নিগ্রো শিল্পী এবং জাতিভেদের পাহাড়

 

         ল্যাংস্টোন হিউজ  [Langston Hughes]

ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন এখনো চলছে। এটি শুরু হয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর পুলিশি নৃশংসতা এবং জাতিবিদ্বেষ থেকে তাদের ওপর ঘটতে থাকা সব রকম সহিংসতার বিরুদ্ধে। সামাজিক ও রাজনৈতিক এই আন্দোলন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে গত বছর জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের পর। বর্ণবাদবিরোধী এই আন্দোলনের প্রায় এক শ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়েছিল হার্লেম রেনেসাঁ আন্দোলন। বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক সেই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল শিল্প-সাহিত্যে বর্ণবাদের পাহাড় ডিঙানো এবং তাতে নিজেদের পরম্পরা আবিষ্কার করা।

ল্যাংস্টোন হিউজ ছিলেন হার্লেম রেনেসাঁর নেতা। তিনি আমেরিকান কবি, ঔপন্যাসিক ও সমাজকর্মী। জ্যাজ কবিতা নামের একটি শৈলী উদ্ভাবন করেন। হিউজ লেখাপড়া করেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও লিংকন বিশ্ববিদ্যালয়ে। লিংকনে ছাত্র থাকাকালে প্রথম কবিতার বই দ্য ওয়ারি ব্লুজ [১৯২৬] প্রকাশিত হয়। একই বছর প্রকাশিত হয় তাঁর নিগ্রো শিল্পী ও জাতিভেদের পাহাড় শিরোনামের লেখাটি। এ লেখাকে অনেকেই হার্লেম রেনেসাঁর গুরুত্বপূর্ণ নথি হিসেবে দেখেন।

প্রবন্ধটি প্রকাশের আগে নেশন ম্যাগাজিনের সম্পাদক ফ্রিডা কার্চওয়ে ল্যাংস্টোন হিউজকে জর্জ স্কাইলারের লেখা দ্য নিগ্রো আর্ট হকুম নামের একটি লেখার পাল্টা প্রতিক্রিয়া লিখতে অনুরোধ করেন। স্কাইলার ছিলেন আফ্রিকান-আমেরিকান সংবাদপত্র দ্য পিটসবার্গ কুরিয়ারের সম্পাদক। তিনি তাঁর প্রবন্ধে প্রশ্ন তোলেন, আদৌ আফ্রিকান-আমেরিকান শিল্প-সাহিত্যের আলাদা কোনো পরম্পরার দরকার আছে কি না। সেই বক্তব্যের পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবেই হিউজের লেখাটি নেশন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।

সবচেয়ে সম্ভাবনাময় তরুণ কবিদের একজন আমাকে একবার বললেন, আমি একজন কবি হতে চাইকোনো নিগ্রো কবি নয়। আমার বিশ্বাস, কথাটার মানে, আমি একজন সাদা কবির মতো লিখতে চাই; অবচেতনে যার অর্থ, আমি একজন সাদা কবিই হতে চাইব; যে কথার অন্তর্গত মানে, আমি একজন সাদা মানুষ হতে চাই।আমি দুঃখিত যে, একজন তরুণ এটা বলেছেন, কিন্তু কোনো বড় কবি কখনোই নিজের মতো হতে ভয় পান না। কাজেই আমি সন্দিহান যে, নিজের জাত ছেড়ে মানসিকভাবে পালাবার বাসনা নিয়ে এই তরুণ আদৌ বড় কবি হতে পারবেন কি না। কিন্তু আমেরিকায় যেকোনো সত্যিকার নিগ্রো শিল্পের পথে দাঁড়ানো এটা একটা পাহাড়জাতির ভেতর সাদার প্রতি এই তাড়না, আমেরিকান মানদণ্ডের ছাঁচে জাতিগত স্বাতন্ত্র্য ঢালাইয়ের এই বাসনা, আর যতটা সম্ভব কম নিগ্রো আর বেশি আমেরিকান হতে চাওয়া।

