ঊনসত্তরের অনালোচিত ইতিহাসের সন্ধান

 

[বিরোধীরা] নিজেরা কি তাদের এই নিষ্ফলা, নেতিবাচক এবং বিক্ষুব্ধ মনোভঙ্গির ভয়াবহ পরিমাণটা বোঝে? তারা সাবধান না হলে এই সব বিক্ষোভের পরিণতি হবে সম্পত্তিবানের সাথে সম্পত্তিহীনের যুদ্ধ, সেটা তাদের সবাইকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।...’
জেনারেল আইয়ুব খান, ৬ জানুয়ারি, ১৯৬৯; বিরোধীদের মাঝে যারা তারা ভাষায় প্রকৃতিস্থ, তাদের মতিগতি বুঝতে শাহাবুদ্দীনকে ঢাকা পাঠানো প্রসঙ্গে।

 

আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান কীভাবে গদিচ্যুত হলেন, তার ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে নূরুল কবীর রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের শেষ অধ্যায়টির একটি রাজনৈতিক মূল্যায়ন হাজির করেছেন তাঁর ডিপোজিং অব আ ডিক্টেটর: রিভিজিটিং আ ম্যাগনিফিসেন্ট আপরাইজিং আফটার ফিফটি ইয়ারস নামের বইটিতে। এই আলাপের শুরুতে এই কথা প্রথমে না বলে রাখার উপায় নেই যে নূরুল কবীরের এই কাজ নিয়ে বাংলা বা ইংরেজি ভাষায় বলবার মতো কোনো গ্রন্থালোচনা মিলবে না। এই তথ্য একদিকে আমাদের জানিয়ে দেয় বাংলাদেশে এমনকি বই নিয়ে আলোচনাও কোনো নিরীহ বিষয় নয়, নানান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যাকরণ তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্যদিকে বইটি নিয়ে গভীর নীরবতার পরও মাত্র দুই বছরে [প্রথম মুদ্রণ জানুয়ারি ২০২০, তৃতীয় মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০২১] দুটি মুদ্রণ নিঃশেষ হয়ে তৃতীয় মুদ্রণের আগমন এটাও প্রমাণ করে যে উনসত্তুরের প্রবল সেই গণ-অভ্যুত্থানের আলোড়ন এখনো পাঠকের মনে গভীর সংবেদন তৈরি করতে সক্ষম।

নূরুল কবীরের এই বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি পাঠকপ্রিয়তা পাওয়ার পরও এই গুরুত্বপূর্ণ বই কেন এতটা অনালোচিত হলো, সেটির অনুসন্ধান। বাংলাদেশের বিদ্যমান বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতিকে বুঝতে সেটা আমাদের খানিকটা সহায়তা করবে, এমনকি সাহায্য করবে বইটির বিষয়বস্তুর তাৎপর্যকেও নতুনভাবে উপলব্ধি করতে। কেননা এটাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে দুটি প্রবল ও সমান্তরাল ধারা মুক্তির সংগ্রামে বিরাজমান ছিল, তার একটির আপাত-অপসৃত হবার রহস্যটিকেও বুঝতে সাহায্য করবে। মূল আলাপের আগে তাই সেই নীরবতা ও আলাপহীনতা বিষয়ে কিছু আলাপ হোক।

এই আলাপহীনতার দুটি মুখ্য কারণ থাকতে পারে, যে দুটি কারণ একত্রে যুক্ত থেকে কিংবা পৃথক পৃথকভাবেই  বলা যায়, নূরুল কবীরের এই গ্রন্থটিতে তোলা ইতিহাসের অস্বস্তিকর অধ্যায়গুলোকে পরিহার করে যেতে চায়। এই দুটি সম্ভাব্য কারণের মাঝে একটি হতে পারে এই যে বইটি আমাদের ইতিহাসে আড়ালে পরে থাকা অতিকায় সব পর্বকে ঢেকে রেখেছে যে চাদরটি, তাকে সবলে সরিয়ে দিয়েছে। গ্রন্থটি পাঠ করলে বেশির ভাগ পাঠক বুঝতে পারবেন আমাদের চেনা ইতিহাসের একটা বড় অংশই জোড়াতালি দিয়ে সাজানো, এবং সেই সব জোড়াতালির আশ্রয় নেওয়ার প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ব্যাকরণ আছে। এই গ্রন্থে নূরুল কবীর বাংলাদেশের ইতিহাস ব্যাখ্যায় যে প্রকল্পের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তার গুরুত্বপূর্ণতম প্রায় সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ তিনি সংগ্রহ করেছেন ইতিহাসবিষয়ক সম্পূর্ণ অনালোচিত পক্ষেকার মানুষদের কাছ থেকে। সেই অর্থে নূরুল কবীরের এই গ্রন্থটিতে প্রায় কোনো নতুন তথ্যের উল্লেখ নেই; বরং তিনি অন্যদের লেখা, বিশেষ করে উনসত্তুরের ঘটনাপ্রবাহের মাঝেই ছিলেন, এমন ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণাকেই তার প্রধান সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বইটির শেষে দেওয়া গ্রন্থপঞ্জি দেখলে বোঝা যাবে, উনসত্তুর নিয়ে যাঁদের উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাঁদের প্রায় কেউই পরবর্তীকালের গবেষক নন, বরং তাঁরা মূলত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাহলে নূরুল কবীরের কৃতিত্ব কী? সেটা প্রধানত এই যে নূরুল কবীর নানান স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই বিপুল পরিমাণ আকরিক থেকে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোকে ব্যবহার করে একটা প্রকল্প হাজির করেছেন আজকের পাঠকের সামনে। এভাবে তাঁর কাজের একটি বৈশিষ্ট্য বেশ গুরুতর কৌতুকেরই জন্ম দেয়: অজস্র সাক্ষ্য ও নিদর্শনের ভিত্তিতে নূরুল কবীর তাঁর প্রকল্পটিকে দাঁড় করালেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তিনি তাঁর প্রকল্পের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণতম প্রমাণগুলো হাজির করেছেন আপাতদৃশ্যে এই প্রকল্পের বিপরীত ধারার ব্যক্তিদের জবানিতে। ফলে এই বইতে ঐতিহাসিক যুক্তির যে ইটগুলো পরপর তিনি সাজিয়ে তাঁর সৌধটি নির্মাণ করেছেন, সেটি অনেকটাই দুর্ভেদ্য। এই রকম একটি বইকে মোকাবিলা করার চাইতে তাই তা নিয়ে চুপ করে থাকাই শ্রেয়, ডিপোজিং অব আ ডিক্টেটর নামের বইটিকে নীরবতায় এড়িয়ে যাওয়ার এমন কৌশলের আশ্রয় নেওয়ার এটুকুই যথেষ্ট কারণ হতে পারে।

সম্ভাব্য দ্বিতীয় একটি কারণ হলো বিদ্যমান ভয়ের সংস্কৃতি। বইটিতে ব্যক্ত ঐতিহাসিক প্রকল্পটিকে আলোচনায় আনা মানেই বিরাজমান শাসকের বিরাগভাজন হবার মতো কারণের জন্ম দেওয়া। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তির জগৎজুড়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি একটা সুনসান নীরবতা, ডিপোজিং অব আ ডিক্টেটর বইটি ছাড়াও আরও অনেক গুরুতর বিষয় নিয়েও। সম্ভবত এই নীরবতা আইয়ুব শাহীর সময়ের চেয়েও বহুগুণ বেশি ভারী! ইতিহাস চর্চাকে স্বৈরশাসকেরা সর্বদাই পরিণত করেন বুদ্ধিবৃত্তিক রণাঙ্গনের প্রধান ক্ষেত্রে। ফলে এটা একদমই কাকতালীয় নয় আলোচ্য এই বইটির মতোই বইটির বিষয়বস্তুওঅর্থাৎ উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থানবাংলাদেশের ইতিহাসে সবচাইতে অনালোচিত, অথচ অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত একটি অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অনেক জনপ্রিয় গ্রন্থের দেখা মিলবে যেখানে উনসত্তুর নিয়ে প্রায় কোনো কথা নেই, থাকলেও এত বড় আলোড়নের কোনো তাৎপর্যই অনুভব করা যাবে না। মুহম্মদ জাফর ইকবাল রচিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তেমন বইয়ের একটি উদাহরণ।

