কার্ল মার্কসের সমাধিতে হুমায়ূন আহমেদ 

 

গত সপ্তাহে দুদিনের জন্য লন্ডনে যেতে হয়েছিল SOAS-এ বাংলা কথাসাহিত্য নিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। বিখ্যাত হয়ে গেলে এ রকম অনেক বক্তৃতা দিতে হয়। সম্মানীর পরিমাণও আকর্ষণীয়। ভালো আয়-পত্র হয়। বক্তৃতার পরে বিকেলবেলা হাতে কাজ ছিল না। ডিরেক্টরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হচ্ছেন, একটি চশমাপরা মেয়ে এসে বলল, ‘হাই।’ 
হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘হ্যালো।’ 
চশমাওয়ালা মেয়েটি বলল, ‘দেয়াল উপন্যাসের অবন্তী-মায়মুনার চরিত্র নিয়ে আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই।’
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হতাশ কণ্ঠে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘সেমিনার কি শেষ হয়ে যায়নি?’ 
চশমাওয়ালি বলল, ‘এই চরিত্রটি নির্মাণে আপনার মনে কি কোনো ফেমিনিস্ট চিন্তা কাজ করেছে?
হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘ফেমিনিজম সম্পর্কে আমার ধারণা নেই বললেই চলে।’
‘বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত’ বলে মেয়েটি পথ ছেড়ে দিল। 
তখন হাইগেইট সিমেট্রিতে গিয়ে কার্ল মার্কসের কবরে একটা সাদা গোলাপ রেখে আসার জন্য উবার নিলেন হুমায়ূন আহমেদ। কার্ল মার্কস সম্পর্কে তাঁর মনে কিঞ্চিৎ দুঃখ জমা আছে—এত বড় মনীষী আর তাঁর মত অনুসরণ করতে গিয়ে কত না রক্তগঙ্গা ব’য়ে গেল।
কার্ল মার্কসের কবরের আশপাশে কেউ ছিল না। কেশে গলা পরিষ্কার ক’রে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘মার্কস ভাই, কেমন আছেন, ভালো আছেন?’
উনি ঘুমিয়ে ছিলেন। ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল। অসময়ে ঘুম ভাঙানো হলে মানুষ অসন্তুষ্ট হয়। মুখে বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘কী ব্যাপার? ঘুম ভাঙালে কেন? জরুরি কিছু?’ কিন্তু মার্কস সাহেবের গলায় কোনো বিরক্তি প্রকাশ হলো না। মনে হয় আরামে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছেন। খুব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘জি, ভালো আছি। তবে সত্যি কথা বলতে কি, আপনাকে চিনতে পারিনি।’
হুমায়ূন আহমেদ লজ্জিত গলায় বললেন, ‘আমাকে চিনতে পারার কথা না, আমার নাম হুমায়ূন আহমেদ। বাঙালি। ২০১১ থেকে নিউইয়র্কে থাকি। লন্ডনে বেড়াতে এসেছি।’
‘পরিচিত হয়ে খুশি হয়েছি। গোলাপ নিয়ে এসেছেন। এটা ভালো লাগছে। বোঝা যায় আপনি রুচিশীল মানুষ। আপনি কি আমার বইপত্র পড়েছেন?’
‘আপনার লেখা পড়ার যোগ্যতা আমার নাই। বাংলাদেশে আবু মাহমুদ নামে একজন আধপাগলা অধ্যাপক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তিনি আপনার বই-পত্র পড়েছেন। আমি কেবল ভারতের ইতিহাস নিয়ে আপনার লেখাটা পড়েছি।’ 
‘ভালো লেগেছিল?’
‘জি, ইতিহাসকে দেখবার নতুন চোখের সন্ধান পেয়েছিলাম।’
‘শুনে খুশি হলাম। আবু মাহমুদ সাহেবকে আমার শুভেচ্ছা জানাবেন।’
‘সেটা সম্ভব হবে না। তিনি প্রয়াত।’
‘শুনে দুঃখিত হলাম।’
‘আমার যৌবনের বন্ধু আহমদ ছফা আপনার ভক্ত ছিলেন। তিনি মহাত্মা লেনিনেরও ভক্ত ছিলেন।’
‘শুনে প্রীত হলাম।’
‘মহাত্মা লেনিনকে নিয়ে তাঁর লেখা একটি কবিতা আছে। দীর্ঘ কবিতা।’
‘পৃথিবীর মানুষ কবিতা পড়ে এখনো? সবার ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা হয়ে গেছে?’ কার্ল মার্কসের কণ্ঠে নিখাদ বিস্ময়।
‘না মহাত্মা, সব মানুষের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করা এখনো সম্ভব হয়নি। তবে মানুষ কবিতা পড়ে। এখন কবিতার উত্তর-আধুনিক পর্ব সূচিত হয়েছে।’
‘উত্তর-আধুনিক পর্ব?’
‘হ্যাঁ, উত্তর-আধুনিক পর্ব। এ ছাড়া পোস্ট-কলোনিয়াল সাহিত্য রচিত হচ্ছে। ডিকন্সট্রাকশন চলছে। কিন্তু লজ্জার কথা হলেও সত্য এসব বিষয়ে আমার ধারণা নেই; বরং আমি ছফার কবিতাটির খানিকটা আপনাকে শোনাতে পারি।’
‘আমি কবিতার ভক্ত ছিলাম না, তা নয়। তবে অনেকদিন কবিতা পড়িনি। কিন্তু ভ্লাদিমিরের বিষয়ে আপনার বন্ধু কী লিখেছেন শোনা যেতে পারে।’
কার্ল মার্কস সম্মত হওয়ায় হুমায়ূন আহমেদ পড়তে শুরু করলেন—

