কবিতা আমাকে বিদ্বেষ মুক্ত রাখে

 

হোসে কোজের  [José Kozer]

জন্ম ১৯৪০ সালে, কিউবার হাবানায়। ১৯২০ সালে তাঁর পরিবার ইউরোপ থেকে কিউবায় বসবাস শুরু করেন। বাবা পোলিশ আর মা চেকোস্লোভাকিয়ান। কোজের প্রথম জীবনে আইনশাস্ত্রে পড়াশোনা করেছেন হাবানা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬০ সালে কিউবা থেকে তাঁর মা-বাবা পাড়ি জমান আমেরিকায়। সেখানে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যে পড়াশোনা করেন তিনি। পরে আমেরিকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাতিন সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘ ৩৫ বছর। দাদির হাতেই ১০ বছর বয়সে রবিনসন ক্রুসো দিয়ে তাঁর সাহিত্যের হাতেখড়ি। জীবনের একপর্যায়ে এসে পেয়েছেন ক্রুসো স্কলারশিপ। স্প্যানিশ সাহিত্যের নিউবারোক মুভমেন্টের অন্যতম জনক তিনি। অসংখ্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ, গবেষণা ও সাক্ষাৎকার। সব মিলিয়ে গ্রন্থসংখ্যা ১ শ’র কাছাকাছি। সমকালীন স্প্যানিশ সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী কবি কোজেরকে নিয়ে ১০ হাজার কবিতা লেখার মিথ চালু আছে। কবিতায় অসামান্য অবদানের জন্য চিলির রাষ্ট্রপতি সেবাস্তিয়ান পিনেরা তাঁকে আজীবন সম্মাননা হিসেবে পাবলো নেরুদা পুরস্কার প্রদান করেন ২০১৩ সালে। স্পেনের হুলিও তোবার বায়োনিয়াল পুরস্কারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন বেশকিছু সম্মাননা ও বৃত্তি। বর্তমানে স্পেনের বার্সেলোনায় অবসর জীবন যাপন করছেন তিনি। সম্প্রতি তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কবি ও প্রাবন্ধিক সাখাওয়াত টিপু।   

 ছবি © কার্লোস ব্লাকবার্ন

সাখাওয়াত টিপু : প্রিয় হোসে কোজের, আপনার শত ব্যস্ততার মধ্যেও সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আপনার বয়স ৮০ বছরেরও বেশি, দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসে কবিতা নিয়ে আপনার ধারণা কি? আপনি কবিতা থেকে কি চান? কবিতা আপনাকে কি দিয়েছে? 

হোসে কোজের : কবিতা লেখা আমার অন্তর্গত অভ্যাস, কিন্তু কখনো যান্ত্রিকভাবে নয়। দৈনন্দিন কাজের প্রতি আমি যেমন আসক্ত থাকি, ঠিক তেমনি। এটা আমাকে সুস্থ, জীবন্ত আর থিতু থাকতে সাহায্য করে। আমি কবিতায় খুঁজে পাই নিজের হয়ে ওঠা কিংবা মনের জগতে ফিরে আসার পথ, সামাজিক পথের সন্ধান, ব্যক্তিগত আচরণ সংশোধনের উপায়। একই সঙ্গে সৃজনশীল ভাবে থাকা, সর্বোপরি আত্মানুসন্ধানের সাধারণ অবস্থায় থাকা আর আমার ভেতরগত জীবনের আত্মোন্নয়ন ঘটানো।
কবিতা আমাকে দিয়েছে আধ্যাত্মিকতা, ধ্রুব পরিবর্তনশীলতা, ভাষার প্রতি আকর্ষণ, অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি, রহস্যের ভেতরের প্রতিচ্ছবি, রূপান্তরিত জীবন, দিনের পর দিন বদলে যাওয়া নানা উপাদান-সমৃদ্ধ উন্নত জীবন। সবকিছুর যৌথতায় বৌদ্ধতন্ত্র চর্চার সঙ্গে আমার জীবনকে সৃষ্টি করেছে কৌতূহলপূর্ণ অভিজ্ঞতায়, যেটা আমাকে বৃদ্ধ বয়সেও বিদ্বেষ মুক্ত রাখে। শুরুর দিকে এটা আমাকে এমন অর্থ দেয়নি—যাতে এক স্ত্রী আর দুই মেয়েকে পালন করতে পারি। তবে আমাকে শিখতে হয়েছিল কিভাবে আর্থিক সংকট মোকাবেলা করতে হয় পরিচ্ছন্ন আর সৎ উপায়ে। আর আর্থিক জীবনে ব্যবহারিকভাবেও কিভাবে কবিসত্তার দিকে নজর রাখতে হয়। আর একই সঙ্গে সৃষ্টিশীল জীবন বন্ধ করবার ছুতা হিসেবে আমি এটাকে ব্যবহার করিনি কখনো। 


টিপু : কবিতা নিয়ে দুটি স্মৃতির কথা বলুন, যা আপনাকে আনন্দ দেয় আর যা বিষণ্ণ করে তোলে? 

