মানিকগঞ্জের লম্বা নৌকার বাইচ

 

দুই পাশে সারি সারি নৌকা। কোনোটা কোষা নৌকা, আবার কোনোটা ইঞ্জিনের [স্থানীয়রা বলেন শ্যালো] বড় নৌকা। এর মাঝ দিয়েই ছুটে আসছে বাইচের নৌকা। আর দুই পাশের নৌকায় থাকা দর্শকেরা নানা স্লোগানে বাইচওয়ালাদের উৎসাহ দেন। এ বাইচ হয় মানিকগঞ্জের ঘিওরের কুষ্টিয়া এলাকার বিলে। আর এটা দেখতে কোষা নৌকায় আমিও হাজির হই বিলের মাঝে।

বর্ষার আগে এ বিল ফসলে ভরা ছিল। বর্ষা এলে বিল পানিতে তলিয়ে যায়। এ বিলেই প্রতিবছর বর্ষার মৌসুমে নৌকাবাইচ হয়। বাইচ শুরু হয় তিনটার পর। আমি দুপুরের দিকে তেরশ্রী বাজার থেকে নৌকায় রওনা হই বাইচের দিকে। মাঝি ছাড়া নৌকায় আছেন মো. আনোয়ার হোসেন [আয়ান] ও পাহালি মিয়া। এর মধ্যে আনোয়ার হোসেনের বাইচের নৌকা এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। তাদের বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুরের কোদালিয়া। তেরশ্রী বাজারে তাদের সঙ্গে আলাপ। বাইচের দিকে যাওয়ার আগে পাহালি মিয়ার আত্মীয়ের বাড়ির ঘাটে নৌকা ভেড়ানো হয়। এখানে দুপরের খাবার খাই। গরুর মাংস দিয়ে চিতই পিঠা। এখানকার ঐতিহ্য। বাড়িতে অতিথি এলে এ পিঠা বানানো হয়। সঙ্গে বিলের দেশি মাছ ও সাদা ভাত। খেয়ে আবার রওনা হই। আমাদের আশপাশ দিয়েও ছোট-বড় আরও নৌকাবাইচ দেখতে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আসি বাইচের জায়গায়। অবস্থান নিই বাইচের সমাপ্তিরেখার পাশে।

অধিকাংশ বাইচের নৌকা চলে এসেছে। বাকিরাও আসছে। সেই সঙ্গে আশপাশের দর্শকরাও আসছে কোষা নৌকা বা ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকায়। কেবল বাইচ বা দর্শকের নৌকা নয়, নৌকায় করে চা, বিস্কুট, পানীয়, চিপস, বাদামসহ বিভিন্ন খাবার বিক্রির দোকানও আছে। এ ভাসমান টি-স্টল বা দোকান ভেসে ভেসে দর্শকদের নৌকার কাছে গিয়ে চা-বিস্কুট বিক্রি করে।

দর্শকদের বাড়তি আনন্দ বা বাইচওয়ালাদের উৎসাহ দিতে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার দল আছে। তারা নৌকায় ঘুরে ঘুরে নাচ-গান করেন। দুজন দাঁড়িয়ে নাচ-গান করেন, তারা দুজনই পুরুষ, কিন্তু সেজেছেন নারী। বাকিরা হারমোনিয়াম, ঢোল, বাঁশি, বাজনা বাজান। এ সাংস্কৃতিক পরিবেশনার নৌকায় কেউ কেউ বাঘের মুখোশ পরে ও শরীরে গাছের লতাপাতা জড়িয়ে নিজেকে উপস্থাপন করেন। এর পাশাপাশি একদল দর্শক নৌকায় মাইক বা বড় সাউন্ড বক্সে গান ছেড়ে নাচ-গান করেন এবং এ দলের অধিকাংশই তরুণ।

দর্শকদের আনন্দ দিতে মূল বাইচ শুরুর আগে মহড়া চলে। এ ছাড়া বড় বাইচের নৌকার পাশাপাশি ছোট ছোট বাইচের নৌকাও আছে। তারা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে নয়, এসেছে দর্শকদের আনন্দ দিতে। তারাও মহড়া দেয়।