ভলগা নদী ধীরে বয় 
রেড স্কয়ারে পুরু হয় বরফের স্তর 
ধূসর কুয়াশা ঢাকা ক্রেমলিন শিখর। 
বছর বছর ধ’রে একঠায় দাঁড়িয়ে একাকী 
লেনিনের বোবা চোখ প্রশ্ন করে আর কত বাকি। 
কেটে গেছে বহুকাল, ঘটে গেছে বহু যুদ্ধ—বহু মন্বন্তর
লেনিনের বুকে বিঁধে কালের নখর। 
অগাধ প্রত্যাশা নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বড় ক্লান্ত 
শ্রান্ত জানু ঢ’লে আসে, আর সাধ্য নেই দাঁড়াবার 
লেনিন ঘুমোবে এবার। 

কার্ল মার্কস বললেন, ‘কবিতার ধ্বনিময়তা আমার পছন্দ হয়েছে। আপনার আবৃত্তিও ভালো। কিন্তু ভ্লাদিমিরের ঘুমের প্রশ্ন আসছে কেন? সে কি জেগে আছে? ইনসমনিয়ায় ধরেছে ওকে?’ 
হুমায়ুন বললেন, ‘মহাজ্ঞানী কার্ল মার্কস, আপনি ভাগ্যবান। মৃত্যুর পর মাটির কোলে আপনার আশ্রয় জুটেছে। সেই সৌভাগ্য তাঁর হয়নি।’
‘আমরা ভ্লাদিমিরের ঘুমের বিষয়ে কথা বলছিলাম।’—কার্ল মার্কস মনে করিয়ে দিলেন।  
‘আপনার শিষ্য ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের মৃত্যু হয় ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি তারিখে—কিন্তু এক শ বছর পার হয়ে গেল আজও তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়নি। মস্কোর রেড স্কয়ারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে তাঁর লাশ রাখা। তাই ছফা লিখেছেন, 

লেনিন ঘুমোতে চায়, 
লেনিন ধূলির শিশু ভূমিশয্যা বড়ো ভালোবাসে
সিমেট্রির গভীর থেকে জননীর ডাক ভেসে আসে 
আয় যাদু ফিরে আয়...