উনসত্তুর নিয়ে এই নীরবতা কিংবা অল্পকথায় এর ইতিহাস শেষ করে ফেলার কারণ অন্য কিছু নয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই একজন মাত্র নেতার একক ভূমিকা প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশকে শাসনের অধিকারের ওপর একটিমাত্র দলের একচ্ছত্র আধিপত্যের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা, এবং দেশটির ওপর একটি পরিবারের প্রশ্নাতীত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য যে ইতিহাস প্রকল্পকে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, তারই অংশ এটি। সরকারি এই ইতিহাস প্রকল্পকে দরবারি একজন ইতিহাসবিদ রীতিমতো এভাবেই সারসংক্ষেপ করেছেন বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীন করে গেছেন। ইতিহাস চেতনার এই বীজটিই নানান ব্যাখ্যার ডালপালা মেলে মোসাহেব বুদ্ধিজীবীদের নানা লেখাপত্রের কেন্দ্রীয় যুক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে আসছে নানান সময়ে: জাতি গণতন্ত্রের যোগ্য না, তাই মাঝরাতে ভোট করে গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনকদের ঠেকিয়ে রাখা বৈধ; জাতি স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত না, তাই স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য গণমানুষকে পরাধীন করে রাখতে হয়; জাতি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেহেতু জানে না, তাই ইতিহাস বিকৃতি ঠেকাবার জন্য আইন তৈরি করতে হয়। বস্তুত অপ্রস্তুত জাতির এই তত্ত্বায়ন যাবতীয় দমনমূলক আইন, যাবতীয় দখলদারত্ব এব্ং সাথেকার আর সকল জবরদস্তির সংস্কৃতির সাথেই সংশ্লিষ্ট। অপ্রস্তুত ও অযোগ্য জাতিকে পথে রাখবার জন্যই এমনকি যেকোনো অপশাসন, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তপরায়ণতাকে বৈধতা দেওয়া হয় মন্দের ভালো কিংবা বিকল্পহীন বাস্তবতা হিসেবে। অপ্রস্তুত জাতির এই ইতিহাস প্রকল্পের অপরিহার্য পরিপূরক হলো এমন একটি মতাদর্শ, যেখানে কোনো মহান ত্রাতা জাতিকে মুক্ত করার কাজটি এককভাবে করে দিয়েছেন, জাতির কোনো আলাদা কর্তাসত্তা ছিল না, ততটা সক্রিয় আগ্রহ ছিল না, কার্যকর সক্রিয়তাও ছিল না, চেতনাও না। তাদের বেঁধে দেওয়া মুদ্রণ-সীমায় বড়জোর একক ত্রাতার সাথেকার কিছু সঙ্গীসাথীর আলোচনাই জাতির মুক্তির আলোচনায় ঠাঁই পেতে পারে।

নূরুল কবীরের ডিপোজিং অব আ ডিক্টেটর: রিভিজিটিং আ ম্যাগনিফিসেন্ট মাস আপরাইজিং আফটার ফিফটি ইয়ারস সরকারি সেই ইতিহাস প্রকল্পকে চুরমার করে দিয়েছে, গণমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে বুঝিয়ে দিয়েছে তার প্রাপ্য মর্যাদা, কেড়ে নেওয়া কর্তাসত্তাকে তাদের কাছে ফেরত দিয়েছে যাদের কাছ থেকে তা চুরি করা হয়েছিল, সেই জনগণকে। জনগণের সেই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছিল যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝে, তাদেরও ভূমিকার ওপর যথাযথ আলো ফেলে দেখিয়ে দিয়েছে উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থান ও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে যে মানুষটিকে নিয়ে প্রায় কোনো আলাপ হয়নি, সেই মওলানা ভাসানী তাঁর সমকালীন ইতিহাসে কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ফলে ক্ষমতা-সংশ্লিষ্ট সকল পরিসরে এই বইটিকে যে ব্রাত্য করে রাখা হবে, যথাসম্ভব সেটিকে অনালোচনার অন্ধকারে সরিয়ে রাখা হবে, সেটি একরকম অনিবার্যই ছিল।

দ্বিতীয় সম্ভাব্য কারণটি আসলে প্রথম কারণটিরই ধারাবাহিকতা: এমনকি নূরুল কবীরের মূল্যায়নের সাথে সম্পূর্ণাংশে একমত কেউ হন বা না হন, কোনো মূলধারার বাংলা পত্রিকার সম্ভব হবে না ইতিহাসের এই বিচারমূলক পর্যালোচনা কিংবা ভিন্নমতকে ন্যায্য জায়গা বরাদ্দ করা, অন্তত এই প্রবল জবরদস্তির কালে। ওদিকে নূরুল কবীরও আইয়ুব শাহীর গদি উল্টে দেওয়া উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থানের ৫০তম বার্ষিকীতে ইতিহাসকে কোনো পুরোনো প্রসঙ্গ হিসেবে চর্চা করেননি, বরং এই ইতিহাস কেন আজও সমকালীন, কেন একই রকম প্রাসঙ্গিক, সেই কথাটিই গুরুত্বের সাথে বারবার বলেছেন। পুরো বইটির উত্থাপনের ধরনের মাঝেই কোনো ইতিহাস সচেতন পাঠক বারবার অনুভব করতে থাকবেন যে ইতিহাসের একটি বই পড়তে গিয়ে তিনি যেন সমকালের রাজনীতির রাষ্ট্রনৈতিক বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন পাঠ করছেন। ফলে সেই অর্থে গ্রন্থটির নামটিই যথেষ্ট উসকানিমূলক, বিপজ্জনকও। আশ্চর্যের কিছু নেই যে একজন স্বৈরাচারকে গদিচ্যুত করা বিষয় নির্দোষ ঐতিহাসিক বিবরণী থাকেনি ডিপোজিং অব আ ডিক্টেটর, বরং হয়ে উঠেছে রাজনীতির শাস্ত্রের ব্যাকরণ পাঠের একটি অভিজ্ঞতার মত, যার প্রধানতম শিক্ষাটি হলো কখনো ভরসা হারানো যাবে না।

আবুল মনসুর আহমদকে উদ্ধৃত করে নূরুল কবীর জানিয়েছেন, রাজনীতিবিদদের দুবর্লতা সামরিক বাহিনী প্রধানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পথকে প্রশস্ত করেছিল। এই দুর্বলতার নিদর্শন একদিকে ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রটাকে জন্ম দেওয়া মুসলিম লীগ দলটিরই ৫৪ সালের নির্বাচনে সমূলে উৎখাত হয়ে যাওয়ার ফলে ঢাকার নবাব পরিবারকে ঘিরে সামন্ত অভিজাত শ্রেণিটির জনবিচ্ছিন্নতার এবং অক্ষমতার চিত্র, আরেকদিকে ছিল অতি ক্ষুদ্র ও হতবল মধ্যবিত্ত শ্রেণির পক্ষে কোনো রাজনৈতিক শক্তি আকারে দাঁড়ানো সম্ভব না হওয়া, এবং এই ছোট অংশটিরও নিজেদের ভেতরে ক্ষমতার তীব্র কামড়াকামড়িতে লিপ্ত থাকা

রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিবেচনায় একটা হতাশার কালে নূরুল কবীর রচনা করছেন ৫০ বছর আগেকার একটি রাজনৈতিক আলোড়নের ইতিহাস। কেন? যে উদ্দেশ্য থেকে নূরুল কবীর এই বই লিখতে চেয়েছেন, তা তিনি কোনোভাবেই গোপনও করেননি। বইটির প্রস্তাবনা অধ্যায়টির শিরোনামটিকে যেমন বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়াবে গণপ্রতিরোধের শক্তিতে ভরসা ফিরে পাওয়া। এই প্রসঙ্গে তিনি উদ্ধৃত করেছেন প্রখ্যাত মার্কিন ইতিহাসবিদ হাওয়ার্ড জিনকে, যিনি বলেছিলেন কেবল চরম খারাপটাই দেখতে থাকলে তা আমাদের কিছু একটা করবার সামর্থ্যকেও নষ্ট করে দেয়। বরং আমরা যদি জনগণ মহান কীর্তি স্থাপন করেছিল এমন সব সময় আর স্থানের স্মৃতিচারণা করিআর সে রকম ঘটনা অজস্রই আছেসেটা আমাদের কাজ করে যাওয়ার শক্তি জোগায়।

প্রেরণার শক্তির কথাই বলেছেন এখানে হাওয়ার্ড জিন, এবং অন্য কোনো হাতিয়ারের চাইতে কম শক্তিশালী যে নয় সেটা, তা আমরা সকলেই কমবেশি জানি। প্রেরণার অফুরান উৎসও বটে উনসত্তুর; তবু শুধু প্রেরণার সন্ধানে আমরা তো আরও বহু কিছুর কাছেই যেতে পারতাম, আছে আরও অজস্র বীরত্বব্যঞ্জক ঘটনা, আছেন তাঁর নায়কেরা। উনসত্তুর শুধু প্রেরণারই উৎস নয়, বরং এমন একটা ইতিহাসের যুদ্ধক্ষেত্র, যার অনেকটাই চাপা দেওয়া হয়েছে, খানিকটা দখল করা হয়েছে। উনসত্তুরের সেই রাজনৈতিক অব্স্থার সাথেও বর্তমান বাস্তবতার রয়েছে আশ্চর্য মিল। এটা আমাদের ভবিতব্যই ছিল হয়তো। জনতার সেই প্রবল আলোড়ন কী করে শেষ পর্যন্ত গণশত্রুদের হাতে স্তিমিত হলো, সেই ইতিহাসও নূরুল কবীর এই গ্রন্থের শেষ অধ্যায়টিতে, অর্থাৎ উপসংহারে লিখেছেন, যেটির নাম বাংলায় হতে পারে পুরাতন ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং অতঃপর। এমনকি রাষ্ট্র বদলে গেলেও কাঠামোগত কিছু খোলস পরিবর্তন করে পুরাতন রাষ্ট্রযন্ত্রটিরই এই পুনঃপ্রতিষ্ঠা এত অবিকল আকারে স্বাধীন বাংলাদেশেও সম্ভব হয়েছিল কী করে, তার প্রক্রিয়াটি আমাদের জানতে হলে ইতিহাসের এই অধ্যায়গুলোর কাছে আমাদের ফিরে ফিরে আসতে হবে। নূরুল কবীর সেই কাজটি আমাদের জন্য আরেকবার করেছেন এই গ্রন্থে। তাঁর সিদ্ধান্তটি পরিষ্কার, উনসত্তুর সে সম্ভাবনা তৈরি করেছিল, তার বাস্তবায়ন করা যায়নি বলেই প্রায় একই ধরনের বাস্তবতায় আমাদের আবারও পতিত হতে হচ্ছে। ফলে উনসত্তুর শুধু প্রেরণার জ্বালানি দিয়ে নয়, সংকট চিহ্নিত করে এবং তা উত্তরণের শিক্ষা ও দিশা দেখিয়েও আমাদের জন্য এতটা প্রাসঙ্গিক, এই অর্ধশতাব্দী পরও।

