উমর-রানুরা ভালোই আছে

 

 

একাকী পথিক ফিরে যাবে তার ঘরে
শূন্য হাঁড়ির গহ্বরে অবিরত
শাদা ভাত ঠিক উঠবেই ফুটে তারাপুঞ্জের মতো, 
পুরোনো গানের বিস্মৃত-কথা ফিরবে তোমার স্বরে 
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না

শহীদ কাদরী

রশীদ করীমের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়, ১৯২৫ সালের ১৪ আগস্ট। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর তেল কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে সপরিবারে চলে আসেন ঢাকায়। তাঁর লেখালেখির শুরু ব্রিটিশ আমলে, যা গড়ায় পাকিস্তান পর্বে; তবে লেখক হিসেবে যশ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে- তাঁর বড় কাজগুলো এ সময়েই।

প্রথম গল্প লেখেন ১৪ বছর বয়সে। ১৯৪২-এ ছোটগল্প আয়েশা ছাপা হয় মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সওগাত পত্রিকায়। তারপর নিয়মিত লিখেছেন একটি মেয়ের আত্মকাহিনি। দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৬১ সালে এসে শুরু দ্বিতীয় পর্বেরপ্রকাশ পায় প্রথম উপন্যাস উত্তম পুরুষ। ব্যাপক সাড়া ফেলে এ বই, পান আদমজী পুরস্কার। দুবছর পর বাজারে আসা প্রসন্ন পাষাণ তাঁকে বড় লেখকের কাতারে তুলে দেয়। এরপর আবারও শীতনিন্দ্রা, এবার প্রায় এক দশকের জন্য। পাঠকের কাছে ফেরেন স্বাধীন বাংলাদেশে, যার শুরু ১৯৭৩-এ আমার যত গ্লানি দিয়ে। এই উপন্যাস তাঁকে সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে যায়। এরপর ১৯৭৮-এ প্রেম একটি লাল গোলাপ। এটি ১৯৭৭-এ ছাপা হয়েছিল বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায়। বই করার সময় তাতে আর হাত দিতে হয়নি তাঁর। আমি বিউটি বুক হাউসের যে সংস্করণটি পড়েছি, তাতে লেখা চতুর্থ মুদ্রণ ১৯৮৬, পঞ্চম মুদ্রণ ২০০৮। শেষেরটার সঙ্গে আগের সংস্করণের ২২ বছরের ব্যবধান। ১১২ পৃষ্ঠার বই, গায়ের দাম ১৫০ টাকা।

সৈয়দ ওয়াল্লীউল্লাহ্‌র পর বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে বিশিষ্ট নাম আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, কায়েস আহমেদ, মাহমুদুল হক, রশীদ করীম। তবে আজকাল শেষের তিনজনের নাম খুব একটা শোনা যায় না। কায়েস আত্মহত্যা করেছেন, মাহমুদুল বেছে নিয়েছিলেন আধ্যাত্মিকতার পথ আর শেষ জীবনের বড় একটা অংশ রশীদ করীমের কেটেছে বিছানায়, পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েএ সময় লিখতে পারেননি তিনি।

বাঙালি মুসলমান মেয়ের হাঁড়ির খবর প্রথম দিয়েছিলেন মোহাম্মদ নজিবর রহমান, আনোয়ারা উপন্যাসে। দেশভাগের পর এই অঞ্চলের সাহিত্যের যে পালাবদল, তার পূর্বপ্রস্তুতিও ছিল তাঁর লেখায়। সেকালে সাহিত্যরত্ন উপাধি পেলেও এখন বিদগ্ধ সমাজে খুব একটা উচ্চারিত নন। তবে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সেই নারীর গল্পই শোনান আরেক লেখক রশীদ করীম, ১৯৭৩ সালের কোনো এক সকালবেলায়।

তখন শুরু নয়, উদ্বোধন হয় উপন্যাসটির। কলেজে অধ্যাপনা আর লিখেটিখে দিন কাটানো এক লোকের আড়ালে লেখক নিজেই হাজির হন প্রথম পুরুষের আখ্যানে প্রেম একটি লাল গোলাপের সূচনা অংশে। জানান, দেখা-সাক্ষাৎ খুব একটা না হলেও রানুকে তিনি চিনতেন। সে নিজেকে খুঁজে পেত গানে, অথচ সে গানই ছেড়ে দিয়েছে। রানু কখনো-বা ছোট্ট এবং দেখতে খুব সুন্দর একটি কাঁচের তশতরিতে দারুচিনি, এলাচি, লবঙ্গ আর সুপরি এনে দেয়। তার মধ্যে এক নিবিড় অন্তরঙ্গতা স্তব্ধ হয়ে থাকে। বলে, আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখুন। সে গল্পই লিখতে বসেন তিনি। কাহিনি শুরুর পর প্রথা ভেঙে হঠাৎ করেই কবি আহসান হাবীবকে উপন্যাসটি উৎসর্গ করে আবার ফেরেন লেখার টেবিলে।

