ঢাকায় শওকত ওসমানের ‘প্রগতিশীল’ পাঠ

 

শওকত ওসমান [১৯১৭-১৯৯৮] নামটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথেই ‘প্রগতিশীল’ নামক একটা তকমা বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। যেন শওকত ওসমান ও প্রগতিশীল শব্দ দুটি সমার্থক। কেন ও কীভাবে এই ঘটনা এক সিদ্ধরসে পরিণত হয়েছে, তার কুলঠিকুজির আভাস দেওয়াই এই লেখার উদ্দেশ্য।

প্রথমে শওকত ওসমানের কাজের চৌহদ্দির একটা উল্লেখমূলক খোঁজ নিয়ে আসা যেতে পারে। মৌলিক ও অনুবাদ মিলিয়ে শওকত ওসমান [১৯১৭-১৯৯৮]-এর মোট বইয়ের সংখ্যা আটষট্টি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, রম্য রচনা, এমনকি কবিতা। এত কিছু সত্ত্বেও তাঁর ঔপন্যাসিক সত্তা এবং গল্পকার সত্তাই সাহিত্যিক মহলে বেশি সমাদৃত এবং প্রশংসিত হয়েছে। তিনি গ্রামীণ জীবনের পটভূমিতে লিখেছেন বনী আদম [১৯৪৬] এবং জননী [১৯৫৮]-এর মতো উপন্যাস। লিখেছেন ক্রীতদাসের হাসি [১৯৬২], চৌরসন্ধি [১৯৬৬], সমাগম [১৯৬৮] এবং রাজা উপাখ্যান [১৯৭০]-এর মতো রূপক-ফ্যান্টাসিধর্মী উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস লিখেছেন চারটি—জাহান্নম হইতে বিদায় [১৯৭১], দুই সৈনিক [১৯৭৩], নেকড়ে অরণ্য [১৯৭৩] এবং জলাংগী [১৯৭৪]। আর শেষ দিকে লিখেছেন রাজসাক্ষী [১৯৮৩], পতঙ্গ পিঞ্জর [১৯৮৩], আর্তনাদ [১৯৮৫], পিতৃপুরুষের পাপ [১৯৮৬] এবং রাজপুরুষ [১৯৯২] উপন্যাস। এর সঙ্গে সঙ্গে চলেছে জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প [১৩৫৮], পিঁজরাপোল [১৩৫৮], প্রস্তর ফলক [১৯৬৪], উভশৃঙ্গ [১৩৭৫], জন্ম যদি তব বঙ্গে [১৯৮৪], ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী [১৯৯০]-এর মতো গল্পগ্রন্থের রচনা। এরই মধ্যে রচনা করেছেন সংস্কৃতির চড়াই উৎরাই [১৯৮৫], ইতিহাসে বিস্তারিত [১৯৮৫], মুসলিম মানসের রূপান্তর [১৯৮৬], পূর্ণ স্বাধীনতা চূর্ণ স্বাধীনতা [১৯৯০] ইত্যাদি প্রবন্ধগ্রন্থ; লিখেছেন নাটকও। এ ছাড়া বাকি ছিল শুধু কবিতা লেখা। তা-ও তিনি লিখলেন নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত [১৯৮২]।

এক

শওকত ওসমানের সমগ্র সাহিত্যকর্মের প্রবণতা লক্ষ করলে একথা নিঃসন্দেহে বলা যাবে যে, তিনি শিল্পের জন্য শিল্প [Art for Arts’ shake] চর্চা করেননি। নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত গ্রন্থে তিনি নিজেকে ‘ঝাড়ুদার গ্রন্থকার’ বলে উল্লেখ করেছেন। শওকত-চৈতন্যের এই দিকটি সমালোচকদেরও দৃষ্টি এড়ায়নি। হুমায়ুন আজাদ মন্তব্য করেছেন—‘নান্দনিক সৌন্দর্যকে তিনি অবহেলা করেছেন অনেক সময় জীবনের জন্যে, স্থূলতাকে আক্রমণ করেছেন স্থূলতা দিয়ে। বিনোদনে তাঁর উৎসাহ ছিলো না, তাই তাঁর রচনাবলি বিনোদনমূলক নয়।’ [হুমায়ুন ২০০৯ : ৬৬]