ডিপোজিং অব আ ডিক্টেটর: রিভিজিটিং আ ম্যাগনিফিসেন্ট মাস আপরাইজিং আফটার ফিফটি ইয়ার্স পড়তে গেলে পাঠক শুধু যে ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহের ব্যাখ্যাটাই পান তা-ই নয়, নূরুল কবীরের ব্যাখ্যাপদ্ধতির কল্যাণে তা একটা চিরকালীনতাও পায়। ইতিহাসের হুবহু পুনরাবৃত্তি ঘটে না এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও খুবই সত্যি যে ইতিহাসের কিছু সাধারণীকৃত সত্য আছে, যেটা সব কালের, সব যুগের জন্য প্রযোজ্য। সেই সত্যগুলো স্বৈরাচারদের জন্য, তাদের মোসাহেবদের জন্য খুবই অস্বস্তিকর। অমোঘ জেনেই তারা সেটাকে প্রাণপণে দূরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে, তাদের মাঝে নির্বোধরা সেটা করে সশব্দে, বুদ্ধিমানতররা নীরবে। সেটাই বইটি নিয়ে সুনসান নীরবতার কারণ।

 

বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ের বিষয়বস্তু পাকিস্তানের প্রথম অবৈধ ক্ষমতা দখল, যেটির বৈশিষ্ট্যকে নূরুল কবীর চিহ্নিত করেছেন আ ডিকেড অব অপ্রেসিভ সাইলেন্স বা দুর্বিষহ নীরবতার এক দশক হিসেবে। তার বিবরণ থেকে দুর্বল রাজনৈতিক কাঠামোর পাকিস্তান দেশটিকে ঠিকঠাকই চেনা যায়, যেখানে ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতা থেকে পাওয়া আমলাতন্ত্র ও সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের বাকি সব অংশের চেয়ে সব দিক দিয়েই ছিল তুলনামূলকভাবে সংগঠিত, শক্তিশালী এবং সঙ্গত কারণেই উচ্চাভিলাষী। আবুল মনসুর আহমদকে উদ্ধৃত করে নূরুল কবীর জানিয়েছেন, রাজনীতিবিদদের দুবর্লতা সামরিক বাহিনী প্রধানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পথকে প্রশস্ত করেছিল। এই দুর্বলতার নিদর্শন একদিকে ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রটাকে জন্ম দেওয়া মুসলিম লীগ দলটিরই ৫৪ সালের নির্বাচনে সমূলে উৎখাত হয়ে যাওয়ার ফলে ঢাকার নবাব পরিবারকে ঘিরে সামন্ত অভিজাত শ্রেণিটির জনবিচ্ছিন্নতার এবং অক্ষমতার চিত্র, আরেকদিকে ছিল অতি ক্ষুদ্র ও হতবল মধ্যবিত্ত শ্রেণির পক্ষে কোনো রাজনৈতিক শক্তি আকারে দাঁড়ানো সম্ভব না হওয়া, এবং এই ছোট অংশটিরও নিজেদের ভেতরে ক্ষমতার তীব্র কামড়াকামড়িতে লিপ্ত থাকা। এর বাইরে বাস্তবতা আকারে হাজির ছিল দুর্বল অস্তিত্বের শ্রমিকশ্রেণি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক জনগোষ্ঠীর কোনো রাজনৈতিক সংগঠন আকারে প্রতিনিধিত্ব না থাকা।

অবিকশিত ও দুর্বল মধ্যবিত্ত শ্রেণিটির প্রতিনিধিস্থানীয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা পারস্পরিক প্রতিযোগিতা ও অন্তঃকলহের মধ্য দিয়ে এমন সুযোগ করে দেন, যাতে অনির্বাচিত কিন্তু সংগঠিত রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর পক্ষে নিজেদের ক্ষমতার কেন্দ্রে স্থাপন করাটা সম্ভব হয়। এই ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে কিছু প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ পাকিস্তানে হয়েছিল বটে, কিন্তু কারাদণ্ড, বেত্রাঘাত, চাকরিচ্যুতি ও আরও নানান ধরনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মাধ্যমে সেগুলোকে বেশ সহজেই দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন জরুরি অব্স্থা জারি করে ইস্কান্দার মির্জাকে হটিয়ে গদি দখলে নেওয়া আইয়ুব খান। দেশটির আসল ক্ষমতার মালিক বেসামরিক ও সামরিক আমলাতন্ত্রের জন্য কেন সামরিক অভ্যুত্থান প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছিল? এর একটা তাৎপর্যপূর্ণ কারণ নূরুল কবীর বলেছেন উনসত্তুরের একজন বিখ্যাত ছাত্রনেতা তারিক আলীকে উদ্ধৃত করে: ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের প্রথম অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হতে না দেয়ার যে তাড়না আমলাতন্ত্রের মাথায় চাড়া দিয়ে উঠছিল, সেটাই ছিল পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবরের অভ্যুত্থানের প্রধান কারণ। আশু একটা নির্বাচনের সম্ভাবনা জনসাধারণের মাঝে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছিল, আর এর ফলে বিরোধী দলের নেতারা বিপ্লবাত্মক সব সংস্কারের অঙ্গীকার করতে প্ররোচিত হচ্ছিলেন... জনমতের এই প্রকাশগুলোকে কিছুটা ছাড় দিতেই হতো পাকিস্তানের নির্বাচিত যে কোন সরকারকে, একইসাথে আমলাতন্ত্রের প্রভাব মোকাবেলায় এবং সামরিক বাহিনীর ওপর বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টাতেও একটা নির্বাচিত সরকার অনেক বেশি আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠতো। ফলে একদিকে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের কায়েমি স্বার্থরক্ষায় এই অভ্যুত্থান প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল, অন্যদিকে অবিকশিত, দুর্বল ও অন্তঃকলহে লিপ্ত বেসামরিক নেতৃত্বের পক্ষে তাকে ঠেকানোও সম্ভব ছিল না। সবচেয়ে বড় অভাবটি ছিল সংগঠিত শ্রমিক ও কৃষক রাজনীতির, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে, যেকোনো সময়ে, যারা স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় শক্তি।

খুব সংক্ষেপে বললে এটাই দাঁড়ায়, উপনিবেশ উত্তর রাষ্ট্রগুলোতে আমলাতন্ত্র ও সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী অংশগুলো নির্বাচিত এবং বেসামরিক রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধীনে যাবার চেয়ে, জনগণকে সম্পদের ভাগ দেওয়ার চেয়ে, নিজেরাই যথাসম্ভব এককভাবে ক্ষমতা ও সম্পদের ওপর দখলদারত্ব কায়েম করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকে। কিন্তু বিষয়টা আবার অতটা সহজও না। এই আমলাতন্ত্র ও সেনাবাহিনীর একটা সঙ্কটের দিক হলো তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার বৈধতা বা গ্রহণযোগ্যতা নাই। ফলে সেই নৈতিক বৈধতা পেতে কখনো তারা আইয়ুবের মতো মৌলিক গণতন্ত্র নামের প্রহসনের উদ্ভাবন করেন, কখনো তারা আগের রাতেই ভোটের আয়োজন করেন। কিন্তু এসবের মধ্য দিয়ে যে সরকারটা গঠিত হয়, জনসম্মতি নেই বলেই তাদেরকে পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দমনের শক্তির ওপর, সম্মতির অভাবকে পূরণ করতে হয় নিপীড়নের হাতিয়ারগুলোকে চরম মাত্রায় সক্রিয় করে। বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে অংশটুকু এই প্রক্রিয়ায় সম্মতি দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে, তারা তখন পরিণত হয় সামরিক-বেসামরিক আমলা শাসনের ছোট তরফের অংশীদারে।

