লেখকতা ও জীবিকা

 

জীবিকা হিসেবে লেখকদের লেখা ছাড়া আলাদা কিছু থাকা উচিত? জীবন থেকে সময় কেড়ে নেয় বলে কোনো কোনো লেখক মনে করেন, লেখা ব্যতীত অন্য কোনো জীবিকা তাদের থাকতে নেই! লেখকতার সঙ্গে জীবিকা দ্বন্দ্বময় হয়ে উঠলে লেখকমন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। অনেকেই লেখকতাকে একধরনের পবিত্র সত্তা মনে করেন। ফলে একে অর্থোপার্জনের কাজ হিসেবে দেখতে অনিচ্ছুক। সে জন্যই বাঙালি সংস্কৃতিতে অর্থোপার্জনের জন্য লেখকের লেখা ব্যতীত আলাদা জীবিকা থাকাকেই সংগত মনে করা হয়।

রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামোর বাস্তবতাসূত্রে ইয়োরোপ-আমেরিকায় লেখকতাকে জীবিকা হিসেবে নিয়েছেন এমন মানুষ উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় দেখা যায়। আমাদের সমাজে এমনটা নেহাতই বিরল ব্যতিক্রম! এখন থেকে প্রায় দেড় শ বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্রও এটা উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কেবল অর্থোপার্জনের জন্য লিখলে লেখক হওয়া যায় না। তাঁরও নজরে পড়েছিল যে, টাকার জন্য লিখেও ইয়োরোপ-আমেরিকায় লেখক হওয়া যায়, কিন্তু বাংলাদেশে তা সংগত ব্যাপার নয়। কিন্তু লেখক কীভাবে বেঁচে থাকবেন, সে ব্যাপারে তিনি পথ দেখিয়ে যাননি। যদিও নিজে লেখক হওয়া সত্ত্বেও শাসক ব্রিটিশ সরকারের ডেপুটিগিরিও করেছেন। তবে লেখার উদ্দেশ্য হিসেবে লেখকের মনে সৌন্দর্য সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা ও মানুষের মঙ্গল কামনার প্রতি তিনি গুরুত্ব নির্দেশ করে গেছেন।

শুধুই লেখক হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে কেউ প্রকৃত সম্মান পান? যদি পেয়েই থাকেন, তাহলে আজকাল আমাদের দেশে লেখকেরা নিজেদের লেখক পরিচয়ের চেয়ে জীবিকা বা পদপদবির পরিচয়ে পরিচিত হতে বেশি পছন্দ করেন কেন? একথা কি বলা ঠিক নয় যে, জীবিকার গুরুত্ব বা পদপদবির মর্যাদার ভিত্তিতেই লেখকেরও মূল্য এখন আমাদের সমাজে নিরূপিত হয়ে থাকে! এমতাবস্থায় কেউ যদি এমন বিবেচনা করেন যে, জীবিকার মর্যাদাপূর্ণ পরিচয়ে পরিচিতরা অধিকাংশই প্রকৃতপক্ষে লেখক নন, তাহলে কি ভুল হবে?

সাংবাদিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যাংকার, পুলিশ বা পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ইত্যাদি পেশাগত পরিচয়ের ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা লেখালেখি করেন, সমাজে আজকাল তাঁরাই সাধারণত বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। কিন্তু তাঁরা লেখালেখি করে থাকেন বটে, বইও হয়তো তাঁদের নিয়মিত বের হয়, লেখালেখির পরিচিতিসূত্রে তাঁদের সামাজিক মর্যাদাও হয়তো অনেকটা বাড়ে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁরা লেখক কি না, সে প্রশ্ন তোলেন উচ্চ সাহিত্যরুচির স্বল্পসংখ্যক মানুষ! কারণ, তাঁরা মনে করেন, লেখকের পরিচয় তো সর্ব অর্থেই কেবল তাঁর লেখকতার মধ্যেই থাকবার কথা। সে পরিচয়ে কেউ পরিচিত হলে আমাদের সমাজ তার যথার্থ মূল্য না দিলে একজন লেখকের আত্মার জাগরণ থেমে যেতে পারে না কি? শুধু লেখক হিসেবে জাগর সত্তা নিয়ে বাংলাদেশে যাঁদের পরিচয় তেমন লেখক এই কারণেই কি আজকাল খুব কম খুঁজে পাওয়া যায়?

বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে লেখক নেই এমন কথা শুনলে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ লেখালেখি করছেন, তাঁদের অনেকেই ব্যথিত হবেন। কেউ বলতে পারেন, লেখক বহুপ্রজভাবে সৃষ্টিশীল হলেও তো তাঁর সৃষ্টিকর্ম এমন বাজার না-ও পেতে পারে, যার দ্বারা লেখকের গ্রাসাচ্ছাদন চলবে! এই অসার্থকতার মনোবেদনা থেকে কেউ কেউ বলে উঠতে পারেন যে লেখককেও তো খেয়ে বাঁচতে হবে, তারও তো অন্য মানুষের মতো বস্ত্র ও বাসস্থান অবশ্য প্রয়োজনীয়! এ কথা স্বীকার না করার কি কোনো উপায় আছে? সুতরাং লেখকতা ছাড়াও অন্য জীবিকা তো তাঁদের থাকতেই পারে! নিজেদের বক্তব্যের সমর্থনে বিশ্ববিখ্যাত লেখকদের নাম বলে হাজারটা দৃষ্টান্তও তো দিতে পারবেন তাঁরা! লেখকতার সঙ্গে অন্য জীবিকা যদি সাংঘর্ষিকই হতো, তাহলে অন্য জীবিকা নিয়ে দিন গুজরান করা কোনো মানুষকেই আমরা লেখক হিসেবে পেতাম না।

প্রকৃতপক্ষে লেখক তাঁরাই, যাঁরা কেবল লেখার মধ্য দিয়েই কিছু সৃষ্টিপ্রয়াসী! তাঁদের সৃষ্টিপ্রয়াসের মধ্যেই তাঁদের লেখকতার পরিচয়, জীবিকার পরিচয়ের শক্তিতে তাঁদের চলতে হয় না, সামাজিক কোনো উচ্চ ক্ষমতার ঠেকনা দরকার পড়ে না তাঁদের; কারণ, সৃষ্টি-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে বসবাসরতদের জীবনযাপনের অন্য সমস্ত অনুষঙ্গ তাঁদের লেখকতায় জ্বালানি জোগায় মাত্র!

লেখকতাকে অর্থোপার্জনের উপায় হিসেবে না দেখে অনেক সংগত ও বাস্তব কারণেই আমাদের সমাজের অধিকাংশ লেখাপ্রয়াসীই সাধারণত জীবিকার পরিচয় বা পদ-পদবির জোরকেই জীবনের প্রধান বিষয় মনে করেন! কারণ, তাঁরা জানেন লেখালেখি তাঁদের আত্মার বিষয় হলেও সাফল্যজনক জীবিকা না হয়ে ওঠার সম্ভাবনাই বেশি। অন্যদিকে লেখকতা যদি সত্যিকারভাবে কারও আত্মার মাধ্যম হয়, তাহলে তিনি হয়তো জীবিকা বা পদ-পদবির পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইবেন না এমন বিবেচনাও তো কম প্রবল নয় আমাদের লেখকসমাজে।

এ কথা নিশ্চয়ই অস্বীকার করার উপায় নেই যে, লেখককেও খেয়ে বাঁচতে হয়, সংসার চালাতে হয়, পালন করতে হয় অনেক সামাজিক দায়িত্বও! এই সব নিয়ে বেঁচে থাকবার জন্য লেখালেখি ছাড়া অন্য কোনো না কোনো জীবিকা তাঁদের থাকাটাই স্বাভাবিক ব্যাপার! কিন্তু লেখক যিনি তাঁর কাছে তো জীবিকা মানে বায়ুমণ্ডলীর অক্সিজেন শ্বাসের মাধ্যমে যা গ্রহণ করতে হয় বেঁচে থাকার জন্য; বেঁচে থাকবার জন্য এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই বলে লেখককেও অন্য যেকোনো মানুষের মতোই বেঁচে থাকার আবশ্যিক জ্বালানি হিসেবে প্রতিদিন খাদ্য গ্রহণ করতে হয়! মানুষ যে বায়ুমণ্ডল থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে, তার পরিচয়ে কি মানুষ তার মনুষ্যত্বের পরিচয় দেয়? নাকি মানুষ যে খেয়ে বাঁচে, সে তার খাদকতার পরিচয়েই পরিচিত! সে রকমই জীবিকাও তো তার বেঁচে থাকার আবশ্যিক উৎস! লেখক হতে হলে তাকে যে আগে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ নেই! তাই আমার মনে হয়, জীবিকার প্রসঙ্গ লেখকতার জন্য যেমন আবশ্যিক নয়, তেমনি নয় আলাদাভাবে উচ্চার্য কিছু! তবে এটা ঠিক যে, অনেক সময় জীবিকার কোনো কোনো দিক লেখকসত্তাকেও আলাদাভাবে জ্বালানি দিতে পারে!

