অলীক নক্ষত্র
তাশিন আয়োলিতা মগ্ন হয়ে আছে কালো কি-বোর্ডের ওপরে। দুহাতের আঙুলে একধরনের শব্দহীন শব্দে রচনা করে চলেছে ঠাসবুননের গল্পগাথা। যেন ঘন কাঁথাস্টিচের নকশিকাঁথা কিংবা নরম গরম উলের এক অসাধারণ বুনন। তাঁর আঙুলের স্পর্শে রচিত হচ্ছে বিভিন্ন মানুষের সাদাকালো বা রঙিন আখ্যান। ধবধবে ডিজিটাল সাদা পাতা একের পর এক আসছে, ভরে উঠছে কালো কালো দানায়, শেষ হয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে, নিচ থেকে আবার সাদা পাতা আসছে।
বাইরে ভাদ্রের আকাশ একনাগাড়ে ঝরে যাচ্ছে, ঝরঝর...ঝরঝর। কদিন আগেই ছিল দাবদাহ। ভ্যাপসা গরম। এখন চমৎকার আবহাওয়া। আয়োলিতার ঘরসংলগ্ন ব্যালকনির দরজা খোলা। মাঝে মাঝে জলের হালকা ছাঁট আসছে, আর শরীর জুড়ানো বাতাস তো আসছেই। সে আপন মনে লিখে চলেছে।
এমন লগ্নে মিষ্টি জলতরঙ্গের সুর বেজে ওঠে। আহ! ধ্যান ভঙ্গ। তাকিয়ে দেখে একটি অজানা নম্বর থেকে ফোন। ধরল না। আবার জলতরঙ্গ—।
—হ্যালো!
—তাশিন আয়োলিতা!
—বলছি
—আমি আপনার একজন ভক্ত, আপনার লেখা পড়ি। কেবল পড়ি নয়, পছন্দ করি। ভালোবাসি।
—বেশ। ধন্যবাদ।
এরপর সে ভরাট কণ্ঠে আয়োলিতার বিভিন্ন লেখার অংশ অবলীলায় বলে যেতে লাগল। আয়োলিতা ভীষণ অবাক হলো। আবার মনটা আনন্দ খুশিতে ভরে উঠল। এমন ভক্ত পাঠক পেলে যেকোন লেখকের মন ভালো হতে বাধ্য। এবারে সে জানাল, একবার লেখকের সাথে দেখা করতে চায়।
আয়োলিতার কপাল কুঁচকে গেল। সে বলল, আমি ব্যস্ত আছি। পরে জানাব। লেখা ছেড়ে ওঠার কোনো ইচ্ছে নেই। তাড়াহুড়ো করে বাই বলে ফোন কেটে দিল সে। আবার মন দিল শব্দ গাঁথুনিতে, লেখাটি বেশ এগোচ্ছে। একসময় যখন লেখার ধ্যান ভঙ্গ হলো, সে দেখে রাত তখন দুটা। এত রাতে কিছু আর খেতে ইচ্ছে করল না। রাতবাতি জ্বালিয়ে বাকি আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।
পরদিন ঠিক ওই সময়েই আবার ফোন। একই কথা। একবার দেখা করতে চায়। এবারে বলে,
আপনার বাসার কাছেই কফিশপ ‘কফিবিন অ্যান্ড টিলিফ’ ওখানে আসুন। অল্প সময়ের জন্য, আমি অপেক্ষা করব।
আয়োলিতা শ্যাম্পু দিয়ে হট শাওয়ার নিয়েছে, দুপুরে স্মোকড কোরালের সাথে নিয়েছে বয়েল্ড ভেজিটেবল আর প্রচুর স্যালাড। খাওয়া শেষে এক মগ কুসুম উষ্ণ জলে পিওর কাগজি লেবুর রস। লেখাটা মোটামুটি শেষ হয়েছে। এখনো এডিট বাকি, তবে মূল কাজ হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে এডিট হবে। আচ্ছা, কে এক ভক্ত এত করে যখন ডাকছে, তবে যাওয়া যেতেই পারে। তা ছাড়া ইউনিমার্ট থেকে মাশরুমসহ কিছু জিনিসও আনতে হবে। ক্লোজেটে গিয়ে সে সালোয়ার-কামিজ কিংবা প্যান্ট ফতুয়া সরিয়ে রেখে মিল্ক হোয়াইট সফট সিল্ক শাড়িটা পরে ফেলে। এটি ওর প্রিয় শাড়ি। সে জানে এটি পরলে কেমন লাগে ওকে। সে কোনো সাজগোজ করে না। মুখে সামান্য ক্রিম, একটু ফেস পাউডার, ব্যস।