নূরুল কবীর সঙ্গত কারণেই আইয়ুব উৎখাতের কাহিনি লিখতে গিয়ে আইয়ুবী শাসনের রাষ্ট্রনৈতিক বিবরণও দিয়েছেন। স্বৈরশাসনে-স্বৈরশাসনে হুবহু মিল বা সাদৃশ্য আশা করাটা অবান্তর বলেই এই ইতিহাসের পাঠ আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, কেননা মিলিয়ে নিলে পার্থক্যের জায়গাগুলো যেমন স্পষ্ট হবে, নতুন সময়ের নতুনতর করণীয়ও নির্ধারণ সহজ হবে। যেমন নূরুল কবীর জানিয়েছেন অধিকাংশ পূর্ব বাংলাভিত্তিক পত্রিকা ছাত্র আন্দোলনের গণতান্ত্রিক দাবিগুলোকে সমর্থন করত বলে আইয়ুবের সামরিক সরকার ১৯৬৩ সালে প্রেস ও পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স জারি করেন। উল্টো দিকে, আজকে স্বাধীন বাংলাদেশে গণমাধ্যমের প্রায় নিঃশর্ত আনুগত্যের কালেও দেখতে পাই নিত্যনতুন আইন প্রণয়ন করে গণমাধ্যমকর্মীদের এবং বিশেষ করে লেখালেখির সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির বন্দোবস্ত

প্রবল একটা স্বৈরশাসন একটা জাতির সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা করে, সেটা হলো রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণের সকল পথ ও উপায়কে সে কেড়ে নিয়ে একটা অনুগত, ভীরু এবং প্রতিবাদে অক্ষম জনগোষ্ঠী তৈরি করার চেষ্টা করে। এই অঞ্চলের ইতিহাসে আইয়ুবের শাসন তার অন্যতম দৃষ্টান্ত। অন্যদিকে স্বৈরশাসনের এই তৎপরতা যে শেষ পর্যন্ত সফলও হয় না, তারও অন্যতম দৃষ্টান্ত আইয়ুব খানের পতন।

একটা গণতান্ত্রিক সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হবার কথা যেখানে রাষ্ট্র যাঁরা চালাচ্ছেন, তাঁরা থাকবেন বিনয়ী ও জবাবদিহিমূলক, জনগণ থাকবেন নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন। অন্যদিকে একটা স্বৈরশাসনের লক্ষ্য থাকে ঠিক তার বিপরীত একটা জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা। আগেই বলেছি, শেষ বিচারে এই কাজে স্বৈরশাসন সক্ষম হয় না। কিন্তু যত দূর সে এতে সক্ষম হয়, তত দূর পর্যন্ত তা ওই জাতির মননে একটা ক্ষতিকর ছাপ রাখে, জাতীয় অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিকে তত দিন পর্যন্ত বাধাগ্রস্ত করে। প্রতিবাদের সংস্কৃতি দমনে স্বৈরশাসক যত দূর পর্যন্ত সফল, তত দূর পর্যন্তই একটা জনগণ আত্মপরিচালনায় অক্ষম এবং দর্শকের ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হয়। আইয়ুবী প্রশাসন ও তার মৌলিক গণতন্ত্রী নামধারী গুণ্ডাতন্ত্র ছিল আত্মবিশ্বাসী, অন্যদিকে অনেক বড় বড় রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীও তত দিনে জনগণের শক্তির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। অধিকাংশ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও কূটনৈতিক মহলে আইয়ুবের পরিচয় ছিল লৌহমানবের, যাকে টলানো সম্ভব নয়। ১৯৬৮ সালের ২৩ অক্টোবর তারিখে আইয়ুব খানের দিনপঞ্জিটাতে তেমনই নিশ্চিন্ত একটি মনের পরিচয় মেলে, যেদিন তিনি তার উন্নয়নের বিপ্লবের দশক পালনে গণমাধ্যমে জাতির সামনে বক্তৃতার খসড়া লিপিবদ্ধ করছেন। এর ঠিক কয়েক দিন পরই ১১ নভেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের ল্যান্ডিকোটালে চোরাকারবারি জিনিসপত্র থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া গর্ডন কলেজের শিক্ষার্থীদের বিবরণও তিনি দিয়েছেন মাত্র একটি বাক্যে। তখনো আইয়ুব খান জানেন না তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়তে যাচ্ছে, যার সূচনা পশ্চিম পাকিস্তানে হলেও অচিরেই আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়বে পূর্ব বাংলায়। কেউই কল্পনা করেননি নীরব সেই দশকজুড়ে জনতার মাঝে কী প্রস্তুতি চলছিল।

এই নীরব দশকের ব্যাখ্যায় নূরুল কবীর লিখেছেন, সভ্যতার ইতিহাসে এমন কালপর্ব অদৃষ্টপূর্ব নয় যখন বিশেষত সামরিক অথবা বেসামরিক একটা স্বৈরশাসকের অধীনে থাকা একটা জাতি তার যাত্রাপথের একটা কঠিন সময় পাড়ি দিতে গিয়ে উৎপীড়নের বিরুদ্ধে সংগঠিত রাজনৈতিক প্রতিরোধ করাটাকে অসম্ভব একটা বিষয় হিসেবে দেখতে পায়। ফলে সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ মানুষ স্বৈরশাসনকে অপরিবর্তনীয় কিছু একটা হিসেবে বিশ্বাস করা শুরু করেন। অন্যদিকে স্বৈরাচারও বিশ্বাস করতে শুরু করে যে পৃথিবীর কোনো শক্তিই তাকে রাষ্ট্রক্ষমতার চূড়া থেকে উৎখাত করতে পারবে না।

পূর্বে উল্লেখ করা দুর্বিষহ নীরবতার এক দশক অধ্যায়ে নূরুল কবীর যেমন এই হতোদ্যম নীরবতার বিবরণ দিয়েছেন, তেমনি তার পরের অধ্যায়টিরই নাম ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স আ্যালাউড’—বাংলা কী করব এর, খান খান শব্দে বিচূর্ণ নীরবতা? নূরুল কবীরের ভাষায় আপাতদৃশ্যে শক্তিহীন আমজনতার মাঝেই থাকা সেই অন্তর্নিহিত শক্তিটি আপাতদৃশ্যে সর্বক্ষমতাবান অথচ অবৈধ সামরিক-রাজনৈতিক শাসককে উৎখাত করতে পারে, যদি এবং যখন জনগণ রাজনৈতিকভাবে সৎ এবং আদর্শিকভাবে আপোসহীন নেতৃত্বের অধীনে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

নূরুল কবীর সঙ্গত কারণেই আইয়ুব উৎখাতের কাহিনি লিখতে গিয়ে আইয়ুবী শাসনের রাষ্ট্রনৈতিক বিবরণও দিয়েছেন। স্বৈরশাসনে-স্বৈরশাসনে হুবহু মিল বা সাদৃশ্য আশা করাটা অবান্তর বলেই এই ইতিহাসের পাঠ আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, কেননা মিলিয়ে নিলে পার্থক্যের জায়গাগুলো যেমন স্পষ্ট হবে, নতুন সময়ের নতুনতর করণীয়ও নির্ধারণ সহজ হবে। যেমন নূরুল কবীর জানিয়েছেন অধিকাংশ পূর্ব বাংলাভিত্তিক পত্রিকা ছাত্র আন্দোলনের গণতান্ত্রিক দাবিগুলোকে সমর্থন করত বলে আইয়ুবের সামরিক সরকার ১৯৬৩ সালে প্রেস ও পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স জারি করেন। উল্টো দিকে, আজকে স্বাধীন বাংলাদেশে গণমাধ্যমের প্রায় নিঃশর্ত আনুগত্যের কালেও দেখতে পাই নিত্যনতুন আইন প্রণয়ন করে গণমাধ্যমকর্মীদের এবং বিশেষ করে লেখালেখির সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির বন্দোবস্ত। একই রকমভাবে তুলনীয় ১৯৬৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, যার মূল লক্ষ্য ছিল বিদ্যালয়কে বশীভূত রাখা। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের আইন প্রণয়ন করা হয়, কেননা সেটা ছিল জনপ্রিয় দাবি। একই সাথে কিন্তু বাংলাদেশের সূচনা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানান অপ্রাতিষ্ঠানিক বন্দোবস্ত আরোপ করাতে নতুন শাসকেরা আইয়ুবকেও ছাপিয়ে যান, কেননা আইয়ুবের অভিজ্ঞতা থেকেই তারা শিক্ষা নিয়েছিলেন। অন্যদিকে বলা যায়, বাংলাদেশের পুরোনো চারটি সর্বজনের বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে নতুন সব কটি বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত চলছে সেই আইয়ুবের জারি করা অধ্যাদেশেরই প্রায় হুবহু অনুলিপিতে। আপাতদৃশ্যে নীরব এবং অনুগত এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিমত্তা সম্পর্কে শাসকদের অবহিত থাকাটাই এর প্রধান কারণ, সেটা সহজেই অনুমেয়। নির্বাচনের প্রসঙ্গটাও এই আলাপে প্রাসঙ্গিক, স্বৈরশাসক আইয়ুবও মাঝরাতে নির্বাচনের মতো নির্লজ্জ হবার কথা কল্পনা করেননি। বৈধতার আলখাল্লা পরতে আইয়ুবকে তাই তাই উদ্ভাবন করতে হয়েছিল মৌলিক গণতন্ত্র নামের আস্ত একটি বন্দোবস্ত।