এবার এই তরুণ কবির কুলপঞ্জির দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। আমার ধারণা, তাঁর পরিবার নিগ্রো মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আসা, যাদেরকে কোনোভাবেই ধনী বলা যাবে না, আবার তারা যে অস্বচ্ছন্দ বা ক্ষুধার্ত এমনও নয়ফিটফাট, আত্মতৃপ্ত, শ্রদ্ধাভাজন লোক, ব্যাপ্টিস্ট গির্জার সদস্য। বাবা প্রতিদিন ভোরবেলা কাজে যান। তিনি সাদাদের ক্লাবের একজন প্রধান গোমস্তা। মা কখনো কখনো শখের সেলাই নিয়ে বসেন কিংবা শহরের ধনী পরিবারের উৎসবগুলোর তত্ত্বাবধায়কের কাজ করেন, বাচ্চারা মিশ্র স্কুলে যায়। বাড়িতে তারা সাদাদের পত্রিকা আর ম্যাগাজিন পড়ে। এবং বাচ্চারা খারাপ কিছু করলে মা মাঝে মাঝে বলেন, নিগারদের মতো হইয়ো না। বাবার দিক থেকে ঘন ঘন শোনা যায়, দেখো, সাদা লোকেরা কত সুন্দরভাবে কাজগুলো করে। কাজেই অসচেতনভাবেই সাদা শব্দটি হয়ে ওঠে সমস্ত সদ্গুণের প্রতীক। বাচ্চাদের জন্য এটা ধারণ করে সৌন্দর্য, নৈতিকতা এবং অর্থকড়ি। তাদের মনের ভেতর দিয়ে কেবল একটা কথাই মৃদু স্বরে উচ্চারিত হয়, আমি সাদা হতে চাই। এই তরুণ কবির বাড়ি, আমার ধারণা, বাদামি মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকদের মতো। কেউ তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারবে এমন একটা বাড়িতে জন্ম নেওয়া একজন শিল্পীর পক্ষে তার নিজের লোকদের সৌন্দর্য ব্যাখ্যায় আগ্রহী হওয়া কত কঠিন। সেই সৌন্দর্য তাকে কখনোই দেখতে শেখানো হয়নি। তাকে বরং এমনটাই শেখানো হয়েছে যে, সে যেন এটা না দেখে, কিংবা যদি দেখেও, তাহলে যেন এর জন্য লজ্জিত বোধ করে, যেহেতু এটা ককেশীয় ধাঁচের নয়।

নিজস্ব ঠমকে চলা উচ্চ শ্রেণির নিগ্রোরা যে ধরনের বাড়িতে থাকে, তার জন্য জাতিগত সংস্কৃতির পক্ষে ভালো কিছুই দেওয়ার নেই। কম সংস্কৃতিমান এবং কম ধনীদের বাড়ির চাইতে তারা বরং সাদাদের জিনিসপত্রেরই বেশি বেশি অনুকরণ করবে। বাবা হয়তো একজন ডাক্তার, আইনজীবী, জমির মালিক কিংবা রাজনীতিবিদ। মা হয়তো একজন সমাজকর্মী, কিংবা একজন শিক্ষক, কিংবা তিনি হয়তো কিছুই করেন না এবং তাঁর একজন চাকরানি আছে। বাবা প্রায়শ কালো কিন্তু সাধারণত তিনি বিয়ে করেন তাঁর খুঁজে পাওয়া উজ্জ্বলতম নারীকেই। পরিবারটি ফ্যাশনদার কোনো চার্চে যায়, যেখানে কিছু বাস্তবিক বাদামি মুখ দেখা যাবে। এবং তাঁরা নিজেরাও বর্ণের একটি রেখা টেনে রাখেন। উত্তরে তাঁরা সাদাদের থিয়েটারে এবং সাদাদের সিনেমায় যান। এবং দক্ষিণে তাঁদের অন্তত দুটি গাড়ি আছে এবং বাড়ি আছে সাদা ভদ্রলোকদের মতো। নরডিক চালচলন, নরডিক মুখ, নরডিক চুল, নরডিক শিল্প [আদৌ যদি থাকে], এবং এক বিশপীয় স্বর্গ। সম্ভাব্য জাতিগত শিল্পীকে বেয়ে উঠতে হবে খুব উঁচু একটা পাহাড়, যদি তিনি নিজেকে এবং নিজের লোকদেরকে আবিষ্কার করতে চান।

