ঔপনিবেশবিরোধী কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ পঞ্চাশের দশকের বাংলা কবিতার আদি ও মৌল আধুনিক কবি। ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করেও নিজের কবিতাকে তিনি অধিত বিদ্যার দূষণ থেকে সযত্নে রক্ষা করেছিলেন। তাঁর কবিতা খাঁটি বাংলা কবিতা। ইতিহাসের বাঙালি ও তার কণ্ঠস্বর ধরতে চেষ্টা করেছিলেন তিনি। বাঙালির প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারা-পরিভাষা, লোক উপাদান, বাঙালির অভিন্ন ব্যথা-বেদনা তিনি কালানুগ করে পরিবেশন করেছিলেন। সেদিক থেকে বলা চলে, ব্রিটিশ শাসনোত্তর বাংলা কবিতার তিনিই প্রথম উত্তর-ঔপনিবেশিক কবি, সচেতন বা অবচেতনে। ইংরেজ শাসনের ফলে নিজের জাতের ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছিল, তিনি কবিতা দিয়ে তা কিছুটা ঘুচিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর এই প্রয়াস একটি ভাষার জাতির ইতিহাস-সঞ্জাত সচেতন প্রয়াস বলেই মনে হয়।
আপাতভাবে মানুষের পক্ষে অতীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব না হলেও অতীত মানুষের তৈরি ভাষা ও সংস্কৃতির জগতেই তাকে বাস করতে হয়। একটি ভূখণ্ডে পরস্পর সংবদ্ধ মানুষের পাশাপাশি বসবাসের ধারাবাহিকতায় জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় গড়ে ওঠে। শরীর কাঠামোর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের বাইরে মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি তাকে একই আনন্দ-বেদনার সঙ্গী করে তোলে। কিন্তু সেই জাতির মধ্যে যখন পরদেশি আগ্রাসন ঘটে, তখন আগ্রাসীরা অধিকৃত জাতির ভাষা-সংস্কৃতি ও গর্ব করার সকল অতীত স্মৃতি ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। উপরন্তু ঔপনিবেশিক প্রভুরা তাদের নিজেদের ভাষা সংস্কৃতির আগ্রাসনের মাধ্যমে তাদের কায়েমি স্বার্থ পাকাপোক্ত করতে চায়। ভাষা-সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটলে কোনো জাতি তার পূর্বপুরুষের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলে। উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যের মূল বৈশিষ্ট্য হলো—তার অব্যবহিত অধিকৃত প্রভুদের দ্বারা চর্চিত অবিচ্ছেদ্য ভাষা-সাহিত্যের উত্তরাধিকার অক্ষুণ্ন রেখেও উপনিবেশ-পূর্ববতী নিজ ভূখণ্ডের পূর্বপুরুষকে স্মরণে রাখা। যেটি সম্ভব কেবল তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের কালের ভাষা সংস্কৃতির বিনিময়ের দ্বারা। যেটি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ঠিকঠাকমতো করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়। তাঁর মতো করে এ সময়ে আর কেউ এ ধরনের কবিতা করার ঝুঁকি নেননি। ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যের দ্বারা তাঁর মানস-গঠন হলেও তিনি নিজের জাতিগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা কবিতায় বিধৃত করেছিলেন। পরিবর্তমান কালের প্রলুব্ধ ভাষা চেতনা থেকে তিনি বিরত থাকার কিছুটা ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এটা ঠিক, বিশ শতকের দুইয়ের দশকে জসীমউদ্দীন ও তাঁর অনুসারীদের ভাষা-চেতনা তখনো পূর্ববঙ্গীয় প্রধান জনগোষ্ঠীর অংশ ছিল।