এবার হাজির হয় এক বিশ্বখ্যাত ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানের সিনিয়ন এক্সিকিউটিভ উমর, সে একজন লেখকও। কাহিনি এগোলে দেখা যাবে রানুর গান ছাড়ার মতো উমরেরও লেখক-সত্তাটিও মিলিয়ে গেছে দাম্পত্যের টানাপোড়েনে। নারী-পুরুষের সম্পর্কের এই জটিল, সূক্ষ্ম আর রহস্যময়তায় বেশ মনোযোগী ছিলেন তিনি। শুধু প্রেম একটি লাল গোলাপ নয়, প্রায় সব উপন্যাসই আকর্ষণীয় এ প্রশ্নে তাঁর বিশেষ ও প্রখর অন্তর্দৃষ্টির কারণে। তাঁর লেখায় সমাজ নয়, প্রাধান্য পেয়েছে ব্যক্তি, বিশেষ করে নারী। তো হঠাৎ করেই উমর-রানুর এই নিস্তরঙ্গ জীবনে ঘটতে শুরু করে অভিনব কিছু ঘটনা। শুরু হয় অবিশ্বাস, সংকট আর সন্দেহের ত্রিমুখী লড়াই। ভেঙে যেতে যেতেও সম্পর্কটা ভাঙে না। জোড়াতালি দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চলে শেষ পর্যন্ত। আর জটিল সেই মনোজাগতিক লড়াইয়ের অনুপুঙ্খ বিবরণ জলের মতো সহজ-সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করেন রশীদ করীমএখানে যে মুনশিয়ানা, তাতে তার দখল ষোলো আনা।

সেই সত্তরের দশকে সদ্য স্বাধীন দেশের রাজধানী ঢাকা তখনো মফস্বল শহর। তবে গড়ে উঠছে নব্য ধনিক শ্রেণি। আছে নাগরিক চরিত্র পেতে তড়িঘড়ি। মধ্যবিত্তের মনে জ্ঞান-ধন দুটো একসঙ্গে করায়ত্তের পাঁয়তারা। ভীষণ সেই লড়াইয়ের ঘাত-প্রতিঘাতেই ঘটছে ব্যক্তির বিপর্যয়।

গোড়াতেই দেখি দৈনিকের ঈদ সংখ্যার জন্য সাহিত্য সম্পাদকের তাগাদার মুখে উমর। তবে লেখার টেবিলে বসলেই তার মনে হয়, যেন দস্তোয়ভস্কির নকশা করা এক দরজা-জানালাহীন কোনো ঘরে বাস করছে সে। লেখা এগোয় না: লিখবার কথা ভাবলেই নিজেকে নিঃস্ব আর শূন্য মনে হচ্ছে। এবার পরিচারিকার বেশে হাজির হয় কুমকুম: কিন্তু কুমকুমের উপর উমরের কোনো কর্তৃত্বই নেই, থাকলে রানুরই আছে কারণ সে খুব দূর সম্পর্কের বোন হয়। মহিলার বয়স চল্লিশ মতো হবে, কিন্তু তার শরীরেও এক রকম অবিনশ্বরতা আছে। দেখে যে বয়স চল্লিশের চাইতে কম মনে হয় তা নয়; তাকে দেখে চল্লিশ বয়সটাকেই কম মনে হয়। স্বামীর ছেড়ে যাওয়া, যুদ্ধে ছেলে হারানো কুমকুম দ্বিতীয় বিয়ের জন্য প্রস্তুত হলেও তাকে বিয়ে দিতে পারছে না রানু। রানুর মুশকিল স্ত্রীলোকটিকে সে সহ্য করতে পারছে না। আবার একেবারে বিদায় করে দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না।