নরডিকভাবাপন্ন বুদ্ধিজীবিতা এবং কতিপয় সাদা সম্পাদকের মনের বাসনা যা-ই থাকুক, আমাদের আন্তরিক আমেরিকান নিগ্রো সাহিত্য ইতোমধ্যে আমাদের আছে। এখন আমি নিগ্রো থিয়েটারের জেগে ওঠার অপেক্ষা করি। আমাদের লোকগান, জগৎজোড়া খ্যাতি অর্জন করে নিজেকে নিবেদন করছে সেই মহান আমেরিকান নিগ্রো সংগীতকারের মেধার সমীপে, যার জন্ম সমাগত।

এবং তারপর আছে নিম্নশ্রেণির লোক, কথিত আমজনতা, এবং তারাই সংখ্যাগুরুসকল প্রশংসা প্রভুর! শনিবার রাতগুলোর জন্য তাদের আছে একটুখানি জিন এবং তারা নিজেদের কাছে কিংবা সমাজের কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ নয়, ভালোমতো খাবার জোটে না, কিংবা তারা অতটা শিক্ষিত নয় যে, অলস দুনিয়া কীভাবে ঘুরছে সেটা দেখবে। তারা বাস করে ওয়াশিংটনের ৭ নম্বর সড়কে, কিংবা শিকাগোর স্টেট সড়কে। তাদের চেহারা সাদা ভদ্রলোক কিংবা অন্যদের মতো কি না, তা নিয়ে তাদের বিশেষ কোনো ভাবনা নেই। তাদের স্ফূর্তি চলতে থাকে, তারা ফেটে পড়ে উচ্ছ্বাসে। তাদের ধর্ম হুংকারে উড়তে থাকে। আজ হয়তো কাজ একটু কম, কাল বিশ্রাম একটু কম। কিছুক্ষণ খেলা। কিছুক্ষণ গান। ওহ, চলো নাচি! এই সাধারণ লোকগুলো আধ্যাত্মিকদের নিয়ে শঙ্কিত নয়, যেহেতু তারা দীর্ঘকাল ধরে ছিল তাদেরই বুদ্ধিবৃত্তিক ভাই-বেরাদর, এবং জ্যাজ হচ্ছে তাদের সন্তান। তারা যেকোনো শিল্পীর জন্য জোগান দেন বর্ণিল এবং স্বতন্ত্র উপাদানের সম্পদ; কারণ, আমেরিকান মানদণ্ডের মুখে তারাই এখনো নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেছেন। এবং এই সাধারণ লোকগুলোই সম্ভবত জগৎকে দেবে সত্যিকার এবং মহৎ নিগ্রো শিল্পী, যিনি নিজের মতো হতে ভয় পাবেন না। উচ্চ শ্রেণির নিগ্রোরা শিল্পীদেরকে কী করতে হবে, সেটা বলে দিলেওতাঁর আবির্ভাবের সময় লোকজন তাঁকে অন্তত একলা থাকতে দেবে। তাঁকে নিয়ে লজ্জিত বোধ করবে নাযদি আদৌ তারা জানে যে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে। এবং তারা প্রশ্নহীনভাবে নিজেদের সৌন্দর্যকে মেনে নেবে।

নিজেদের গোষ্ঠীর দ্বারা আরোপিত নতুন নতুন বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করতে পারেন এমন আমেরিকান নিগ্রো শিল্পীদের শিল্পের জন্য আছে অব্যবহৃত উপাদানের বিস্তীর্ণ ভূমি। উচ্চ শ্রেণির নিগ্রোদের সাদা সংস্কৃতি এবং সচেতন আমেরিকান চালচলন থাকা সত্ত্বেও নিগ্রো হিসেবে তারা যথেষ্টই আলাদা, তাই নিজেদের জগতের বাইরে না গিয়েও জীবনভর সৃষ্টিশীল থাকার জন্য একজন কালো শিল্পীর জন্য পর্যাপ্ত উপাদানের জোগান আছে। এবং যখন তিনি এ দেশের নিগ্রো-সাদা সম্পর্ককে ছুঁতে চান, তাদের অসংখ্য চড়া ও নিম্নসুর সমেত, বিশেষত সাহিত্য এবং নাটকের জন্য, তখন তাদের হাতে থাকে থিমের অনিঃশেষ সরবরাহ। একজন নিগ্রো শিল্পী তাঁর জাতিগত স্বাতন্ত্র্য, ছন্দ ও উদ্দীপনার উত্তরাধিকার, এবং তাঁর বেখাপ্পা  রসবোধ এস্তেমাল করতে পারেন এসব শিল্পে; যা কখনো কখনো, যেমন ব্লুজ-এ, হয়ে ওঠে অশ্রু মেশানো বিদ্রূপাত্মক হাসি। এবার তবে পাহাড়টার দিকে তাকানো যাক।