তবে প্রশ্ন ওঠে, শওকত ওসমান তাঁর যাবতীয় সাহিত্যকর্মে জীবন-জগতের যে-আবিষ্কৃত রূপ-কাঠামোটি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, তার ধরনটি কেমন? এর উত্তরে একবাক্যে বলা যায়—তিনি উদার মানবিকতা, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতায় আস্থাশীল ছিলেন। সমস্ত প্রকার আধিপত্যবাদ, ধর্মান্ধতা আর অন্ধকারের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। তাঁর শিল্প-সাহিত্য এসব চিন্তারই আকর। এর প্রমাণ পাওয়া যাবে তাঁর যেকোনো সাহিত্যকর্মে—তা সে সৃজনশীল সাহিত্যকর্মই হোক আর মননশীল সাহিত্যকর্মই হোক। সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম থেকেই একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। সেখানে তিনি প্রথাগত গোঁড়া ধার্মিকদের সম্পর্কে বলেছেন—

ধার্মিকদের মন হয় একরোখা। ওরা নিজেদের নাক বরাবর যা দেখে তার বেশি আর কিছু চোখে নিতে পারে না। এই জন্যে একই ধর্মের মধ্যে কত উপদল দেখেন না? নিছক শাস্ত্রের বুলি তাই এ যুগে অচল! কারণ তার প্রয়োগ ক্ষমতা কবেই নিঃশেষ হয়ে গেছে। ধর্মের নামে অধর্মের খেলাই তাই এত বেশি ।...বিজ্ঞানে হয়ত একই সময়ে দুই থিয়োরি চালু থাকে, যত দিন তার চেয়ে ভালো তত্ত্ব না পাওয়া যায়। অর্থাৎ দুইয়ের ফসল ফলতে দেওয়া হয়, তারপর ফসল দেখে বিচার। কিন্তু ধর্মের ক্ষেত্রে তা হয় না। সেখানে এক জঙ্গলে এক বাঘ—এই নীতি চালু। ফলে, ধর্মের ক্ষেত্রে হিংস্রতা আরো ভয়ানকভাবে দেখা দেয়। কারণ সেখানে সহনশীলতার কোনো জায়গা নেই, যদিও কেতাবে থাকে। [শওকত ২০০১ : ১০১/২]

এই হচ্ছেন শওকত ওসমান। উদ্ধৃতিটি তাঁর সমাগম উপন্যাস থেকে নেওয়া হয়েছে। ভাবতে একটু বেগ পেতে হয় যে, এটি কোনো উপন্যাসের উদ্ধৃতি। কিন্তু শওকত ওসমান এভাবে প্রতিটি উপন্যাসেই কোনো না কোনো চরিত্রের বয়ানে অথবা ঔপন্যাসিকের বিশেষ ক্ষমতাবলে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর নিজস্ব কেজো চিন্তার উদ্দেশ্যমূলক প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এর কারণ বোধ হয় তাঁর উপযোগবাদী সাহিত্যচিন্তার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। যাহোক, ওপরের উদ্ধৃতির মতো অসংখ্য উদ্ধৃতি দেওয়া যাবে শওকত ওসমানের প্রবন্ধ ও অন্যান্য সাহিত্যকর্ম থেকে। কিন্তু উপন্যাস থেকে যখন এ রকম অসংখ্য উদাহরণের সুযোগ থাকে, তখন শওকত ওসমানের জীবনদৃষ্টি আর শিল্পবিশ্বাস সম্পর্কে আর বুঝতে বাকি থাকে না।

প্রকৃতপক্ষে, শওকত ওসমানের লেখকসত্তা বেড়ে উঠেছিল দেশ এবং কালের এমন একটি পরিস্থিতি ও প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে, যেখানে তাঁকে দেখতে ও মোকাবিলা করতে হয়েছে ধর্মান্ধতা, অজ্ঞতা, সাম্প্রদায়িকতা, দাঙ্গা, রাষ্ট্রীয় দমন-নিপীড়ন-অবরুদ্ধতা, যুদ্ধ, স্বৈরশাসন ইত্যাদি। একথা তাঁর কলকাতা জীবনের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি তাঁর দেশ বিভাগ-পরবর্তী পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রে অতিবাহিত করা জীবনের অধিকাংশ সময় সম্পর্কেও সত্য। এ কারণে শওকত ওসমানের যেকোনো সাহিত্যকর্মই একধরনের ‘সংগ্রামী’ সাহিত্যকর্ম। এই সংগ্রাম ধর্ম [নাকি ধর্মান্ধতা!], অজ্ঞতা, সাম্প্রদায়িকতা, দাঙ্গা, রাষ্ট্রীয় দমন-নিপীড়ন-অবরুদ্ধতা, যুদ্ধ, স্বৈরশাসন ইত্যাদির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। স্বদেশ ও স্বকালের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে তাঁর সাহিত্যকর্ম শাসিত এবং শাণিত।