বাইচের প্রতিটি নৌকার সামনে ও পেছনের অংশকে গলুই বলে। এ গলুইয়ের গায়ে নৌকার নাম, মালিকের নাম-ঠিকানা লেখা আছে। তা দেখে বোঝা যায় নৌকাগুলো মানিকগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছে। এ ছাড়া বাইচওয়ালাদের সবার গায়ে জার্সি আছে। একেক নৌকার জার্সির রং একেক রকম। জার্সির গায়েও নৌকা এবং মালিকের নাম-ঠিকানা লেখা। নৌকার নামগুলো বেশ সুন্দর। যেমন সোনার তরী, পঙ্খীরাজ, পবন তরী, চাচা-ভাতিজা সোনার তরী, ভাই-ভাই পবন তরী, দাদা-নাতি ময়ূরপঙ্খী, দাদু বাড়ি-নানু বাড়ি, দাদা-নাতি রূপসী বাংলা ইত্যাদি। এ ছাড়া গলুয়ের দুই পাশে লেখা থাকে ‘আল্লাহু আকবর-ইয়া আলী, চল বাসাসী’, ‘মা-বাবার দোয়া’, ‘আল্লাহ সর্ব শক্তিমান’ ইত্যাদি। আবার অনেক নৌকার গলুইয়ের একেবারে মুখে ‘আল্লাহ’ লেখা বা চাঁদ-তারা আঁকা।

তিনটার দিকে মূল প্রতিযোগিতা শুরু হয়। শুরুর স্থান বড় কুষ্টিয়া। শেষ রেখা কান্দা কুষ্টিয়া। দূরত্ব প্রায় দেড় কিলোমিটার। সমাপ্তিরেখার দুই পাশে বাঁশ পুঁতে নিশানা দেওয়া। সে দুই বাঁশের ওপর দড়ি দেওয়া। আর দড়ির মাঝখানে লাল কাপড়ের নিশানা। যেন দূর থেকে বাইচওয়ালারা সমাপ্তিরেখা দেখতে পান। এ ছাড়া যে জায়গাটুকুতে বাইচ হয়, স্থানীয়দের ভাষায় সেটাকে আড়ং বলে।

সমাপ্তিরেখার পাশে আয়োজকদের নৌকা। তারা মাইকে বাইচ শুরুর ঘোষণা দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখি দূর থেকে নৌকা ছুটে আসছে। আর দুই পাশের দর্শক করতালি ও স্লোগান দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন। দুই নৌকার প্রতিযোগিতা। আগেই লটারিতে ঠিক হয় কোন নৌকার সঙ্গে কোন নৌকার বাইচ। পাশাপাশি দুই নৌকা ছুটে আসছে। অবশেষে শেষ রেখা ছুঁয়েছে দুই নৌকা। শেষ রেখা ছুঁয়ে দুই নৌকার মানুষই জয় জয় বলে স্লোগান দেন। শুধু স্লোগান নয়, নৌকার মধ্যখানে থাকা কাঠের মোটা তক্তার ওপর বাঁশ দিয়ে জোরে জোরে শব্দ করেন আর স্লোগান দেন জয় জয় বলে। কেউ কেউ শেষ রেখা ছুঁয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

জয় জয় বলে সবাই স্লোগান দিলেও আয়োজকদের দৃষ্টিতে যারা বিজয়ী, তাদের নামই ঘোষণা করা হয় এবং কাগজের স্লিপ বা টোকেন দেওয়া হয়। এ স্লিপ দেখিয়ে বিজয়ী পুরস্কার গ্রহণ করেন। পুরস্কার থাকে আয়োজকদের আরেকটি নৌকায়। পুরস্কার হিসেবে আছে এলইডি টিভি, অ্যালুমিনিয়ামের বড় ডেক, পাতিল ও কলস। প্রতিবারে দুটি নৌকার মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। এভাবে এবার ১০টি নৌকা অংশ নেয়। সব নৌকার মানুষই শেষ রেখা ছুঁয়ে জয় জয় বলেন, কেউ কেউ পানিতে ঝাঁপ দেন।