লেখার আশা ছেড়ে এক ভোরে হাঁটতে যাবে উমর, পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সিঁড়ির গায়ে লাগানো ছোট কামরাটি। সেখানে কুমকুম থাকে। আর রানু ঘুমে তাই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে। সেই মুহূর্তে: আপনার চা। সলজ্জ হাসি, পরিপাটি চুল; উমরের চলাফেরার শব্দে জেগেছে কুমকুম। চায়ে পেয়ালাটি রাখে বিছানার পাশের টেবিলে, ঝুঁকে কাপটি রাখার সময় উমর কুমকুমের স্তনযুগল প্রায় সমস্তটাই দেখতে পেল। এবং তার নাকে এল কুমকুমের শরীরের ঘ্রাণ; সারা রাতে ঘামে ভেজা শরীরের ঘ্রাণ। কিন্তু উমরের খারাপ লাগল না। এবং খারাপ লাগেনি বলেই এখন খুব খারাপ লাগছে। উমর চা চায়নি, কিন্তু ধূমায়িত পেয়ালাটি দেখে তার মনে হয় এর অপেক্ষায়ই সে ছিল এবং আরও মনে হয়, চায়ের পেয়ালাটি নিয়ে রানু যদি উপস্থিত হতো কত ভালো লাগত। মাঝে মাঝে নিজের স্ত্রীকেই কত না অচেনা মনে হয়। পরে প্রবোধ দেয় নিজেকে: রানু অবশ্য জানে না উমর উঠে পড়েছে। রোজ তো আর সে এতো সকালে উঠে না। তারপরের প্রশ্নটা কার উদ্দেশে বোঝা যায় না: কুমকুম যদি জানতে পারলো, রানুই বা পারবে না কেন? কুমকুম তখনো দাঁড়িয়ে। এবার এক শ টাকার একটা নোট তার হাতে গুজে দেয় উমর: বাধ্য হয়েই এই প্রথম তাকে স্পর্শ করতে হলো। এবার শোনা যায় বারান্দায় রানুর চটির শব্দ। ভুল করে বসে উমর: দ্রুত পালিয়ে যাবার মতো করে ছুটে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। কুমকুমও সেই চেষ্টাই করতে গেলে, দুজনের গায়ে লাগলো ধাক্কা। ঠিক সেই মুহূর্তে বারান্দার মাথায় দেখা গেল রানুকে। তারপর উমর বলছে: প্রত্যেককে তার মনের সঙ্গে নিজের লড়াইটা লড়তে দাও। নালিশ করে জটিলতা বাড়িয়ে দিও না রানু।

অথচ বিয়েটা তাদের প্রেমের। রানু বড়লোকের মেয়ে। কেউকেটা সব পাণিপ্রার্থী বয়কট করে সে বিয়ে করেছে উমরকে। বাড়ির বারান্দায় বসে তখন সে সেতার বাজায়। সেই গলি দিয়েই রিকশায় যাতায়াতের সময়, তাদের বাউন্ডারি ওয়ালটা টপকে, দুটি আম গাছের মাঝ দিয়ে উমরের চোখ পড়ত রানুর ওপর। সে সময়টার জন্য তৈরি থাকত রানুও। তারপর রানুদের বাড়ির কারও জন্মদিনের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণলিপি আসে উমরের হাতে। সেখান থেকেই ঘনিষ্ঠতার শুরু। শেষে বাড়ির সবার অমতে তাদের বিয়ে। কী উচ্ছল ছিল বিয়ের প্রথম দু বছর। ছিল দুজনে দুজনের মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকার এক ঐকান্তিকতা। এখন সেসব ম্লান।

তবে জীবন থেমে থাকে না বলেই উমরের মাইনে বাড়ে। প্রমোশন হয়। মাঝেমধ্যে বড় কাজে নিজে না গিয়ে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার সুফি তাকেই পাঠান। চেক সই করার অথরিটিও পেয়েছে উমর। তবে উমরকে তিনি পছন্দ করেন না। লোকে বলে সুফি সাহেবের সঙ্গে উমরের চেহারায় মিল আছে। এই সুফি বাড়ি করবেন, নকশাও এসেছে হাতে। উমর স্থপতি না হলেও তার অভিমতটাই হয়ে পড়ে জরুরি। তাকে বাড়িতে তলব করেন সুফি। আলাপ-আলোচনা শেষে বৃষ্টি নামে। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে উমরকে চমকে দিয়ে সুফি বলে: সেদিন আপনার স্ত্রীকে দেখলাম। নাজ সিনেমায়। সঙ্গে একটি পুরুষ ছিল। ব্যক্তিটি কিন্তু আপনি নন; সে তো জানেনই। ভদ্র মহিলা লিপস্টিক লাগান কিন্তু বড্ড গাঢ় করে; তবু হাসে উমর। চাকরিটা তো সে ছাড়তে পারবে না। আর এ সুযোগেই তার অন্দরমহলে ঢোকে সুফি। ঢোকে সশরীরেই।

