সংবাদ পাঠ বন্ধের ইশতেহার
বর্তমান সময়ে তথ্যকে একধরনের শক্তি বা ক্ষমতা হিসেবে চিহ্নিত করার একটি প্রবণতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, একজন মানুষের কাছে কোনো বিষয়ে যত বেশি তথ্য আছে, ক্ষমতাকাঠামো কিংবা আলোচনার টেবিলে তিনি তত বেশি ক্ষমতাবান, কিংবা নিদেনপক্ষে এগিয়ে আছেন। আর সাধারণ বিবেচনায় দৈনন্দিন জীবনে আমাদের তথ্যপ্রাপ্তির অন্যতম প্রধান উৎস হলো সংবাদ। সেটি সংবাদপত্র, বেতার, টেলিভিশন কিংবা আজকের দিনে প্রশ্ন সাপেক্ষে সর্বাধিক ব্যবহৃত অনলাইন পোর্টাল, যে মাধ্যমটিই আমরা ব্যবহার করে থাকি না কেন।
এমন পরিস্থিতিতে যদি বলা হয় সংবাদ পাঠ-শ্রবণ-দর্শন ছেড়ে দিতে, অর্থাৎ আমাদের যে সংবাদ ভোক্তা সত্তাটি রয়েছে, তাকে বিসর্জন দিতে হবে, তাহলে শুনতে কেমন লাগবে? আর যদি এটিও বলা হয় যে এই বিসর্জনের মাধ্যমে মানুষের জীবন আগের চেয়ে সুখী, শান্ত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ হয়ে উঠবে? প্রবল সম্ভাবনা আছে এমন বলা মানুষটি তিরস্কারের শিকার হবেন, মানুষের হাসির পাত্র হবেন। অর্থাৎ আত্মসম্মানের প্রশ্নে নিজের পরিচিত মহলেও এমন বক্তব্য উপস্থাপন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
কিন্তু এই নিদারুণ ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করেছেন সুইজারল্যান্ডের লেখক রলফ ডবেলি। তাঁর যে বইটির ইংরেজি অনুবাদের আলোকে এই আলোচনার সূত্রপাত, সেই বইয়ের নাম Stop Reading the News: A Manifesto for a Happier, Calmer and Wiser Life। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশকে সংবাদ পাঠ-শ্রবণ-দর্শন ছেড়ে দেওয়া ডবেলি তাঁর এই বিসর্জনের ইতিবাচক ফল আর সবার কাছে প্রকাশের উদ্দেশ্যেই এই বই রচনা করেছেন।
ডবেলি স্বীকার করেই নিয়েছেন, যখন তিনি সংবাদ পড়া বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন তিনি নিজেও এর ফলাফল নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। তবে সময়ের সাথে সাথে সংবাদ থেকে দূরে থাকার ফলে তাঁর জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো তিনি টের পেতে শুরু করেন। এর ভেতর বর্তমান লেখকের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে স্বচ্ছ ও গভীরভাবে কোনো বিষয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রসঙ্গটি।
ডবেলির অন্যতম অনুসিদ্ধান্ত হলো, বর্তমানে যে ধরনের সংবাদ প্রতিবেদনগুলো বিভিন্ন মাধ্যমে আমাদের সামনে উপস্থিত হচ্ছে, তার দৈর্ঘ্য ও বর্ণনাভঙ্গির ফলে মানুষ দীর্ঘ ও গভীরতর প্রবন্ধ বা অন্যান্য লেখা পড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এর ফলে মানুষ তাদের নিজস্ব বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও চিন্তার সৃজনশীলতা থেকে প্রতিনিয়ত দূরে সরে যাচ্ছে। এর অন্যতম ফল হিসেবে ডবেলি বলছেন, সামাজিক মাধ্যম ও স্মার্টফোনের উত্থানের ফলে সংবাদের যে জোয়ার বইছে, তা এসবের ভোক্তাদেরকে সত্য ও মিথ্যা তথ্যের সাগরে ভাসিয়ে নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এর ফলে মানুষের প্রজ্ঞা বৃদ্ধি পাচ্ছে না কোনোভাবেই। অর্থাৎ মানুষের হাতের কাছে প্রচুর তথ্য রয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলোকে ব্যবহার করে নিজের উন্নয়নের কোনো সুযোগ মানুষ পাচ্ছে না।
