আমৃত্যু বাংলা কবিতার স্বজন ওমর আলী

 

হাতে গোনা দু-একজন ভাগ্যবান ব্যতীত বাংলাদেশের অধিকাংশ কবিকেই উপেক্ষা ও বঞ্চনার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। গন্তব্য বলতে সাফল্য-স্বীকৃতি-পৃষ্ঠপোষকতার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা নয়, পাঠকের হৃদয়কেই বোঝাচ্ছি। অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা জানি, হৃদয়ের সান্নিধ্যলাভের কাজটিই একজন কবির পক্ষে সবচেয়ে কঠিন। অন্য পথে নানা রকম সহজ-সংক্ষিপ্ত-সংগুপ্ত তরিকার সন্ধান মিললেও, হৃদয়ের পথে কোনো ফাঁকফোকর চলে না। সাহিত্যের সত্যমূল্য নিরূপণের জন্য যাঁরা সমালোচকের দ্বারস্থ হতে ভালোবাসেন, তাঁরাও নকলসৌখিন মজদুরির পসরা সাজিয়ে কিছুটা সাফল্যের দেখা পেতে পারেন। কারণ, সময়টা এমন, যখন নকল মালের ফইরা যারা, তারা খুব গরম। ফলে ফেরেববাজদের দোকানেই আজকাল বেচাকেনার ধুম লেগে আছে। এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে যাঁরা শিল্পসাহিত্যকে দূরে রাখতে চান, তাঁদের দলে আমি নই। চোখ-কান খোলা রাখলে সহজেই বোঝা সম্ভব যে, বাংলাদেশের অন্য যেকোনো অঙ্গনের তুলনায় শিল্পসাহিত্যের অঙ্গনই অধিকতর বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে জীবন ও সাহিত্যের সংযোগ-সম্পর্ক-সমন্বয়ের বিচিত্র বিশ্বে প্রান্তে আলোকপ্রক্ষেপণের প্রয়োজন হবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আমাদের মনে করিয়ে দেন, সময় কোথা সময় নষ্ট করার? তাই সরাসরি ওমর আলীর কবিতার কাছে ফিরে যাওয়াই ভালো। তাঁর কবিতার দু-একটি দৃশ্যপট থেকে কবির বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটা সংক্ষিপ্ত অবয়ব নির্মাণ করা সম্ভব কি না, তার চেষ্টা করা যাক।

কবিতার সঙ্গে হৃদয়ের সংযোগের কথা বলছিলাম। পাঠককে প্রাণিত ও পল্লবিত করার বিচিত্র ব্যবস্থাপনায় ভরপুর একটি কালোত্তীর্ণ কবিতার কতটুকুই আলোচনায় উদ্ভাসিত হতে পারে? হৃদি দিয়ে হৃদি অনুভবের যে উচ্চাবিলাস আমাদের চেতনার চারপাশে গানের মতো আবর্তিত হতে থাকে, সেই বিলাসেরই ভালো নাম বোধ করি কবিতা। উদাহরণ হিসেবে ওমর আলীর একটি কবিতার চরণ উল্লেখ করা যায় এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি। কবিতার এই চরণকেই ওমর আলী প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তার পরের ইতিহাস সকলেরই জানা। ওমর আলীর নামেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেল এই কাব্যের নাম। বাংলা সাহিত্যে এ রকম সৌভাগ্যবান কবির তালিকা খুব দীর্ঘ না হওয়ারই কথা। আরও দুজন কবি ও তাঁদের প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম হয়তো ইতিমধ্যে পাঠকের মনে ঝলক দিয়ে উঠেছেকাজী নজরুল ইসলাম ও অগ্নি-বীণা এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও পদাতিক। হেলাল হাফিজ এবং তাঁর যে জলে আগুন জ্বলে কাব্যগ্রন্থের কথাও এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায়। পাঠকের রুচি ও পঠনের তারতম্য ভেদে আরও কিছু নাম হয়তো যুক্ত হতে পারে, তবে কোনো বিবেচনায়ই ওমর আলী ও এ দেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছিএই দুয়ের সংযোগসূত্রটি বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয় বলেই আমাদের ধারণা।

বিশ শতকের ষাটের দশকের বাংলা কবিতাবিষয়ক আলোচনার যে প্রথাবদ্ধ ধারাটি দীর্ঘকাল ধরে সক্রিয়, সেখানে ওমর আলীর উপস্থিতি উল্লেখ করার মতো নয়। স্বকাল-মথিত যে সকল অসুখ-বিসুখ এই কালখণ্ডের কবিদের ভারাক্রান্ত করেছিল, বিস্ময়করভাবে ওমর আলী তা থেকে মুক্ত ছিলেন। যে সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এই সময়ের কবিদের বিবরবাসী কিংবা আত্ম-উন্মুখ হতে বাধ্য করেছিল, সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তিনি নিজের পথে অবিচল ছিলেন। হাংরি জেনারেশন কিংবা স্যাড জেনারেশনের মতো কাব্যান্দোলনের প্রভাবও তাঁর কবিতার গতিপথকে বদলে দেয়নি। তিনি মুক্ত জীবনানন্দের মতোই আপনার তালে নেচে গেছেন। যে ভূখণ্ডের ওপর তাঁর এই আত্মখচিত নৃত্য, তা কি কেবল তাঁর চিত্ত হতেই উৎসারিত? বাংলা কবিতার প্রকৃতি ও পরম্পরার কোন উত্তরাধিকারকে তিনি নিজের করে নিলেন? এই প্রশ্নের যৌক্তিক মীমাংসা ব্যতীত ওমর আলীর কবিতার প্রতি সুবিচার করা অসম্ভব।