বিয়ের পর দুবছর ছেলেমেয়ে হয়নি তাদের। তারপরের দু বছরে দুটি সন্তানরিনি আর খোকন। বাচ্চা হওয়ার পর রানু রাতারাতি বদলে যায়। তারপরও রানু গা হাত-পা ধুয়ে সাজগোজ করলে উমরের চোখে তা খুব ভালো লাগে, কিন্তু অফিসফেরত উমর রানুকে অত সুসজ্জিত দেখতে চায় না। এত দিনে রানু সেটা বুঝেছে। উমরেরই পীড়াপীড়িতে রানুকে হাতকাটা বুক খোলা ব্লাউজ বানাতে হয়েছে। এ ব্লাউজ পরে সে রানুকে বাইরে যেতে দেয় নাতবে ঘরে অন্য কোনো ব্লাউজ পরলে উমর রাগ করে। উমর স্তনের খানিকটা আভাস দেখবে, রানু যখন ঘরময় কাজ করে বেড়াবে। তার আরেক আজগুবি ইচ্ছেরানুর বাহুমূল দেখতে ভালোবাসে সে। সেখানে উমর কী সৌন্দর্য খুঁজে পায় সে-ই জানে! কোনো কোনো দিন প্রায় উন্মাদের মতো সে ঘ্রাণ নেয়। বলে, এই ঘ্রাণে আমার নেশা হয়। বাড়ির সামনের গাছের সারিতে তখন হয়তো পাখির কিচিরমিচির বন্ধ হয়। পাশের পুকুরটায় চাঁদ করে টলটল। কিন্তু মাঝে মাঝেই একটি প্রশ্ন পীড়িত করে উমরকে: শরীরের খেলা রানুও উপভোগ করতে শিখেছে। সে তার শরীরটা মেলেও দেয়। তবু সবকিছুর মধ্যেও কোথায় যেন সেই মুহূর্তে তার শরীরে একটা গোটানো ভাব থাকে। শরীরটা যেন সাম্প্রতিক কালে তার অন্যমনস্ক থাকে। মেঘমুক্ত নিটোল দাম্পত্যে এবার হোঁচট লাগে।

একে অন্যে বুঁদ হয়ে থাকা এই দাম্পত্যে তবে সুফি ঢোকে কী করে? দায় কার? দায় আসলে তাদের দুজনেরই। দুই ধরনের নির্ভরতা থেকে। অথবা হয়তো সে বিক্ষুব্ধ সময়ই তাদের বসিয়ে দিয়েছে বাঘবন্দি কোটে। এর মাশুল দেয়ার শুরু ময়মনসিংহের গানের অনুষ্ঠান থেকে রানু যেদিন সুফির সঙ্গে তার গাড়িতে ফেরে সেদিন। তারপর এক রাতে সহকর্মীর মৃত্যুসংবাদ নিয়ে আসে সুফি। উমরের সঙ্গে রওনা হয় রানুও, তবে ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে। উমর শুধু বলে: যাবেই যদি লিপস্টিকের রংটা মুছে ফেল। হাজার হলেও মুর্দাকে দেখতে যাচ্ছি। পরে উমর যায় রিকশায় আর রানু গোঁ ধরে হেঁটে চলে ভিজে ভিজে। মুর্দাবাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে সুফি, চোখে তার লোভ। বাড়ি ফেরার পর উমর-রানু কথাবার্তায় জানা যায়, সুফির কড়া নাড়ার শব্দটাও চেনে রানু। নাজে গিয়েছিল তার সঙ্গে সিনেমা দেখতে। কোনো উত্তর না দিয়ে রাতে উমরকে প্রশ্ন করে: তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। বিশ্বাস করো? তারপরও রানু ফেরে না। তার গা থেকে বেরুনো পারফিউমের গন্ধটা যে লন্ডন থেকে সুফির এনে দেওয়া শিশির সেটাও বোঝে উমর। তবু রানুকে জয় করতে চায় সে, কিন্তু বোঝে, রানু সুদূর। তাদের বিবাহবার্ষিকীতে এবার শাড়ি দেয় সুফি। সেই শাড়ি পরে রানু জানায়, উমরকে দেওয়া পাঞ্জাবিটার মতো একটা পাঞ্জাবি ছেলেমানুষের মতো আবদার করেছে সুফি, সেটা সে তাকে দেবে। উমরকে পেছনে ফেলে সুফি এগিয়ে চলে অদম্য গতিতে। তার তরফে এবার আসে একটি ব্রা। সে ব্রা পরলে উমরের মনে হয়: সুফি রানুর গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়েছে। তাদের চাটগাঁ ভ্রমণেও পিছু নেয় সুফি। উমরকে ঢাকায় ডেকে সেই অবসরে চলে যায় রানুর কাছে, এ তথ্য রানুর কাছে জেনে উমরদাঁড়িয়ে থাকে একটা কুকুরের মতো, রানু ঠাণ্ডা মাথায় গোসল করে। এমন নিরাসক্ত-নির্মোহ বয়ানই রশীদ করীমকে বাংলা ভাষা-সাহিত্যে দিয়েছে স্বকীয়তা, করেছে বিশেষ।  

উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে উমর-রানুর বাড়িতে ভিনদেশি অতিথি আপ্যায়নের পার্টি। সব খরচ সুফির। আর সঙ্গে রানুর জন্য উপহার হিসেবে একটা পিয়ানো। সেখানে সুফি আর উমর স্থির, শান্ত, সেই সঙ্গে কঠোর হিংস্র দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে। এ পর্যায়ে সেখানে আসেন গেলাসে হুইস্কি, হুইস্কিতে পানি, এবং পানিতে বরফ ঢালতে ঢালতে বলতে শুরু করা চল্লিশ বছর বয়সী হারুনর রশীদ। সুফি জীবনে প্রথম বুঝতে পারে, কোণঠাসা হওয়া কাকে বলে! হারুনর রশীদ সোজা সুফির চোখে চোখ রেখে বলেন, স্ত্রী বললেই স্বামী শব্দটি মনে আসে! আজকাল অবশ্য আর আসা উচিত নয়। তাই না? তারপরও হাল ছাড়ে না সুফি। রানুর দেওয়া সেই পাঞ্জাবি গায়ে উমরের ছদ্মবেশে ঢুকে পড়ে রানুর শোবার ঘরে, উমর নয় বুঝতে পারার পরও কোথায় যেন এই ইচ্ছেটাই লুকিয়ে ছিল। সারা মন প্রতিবাদ করছে কিন্তু ভালোও লাগছে তার। এক মিনিট মাত্র, তারপর নিজেকে সরিয়ে নেয় রানু আর এই ঘটনা জানল শুধু হারুনর রশীদ। উমরকে তিনি বলেন: আপনার গৃহভৃত্য আবদুল প্রভুভক্ত নয়, তাকে অবিলম্বে বিদায় করে দেবেন।

এতসবের পরও উমর-রানুর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দাম্পত্যে বয় স্বাদুবাতাস। সকালে নাশতার টেবিলে তারা মুখোমুখি। উমর বিছানায় পাওয়া একটি সাদা রুমাল বাড়িয়ে ধরে জানতে চায় সেটি কার। সে রুমালের কোনায় লেখা সু শব্দটি পড়ে চুপসে যায় রানু। তারপর হঠাৎ এক নতুন আবিষ্কারের উল্লাসে বলে, উমর আমার ভালো নামটা তুমি ভুলে গেছ? উমর ভোলেনি। রানুর ভালো নাম সুফিয়া। তার চোখেমুখে নেমে আসা অন্ধকার কেটে যায় আর রানু চলে যায় রান্নাঘরে। আর সে রুমাল হাতে অন্যমনস্কভাবে খেলে উমর। এ ‍রুমালটা বড়, আছে অপরিচিত একটা গন্ধও। তবু উমর আর রানু এখন ভালোই আছে। কিন্তু তাদের জীবনে সেই রুমালটির আড়াল বোধ হয় থেকেই গেছে।

নগরে জন্ম বেড়ে ওঠা বলে নাগরিক মনটা তিনি অন্যদের চেয়ে ভালো ধরতে পারতেন। যেমনটা কবিতায় পারতেন তাঁরই বন্ধু, তাঁরই সময়ের শহীদ কাদরী। তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে বিদেশ-বিভুঁইয়ে গিয়ে আর রশীদ করীম প্যারালাইসিস নিয়ে গৃহবন্দি ছিলেন প্রায় ২০ বছর। মারা যান ২০১১ সালের ২৬ নভেম্বর। তার আগে ১৯৭২-এ বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮৪-তে পান একুশে পদক