উপেক্ষিত জীবন ও সুর!
ভিক্ষা দাও গো নগরবাসী, ভিক্ষা দাও আমারে
তোমরা যদি ভিক্ষা না দাও, জীবন আমার বাঁচবে না
নগরজীবনের সবচেয়ে পরিচিত দৃশ্য—ভিক্ষুক বা ভিক্ষুকের দল। তাদের কারও মুখে থাকে গান, কারও হাতে থালা। সেই থালায় পয়সা পড়লে অন্ধ ভিক্ষুকটির চোখ নাচে কি না, তার দিকে আমাদের ভ্রূক্ষেপের সময় কই?
কেবল নগরকেন্দ্রিক মানুষ নয়, সমাজের উঁচু শ্রেণির কাছে ভিক্ষুকমাত্রই ঘৃণিত কীট। সমাজ যেন এই পরগাছাকে উপড়ে ফেলতে পারলে বাঁচে। দানে যদিও আমি মহৎ সাজব, তবে গ্রহীতাকে করে যাব হীন। উদার চিত্তে আজ ভিক্ষা বা নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার লোক পাওয়া এখন রৌদ্র ঝলমলে বালুরাশিতে মুক্তো খোঁজার সমান।
ফ্রেডারিখ নীৎশের ‘জরথুস্ত্র বললেন’ থেকে এক উদ্ধৃতি দেওয়া যাক—‘আমি ভিক্ষা দিই না। ভিক্ষা দেওয়ার মতো দরিদ্র নয় আমার মন।’ আপাতদৃষ্টে নীৎশের এই বক্তব্যকে মনে হতে পারে ভিক্ষাবৃত্তিকে ঘৃণা করার। তবে দাতাকে আরও উদার হওয়ার আহ্বানও জানান তিনি। ইউরোপ যেখানে বলছে কঠোর পরিশ্রমের কথা, সেখানে প্রাচ্যে ভিক্ষার সঙ্গে সংযোগ করেছে বৃত্তির।
চাকরিজীবীদের মতো ভিক্ষাও অনেকের পেশা। তার জন্য তাদেরও কিছু শারীরিক কসরত করে দেখাতে হয়। কেউ গান করে, কেউবা অভিনয়। দুটো পয়সা পাওয়ার লোভে গলাতে হয় মানুষের মন। ভিক্ষুক শ্রেণিরও রয়েছে এক আলাদা জীবন। তারাও একটা সমাজ বটে। তাদেরও রয়েছে নিজস্ব সুর ও গান।
তাদের সেই জীবন-জীবিকার সুরলিপি নিয়ে সিরাজ সালেকীন সম্পাদনা করেছেন ‘ভিক্ষুকের গান’। একুশজন লেখকের একুশটি প্রবন্ধের বইটি প্রকাশ করেছে ‘কথাপ্রকাশ’। ২০২১ সালে প্রকাশিত বইটির গায়ের মূল্য ৪০০ টাকা। প্রচ্ছদ করেছেন সব্যসাচী হাজরা।
পরিচিতি পর্ব শেষে এবার আসা যাক মূল আলোচনায়। বইটির শুরুতে ভিক্ষা-ভিক্ষুকদের নিয়ে ‘মনোযোগ…’ নামে সম্পাদকীয়তে গভীর ও তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন সিরাজ সালেকীন। শুরুটা এভাবে—‘বাংলায় লোকবচন আছে, ‘ভিক্ষার চাল কাঁড়া আর আঁকাড়া’। এখানে ভিক্ষুকের প্রার্থনা আছে অথচ অধিকার নাই; এ জন্যই হেলাফেলা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য তার প্রাপ্য। শব্দটির উদ্ভব সংস্কৃত পরিমণ্ডলে; ভিক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভিক্ষু, যতি, ব্রহ্মচারী, পরিব্রাজক বা পর্যটক সন্ন্যাসী সম্প্রদায় এবং তারা সমাজে সম্মানিত।’
বইয়ের প্রথম প্রবন্ধে দিনাজপুরের অন্ধ ভিক্ষুক ‘দদি মোহনের গান নিয়ে’ লিখেছেন মাসুদুল হক। জন্মগতভাবে অন্ধ দদি মোহন। নিজস্ব গানও নেই তাঁর। বিজয় সরকার, নারায়ণ সরকার প্রমুখের গান গেয়ে ভিক্ষা করেন তিনি। গাইতে গাইতে গানগুলোকে নিজের মতো করে নিয়েছেন। অবশ্য দদি মোহনের জীবন পুরোপুরি সচরাচর চোখে পড়া ভিক্ষুকদের মতো নয়। তিনি অধ্যাত্মবাদী। তাঁর গুরু বা গোঁসাই রয়েছে। গানের সুরে সুরে মানবজীবনের অর্থ খুঁজে বেড়ান তিনি—‘ওরে মানুষ হইয়া জনম লইয়া/ মানুষের করিলাম কী?’
