কিছু কথা কিছু দুঃখ, থাক না একান্ত ব্যক্তিগত

 

তখন একদম মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতাম মুনকে। মুন ছিল আমার ধ্যানজ্ঞান, মানে আমার ধ্যান, আমার জ্ঞান! আমার ভালোবাসায় কোনো ধরনের খাদ বা কমতি ছিল না। কেবল কমতি ছিল আমার সহায়সম্পদে। অবশ্য সহায়সম্পদের কথা বললে দায় এসে যায় মুনের বাবারও। দায় এড়াতে পারেন না তিনি।
মুন আমার বোন। চাচাতো বোন। তবে, আপন চাচাতো বোন বলব কি না, বড় চাচার কারণে সে নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়। অহরহ আজকাল স্বজনেরাই প্রশ্ন উত্থাপন করেন! তবে রক্তের সম্পর্ক তো, তাই অস্বীকারও করতে পারি না।
বাড়িতে ছিলাম। বেড়ে উঠেছি বাড়িতেই। বাড়ি আমাদের একদম শহরে বলব না, আবার গ্রামেও বলব না, তবে শহরতলি বললে কেউ আপত্তি জানাবে না। আর বাড়িতে নিজের ভাইবোন, চাচাতো ভাইবোন মিলে প্রায় সমবয়সী একদঙ্গল ভাইবোন ছিলাম আমরা। কাজেই, মারামারি, লাঠালাঠি ওই আমাদের মধ্যেই হতো, আবার খানিকক্ষণ বাদে বা দু-এক দিন বাদে শেষও হয়ে যেত।
ছোট চাচির কথা মনে পড়ে। তিনি ছিলেন মা বাদে আমার আশ্রয়। শৈশবে এমনকি কৈশোরের প্রারম্ভেও মা যখন যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে শাসন করতেন, পিঠে ধুম ধুমাধুম কিল পড়ত, বেতের বাড়ি পড়ত, দৌড়ে গিয়ে বড় চাচা, মাইজল চাচা, সাজু চাচার ঘর ডিঙিয়ে ছোট চাচার ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিতাম। মা আর এগোবার সাহস পেতেন না। অপরাধের ধরন বুঝে একবার-দুবার এগিয়েও ছিলেন, কিন্তু ছোট চাচি একেবারে জড়িয়ে ধরে রাখতেন। মা বকাবকি করা ছাড়া আর কোনো কিছুই করতে পারতেন না।
আমাদের ছোট চাচা আর ছোট চাচি ছিলেন নিঃসন্তান! তবে, একেবারে নিঃসন্তানও বলব না। সাব্বির নামে তাঁদের একটা পুত্রসন্তান মানে আমার একটা চাচাতো ভাই ছিল। আদর করতাম খুব। আমার সঙ্গে ওর খুব ভাব ছিল। হায়াত নেই, তাই ওর যখন বয়স চার, তখন পুকুরে ডুবে মরে গেল। হায় রে, ছোট চাচির কী কান্না! এখনো কান পাতলে চরাচরজুড়ে ছোট চাচির বুকফাটা আর্তনাদ শুনতে পাই।
আমাদের তখন বাবা হারিয়ে জীবনসংগ্রাম চলছে।
বাবা ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক। কত টাকা আর বেতন পেতেন! তবু তিন বেলা খেতে পারতাম। খাওয়ার অভাব হতো না।
সেই বাবাই যখন মরে গেলেন অকস্মাৎ হৃদরোগে, অভাব হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। প্রথম ধাক্কাতেই আমার আর লিপির স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। লিপি তখন সিক্সে, আর আমি সেভেনে। ইমতিয়াজ সিক্স প্লাস হয়নি।
তখন কিন্তু ডিজিটাল যুগ না। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষাও অবৈতনিক না। দেশের বাজেটের প্রায় সব টাকাও নিজেদের না।
তো ভীষণ বিপদে পড়ে গেলাম।
খবর শুনে মামারা দৌড়ে এলেন।
বড় চাচা বাদে চাচারাও বাবার চাচাতো ভাই সমেত সবাই নড়েচড়ে বসলেন। জমায়েত একটা হলো ছোট চাচার ঘরে। দাদি কিন্তু তখনো বেঁচে আছেন। প্যারালাইজড হয়ে বেঘোরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে ছোট চাচার ঘরে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।
সংক্ষেপে যদি বলি সেসব দিনের ঘটনা, তাহলে বলতে হয়, লিপির স্থান হয়ে গেল নানাবাড়িতে; বড় মামার ঘরে। ওর স্কুলও বদলে গেল।
আর আমি ছোট চাচার হাওলায় চলে গেলাম। দুপুর আর রাতে ছোট চাচার ওখানেই আহার সারতাম। একই বাড়ি তো, কাজেই কোনো সমস্যা হতো না। মাসকাবারি আবার হাজার দেড়েক টাকাও সরবরাহ করতেন কন্ট্রাকটরি করে মালদার বনে যাওয়া ছোট চাচা। বিনিময়ে মা একটু-আধটু কি সকালবেলা, কি সন্ধ্যাবেলা, কি রাতে ছোট চাচির হেঁশেলের কাজে সঙ্গ দিতেন। সঙ্গ দিতেন মাইজলা চাচিকেও।
এভাবেই চলছিল।
তখন তো আমি একদম চুপ হয়ে গেছি। মনটাও ছোট হয়ে গেছে। বাবা নেই, ছোট চাচার ঘরে খাই, বোনটাও অভাবের তাড়নায় বড় মামার সংসারে মানুষ হচ্ছে। মনটা আর বড় থাকে কীভাবে!