তাঁর অব্যবহিত চল্লিশের দশক ছিল বাংলা কবিতার আদর্শায়নের দশক। দেশ বিভাগের প্রাক্কালে এ দেশের কবিকুল ভেবেছিলেন, দুশ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসানে নিশ্চয় একটি শোষণহীন সমাজ গড়া সম্ভব হবে। অবশ্য সে বাসনা একমুখী ছিল না। কালচালিত বিশ্বাস ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার এতটাই বিপরীতমুখী ছিল যে, সমান্তরাল রেলের মতো তার কখনো মিলন সম্ভব ছিল না। শোনা যায় চল্লিশের কবি ফররুখ আহমদ ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় কিছুদিন একসঙ্গে এক প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছিলেন। পরবর্তীকালে দুজনই চল্লিশের প্রধান কবি হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলেন। দুজনই কবি হিসেবে শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। ফররুখের চিন্তায় ছিল ইসলামি রোমান্টিক সাম্যবাদ, আর সুভাষের বৈজ্ঞানিক মার্কসবাদ। তাঁর আগে তিরিশের বিষ্ণু দে-সহ অনেকের অন্বিষ্ট ছিল মার্কসবাদী জীবনচেতনা। তাঁদের চিন্তার মধ্যে বহু যোজনের পার্থক্য থাকলেও কবিতার গুরু হিসেবে পছন্দ ছিল অবক্ষয়ী এলিয়টের শৈলী-প্রকরণ। কিন্তু আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সে পথে যাননি। সেদিক থেকে কবিতার বিষয় ও আঙ্গিক নির্মাণে তিনি কালের পূর্বসূরিদের কাছে তেমন দায়ী নন। আবার ইংরেজি সাহিত্যের অনুকরণপ্রিয়তার পথও তিনি পরিহার করেছিলেন। এ পথ তাঁর জন্য যতই ঝুঁকিপূর্ণ হোক, বাংলা কবিতার জন্য কিছুটা ছিল নতুন। পূর্বসূরি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর কিছুটা মিল থাকলেও বিষয় ও আদর্শের দিক থেকে ছিল যোজন পার্থক্য। ওবায়দুল্লাহর কবিতার উদ্দেশ্যের কেন্দ্রে না ছিল আদর্শবাদ, না ছিল কেবল কলাকৈবল্যবাদ। তিনি মূলত জনগণের কবিতাকে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ঔপনিবেশিক শাসনের আগে বাংলা কবিতা ছিল মূলত গণের কবিতা। গোষ্ঠী জীবনের আশা আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্নযাত্রা ছিল মূলত কবিতার বিষয়। একটি সমাজে একজন কবিতা লিখতে বা পড়তে জানলেই হলো, অন্যরা সেই কবিতার অংশীদার হয়ে উঠতেন। কারণ, তাদেঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল অভিন্ন। তখনো ব্যক্তি কবি কবিতার বিষয় হয়ে ওঠেনি।
উনিশ শতকের শুরুতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ অনুসৃত যে ভাষা-সাহিত্যের সূচনা হয়েছিল, তিরিশের তথাকথিত পঞ্চপাণ্ডবের ইংরেজি ভাষা-সাহিত্য চর্চার ভেতর তার চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছিল। এটি অস্বীকার করা যাবে না যে, বাঙালির সংস্কৃতি ও ইতিহাসের কাল নির্মাণে তাদের অনীহা ছিল। কিন্তু আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ কাব্যচর্চায় খুব সচেতনভাবে ঔপনিবেশিক ভাষা প্রকরণ থেকে কবিতাকে দূরে রাখতে পেরেছিলেন। একুশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাতনরী হার [১৯৫৫] প্রকাশিত হচ্ছে ভারত বিভাগের মাত্র সাত বছর পরে। তার আগে সতের বছর তিনি ব্রিটিশ শাসনের শেষ পর্বে উত্তাল সময়ের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। আর দুশ বছরের ইংরেজ শাসনের অবসান হতে না হতেই এর মধ্যে শুরু হয়ে গেছে পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্তির আন্দোলন। বিশেষ করে সংখ্যা গরিষ্ঠ বাঙালির ভাষার পরিবর্তে সংখ্যালঘু উর্দু ভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষিত হওয়ায় বাঙালিদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছিল। এই একটি মাত্র ঘটনা বাঙালিরা বুঝতে পেরেছিল, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের দ্বারা বাঙালি জাতীয়তাবাদ অধিকৃত হওয়ার পাঁয়তারা চলছে। এই পরিপ্রেক্ষিতটুকু আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কাব্য আলোচনায় প্রয়োজন বলে বিবেচনা করা যায়। সম্ভবত তিনিই প্রথম সচেতনভাবে কাব্য-সাহিত্যের কাঁধ থেকে ইংরেজি-উর্দুর জোয়াল ফেলে দিতে পেরেছিলেন। ফলে তাঁর কবিতার বিষয়, শৈলী, ভাষা সমকাল ও প্রাক-আধুনিক কালের কবিতা থেকে আলাদা হতে পেরেছিল। তা ছাড়া তাঁর কবিতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হলো, ব্যক্তিগত ব্যথাবেদনা নিরপেক্ষ হয়ে কবিতা লেখার পথে তিনি এগিয়েছিলেন। একুশ বছরের একজন তরুণ কবি ব্যক্তিগত প্রেমবিরহ ও বিচ্ছিন্নতা তাঁর কবিতার বিষয় করে তুলছেন না। একটি ভাষাজাতির নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে তিনি কবিতার বিষয় করে তুলেছেন।
তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তাঁর পূর্ববতীকালের জসীমউদ্দীন, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, করুণানিধান, বন্দে আলী মিয়ার কাব্যশৈলীর অনুগামী কি না। যদিও এতে দোষের কিছু নেই, তবু সত্য হলো, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর পূর্ববতী আধুনিক বাঙালি কবিগণ মূলত শহুরে সভ্যতা থেকে মুক্ত হয়ে গ্রামবাংলার চিরায়ত রূপটি তাঁদের কবিতায় অঙ্কন করার চেষ্টা করেছেন। গ্রামীণ জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, ক্রোধ-রিরংসা, সংগ্রাম ও স্বপ্নযাত্রা কবিতায় তুলে আনতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ওবায়দুল্লাহ সে পথে হাঁটেননি। তিনি সমকালীন কবিদের কাব্যভাষায় প্রলুব্ধ না হয়েও তাঁর কালের কবিতাই লিখতে চেয়েছেন; পরিবর্তিত সময় ধরতে চেয়েছেন। তাঁর সম্বন্ধে সচেতনভাবে এই আলোচনার দরকার হয় যে, ইংরেজি সাহিত্যসংশ্লিষ্ট কবি সাহিত্যিকগণ সাধারণ জনগণের চর্চিত ভাষা থেকে তাদের কবিতাকে কালের প্রপঞ্চ হিসেবে বিচ্ছিন্ন করেছেন। তিনি তা থেকে বিরত ছিলেন। হতে পারে এটিও তাঁর আধুনিক শিক্ষা ও জীবনচেতনার প্রকাশ।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ © ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
কবিতার কাল বিচারে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বিশ শতকের পঞ্চাশ দশকের কবি। রবীন্দ্র-নজরুল উত্তর বাংলার কবিতার তিরিশ ও চল্লিশ দশকের প্রতিভাবান কবিদের দুর্দান্ত বিষয় ও আঙ্গিক উপস্থাপনের পরে নতুন কাব্যভাষা তৈরি খুব সহজ ছিল না, তাঁদের অনুসৃত পথের বাইরে। এমনকি পঞ্চাশের অন্য কবিরাও পূর্ববতী সময়ের কবিদের আঙ্গিকের অনুসৃত পথে কাব্য-জীবন শুরু করেছিলেন। প্রমিত গভীর ও ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের ফিরিস্তি নিয়ে তাঁদের আগমন ঘটেছিল। এ ক্ষেত্রে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ কিছুটা আলাদা। একুশ বছরের দুরন্ত তরুণ, ব্যক্তিগত প্রেম-রিরংসা, ক্ষোভ-হতাশা, তারুণ্যের অঙ্গীকার বাইরে রেখে লোকজ জীবনের আলোকে তার সমকালকে ধরতে চাইলেন, অন্তর্লীন হলেন বাঙালির চিরন্তন বোধের