কোজের : বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে কিছু লোক আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আর তাঁরা আমাকে এই গল্প বলেছিলেন যে, জীবনের এক পর্যায়ে তাঁরা খুব বিষণ্ণ ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এমন কি—তাঁরা আত্মহত্যার দোরগোড়ায় পৌঁছেছিলেন! হঠাৎ যখন তাঁরা হোসে কোজেরের একটি কবিতার বইয়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন আর তখন এটি তাদের বিষণ্ণতা বা আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করেছিল। ব্যাপারটাকে আমি খুব আনন্দদায়ক বলতে পারিনি, তবে ঠিক যে, এটা আমাকে কবিতার প্রতি বারবার গভীর আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল। বিশেষত গভীর সংকটের সময়ে জীবনে বেঁচে থাকার সক্ষমতা দিয়েছিল আরও।
সাধারণত ডাহা পরশ্রীকাতরতার বাইরে, দুঃখ বা বিষণ্ণতার বিরল অভিজ্ঞতা তখনই ঘটে, যখন মাঝারি কিংবা হতাশাগ্রস্ত কবিরা যুক্তিহীনভাবে আমার কবিতাকে আক্রমণ করেন। এসব অদরকারিভাবে কবিদের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধের মুখোমুখি করে। খুব স্বাভাবিক কারণে এটা কবিতার জন্য ক্ষতিকর। আসলে এই জাতীয় কবিদের পেটে মানবতা সয় না।

 

সাধারণত ডাহা পরশ্রীকাতরতার বাইরে, দুঃখ বা বিষণ্ণতার বিরল অভিজ্ঞতা তখনই ঘটে, যখন মাঝারি কিংবা হতাশাগ্রস্ত কবিরা যুক্তিহীনভাবে আমার কবিতাকে আক্রমণ করেন। এসব অদরকারিভাবে কবিদের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধের মুখোমুখি করে। খুব স্বাভাবিক কারণে এটা কবিতার জন্য ক্ষতিকর। আসলে এই জাতীয় কবিদের পেটে মানবতা সয় না।


টিপু : আপনার পারিবারিক ভাষা ছিল স্প্যানিশ এবং ইদ্দিশ। আপনি ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেছেন। লেখার জন্য কেন স্প্যানিশ ভাষা বেছে নিয়েছিলেন? তবে কি ভাষার ক্ষেত্রে কোনো বিশেষত্ব আছে?

কোজের : কারণ নির্ণয় করা খুব কঠিন, লেখালেখিতেই, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একজন কবি যখন লিখেন তিনি মাতৃভাষায়ই লিখেন। আমার স্প্যানিশ ভাষার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। আমার ইংরেজি সুন্দর। কিন্তু আমি কখনো ইংরেজিতে ভালো কবিতা লিখতে পারিনি, যেহেতু আমি কখনো স্প্যানিশ কবিতার ভাল ইংরেজি অনুবাদ করতে পারিনি। কবিতার ইতিহাসে আমি বেশকিছু ঘটনা জানি যে, একজন কবি এমন এক ভাষায় লিখেন যা তাঁর মাতৃভাষা নয়, সাধারণত তাঁদের সে সব কবিতা মাতৃভাষার চেয়ে আকর্ষণীয় আর ভালো হয় না। ফার্নান্দো পেসোয়া ইংরেজিতে লিখতে শুরু করেছিলেন, খুব সফল হননি। কিন্তু তিনি যখন তাঁর মাতৃভাষা পুর্তগিজে লিখতে শুরু করলেন, তখন তিনি সত্যিই একজন মহান কবি ফার্নান্দো পেসোয়া হয়ে উঠলেন। রাইনে মারিয়া রিলকে ফরাসি ভাষায় লিখেছেন, ঠিক তেমনি লিখেছেন ভিসেন্তে উইদ্রাব্রো। তবে আমার কাছে—তাঁদের ফরাসি কবিতা, তাঁদের মার্তৃভাষায় লেখা জার্মান কিংবা স্প্যানিশ কবিতার চেয়ে উচ্চতর নয়। 
তুমি জানো, দুজন মহান ঔপন্যাসিক আছেন একজন ভ্লাদিমির নবোকভ, আরেকজন জোসেফ কনরাড, যাদের বহু উপন্যাস রাশিয়ান কিংবা পোলিশ ভাষায় লিখেননি। লিখেছেন ইংরেজিতেই। এবং সত্যিকারার্থে ইংরেজি উপন্যাসে গুরুতুল্য হয়েছিলেন তাঁরা। পরিশেষে তোমার, এক মহান কবির বিরল ঘটনা আছে, জোসেফ ব্রডস্কি, যিনি একই সঙ্গে মাতৃভাষা রাশিয়ান আর অধিগত ইংরেজি দুটোতেই ভাল লিখেছেন। আসলেই প্রতিটি সাধারণ নিয়মেই আমরা দেখতে পাই কিছু বিরল ব্যতিক্রম।  