যাঁরা বৈঠা চালান, তাঁদের স্থানীয় ভাষায় ‘বাইচা’ বলে। যাঁরা হাল ধরেন, তাঁদেরকে বলে ‘হাইলা’। নৌকার মধ্যখানে থেকে বাইচাদের বৈঠা বাইতে তাল জোগান বা সাহায্য করেন, তাঁদেরকে বলে ‘চরণদার’। চরণদারেরা পিতলের ঘণ্টা পিটিয়ে বা বাঁশি বাজিয়ে তাল দেন। আবার কেউ লাঠির মাথায় ঝুনঝুনির মতো কিছু একটা বেঁধে তাল দেন। বাইচে তাল খুব জরুরি। তালের সঙ্গে সবাই বৈঠা মারলেই নৌকা আগায়।

সোনার তরী নৌকার মালিক আনোয়ার হোসেন (আয়ান) জানান, তাঁর নৌকার দৈর্ঘ্য ৯০ ফুট। প্রস্থ ৬০ ইঞ্চি। তৈরি গজারি কাঠে। খরচ হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। এ রকম নৌকা বানাতে ৫ থেকে ৬ জন মিস্ত্রির ২ থেকে ৩ মাস লাগে। এ ছাড়া সাধারণত নৌকার বৈঠা তিন থেকে সাড়ে তিন হাত হয়। অনেকেই বৈঠা গজারি কাঠ দিয়ে বানান। হাইল সাধারণত ২১ হাত হয়। এটা বানানো হয় শালকাঠ বা লোহাকাঠ দিয়ে। ভেতরের অংশকে বলে গালা। আর অধিকাংশ নৌকার গলুই কাঁঠাল কাঠের হয়।

সাধারণত বাইচের নৌকা ৬০ হাত থেকে ১২০ হাত পর্যন্ত লম্বা হয়। এলাকাভেদে নৌকার নকশা ও নাম ভিন্ন হয়। যেমন—‘গজারি খেল্লা’। এ নৌকা গজারি কাঠে বানানো হয়। লম্বায় থাকে ৬০ থেকে ৬৫ হাত। ‘ছিপা’। এর গলুই একটু চিকন হয়। গজারি খেল্লার চেয়ে লম্বাও বেশি হয়। ‘বাদল পুরী’। অন্য নৌকার গলুই ওপরের দিকে থাকলেও এর গলুই থাকে পানির দিকে। ‘ডোঙ্গা’। এ নৌকা ১২০ হাত পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এর গলুই অনেক চিকন হয়ে থাকে। এ ছাড়া এর তলিতে কাঠ থাকলেও দুই পাশে থাকে স্টিলের আবরণ।

আনোয়ার হোসেন বলেন, বাবা গাদু মাতবরের বাইচের নৌকা ছিল। সেই নৌকার বাইচও দেখেছি। আগে পুরস্কার হিসেবে কাঠের শিল, পিতলের কলস, অ্যালুমিনিয়ামের বড় কলস, ডেক, পাতিল দিত। এখন শিল বাদ পড়েছে। যোগ হয়েছে ফ্রিজ-টিভি। শ্রাবণে বাইচ শুরু হয়। চলে কার্তিক পর্যন্ত। তবে ভাদ্র-আশ্বিনে বেশি হয়। সাধারণত এক মৌসুমে ২০ থেকে ২২টি বাইচ হয়। আয়োজকেরা চিঠি দিয়ে নৌকার মালিকদের জানান। এ ছাড়া বাইচের নৌকা বানাতে যেমন খরচ হয়, তেমনি বাইচা, চরণদার, হাইলা ও গায়েনদের যাতায়াত-খাওয়াসহ আনুষঙ্গিক খরচও অনেক। আবার নৌকা ৫ থেকে ৬ বছরের বেশি টেকে না। তবু আমরা নতুন নতুন নৌকা বানাই, প্রতিবছর বাইচে অংশ নিই। পুরস্কার হিসেবে ফ্রিজ-টিভি পাই। পুরস্কার জিতলে এলাকার মানুষ ও বাইচাদের খাসি জবাই করে খাওয়ায়। আসলে এটা যেমন আমাদের ঐতিহ্য, তেমনি শখের।