কোনো শিল্পস্রষ্টাই শেষ পর্যন্ত স্বয়ম্ভু নন। অতীতের কোনো এক সমৃদ্ধ শিল্পভূমিতেই বিস্তৃত হয় তাঁর শিকড়। ওমর আলীর পূর্বসূরি হিসেবে উল্লেখ করা যাবে জীবনানন্দ দাশের নাম। ওমর আলীর প্রস্তুতিপর্বে জীবনানন্দ দাশকেই বেশি ভালো লাগলো বলে উল্লেখ করেছেন কবি নিজেই। জসীমউদ্‌দীনের নামও এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। জীবনানন্দ দাশ এবং জসীমউদ্‌দীনের গ্রাম বাংলা ও প্রকৃতিকে আরও প্রাণবন্ত ও বাস্তবধর্মী করার লক্ষ্যেই আমার পরবর্তী কবিতাগুলো লেখা হয়েছে।’— শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় ওমর আলীর এ স্বীকারোক্তি নিশ্চয়ই পাঠকের মনে পড়বে। তাঁর কবিতা পাঠ করে বন্দে আলী মিয়ার কবিতার কথা মনে পড়াও অসম্ভব নয়। কিন্তু ওমর আলীর আদর্শ হিসেবে এঁদের কাউকে স্বীকৃতি দেওয়া চলে না। আমাদের বিবেচনায়, কাব্যাদর্শ হিসেবে তিনি কোনো মহৎ কিংবা কালোত্তীর্ণ কবিকে গ্রহণ করতে চাননি। তিনি মানুষের কাছে ফিরেছেন। সেই মানুষের কাছে, যাদের সান্নিধ্যে এলে সোনার মানুষ হওয়া যায় এবং এই মানুষেরাই মূলধারার বাংলা কবিতায় দীর্ঘদিন উপেক্ষিত থেকেছেন। আমাদের কাছের মানুষই তাঁরা, যাঁদের দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া। কিন্তু বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তন্নতন্ন করে আমরা কবিতার উপাদান ও করণকৌশল অন্বেষণ করেছি, যদিও সেই ব্রহ্মাণ্ডের উর্বরতা বিষয়েও অন্তহীন অনিশ্চয়তার জন্য আমাদের পূর্বসূরিদের আক্ষেপ করতে দেখেছি। এ প্রসঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কথা নিশ্চয়ই আমাদের মনে পড়বে যিনি বলেছেন, বিশ্বের সেই আদিম উর্বরতা আজ আর নেই। এখন সারা ব্রহ্মাণ্ড খুঁজে বীজ সংগ্রহ না করলে, কাব্যের কল্পতরু জন্মায় না। একথা সুধীন্দ্রনাথের স্বকাল এবং তাঁর পরবর্তী দশকের অনেক কবির ক্ষেত্রেই হয়তো প্রযোজ্য হবে। কিন্তু ওমর আলী কবিতার জন্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরিবর্তে নিজের দিকে তাকিয়েছেন, আপনারে আপনি চিনে নিতে চেয়েছেন, যে রকম পরামর্শ দিয়েছেন ফকির লালন শাহ্। ফিরে চল মাটির টানে বলে যে আহ্বান জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তার প্রতিফলন রবীন্দ্র-পরবর্তী প্রভাবশালী কবিবৃন্দের শিল্পসৃষ্টিতে খুব একটা চোখে পড়ে না। ওমর আলী সেই মাটির টানকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন, সেই মাটির মানুষের জীবনাভিজ্ঞতাকে শিল্পরূপ দিয়েছেন। বাংলা কবিতায় দীর্ঘ সময়ের সেই প্রত্যাখ্যাত ভালোবাসা এতোদিন কোন্ অমৃতে বেঁচে রইল, তা অনুধাবনের জন্য কবিতার ইতিহাস ও পরম্পরার প্রকৃত পৃষ্ঠাগুলো পাঠ করা জরুরি। আমার বিবেচনায়, ওমর আলী কবিতায় প্রকৃতি ও মানুষের প্রকৃত পাঠ নিরূপণেরই চেষ্টা করেছেন।

বাংলা কবিতার নাড়ি-নক্ষত্র নিয়ে যেকোনো আলাপচারিতায় একটা বিরাট অংশে নারীর অধিষ্ঠান লক্ষ করা যায়। প্রেমের কবিতায় নারী, বিরহের কবিতায়ও। নারীকে নানাভাবে দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গি বাংলা কবিতায় দৃশ্যমান, তাকে এককথায় রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়, অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা। নারীর যে আধেক সত্তায় মানবীয় ঐশ্বর্যের দেখা মেলে, তা থেকে একজন কবির সৃজনপ্রতিভার বিশেষত্ব নির্দেশ করা চলে না। কারণ, তাতে ব্যক্তিমানুষের অভিজ্ঞতা ও অভ্যাসের প্রথাবদ্ধ দিকটিই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে দেখি। তাই নারীবিষয়ক ভাবনার বাকি অর্ধেক অর্থাৎ কল্পনাই একজন কবি থেকে অন্য একজনকে পৃথক করে দেয়। এই বিবেচনা প্রত্যেক কবির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও ওমর আলীর ক্ষেত্রে তা দৃশ্যমান সত্য ও স্বীকৃত অভিধায় পরিণত হয়েছে। এই স্বীকৃতির নিশ্চিতভাবেই সৌভাগ্যের, সম্মানের। বুঝতে পারছেন, আমরা এ দেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি কাব্যগ্রন্থের কথা বলছি। কবিতায় শ্যামল রঙ রমণীর কথা ওমর আলীই প্রথম বলেছেন এমন নয়। রবীন্দ্রনাথের কবিতার কথা নিশ্চয়ই আমাদের মনে পড়বে শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল।/ আমার নিখিল/ তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল। অভিজ্ঞ পাঠকের মনে হয়তো আরও অনেক কবির এ-জাতীয় পঙ্‌ক্তি নড়েচড়ে উঠতে পারে। এই শ্যামলের সঙ্গে ওমর আলী কেবল দেশসুনামের সংযোগ ঘটিয়েছেন। এতেই মন্ত্রের মতো মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে তাঁর উচ্চারণ। কবিতার কাছে আমাদের প্রত্যাশা কী, তা হয়তো সব সময় স্পষ্ট করে বলা যায় না, কিন্তু কবিতায় আমরা কখনো কখনো এমন কিছু পেয়ে যাই, যা আমাদের প্রত্যাশার সীমাকেও অতিক্রম করে যায়। ওমর আলীর কবিতায় প্রত্যাশার সীমা অতিক্রমী এমন কিছু নিশ্চয়ই আছে, যা পাঠকের মনে অনাস্বাদিত আনন্দ সঞ্চার করে।

ওমর আলীর কবিতায় বৈষয়িক পরিমণ্ডল নিয়ে কেউ কেউ আলোচনা করেছেন। তাঁর কবিতায় গ্রামের মাটি ও মানুষের অবয়ব নির্ধারণে যাঁরা মনোযোগী হয়েছেন, তাঁদের পরিশ্রম ও পাণ্ডিত্যকে প্রণতি জানিয়েই বলি, ওমর আলীর বিশেষত্ব তাঁর কবিতায় বিধৃত বিষয়ের গতর ঘেঁটে চিহ্নিত করা যাবে না। বস্তুত কোনো মহৎ কবির বসবাসই তাঁর বিষয়ের বাস্তুভিটায় নয়। তিনি অন্য কোথাও থাকেন, অন্য কোনো অনুষঙ্গে তিনি আর সব কবি থেকে আলাদা হয়ে যান। ফলে কী দেখছেন সেই দিক থেকে আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হয় অন্যদিকে, কীভাবে দেখছেন এবং সেই দেখাকে কীভাবে শব্দবন্দি করছেন, সেই বিবেচনাই তখন বড় হয়ে ওঠে। তাই কবিতার ইতিহাসকে যাঁরা টেকনিকের ইতিহাস বলেছেন, শেষ পর্যন্ত তাঁদের প্রতিই আমাদের ভক্তিভাব জাগ্রত হয়। তবে ভয়টা অন্য জায়গায়। কবিতার বিষয়কে কবিতার শরীর থেকে যত সহজে বিচ্ছিন্ন করে অন্যের বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করা যায়, টেকনিক বা কৌশলের দিকটাকে সেইভাবে পাঠকের সামনে দৃশ্যমান ও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যায় না। কবিতার পরিণত পাঠক তাই আলোচনা-সমালোচনায় সময় নষ্ট না করে সরাসরি কবিতার কাছে ফিরতে চান।