ফিলাডেলফিয়ায় ক্লাবে যাওয়া একজন বিশিষ্ট নিগ্রো নারী এগারো ডলার খরচ করেন রাকেল মেলেরের আন্দালুসীয় জনপ্রিয় গান শুনতে। তিনি আমাকে কয়েক সপ্তাহ আগে বললেন, তিনি ওই মহিলা, নিগ্রো লোকগান গাওয়া বিখ্যাত কালো শিল্পী, ক্লারা স্মিথের গান শুনতে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না। এবং উচ্চ শ্রেণির নিগ্রো চার্চ এমনকি এখনো কোনো আধ্যাত্মিককে তার পরিষেবায় নিয়োগ দেওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। তাদের কাছে বরং সাদা ভদ্রলোকদের স্তোত্রপুস্তকের একঘেয়ে সুরগুলোই বেশি পছন্দের। তাদের কথা হলো, আমরা ঠিকভাবে এবং শান্তভাবে প্রভুর কাছে প্রার্থনা করতে চাই। চেঁচামেচিতে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা বরং নরডিকদের মতো নীরসই হবো।

কাজেই, নিষ্ঠাবান নিগ্রো শিল্পী যিনি জাতিগত শিল্প সৃষ্টি করেন, তার জন্য পথটা অবশ্যই পাথুরে এবং পাহাড়টা বেশ উঁচু। এখনো অব্দি তিনি সাদা বা বাদামি লোকদের কাছ থেকে কোনো উৎসাহ পান না। চেসনাটের চমৎকার উপন্যাসগুলোর মুদ্রণ নিঃশেষ হয়ে যায় জাতি বিষয়টির উল্লেখ ছাড়াই। উপভাষায় রচিত ডানবারের কবিতার অদ্ভুত আকর্ষণ এবং রসবোধ তাঁর জন্য, তাঁর সময়ে, এনেছে সেই ধরনের উৎসাহ যেমনটা দেওয়া হয় রঙ্গ-তামাশাকারী [একজন বাদামি আদমি কবিতা লিখছে!] কিংবা কোনো ক্লাউনকে [কী মজার!]।

নিগ্রো বিষয়-আশয়ের বর্তমান রেওয়াজযদিও এর আঘাত যতটা তা বাদামি শিল্পীটির বিকাশ ত্বরান্বিত করতেইএটি অন্তত একটি কাজ করতে পেরেছে: জোরপূর্বক এই শিল্পীকে তার নিজের লোকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে, যাদের কাছে দীর্ঘকাল ধরে সে ছিল অল্প সম্মান পাওয়া এক নবি, অবশ্য ইতোমধ্যেই যদি না সে চিহ্নিত হয়ে থাকে অন্য জাতির লোকদের দ্বারা। আমি বুঝতে পারি, চার্লস গিলপিন নিগ্রো থিয়েটারে বহু বছর ধরে অভিনয় করে গেছেন, নিজের জন্য বিশেষ কিছুই চাননি, কিন্তু ব্রডওয়ে থিয়েটার যখন অভিনয় শেষে তাঁকে আটবার মঞ্চে ডাকল, নিগ্রোরাও তখন তাঁর সম্মানে টিনের থালা বাজাতে শুরু করল। আমি একজন তরুণ বাদামি লেখকের কথা জানি, দিনের বেলা যিনি কায়িক শ্রমের কাজ করেন, কয়েক বছর যাবৎ বাদামি পত্রিকাগুলোর জন্য ভালোই লিখছিলেন, এরপর তিনি যখন সাদা প্রকাশনা সংস্থাগুলোতে ঢুকে পড়লেন এবং তাঁর প্রথম বইটি নিউইয়র্কের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশের অনুমোদন পেল, তখন তাঁর শহরের সবচেয়ে ভালো নিগ্রোরা তাঁকে একই শহরে আবিষ্কার করে বেশ অসুবিধায় পড়লেন। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁরা একটা নৈশভোজের আয়োজন করলেন তাঁর জন্য। কিন্তু সমাজের নারীরা সতর্ক হয়ে তাঁর মায়ের কানে ফিসফিস করে বললেন, ওখানে তাঁর না যাওয়াই ভালো। তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন না আদৌ তাঁর কোনো সান্ধ্য গাউন আছে কি না।