প্রতিযোগিতায় যাওয়ার আগে বাইচওয়ালারা কিছু নিয়মও মানেন। বাড়ির ঘাট থেকে নৌকা বের করার সময় নৌকার গলুইয়ে মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালানো হয়। সঙ্গে দেওয়া হয় দূর্বা ঘাস। গলুইয়ে পরানো হয় জবা ফুল বা লাল কাপড়ের মালা। বাইচের নৌকায় কেউ জুতা নিয়ে ওঠেন না। প্রতিযোগিতা শুরুর ঠিক আগে নৌকার গলুই দুধ দিয়ে ধোয়া হয়। এরপর নৌকাকে সবাই হাত দিয়ে সম্মান করে বৈঠা ধরেন। তবে বাইচের নৌকার আরেকটি বিষয় যাত্রাপথের গান। বাড়ির ঘাট থেকে বাইচের উদ্দেশে যখন বের হন, তখন বাইচা, চরণদার ও হাইলাদের সঙ্গে একদল গায়েনও নৌকায় ওঠেন। তারা গান করতে করতে বাইচের দিকে যান। এ গান শোনার জন্য আরও একদিন হাজির হই টাঙ্গাইলের নাগরপুরে। বারাপুষা ব্রিজের কাছ থেকে নৌকায় উঠি। এ নৌকার নাম ভাই ভাই পবন তরী। মালিক লাল মিয়া। নৌকাটি ৬৫ হাত। এবারের বাইচ ভারড়ার উলাডাব এলাকায় ধলেশ্বরী নদীতে।

বাইচের নৌকা টেনে নেয় ইঞ্জিনের নৌকা। আর বাইচের নৌকায় চলে গান। গায়েন মো. আমিনুর রহমান ও মো. জয়নাল আবেদিন। তাঁরা দুজনই নাগরপুরের সিংদাইর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁদের সহযোগী সেকেন্দার আলী ও ইউনুস আলী। মূল গায়েন দুজন। বাকিরা তাল মেলান। পায়ে ঘুঙুর বেঁধে ও ঢোল পিটিয়ে গানের তাল মেলান। গায়েনরা দাঁড়িয়ে গান। অন্যরা বসে তাল দেন। কেবল বাড়ি থেকে বাইচস্থলে যাওয়ার পথে গান নয়, বাইচওয়ালাদের বাইচ উপলক্ষে তাদের আত্মীয়রা দাওয়াতও দেন। তখন সেই বাড়ির ঘাটে নৌকা ভেড়ানো হয় ও গান গাওয়া হয়। এরপর খেয়ে-গেয়ে আবার রওনা হন। এভাবে গাইতে গাইতে বাইচস্থলে পৌঁছেন। গায়েন মো. আমিনুর রহমান বলেন, কোনো পারিশ্রমিক নয়, নিজেদের ঐতিহ্য ও আনন্দ থেকেই গান করি। আর যে গান করি, এগুলো যুগ যুগ ধরেই আমাদের বাবা-দাদারা বাইচে খেয়ে আসছে। শুধু গায়েন নয়, বাইচের কেউই কোনো পারিশ্রমিকের জন্য বাইচের নৌকায় আসেন না। সবাই নিজের গ্রাম বা এলাকা বা পারিবারিক ঐতিহ্য থেকেই এটা করে আসছেন।

প্রথমে বিল, এরপর খাল, এরপর নৌকা নামে নদীতে। এভাবে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পর নৌকা আসে বাইচস্থলে। বাইচস্থলে পৌঁছে সবাই শ্যালো নৌকায় রাখা খাবার খান। চিড়া ধুয়ে চিনি দিয়ে খাওয়া। এটা খেয়েই তাঁরা নৌকা চালান। অনেক সময় অন্যান্য খাবারও থাকে। তবে অধিকাংশ সময়ই চিড়া-চিনি।

তিনটার দিকে বাইচ শুরু হয়। ১০ থেকে ১২টা নৌকা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এখানেও দর্শক আছেন ছোট-বড় নৌকায়। পাশাপাশি নদীর দুই পাড়েও আছেন। এখানে নদীর পাড়ে বাইচ উপলক্ষে মেলাও বসেছে। মানিকগঞ্জের মতো এখানকার নৌকার ধরনও একই। তবে দোহার-নবাবগঞ্জ বা অন্য অঞ্চলে দেখা বাইচের নৌকার ধরন একটু ভিন্ন।