তবু আমরা কবিতা নিয়ে কথা বলি, বলতে ভালো লাগে। যাঁকে নিয়ে বা যাঁর কবিতা নিয়ে কথা বলি, কেবল যে তিনি বা তাঁর কবিতার কথাই বলি এমন নয়। কবি বা কবিতার বরাত দিয়ে আমরা মূলত নিজের কথা বলতে চাই এবং যে কথাগুলো মূলত নিজের বলে ভাবি, তারও অনেক কথার জন্মতীর্থও হয়তো সেই কবি বা তাঁর কবিতা। কবিতাবিষয়ক যেকোনো আলোচনাই সেই অর্থে, তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান। ওমর আলীর কবিতার সঙ্গে কালযাপনের আরাম ও আনন্দের নিশ্চয়ই নানা দিক আছে। কিন্তু পাঠক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা হলো, তিনি পাঠকের দেখার প্রথাবদ্ধ চোখকে বদলে দিতে চান। বদলে দেওয়ার জন্য তিনি কোনো রঙিন চশমার শরণ নেন না, চোখের সামনে কোনো ঝলমলে দৃশ্যপটও মেলে ধরেন না, বরং দেখার চোখকে ফাঁকি দিয়ে হৃদয়ের সঙ্গে একধরনের বোঝাপড়া করে নেন। অন্তরের চোখ দিয়ে দেখার কথা আমরা প্রায়ই বলি, কিন্তু এই চোখে যে ধুলো জমে, এই চোখের চারপাশে যে দেয়াল নির্মিত হয়, তা বুঝতে পারি না। ওমর আলী বুঝতে পারেন। তাই তাঁর কবিতা আমাদের অন্তর্দৃষ্টির সমস্ত ধুলোমলিনতা দূর করে নেন, বিদ্যমান দেয়ালগুলোকে ভেঙে দিয়ে তিনি বলেন, চলুন এবার কবিতার মুখোমুখি, অর্থাৎ নিজের মুখোমুখি বসি।

ওমর আলী সম্পর্কে আমি এতক্ষণ যা কিছু বলেছি, তার সত্যতা প্রমাণের জন্য তাঁর কবিতা থেকে বিপুল উদ্ধৃতি দাবি করে এবং আমার কথায় আস্থা রেখে যারা বিভ্রান্ত হতে চান না, তারা নিশ্চয়ই ওমর আলীর কবিতার প্রতীক্ষায় আছেন। পাঠকের এই দাবি পূরণের কাজটি খুব কঠিন এমনও নয়। তাঁর কিছু কালজয়ী কবিতার চৌম্বক অংশ উদ্ধৃত করে সেই কবিতা বা কবিতাংশের ভাব ও রূপ দুর্বল গদ্যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে কবির অভিব্যক্তিকে নিজের বলে প্রচার করলেও কাজ চলে যাবে। তবু আমি সেই পথে হাঁটব না। পরিশ্রমী পাঠক এ কাজটি নিজেই করে নিতে পারবেন। অভিজ্ঞতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বাস্তবের পৃথিবীতে পরের মুখে ঝাল খাওয়ার অভ্যাস স্বাস্থ্যকর নয়। তবে স্বপ্ন ও কল্পনা, সৌন্দর্য, সম্প্রীতি ও সম্পৃক্তির পৃথিবীতে অর্থাৎ কবিতার দেশে আমরা পরের মুখে মিষ্টি খাওয়ায় অভ্যস্ত হবো কেন? কবিতার এই মিষ্টতাকে আলিঙ্গন ও চুম্বনের সমকক্ষ ভাবতেই আমার ভালো লাগে এবং এই অভিজ্ঞতা কখনোই তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না। কবিতার পাঠককেও তাই নিজের মতো করে বুঝে নেওয়া ও খুঁজে নেওয়ার বিচিত্র ব্যবস্থাপনায় মনোযোগী হতে হয়। তবু জানি, প্রমাণপত্র হাজির না করলে আমার কথামালা শঙ্ঘ ঘোষের কবিতার ভাষায়, কেবলই উড়ে বেড়াবে, ঘুরে বেড়াবে, সমস্ত দিনমান পথে পথে পুড়ে বেড়াবে। কাজেই, প্রয়োজন হলো অনাবিল আশ্রয়ের, নিশ্চিত নোঙরের। এই প্রবন্ধে নোঙর বলতে আমরা ওমর আলীর কবিতাই বুঝব। তবে তাই হোক। ওমর আলীর কয়েকটি কবিতায় ডুব দেওয়ার প্রত্যাশা রাখি।

এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি কাব্যের নাম-কবিতার পর ওমর আলীর সবচেয়ে আলোচিত ও আকর্ষণীয় কবিতা সম্ভবত একদিন একটি লোক। ছোট্ট কবিতাসরল, স্নিগ্ধ, তন্বী নদীর মতো এর অবয়ব। অন্তর্গত বৈভবও অনেকটা জলের স্বভাবজাত, যা কেবলই ঘুরে ঘুরে একা কথা বলতে চায়, বিশ্রামের সময় দেয় নাএকটা অনাস্বাদিত বিহ্বলতার ভেতর দিয়ে পাঠকের চিত্ত ও চিন্তাকে বিগলিত করে। সংলাপধর্মী কবিতায় আমরা যে স্বতঃস্ফূর্ততা প্রত্যাশা করি, তার পুরোটাই এই কবিতায় ধারণ করেছেন কবি। কিন্তু কবিতায় বিধৃত ছবির বাইরে আরও কিছু দৃশ্যপট পাঠককে অন্য দিগন্তে টেনে নিয়ে যায়, যেখানে অপ্রাপ্তি-অতৃপ্তি-দুঃখ-দীর্ঘশ্বাসের একটা সর্বজনীন রূপ পরিস্ফুট। পাঠক হিসেবে আমরা জানি, বিরহই প্রেমের কবিতার প্রধান অবলম্বন। কিন্তু সেই বিরহের বিস্তৃত বয়ান থেকে কবিতাটি একেবারেই মুক্ত, কবিতার শরীরে তার সামান্য অভিঘাতমাত্র উপস্থিত, বাকিটা পাঠকচিত্তের অভিজ্ঞতার সমান্তরালে প্রসারিত। পুরো কবিতাটি একবার পাঠ করা যাক:

একদিন একটি লোক এসে বললো, ‘পারো?’
বললাম ‘কি?’
‘একটি নারীর ছবি এঁকে দিতে’, সে বললো আরো,
‘সে আকৃতি
অদ্ভুত সুন্দরী, দৃপ্ত, নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে—পেতে চাই নিখুঁত ছবিতে।’
 ‘কেন’ আমি বললাম শুনে।
 সে বললো, ‘আমি সেটা পোড়াবো আগুনে।’