নিগ্রো শিল্পীকে কাজ করতে হয় তাঁর নিজের গোষ্ঠীর দিক থেকে ভুল- বোঝাবুঝি ও তীব্র সমালোচনার উল্টো স্রোতে এবং সাদাদের অনাকাঙ্ক্ষিত নজরানার প্রলোভনের বিরুদ্ধে। নিগ্রোরা বলে, ওহে, শ্রদ্ধা রাখো, সুন্দর লোকদের নিয়ে লেখো, তারা যে কত ভালো, সেটা দেখাও। সাদারা বলে, বাঁধাধরা পথেই হাঁটো, বেশি এগিয়ো না, তোমাদের নিয়ে আমাদের মনে যে বিভ্রম আছে, সেটাকে ধ্বংস করো না, আমাদেরকে মজা দিতে গিয়ে অত সিরিয়াস হওয়ার দরকার নেই। আমরা তোমাদেরকে এর মূল্য দেব। উভয়েই জ্যাঁ টুমেরকে তাঁর চাবুক না লেখার জন্যই বলে থাকবেন। বাদামি লোকেরা এ বইয়ের প্রশংসা করেনি। সাদা লোকেরা এটা কেনেনি। বাদামিদের যারাই চাবুক পড়েছে, বেশির ভাগই এটাকে ঘৃণা করেছে। এ বইটিকে তারা ভয় পেয়েছে। যদিও সমালোচকেরা এ বইয়ের প্রশংসা করেছেন, কিন্তু জনগণ থেকেছে নির্বিকার। তবু [দু বোইসের কাজকে বাদ রেখে] চাবুক-এ আছে একজন আমেরিকান নিগ্রোর লেখা দারুণ চমৎকার গদ্য। এবং এটা রবসনের গানের মতো সত্যিকার অর্থেই জাতিগত।

আমি সেই কালো কবির জন্য লজ্জিত যিনি বলেন, আমি একজন কবি হতে চাইকোনো নিগ্রো কবি নয়, যেন তাঁর নিজের জাতিগত জগৎ অন্য যেকোনো জগতের মতো আগ্রহোদ্দীপক নয়। আমি একইভাবে বাদামি শিল্পীদের জন্যও লজ্জিত যে, তাঁরা নিগ্রো মুখ আঁকা ছেড়ে সূর্যাস্তের ছবি আঁকেন; কারণ, শিক্ষাবিদদের আচরণের জন্য তিনি নিজের অ-সাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে ভয় পান।

নরডিকভাবাপন্ন বুদ্ধিজীবিতা এবং কতিপয় সাদা সম্পাদকের মনের বাসনা যা-ই থাকুক, আমাদের আন্তরিক আমেরিকান নিগ্রো সাহিত্য ইতোমধ্যে আমাদের আছে। এখন আমি নিগ্রো থিয়েটারের জেগে ওঠার অপেক্ষা করি। আমাদের লোকগান, জগৎজোড়া খ্যাতি অর্জন করে নিজেকে নিবেদন করছে সেই মহান আমেরিকান নিগ্রো সংগীতকারের মেধার সমীপে, যার জন্ম সমাগত। এবং আশা করছি আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বাদামি শিল্পীদের জায়মান সম্প্রদায়গুলোর কাজ দেখতে পাব, যারা কালো মুখের সৌন্দর্যকে আদর্শ ধরে আঁকবেন এবং যারা নিজের আত্মিক জগতের অভিব্যক্তিকে নির্মাণ করবেন নতুন কৌশল দিয়ে। এবং নিগ্রো নৃত্যশিল্পীরা নৃত্য করবেন আগুনের শিখার মতো এবং গায়কেরা আমাদের গানকে নিয়ে যাবেন সবার কাছে যাঁরা শুনবেনতাঁরা আগামী দিনে আমাদের সঙ্গে থাকবেন সংখ্যায় সুবিশাল হয়ে।