কার্ল মার্কস বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘বুঝতে পেরেছি। এটা কি ভ্লাদিমিরের ইচ্ছা অনুযায়ী করা হয়েছে?’
হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘ঠিক উল্টো। লেনিন উইল করে গিয়েছিলেন, যেন মৃত্যুর পর তাঁকে সেইন্ট পিটার্সবুর্গে অবস্থিত মায়ের সমাধির পাশে সমাধিস্থ করা হয়। জনতা তা’ হতে দেয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর হাজার হাজার লেনিনভক্ত বলশেভিক বিপ্লবী মস্কোতে জমায়েত হ’য়ে তাদের প্রিয় নেতাকে সমাধিস্থ না ক’রে চিরকালের জন্য দৃশ্যমান রাখার ব্যাপারে দাবি জানায়।’
‘তাতেই হয়ে গেল?’ 
‘সরকারি কর্তাব্যক্তিরা জনতার এ দাবি মেনে নিয়েছিলেন; সায় দিয়েছিলেন লেনিনের স্ত্রী, ভাই ও বোনেরা। সম্ভবত এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি দৃষ্টেই কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছিলেন, “সহে না সহে না জনতার জঘন্য মিতালী”।’
‘ইনি কে?’
‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বাঙালি কবি একজন।’
‘প্রতীয়মান হয় আপনি কবিতার ভক্ত। কিন্তু এত দিন একটি মরদেহ রাখা সম্ভব? মমি করা হয়েছে নাকি? ফারাওরা ছিল মমি বানানোর ওস্তাদ কারিগর।’ 
‘রাসায়নিক দিয়ে কাচের বাক্সে সংরক্ষণ করা হয়েছে। মাঝে মাঝে সমস্যা হয়, কখনো কখনো ত্বকে ছোপ ছোপ দাগ পড়ে যায়, বিশেষ ক’রে মুখমণ্ডলে। কেমিস্টরা সে সমস্যারও সমাধান ক’রে ফেলেছে। চামড়া কুঁচকে গেলে বা রং চটে গেলে অ্যাসিটিক অ্যাসিড ও ইথাইল অ্যালকোহলের দ্রবণ প্রয়োগ করা হয়। কখনো হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, ফেনল ও কুইনিনও কাজে লাগে।’
‘আপনি একটি দুঃখজনক কাহিনি বললেন। মৃত মানুষের প্রতি এ রকম ব্যবহার না শোভন, না রুচিকর।’ 
‘আমারও তাই মনে হয়। মৃত্যুর পর সমাধি লাভের ব্যাপারে লেনিনের ইচ্ছা এবং অধিকার—কোনোটিই কার্যকর হলো না। কার্যকর হয়েছে এ বিষয়ে গৃহীত একটি “সামাজিক সিদ্ধান্ত”। তবে একটা গণভোট আয়োজনের কথা শুনতে পাচ্ছি। তাঁকে মাটিতে সমাধিস্থ করা হবে না রেড স্কয়ারের পাহারায় চিরকাল রেখে দেওয়া হবে, তা নিয়ে অচিরেই গণভোটের আয়োজন করা হবে।’
‘সে হবে ঘোরতর অন্যায়। মৃত্যুর পর মাটিতে শেষ শয্যা লাভ মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার। এ বিষয়ে সমাজের কোনো মত-অভিমত থাকতে পারে না।’
‘আপনি আমার মনের কথাটি বলেছেন, মহাত্মা। এই সরল কথাটি মানুষের মাথায় আসছে না। যাহোক, এখন আমি আপনার জন্য দোয়া করব। কী দোয়া করলে খুশি হবেন?’
‘আপনাদের ঈশ্বর করুণার আধার। দোয়া ছাড়াই আমাকে ক্ষমা করেছেন। তিনি আমাকে যেমন ক্ষমা করেছেন, পৃথিবীর সব মানুষকে সে রকম একতরফা ক্ষমা করে দিলে ভালো।—এ রকম একটা দোয়া করতে পারেন।’
হুমায়ূন আহমেদ হাত তুলে চোখ বন্ধ করে মনে মনে মোনাজাত করতে লাগলেন। এ সময় কবরের সংকীর্ণতার কথা স্মরণ করে তাঁর চোখ অশ্রুময় হয়ে উঠল। আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত লাভার কথা স্মরণ করে তাঁর দুচোখ চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। 
জুতা খুলে কার্ল মার্কসের কবরে দাঁড়িয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। মোনাজাত শেষ ক’রে জুতা পরলেন। 
কার্ল মার্কস বললেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ সাহেব, আপনি সহৃদয় মানুষ। আপনার চোখের জল মাটিতে পড়েছে। আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। অনুভূতিটি ঠিক কী, তা ধরতে পারছি না। আপনি কি এখন চ’লে যাবেন?’
হুমায়ুন আহমেদ বললেন, ‘জি। তবে বেয়াদবি না নিলে একটি জিজ্ঞাসা ছিল।’ 
‘নিঃসংকোচে বলুন।’
‘মৃতদের জগতে একজন কি আরেকজনের খবর রাখে? সেটা কি সম্ভব?’
‘কার কথা জানতে চাইছেন?’
‘মৌলভী ফয়জুর রহমান সাহেবের কথা। আমার বাবা। ১৯৭১-এ সৈন্যদের গুলিতে নিহত।’
‘জি; তিনি ভালো আছেন। নিশ্চিন্তে আছেন।’ 
‘নিশ্চিন্তে আছেন?’
‘জি, নিশ্চিন্তে আছেন।’
কার্ল মার্কসকে বিদায়ী সালাম জানিয়ে সিমেট্রি থেকে বের হলেন হুমায়ূন আহমেদ। 
তখন লন্ডনের আকাশের আলো নিভু নিভু। ওভারকোট ছিল—মাথায় হ্যাট চড়ালেন হুমায়ূন আহমেদ। হ্যাট পরতে ভালো লাগে তাঁর। নিজেকে শার্লক হোমস মনে হয়। সিমেট্রি থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটতে থাকলেন। মনের ভেতরে খুব ভালো একটি অনুভূতি কাজ করছে। তাঁর ধারণা ছিল মার্কস সাহেব ধর্মকর্ম না করা মানুষ—কবরে হয়তো অসুবিধার মধ্যে আছেন। কিন্তু তিনি ক্ষমা লাভ করেছেন। সম্ভবত ঈশ্বরে তাঁর বিশ্বাস ছিল। অনেকের ধারণা, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন নাস্তিক ছিলেন। এক জায়গায় তিনি বলেছেন, ‘God does not play dice’। আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি কেবল ঈশ্বরের সৃষ্টির দর্শনটা বোঝার চেষ্টা করছি।’ এই লোককে নাস্তিক বলা ঠিক না। হয়তো আইনস্টাইনও ক্ষমা লাভ করেছেন। আল্লাহর এক নাম গাফফার—তিনি ক্ষমা করতে পছন্দ করেন। মানুষকে ক্ষমা করার কোনো না কোনো উছিলা তিনি খুঁজে নেন। 
‘আমি কি ক্ষমা লাভ করব?’ এই প্রশ্নটা হুমায়ূন আহমেদের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। তাঁর চোখে বারবার পানি আসতে লাগল। পৃথিবীর নশ্বরতা সম্পর্কে তিনি পুনরায় সচেতন হয়ে উঠলেন।