[একদিন একটি লোক/ এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি]

এই কবিতা নিয়ে অনেক কথা বলা যায়, বলার ইচ্ছে সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু কী লাভ তাতে? কথাগুলো এত অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক মনে হয় যে, তা কবিতার সৌরভ, সংহতি ও সমৃদ্ধিতে কোনো নতুনত্ব যোগ করে না, বরং কবিতার গতি ও গভীরতাকে আরও বিভ্রান্ত ও ভারাক্রান্ত করে। তাই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ—‘এর চেয়ে অনেক ভালো চুপ করে থাকা। মোদ্দাকথা এই যে, ওমর আলীর কবিতা কেবল পাঠকচিত্তেই নিজস্ব নিয়মে ডালপালা বিস্তার করতে চায়। বাকি যা কিছু, তা কেবল কথার কথা।

আরও একটি সংলাপধর্মী কবিতার শরণ নিতে চাই। কবিতার নাম বেদনার মন। এই কবিতায় বেদনা মধুর হয়ে যাওয়ার মতো কোনো অনুষঙ্গ নেই। বরং বিচিত্র রূপকল্পে বেদনাকে তীব্রতর করে তোলার চেষ্টা আছে। কবিতাটিতে মনের অতল থেকে জলের অতলে পাথরের এই যে তলিয়ে যাওয়া, তা হয়তো অদৃশ্য ও অনুভবসম্ভব বেদনাকে দৃশ্যমান ও স্পর্শের সীমায় নিয়ে আসার প্রয়াস। একটি পাথর পুকুরের জলে যে আলোড়ন তোলে, তা হয়তো পাড়ে এসে পৌঁছানোর আগেই জলের শরীরে হারিয়ে যায়, কিন্তু মনের বেদনা মনের নানা প্রান্তে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখে যায়। সেই প্রভাব ব্যক্তিস্বভাবের সমান্তরালে নানা ভাব ও ভাষায় অনূদিত হতে থাকে। বেদনা সম্পর্কে একজন নারীর যে অভিজ্ঞান এই কবিতায় মুদ্রিত, তাতে কবিরও সায় আছে বলে মনে হয়। সেই অর্থে বেদনার এই অভিব্যক্তি কবিরই যা তিনি ছবির মতো করে পাঠকের চোখের সামনে মেলে ধরেছেন। এই ছবি কেবল দৃশ্যের সীমায় আবদ্ধ না থেকে পাঠকের অদৃশ্য বেদনার দ্যোতক হয়ে ওঠে। নারীর ভাষ্যে পাথরের অনুভব-ক্ষমতার যে বয়ান ওমর আলী এই কবিতায় ধারণ করেছেন, তা থেকে পাঠকের মনে এই ধারণা জন্মানো অসম্ভব নয় যে, নারী-হৃদয় পাথরের চেয়েও রূঢ়, কঠিন, অনুভূতিহীন। কবিতায় প্রশ্নকর্তা যে পুরুষের উপস্থিতি আমরা লক্ষ করি, এই নারী নিশ্চয়ই তার কল্পনাজাত। তাতে পাঠক হিসেবে আমরা কোনো সমস্যা বোধ করি না। বরং নারী হৃদয়কে নেড়েচেড়ে দেখার পুরুষতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ও অভিব্যক্তিতে তা নতুন মাত্রা যোগ করে। পুরো কবিতাটিই উপভোগ করা যাক:

‘একটি তীক্ষ্ণ ঢিল বিদ্ধ ক’রে মনের অতলে 
যদি কেউ ভেবে দেখে কি হয় সেখানে’— 
এক নারী চোখ রেখে পুকুরের জলে 
বললো ক্লান্ত স্বরে, ‘তা হ’লে সে জানে’— 
কৌতূহলে সুধালাম, ‘তা হ’লে কি জানে?’ 
একটি পাথর মুঠো করে সে তখন
ছুঁড়ে দিলো পুকুরের ঠিক মাঝখানে; 
সশব্দে বিদ্ধ, স্থির জলে আলোড়ন, 
কাঁপুনি ছড়ালো চারদিকে গোলাকার। 
সে নারী করুণ স্বরে বললো আবার, 
‘তা হ’লে সে জানে এক বেদনার মন।’

[বেদনার মন/ এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি]

এই কবিতায় কী আছে তা বোঝার জন্য ওমর আলীর কবিতাই যথেষ্ট। আর যা কিছু নেই কিন্তু পাঠক হিসেবে আমাদের ভাবনার চারপাশে ঘুরপাক খায়, সেটুকু বোঝার জন্যও এই কবিতার নিকটবর্তী হতে ইচ্ছে করে। পাঠকের চেতনায়-কল্পনায় কবিতার নবজন্মের যে সম্ভাবনা সুপ্ত থাকে বলে কাব্যতাত্ত্বিকেরা দাবি করেন, সেই সূত্র কিংবা চাবিকাঠির তত্ত্বতালাশে অবতীর্ণ না হয়েও আমরা নিজের মতো করে একটি কবিতার পাঠ নির্মাণ করতে চাই। অর্থাৎ, সার্থক শিল্পের সান্নিধ্যে আমরা সৃষ্টিশীল হয়ে উঠি। ওমর আলীর যে কটি কালজয়ী কবিতার কথা পাঠক হিসেবে আমরা ভুলতে পারি না, তাতে কবির উপলব্ধি ও পাঠকের বোঝাপড়ার একটা দ্বৈরথ চলমান থাকে বলেই বাংলা সাহিত্যের একজন বলবান কবি হিসেবে তিনি স্বীকৃত-সম্মানিত-অভিনন্দিত।

বেদনার মন কবিতায় আমরা যে পাথরের দেখা পাই, সেই পাথরই বোধ করি অন্য একটি কবিতায় স্বরূপে উদ্ভাসিত। কবিতার নাম পাথর। ধারণা করি, পুকুরের জলে ডুব দেওয়া যে পাথর বেদনার মন বোঝে বলে দাবি করেছিলেন এক নারী, সেই নারীই পাথরের অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করতে চেয়েছিলেন; জেনে নিতে চেয়েছিলেন, জলের গভীরে ডুব দিয়ে পাথর কোন্ অমৃতের দেখা পেয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এই কবিতার পাথর পুকুরের জলে নয়, রমণীর চোখের জলে সিক্ত। এই সৌভাগ্যবান পাথর একাধিকবার নারীর বুকের স্পর্শ পেয়েছে। ফলে এই পাথর অনেক পুরুষেরই ঈর্ষার শিকার হতে পারে। কিন্তু পাথরের ঠোঁটে যে নীরবতা বাসা বেঁধেছে, সেই নীরবতা পাথরের চেয়েও নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে রমণীর হৃদয়কে রক্তাক্ত করে। সেই রক্ত পাঠক হিসেবে আমাদের চিত্তলোকেও অমোচনীয় চিহ্ন রেখে যায়। কবিতাটি এক নিশ্বাসে সে পড়ে ফেলার মতো সুন্দর-সাবলীল-নান্দনিক:

একটি রমণী একটি পাথরকে বুকে চেপে ধরে
বললো আকুল স্বরে, ‘তুমি একবার,
একবার শুধু কথা বলো।’
তারপর সে নীরব হলো।
হয়তো শোনার জন্যে পাথর কি বলে।
পাথর ভিজলো তার দু’চোখের জলে।
খুললো না পাথরের মুখ।
রমণী আবার তার বুক
মিশালো পাথরে, 
বললো আকুল ভেজা স্বরে,
‘কথা বলো, ওগো, বলো কথা!’
পাথর দিলো না সাড়া। পাথরের ঠোঁটে নীরবতা।

[পাথর/এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি]

পাথরের এই নীরবতাকে নানা ভাব ও ভাষায় অনুবাদ করার সুযোগ আছে। কবিতাটির শুরুতেই আমরা লক্ষ করি, পাথরের সঙ্গে কথোপকথনের আগেই পাথরটিকে রমণী বুকে চেপে ধরেছে। তারপর কথা বলার আকুল আবেদন প্রকাশ পেয়েছে। চোখের জল ও বুকের স্পন্দনেও কেঁপে ওঠেনি পাথরের ঠোঁট, ভাঙতে পারেনি তার স্তব্ধতা। নারীর এই অসহায়ত্ব হয়তো আমার দুর্বল গদ্যভাষ্যে পরিস্ফুট হবে না। এই নিস্তব্ধতা থেকেই জন্ম নেয় শূন্যতার বোধ এবং এই শূন্যতা থেকে কোনো সম্ভাবনার দ্যুতি সঞ্চারিত হয় নাআবু হেনা মোস্তফা কামাল যেমন বলেছেন, কেবল শূন্যতা ছাড়া শূন্যতার নেই কোনো মানে। প্রশ্ন জাগে, নারীর বুকের স্পর্শেই কি ওমর আলীর কবিতার পাথরের এই নির্মম-নিষ্ঠুর নীরবতা? কিংবা নারী-হৃদয়ের প্রতিভূ হিসেবেই কি এই কবিতায় পাথরকে হাজির করা হয়েছে? নারী-হৃদয় নিশ্চয়ই সেই পরশপাথর নয় যার স্পর্শে স্বল্পমূল্যের তামা-লোহা-পিতল খাঁটি সোনায় রূপান্তরিত হবে। তাই বলে কি তা এতই হন্তারক যা সজাগ-সক্রিয়-প্রাণবন্ত সত্তাকেও পাথরে পরিণত করবে? প্রশ্নগুলো পাঠকের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। উত্তর খুঁজতে গিয়ে হয়তো অনাস্বাদিত কোনো আলোর দিগন্ত মিলে যেতে পারে।

ওমর আলীর একটি কবিতার নাম আমি। এই কবিতা রবীন্দ্রনাথের শ্যামলী কাব্যের আমি কবিতাটির কথা অবশ্যই মনে করিয়ে দেবে, যেখানে কবি তাঁর চেতনার রঙে পান্নাকে সবুজ করে তুলেছেন, চুনির শরীরকে রাঙিয়ে দিয়েছেন, তাঁরই চোখের আলোয় আকাশের পূর্বে-পশ্চিমে দীপ্তি ছড়িয়েছে। এই অহংবোধই কবিতাটিকে মহিমান্বিত করেছে। কারণ, রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, মানুষের অহংকার-পটেই/ বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প। ওমর আলীর কবিতায়ও আমরা এই অহংবোধের শিল্পরূপ দেখতে পাই। ভাবের দিক থেকে যেটুকু মিল দুজনের কবিতা দুটিকে কাছাকাছি করেছে, ভঙ্গির বৈপরীত্য আবার দুজনের কবিতা দুই ভিন্ন মেরুতে পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথ জীবনের যাবতীয় অর্জনকে কেন্দ্রে ধারণ করে জীবনকেই উদযাপনের কথা বলেছেন। অন্যদিকে ওমর আলীর কবিতায় মৃত্যুকে কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছে। মৃত্যু-চেতনার প্রসঙ্গেই কবিতায় হাজির হয়েছে হারিয়ে যাওয়ার কথা, বহদূর চলে যাওয়ার বেদনা-বিহ্বল উচ্চারণ। কিন্তু এই হারানোর মধ্যে তিনি তাঁর চারপাশের সবকিছুর মধ্যে নিজের উপস্থিতির প্রগাঢ় ছাপ রেখে যেতে চেয়েছেন, যে কথা রবীন্দ্রনাথের গানে ধ্বনিত হতে দেখি—‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি। ওমর আলী সাগরের দেহে মিশে যেতে চেয়েছেন, বেলাভূমির ওপর সবুজ ঘাসের শরীরে নিজেকে ঢেলে দিয়েছেন, অরণ্যের ডালে ফুল হয়ে ফুটে উঠতে চেয়েছেন এবং সেই ফুলকে নারীর চুলে সজ্জিত দেখতে চেয়েছেন, নদী-ঢেউ-মাঝি-মাল্লার গানের সুরে অনুভব করেছেন নিজের অস্তিত্বের প্রতিধ্বনি। অবশেষে তিনি নোঙর করেছেন বাংলাদেশের শ্যামল মাটিতে, যার অনেক গভীরে প্রোথিত তাঁর শিকড়। মানুষের কাছেও তিনি ফিরেছেন, যে মানুষ বাংলার জল-কাদার মতোই নরোম, স্নিগ্ধ, মহিমান্বিত। কবিতাটির অংশবিশেষ উদ্ধৃত করি:

আমি ওই উর্বরা মাটিতে
চিরকাল নতুন ফসলে
মানুষের ঘরে, পৃথিবীতে
হাসি-খেলি ফুলে আর ফলে।
সকল সৃষ্টিতে আমি আছি,
ছিলাম এবং রয়ে যাবো;
সময়ের মধ্যে, কাছাকাছি
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দাঁড়াবো। 
আমি যদি হই মহাকাল, 
আমাকে স্বীকার করবে না? 
যদি হই ফুল ভরা ডাল 
ইতিহাস, সাগরের ফেনা?