এইটেই জাত চেনালাম। এ ছাড়া আর উপায়ও ছিল না। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি হাঁকালাম। কিন্তু আনন্দ করার ফুরসত পাইনি।
মায়ের যে সেদিন কী হয়েছিল! মরার ঘুমে যখন দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো চরাচরে, মায়ের তখন খোঁজ পড়ল ইমতিয়াজের!
না, ভাইকে আর পাইনি। কী হয়েছিল, কোথাও গিয়েছিল কি না? সে রহস্যের কিনারা আর হয়নি।
আদরের ছোট ভাই তো, বুকের মধ্যে একটা হাহাকার ধ্বনিত হচ্ছিল। মনটাও খারাপ হয়ে থাকত মাঝেমধ্যে।
কিন্তু, ঘুরে দাঁড়াতেই হলো। এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না। লিপিকে কিছুই বলতে হয়নি। মেয়ে মানুষ তো, জানত এবং বুঝত, এ দেশে মেয়েদের টিকে থাকতে হলে পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই। সে-ও ট্যালেন্টপুল পেল।
আমাদের তখন খুব আনন্দ। আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে!
বড় চাচা আমাদের যে চোখেই দেখুন না কেন, বড় চাচি আর চাচাতো ভাইবোনদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কিন্তু একদম স্বাভাবিক ছিল। কোনো জটিলতা কিংবা টানাপোড়েন ছিল না। উল্টো, সময় ও সুযোগ পেলেই বড় চাচিই বড় চাচা সম্পর্কে বিভিন্ন কথা বলতেন মায়ের কাছে। বদনাম করতেন আরকি। বড় চাচা নাকি কোথাও গোপনে একটা বিয়ে করেছেন।
বড় চাচার ক্ষেত্রে এসব কিন্তু খুবই স্বাভাবিক। বড় লোক তো! বড় লোকের বড় বড় কারবার! অ্যাডভোকেট তিনি, মুক্তাদির রহমান।
সত্য একটা কথা বলে নিই।
আমাদের বাবা কিন্তু তাঁর বাবার একমাত্র সন্তান ছিলেন। যদ্দূর জেনেছি, দাদাভাই অ্যাপেনডিসাইটিসে ইহজগৎ ত্যাগ করেছেন। সে আমলে তো এসব রোগের কোনো চিকিৎসা ছিল না। কিংবা থাকলেও চিকিৎসা ফলপ্রসূ হতো না। বাবার বয়স তখন বছর দুই। দাদি কী করবেন? পথ বাতলালেন তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি। দাদির বাবা-মায়ের সম্মতিতে ছোট দেবরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে গেল।
বাবা আর চাচার মধ্যে এই-ই পার্থক্য। মা এক, বাবা দুই। কিন্তু সহায়সম্পদের বন্টনের ক্ষেত্রে বড় চাচা বড় ধরনের পার্থক্য সূচনা করলেন। ইঙ্গিত ছিল সাজু চাচার, পেছনে হয়তো আরও কেউ কলকাঠি নাড়ছিল। যাহোক, আমরা একেবারে বঞ্চিত হয়ে গেলাম। এক বাড়ি ছাড়া মৌরসি সম্পত্তির আর কিছুই মিলল না। মা কী করবেন! সবুর করলেন; ধৈর্য ধরলেন। বললেন, ‘সবর কররাম আল্লাহ। তুমি দেকিও।’
সত্যি সবুরে মেওয়া ফলে। আচ্ছা, সেসব কথা পরে না হয় সময় থাকলে বলা যাবে।
বলছিলাম তো মুনের কথা।
তো এই মুন আর আমি ছিলাম একদম সমবয়সী। বয়সের দিক থেকে হয়তো দু-চার মাসের বড়ই ছিলাম আমি। পড়তামও একসঙ্গে, তবে ভিন্ন স্কুলে। আর চাচাতো বোন যেহেতু, তাই পড়ালেখার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা পরস্পর মতবিনিময়ও করতাম। বড় চাচির সায় ছিল এতে। বলতেন বড় চাচি তাঁর মেয়েকে, ‘ইকবালোর পরামর্শ নিস।’ পরামর্শ আমি কোত্থেকে দেব! আমার তো কোনো প্রাইভেট টিউটরই ছিল না! আর টিউটর! পড়তামই তো ফুল ফ্রি স্টুডেন্টশিপে! তবে, স্যাররা ক্লাস শেষে কোচিং করাতেন। ক্লাস আর কোচিং কখনো মিস করিনি। এটাই ছিল আমার সম্পদ।
তখন কিন্তু আমার জেদ চেপে গেছে। আর চাপবেই বা না কেন! আমি শুনিনি, মা শুনেছেন। মা তো আর মিথ্যে বলবেন না। ভাইবোন দুজনে ভালো রেজাল্ট করার পর বড় চাচা নাকি একদিন তাঁর ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা প্রসঙ্গে আমাদের উদাহরণ টেনে বড় চাচিকে বলছেন, ‘লাড়ি (রাঁড়ি) বেটির গরো সারা বৃত্তি-স্টাইপেন্ড যারগি, তুমি কিতা করো! খালি বইয়া বইয়া এন্ডা (ডিম) পারিও!’