তার নিজস্ব একটি স্কুটি আছে। সেটাই ওর বাহন। কফিশপ এতটাই কাছে যে স্কুটি নিয়ে ঘুরে যাওয়ার চেয়ে অ্যাপার্টমন্টের পেছন দিয়ে হেঁটে যাওয়াই ভালো।
কফিশপে ঢুকে সে চারদিকে তাকায়। বোঝার চেষ্টা করে, কেউ অপেক্ষা করছে কি না। অতঃপর একটি ফাঁকা টেবিলে বসে পড়ে। ফোনে সে যে সময় দিয়েছে, তার চেয়ে খানিক পরে সে পৌঁছেছে, আবার পৌঁছানোর পরও অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল, কই কেউ তো এলো না। ধীরে ধীরে ওর কপালে ভাঁজ পড়তে থাকে। এ কী ধরনের ছেলেমানুষি! কে এমন করল! আসাটাই ভুল হয়ে গেছে। ভাবল আর পাঁচ মিনিট দেখেই সে উঠে পড়বে। যত্ত সব!
ঠিক এমন সময় এক যুবকের আবির্ভাব। আয়োলিতা মুখ তুলে তাকায়।
—আপনি একা আছেন, আমি কি এখানে বসতে পারি?
—হ্যাঁ। বলেই চুপ করে যায় সে।
—আমি কি বিরক্ত করলাম? সে কোনো কথা বলে না।
—কফির কথা বলি? বলেই সে দ্রুত কফির কথা বলে।
—আপনি ফোনে বললেন অপেক্ষা করছেন, আর এতক্ষণে এলেন?
—আমি? ফোন? মানে কী বলছেন? আয়োলিতা অপলক তাকিয়ে থাকে। কোথাও গড়বড় হচ্ছে।
—আপনি কি কাউকে ফোন করে এখানে আসতে বলেছেন?
—না। আমি এইমাত্র এখানে ঢুকলাম। আমার গাড়ির কী একটা প্রবলেম হওয়াতে, গাড়ি ঠিক করার ফাঁকে ভাবলাম, এখানে কফি খেয়ে নিই। ঢুকেই দেখি আপনি। আপনি জানেন না, আপনার সব বই আমার কাছে আছে। আপনার লেখা আমি নিয়মিত পড়ি, ভালোবেসে পড়ি।
শেষের উপন্যাসটি অদ্ভুত ভালো লেগেছে। কফি চলে এলো।
—প্লিজ, নিন।
আয়োলিতা কফির মগ হাতে নেয়। ওর কেমন যেন লাগে। সামনের যুবকের কথা বলা, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ পরিচিত লাগে, এমনকি কফিমগ এগিয়ে দেবার ভঙ্গিটি পর্যন্ত। কে যেন ঠিক এভাবেই এগিয়ে দিত, কিন্তু ঠিক ধরতে পারে না। মনে পড়ে না। নিজ স্মৃতির ওপর ওর অগাধ আস্থা, কিন্তু স্মৃতি এখন সহযোগিতা করছে না। দরকারের সময় স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করে, এটাই নাকি নিয়ম। বিরক্ত লাগছে। যে ফোন করেছিল এ কণ্ঠস্বর তার নয়। সে এলো না কেন! আর যে এলো সেই-বা কে! পরিচিতই-বা লাগছে কেন!
কফি শেষ হয়। আয়োলিতা মুডে নেই। আলাপ এগোয় না। সে অন্যমনস্ক। যুবক উঠে দাঁড়ায়।
—কফি খাওয়ানোর সুযোগ দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আসি তাহলে।
ও হ্যাঁ, ওই কথাটি ভীষণ সত্যি। আয়োলিতা মরাল গ্রীবা তুলে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকিয়ে থাকে।
—আপনি মার্গারিটার চেয়ে অনেক সুন্দর। বলে বুকের রক্ত ছলকে ওঠার মতো একটা হাসি দিয়ে গটগট হেঁটে চলে যায়। আয়োলিতা নির্বাক তাকিয়ে থাকে। কে! কে!
