হয় দানবশ্রেষ্ঠ বিদ্যুদ্‌জিহ্বের সঙ্গে কিন্তু রাবণের হাতে মৃত্যুর পর তার পরিপোষণের দায়িত্ব ন্যস্ত হয় জ্ঞাতি ভাই খরের হাতে। অরণ্যকাণ্ডে রাম, স্ত্রী সীতা ও ভাই লক্ষ্মণসহ পঞ্চবটীবনে অবস্থানকালে সূর্পণখার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। রাম সরলভাবে আত্মপরিচয় দানের পর সূর্পণখাকে প্রশ্ন করে: এবারে তোমার পরিচয় জানতে চাইছি। তুমি কার কন্যা। তুমি কে? আর কেই-বা তোমার পতি? তোমাকে তো সুন্দরী রাক্ষসী বলে আমার মনে হচ্ছে। [অরণ্যকাণ্ড: ১৭.১৮]। রাম কেন সূর্পণখাকে সুন্দরী বলছে? ভয়ংকর এক ঠাট্টার মানসিকতা কাজ করেছে রামের ভেতর, যা কর্তৃত্ববাদের বিশেষ ভঙ্গিজাত। দৃশ্যমানভাবে সূর্পণখা স্বাধীন নারী, সে স্পষ্টভাবে বলে: রাম, পুরুষশ্রেষ্ঠ তুমি। আগে তোমাকে দেখেই মনে মনে পতিরূপে বরণ করে তাদের না জানিয়েই আমি এখানে চলে এসেছি। আমার বেশ প্রভাব আছে। আমি ইচ্ছেমতো শক্তিতে চলতে পারি। তুমি চিরকালের জন্য আমার পতি হও। সীতাকে দিয়ে কি করবে? [অরণ্যকাণ্ড: ১৮.২৪-২৫]। এরপর রামের যে তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে সূর্পণখার প্রতি তা কেবল অবিবেচনা নয়, অমানবিক এবং প্রান্তিক মানুষের প্রতি ক্ষমতাবানদের ঔদ্ধত্য। সূর্পণখার প্রেমাবেগ নিয়ে খেলায় মেতে ওঠে রাম ও লক্ষ্মণ;  একসময় লক্ষ্মণের প্রতি প্রেমাকাঙ্ক্ষা প্রকাশের প্রেক্ষাপটে সে কেটে দেয় সূর্পণখার নাক-কান। ব্রহ্মক্ষত্রিয়ের কেন্দ্রীয় সমাজভাবনায় নারীর স্বাধীন ইচ্ছার কোনো মূল্য নাই, প্রেমপ্রকাশের প্রসঙ্গ সেখানে অবান্তর। রামায়ণে যে কয়েকজন নারী স্বাধীনভাবে প্রেমাবেগ, যৌন-ইচ্ছা বা সন্তান কামনা করেছে, তারা বসবাস করে ব্রহ্মক্ষত্রিয় পরিমণ্ডলের বাইরে। ব্রহ্মক্ষত্রিয় পুরুষেরা ধর্ষণে উৎসাহী হলেও নারীর প্রেমাবেগে সাড়া দেয় না। লক্ষণীয়, সূর্পণখা স্বাধীন ভাবপ্রকাশে দীপ্র; তার পূর্ব-বিবাহের কোনো প্রসঙ্গও এখানে উত্থাপিত হয়নি। তাই স্বাধীন কন্যাধর্মেই সে প্রেম প্রকাশে সরল। অথচ লক্ষ্মণ তাকে শাস্তি দিয়েছে ব্যভিচারিণীর দৃষ্টান্তে; প্রাচীন ভারতে ব্যভিচারিতার শাস্তি হিসেবে নাক-কান কেটে দেওয়ার দৃষ্টান্ত আছে, বিশেষত পঞ্চতন্ত্র গ্রন্থে। এখানে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে, কেন বারবার প্রান্তিক নারী কন্যাদের