আমার মনে হয়, আল্লাহর আরশ তখন কেঁপে উঠেছিল।
তো যে কথা বলছিলাম।
মন তো সকলেরই আছে। যদিও একসময় জেনেছি, মন হচ্ছে কিছু অনুভূতির সমষ্টি। তা সুখের অনুভূতি হতে পারে, আবার দুঃখেরও অনুভূতি হতে পারে।
মুনেরও একটা সুন্দর মন ছিল। আর ছিল সুন্দর একটা মুখ। তবে, ওই মনে মনেই মিলটা হয়ে গেল।
তখন আমি এসএসসিতে সায়েন্স থেকে স্টার মার্কস পেয়ে আমাদের শহরেরই নামকরা কলেজে অনেক ভেবেচিন্তে হিউম্যানিটিজে মানে মানবিকে ভর্তি হয়েছি। আর মুন ভর্তি হয়েছে মেয়েদের কলেজে।
সময়টা তখন শরৎকাল।
প্রকৃতিতে আহা কী সাজ সাজ রব! সাদা মেঘের ভেলারা নীল আকাশে অবাধ বিচরণের সুযোগ পেয়ে তখনই ম্যারাথন দৌড়ে দিনমান ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছে। কাশফুলের কথাই শুনছে না। শোনার সময় তাদের নেই! সারা দিনে একবার কি দুবার শুনছে! বৃষ্টি হয়ে সাড়া দিচ্ছে!
কিন্তু মুনের কথা আমাকে শুনতেই হলো। ওর যুক্তির কাছে হার মানতেই হলো।
এই শহর তো আমাদের। আমাদেরই শহর। আমাদের জ্ঞাতিকুটুম শহরের সর্বত্রই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। সাবধানের মার নেই। তাই ভেবেচিন্তে কিছুটা কাঠখড় পুড়িয়ে সাজু চাচার ছোট মেয়ে মিমকে ডাকপিয়ন নিযুক্ত করা হলো। মিমই চিঠি দেওয়া-নেওয়া করত। কিন্তু, কীভাবে যেন ছোট চাচি ব্যাপারটি টের পেয়ে গেলেন।
গাইয়ে গোয়ালে মিল থাকলে নাকি হাঁটুপানিতে দোহানো যায়! তাই একদিন সুযোগটাও এসে গেল। বলা যায়, ছোট চাচিই সুযোগ করে দিলেন। দেখেও না দেখার ভান করলেন।
 বললাম, ‘গরিব মানুষ। বামন অইয়া চান্দো আত (হাত) দিলাইছি।’
বলল, ‘অন্য মাত মাতো। আমি তো গরিব দেকিয়া তুমার লগে ভিড়ছি না।’
‘তে কিতা দেকিয়া ভিড়ছো?’
‘তুমার মন দেকিয়া ভিড়ছি।’
‘মনে মনে মিল অইবোনি?’
‘অইতো না কেনে! তুমি ঠিক থাকলে সবতাই অইবো।’
ঠিক তো ছিলাম আমি।
কিন্তু, মুন ঠিক থাকতে পারল না।
অনার্স পড়াকালীন বাবা-মায়ের পছন্দে এক ব্রিটিশ সিটিজেনের সঙ্গে বিয়ে হয়ে ধেই ধেই করে গ্রেট ব্রিটেনে পাড়ি জমাল।
সে সময়ে আমি আমাদের জেলার একটি থানায় ডিগ্রি পাস করে সহকারী তহশিলদার পদে বছর দুয়েক ধরে কাজ করছি, আর সংসারের সমস্ত দায়িত্ব নিজ কাঁধে সমঝে নিয়েছি।
তারপর তো লিপি ডাক্তার হলো। ডাক্তার হয়ে ডাক্তারই বিয়ে করল।
আমিও একসময় কুমার জীবনের অবসান ঘটালাম। মায়ের ইচ্ছায় ছোট চাচির বারণ সত্ত্বেও ছোট চাচির খালাতো বোনের মেয়ে ইতিকে বিয়ে করে ঘরে তুললাম।
তারপর, মা মারা গেলেন।
সবকিছু মোটামুটি সুন্দরভাবে চলছিল।
নিজেকে নিয়ে আফসোস থাকলেও মোটামুটি সুখেই দিন কাটছিল।
কিন্তু, ইতির ইতরামিতে সবকিছু বরবাদ হয়ে গেল।
সেও তো বছর বিশেক আগের ঘটনা।
না, আর কিছু বলছি না।
কিছু কথা কিছু দুঃখ, থাক না একান্ত ব্যক্তিগত।