কিন্তু আইয়ুবের ওই প্রবল শ্বাসরোধী অবস্থার মাঝেই জনতার নীরব প্রস্তুতিও চলতে থাকে। জাতিগত বৈষম্য, আঞ্চলিক বৈষম্য, সংস্কৃতিগত বৈষম্য ও ভাষাগত বৈষম্যের অনুভূতির বিস্তারের সাথে সাথেই এই অনুভূতিগুলো রাজনীতির ভাষার সন্ধান করতে থাকে। এর প্রথম বীজ মিলবে আইয়ুবের সামরিক শাসনের আগেই ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের ২১ দফায়, যেখানে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের কথাটা বেশ জোরেশোরেই রাজনৈতিক দাবি আকারে উচ্চারিত হয়। ২১ দফা সম্পর্কে আরেকটু বিস্তারিত করা প্রয়োজন, ইতিহাসের স্বার্থেই। এই প্রসঙ্গে আসে আরও একটি গ্রন্থের কথা। আইয়ুব খানকে হটিয়ে দেওয়ার গণ-আন্দোলনের ঘটনাবলির বিশ্লেষণ হলেও ডিপোজিং অব আ ডিক্টেটর নামের এই বইকে অনায়াসেই মওলানা ভাসানীর এমন একটি জীবনচরিতের খণ্ডাংশ হিসেবেও অভিহিত করা যাবে, যে জীবনীগ্রন্থটি এখনো পূর্ণাঙ্গরূপে লেখা হয়নি, যদিও  নূরুল কবীর নিজেই স্বয়ং ভাসানীর একজন জীবনীকার। অথবা বিষয়টাকে অন্যভাবে বলা যেতে পারে, এই বইটিকে নূরুল কবীরের লেখা দ্য রেড মওলানা গ্রন্থের সাথে মিলিয়ে পাঠ করলে পাঠক হয়তো ইতিহাসের খানিকটা পূর্ণতর একটা চিত্রপট পাবেন, যদিও সেটাও কোনো পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ নয়।

কেন এই দুটো গ্রন্থকে একত্র করে পাঠ করাটা দরকার, তার কয়েকটা ছোট নমুনা হাজির করা যাক। বাংলাদেশের জনপ্রিয় ইতিহাস ভাবনায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা এখনকার বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের ধারণাটি প্রথম ৬ দফাতে এসেছে বলে একটা গভীরে প্রোথিত বিশ্বাস রয়েছে। কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের কথাটি কর্মসূচি ও দাবি আকারে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রথম এসেছে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাতে। নূরুল কবীর এই প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করেছেন আওয়ামী লীগ নামের গবেষণা গ্রন্থটির রচয়িতা শ্যামলী ঘোষকে: সোহরাওয়ার্দীর প্রাথমিক আপত্তি এবং মুজিবুর রহমানের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিরোধিতা সত্ত্বেও যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতা সোহরাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা বাস্তবায়নে প্রায় প্রতারণামূলক তৎপরতা পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন এবং সামগ্রিকভাবে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে বহুলাংশে পিছিয়ে দিয়েছিল। নূরুল কবীর উল্লেখ করেছেন, ১৯৬৬ সালের তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত ন্যাপের ১৪ দফারও কথা। সত্যি বলতে কি, মওলানা ভাসানী ঘোষিত এই ১৪ দফার ভেতর পরবর্তীকালে ইতিহাস ঘটিয়ে দেওয়া ২১ দফার বীজটি লুকিয়ে ছিল, সেই চারাগাছটিই বহু বছর পর মহীরুহ আকারেই দেখা দিয়েছে উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে। ১৯৭০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ডাকা হরতালের সমর্থনে ৮ ফেব্রুয়ারির এক সভায় মওলানা গোলটেবিল বৈঠকের নামে গণসংগ্রামকে স্তিমিত করার বিরোধিতা করেন, সেই সভাতেও তিনি ছাত্রসমাজের তোলা ১১ দফার সাথে ১৪ দফার সাদৃশ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, উত্তরণের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে তাঁহার দল ১৯৬৬ সালের জুন মাসে যে ১৪ দফা দাবী গ্রহণ করিয়াছিল তাহা ছাত্রসমাজের ১১ দফা দাবীর অনুরূপ। এই ১৪ দফাতেও ছিল কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তিবিষয়ক দিকনির্দেশনা, যা ৬ দফায় অনুপস্থিত, কিন্তু উপস্থিত যুক্তফ্রন্টের ২১ দফায়। এভাবে মওলানার রাজনীতি তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে গণসংগ্রামের সব কটি পর্বজুড়ে, অন্যরা কখনো কখনো গণজোয়ারের চাপে সেগুলোকে স্বীকার করেছেন এবং সুযোগ পেলেই ছুড়েও ফেলেছেন।

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচিতে বা ৬৬ সালের ১৪ দফায় শিক্ষার অগ্রগতি, শিল্প ও কৃষির উন্নয়ন, ভাষার অধিকার এবং ন্যায্য মজুরি নির্ধারণসহ যে প্রগতিশীল কর্মসূচিগুলো ছিল, একই সাথে সেখানে নতুন গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতিফলনস্বরূপ স্বায়ত্তশাসনের দাবিটিও ছিল। এই অর্থে আওয়ামী লীগের ৬ দফা নিতান্তই খণ্ডিত একটি কর্মসূচি, যেখানে কৃষক শ্রমিক বা ছাত্রসমাজের দাবিদাওয়ার প্রতিফলন ছিল না। অন্যদিকে আইয়ুবের পতনের প্রধান নিয়ামক ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যে একক কর্মসূচির অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, সেই ১১ দফাতে আবারও ২১ দফা ও ১৪ দফার এই দাবিগুলোর জাজ্বল্যমান উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। শিক্ষার্থী সমাজের মাঝে ঐক্যের শর্তস্বরূপ এই ১১ দফা বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের একটা বড় অংশের বিরোধিতার কথা লিখেছেন ড. এম ওয়াজেদ মিয়া তাঁর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ নামের গ্রন্থটিতে। তাঁর স্মৃতিচারণায় তিনি জানিয়েছেন, আন্দোলনকারীদের মাঝে ১১ দফা প্রশ্নে আওয়ামী লীগের অবস্থান বিষয়ে সংশয়ের কারণে কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে ছাত্রনেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করে আশ্বস্ত করার ব্যবস্থা করতে হয়। এটা তিনি সানন্দেই করেছিলেন, কেননা তিনি ভালোভাবেই জানতেন ৬ দফা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ নয়, ঐক্যবদ্ধ আইয়ুববিরোধী আন্দোলন সম্ভব ছিল ১১ দফায়, যে ১১ দফার প্রশ্নে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতার ভিন্নতম ছিল। ড ওয়াজেদের স্মৃতিচারণা থেকেই আমরা আরও জানতে পারি, ক্ষুব্ধ ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতেই ১১ দফা বিরোধী আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীর লাঞ্ছিত হবার কাহিনি। অন্যদিকে গণ-অভ্যুত্থানের শেষ দিককার দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদন দেখে আমরা আবার বুঝতে পারি ১১ দফার প্রতি এই সমর্থন পুরোপুরি আন্তরিক ছিল কি না, সে বিষয়ে সমকালেই যথেষ্ট প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। এমনকি আওয়ামী লীগের প্রতি মিত্রসুলভ এবং ভাসানীর প্রতি ঐতিহাসিকভাবেই বিরূপ মোজাফফর ন্যাপের সমাবেশ থেকেও ১১ দফা থেকে সরে আসার তৎপরতার জন্য আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিযুক্ত করা হয়েছে এমন বহু ঘটনার সংবাদও ওই সময়ের গণমাধ্যমগুলোতে মিলছে।

২১ দফা ও ৬ দফাকে পাশাপাশি মিলিয়ে পাঠ করলে যে কেউ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারাটি ১৯৬৬ সালে কোন সীমায় জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে বাঁধতে চেয়েছিল, আর জনগণের আকাঙ্ক্ষা তার আগেই ১৯৫৪ সালে কোন উচ্চতায় উঠেছিল, তার ছাপটি বুঝতে পারবেন। এই সব অস্বস্তিকর সত্যকে চাপা দিয়েই তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের মূলধারার ইতিহাসচর্চা। কিন্তু ১১ দফার মাঝে সেই আকাঙ্ক্ষাটি আবারও ফেরত এসেছিল, এবং ৬৯-পরবর্তী ইতিহাস হলো সেই আকাঙ্ক্ষাকে আবারও লাগামে আটকাবার ইতিহাস। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাসদ, নকশাল, সর্বহারাসহ আরও যত নামে বেপরোয়া তারুণ্যের হঠকারী আত্মবলিদান ঘটেছে, সেগুলো সবই এই জনতার আকাঙ্ক্ষাকে স্তিমিত করার প্রতিক্রিয়ার ফলাফল। কীভাবে গণ-অভ্যুত্থানকে প্রশমিত করা হয়েছিল, সেই আলোচনাও নূরুল কবীর করেছেন অন্য একটি অধ্যায়ে।