ব্রহ্মক্ষত্রিয় পুরুষদের প্রতি প্রেমপ্রকাশের দৃষ্টান্ত উপস্থান করা হচ্ছে? প্রথমত, প্রান্তিক মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য সুযোগ তৈরি হয় এতে; দ্বিতীয়ত, তৃপ্ত হয় ব্রহ্মক্ষত্রিয় পুরুষের অহং, আধিপত্য, কর্তৃত্ব। পুরুষেরা সহজেই এই নারীদের গ্রহণ করে, বলাৎকারে বিধ্বস্ত করে, কিন্তু সামাজিক স্বীকৃতি দেয় না। অন্যদিকে, নারীসংরক্ষণের নীতি অনুসারে ব্রহ্মক্ষত্রিয়রা তার একজন নারীর অপহরণে লিখে ফেলেছে আস্ত মহাকাব্যরামায়ণ। অরণ্যকাণ্ডেই লক্ষ্মণকে আলিঙ্গনের দ্বারা যৌনমিলনের আহ্বান রাক্ষসী অয়োমুখী। এক্ষেত্রেও লক্ষ্মণ ক্ষুব্ধভাবে অয়োময়ীর নাক কান ও স্তন কেটে দেয় [অরণ্যকাণ্ড: ৬৯.১৭]।

ব্রহ্মক্ষত্রিয়ের কেন্দ্রেও ভিন্নমতের কারণে নির্বিচারে মন্দচরিত্রের দৃষ্টান্ত কৈকেয়ী ও মন্থরা। পুরুষতান্ত্রিক পরম্পরা বা বংশধারা খর্ব হওয়াতে ক্ষুব্ধ হতে পারে সমাজ; কারণ রামকে প্রথম পুত্র ও ধর্মপুত্র বানাতে হয়েছে এবং এ জন্য গোপন করতে করতে হয়েছে শান্তার জন্ম। এমন একটি কৌশলী পরিকল্পনা বিনষ্ট হওয়ায় মন্থরা ও কৈকেয়ীকে ক্ষমা করেনি মতাদর্শবাদী সমাজ; মন্থরাকে বানানো হয়েছে কুব্জাশারীরিকভাবে অব্যবহৃত ও অক্ষম এবং কৈকেয়ীকে বলা হয়েছে মাতৃবৎ অসদাচারী কন্যা। মন্থরা, কৈকেয়ীর পরিবার থেকে প্রাপ্ত দাসীমাত্র, দশরথ-পরিবারে আমৃত্যু অবস্থান অথচ তার দেহ-মন-যৌবন বিনষ্টির কোনো পরিচয় নাই। তার মনোজটিল জীবনধারা বিকাশেরও কোনো সুযোগ নাই রামায়ণে। অন্যদিকে, দশরথ-পরিবারে সার্বিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করা হয় কৈকেয়ীকে। মন্থরার পরামর্শ বা কূটবুদ্ধি, কৈকেয়ীর অতীত প্রসঙ্গ উত্থাপন ও ভরতের রাজপদ প্রাপ্তির কার্যকারণে রামায়ণে এই দুটি চরিত্রে লিপ্ত হয়েছে অমোচনীয় কলঙ্ক। কৈকেয়ীকে শুরুতেই দায়ী করেছে দশরথ; তারপর বোঝানোর চেষ্টা করেছে মন্ত্রী সুমন্ত্র, অথচ কৈকেয়ী তার দাবিতে অনড়। সুমন্ত্র মনে করে কৈকেয়ী তার মায়ের মতোই অসৎ। পূর্বে কৈকেয়ীর পিতা কোনো এক ব্রাহ্মণের বরদানে পশুপাখির ভাষা বুঝার ক্ষমতা লাভ করে। একদিন জৃম্ভ পাখির শব্দ শুনে কৈকেয়ীর পিতা হাসতে থাকায় মাতা এর কারণ জানতে চায়। হাসির কারণ বললে কৈকেয়ীর পিতার মৃত্যু হবে এমন বলার পরও কৈকেয়ীর মাতা তা শুনতে চেয়েছে; কিন্তু বরদানকারী ব্রাহ্মণের পরামর্শে স্ত্রীকে উপেক্ষা করে কৈকেয়ীর পিতা। কাহিনির শেষে সমুন্ত্রের বক্তব্য, কৈকেয়ীও তার মায়ের মতো পাপদশিনী [অযোধ্যাকাণ্ড: ৩৫.