টিপু : আপনি কিউবান স্প্যানিশ হওয়া সত্ত্বেও, সাংস্কৃতিকভাবে আপনার কবিতায় স্প্যানিশ সামগ্রিকতা আছে। কবিতায় এই সাংস্কৃতিক ঐক্যের উৎস কোথায়? জাতীয়তাবাদ কি এই ক্ষেত্রে কবিতার অন্তরায় নয়? 

কোজের : জন্মসূত্রে, বচনে আর অভিধানিকভাবে আমি কিউবান। তবে নির্বাসনের কয়েক বছরের মধ্যেই আমি একজন কিউবান-আমেরিকান হয়েছি, পেশাগত বৃত্তিতে একজন জাপানি হয়েছি, একজন চারণ ইহুদি হয়েছি। আর অন্য ভাষা ও ধ্বনির প্রতি আমি সবসময় সতর্ক কর্ণপাত করেছি। এই যুক্তিতেই আমি বলতে পারি—নানাপথের রূপ-কল্পনার কল্যাণে আমার স্প্যানিশ ভাষায় ঘটেছে বিভিন্ন ভাষা আর ধ্বনির মিশ্রণ। তাই আমি একজন কিউবান তবে কেবলমাত্র নই, আমি একজন ইহুদি তবে পুরোপুরি নই আর ব্যক্তিগতভাবে আমি বৌদ্ধধর্ম চর্চা করি তবে একচেটিয়া নই। আমি একজন চীনা নারী হতে পারি, একজন বৌদ্ধ মঠের সন্ন্যাসী হতে পারি, আমি লি বাও বা ডু ফু হতে পারি, আমি নেতিবাচক মানসিক অবস্থায় থাকতে পারি যে অবস্থা সম্পর্কে কিটস্ তাঁর লেখায় ও তাঁর ভাইকে লেখা এক বিখ্যাত চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। নির্বাসন তোমাকে বহুমুখি করবে। একজন দিনদার করবে। অপর সংস্কৃতি ও সম্পর্কের বন্ধনে ঋণী করবে। যেমন এখন আমি খেতে পছন্দ করি—সেক থেকে রাম, সশিমি থেকে ভাত আর কালো সিম। এসব আমি সবসময় পছন্দ করতাম। আর তেমন কিছু নয়। নির্বাসন হলো ক্রমবিকাশ, জটিলতায় ভরা আর একেক কবিতার জন্য একেক জীবন্ত উপাদান। যদিও আধুনিককালে এটা যে কোনো পথের দিকে যেতে পারে। অবমূল্যায়িত, এই কঠিন সময়ে: যেখানে আমরা এখন রয়েছি—যে চক্রকে বৌদ্ধ ধর্ম মতে বলা হয় মাপো [Mappō], সেটা অবক্ষয়ের এক দীর্ঘ চক্র।


টিপু : আপনি ‘নিউ-বারোক মুভমেন্ট’-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি। যদ্দুর মনে পড়ে, সমালোচকদের কেউ একজন আপনাকে ‘বিকল্প আধুনিক’ বা ‘কাউন্টার-মর্ডানিস্ট’ কবিও আখ্যা দিয়েছিলেন। আপনি কি কখনও কবিতার তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো ভেবে দেখেছেন?