বিষয়টি দেখার জন্য উঁকি দেওয়া যেতে পারে শওকত ওসমানের উপন্যাসগুলোর ভেতরবাড়িতে। তাঁর প্রথম দুটি উপন্যাস—বনী আদমজননী—রচনা শুরু হয় পশ্চিম বাংলায় তাঁর স্থায়ী বসবাসের সময়। এর মধ্যে ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের ফলে তিনি চলে আসেন বর্তমান বাংলাদেশে। এখানে এসে অসমাপ্ত উপন্যাস দুটি সমাপ্ত করেন। অধিকাংশ সমালোচক প্রথম পর্বে রচিত বনী আদমজননী সম্পর্কে বলে থাকেন যে, এ দুটি উপন্যাসে শওকত ওসমান সমকালের অর্থাৎ ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের বাংলার রাজনৈতিক ভাঙা-গড়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিখাদ পল্লির জনজীবনের আলেখ্য নির্মাণ করেছেন। কিন্তু একটু গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, সেখানেও পরবর্তীকালের শওকত ওসমানের মানস-প্রবণতাটি অন্তর্লীন প্রবাহের মতো প্রবহমান এবং তা তাঁর সমকালীন অর্থাৎ বনী আদমজননী উপন্যাসে বিধৃত সময়ের রাজনৈতিক প্রধান ঘটনাধারার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত।

অবিভক্ত বাংলার বিশ, ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের রাজনৈতিক ঘটনাধারার ওপর চোখ রাখলে মোটা দাগে সহজেই যা চোখে পড়ে তা হচ্ছে, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম এবং হিন্দু-মুসলমানের পরস্পর থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং তজ্জনিত দাঙ্গার ইতিহাস। শওকত ওসমান এ বিষয়ে বিশেষত, সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প সম্পর্কে ছিলেন সম্পূর্ণ সজাগ। তার প্রতিফলন দেখা যায় জননী উপন্যাসে। উপন্যাসের একটা বড় স্থান দখল করে আছে হিন্দু রোহিনী চৌধুরী আর মুসলমান হাতেম বখশের দ্বন্দ্ব। উপন্যাসের এই সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব যে ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিরই [নাকি অর্থনৈতিকও!] রূপক-বাস্তবতা—এটি সহজেই বোঝা যায়। আর শওকত ওসমান উপন্যাসের এই দ্বন্দ্বের মীমাংসা করেছেন জননী উপন্যাসের চন্দ্র কোটাল চরিত্রের মাধ্যমে। এই চন্দ্র কোটাল চরিত্রটি উপন্যাসে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত চরিত্র। তার প্রভাবেই অন্য চরিত্রও উপন্যাসের মধ্যে বলে উঠেছে ‘হিন্দু-মুসলমান, ঝগড়া। নিকুচি করি ঝগড়ার, কি-সব বাজে কথা’। [শওকত ২০০১ : ২৬৭/১] আবার চন্দ্র কোটালও বলেছে ‘...রোহিনী-হাতেম বখ্শ ঐ শালারা যাক, তবে না দুঃখ যাবে’। [শওকত ২০০১ : ২৭৯/১] ফলে, দেখা যায়, শওকত ওসমান প্রথমাবধি সমকাল-সচেতন। স্বকালের এবং স্বদেশের বেদনার জায়গাটিতে তিনি হাত দিতে ভুল করেননি কখনো। আবার তাঁর দ্বিতীয় পর্বের ক্রীতদাসের হাসি, চৌরসন্ধি, সমাগম এবং রাজা উপাখ্যান উপন্যাসেও রূপক-ফ্যান্টাসির মোড়কে স্বকাল-স্বদেশ কথা বলে উঠল। এসব উপন্যাসে তিনি ব্যক্তির অবরুদ্ধতা, রাষ্ট্রের অবরুদ্ধতা, সমস্ত প্রকার আধিপত্য, অমানবিকতা, অন্ধ-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানটি জারি রাখলেন। আবার তৃতীয় পর্বে গিয়ে রচনা করলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ইতহাস মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চারটি উপন্যাস—জাহান্নম হইতে বিদায়, দুই সৈনিক, নেকড়ে অরণ্য এবং জলাংগী। আবার চতুর্থ পর্বে গিয়ে রচনা করলেন স্বৈরাচারী অবরুদ্ধতার বিরুদ্ধে যূথবদ্ধ চেতনাজাগানিয়া উপন্যাস পতঙ্গ পিঞ্জর এবং আর্তনাদ। এর মাঝে ষাটের দশকে স্বৈরশাসনবিরোধী চেতনাসমৃদ্ধ দারুণ দারুণ সব গল্প লিখলেন। প্রস্তর ফলক গল্গগ্রন্থের প্রায় প্রতিটি গল্পে প্রস্তরিত হয়ে আছে পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে রূপকী প্রতিবাদ। এই হচ্ছে সৃষ্টিশীল শওকত ওসমানের সৃষ্টিজগতের স্বরূপ। এই জগৎকেই তিনি পাঠকদের সামনে উন্মোচন করতে চেয়েছেন; প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন বাংলাদেশের সাহিত্যে শওকতের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব। মনে রাখা দরকার, স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত শওকত ওসমানের যে সৃজনজগৎ সেখানে তিনি শিল্পের দাবিকে যতটা পারা যায় মিটিয়েই তাঁর চেতনার জগৎকে মেলে ধরার চেষ্টা করেছেন।  