২৭] এবং একটি প্রবাদ জানায়: পিতৃন সমনুজায়ন্তে নরা মাতরমঙ্গনাঃ [অযোধ্যাকাণ্ড: ৩৫.২৮]পুত্রেরা পিতার স্বভাব পায়, কন্যারা হয় মায়ের মতো। অসুবিধাজনক অবস্থায় এটিই সম্ভবত রামায়ণীয় কন্যানীতি; বিপরীত দিকে, পুরুষদের কন্যা গ্রহণে বাছবিচার তেমন চোখে পড়ে না।

 

ছয়

মানুষীকন্যার বাইরেও কিছু কন্যা আছে সর্বজনগৃহীত, মান্য; তারা অনেকাংশে রূপক-প্রতীকী। যেমন, সুমেরু পর্বতের কন্যা মেনা; তার দুই কন্যাগঙ্গা ও উমা। দেবতাকার্যের জন্য শৈলরাজের স্ত্রী নির্বাচিত হয় গঙ্গা এবং আবির্ভূত হয় স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে মঙ্গলময় শক্তিরূপে। গঙ্গার দ্বারা কন্যামূল্যের অধিক ভিন্ন এক প্রাকৃতিক শক্তির যোগসূত্র রচিত হয় স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের মধ্যে। দ্বিতীয় কন্যা উমা কঠোর তপস্যার দ্বারা লাভ করে রুদ্রকে। অনুমিত হয়, কন্যাদের মাধ্যমে পর্বতরাজের অনুপ্রবেশ ঘটে স্বর্গীয় বলয় তথা কেন্দ্রীয় শক্তিতে। অন্য এক উপাখ্যানে আছে, সগরের বংশধর ভগীরথ গঙ্গাকে ভূতলে নামিয়ে আনে পিতৃপুরুষদের স্বর্গে যাওয়ার বন্দোবস্তের জন্য। কিন্তু ঘটনাক্রমে গঙ্গার জলে জহ্নুমুনির আশ্রম ও যজ্ঞ ভেসে যাওয়ায় ক্ষিপ্ত জহ্নু উদরস্থ করে গঙ্গার সমস্ত জল। সংকট তৈরি হয় দেবতা, গন্ধর্ব ও ঋষিদের জন্য; তারা অনন্যোপায় হয়ে গঙ্গাকে মেনে নেয় জহ্নুর কন্যা হিসেবে। এভাবে গঙ্গার অপর নাম জাহ্নবী। [আদিকাণ্ড: ৪৩.৩৪-৩৮] কিন্তু, জাহ্নু কি গঙ্গাকে স্পর্শ, ভোগ, দখল বা উদরস্থ করেননি? তাহলে কী অর্থ দাঁড়ায়? স্ত্রী হওয়ার কথা নয়? এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, কেননা গঙ্গা মহাদেবের স্ত্রী হিসেবে পূর্বেই গৃহীত। তদুপরি মহেশ্বরের অসম্মান হয় এমন কাজ বা বার্তা সমাজ ঘোষণা করতে পারে না। অন্যদিকে ভগীরথ ভূতলে নিয়ে এসেছে গঙ্গাকে অর্থাৎ ভগীরথকে অনুসরণ করেছে গঙ্গা। এ জন্য গঙ্গা ভগীরথেরও কন্যা; তার অপর নাম ভাগীরথী। বিশ্বামিত্রের এক বোন সত্যবতী; স্বামীর মৃত্যুর পর সেও স্বর্গগামিনী হয়। বিশ্বামিত্রের মতে, বোন সত্যবতীই এখন কৌশিকী নদী; বোনের প্রতি বিশ্বামিত্রের বিশেষ ভালোবাসাও স্পষ্ট: হিমালয় পর্বতকে আশ্রয় করে আমার ভগিনী ঐ পুণ্যতোয়া নদীরূপে জগতের কল্যাণের জন্য বয়ে চলেছে। তার জলে ভেসে চলে পুষ্পরাজি। তার জন্যে দিদি কৌশিকীর প্রতি স্নেহবশতঃ আমি হিমালয়ের পাশে সংযত হয়ে সুখে বাস করে থাকি। [আদিকাণ্ড: ৩৪.