চারপাশের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, লেখকেরা কী লিখছেন, তার চেয়ে আমাদের সমাজ এখনো তাঁর জীবিকার পরিচয়কেই প্রধানত মূল্য দেয়! যথা উচ্চ পদের সরকারি আমলা, করপোরেট হাউসের ক্ষমতাধর ব্যক্তি, জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রের ডাকসাইটে সম্পাদক, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরাক্রমশালী অধ্যাপক, প্রধানমন্ত্রীর নিকটজন, বড় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রবাসী ইত্যাদি পরিচয়ের সঙ্গে লেখালেখির সামর্থ্য যুক্ত হয়ে ফল হিসেবে বইপত্র প্রকাশিত হলে তাঁদের পরিচয় গৌরবান্বিত হয়ে ওঠে! সমগ্র বিশ্বে লেখকদের জীবন পর্যালোচনা করলেও এই রকম লেখকদের প্রকৃত লেখক হিসেবে মানা সহজ নয় বলেই মনে হবে! এই ধরনের তথাকথিত লিখিয়েরা আসলে কেবল লেখালেখি করেন মাত্র; তাঁরা প্রকৃত লেখক নন!

প্রকৃতপক্ষে লেখক তাঁরাই, যাঁরা কেবল লেখার মধ্য দিয়েই কিছু সৃষ্টিপ্রয়াসী! তাঁদের সৃষ্টিপ্রয়াসের মধ্যেই তাঁদের লেখকতার পরিচয়, জীবিকার পরিচয়ের শক্তিতে তাঁদের চলতে হয় না, সামাজিক কোনো উচ্চ ক্ষমতার ঠেকনা দরকার পড়ে না তাঁদের; কারণ, সৃষ্টি-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে বসবাসরতদের জীবনযাপনের অন্য সমস্ত অনুষঙ্গ তাঁদের লেখকতায় জ্বালানি জোগায় মাত্র! মানুষ হিসেবে বাঁচতে সৃষ্টিপ্রয়াসী লেখক যাপন করতে পারেন দাম্পত্য জীবন, জীবনযাপনে হতে পারেন দায়িত্বশীল ও স্নেহবৎসল বাবা অথবা মা, কিংবা হতে পারেন স্নেহপ্রত্যাশী সন্তান, এমনকি হতে পারেন ব্যবসায়ী কিংবা আমলাঅর্থাৎ যা-ই তিনি হন না কেন, সেসবই তাঁর বেঁচে থাকার আবশ্যিক উৎসমাত্র! লেখক না হলেও এর কোনো না কোনোটা তাঁকে হতেই হতো বেঁচে থাকবার জন্য! এসব নানা সত্তার সহযোগও নিশ্চয়ই লেখক পেয়ে থাকেন বা পেয়ে যাবেন কিন্তু তা লেখকের প্রধান পরিচয়ের ভিত্তি হতে পারে না! এই ধরনের পরিচয়ে কাউকে পরিচিত হতে হলে তাঁর লেখকতা নিয়ে কেউ যদি সন্দেহ করেন, তাহলে তাকে অযৌক্তিক মনে করার কোনো কারণ নেই!

বেশি দূর যেতে হবে না, আমাদের সমাজেই এমন মানুষদের দেখা গেছে যাঁদের জীবিকার পরিচয়ে তাঁদের চিনতে হয়নি! শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, বেলাল চৌধুরী কিংবা হাসান আজিজুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দরা কে কী পেশার মানুষ, তা আমাদের প্রায় মনেই পড়ে না! আরেকটু আগের দিকে আবু ইসহাক বা শওকত ওসমান, রশীদ করীম কিংবা পরের দিকের মাহমুদুল হকের অথবা আরও পরের দিকের এমনকি ইমদাদুল হক মিলন বা মঞ্জু সরকার কিংবা মামুন হুসাইনের কথাও মনে করলে তাঁদের লেখকসত্তার কথাই আমাদের মনে জেগে থাকে, জীবন ধারণ করার জন্য কোন জীবিকার আশ্রয় তাঁদের নিতে হয়, সে প্রশ্ন মনেও আসতে চায় না, বা মনে করতে হলে সে কথা আলাদাভাবে ভাবতে হয়! তাঁদেরই কেবল লেখক বলা যায়; এবং এ কথাও তো ঠিক যে, সে রকম লেখক আমাদের সমাজে এখন ক্রমশ হ্রাসমান! লেখকের জীবিকা হিসেবে লেখালেখি ভিন্ন অন্য পেশার প্রশ্নে আমার মন তাই ক্ষুব্ধ হয় না। অর্থাৎ আমার মনে হয়, লেখকের অন্যতর একটা জীবিকা থাকতেই পারে, কিন্তু তা হবে কেবলই তাঁর বেঁচে থাকার স্বাভাবিক মাধ্যম। এটা তাঁর লেখকসত্তার পরিচয়ে আলাদা গুরুত্ব পেতে পারে না, গুরুত্ব কিছু যদি থেকেই থাকে, তা থাকে লেখকের অভিজ্ঞতার উৎস হিসেবে, এর বেশি নয়!