কোজের : না। তাত্ত্বিক বিষয়গুলো আমি কষ্ট করে ভাবি। আমি সেটা বিশ্লেষণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। ভাষা আর সাহিত্যের তত্ত্বজ্ঞান আমার ন্যূনতম। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি নিজের কবিতার মূল্যায়ন প্রত্যাশাও করি না। তবে একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে, মহান তাত্ত্বিক আর ভাষা ও সাহিত্যের চিন্তাবিদদের আমি খুবই সম্মান করি। কিন্তু আমি কখনো তাঁদের একজন নই। তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমি আমার ও অন্যদের কাজ বিশ্লেষণ করতে অক্ষম। আমি একজন নিউ-বারোক কবি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছি, তবে তকমাটি আমি সীমিত আকারে নিচ্ছি। আমি ভাবি এই জন্য যে, এটাতে আমার কাজ আংশিক, কিন্তু আরো অনেক বিষয় আছে, সম্ভবত যেটাকে আমরা কিউবানরা বলি ‘ভাতের সঙ্গে আম’ [un arroz con mango], যা এক বিরল সমন্বয়। 
আমার জানা নেই কোন সমালোচক আমার কবিতাকে ‘বিকল্প আধুনিক’ বা ‘কাউন্টার-মর্ডানিস্ট’ বলেছেন। স্প্যানিশ সাহিত্যে আধুনিকতার অর্থ ইংরেজি ও আমেরিকান ইংরেজি সাহিত্যের আধুনিকতার অর্থ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তো শুরুতেই বলি, বারোকর পাশাপাশি আমার কাজ মূলত সংলাপমূলক কথ্যভাষায়। আর তা ভাষায় ও গঠনে সংহত। প্রচলিত ও অপ্রচলিত নিয়মকে সংযুক্ত রাখে বাক্যের গঠন। যার বিন্যাস ক্রমাগত বদলায়—যেনবা আমার শ্বাস প্রবাহের মতো আমার লেখা। আমি যখন লিখি আমার ব্যাকরণ আর বাক্যের রূপগুলো হেরাক্লিশিয়ানের সহজ তরঙ্গে প্রবাহিত হয়।


টিপু : নৈঃশব্দ্য আপনার কবিতার প্রধান বিষয়। আপনি কি মেশিনের শব্দের মতো একাকিত্ব উদযাপন করেন? কখনো কখনো এটা মনে হয় ভূমিহীনের কান্না! কবিতার দর্শন ও নন্দনতাত্ত্বিক জায়গা থেকে ব্যাখ্যা কী?

কোজের : যদিও আমার ব্যাপারটা ছিল মার্সেল প্রুস্তের মতোই—শব্দের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। আমার জন্য দরকারি নির্জনতা আর নীরবতায় অযাচিত হস্তক্ষেপ করা—আমি একে অসভ্য বলে বিবেচনা করি। অন্তর্নিহিত শান্তি, সন্ত জীবনযাপনে আমি নিজেকে একজন সভ্য আর ঘরকুনো সন্ন্যাসী মনে করি। আর নৈঃশব্দ্য তো সেই মনের অবস্থারই একটি অংশ। আমি যদি পারতাম, আমি সেখানেই বসবাস করতে পছন্দ করতাম—কোনো এক পর্বতের চূড়ায় বা পৃথিবী থেকে দূরে কোনো এক উপত্যকায় অথবা নরওয়ের জনবসতিহীন দ্বীপে ভিটগেনস্টেইন যেখানে একা দু’বছর নিজের মতো কাজ করেছেন। বাইরের জগত আমার জন্য খুবই সামান্য প্রয়োজন। তবে আমি অসামাজিক নই, তা সত্ত্বেও সত্তার সঙ্গে নিতে পারি অপরাপর সামান্য কিছুই। 

ছবি © এদুয়ার্দো ব্রেডলি

টিপু : আপনি কবিতাকে প্রার্থনার সঙ্গে তুলনা করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘প্রার্থনাই কবিতা’। কবিতার কি এমন কোনো আদর্শিক বা সার্বজনীন রূপ আছে যেখানে মানুষের বাসনা মানবিকতার [humanity] শেষ পর্যায়ে পৌঁছে? আমার মনে হয় কি—আধুনিক জগতের সংকট হলো সত্যের অনুপস্থিতি! এটা সম্পর্কে আপনার মত কি?