কৃষক শ্রমিকের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার এই ধারাকে পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাচক্র যেমন ভয় পেত, একইভাবে ভয় পেত এ দেশের ক্ষুদে বুর্জোয়া উঠতি ধনিক শ্রেণিও। এই আতঙ্কের কথাটাই আইয়ুব খান তার বিরোধীদের মাঝে যারা বুঝদার, সেই সব নেতাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন এই লেখার একদম শুরুতে উদ্ধৃত করা তার দিনপঞ্জির ভুক্তিটিতে, এই আতঙ্কের কারণেই মুক্তিযুদ্ধের আগে, সময়ে এবং পরে নানান রকম আপোস, আত্মসমর্পণ এবং রফা ও দোদুল্যমানতার ঘটনাগুলো ঘটেছে, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়টিতে মুক্তির স্বাদের বদলে জনতা যে নিপীড়নের পুনর্নবায়ন দেখল, তার কারণও লুকিয়ে আছে এই দুই ধারার পার্থক্যের মাঝে।

১১ দফার সাথে ৬ দফার পার্থক্যের এই রাজনৈতিক জায়গাটা উপলদ্ধি করাটা অত্যন্ত জরুরি। পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের দুটি পরিষ্কার ধারা ছিল। একটি জাতীয়তাবাদী, অন্যটি ছিল কৃষকের, এবং শ্রমিকের মুক্তির জাতীয় সংগ্রাম। দুয়ের কর্মসূচির মাঝে পরিস্থিতিগত কারণে কিছু সাদৃশ্য থাকলেও, বলা যায় দ্বিতীয় ধারার চাপে প্রথম ধারাটিতে পরবর্তীকালে কিছু বিপ্লবী রূপান্তরকামী প্রভাব দেখা দিলেও দুয়ের ফারাকটিও ছিল বিপুল। যেমন বলা যাক, পাকিস্তানের জাতীয় ঐক্যের সঙ্কটকে দেখিয়েছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান প্রধানত আমলাতন্ত্র, সেনাবাহিনী ও ব্যবসা বাণিজ্যেসহ সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার বণ্টনের বেলাতে পাকিস্তানের দুই অংশের স্বার্থের দ্বন্দ্বের জায়গা থেকে, অধিকাংশ এসব গ্রন্থে সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার চিত্রটি একরকম চাপা পড়ে গেছে। সমকালের সাহিত্যে এবং অর্থনীতি ও রাজনীতিবিষয়ক অজস্র প্রবন্ধ কৃষক-শ্রমিকের এই রাজনৈতিক উত্থানের ছাপটি প্রবলভাবেই প্রকাশ পেলেও স্বাধীনতা-উত্তরকালের পরবর্তীকালের জাতীয়তাবাদী ধারা ধীরে ধীরে একক আধিপত্য অর্জন করে, কিন্তু ঘটনার সময়কার প্রধানতম সাহিতকর্মগুলোতে অন্য আকাঙ্ক্ষাটির নির্ভুল ছাপ লক্ষ করা যায়। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি দৃষ্টান্তের আলোচনা অর্থহীন হবে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন ইতিহাস ছাপ ফেলেছে, সাম্প্রতিক সময়ের এমন একটি উপন্যাস হলো শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্নেল। ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের প্রেক্ষাপটে আলোচনা করতে গিয়ে শাহাদুজ্জামান একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের তৎপরতার কথাই বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, যদিও তিনিও পীড়িত অঞ্চল সফর করেছিলেন। অথচ ঘূর্ণিঝড়টির সমকালের শিল্পসাহিত্যের অভিঘাতে শেখ মুজিবুর রহমানের উল্লেখ তেমন মিলবে না; বরং বয়োবৃদ্ধ মওলানা ভাসানী যে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের এই সময়টিতে আর্ত জাতির কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন, সেটার সাক্ষ্য মিলবে তৎকালের অন্তত দুটো উল্লেখযোগ্য কীর্তিতে, একটি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বিখ্যাত চিত্রকর্ম এবং অপরটি শামসুর রাহমানের অলৌকিক স্টাফ রিপোর্টার নামের কালজয়ী কবিতাটি। গণমাধ্যমের আলোচনাতেও অসুস্থ মওলানার হাসপাতাল ছেড়ে থেকে ঘূর্ণিঝড় প্লাবিত দক্ষিণবঙ্গে হাজির হওয়াটা আলোড়ন তৈরি করেছিল। একইভাবে, গণ-অভ্যুত্থানের দিনগুলো নিয়ে উপন্যাসটিতে যে স্লোগানগুলো প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, সেগুলো জাতীয়তাবাদী ধারার, এবং অন্য স্লোগানগুলোকে প্রায় গৌণ করে ফেলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তুলনীয় চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসটি। কৃষকের এবং শ্রমিকের দাবিগুলোকে চাপা দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা ওই উনসত্তুরের গণমিছিলগুলোতে কীভাবে ছিল, সেগুলো ছাপিয়ে শ্রেণির দাবিগুলো কীভাবে বারবার জেগে উঠেছিল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সেই ছবিগুলোকে স্পষ্ট করেই তুলে ধরেছেন।

ডিপোজিং অব আ ডিক্টেটর গ্রন্থটির তাৎপর্য এখানেই। আমাদের ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে শুধু নয়, সাহিত্যকর্মেও ওই দুই ধারার প্রকাশ্য কিংবা গোপন যুদ্ধটি চলমান ছিল, আছে, এবং বহু সময়েই যে নীরবতার কিংবা পরিহারের কৌশলের আশ্রয় নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী ধারাটিকে অদৃশ্য করে ফেলা হয়, অথবা প্রান্তিক করা হয়, তার বহু রাজনীতি বুঝতেও ৬৯-এর ঘটনাপ্রবাহ জানা থাকাটা অপরিহার্য।

১৯৬৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান কারাগার থেকে ভাসানীর কাছে একটি অনুরোধ জানিয়ে পত্র লিখেছিলেন, অনুরোধটি ছিল তাঁর মুক্তির দাবিতে মওলানা যেন একটা চূড়ান্ত আন্দোলনের ডাক দেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করতে আইয়ুবকে বাধ্য করার সাধ্য আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের পক্ষে সম্ভবই ছিল না, নূরুল কবীর তা জানাচ্ছেন তাঁর অন্যতম জীবনীকার এস এ করিমের শেখ মুজিব: ট্রায়াম্ফ অ্যান্ড ট্র্যাজেডির উদ্ধৃতি দিয়ে

আমাদের নিজস্ব ইতিহাস বুঝতে কতভাবে গ্রন্থটি সাহায্য করবে, এবং অপইতিহাসকে ঘোচাতেও তার আরেকটা নতুনা হাজির করা দরকার। মুক্তিযুদ্ধে গণমানুষের অংশগ্রহণ বিষয়ে বহু ভাবোচ্ছ্বাস দেখা গেলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে মূলত এক নায়কের অবদান, সেটা স্থাপন করার চেষ্টার কথা আগেই আমরা দেখিয়েছি। অন্যদিকে দেখা দরকার মুক্তিযুদ্ধে জনগণের অংশগ্রহণের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি। নূরুল কবীর বইটির ৬৯ পাতায় একটা তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য উল্লেখ করেছেন, আওয়ামী লীগের কোনো কৃষক সংগঠন পুরো পাকিস্তান পর্ব জুড়ে ছিল না। শ্রমিক সংগঠনও তাঁরা করেছিলেন পাকিস্তান পর্বের একদম শেষ অধ্যায়ে এসে। এ প্রসঙ্গে একটি তথ্যই নূরুল কবীর বলা যায় শেখ মুজিবুর রহমানের বিরোধী কারও থেকে উদ্ধৃত করে, সেটি মোহাম্মদ তোয়াহা। জীবনস্মৃতিতে তোয়াহা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের কর্মীদের শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলায় বিধিনিষেধ জারি করা হয় ১৯৫৬ সালে [পৃষ্ঠা ৬৯]। প্রস্তাবটি কে উত্থাপন করেছিলেন, জানতে পারলে পাঠক বিস্মিত হতে পারেন। পরের পাতাতেই সিরাজুল আলম খানের উদ্ধৃতি দিয়ে নূরুল কবীর জানিয়েছেন, পাকিস্তানের শেষ দিকে তৈরি হওয়া দলটির শ্রমিক সংগঠনের সূচনা আয়োজনে অংশ নেননি শেখ মুজিবুর রহমান, দলের মাঝেকার সম্মিলিত চাপে, যদিও এবারে তাঁর প্রাথমিক সম্মতি ছিল।

 নূরুল কবীর ডিপোজিং অব আ ডিক্টেটর গ্রন্থটিতে দেখিয়েছেন, শিক্ষার্থীরা সূচনা ঘটালেও গণ-অভ্যুত্থানের তুঙ্গ মুহূর্তটি আসে যখন কৃষক ও শ্রমিক জনগোষ্ঠী গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত হয়। নূরুল কবীর এই বিষয়ে মওলানা ভাসানী এবং কৃষক সমিতির কাজকর্মকে অভিহিত করেছেন জনগণের রাজনৈতিক চেতনাকে উত্তোরিত করার প্রক্রিয়া হিসেবে। এই গণমানুষ শুধু ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের নায়কই নন, তারা আসলে অনতিকাল পরের একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধেরও প্রধান সেনা। এই প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানীর নিজের একটি লেখাকে উদ্ধৃতি করবার লোভ কিছুতেই সামলানো যায় না, ১৯৭২ সালে হককথায় মওলানা লিখেছেন:

ইহা আজ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে এই সকল কৃষক সম্মেলনের সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া হয়। এই সকল সম্মেলনের ফলে ব্যাপক কৃষকসমাজ গ্রামে গ্রামে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষোভে জাগিয়া ওঠে। পাক শাসকগোষ্ঠীকে উৎখাত করিবার সংগ্রামে তাহারা উদ্বুদ্ধ হয়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের শতকরা পঁচিশ ভাগ লোকও যদি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে থাকিত তবে যুদ্ধের অবস্থা অন্যরূপ দাঁড়াইত। বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক পাকসরকারের পক্ষে ছিল না এবং তাহারাই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। বিহারী বাঙালী দালাল বা এক শ্রেণীর তথাকথিত মৌলভী-মাওলানা যাহারা বদরবাহিনীতে যোগদান করিয়া অন্যায়ভাবে পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলাইয়া বাংলাদেশের কোটি কোটি ঘর জ্বালাইয়াছে, নিঃস্ব নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করিয়াছে। তাহার মূলে কাজ করিয়াছে ঐ সমস্ত কৃষক শ্রমিকদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা যাহারা লালটুপি, লালপতাকা লইয়া কৃষক-মজুর রাজ কায়েম কর, শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধর পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর, কৃষক-শ্রমিকদের সংখ্যানুপাতে আইনসভা ও অন্যান্য সংস্থাসমূহে আসন চাই, কৃষকের ভোটে অকৃষক নির্বাচিত হইতে পারিবে না ইত্যাদি শ্লোগান দিয়া বাংলাদেশে নতুন আবহাওয়া সৃষ্টি করিয়াছিল।

তেভাগা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকের দাবিতে একদা পাকিস্তান এসেছিল, কৃষকের রাজনৈতিক চেতনার এই বিকাশ, মুক্তিযুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণ, তাদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর প্রবল নিপীড়ন, এবং সেই নিপীড়নের ইতিহাসকে প্রায় আড়ালে রেখে এক ব্যক্তির নেতৃত্বে অপ্রস্তুত জাতিকে স্বাধীন করার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পের অন্তঃসারশূন্যতাকে বোঝা খুব কঠিন হবে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসকে নতুন আলোয় চিনতে না শিখলে।

আমাদের মধ্যবিত্ত ইতিহাস ও সাহিত্যচর্চার অন্য একটা দিক নিয়েও এই প্রসঙ্গে বলা দরকার। ৬৯-এর এই উত্তুঙ্গ মুহূর্তে মওলানা গ্রামে গ্রামে কৃষকদের যখন সংগঠিত করছেন, ঘেরাও করছেন গণশত্রুদের, হাটসভা ও আরও নানান কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষকদের জাগিয়ে দিচ্ছেন, তাঁকে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কাছে মনে হচ্ছে পলায়নপরতা ও দায়িত্বহীনতা হিসেবে, আত্মজীবনীমূলক উতল হাওয়া নামের গ্রন্থে। কৃষক ও তাঁর রাজনীতির গুরুত্ব মনোজগতে অনুপস্থিত থাকার এটা স্বাভাবিক ফল বটে। ভাসানীর কৃষক রাজনীতির তাৎপর্য বোঝা যাবে, এই সময়কার এমন একটা প্রচারপত্রের কথা নূরুল কবীর উল্লেখ করেছেন যেটা কৃষক সমিতি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মাঝে বিতরণ করছে। ভাষাসংগ্রামী আব্দুল মতিন স্বাক্ষরিত সেই প্রচারপত্রে বলা হয়েছে অভ্যুত্থানের চেতনাকে শহুরে অংশের মাঝে সীমিত রাখা হলে সাধারণ মানুষের ওপর শোষণের অবসান ঘটবে না, কাজেই সেখানে আহবান জানানো হয়েছে প্রদেশের সর্বত্র ঘেরাও আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান।

গ্রামাঞ্চলব্যাপী গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা ছড়িয়ে যাবার তাৎপর্য ব্যাখ্যায় নূরুল কবীর উদ্ধৃত করেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদকে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী নামের বইটিতে তিনি দেখিয়েছেন এই নতুন পরিস্থিতির ফলে এমনকি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোও কৃষকের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে বাধ্য হয় এবং এমনকি কিছু সমাজতান্ত্রিক স্লোগানও নিজেরা রপ্ত করে। বস্তুত স্বাধীনতা আন্দোলনবিষয়ক খুব কম গ্রন্থই আপনাকে এখন মনে করিয়ে দেবে যে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের আগেই মওলানা ভাসানী গ্রামে গ্রামে ঘুরে খাজনা দেওয়া বন্ধ করার কথা হুমকি দিয়েছেন পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও পূর্ব বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের আয়োজন না হলে।

 

১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানের আরও একটি কম আলোচিত অথচ রোমাঞ্চকর দিককে নূরুল কবীর বিস্তারিত করেছেন। সেটি কারাগার থেকে পাঠানো একটি চিরকুটবিষয়ক। এর আগে বাংলাদেশে আমরা দেখেছি কারাগার থেকে ভাষা আন্দোলন পরিচালনাবিষয়ক একটা ইতিহাসের রোমাঞ্চকর আখ্যান তৈরির চেষ্টা, যেটাও ওই একক নেতৃত্বের ওপর সকল কৃতিত্ব আরোপের মনোভঙ্গি থেকে এসেছে। কিন্তু সত্যি অন্য একটি চিরকুট উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থানে ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৬৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান কারাগার থেকে ভাসানীর কাছে একটি অনুরোধ জানিয়ে পত্র লিখেছিলেন, অনুরোধটি ছিল তাঁর মুক্তির দাবিতে মওলানা যেন একটা চূড়ান্ত আন্দোলনের ডাক দেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করতে আইয়ুবকে বাধ্য করার সাধ্য আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের পক্ষে সম্ভবই ছিল না, নূরুল কবীর তা জানাচ্ছেন তাঁর অন্যতম জীবনীকার এস এ করিমের শেখ মুজিব: ট্রায়াম্ফ অ্যান্ড ট্র্যাজেডির উদ্ধৃতি দিয়ে। অগত্যা তিনি কারাগার থেকে যোগাযোগ করেন আতাউস সামাদের সাথে। আতাউস সামাদ আবার অনুরোধটি পৌছে দেন এবিএম মূসাকে। এবিএম মুসাসহ আরও অনেকগুলো সূত্রের উল্লেখ করে যে অধ্যায়টির একটি বিবরণ নূরুল কবীর আমাদের দিয়েছেন, শেখকে মুক্ত করার অনুরোধে সাড়া দিয়ে গর্জে উঠলেন মওলানা নামের অধ্যায়টিতে। এর বিবরণ তিনি তাঁর দ্য রেড মওলানা গ্রন্থটিতেও দিয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব কমই ঘটেছিল যখন সেনানিবাস ঘেরাও করার হুমকি দিয়ে একজন নেতাকে ছাড়িয়ে আনা হয়েছিল, মওলানা সেই ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। প্রশ্ন আসতে পারে, নূরুল কবীর তো এই তথ্যগুলো আবিষ্কার করেননি, বরং তিনি আওয়ামী লীগের ঘরের সূত্রগুলোকেই ব্যবহার করেছেন। তাহলে এই তথ্যগুলো উনসত্তুর প্রসঙ্গে, শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী রচনার প্রসঙ্গে অথবা মুক্তিযুদ্ধের ৫০তম বর্ষে কোনো আলোচনায় কেন নেই? কারণ, ওই দুটোইযা আমাদের লেখার শুরুতে আমরা বলেছি। শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করার যে ডাক মওলানা দিয়েছিলেন, তাতে নেতৃত্বও প্রদান করেছিলেন, তার পেছনে জমায়েত জনতা সরকারি কার্যালয়গুলোতে আগুন শুধু দেয়নি, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারপতির বাসগৃহ পুড়িয়ে দিয়েছিল, অল্পের জন্য তিনি প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছিলেন। এরপর কার্যত বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্র উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল, পাকিস্তানকে তখনো টিকিয়ে রেখেছিল জনতার এই উত্থানকে ভয় পাওয়া অংশটুকু, নানান কায়দাতেই তারা গণ-আন্দোলনকে প্রশমিত করার, জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার কৌশল গ্রহণ করেছিল। এই বিষয়গুলো অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্মমুহূর্তে ভারতীয়, পাকিস্তানি এবং আন্তর্জাতিক বহু মহলকে তটস্থ করেছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেকার ঘটনাপ্রবাহ তারই অজস্র ইঙ্গিত বহন করে।