আমার নিজের অধিকাংশ কবিতার মূলভাব ও নিরীক্ষার ধরন জাতিগত এবং যে জীবনটাকে আমি জানি সেখান থেকেই নেওয়া। আর বেশ কটি কবিতায় আমি জ্যাজের ছন্দ ও তাৎপর্যকে ধরার চেষ্টা করেছি। আমি খুবই নিষ্ঠাবান যে, আমি জানি এসব কবিতার হয়ে ওঠাটা কেমন, তবু প্রতিবার কবিতা পড়ার পর আমার নিজের লোকদের কাছেই এসব প্রশ্নের জবাব দিতে হয়: তুমি কি ভাবো নিগ্রোরা কেবল নিগ্রোদের নিয়েই কবিতা লিখবে? আমি চাই কিছু কবিতা তুমি সাদাদের সামনে পড়বে না। ক্যাবারের মতো জায়গার ব্যাপারে আগ্রহী হওয়ার মতো কিছু কীভাবে তুমি খুঁজে পাও? কালোদের নিয়ে লেখো কেন? তুমি তো কালো না। এতগুলো জ্যাজ কবিতা লেখার কারণ কী?

কিন্তু আমি মনে করি, জ্যাজ আমেরিকান নিগ্রো জীবনের সহজাত অভিব্যক্তির একটি: নিগ্রো আত্মার অনন্ত টম টম স্পন্দনসাদা জগৎ পাতালরেল, এবং কাজ, কাজ আর কাজের সেই জগতের ক্লান্তির বিরুদ্ধে দ্রোহের টম টম; আনন্দ এবং হাসির টম টম, এবং যে হাসি গ্রাস করে নেয় যন্ত্রণাকে। তবু ফিলাডেলফিয়া ক্লাবের সেই নারী বলতে লজ্জা পান যে তার জাতি এটা সৃষ্টি করেছে এবং তিনি চান না এটা নিয়ে আমি লিখি; সাদাই যে শ্রেষ্ঠ এই অবচেতন সক্রিয় তার মনের ভেতর। সাদা শিক্ষকদের কাছে বহু বছরের শিক্ষা, জীবনভর সাদা বই, ছবি, পত্র-পত্রিকা, এবং সাদা আচার-ব্যবহার, নীতি-নৈতিকতা, এবং শুদ্ধতাবাদী মানদণ্ড তাকে আধ্যাত্মিকদের প্রতি বিদ্বেষী করে তোলে। এখন তিনি জ্যাজ এবং এর যাবতীয় বিকাশ এবং একইভাবে জাতিগত সবকিছুর দিকে নাক সিঁটকাচ্ছেন। তিনি উইনোল্ড রেইসের নিগ্রো পোর্ট্রেটগুলোকে পরোয়া করেন না; কারণ, এগুলো খুব বেশি নিগ্রো। কারও কাছ থেকে তিনি তাঁর নিজের সত্যিকার ছবিটা চান না। তিনি চান, শিল্পী তাঁকে অতিরঞ্জিত করে আঁকুক, যাতে সাদা জগৎ বিশ্বাস করে যে, সব নিগ্রো আত্মিকভাবে সাদাদের কাছাকাছি এবং তাদের মতোই ফিটফাট। কিন্তু আমার মনে হয়, একজন তরুণ নিগ্রো শিল্পীর কর্তব্য হলো, যদি তিনি বাইরে থেকে আদৌ কোনো কর্তব্যকে আমলে নেনএকটা বদল ঘটানো, সেটা ঘটাতে হবে তাঁর শিল্পের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে, যেন সেই ফিসফিসানি আমি সাদা হতে চাই যা তাঁর লোকদের আকাঙ্ক্ষায় নিহিত, সেটা বদলে যায় এবং সে বলে, কেন আমি সাদা হতে চাইব? আমি একজন নিগ্রো এবং সুন্দর।