যেকোনো মাজারে ভিক্ষুকদের চোখে পড়ে বেশি। বাউল-ফকিরদেরও আবাস বলা যায় মাজার। সিলেটের শাহ পরান মাজারের ওরস ঘুরে ঘুরে ‘ভিক্ষুক-সংগীত’ নামে লিখেছেন সুমনকুমার দাশ। মাজারে ভিক্ষুকেরা কীভাবে ভিক্ষা চায়, তার এক বিস্তারিত ফিরিস্তি দিয়েছেন তিনি। শতাধিক ভিখিরির সঙ্গে কথা বলে রেকর্ড করেছেন তাঁদের অনেক গান। আল্লাহর ওয়াস্তে ভিক্ষা চেয়ে থাকেন মূলত তারা, ‘ভিক্ষা দাও গো মা জননী আমরারে/ আখেরাতে শান্তি দিবা আল্লায় তোমরারে।’
ভিক্ষুক এমন এক শ্রেণি, যাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য তেমন কিছুরই দরকার নেই। দিনের যেকোনো সময় প্রতিনিয়তই তো তাদের দেখা মেলে। তবে তাদের জীবন কম রহস্যমোড়া নয়। কোথায় থাকে তারা, কী খায়, দৈনন্দিন আয় কত? জগৎ-সংসারে কে তাকে দেখে, ভালোবাসে। সাহিত্যে ভিক্ষুকদের সবচেয়ে বড় চিত্রটি এঁকেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে ভিখু-পাঁচীর জীবন আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় বিশাল এক বাস্তবতার সামনে। এ ক্ষেত্রে আলোচনা করা যেতে পারে জার্মান নাট্যকার বের্টল ব্রেশটের ‘থ্রি পেনি অপেরা’ নিয়ে। আজকাল অবশ্য টিভির পর্দাতেও উঠে এসেছে ভিক্ষুকদের জীবন ও সংগীত। অনেক নাটক-সিনেমায় ভিক্ষুক চরিত্রের মুখে তুলে দিয়েছেন, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে দুই টাকা ভিক্ষা দেন গো মা’ কিংবা, ‘একটা টাকা দিয়ে যান, আমি গরীব মুসলমান’। বইয়ে সংকলিত ‘কয় পয়সার পালা কিংবা সামান্য মাধুকরী’ নামের প্রবন্ধে এসব নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন হুমায়ুন আজম রেওয়াজ।
চাকরিজীবীদের মতো ভিক্ষাও অনেকের পেশা। তার জন্য তাদেরও কিছু শারীরিক কসরত করে দেখাতে হয়। কেউ গান করে, কেউবা অভিনয়। দুটো পয়সা পাওয়ার লোভে গলাতে হয় মানুষের মন। ভিক্ষুক শ্রেণিরও রয়েছে এক আলাদা জীবন। তারাও একটা সমাজ বটে। তাদেরও রয়েছে নিজস্ব সুর ও গান।
নগর হোক বা গ্রাম—পরিচিত দৃশ্যের একটি হলো দলীয় ভিক্ষুক। এলাকামাফিক শুক্রবারের সকালবেলা এদের দেখা মেলে বেশি। দলে থাকে তিন থেকে চারজন। তাদের কেউ অন্ধ, কেউ বোবা, কারও হাত বা পা নেই। উচ্চস্বরে তারা একসঙ্গে ভিক্ষা করে। এদের ‘প্রতিবন্ধী পথশিল্পীও’ বলা যায়। তারা আল্লাহর নামে ভিক্ষে প্রার্থনা করে। তাদের মধ্যে একজন থাকে মূল গায়ক। যে গানের কলি বলে আর বাকিরা কোরাস—
আল্লা, মা-বাবার নামে আল্লা
কইরা যাবেন দান
কোরাস : দয়াল আল্লা রাসুলের নাম
এই গান একই সুরে দুপুরের ছায়ার মতো দীর্ঘ হয়। একেক ভিক্ষুকের দল সুর অবিকৃত রেখে বিভিন্ন কথায় এই গান করে ভিক্ষা চায় [কেউ কেউ ‘রাসুলের’ জায়গায় ‘নবীজির নাম’ও উচ্চারণ করে]। তখন আশপাশের কেউ হয়তো তাদের থালায় দুই-পাঁচ টাকার কয়েন ফেলে দেয়। কিংবা ওপরতলা থেকে কোনো কোনো গৃহিণী বা কর্তা পুরোনো জামাকাপড় বা দশ-বিশ টাকার নোট দেয়। তখন ভিক্ষুকদের গলাটাও আরও জোরে চিৎকার দিয়ে বলে, ‘দয়াল আল্লা রাসুলের নাম’।