মুক্ত হয়ে দলের অনেক কর্মীর বাধার মুখেও শেখ মুজিবুর রহমান গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন। এই বৈঠকের আগে জেনারেল আইয়ুব খানের সাথেও তিনি একটা হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যক্তিগত বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন, নিজের স্মৃতিকথায় আইয়ুব খান এ বিষয়ে যা বলেছেন, সেটা নূরুল কবীর উদ্ধৃত করেছেন তাঁর গ্রন্থটিতে, পাঠক তা থেকে নতুন অন্তর্দৃষ্টি লাভ করবেন। কিন্তু নূরুল কবীরের এই গ্রন্থে একটা প্রশ্নের আলোচনা অনিষ্পন্ন থেকে যায়, মওলানা নিজে গোলটেবিল বৈঠকের বিরোধিতা করে, সেটাকে অর্থহীন মনে করেও এবং অংশ না নিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের ডাক দিয়ে গেছেন, সেটা যেমন নূরুল কবীর বলেছেন, তেমনি তিনি এই ইঙ্গিতও দিয়েছেন যে শেখ মুজিবুর রহমানের গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণে মওলানার সায় ছিল, তাঁকে তিনি পুত্র সম্বোধন করেই বলেছেন যে পুত্র সেখানে হাজির থাকলে পিতার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এর কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা নূরুল কবীর হাজির করেননি।

উত্তুঙ্গ উনসত্তুরকে স্তিমিত করার প্রয়াসে একটা দিকে ছিল গোলটেবিল ও এমন নানান সব রাজনৈতিক আয়োজন, আরেকদিকে ছিল আইয়ুবকে সরিয়ে ইয়াহিয়ার আগমন ও নতুন করে ইয়াহিয়ার জারি করা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কর্মসূচি প্রদানে ব্যর্থতা। এই বিষয়ে পাঠকের কৌতূহল আরও বাড়বে, যেখানে তখনকার মস্কোপন্থী ন্যাপের ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ও পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে উদ্ধৃত করেছেন নূরুল কবীর, যিনি জানিয়েছেন ছাত্রসংগঠনগুলোর এই্ ব্যর্থতার কারণ বিশেষত আওয়ামী লীগ ইয়াহিয়া খানের বিষয়ে অপেক্ষা করা ও দেখার নীতি গ্রহণ করেছিল। মস্কোপন্থী আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা মোহাম্মদ ফরহাদকেও উদ্ধৃত করেছেন নূরুল কবীর, যিনি জানিয়েছেন কারাগার থেকে মুক্ত হবার পর শেখ মুজিবুর রহমান বস্তুত সকল ধরনের রাজনৈতিক সংগ্রামকে ধীরগতি করা শুরু করেন, ছাত্রলীগও সেই ধারা অনুসরণ করে, কাজেই তারা [জাতীয় পরিষদ ও আইন পরিষদের সদস্য এবং] বিডি সদস্যদের পদত্যাগের আহবান বিষয়ক ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পূর্বতন একটি ডাক থেকে সরে আসার প্রস্তাব দেয় [পৃষ্ঠা ১৩৮]। পাশাপাশি নূরুল কবীর দেখিয়েছেন, মওলানা ভাসানী ইয়াহিয়ার সামরিক আইন লঙ্ঘন করে ১৯৬৯ সালের অক্টোবরে পাবনার শাহপুরে একটা কৃষক সম্মেলন আহবান করেন। অর্থাৎ মধ্যবিত্ত জাতীয়তাবাদী ধারাটি নির্বাচনের গন্ধে রাজনীতিকে দমিয়ে আনলেও কৃষকের চেতনাকে মওলানা সেই সময়েও শান দিয়ে চলেছেন। ইতিহাসে এই সম্মেলন শাহপুরের লালটুপি সম্মেলন নামে খ্যাত হয়ে আছে। মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও অভিযানের দায়িত্বে থাকা মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক এ কে খন্দকারকে উদ্ধৃত করে এই গ্রন্থ আবারও আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, এই্ কৃষক পরিবারগুলোর সন্তানেরাই মুক্তিযোদ্ধাদের ৮০ ভাগ ছিল। আবারও আমাদের মনে পড়ে মওলানার সেই স্মৃতিচারণা, যেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের জন্য দেশকে প্রস্তুত করার ঐতিহাসিক দায়িত্বটি পালনের কৃতিত্বটি দিয়েছিলেন তার প্রতিষ্ঠিত কৃষক সমিতিকে।

 

বইটির ছোট ছোট কিছু অসম্পূর্ণতা নিয়ে আলাপ করা যাক। ৪৭ পৃষ্ঠায় আইয়ুব শাসনের একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্বে ভাসানীর নীরবতা নিয়ে নূরুল কবীর কথা বলেছেন একটিমাত্র বাক্যে, কিন্তু কোনো বিস্তারে যাননি। সতর্ক পাঠক নিশ্চিতভাবেই এর বিস্তার দাবি করবেন, জানতে চাইবেন অন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব ওই সময়ে কী কী ভূমিকা পালন করেছেন। এ ছাড়া অন্য একটি স্থানে নূরুল কবীর লিখেছেন: ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষার্থীরা একটা সাধারণ ধর্মঘট আহবান করেন, এটাই ছিল পাকিস্তানে আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের পর প্রথম এই জাতীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি। আইয়ুব খান এর প্রতিক্রিয়ায় সকল রাজনৈতিক কর্মসূচির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন, আইন তাকে সেই অধিকার দিয়েছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এবং শহরবাসী হাল ছাড়তে চাচ্ছিল না। তারা বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন, যাদের মাঝে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তারা তাঁকে অনুরোধ করেন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে একটা বৃহত্তর আন্দোলন শুরু করার জন্য। কিন্তু অক্টোবর ১৯৫৮ থেকে জুন ১৯৬২ পর্যন্তু সামরিক শাসনের পুরোটা পর্ব জুড়ে গণতন্ত্রের দাবিতে মাঠে নামতে সাহস না পাওয়া আলোচ্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পত্রিকায় বিবৃতি প্রদানের চাইতে বেশি কিছু করতে অস্বীকৃতি জানান।

এই সময়টিতে মওলানা ভাসানী কী করেছিলেন, সঙ্গত কারণেই পাঠকের কৌতূহল জাগে। প্রশ্নটা এখানে প্রাসঙ্গিকও। তিনি তখন কারাগারে, সেই ৫৮ সালের ১২ অক্টোবর থেকেই। অর্থাৎ সামরিক শাসন জারির [৭ সেপ্টেম্বর] মাত্র ৫ দিনের মাথায় তিনি গ্রেফতার হন টাঙ্গাইলের মির্জাপুর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। ১৭ সেপ্টেম্বরের মহান শিক্ষা আন্দোলনের সময়ে তিনি কারাবন্দী এবং এর এক মাস পর বন্যা নিরসন, পাটের ন্যায্যমূল্য প্রদান ইত্যাদি দাবিতে তিনি কারাগারেই অনশন করেন।

বইয়ের একটা স্থানে ১৪ দফার সালটা ভুল হয়েছে। যদিও এই ভুল প্রধানত নূরুল কবীরের নয়, ভুলটার সূত্রপাত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ দলিলপত্র দ্বিতীয় খণ্ডে। এই ১৪ দফার বিবরণে ন্যাপের যে দলিলটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, সেখানেই ১৯৬৬ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের কথা উল্লেখ আছে, ফলে তা অবশ্যই যুদ্ধটির পরেকার। এমনকি ভাসানী স্বয়ং ৬৯ সালে সভায় বলেছেন, এই ১৪ দফা তিনি ৬৬ সালে উত্থাপন করেছিলেন, যেটার উল্লেখ বর্তমান নিবন্ধেও করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টে গৌণ হলেও এই সালের ভুল উল্লেখটি গুরুতর বিভ্রান্তি তৈরি করতে সক্ষম, কেননা তা ১৪ দফাকে সময়ক্রমের দিক দিয়ে ৬ দফার আগে স্থাপন করে। যদিও এটা খুব ঠিক যে ১৪ দফার প্রেরণাটা ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা থেকে উৎসারিত, এবং তার আদর্শিক ধারাবাহিকতা।

ডিপোজিং অব আ ডিক্টেটর: রিভিজিটিং আ ম্যাগনিফিসেন্ট আপরাইজিং আফটার ফিফটি ইয়ারস বইয়ের প্রচ্ছদটি করেছেন শিল্পী সব্যসাচী হাজরা। এমন একটি গ্রন্থ উৎসর্গীত হয়েছে দুজন গুণী ব্যক্তিত্বের প্রতি, একজন ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক কাজী কামরুজ্জামান, নূরুল কবীরের ভাষায় যিনি মানুষের বেশির ভাগ অসুখ সারাতে সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যকে দূর করাকেই সবচাইতে বড় দাওয়াই বলে প্রচার করেন; অন্যজন অধ্যাপক আজফার হোসেন, যিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের সজ্জিত করেন মুক্তিকামী মতাদর্শের অস্ত্র দিয়ে, লক্ষ্য সাম্যবাদী মুক্তি। এই বিবেচনায় নিঃসন্দেহে যথোপযুক্ত ব্যক্তিদেরই স্মরণ করা হয়েছে উৎসর্গপত্রে।