ওপরের আলোচনায় শওকত ওসমানের যে-চৈতন্যটি ধরা পড়েছে, তাকে ঢাকার মানুষেরা নাম দিয়েছেন ‘প্রগতিশীলতা’। কথা একরকম সত্য। কারণ, এখানে প্রগতিশীলতা প্রত্যয়টি ধর্ম, সাম্প্রদায়িক বোধের বাইনারি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ঢাকার প্রগতিশীল-চিন্তা ধর্মের সার ও জাত-সম্প্রদায়গততাকে তার প্রগতিশীলতার মধ্যে আঁটিয়ে উঠতে পারে নাই বা এগুলোকে যথাযথভাবে মোকাবিলাও করতে পারে নাই; চায়ও নাই। শুধু তা-ই নয়, ঢাকার প্রগতিশীলতার জনবিমুখ, বিচ্ছিন্ন একটা শ্রেণিচরিত্রও চোখ এড়িয়ে যায় না। ঠিক অনেকটা ঔপনিবেশিক শক্তির কোলে লালিতপালিত ঊনবিংশ শতাব্দীর ‘রেনেসাঁসের’ মতোই; নির্মমভাবে কোটারিভিত্তিক এবং ‘এলিটভাবাপন্ন’। শওকত ওসমানও একই ধারায় হেঁটেছেন। ফলে শওকত ওসমানের প্রগতিশীলতার বোধ ঢাকার প্রগতিশীলতার সঙ্গে দারুণভাবে মিলেমিশে গেছে। এ কারণে শওকত ওসমান ঢাকার আরাধ্য হয়ে উঠেছেন। এর প্রমাণ নিহিত আছে ঢাকায় শওকত ওসমানের মূল্যায়নের মধ্যে। নজর রাখা যাক ঢাকায় শওকত ওসমানের মূল্যায়নের একটা রূপরেখার ওপর।

প্রস্তর ফলক গল্গগ্রন্থের প্রায় প্রতিটি গল্পে প্রস্তরিত হয়ে আছে পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে রূপকী প্রতিবাদ। এই হচ্ছে সৃষ্টিশীল শওকত ওসমানের সৃষ্টিজগতের স্বরূপ। এই জগৎকেই তিনি পাঠকদের সামনে উন্মোচন করতে চেয়েছেন; প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন বাংলাদেশের সাহিত্যে শওকতের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব। মনে রাখা দরকার, স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত শওকত ওসমানের যে সৃজনজগৎ সেখানে তিনি শিল্পের দাবিকে যতটা পারা যায় মিটিয়েই তাঁর চেতনার জগৎকে মেলে ধরার চেষ্টা করেছেন...

দুই

আমরা শওকত ওসমানের চার ধরনের প্রচলিত মূল্যায়নের দিকে দৃষ্টি রাখতে চাই। এক, রাষ্ট্রীয় মূল্যায়ন; দুই, সাহিত্য-সংস্কৃতিজগতের মানুষের মূল্যায়ন; তিন, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের মূল্যায়ন; চার, একাডেমিক বা সাহিত্য-নন্দনতাত্ত্বিক মূল্যায়ন। এই মূল্যায়নের মধ্য দিয়েই শওকত ওসমানের ঢাকাই পাঠ বা ঢাকায় তাঁর গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠিটিকে আমরা আমাদের বুঝের আওতায় নিয়ে আসতে পারব।