কাজেই, আমি সেই কালো কবির জন্য লজ্জিত যিনি বলেন, আমি একজন কবি হতে চাইকোনো নিগ্রো কবি নয়, যেন তাঁর নিজের জাতিগত জগৎ অন্য যেকোনো জগতের মতো আগ্রহোদ্দীপক নয়। আমি একইভাবে বাদামি শিল্পীদের জন্যও লজ্জিত যে, তাঁরা নিগ্রো মুখ আঁকা ছেড়ে সূর্যাস্তের ছবি আঁকেন; কারণ, শিক্ষাবিদদের আচরণের জন্য তিনি নিজের অ-সাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে ভয় পান। একজন শিল্পী কী করতে চান, সেটা অবশ্যই তিনি স্বাধীনভাবে নির্বাচন করবেন, এবং অবশ্যই তিনি তাঁর বেছে নেওয়া বিষয়ে কাজ করতে কখনো ভয় পাবেন না।

নিগ্রো জ্যাজ ব্যান্ডের তূর্যনিনাদ এবং ব্লুজ গাওয়া বেসি স্মিথের গান বাদামি প্রায়-বুদ্ধিজীবীদের বন্ধ কানে প্রবেশ করুক যতক্ষণ না তাঁরা শুনতে পান এবং হয়তো বোঝেন। পল রবসনকে ওয়াটার বয় গাইতে দাও, এবং রুডলফ ফিশার লিখুন হার্লেম স্ট্রিট নিয়ে এবং জ্যাঁ টুমের জর্জিয়ার হৃদয়কে তাঁর হাতের মধ্যে ধারণ করুন, এবং আরোন ডগলাস আঁকুন তাঁর অদ্ভুত কালো ফ্যান্টাসি, যা ফিটফাট নিগ্রো মধ্যবিত্তকে তাদের শ্রদ্ধাস্পদ সাদা থেকে ফেরায়, সাধারণ বইপত্রগুলো যাতে তাদের নিজেদের সৌন্দর্যকে ধরতে পারে। আমরা তরুণ শিল্পীরা যারা এখন সৃষ্টি করে যাচ্ছি, আমরা চাইছি কালো চামড়ার সত্তাকে ভয় এবং গ্লানি ব্যতিরেকে প্রকাশ করতে। সাদারা যদি এতে সন্তুষ্ট হয় আমরা খুশি। যদি না হয়, কিছুই যায় আসে না। আমরা যে সুন্দর সেটা আমরা জানি। আমার এ-ও জানি যে, আমরা কুৎসিত। টম টম ধ্বনি কাঁদে এবং টম টম ধ্বনি হাসে। বাদামি লোকেরা যদি তুষ্ট হয়, আমরা খুশি। যদি তা না হয়, তাদের অসন্তুষ্টিতে কিছুই যায় আসে না। আমরা আমাদের আগামীকালের মন্দির গড়ি, সেটাকে কীভাবে মজবুত করতে হয় আমরা জানি, এবং আমরা পাহাড়টার চূড়ায় গিয়ে দাঁড়াই, আমাদের অন্তর মুক্ত।

টীকা

১. হিউজ সম্ভবত কাউন্টি কালেনকে [১৯০৩-১৯৬২] ইঙ্গিত করেছেন। আফ্রিকান-আমেরিকান এই কবি চিরায়ত ধাঁচের কবিতা লিখতেন, অনুসরণ করতেন ইউরোপীয় কবিতার শৈলী ও ছন্দের ঐতিহ্য। হিউজ তাঁর সমালোচনা যেমন করেছেন, তেমনই প্রশংসাও করেছেন এবং তুলে ধরেছেন তাঁর লেখার গুরুত্ব।

২. রাকেল মেলের [১৮৮৮-১৯৬২], জনপ্রিয় হিস্পানি গায়িকা এবং অভিনেত্রী। ক্লারা স্মিথ [১৮৯৫-১৯৩৫], আফ্রিকান-আমেরিকান ব্লুজ গায়িকা। গানের প্রদর্শনীগুলোতে তিনি কৌতুকনকশা ও কমেডি ঢোকান, প্রায়শ যাতে এমন সব যৌন বিষয়-আশয় থাকত, যা শালীনতাবোধে আঘাত দিতে পারে।