ভিক্ষুকেরা ভিক্ষা চাওয়ার জন্য কথা ও সুর রচনা করে। আবার অনেকে পাশেরজন বা অন্য কোনো ভিক্ষুক থেকেও গান শিখে বা মুখস্থ করে নেয়। কথায় আছে, আল্লাহ একটা কেড়ে নিলে আরেকটাতে দু’হাত ভরে দেয়। অনেক ভিক্ষুককে দেখেছি চমৎকার কণ্ঠের অধিকারী, কিন্তু অন্ধ। সেই কণ্ঠই তার উপার্জন করে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। তবু প্রাচ্য থেকে প্রতীচ্যে ভিক্ষাবৃত্তিকে সমান ঘৃণা ও অবজ্ঞার চোখে দেখে। তাদের পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা আছে। তবে তা আদৌ কার্যকর হয় কি? ২০১১ সালে যৌথভাবে ওয়ানডে ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কা। সেবার ভেন্যু পাওয়া চট্টগ্রাম নগরী সাজাতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে জড়িতদের। পরবর্তীকালে চাকরিও দেওয়া হয় তাদের বেশ কয়েকজনকে। গত বছরের খবর হলো, এসব ভিক্ষুক চাকরি হারিয়েছে। স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে তাদের কেউ যদি পুরোনো পেশায় ফেরত আসে, তা-ও যেন স্বাভাবিক। ভিক্ষা করে সম্পত্তির মালিক হয়েছে, এমন ভিক্ষুকের সংখ্যা কম নয়। ফলে ধীরে ধীরে ভিক্ষুকদের থেকে ‘দাতাদের’ মন উঠে যাচ্ছে। এতে অবশ্য ক্ষতিগ্রস্তের ওপরে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সত্যিকারের ভিক্ষুকেরা। আবার অনেকে সিন্ডিকেট করে ভিক্ষা করে। শিশু-নারীদের অনেককে ভিক্ষার জন্যও বাধ্য করা হয়। ভিক্ষুকদের নিয়ে এসব আশ্চর্য তথ্য উঠে এসেছে ‘ভিক্ষুকের গান’-এ।
বাংলাদেশ মুসলিম-অধ্যুষিত হওয়ায় ভিক্ষুকদের অধিকাংশ মুসলিম। অন্য ধর্মাবলম্বী ভিক্ষুকও আছে। অবশ্য আর্থিক-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কাছে ধর্ম গৌণ। কৃষির পর নগরসভ্যতার উন্নয়নের ফলে ভিক্ষুকের সংখ্যাটা দিন দিন বেড়েছে। এতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য কতটুকু বেড়েছে। কনক আমিরুল ইসলাম ‘ভিক্ষাবৃত্তি ও মাঙনের গান’ প্রবন্ধে বাংলার সমাজকাঠামোতে পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে ভিক্ষাবৃত্তির রূপ নির্ণয় করেছেন।
খুব কমই আছে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে ভিক্ষাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। নদীতে কারও ঘর ভেসে গেছে, কেউ ছোট থেকে অনাথ বা জন্ম প্রতিবন্ধী, তারা নগরে হোক বা মফস্বলে জীবন কাটাচ্ছে ভিক্ষুক সেজে। সেসব ভিক্ষুকের আপনজন কি কেউ আছে? হয়তো ভিক্ষা করতে করতেই একদিন এক ভিক্ষুকের সঙ্গে আরেক ভিক্ষুকের সম্পর্ক হয়। গানে গানে তারা সমাজের ভেদাভেদের কথা তোলে। এ ক্ষেত্রে তারা বেছে নেয় লালনের গানকে। কার্ল মার্কসের সংজ্ঞায়িত শাসক ও শোষিত শ্রেণির ভেতর ভিক্ষুকদের তো জীবন-মরণ সমান। ‘গানে গানে ভিক্ষাবৃত্তি’ নামক লেখায় এসব কথায় জানান আতিকুর রহমান দৃষ্টি।