শওকত ওসমান মৃত্যুবরণ করেন ১৯৯৮ সালের ১৪ মে। এর আগে ২৯ মার্চ তিনি অসুস্থ হয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হন। যেদিন তিনি ভর্তি হন, সেদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এক মিটিংয়ে ছিলেন। খবর পেয়ে তিনি তাঁর রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করে ছুটে যান শওকত ওসমানকে দেখতে। সেখানে তাঁর সুচিকিৎসার নির্দেশ দিয়ে আসেন। প্রয়োজনে তাঁকে বিদেশে পাঠাতে বলেন। দুঃখজনকভাবে সে-যাত্রায় শওকত ওসমান আর সুস্থ হননি। হাসপাতালে ভর্তির ষোলো দিন পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, রাজনৈতিক ও সাহিত্যজগতের নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন সংগঠন, টিভি, রেডিও সংবাদপত্রসমূহের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ...আন্তরিকভাবে শোকবাণী ও শোক প্রচার করেছেন।’ [ইয়াফেস ২০০৮ : ২৫২] এই হচ্ছে শওকত ওসমানের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়ন। রাষ্ট্র শওকত ওসমানকে যে গুরুত্ব দিয়েছে, তা চোখে পড়ার মতো। এটি কি কেবল শওকত ওসমানের সৃজনশীল লেখকসত্তার মূল্যায়ন? তা তো বটেই। কিন্তু আরও কারণ আছে। এর সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত শ্রেণির রাজনৈতিক চেতনার রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এই রাজনৈতিক শ্রেণির চেতনার সঙ্গে শওকত ওসমানের চেতনার মিলের খোলা দরজা দিয়েই শওকত ওসমানের প্রতি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ আচরণ প্রবেশ করেছে। সাযুজ্যপূর্ণ এই চেতনার নাম দেওয়া যায় প্রগতিশীল চেতনা।

সাংস্কৃতিক এবং কিছুটা সাহিত্যিক মূল্যায়ন বোঝার জন্য নিচে শওকত ওসমানের মৃত্যু-পরবর্তী কয়েকজন বিখ্যাত সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তির মূল্যায়ন দেখে নেওয়া যেতে পারে— 


১. ...একালের তৃতীয় বিশ্বের বাসিন্দা হিসেবে শওকত ওসমানকে ব্যাপৃত থাকতে হয়েছে মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। বারবার শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে, নান্দনিকতা বর্জিত প্রচুর নিবন্ধ এবং শেখের সম্বরা জাতীয় লেখা লিখতে হয়েছে, জনসাধারণের ঘুমিয়ে পড়া চেতনাকে জাগিয়ে তোলার জন্য। [শামসুর ২০০৮ : ১৬৬]
২. তিনি আমাদেরি একান্ত শওকত ভাই, স্বয়ং যিনি সৎসাহস-দুঃসাহস, স্বৈরাচারের মৌলবাদের প্রতিবাদী সৈনিক; আদম সন্তানের অগ্রাভিযানের তূর্যবাদক। [মুস্তাফা ২০০৮ : ১৪১]
৩. আজকের বাংলাদেশ যখন ভেতরে বাইরে বিরুদ্ধবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত, তার অলংকারগুলো চুরি হচ্ছে ক্রমে-ক্রমে এমনকি অন্তর্গতভাবে তার চরিত্র হননের মাধ্যমে ইতিহাস-শ্রেষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধকে আঘাত করা হচ্ছে, অবিরল, এমন দুঃসময়ে শওকত ওসমানের কলম বারংবার রুখে দাঁড়াচ্ছে আপামর জনতার স্বপক্ষে। ...বাংলাদেশের জন্ম, দুঃশাসন, বিপ্লবে রাজরোষে অবিচল ন্যায়-প্রতিজ্ঞ শওকত ওসমান আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। [অজয় ২০০৮ : ২২০]
৪. ...রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাঁর প্রগতিশীল এবং সাহসী ভূমিকা ছিল সবার জন্যে উজ্জীবক এবং অনুকরণীয়। নিজের মতাদর্শ থেকে সরেননি কখনো। মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, অপসংস্কৃতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে তিনি আজীবন লড়াই করে গেছেন। সোচ্চার ছিলেন চিরকাল এসব নির্মূলের আন্দোলনে। [রফিকুন ২০০৮ : ১৮৪]
৫. বিভিন্ন জায়গায় সভাসমিতিতে দেখা হতো। ঐ সময়টা তো আন্দোলনের কাল ছিলো। অর্থাৎ এরশাদের অবৈধ ক্ষমতা দখল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। ...এ সময়টিতে তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছিলেন। সিভিল সমাজের বিভিন্ন সমাবেশে নিয়মিত যোগ দিচ্ছিলেন। ...এমন কোনো দিন যায়নি, যেদিন তিনি ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করেননি। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতায় ছিলেন তিনি নিবেদিত প্রাণ। [মুনতাসীর ২০০৮ : ২১২-২১৩]