সংবাদ পাঠ করা বন্ধের পেছনে ডবেলির অন্যতম যুক্তি হলো, একেকটি গণমাধ্যম একই সংবাদ অগণিত মানুষের জন্য প্রচার ও প্রকাশ করে। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের জন্য ওই একই সংবাদ কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক হতে পারে না। আবার প্রাসঙ্গিকতাহীন সংবাদ বা তথ্য একজন মানুষের উন্নয়নেও কোনো কাজে আসে না। তা ছাড়া নানা ধরনের সংবাদের এই জোয়ারে মানুষের মূল দক্ষতার জায়গায় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসে না বলেও দাবি করছেন ডবেলি।
সংবাদের ভোক্তা সত্তাটি বিসর্জনের পক্ষে এই বইতে ২০টির বেশি যুক্তি তুলে ধরেছেন ডবেলি। এই যুক্তিগুলোর মধ্যে প্রধানতম হলো সেগুলো, যেখানে ডবেলি বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল উল্লেখপূর্বক বর্তমান সময়ের সংবাদ প্রতিবেদনগুলো কীভাবে নিয়মিত এর পাঠক-শ্রোতা-দর্শকদের শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি সাধন করছে, তার বিবরণ দিয়েছেন। অন্যদিকে বইয়ের বিভিন্ন অংশে একাধিকবার নিজের যুক্তি প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে ডবেলি কিছু অনুমানমূলক বাস্তবতা ধরে এগিয়েছেন, আবার বিভিন্ন যুক্তিকে যে ধরনের উদাহরণের আলোকে সাজিয়েছেন, তার কিছু কিছু প্রায়শই অপ্রাসঙ্গিক ও দুর্বল মনে হয়ে থাকতে পারে, যা ডবেলির অবস্থান ও বক্তব্যকে পাঠকের কাছে কিছুটা হলেও দুর্বল করে দিতে পারে। তবে, সংবাদ না পড়েও কীভাবে একজন মানুষ দৈনন্দিন জীবনে একদমই পিছিয়ে পড়বেন না, বরং এর ফলে তার নিজস্ব ভাবনার ক্ষেত্র প্রসারিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে, সে-সংক্রান্ত ডবেলির যুক্তিগুলো সংবাদ পাঠ ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে বইটির পাঠককে ভাবতে নিশ্চিতভাবেই বাধ্য করবে।
এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ডবেলি তাঁর যুক্তি উপস্থাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সংবাদ তৈরির প্রবণতা এবং এর পেছনের কারণগুলো বারবার উল্লেখ করেছেন। এ জন্য ডবেলিকে সাহায্য নিতে হয়েছে প্রাচীন গ্রিস ও রোমের স্টয়িক দার্শনিকদের থেকে শুরু করে হাল আমলের ইয়ুভাল নোয়াহ হারারি পর্যন্ত। কোন ঘটনাগুলো আসলে কেন সংবাদ হয়ে উঠতে পারে, সে প্রশ্নে ডবেলির ব্যাখ্যা হারম্যান-চমস্কির মডেল থেকে ক্রিস রজেকের সেলিব্রিটি ও জ্যাঁ বদ্রিলারের ‘নন-ইভেন্ট’ সংক্রান্ত ধারণাগুলোকে সম্পর্কিত করে এগিয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া স্মার্টফোন এবং গুগল, ফেসবুক, আমাজনের মতো অনলাইনভিত্তিক মেগা-করপোরেশনের নজরদারির ফলে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা হ্রাস এবং সংবাদ ও বিজ্ঞাপনের এক ‘অপবিত্র জোট’-এর উল্লেখ ডবেলির অবস্থানকে যৌক্তিকতা প্রদান করেছে বেশ শক্তিশালীভাবেই। ফলে গণমাধ্যম অধ্যয়নে আগ্রহী যেকোনো পাঠকের জন্য এই বই চিত্তাকর্ষক হতে পারে।
Stop Reading the News শীর্ষক বইটি লেখার আগে প্রকাশিত রলফ ডবেলির অপর দুটি বই হলো The Art of Thinking Clearly ও The Art of the Good Life। বর্তমান লেখায় আলোচনাধীন বইটির বিভিন্ন অংশে ডবেলি যেভাবে তাঁর ওই বই দুইটির উল্লেখ করেছেন, তা চোখে লাগার মতো। বিষয়টিকে বই দুটির বিজ্ঞাপন কিংবা ‘product placement’-এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে, ডবেলি নিজে আবার বর্তমান সংবাদ প্রতিবেদনসমূহে এই দুটি বিষয়ের ব্যাপক উপস্থিতির সমালোচনা করে নিজ বক্তব্য এগিয়ে নিয়েছেন, বিষয়টি বেশ মজার এক প্যারাডক্স বটে!