সঙ্গে। তিরিশের দশকের বিচ্ছিন্নতা, বিবিক্ত, বিষণ্ন হতাশার পথে তিনি গেলেন না। ব্যক্তিগত ব্যর্থতা জাতীয় ব্যর্থতার কাছে তুচ্ছ, এবং প্রকৃতপক্ষে মানুষ ইতিহাসের মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ভাষা মূলত সেটিই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চায়। একই সঙ্গে তিরিশের সংগ্রাম ও আশাবাদ, আদর্শ ও মার্কসীয় দর্শনের প্রকাশ থেকেও তিনি সরাসরি বিরত থাকলেন। তিনি ভাষার মধ্যে ধ্বনি তৈরির চেয়ে দ্বিরুক্তি, শ্লেষ, ব্যাজস্তুতির দিকে বেশি ঝুঁকলেন। সেদিক দিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর কিছু দুরান্বয় আছে। আর এ কথা ভুললে চলে না, পঞ্চাশের কবিদের মধ্যে তিনি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের দিক দিয়েও কিছুটা অগ্রণী। বয়সের দিক দিয়ে শামসুর রাহমান বছর পাঁচেকের বড় হয়েও তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে [১৯৬০] প্রকাশিত হলো আরও বছর পাঁচেক পরে, তেমনি আল মাহমুদ ও শহীদ কাদরীর বই বের হতেও লেগে গেল আরও খানিকটা সময়। সেদিক থেকে পঞ্চাশের হয়েও তিনি পঞ্চাশের মূল প্রবণতা থেকে বাইরে থেকে গেলেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরে এক দীর্ঘ বিরতি লক্ষ করা যায় ওবায়দুল্লাহর কবিজীবনে। তত দিন সতীর্থ কবিরা বেশ ডাকাবুকো হয়ে উঠেছেন। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের দাপুটে উপস্থিতি তখন বাংলা কাব্যাঙ্গনে বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু ওবায়দুল্লাহ তাঁর নিজের পথই নতুন করে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। হাসান হাফিজুর রহমান তার চেয়ে বয়সে কিছুটা বড় হলেও বই প্রকাশের দিকে কিছুটা পেছনে ছিলেন। কিন্তু আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সারা জীবনই হাসানের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, বন্ধু হলেও তাঁকে গুরু মেনেছেন, ঋণ স্বীকার করেছেন। যেন হাসান হাফিজুর রহমানই ছিল তাঁর কবিজীবনের জিয়নকাঠি। প্রথম বই প্রকাশের ক্ষেত্রেও তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন বলে বারবার উল্লেখ করেছেন।
সাতনরী হার কাব্যগ্রন্থের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল তার প্রকাশের পরিমিতি বোধ। হাইকুর মতো অল্প কথায় তিনি চিত্রকল্প ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন, ব্যাজস্তুতি করেছেন। আর এটি সম্ভব হয়েছে জাতিগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা থেকে ভাষা আহরণ করা। তার আগে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ‘দুর্ভিক্ষে’র চিত্রায়ণ, ফররুখ আহমদের ‘লাশ’ আমাদের এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। জীবনানন্দ দাশ লেখেন, ‘বাংলার লক্ষ গ্রাম নিরাশায় আলোহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেজ। সূর্য অস্তে চলে গেলে কেমন সুকেশী অন্ধকার। খোঁপা বেঁধে নিতে আসে— কিন্তু কার হাতে? আলুলায়িত হয়ে চেয়ে থাকে—কিন্তু কার তরে? হাত নেই— কোথাও মানুষ নেই; বাংলার লক্ষ গ্রামরাত্রি একদিন/ আল্পনার, পটে ছবির মতো সুহাস্য, পটলচেরা চোখের মানুষী/ হতে পেরেছিল প্রায়, নিভে গেছে সব।’ সাতনরী হার-এর একটি কবিতায় আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লেখেন, ‘একটা ছেঁড়া গামছা ছিল/ তাই দে দিলে ফাঁস/ মরেও মেয়ে দায় ঠেকাল/ ঢাকব কি দে লাশ!’ কিংবা ‘কুচবরণ কন্যে’ কবিতায় লিখছেন, ‘কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে আগুন লেগেছে, পলাশবনে লাল পরীরা নাইতে নেমেছে। কে দেখেছে? কে দেখেছে? কন্যে দেখেছে, নীল দীঘিতে স্বপ্ন হয়ে ভেসে উঠেছে। কে বলেছে? কে বলেছে? শালুক বলেছে, এলো খোঁপা বাঁধতে গিয়ে কন্যে কেঁদেছে। কে শুনেছে? কে শুনেছে? কেউতো শুনেছে, সোনার কাঁকন খুঁজতে মেয়ে জলে ডুবেছে। [কুঁচবরণ কন্যে/ সাতনরী হার]। যে আলোহীনতা হতাশা আমরা জীবনানন্দে দেখতে পাই, ঠিকই একই হতাশা বাংলার লক্ষ গ্রামজুড়ে নেমে এসেছিল ওবায়দুল্লাহর কবিতায়। এর প্রধান কারণ শত শত বছর ধরে ইংরেজের ঔপনিবেশিক শোষণনীতি। সতেরো শ পঁয়ষট্টি সালে ইংরেজ ক্লাইভ দেওয়ানি কেনার পরেই বাংলার ওপর দুর্যোগ নেমে এসেছিল। সৃষ্টি হয়েছিল ভয়াবহ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। বাংলার এক-তৃতীয়াংশ লোকের অকালমৃত্যু এবং দুর্ভিক্ষের পরের বছর কোম্পানির খাজনা বৃদ্ধি পেয়েছিল কয়েক গুণ। ইতিহাসের কুখ্যাত নাজাইকর নামে পরিচিত হয়ে আছে, মৃত মানুষের কর আদায় করা হয়েছিল জীবিতদের কাছ থেকে। অথচ একদিন কুচবরণ কন্যা ছিল, সাতনরী হার ছিল, ছয় বেহারার পালকি ছিল এই বাংলায়।
বাংলা লোকসাহিত্যের দিকে তাকালে আমরা যে সমৃদ্ধ রূপ দেখতে পায়, তা সর্বদা বাধাগ্রস্ত হয়েছে বাইরে থেকে লুটেরা ডাকাততন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়। অবশ্য সকল লুটেরার চরিত্র এক—দেশি কিংবা বিদেশি। তবে এ দেশের দুর্যোগও প্রধান কারণ ছিল বর্গীদের হানা, ইংরেজের শোষণ, পাকিস্তানি বৈষম্যের নীতি। ওবায়দুল্লাহ সাতনরী হার কাব্যগ্রন্থে মূলত লোক-সাহিত্যের ভাণ্ডারের সঙ্গে সমকালীন চিত্র তুলে ধরেছেন। এই কাব্যগ্রন্থেই স্থান পেয়েছে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা ‘মাগো, ওরা বলে’র মতো কবিতা। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এটি বাঙালি কবিদের রচিত সর্বকালের কেজো কবিতার অন্যতম সেরা। গ্রাম থেকে এক তরুণ পড়তে এসেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, মা তার প্রতীক্ষায় জেগে আছে প্রহর। ছেলে ছুটিতে বাড়ি ফিরে আসবে, তাই মা ডালের বড়ি, নারকেলের চিড়ে, উড়কি ধানের মুড়কি ভেজে অপেক্ষা করছেন। কুমড়ো ফুল, পুঁইয়ের মাচা—ভোরের শিশির এক টুকরো রোদ, আর মায়ের কথার ফুলঝুরি দিয়ে বাংলার প্রকৃতি ও বাংলার মায়ের এক নিখুঁত চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন। কিন্তু খোকার আর বাড়ি ফেরা হয় না। চিরায়ত বাংলার মা ও ছেলের এই সামান্য গল্প দিয়ে অসামান্য বাংলাকে নির্মাণ করেছেন তিনি। বাংলা ভাষা আন্দোলনের যে শ্রেণিচেতনা এই কবিতার মধ্যে উঠে এসেছে, তা আব্দুল হাকিমের পরে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত। কারণ, একটি ব্যক্তিগত গল্পের সঙ্গে চিরন্তন বাংলার আনন্দ বিষাদ একাকার হয়ে গেছে। তাতে কি, ব্রিটিশ গিয়ে পাকিস্তান এসেছে, পাকিস্তান গিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু এ দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে খুব সামান্যই। যখন তিনি স্বৈরশাসকের দরবারে, তখন লিখছেন ‘প্রভু যায় প্রভু আসে’। সকলেই আশ্বাস দেয়, এবার দুঃখ ঘুচবে; ঘোচে না। ‘সকলেই আমাদের রোঁয়া ওঠা দেয়ালে চাঁদ আঁকে। অভিষেক উৎসবে আমাদের ডাক পড়ে, আমরা যে অনুজপ্রতিম। তারপর আমরা জনতা। মৃত্যুতে, রোগে শোকে তাপে, দুর্যোগে নূহুর প্লাবনে, গতকাল এই মাত্র হাজার বছর ধরে আমরা জনতা, উলঙ্গ ক্ষুধার্ত পূতিগন্ধময়।’ এই হলো বাংলার হাজার বছরের গল্প।