কে যেন একথা বলেছিল। আশ্চর্য! কে এই যুবক!
২
ব্যালকনি আলো করে থোকা থোকা এডেনিয়াম ফুটেছে। পার্পল কালার মরুগোলাপ। গুচ্ছ গুচ্ছ। কিছুক্ষণ সেখানে বসে থেকে সে ভেতরে এসে ব্যায়ামের ড্রেস পরে নেয়। প্রথমে ইয়োগা সেরে নেয়। পরে হার্ড ফ্রিহ্যান্ড। ননস্টপ চলতে থাকে। সপ্তাহে এক দিন দীর্ঘ সময় ধরে সে শরীরের ওপর চাবুক চালায়, ক্লান্ত হয় না। সামান্য মেদ জমেছে, তা ঝরাতে হবে। গা ঘেমে একশা। বিশ্রাম নিয়ে, স্নান সেরে হালকা লাল চা সাথে ব্রেড আর সেদ্ধ ডিম।
রকমারিতে কিছু বইয়ের অর্ডার করেছে সেই কবে, কিন্তু আজও নেই। নতুন কোনো বই নেই পড়ার মতো। কদিন আগে বড় বড় দুই কার্টন বই মফস্বলের এক লাইব্রেরির ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছে। ছোট্ট, স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে বই রাখার জায়গা নেই। আজ লেখা এডিট করতেও ইচ্ছে করছে না। সে কিছুক্ষণ ফেসবুকে গুঁতোগুঁতি করে একটা মুভিতে মনোনিবেশ করল। ভালো লাগল। উঠে খেয়ে নিয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিল।
সন্ধ্যেটা কাটল ‘কণ্ঠ’ নামক আরেক মুভি দেখে, জয়ার অভিনয় ওর প্রিয়; তার চেয়ে প্রিয় জয়ার ফিগার। ওটা শেষ হলে ‘তাসের ঘর’ দেখল, এতটুকু ভালো লাগল না। ঘুমুতে গেল যখন, তখন রাত গভীর।
পরদিন, সকাল পায়ে পায়ে দুপুরের দিকে ধাবমান। একাকী নিঃসঙ্গ দুপুর বাইরের বিভিন্ন শব্দে কাঁদে। আয়োলিতা ঘুমে বিভোর। সকাল না, দুপুরের রোদ পড়েছে মুখের বাঁ পাশে আর ঘরে পরা টি-শার্টের গলার গভীর খাদে। সাদা ক্রিম আর হালকা গোলাপের সংমিশ্রণে গঠিত টান টান ত্বকে রৌদ্রের খেলা। খেলা করছে বুকের ক্লিভিজে। সে কি স্বপ্ন দেখছে! তার ঠোঁটের কোণে হাসির আভাস। হ্যাঁ, সে স্বপ্ন দেখছিল কফিশপের সেই যুবক তাকে কী যেন বলছে কিন্তু এমন ঝোড়ো বাতাস একটি শব্দও সে শুনতে পারছে না, বুঝতে পারছে না। কেবল বুঝল–
“আপনি সুনীলের মার্গারিটার চেয়েও সুন্দর”।
সে চমকে গিয়ে ঝট করে উঠে বসে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায় মাত্র শেষ করা তার নতুন উপন্যাসে এই বাক্যটি আছে। কিন্তু সে লেখা অপ্রকাশিত। কেউ জানে না। তাহলে কফিশপের সেই যুবক কী করে সেদিন বলল! সে থম মেরে বসে থাকে। কী হচ্ছে! তাই তো সেদিন ওই যুবককে চেনা চেনা মনে হচ্ছিল।
আরও কিছু সময় চলে গেলে সে উঠে স্নানে যায়। সময় নিয়ে স্নান সারে। বের হয়ে সে প্রার্থনায় বসে। তার নিজস্ব প্রার্থনা। এটি করলে সে খুব ফুরফুরে থাকে।
স্মুদি করা ছিল, ফ্রিজ থেকে বের করে চুমুকে চুমুকে খেয়ে নিল।
ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারে আজ শনিবার সন্ধ্যা সাতটায় একটা ফেস্টিভ্যালে নিমন্ত্রণ আছে। সন্ধ্যার আগেই সে প্রস্তুত হয়ে নিল। ক্রিম জমিনে চওড়া সোনালি পাড়ের গাদোয়াল, হাইনেক ব্লাউজ সঙ্গে মাদার পার্লের সেট।
জলতরঙ্গ।
—হ্যালো।
—আমি কি তোমাকে ড্রপ দেব? রেডি হয়েছ, আসব?