এই লেখার শুরুতে বলা হয়েছিল, এ ধরনের একটি বিষয়ে বই লেখা ডবেলি বা অন্য যেকোনো লেখকের জন্যই যথেষ্ট বিপজ্জনক। একই সাথে বিরুদ্ধাচরণ না করে বইটি নিয়ে আলোচনা করাও শিক্ষক হিসেবে পেশাগতভাবে সাংবাদিকতার সাথে সম্পর্কিত একজন আলোচকের জন্যও কিছুটা বিপজ্জনক, কিংবা অন্তত বিব্রতকর মনে হতে পারে বটে। তারপরও আলোচনার পথ গ্রহণ করার মূল কারণ উল্লেখপূর্বক এই আলোচনা শেষ করা যেতে পারে।
এ ক্ষেত্রে বর্তমান লেখকের সাথে ডবেলির অবস্থানের কিছু জায়গায় ভাবনার মিল লক্ষ করার মতো। এই বইয়ের নাম শুনলে মনে হতে পারে, লেখক সংবাদের ভোক্তাদেরকে সংবাদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাচ্ছেন। কিন্তু বইটিতে বারবার এর বিপরীত চিত্র ফুটে উঠেছে। ডবেলি মূলত সেই নাতিদীর্ঘ সংবাদ প্রতিবেদনগুলো পড়তে মানা করছেন, যা আদতে পাঠককে কোনো একটি ঘটনার পরিস্থিতিগত প্রসঙ্গ উল্লেখ না করেই, গভীরে না গিয়েই, প্রতিটি ঘটনাকে আলাদা ঘটনা হিসেবে অযথা চিত্তাকর্ষকরূপে প্রচার ও প্রকাশ করে। ডবেলি সেই সংবাদগুলো পাঠ করা থেকে দূরে থাকতে বলছেন, যার উদ্দেশ্য মূলত বিজ্ঞাপনের প্রচার ও প্রসার এবং সংবাদ প্রচারের নামে এর ভোক্তাদেরকে ভোগবাদের দিকে নিয়ে যাওয়া।
এর বিপরীতে ডবেলি বারবার বলছেন দীর্ঘ সংবাদ প্রতিবেদন বা প্রবন্ধ, বই, প্রামাণ্যচিত্র, গবেষণা প্রবন্ধ, ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বিষয়াদি পাঠ করতে। ডবেলি বলছেন, বর্তমানে প্রচলিত অতিক্ষুদ্রাকৃতির সংবাদ প্রতিবেদনগুলো আমাদেরকে কোনোভাবেই প্রকৃত তথ্য জানায় না, বরং নষ্ট করে দেয় আমাদের দীর্ঘ কোনো লেখা পড়ার বা দীর্ঘ কোনো অডিও-ভিজ্যুয়াল আধেয় ধৈর্য ধরে দেখার সহজাত প্রবণতাটিকে।
এ ক্ষেত্রে ডবেলি গুরুত্ব দিয়েছেন অনুসন্ধানী ও ব্যাখ্যামূলক সাংবাদিকতা ও প্রতিবেদনকে। যেগুলো প্রকৃতপক্ষেই বিশেষজ্ঞ সাংবাদিকদের দীর্ঘদিনের পরিশ্রম ও গবেষণার ফল। আর এগুলো থেকেই মানুষ আসলে কোনো ঘটনার গভীরের তথ্য জেনে নিজেকে ক্ষমতায়িত ও প্রজ্ঞাবান করতে পারে বলে বিশ্বাস করেন ডবেলি। আমাদের হাতের কাছের গণমাধ্যমগুলোতে এই ধরনের অনুসন্ধানী ও ব্যাখ্যামূলক প্রতিবেদনের অভাব কি ডবেলির অবস্থানের পক্ষের বাস্তবতাকেই ফুটিয়ে তুলছে না?
শেষ কথা হিসেবে এটিও বলে রাখা ভালো, ভোক্তাদের আচরণ পরিবর্তনের ফলেই গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও করপোরেশনগুলো তাদের আচরণ পরিবর্তনে একদিন বাধ্য হবে, ডবেলির এই উপসংহারের সাথে বর্তমান লেখকের মতান্তর রয়েছে। কারণ, এসব প্রতিষ্ঠান ও করপোরেশনগুলো তাদের পুঁজি ও প্রচারণার জোরে এবং এসব প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার ফলে করপোরেশনগুলো বরাবরই তাদের উদ্দেশ্য সাধনে সফল হয়ে এসেছে। সেই অতীত ও বাস্তবতার আলোকে নাতিদীর্ঘ সংবাদসমূহ বর্জনে ডবেলির আহ্বান বিবেচনা করা সম্ভব এবং যৌক্তিক হলেও এর ফলে ব্যাপক কোনো পরিবর্তন আনয়নের সম্ভাবনাকে আপাতদৃষ্টে খুব বেশি আশাব্যঞ্জক মনে হয় না।