এটি শওকত ওসমান সম্পর্কে ঢাকার সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মূল্যায়ন। লক্ষণীয় যে, এর প্রতিটি বিবেচনার মধ্যে একটা মূলগত ঐক্য রয়েছে। প্রায় প্রতিটি মূল্যায়নই প্রচলিত প্রগতিশীলতা এবং সাংগঠনিক তৎপরতাভিত্তিক। অর্থাৎ শওকত ওসমান সম্পর্কে এঁরা যে রিডিং বা পাঠ দিচ্ছেন, সেখানে শওকত ওসমানের প্রগতিশীল চিন্তাচেতনা ও প্রগতিশীলতার সঙ্গে জড়িত সাংগঠনিক তৎপরতাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বলা দরকার, এই পাঠের সঙ্গে সম্ভবত পূর্বোক্ত রাষ্ট্রীয় পাঠের মিল অলক্ষ্য নয়। দুটি পাঠই মূলত একই পাঠের এপিঠ-ওপিঠ। রাষ্ট্র যে কারণে শওকত ওসমানের অসুস্থতা এবং মৃত্যুজনিত ক্ষতিকে গুরুত্ব দিয়েছিল, সেই একই কারণে শামসুর রাহমান, অজয় দাশগুপ্ত, মুনতাসীর মামুন প্রমুখ শওকত ওসমানকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।

এবার শওকত ওসমানের কিছু একাডেমিক-তাত্ত্বিক মূল্যায়ন দেখা যেতে পারে। আগেই বলা হয়েছে যে, মৌলিক এবং অনুবাদ মিলিয়ে শওকতের বইয়ের সংখ্যা আটষট্টি। কিন্তু একাডেমিক সাহিত্য সমালোচনায় তাঁর দুটি রচনা সবচেয়ে বেশি উল্লেখিত হয়ে থাকে। এ দুটি রচনা হচ্ছে জননী এবং ক্রীতদাসের হাসি। একজন সৃজনশীল মানুষের দুটি গ্রন্থ তাঁর সৃজনশীলতার ইতিহাসে অমর হয়ে থাকার জন্য যে যথেষ্ট, সে দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যে এবং বিশ্বসাহিত্যে বিরল নয়। যাহোক, বাংলাদেশের উপন্যাসের ইতিহাস এবং বাঙালি মুসলমানের উপন্যাস-প্রয়াসের কথা মাথায় রেখে বলা হয়ে থাকে, জননী শওকত ওসমানের শুধু নয়, সমগ্র বাংলাদেশের সাহিত্যে এক মহৎ সাহিত্যকর্ম। কিন্তু দেশ-কাল-গোষ্ঠীর ঊর্ধ্বে উঠে উপন্যাসকে শিল্প হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে হাসান আজিজুল হক যে মন্তব্য করেছেন, তা বোধ করি যথার্থ সাহিত্যিক মূল্যায়ন বলে বিবেচিত হতে পারে। তাঁর মতে, ‘সাধারণভাবে উপন্যাস সাহিত্যের কথা ভাবলে জননীকে মহৎ উপন্যাস বলা যাবে না। কিন্তু সীমিত পরিসরে উপন্যাসটির সার্থকতা অপরিসীম।’ [হাসান আজিজুল ১৯৯৪ : ১৭] অন্যদিকে ক্রীতদাসের হাসি সম্পর্কে অধিকাংশ সমালোচকই প্রায় একমত যে, ‘এটি একটি নিটোল শিল্পকর্ম, যাকে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে জীবনের বিশুদ্ধ শিল্পরূপ হিসেবে ভোগ করা যায়।’ [হুমায়ুন ২০০৯ : ৭০] জননী ক্রীতদাসের হাসি এই দুটি উপন্যাসের মধ্যে আবার ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসটির কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতি এবং সাহিত্যকর্ম হিসেবে গুরুত্বের মূলে এর শিল্পগুণ ও আঙ্গিক স্বাতন্ত্র্য যতটা না ক্রিয়াশীল, তার চেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল এর পাকিস্তানি স্বৈরশাসনবিরোধী বিষয়। ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসের এই পাঠ পূর্বোক্ত প্রগতিপন্থী শওকত ওসমান-পাঠের সঙ্গে দারুণভাবে মিলে যায়। কারণ, এই পাঠে ক্রীতদাসের হাসি প্রগতিশীলতার রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের নির্মাণ এবং পাঠের সঙ্গে মিলমিশ খেয়ে একাকার হয়ে যায়।

মৌলিক এবং অনুবাদ মিলিয়ে শওকতের বইয়ের সংখ্যা আটষট্টি। কিন্তু একাডেমিক সাহিত্য সমালোচনায় তাঁর দুটি রচনা সবচেয়ে বেশি উল্লেখিত হয়ে থাকে। এ দুটি রচনা হচ্ছে জননী এবং ক্রীতদাসের হাসি। একজন সৃজনশীল মানুষের দুটি গ্রন্থ তাঁর সৃজনশীলতার ইতিহাসে অমর হয়ে থাকার জন্য যে যথেষ্ট, সে দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যে এবং বিশ্বসাহিত্যে বিরল নয়...