[আমি/এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি]

রবীন্দ্রনাথের আমি কবিতায়ও মহাকালের কথা আছে। কিন্তু সেই মহাকালের বেদনাকে তিনি মহামানবের চিত্ত ও চিন্তালোকের অনুভবসম্ভব শব্দভাষ্যে চিত্রিত করেছেন। ফলে কবিতায় বিধৃত উপলব্ধিকে কবির বাণী বলে দাবি করলেও পাঠকের কাছে তা অনেকটা তত্ত্বকথার মতো মনে হয়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ওমর আলী লিখেছেন, জীবনকে আমিও দেখতে গেলেই/ দেখি লোকটা আমার আগেই আমার সামনে হাঁটছে.../ কখনো আমি অনেক পেছনে আর সে অনেক দূরে/ এগিয়ে আছে/ বলা চলে সে এগিয়ে গিয়েছে...। [রবীন্দ্রনাথ/আমার ভেতরে খুব ভাঙচুর হচ্ছে]। রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ে এই অভিব্যক্তি রবীন্দ্র-পরবর্তী প্রত্যেক কবিরই, এমনকি যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে আপন আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ভিন্ন আকাশ খুঁজে নিতে চেয়েছেন, তাঁদেরও। কিন্তু আপন স্বভাবেই ওমর আলী রবীন্দ্র-ভুবনের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন, ফিরে গেছেন সাধারণ মানুষের কাছে, যাপিত জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত নানা বিষয়ের মধ্যেই খুঁজে নিতে চেয়েছেন নিজের অস্তিত্বের প্রগাঢ়তা। ধারণা করি, ওমর আলীর মতো মাটির কাছাকাছি থাকা কোনো এক কবির বাণী শোনার জন্য রবীন্দ্রনাথ কান পেতে ছিলেন।

কবির মতের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার মাধ্যমেই পাঠক হিসেবে আমরা একটি সফল সৃষ্টিকর্মকে নিজের করে ভাবতে শিখি। কবির সঙ্গে মতবিনিময়ের প্রত্যাশা নিয়ে কবিতার সান্নিধ্যে এলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই বিনিময়ের মধ্যে পাঠকের আত্মসমর্পণের ব্যাপারটিই প্রাধান্য পায়। কিন্তু কখনো কখনো কবির সঙ্গে ভিন্নমতের ফাঁক গলেও বেরিয়ে আসতে পারে একটি কালজয়ী কবিতা। এ প্রসঙ্গে ওমর আলীর দ্বিমত কবিতাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করা যায়। কবি যে ভাবনায় তাড়িত হয়ে সুসজ্জিত বাগানের সদ্য ফোটা সূর্যমুখীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর নিকটবর্তী হয়েছেন, সে ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে সেই রমণীর অবস্থান। সূর্যমুখীর সৌন্দর্য সেই নারীকে আকৃষ্ট করছে না। ফলে সেই নারীর খোঁপায় ফুল পরানোর চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। কারণ, সে ফুলের সৌন্দর্যের চেয়েও গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় নিয়ে ভাবছেসেই ভাবনার নাম জীবন। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’—সুকান্ত ভট্টাচার্য এই সত্যকে বাঙালির হৃদয়ে চিরস্থায়ী করে দিয়েছেন। তবু নারীর সৌন্দর্যকে আমরা ফুলের সঙ্গে তুলনা করি এবং সেই ফুলে সাজিয়ে নিয়েই তাকে আমাদের ব্যক্তিগত আঙিনায় উপস্থিত করতে চাই। ওমর আলীর রমণীরা প্রায়শই আমাদেরকে এ-জাতীয় ভাবনার অন্তঃসারশূন্যতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, মনে করিয়ে দেয়, জীবন মানে বেঁচে থাকার আশা, এবং এই আশার পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণের প্রয়োজনীয় উপকরণ। পুরো কবিতাটিই এখানে উদ্ধৃত করছি:

অপরাহ্ণে দেখা হলো রমণীর সাথে এক সজ্জিত বাগানে
সূর্যমুখীর দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে আছে একা,—
হৃদয় উন্মুখ যেন সুললিত গানে। 
বললাম, “রূপবতী, শেষ হলো দেখা? 
কি সুন্দর ফুল! 
এ ফুলে মানায় বেশ রূপসীর খোঁপাবাঁধা চুল।”
সে বললো মৃদু হেসে, “আমি ভাবছি, সূর্যমুখী দ্বারা 
ফুলকপির মতো ভালো ব্যঞ্জন কি যায় রাঁধতে পারা।”

[দ্বিমত/অরণ্যে একটি লোক]

আপাদমস্তক প্রেমিক পাঠকেরা হয়তো মেয়েটিকে বেরসিক ভেবে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। তাঁদেরকে একটু গভীরভাবে চিন্তা করার অনুরোধ করছি। তাহলে বুঝবেন, এই রমণীর মতো আরও হাজার হাজার মেয়ে আছে আমাদের বাংলাদেশে, যারা কখনো খোঁপায় তারার ফুল পরার স্বপ্ন দেখতে পারে না, প্রেমিকের হাত ধরে নীল আকাশ, বিস্তৃত অরণ্য, সুউচ্চ পর্বত কিংবা গভীর সমুদ্র দেখার অভিপ্রায়কে বুকের ভেতর কবর দিয়ে রাখে। বিশ্বাস করতে হবে, তারা আমাদেরই লোক এবং ওমর আলী কোনো ভিনগ্রহের মানুষের কথা বলেননিনিজস্ব দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদেরকে নেড়েচেড়ে দেখার কথাই বারবার ব্যক্ত করেছেন তিনি। ওমর আলীর দ্বিমত কবিতাটি আমাকে আহসান হাবীবের একটি কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়। বিদীর্ণ দর্পণে মুখ কাব্যের প্রিয়তমাসু কবিতায় আহসান হাবীব লিখেছেন, তোমার দুহাতে ফুল তুলে দেবো এই ছিল সাধ/ হাতে হাত রেখে আংটি পরাবো এই ছিল সাধ/ তুমি শুধু বলো, ফুল নয়, চাই ভাত দাও ভাত।/ আংটিও নয়, ভাতে ভরে দাও আমার দুহাত। ওমর আলীর দ্বিমত কবিতার সঙ্গে আহসান হাবীবের প্রিয়তমাসুর মিলের জায়গাটির নাম ক্ষুধা ও দারিদ্র্য। কিন্তু বিষয়ের মিলের কারণে একটি কবিতা আরেকটি কবিতার সৌরভ-সংহতি-সমৃদ্ধিকে ম্লান করতে পারে না। কারণ, কবিতার অধিষ্ঠান বিষয়ের অভ্যন্তরে নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে। সেই স্থানে পৌঁছানোর জন্য কোনো তাত্ত্বিক ধারণা নয়, পাঠকের আত্মিক উপলব্ধিই প্রধানতম পাথেয়।

ওমর আলীর দ্বিমত কবিতার নিকটাত্মীয় হিসেবে একটি কবিতার উল্লেখ করা যায়। কবিতাটির নাম একটি লোক শূন্য নদী তীরে। আত্মীয়তার সম্পর্কসূত্রেই বোধ করি কবিতা দুটিকে অরণ্যে একটি লোককাব্যে পরপর স্থান দেওয়া হয়েছে। কবিতাটি নিয়ে আমি খুব বেশি বাক্য ব্যয় করার পক্ষপাতী নই। যা বলার, তা যেমন কবি বেশ স্পষ্ট করে বলার চেষ্টা করেছেন, তেমনি পাঠক হিসেবেও যা কিছু বোঝার, তা খুব সহজেই আমরা বুঝে যাই। কবিতা ও জীবন একই জিনিষেরই দুই রকম উৎসারণ।’—জীবনানন্দের এই অভিব্যক্তির ওপর আমাদের অগাধ আস্থা, যদিও জীবনানন্দের সমকালে কিংবা তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের অনেক কবিই কবিতাকে জীবনের দিকে নয়, বরং জীবন থেকে দূরবর্তী এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং এই চেষ্টা এখনো অব্যাহত আছে বলে মনে হয়। কিন্তু সে আলোচনা অন্য অবসরে করা যেতে পারে। আপাতত ওমর আলীর কবিতার কাছে ফিরে যেতে চাই:

একটি লোক বসেছিলো শূন্য নদী তীরে
মাঠের মধ্যে এক বটগাছ তলে।
দেখলাম আমি কুতুহলে, 
সে লোকটি ধীরে 
একটি জীবন্ত ঘুঘু ফেলে দিলো তার সম্মুখে
প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে আর যেন বিচিত্র সুখে 
মৃদু হাসলো সে। 
তাজা পাখিটিকে পুড়তে দেখলাম আমি কাছে বসে। 
আমি তাকে বললাম, “তুমি কেন পোড়ালে জীবন্ত পাখিটিকে?”
এ কথায় স্থির চোখে চেয়ে রইলো সে আমার দিকে।
তারপর তার মুখে শোনা গেলো পৈশাচিক এক অট্টহাসি।
বললো, “জীবন মোহময়, তাই জীবনকে পোড়াতে ভালোবাসি।”

[একটি লোক শূন্য নদী তীরে/অরণ্যে একটি লোক]

কবিতাটি নিঃসন্দেহে জীবনঘনিষ্ঠ। আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনা হওয়ার অভিপ্রায় এতে ধরা পড়েছে। বেদনাহত হৃদয়ের আর্তনাদও এতে উপস্থিত। মোহমুগ্ধতার পরিণাম যে সুখকর হয় না সে সম্পর্কেও একটা সতর্কতার ইঙ্গিত আছে। কিন্তু কবিতাটিতে দর্শনের প্রবল উপস্থিতি কিছুতেই পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না, বরং দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে, অন্ধ করে দিতে চায়। দর্শনের চাপে এই কবিতার গোলাপটি সহজ-সাবলীল-স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের পর্যাপ্ত পরিসর থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে মনে হয়। ফলে আগুনে পোড়া পাখিটির জন্য আক্ষেপ করতেও আমরা ভুলে যাই। মোহমুক্তির অভিঘাত এত তীব্র যে, মুক্ত বিহঙ্গের স্বাধীনতা শুধু নয়, তার জীবনসংহারের ঘটনাটিও কোথায় যেন চাপা পড়ে যায়। এ কারণেই প্রথম কবিতাটি পাঠকের চিত্ত ও চিন্তাকে যেভাবে আপ্লুত ও ভারাক্রান্ত করে, দ্বিতীয় কবিতাটি সেইভাবে ছুঁয়ে যায় না। মনে হয় কবিতার কাঠামো বা অবয়বকে ব্যবহার করে কবি এখানে জীবন-দর্শন বিষয়ে আমাদের সদুপদেশ দিতে চাইছেন। দর্শনের আনুগত্য কীভাবে কবিতার কণ্ঠরোধ করতে পারে, তা বোঝার জন্য দ্বিমতএকটি লোক শূন্য নদী তীরে কবিতা দুটিকে পাশাপাশি পাঠ করার পরামর্শ দিয়েই এ-বিষয়ক আলোচনায় ইস্তফা দিতে চাই।

এই লেখায় ওমর আলীর কবিতার নানা দিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রলোভনকে আমি নিষ্ঠুরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছি। এই নিয়ন্ত্রণের পক্ষে অনেক যুক্তি আছে, তবে প্রধান কারণ হিসেবে বলা যায়লেখাটির লাগাম টেনে ধরা। অর্থাৎ অল্প পরিসরে ওমর আলীর কবিতার তাৎপর্যপূর্ণ দু-একটি দিক তুলে ধরা। এ জন্যই ওমর আলীর ছোট ও সংক্ষিপ্ত কবিতাগুলোকে আমি বিবেচনায় নিয়েছি, দৃষ্টান্ত হিসেবে এই লেখায় হাজির করেছি। ওমর আলীর শ্রেষ্ঠ কবিতার পরিসরও বেশ বড়চারশত ষোলো পৃষ্ঠার এই বইটিতে কবিতার সংখ্যাও উল্লেখ করার মতো। কিন্তু তাঁর এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি এবং অরণ্যে একটি লোক বইয়ের ছোট্ট কবিতাগুলোই আমাকে অধিকতর আকর্ষণ করেছে। কারণ, কবিতার কাছে আমি যে বিস্ময় ও মুগ্ধতা প্রত্যাশা করি, তা ওমর আলীর ছোট্ট কবিতাগুলোতেই স্ফটিক-সংহতি লাভ করেছে। তিনি যেখানেই বিস্তৃত হয়েছেন, বড় পরিসরে নিজের ভাবনাগুলোকে সজ্জিত করতে চেয়েছেন, অর্থাৎ দীর্ঘ কবিতার দিকে ধাবিত হয়েছেন, সেখানেই তিনি নিজেকে ছড়িয়ে ফেলেছেন, বলার কথাগুলোকে অধিকতর স্পষ্ট করে তুলতে চেয়েছেনপাঠকের কল্পনাপ্রতিভার ওপর খুব বেশি আস্থা রাখতে পারেননি। এ কথার অর্থ ওমর আলীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো নয়কারণ জীবনানন্দ দাশ যখন বলেন, কবিতা অনেক রকম, তখন অনেক রকম পাঠকের উপস্থিতিও স্বীকার করে নিতে হয়।

ওমর আলীর কবিতায় চমকে দেওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে। এই চমক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর করণকৌশলের অভিনবত্বে প্রাণ পেয়েছে বলে মনে হয়। কবিতায় কথোপকথনের প্রসঙ্গে আমরা যখন আলাপ করি, তখন সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে সামনে আসে আত্মকথনের ভঙ্গি। কিন্তু ওমর আলীর অনেক কবিতায়ই নাট্যকৌশলকে কাজে লাগানোর চেষ্টা আছে। অর্থাৎ একাধিক চরিত্র সংলাপ-বিনিময়ের মধ্য দিয়ে পাঠককে একটি সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। এ-জাতীয় কবিতাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে কবি উপস্থিত থাকেন, কিন্তু কবিতার মূল কথাটি বেরিয়ে আসে অন্য একটি চরিত্রের মুখ থেকে। সংলাপধর্মী কবিতায় ওমর আলী যে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন, তা সচেতন পাঠকমাত্রই স্বীকার করবেন। তাঁর যে কবিতাগুলো এখনো কবিতাপ্রেমীদের স্মৃতিতে মুদ্রিত আছে, তার অধিকাংশ কবিতায়ই এই সংলাপধর্মিতা লক্ষ করা যাবে। একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আমিও তাঁর সংলাপনির্ভর কবিতার ভক্ত। একটি সফল কবিতা পাঠ ও আস্বাদনের পর পাঠক তার মনের ভেতর যে ভাঙচুর অনুভব করেন, তার চেতনার বিস্তৃত চরাচরে যে অনিবার্য পরিবর্তন সাধিত হয়, সেই ভাঙচুর-বদলের রূপকল্পকে তিনি সব সময় অন্যের চোখে দৃশ্যমান করে তুলতে পারেন না। কালজয়ী কবিতার সৌরভ ও সমৃদ্ধিকে আত্মস্থ করার পর চুপ থাকাও তো অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই কথা বলতে ইচ্ছে করে। এই কথার বুক-পকেটে যে নীরবতা সঞ্চিত হতে থাকে, নিশ্চয়ই তা মহিমান্বিত, অর্থাৎ হিরণ্ময়।