৯-১০] বোনের প্রতি ভাইয়ের এই ভালোবাসা খুব বিস্তৃত নয়, ইঙ্গিতে প্রকাশিত কিন্তু আন্তরিক। পুরুষতান্ত্রিক বর্ণনার কারণেই এই সূত্র বিকাশের অবকাশও তেমন নাই।

প্রকৃতিকন্যার বাইরেও আছে কন্যা-সাধারণী। মনুষ্যসমাজে এরা বেশ্যা, বারাঙ্গনা; আরও আছে বিভিন্ন অনন্তযৌবনা স্বর্গবেশ্যা, অমরলোকে সেব্য এবং মাঝে মাঝে তাদের আবির্ভাব ঘটে মর্ত্যে। অমরত্বের পানীয় অমৃতের আশায় দেব ও দৈত্যকুলের ক্ষীরোদসাগর মন্থনে ওঠে আসে হলাহল, ধন্বন্তরি; এরপরই এসেছে অস্পরাশ্চ সুবর্চসঃ’—উজ্জ্বলকান্তি অপ্সরা। এরা সমুদ্রমন্থনজাত রসোত্থিত হিসেবে অপ্সরা নামে চিহ্নিত; সংখ্যায় ষাট কোটি। দেব বা দানব কেউ গ্রহণ না করায় তারা পরিচিতি পায় সাধারণাঃ নারীর। এরপর ওঠে আসে বরুণের কন্যা বারুণী এবং ওঠেই স্বামী-সন্ধান করতে থাকে। দিতির পুত্র দৈত্যেরা গ্রহণ না করলেও অদিতির পুত্র আদিত্য তথা দেবতাদের দ্বারা সাদরে গৃহীত হয়। ফলে, সুরকন্যা বারুণীকে গ্রহণ না করায় দৈত্যেরা পরিচিতি হয় অসুর, এবং গ্রহণ করায় দেবতারা সুর। [আদিকাণ্ড: ৪৫.৩৮]। সাধনায় অন্তরায় সৃষ্টির জন্য ইন্দ্র কন্যা-সাধারণী বা স্বর্গবেশ্যাদের বিভিন্ন সময় কামফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করেছে; বিশ্বামিত্রই দুইবার সাধনায় ব্যর্থ হয় মেনকা ও রম্ভার কামফাঁদের কারণে। ভরত, রামের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বনযাত্রায় একরাত অবস্থান করেছে ভরদ্বাজমুনির আশ্রমে। ভরদ্বাজমুনি তাদের অলৌলিক উপায়ে আপ্যায়ন ও সেবার ব্যবস্থা করে। বিভিন্ন খাবারের মধ্যে ছিল উৎকৃষ্ট মদ্য; পরিবেশনের দায়িত্বে ছিল বিভিন্ন অপ্সরা ও গন্ধর্বনারীঘৃতাচী, বিশ্বাচী, মিশ্রকেশী, অরম্বুষা, নাগদত্তা, হেমা, সোমা প্রমুখ। এর মধ্যে অপ্সরা সাধারণ নারী; গন্ধর্বেরা অবশ্য পারিবারিক জীবনযাপন করে। ভরদ্বাজ নারীদের ব্যবহার করেছেন পুরুষের বিভিন্ন সেবায়, এর মধ্যে যৌনতার ইঙ্গিত স্পষ্ট [অযোধ্যাকাণ্ড: ৯১.