তিন

শওকত ওসমানের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একাডেমিক পাঠ খুব কমই হয়েছে। অধিকাংশ পাঠই মূলত ওই প্রগতিশীলতার পাঠ। এই যে শিল্পীসত্তাকে ছাপিয়ে প্রগতিশীল সত্তা প্রধান হয়ে ওঠা, এর কারণ কি কেবল শওকত ওসমানের সাহিত্যকর্মের মধ্যকার প্রগতিশীল জীবনচেতনার রূপায়ণের কারণে হয়েছে? সাহিত্য নিশ্চয়ই একটা বড় কারণ। কিন্তু মূল কারণটি বোধ করি অন্য জায়গার মধ্যে নিহিত।

তাঁর রচনাবলি হয়তো শিল্পসাহিত্যের সঙ্গে জড়িত ‘শিক্ষিত সাহিত্যিক-এলিট শ্রেণি’র মধ্যে প্রগতিশীল শওকত ওসমানের হেজিমনি তৈরি করতে সাহায্য করেছে। তাঁর সাহিত্যকর্ম হয়তো প্রগতিশীল-শওকত-হেজিমনি উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু তাঁর প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রাম এবং আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকার বাস্তবতা খুব ছোট কারণ হিসেবে কাজ করেছে—এমন মনে হয় না। কথাটা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। এর প্রমাণ আমাদের উল্লিখিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের শওকত মূল্যায়নের মধ্যে ফুটে উঠেছে। সেখানে আমরা লক্ষ করেছি যে, তাঁরা শওকত ওসমানকে প্রগতিশীলতার বাইরে দেখেননি; কেউই নন। তাই-ই হয়তো দেখার কথা। কিন্তু খুবই লক্ষণীয় যে, তাঁরা কেউ-ই শওকত ওসমানের শিল্পীসত্তা নিয়ে কোনো উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেননি। অর্থাৎ তাঁদের কাছে শওকত ওসমানের শিল্পীসত্তাকে ছাপিয়ে গিয়েছে তাঁর প্রগতিশীল সত্তা এবং প্রগতিশীল বলে খ্যাত ঢাকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক-সাংগঠনিকভাবে শওকতের যুক্ত থাকার অনুষঙ্গ-ইতিহাস।

শওকত ওসমান যেমন একজন সৃজনশীল সাহিত্যিক ছিলেন, তেমনি ছিলেন একজন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মী। কারণ, সৃজনশীল সাহিত্য রচনার পাশাপাশি তিনি প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধশক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে সাপ্তাহিক-দৈনিক পত্রিকার পাতার পর পাতা এবং গ্রন্থের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরিয়ে তুলেছেন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ১৫ আগস্টের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে গিয়ে উত্তেজনায় মাইকের তার ছিঁড়ে ফেলেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য শহীদ মিনারে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। প্রতিবাদী সভা-সমিতিতে যোগ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদে দেশত্যাগ করে কলকাতায় স্বেচ্ছা-নির্বাসন যাপন করেছেন [১৯৭৫-১৯৮১]।

এই যে সবাই মিলে শওকত ওসমানের একই ধরনের [প্রগতিশীলতার] পাঠ দিচ্ছেন, এই শওকত ওসমানের একটা ইতিহাস আছে। প্রগতিশীলতার প্রশ্নে শওকত ওসমানের এই ব্যাপক ও একমুখী রূপান্তরটি ঘটেছে মূলত স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে। প্রগতিশীলতার প্রশ্নে এই স্বাধীনতা-পরবর্তী শওকত ওসমান প্রগতিশীল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং সাহিত্যচর্চায় এক সিদ্ধ রসে পরিণত হয়েছেন।