—হ্যাঁ, এসো। আরও কয়েকবার জলতরঙ্গ বাজলেও সে রিসিভ করল না। প্রোগ্রামের এমন দিনগুলোতে দু-চারজন বন্ধু ড্রপ দিতে চায়।
এসব প্রোগ্রাম ওর কিছুক্ষণ ভালো লাগে, তারপর একঘেয়ে হয়ে যায়। যখন একঘেয়ে লাগছে, বের হয়ে যাবার কথা ভাবছে।
—হ্যালো! তাকিয়ে দেখে, ফেসবুকের পরিচিত একজন হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। হ্যান্ডশেক করতে কোনো ছুঁতমার্গ নেই আয়োলিতার, কিন্তু সে হাত বাড়াল না। সীমান্তের ওপারের ওরা ইচ্ছে করে বাংলাদেশের মেয়েদেরকে এমন করে দেখায় যে, দেখো, তোমরা কতটা গোঁড়া। সে মুখে বলল, হ্যালো।
—চলুন না ওদিকে বসি। পায়ে পায়ে তারা একটা টেবিলে গিয়ে বসে। আলাপচারিতা বেশ জমে ওঠে। প্রথম দিকে আয়োলিতার উসখুস লাগলেও লেখালেখির প্রসঙ্গ এলে সে মগ্ন হয়ে যায়। তা ছাড়া দেখা যায় তাদের দুজনের অনেক বন্ধুকে দুজনেই চেনে, যারা খুব ভালো লিখছে।
বিভিন্ন লেখকের বই নিয়ে চলতে থাকে বিক্ষিপ্ত কথা বলা। একসময় তিনি জিজ্ঞেস করেন,
—আপনার শাহাদুজ্জামান পড়া হয়েছে?
—হ্যাঁ, পড়েছি।
—কোনটা পড়েছেন?
—‘ক্রাচের কর্নেল’, ‘একজন কমলালেবু’।
—কেমন লেগেছে?
—এর উত্তর এককথায় দেওয়া যাবে কি? যাবে না। তবে খারাপ না। তাঁর ঐতিহাসিক পটভূমিকার সাথে ভাবনার মিশেলে রচিত ক্রাচের কর্নেল ভালো লেগেছে। সংগ্রামী কর্নেল তাহেরের জীবনী এককথায় অসাধারণ! তিনি ছিলেন বিপ্লবী, প্রতারিত তবে উচ্চশির। এটি বাংলাদেশের একটা দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসও বটে। সেখানে একাত্তর, পঁচাত্তর এবং নভেম্বর এসেছে বিস্তারিতভাবে।
তিনি ফাঁসির রাতে ঘুমিয়ে নেন নিশ্চিন্তে। সেভ করে, গোসল করে আয়েশ করে সিগারেট টেনে পরিপাটি হয়ে এগিয়ে যান ফাঁসির মঞ্চের দিকে। কত বড় বীর হলে এটি সম্ভব! ভাবলেই গা শিউরে ওঠে।
এপার-ওপার লেখকদের লেখা, সমকালীন কারা ভালো লিখছে, বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা আলোচনা হয়। আয়োলিতার রুচি ও ব্যক্তিত্বও বাদ পড়ে না। এরপর তিনি প্রস্তাব করেন, চলো, কোথাও ঘুরতে যাই। আপনি থেকে অনায়াসে সে তুমিতে নেমে আসে। ইনবক্সে কথা বলার সময় তুমি করে বলার অনুমতি চেয়েছিল কয়েক দিন। আয়োলিতা কোনো জবাব দেয়নি।
—কোথায়?