৩. চার্লস ওয়াডেল চেসনাট [১৮৫৮-১৯৩২], বহুপ্রজ আফ্রিকান-আমেরিকান লেখক এবং রাজনৈতিক কর্মী ও আইনজীবী। উপন্যাস এবং ছোটগল্পের জন্য বেশি পরিচিত, যাতে তিনি গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী দক্ষিণের জাতিগত ও সামাজিক পরিচয়ের জটিল বিষয়গুলো অনুসন্ধান করেছেন। পল লরেন্স ডানবার [১৮৭২-১৯০৬], আফ্রিকান আমেরিকান কবি, ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার। উপভাষায় কবিতা লেখার জন্য একই সঙ্গে প্রশংসিত এবং নিন্দিত ছিলেন।

৪. হিউজ হার্লেম রেনেসাঁর দিকে ইঙ্গিত করেছেন। গত শতকের কুড়ির দশকে এই সমাজ-সাংস্কৃতিক আন্দোলনটি সংঘটিত হয়, যা আফ্রিকান-আমেরিকান সাহিত্য, সংগীত এবং দৃশ্যশিল্পকে সামনে আনে। এ সময় আফ্রিকান-আমেরিকান শিল্প ও সংস্কৃতি অনেক সাদা চামড়ার লোককেও মুগ্ধ করে এবং তারা এর উত্তেজনাকর নৈশজীবনের অভিজ্ঞতা নিতে হার্লেম ভ্রমণ করেন।

৫. চার্লস গিলপিন [১৮৭৮-১৯৩০], প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান অভিনেতা, যিনি সিরিয়াস অভিনেতা হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেন। গত শতকের বিশের দশকে তিনি ইউজিন ওনীলের সম্রাট জোনস নাটকের মূল চরিত্রে অভিনয় করেন।

৬. এই কাহিনিতে হিউজ হয়তো নিজের কথাই বলেছেন।

৭. চাবুক প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে। এতে আছে অনুকাহিনি, কবিতা এবং নিগূঢ় ইঙ্গিতপূর্ণ নকশার এক মিশ্র বয়ন। শৈলীর দিক থেকে এটি হার্লেম রেনেসাঁর দুর্দান্ত একটি কাজ। তবে যৌনতার খোলামেলা উপস্থাপনা এবং জাতিগত সহিংসতার কারণে এ বই কিছু সমালোচককে আহত করে। জ্যাঁ টুমের [১৮৯৪-১৯৬৭] চাবুককে গণ্য করেন হংসগীতি হিসেবে, যাতে আছে আফ্রিকান-আমেরিকান [আফ্রিকা-আমেরিকা] এবং দক্ষিণ পল্লির সঙ্গে তাঁর নিজের সংঘাতপূর্ণ সম্পর্কের চূড়ান্ত বয়ান। পল রবসন [১৮৯৮-১৯৭৬], বিখ্যাত আফ্রিকান-আমেরিকান গায়ক, অভিনেতা এবং বৈশ্বিক মানবাধিকারের প্রবক্তা।

৮. উইনোল্ড রেইস [১৮৮৮-১৯৫৩], জার্মান শিল্পী। তাঁর আঁকা আফ্রিকান-আমেরিকান পোর্ট্রেট ব্যবহৃত হয়েছে হার্লেম রেনেসাঁর দ্য নিউ নিগ্রো শিরোনামের সংকলনে।

৯. বেসি স্মিথ [১৮৯৪-১৯৩৭], জ্যাজ যুগের আমেরিকান ব্লুজ গায়িকা। ব্লুজ সম্রাজ্ঞী নামে পরিচিত ছিলেন। রুডলফ ফিশার [১৮৯৭-১৯৩৪], হার্লেম রেনেসাঁর সময়ের অগ্রগণ্য আফ্রিকান-আমেরিকান কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। আরোন ডগলাস [১৮৯৮-১৯৭৯], তাঁকে আফ্রিকান-আমেরিকান চিত্রশিল্পীদের পুরোহিত বলে গণ্য করা হতো। তিনি উইনোল্ড রেইসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে চিত্রশিল্পে আফ্রিকান ভাব ও শৈলী গ্রহণ করেন।

অনুবাদ: রায়হান রাইন

সম্পাদকীয় নোট: আমেরিকান লড়াকু কবি ও প্রাবন্ধিক ল্যাংস্টোন হিউজের গদ্যটি ছাপা হয়েছে পোয়েট্রি ফাউন্ডেশনের সৌজন্যে। পড়ুন নিগ্রো শিল্পী এবং জাতিভেদের পাহাড়