কোজের : আমার কাছে কোনো সার্বজনীন রূপ নেই। তবে তুমি মানবিকতাকে [humanity] যেভাবে সাধারণীকরণ করেছো [আমি ইংরেজি ছোট অক্ষরে মানবতা [humanity] শব্দ লিখেছিলাম], তা থেকে অন্যদের কাছে মানবতা [Humanity] অনেক বিমূর্ত। বিমূর্ততাকে আমি বিশেষ পাত্তা দেই না, আমি সার্বিক পৃথিবীতে বসবাস করি। একটি পাখি যখন আমার জানালার সামনে দিয়ে উড়ে যায়, সেটা বিমূর্ত নয়। তবে এটা সার্বিক সত্তা। এই অর্থে যে—একটা প্রাণকে যত্ন করে, ভালোবেসে, দৃশ্যকল্পে, সর্বোপরি অন্তর্গত উপলব্ধিতে এক সত্তায় নজরে আনা। তেমনি আমি আলু কিংবা ভাত খাই, এটাও বিমূর্ত নয়। আমি যখন লিখি, আকাশ থেকে যতই পাতালের গভীরে যাই তাতে আমার কাজে তো দৃশ্যমান আর অদৃশ্যমান জগতের অন্তর্গত সত্তার বিষয়গুলোই ধারণ করে থাকে। আর চূড়ান্ত অর্থে—সেখানে মৃতদেরও তুমি খুঁজে পাবে, যারা হেদিসের আলোয় বসবাস করে। 


টিপু : স্প্যানিশ-আমেরিকান কবিতার প্রধান প্রবণতাগুলো নিয়ে আপনি কি ভাবেন, যা ভিন্ন ভাষার পাঠকদের জানা দরকার? উত্তর যদিও বেশ বড়, সারমর্মে যদি তার কিছু বলতেন, আর কি! 

কোজের : সেখানে অনেক অনেক কবি রয়েছেন। সেটা নির্বাচন করে বলা দীর্ঘ সময়ের কাজ। যা আমার জন্য সর্বদা অসুন্দর আর অপ্রয়োজনীয় কাজ। এই দীর্ঘ সময়ের ভেতর হাজার হাজার কবি স্প্যানিশ ভাষায় কবিতা লিখেছেন। কিন্তু বলতে গেলে গত একশ বছরে, সম্ভবত বারজন কবিকে নিয়েই কেবল চর্চা আর পড়া হয়। প্রত্যেক লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে এখন, খুব নির্দিষ্ট সংখ্যক কবির কথা ভাবা হয়, অর্জনানুসারে যাঁরা সেরা আর অধিক পরিচিত। আমি তাঁদের নাম বলার প্রয়োজন বোধ করছি না। কিন্তু গুগল! এমন কি গুগলও ক্যাবলার মতো সসীম। চিলি, ব্রাজিল, পেরু বা কিউবার যে কেউ নামগুলো জানতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু তাঁরা কি পঞ্চাশ বছর টিকে থাকবে বলে বিবেচিত হবে? 


টিপু : আপনার কি কোনো স্বপ্ন আছে? যদি থাকে, আপনার স্বপ্নের পৃথিবী কেমন? তো ভবিষ্যত কবি ও কবিতার কাছে আপনি কি দেখতে চান?

কোজের : আমি নিরন্তর স্বপ্ন দেখি এবং আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বপ্ন দেখি। ইদানিং আমি বাস্তবের সঙ্গে মিলে যাওয়া এক স্বপ্ন দেখে বিহ্বল হয়েছিলাম। যেমন: স্বপ্ন দেখেছি আমি একটা অনেক বড় দীর্ঘ কবিতা লিখছি। বাস্তবে সেটা আসলে আমি লিখছিলামও। আর আমি জেগে ওঠার পর বুঝতে পারলাম, আমি আসলেই কিছুই লিখি নাই। আমি স্বপ্নে যে দীর্ঘ কবিতাটি দেখেছিলাম সেটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। ভালো, সেটা অন্যরা লিখবে, তবে আমি এটা নিয়ে খুব হতাশা বোধ করি না। 
আমি ভবিষ্যতকে খুব বেশি আমলে নেই না, কারণ আমি এটার সাক্ষী হতে পারি না। কেন আমি জল্পনা-কল্পনার জন্য সময় নষ্ট করব! যে কোনো অনুমানে আমার ভুল হতে পারে। তবুও আমি আগ্রাসীহীন এক পৃথিবী, ধর্মান্ধতাহীন ও অসহিষ্ণুতাহীন এক পৃথিবী, অক্রুর এক পৃথিবী দেখবার ব্যাপারে চরম আশাবাদী। এমন এক পৃথিবী যেখানে থাকবে বস্তুগত বিষয়-আশয়ের বাইরেরও প্রয়োজনগুলো, হাসবার আর পড়বার আর চিন্তা করবার আর নিজের অন্তর্নিহিত বাস্তবতাকে আলোড়িত করবার জন্য দীর্ঘ সময়।  