৫১-৫৪]। রামের রাজ্যাভিষেকে আনা হয়েছে বিবিধ মাঙ্গলিক দ্রব্য; এর মধ্যে আছে অষ্টৌ চ কন্যা রুচিরা [অযোধ্যাকাণ্ড: ১৫.৮]আটটি সুন্দরী কন্যা। কন্যা কেন মাঙ্গলিক বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হলো? নৃত্যের জন্য আনা হয়েছে এটা নিশ্চিত। তাই মনে হয়, এই কন্যারা কুমারীধর্মে সৃষ্টি ও পবিত্রতার আদি মেলবন্ধনের ইঙ্গিত দিচ্ছে; কন্যা-সাধারণী হওয়াও অসম্ভব নয়। যুদ্ধকাণ্ডে সীতা উদ্ধারে পর অযোধ্যায় রামের সম্বর্ধনার জন্য গণিকাদেরও যুক্ত করা হয়েছে [যুদ্ধকাণ্ড: ১২৭.৩]।

যুদ্ধকাণ্ডে মহাপার্শ্ব বলপূর্বক সীতাকে উপভোগের আহ্বান জানায়। কিন্তু রাবণ এ বিষয়ে ভীত, কেননা, একদা পুঞ্জিকাস্থলা অপ্সরাকে বলাৎকার করায় ক্ষুব্ধ ব্রহ্মা তাকে অভিশাপ দেয়: আজ থেকে তুমি অন্য কোনো নারীকে যদি জোর করে উপভোগ করো, তাহলে তোমার মস্তক শতধা বিদীর্ণ হয়ে যাবে, এতে কোনো সংশয় নাই। [যুদ্ধকাণ্ড: ১৩.১৪]। স্বর্গবেশ্যাও সর্বভোগ্যা নয়, বলাৎকার অধিকারবহির্ভূত ব্যাপার। এই মৌলিক নীতিটি বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে কর্তৃত্ববাদী বলয়ে। তবে পুরুষের অভিমান প্রেমের অধিক; তারা একাধিক প্রেম বা বিয়েতে উন্মুখ ও পারঙ্গম কিন্তু নারী বা কন্যার নিকট থেকে দাবি করে একক অভিনিবেশ বা আনুগত্য। উর্বশীকে একদা ক্ষীরসমুদ্রে জলকেলি করতে দেখে বরুণ কামোত্তেজনাবশত তাকে যৌনমিলনের জন্য আহ্বান জানায়। উর্বশী এতে অপারগতা প্রকাশ করে, কেননা মিত্রদেব তাকে আগেই প্রার্থনা করেছে। [উত্তরকাণ্ড: ৫৬.১৬]। স্বর্গবেশ্যা উর্বশীর নৈতিকতা লক্ষণীয়ভাবে স্পষ্ট, সরল। অবশ্য কামোত্তেজিত বরুণ উপায়হীন, উর্বশীদর্শনে অস্থির; শেষ পর্যন্ত স্বমেহনের আশ্রয় নিতে হয় তাকে। উর্বশী অবশ্য শেষ পর্যন্ত বরুণকে সান্ত্বনা দেয় বিশেষ কলাকৌশলে: আমার চিত্ত আপনার প্রতি নিতান্ত আসক্ত। আপনারও অধিক অনুরাগ আমাতে। পরন্তু এই দেহ সম্প্রতি মিত্রদেবের অধীন। [উত্তরকাণ্ড: ৫৬.২০]। এই বক্তব্যের কারণে অর্থাৎ মনে আর দেহে ভিন্ন পতিত্বের কার্যকারণে মিত্রদেব অভিশাপ প্রদান করে উর্বশীকে। উর্বশী স্বর্গ থেকে মনুষ্যলোকে আবির্ভূত হয়ে পুরূরবার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবে। এ ক্ষেত্রে বোঝা যাচ্ছে মনুষ্যকন্যার জীবন অভিশপ্ত!

রামায়ণের কন্যা-প্রসঙ্গ এই পর্যন্ত!