এই নিবন্ধের নামকরণে যে ছবির প্রতিভাস মুদ্রিত, তাতে ওমর আলীর কবিতায় সারল্যের দীপ্তি অন্বেষণের প্রতিশ্রুতি আছে এবং এই শিরোনামও তাঁর এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি বইয়ের নাম-কবিতা থেকে ধার করা। এ বিষয়ে বিশেষ কোনো কৈফিয়ত হাজির করার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। ওমর আলীর কবিতার পাঠকমাত্রই জানেন, সহজ-সরল সাধারণ মানুষের কথাই সাবলীল ও বোধগম্য ভাষায় কবিতায় ধারণ করার চেষ্টা করেছেন তিনি। এই সরলতার শরীরেই তিনি গেঁথে দিয়েছেন অসাধারণ দীপ্তি ও দৃঢ়তা, যা পাঠককে আসক্ত করে, আপ্লুত করে, আচ্ছন্নও করে কখনো কখনো। তাঁর কবিতা ধরাছোঁয়ার বাইরের কোনো জগতের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ত করে না, অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানোর মতো অসহায় অবস্থার দিকে ঠেলে দেয় না। তাঁর কবিতা মানেই চেনা পল্লির প্রতিবিম্ব। পরিচিত ভূখণ্ডের ভাঁজে ভাঁজে তিনি জীবন ও জগৎ, সমাজ ও সম্পর্কের অনাস্বাদিত কিছু মাধুর্য ঢেলে দিতে জানেন। সহজ-স্বাভাবিক-স্বতঃস্ফূর্ত সৌন্দর্যের দিকে এই যে অভিযাত্রা, তা-ই বোধ করি তাঁর স্বকাল ও পরবর্তীকালের অন্য কবিদের থেকে ওমর আলীকে পৃথক করে দেয়।

গভীর, বিস্তৃত ও বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার জন্য ওমর আলীকে যেভাবে পাঠ করা প্রয়োজন, সেই পাঠ-প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা অনেক। দীর্ঘ জীবন তিনি কবিতার সঙ্গে যাপন করেছেন। এই যাপনের অভিজ্ঞতাকে শব্দরূপ দেওয়ার কাজেও তিনি একনিষ্ঠ থেকেছেন। ফলে তাঁর সৃষ্টিসম্ভারকে এক নিশ্বাসে আত্মস্থ করা অসম্ভব। আগ্রহ থাকলেও যে তাঁর সব রচনা হস্তগত হবে এমন নয়। তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থই এখন দুষ্প্রাপ্যের তালিকায়। সেই অর্থে তাঁর সম্পর্কে সমস্ত পাঠই বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত পাঠ, যদিও এই বিচ্ছিন্নতার শরীরে সুপ্ত থাকে সমগ্রতাকে আস্বাদনের অভিপ্রায়। বিক্ষিপ্ত পাঠের নানা প্রান্ত সংযুক্ত করে ওমর আলীর একটা অবয়ব কল্পনা করে নেওয়া যায়। কল্পনা করার কথা বলছি এ কারণে যে, ওমর আলীর অধিকাংশ কালজয়ী কবিতা পাঠকের কল্পনাপ্রতিভাকে সক্রিয় করেই চিত্তের বিস্তৃত প্রান্তরে আলোক-সঞ্চারের চেষ্টা করে।

কবিতার সঙ্গে ওমর আলীর যে সম্পর্ক, তা কোনো দিনই ছিন্ন হয়নি। আমৃত্যু কবিতার স্বজন হিসেবে নিজেকে নিবেদন করেছেন তিনি। তবু তাঁকে নিয়ে খুব বেশি আলোচনা-সমালোচনা কিংবা গবেষণা আমাদের চোখে পড়ে না। প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে তো নয়ই, প্রাণের টানেও খুব বেশি পাঠক-গবেষক তাঁর কবিতা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন বলে মনে হয় না। এই নীরবতার কারণ হিসেবে অনেকেই হয়তো কেন্দ্র ও প্রান্তের সংযোগহীনতার তত্ত্ব হাজির করবেন। শিল্প-সাহিত্যের বিচিত্র বাঁক ও বিবর্তনের তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব এবং এ বিষয়ে ওমর আলীর অনাগ্রহ-নীরবতা-নিষ্ক্রিয়তার কথাও কেউ কেউ বলবেন। ওমর আলী ও তাঁর কবিতা বিষয়ে এসব বিবেচনা হয়তো অমূলক নয়। তবে এ প্রসঙ্গে আমি একটু ভিন্ন রকম সিদ্ধান্ত পাঠকের বিবেচনার জন্য হাজির করতে চাই। আদর্শ ও আনুগত্যের যে মহাসড়ক একালের কবিবৃন্দকে প্রভাব, প্রতিপত্তি ও পুরস্কারের মন্দিরে পৌঁছে দেয়, সেখানে তিনি কখনোই সরব ও সক্রিয় ছিলেন না। কবিতার শক্তিতে তিনি সবাইকে নিজের দিকে টানতে চেয়েছেন। আহসান হাবীবের কবিতা থেকে ধার করে বলা যায়, সুসজ্জিত ঘরবাড়ি/ সখের বাগান/ সভামঞ্চে করতালি/ জয়ধ্বনি পুষ্পার্ঘ্য ইত্যাদি সব ফেলে ওমর আলী কবিতার পায়ের কাছেই অস্তিত্ব লুটিয়ে দিয়েছেন। যদিও তাঁর সময়ের অনেক কবিই শক্তি প্রদর্শনের সাম্প্রতিক ব্যাকরণ রপ্ত করে তড়তড় করে ওপরে উঠে গেছেন, স্বার্থসিদ্ধির এক ইঞ্চি জমিও তাঁরা অনাবাদি রাখেননি। গোলযোগপূর্ণ এই অসুস্থ সমর্পণের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হননি ওমর আলীনতুন প্রজন্মের পাঠক ও গবেষকের কাছে এ কারণেই অভিনন্দিত হবেন তিনি।