কিন্তু আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ হতাশার কাছে থেমে যাননি। বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা করেছেন। কিংবদন্তির কথা বলেছেন, স্বপ্নে কথা বলেছেন। এক পেশিবহুল শ্রম ও সংগ্রামী মানুষের পুনরুজ্জীবনের স্বপ্ন দেখেছেন। বাঙালির আদি পুরুষ হয়তো সব সময় স্বাধীন ছিল না, কিন্তু স্বাধীনতার স্বপ্ন সে ত্যাগও করেনি। কবিতা ও বেঁচে থাকার স্বপ্নকে একই সমান্তরালে নির্মাণ করেছেন ওবায়দুল্লাহ। সত্যিকারেই এই কবিতা একটি জাতিগোষ্ঠীর স্বপ্নযাত্রার স্মারক হয়ে উঠেছে। এই কবিতা বাঙালির অভয়মন্ত্র। তিনি এই কবিতায় কিংবদন্তির কথা বলেছেন, পূর্বপুরুষের কথা বলেছেন, পলিমাটির সৌরভের কথা বলেছেন, শৃঙ্খল ও শৃঙ্খলমুক্তির কথা বলেছেন, জলোচ্ছ্বাসের মতো অভ্যুত্থানের কথা বলেছেন। রাজশক্তি যখন বাংলার ওপরে আঘাত হেনেছে, তখন প্রাচীন সঙ্গীতের মতো এ জাতি কীভাবে ঋজু ও সংহত হয়েছে, তার চিত্র তিনি অঙ্কন করেছেন। এই কবিতাদ্বয়ের মধ্যে তিনি শব্দের শক্তিমত্তা অনুভব করতে চেয়েছেন। এই কবিতা নিশ্চয় বাংলা কবিতার ইতিহাসে একটি সূচনাবিন্দু হয়ে থাকবে।
‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি/ আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।/ তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিলো/ তাঁর পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিলো।/ তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন/ অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন/ তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।/ জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা/ কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।’ একই সঙ্গে কবিতা, বিদ্রোহ, স্বপ্ন, ব্যক্তি ও জাতিগত উদ্বোধন এই কবিতায় ধরা পড়েছে। পঞ্চাশের বাংলা কবিতা মূলত বাংলাদেশের নিজস্ব কবিতার সূচনাপর্বে। এই দশকে যেমন শক্তিশালী কবিদের আবির্ভাব হয়েছে, তেমন নতুন নতুন কবিতা রচনা করে বাংলা কবিতার শূন্য ভাঁড়ার পূর্ণ করা হয়েছে। তিরিশ ও চল্লিশ দশকের বাংলা কবিতার উপনিবেশনির্ভরতা পাশ কাটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্বের কবিতায় রূপ দেওয়া হয়েছে। এই রূপকারদের মধ্যে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ অন্যতম প্রধান। যদিও মৃত্যুর মাত্র দুই দশকের মধ্যে এই কবি বিস্মৃতির তালিকায় চলে যাচ্ছেন। তাঁর কবিতা থেকে ধার করে বলা যায়, যে তাঁর কবিতা শুনবে না ‘সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।’ যে তাঁর কবিতা শুনবে না, ‘সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।’
পক্ষপাত মুক্ত নান্দনিক বয়ান বিশ্লেষণ। যে পড়ার সে কিন্তু ঠিকই পড়ছে। দেশের সর্বত্র আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতা বৃন্দ ও একক আবৃত্তি বার বার হয়েছে এখনও হচ্ছে--
গাজী লতিফ
ডিসেম্বর ০২, ২০২১ ১৩:৫৬