 

সম্পাদকের নোট 

১.    ফার্নান্দো পেসোয়া [১৩ জুন ১৮৮৮—৩০ নভেম্বর ১৯৩৫] বেঁচে ছিলেন মাত্র ৪৭ বছর। পুর্তগিজ এ কবি, প্রবন্ধিক ও দার্শনিক লেখালেখি করেছেন মাত্র ২৩ বছর। তাঁর আলোচিত কাজ ‘মেনসাজেন’। ১৯৮২ সালে তিনি কুইন ভিক্টোরিয়া প্রাইজ লাভ করেন।    
২.    রাইনে মারিয়া রিলকে [৪ ডিসেম্বর ১৮৭৫—২৯ ডিসেম্বর ১৯২৬] অস্ট্রিয়ার বোহেমিয়ান আধুনিক কবি ও উপন্যাসিক। লেখালেখি করেছেন ৩৮ বছর। তাঁর বিখ্যাত  কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য বুক অব আওয়ারস’ [১৯০৫]। 
৩.    ভিসেন্তে উইদোব্রো [১০ জানুয়ারি ১৮৯৩—২ জানুয়ারি ১৯৪৮] চিলির বিংশ শতাব্দির কবি ও  অনুবাদক। তিনি ক্রিয়েশানিজম আন্দোলনের অন্যতম প্রধান। তাঁর প্রধার কাজ ‘আলতাজর’। তাঁকে দুবার [১৯৬৩ ও ১৯৭২] মিউনিসিপালিটি পুরস্কার দেওয়া হয়।  
৪.    ভ্লাদিমির নবোকভ [২২ এপ্রিল ১৮৯৯—২ জুলাই ১৯৭৭] রাশিয়ান-আমেরিকান ঔপনাসিক, কবি ও অনুবাদক। তাঁর আলোচিত গ্রন্থ দ্য ডিফেন্স [১৯৩০], ডেসপায়ার [১৯৩৪]. ললিতা [১৯৫৫]।
৫.    জোসেফ কনরাড [৪ ডিসেম্বর ১৮৫৭—৩ আগস্ট ১৯২৪] পোলিশ-বৃটিশ আধুনিক ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘আলমায়ারস ফ্যামিলি’ [১৮৯৫], নার্সিসাস [১৮৯৭], জিম লর্ড [১৯০০]।  
৬.    জোসেফ ব্রডস্কি [১২ মে ১৯৪০—২৮ জানুয়ারি ১৯৯৬] রুশ-মার্কিন কবি ও প্রাবন্ধিক। তিনি কবিতা লিখেছেন রুশ ভাষায় আর গদ্য লিখেছেন ইংরেজি ভাষায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ ‘গর্বুনভ এন্ড গর্চাকভ’ [১৯৭০], লেস দেন ওয়ান [১৯৯১]। সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পান ১৯৮৭ সালে।
৭.    হেরাক্লিশিয়ান [খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ শতাব্দি] গ্রিক প্রকৃতিবাদী দার্শনিক। অন্য নাম তাঁর হেরাক্লিটাস। প্লেটোর দর্শনেও তাঁর প্রভাব আছে।  
৮.    মার্সেল প্রুস্ত [১০ জুলাই ১৮৭১—১৮ নভেম্বর ১৯২২] ফরাসি আধুনিক ঔপন্যানিক, সমালোচক ও প্রাবন্ধিক। বেঁচেছিলেন মাত্র ৫১ বছর। প্রথম গ্রন্থ ‘সোয়ানস ওয়ে’ [১৯১৩]। তাঁর আলোচিত কাজ ‘ইন সার্চ অব লস্ট টাইম’ [১৯১৩—১৯২৭]। বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪২১৫।  
৯.    হেদিস গ্রিক মিথ। মৃত মানুষের আত্মা যেখানে বসবাস করে।