—তোমার শহর, তুমিই ভালো জানো কোথায় যাওয়া যেতে পারে। বাইরে তাকিয়ে দেখো, অপুর্ব সন্ধ্যা নামছে! চলো, ঘোরাঘুরি শেষে একসাথে ডিনার করা যাবে। তার চোখেমুখে বিপুল আগ্রহ থইথই করে। ঝকঝকে হাসিতে টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন ধরে রাখে।
এই লোক তার ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহী, তা জানে আয়োলিতা। মাঝে মাঝেই ইনবক্সে তার ছোট ছোট চিঠিপত্র পাওয়া যায়। সেখানে আয়োলিতার লেখার প্রশংসার সাথে লেখকের প্রতি অসীম আগ্রহ ফুটে ওঠে। নানাভাবে তার ভালো লাগার কথা সে জানায়।
অকস্মাৎ আয়োলিতা সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলে ওঠে, চলি তবে বাই। এত দ্রুত সে হাঁটতে থাকে যে বেচারা হতভম্ভ হয়ে বসেই থাকে।
৩
সাঁঝবাতি উপন্যাসটা কবেই শেষ। সে গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে এই উপন্যাস লিখেছে। এই দীর্ঘ সময় সে একটা নেশার মধ্যে ডুবে ছিল, মারিজুয়ানার নেশার মতো, প্রেমের নেশার মতো। কেবল ফাইনাল এডিট বাকি।
কিন্তু একটা অবসাদে পায় আয়োলিতাকে, কিচ্ছু ভালো লাগে না। মনে হয় জীবন কি এই! এর বাইরে আর কিছু নেই। খাওয়া, বইপড়া, লেখালেখির চেষ্টা, ব্যস!
কী হয় লিখে! মনের অব্যক্ত কথারা থাকুক না সিন্দুকে ভরা। তাদের আলোতে আনতে হবে কেন! তাতে কী লাভ! কী প্রাপ্তি! আয়োলিতা দিনকে দিন যেন এক বিবরে তলিয়ে যেতে থাকে। কোনো কিছু অবিনশ্বর নয়, সেকথা জেনে এই শূন্যতাকে মেনে কিংবা না মেনে নিয়ে বুকের মাঝে অব্যক্ত এক যন্ত্রণা অনুভূত হতে থাকে।
সহস্র প্রতিকূলতাতেও জীবন থেমে থাকে না, স্বাভাবিক ছন্দে না চললেও থেমে থাকে না। চলে। এখনো চলছে। কিন্তু কোথায় কিসের যেন এক অভাব। হতাশা, শূন্যতা, অতল গহ্বর, রাত্রি জাগরণ পাইথনের মতো ওকে পেঁচিয়ে ধরে।
রাতের পর রাত সে জেগে থাকে। ঘুম আসে না। লেখালেখি বন্ধ। ব্যায়াম বন্ধ। খাবারের কোনো আয়োজন নেই। অর্ডার করলেই খাবার আসে, তা-ও করে না। সে প্রবলভাবে উপলব্ধি করে জীবন এভাবে চলতে পারে না। আদতে একা একা বাঁচা যায় না। সমস্ত অস্তিত্বে কল্পনাতীত দহন, ক্ষরণ।
সেই জন্মের পরই বাবা চলে গেছে। মাকে নিয়ে বড় ভাই বিদেশের মাটিতে। সংসার হয়নি। পরিবার গড়ে ওঠেনি। বিয়ের পরপরই কনসিভ করেছিল তখন স্বামী বুঝিয়েছিল, বাচ্চা নেবার জন্য এটা উপযুক্ত সময় নয়। নার্সিং হোমের সবুজ বেডে শুয়ে তাকে রিমুভ করা হয়েছিল। সেই ভালোবাসার মানুষ চলে গেছে ফেসবুকের এক ঘর পালানো বন্ধুর সাথে।
আত্মহননের প্রবণতা মানুষের প্রাগৈতিহাসিক একটি ইচ্ছে। সাধারণত বা অসাধারণত মানুষ অনুকূল অবস্থার বিপরীতে গেলেই এমন একটি পৈশাচিক আনন্দময় বিষয়ে চিন্তা করে। কেউ এই চিন্তার বাস্তবায়নে যা করার, তাই করে আর কেউ কেউ ভাবনাটিকে নাড়াচাড়া করে সিন্দুকের গোপন কুঠুরিতে সযতনে তুলে রাখে; ভাবে, রইলই তো, দরকারে কাজে লাগানো যাবে।
আয়োলিতা কি এবারে কাজে লাগানোর কথা ভাবে! ওর দেরাজে চমৎকার একটি কৌটায় অনেকগুলো সাদা সাদা দানা। সে এগুলো একটু একটু করে সংগ্রহ করেছে।
ক’দিন কেটেছে? এক সপ্তাহ? এক মাস? নাকি তারও বেশি? দুর্মর অবসাদে প্রায় অচেতন আয়োলিতা। দিন-রাতের কোনো ফারাক নেই ওর কাছে। ঘুমে, অচেতনে কেটে যাচ্ছে সময়।
একদিন গভীর অন্ধকারে সে অনেক কষ্টে উঠে বসে, তার সেই গোপন কৌটা খুলে হাতে ঢেলে নেয়, জলের মগ আরেক হাতে। মুঠোভর্তি সাদা দানা মুখে দিয়ে জল নিয়ে গিলে ফেললেই হয়। হাতের মুঠো, হাঁ করা মুখের কাছে, ঠিক এমন মুহূর্তে কফিশপের সেই যুবক সামনে এসে দাঁড়ায়
—আয়োলিতা, এ তুমি কী করছ? এ কাজ তোমার জন্য নয়। তুমি একজন লড়াকু মানুষ, তুমি এটা করতে পারো না। এ পরাজয় তোমাকে মানায় না। তুমি সাঁতার জানো, তাহলে ডুবতে চাচ্ছ কেন!
—আর বাঁচতে চাই না, মানে এই একাকিত্ব, এই দহন আমার আর...
—একা হবে কেন! তুমি তো একা নও আয়োলিতা। তোমার একটি পরিপাটি সাম্রাজ্য আছে। সেখানে তুমিই রাজা, তুমিই প্রজা। তোমার ভেতরের শক্তিতে তুমি দেবী দুর্গা। তুমি দশভুজা।
তা ছাড়া, তোমার বিশেষ কজন ভক্ত আছে। কারও কারও ভরাট কণ্ঠে তোমার বইয়ের অধ্যায়গুলো অদ্ভুত শোনায়। আছে ওপারের মানুষ, তোমার প্রতি অনুরক্ত, তোমার কত কত বন্ধু, তোমাকে ভালোবাসে। কতজন বিশেষ মানুষ আছে, যারা তোমাকে ভালোবেসেই কাছে আসতে চায়। তুমিই তো সরে যাও।
তুমি নিজেই এই জীবন বেছে নিয়েছ এবং তা চমৎকারভাবে কাটিয়ে যাচ্ছ। আবার এর বাইরে যদি অন্য রকম চাও তো পেতেই পারো, এত হতাশা কেন! জীবনের অন্বেষণ ফুরিয়ে গেল! বেঁচে থাকার উষ্ণতা তুমি নিজেই তৈরি করে নিতে জানো। তোমার মতো এত প্রাণশক্তি কজনের আছে বলো!
—তুমি কে?
—এবারে, অদ্ভুত এক শুভ্র হাসি সে হাসতে থাকে... তুমিই বল আমি কে?
আয়োলিতার মনে পড়ে এ তারই সৃষ্টি, সর্বশেষ উপন্যাস সাঁঝবাতির এক চরিত্র। অদ্ভুত এক আকর্ষণীয় যুবক। যুবক নয়, যুবকের চরিত্র, কিন্তু এমন এক পুরুষের সাধনায় বুঝি কেটে যায় প্রত্যেক নারীর জীবন।
অদ্ভুতভাবে, আয়োলিতার উষ্ণতা কেবল এই যুবকের জন্যই তৈরি হতে পারে।
অসাধারণ গল্প। টান টান ভাষা, গল্প শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টেনে ধরে রাখে।
সাদিয়া সুলতানা
আগস্ট ১৩, ২০২২ ১৩:৩২