শওকত ওসমানের লেখক-সত্তাকে আমরা এর প্রবণতা অনুসারে মোটা দাগে যদি ভাগ করি, তবে দেখব এটি স্পষ্টত দুটি পর্বে বিভক্ত। এই দুটি পর্ব হচ্ছে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী শওকত ওসমানে বোধ করি শিল্প এবং প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার সমন্বয়টা সহজেই চোখে পড়ে। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী শওকত ওসমান প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার সঙ্গে অতিরিক্ত আপোস করেছেন। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী শওকত ওসমান যে প্রগতিশীল এবং প্রতিবাদী ছিলেন না, তা কিন্তু নয়। এই পর্বে তাঁর প্রগতিশীল মন-মনস্বিতার স্বরূপ সম্পর্কে আমরা আগেই বলেছি। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী পর্বে এসে শওকত ওসমানের যে-রূপান্তরটি হলো তা হচ্ছে, তিনি শিল্পের দাবির চেয়ে বক্তব্যের এবং প্রগতিশীলতার অনুকূলে প্রতিবাদের স্বরকে তারায় চড়িয়ে রাখলেন। ফলে তিনি হয়ে উঠলেন স্পষ্ট, ক্ষিপ্ত, ক্ষুব্ধ, শাণিত, ব্যঙ্গাত্মক এবং অস্থির। কারণ, ১৯৭৫-এর পরের বাংলাদেশের ইতিহাস অবরুদ্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, স্বৈরশাসন আর পশ্চাৎপদতার ইতিহাস বলেই শওকত ওসমান মনে করতেন। শওকত ওসমান এ সময়ে স্বপ্নভঙ্গে আক্রান্ত হয়েছিলেন সন্দেহ নেই। কারণ, এ-সময়ে তিনি রাজনীতিতে দেখেছেন পাক-আমলের ধর্ম আর স্বৈর-শাসনের পুনরুত্থান। স্বাধীনতা-পরবর্তী শওকত ওসমান এগুলোকে নির্মোহ সৃজনশীলতার মধ্যে আনতে পারেননি। ফলে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী শওকত ওসমানের চেয়েও পরবর্তী শওকত ওসমান অশৈল্পিকভাবে সমকাল ঘনিষ্ঠ। এই বিষয়টিকেই শওকত ওসমানের কৃতী ছাত্র আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এভাবে বলেছেন—

সমসাময়িক কালের মানুষ, রাজনীতি, নানা ঘটনা ও দুর্ঘটনা, আন্দোলন, সংগ্রাম, সংঘাত, যুদ্ধ, আপোস প্রভৃতি নিয়ে তাঁর ক্রমবর্ধমান সচেতনতা তাঁকে ক্রমে স্পর্শকাতর করে তুলছে। তাঁর প্রতিক্রিয়া দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে।...এই অবিরাম তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া শওকত ওসমানের রচনায় অস্থির ছায়া ফেলে।...শওকত ওসমানের লেখা তাই ক্রমে পূর্ণ হয়ে উঠেছে, এখানে ক্ষোভ ও বিরক্তিই প্রধান।...পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেয়ে নিজের অসন্তোষ ও বিরক্তি ঘোষণা করার স্পৃহা তাঁর অনেক বেশি তীব্র। তাঁর ব্যঙ্গ প্রায়ই ছাপিয়ে ওঠে তাঁর বক্তব্যকে, গল্পের চরিত্রের স্বভাব ও আকার উপচে ওঠে তাঁর প্রতিক্রিয়া। প্রথম দিকের রচনায় তাঁর ঝাঁঝ কম, কথা বলার স্বর একটু নিচু...।...এখনকার উচ্চকণ্ঠ অনেক সময় তাঁর গলা চিরে ফেলে, কথা বুঝতে একটু বেগ পেতে হয়।...তাই শওকত ওসমানের বর্তমান লেখায় তাপ যতোটা অনুভব করি, আলো সে পরিমাণে কম। অন্ততঃ তাঁরই প্রথম দিকের গল্প উপন্যাসের তুলনায় তো বটেই। [আখতারুজ্জামান ১৯৯১ : ১১২]

উদ্ধৃতিটি দীর্ঘ কিন্তু শওকত ওসমানের বিবর্তন বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ঢাকার প্রগতিশীল রাজনীতি এবং সাহিত্যধারা যে-শওকত ওসমানকে নিয়েছে, তা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কথিত পরের শওকত ওসমান। রাষ্ট্র, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং ‘শিক্ষিত-সাহিত্যিক-এলিট-শ্রেণি’ সবাই মিলে এই যুদ্ধংদেহী শওকত ওসমানকেই নিয়েছে। শওকত ওসমান নামটিকে তাঁরা প্রগতিশীলতার সমার্থক হিসেবে গ্রহণ করে নিজেদের প্রেরণার মিত্র মনে করেছেন। তিনি যে শওকত ওসমান হয়ে উঠেছেন, তার পেছনে তাঁর সাহিত্যিক সত্তা ক্রিয়াশীল ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও তিনি বোধ করি সাহিত্যিক হিসেবে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে যতটা না গৃহীত ও সমাদৃত, তার চেয়ে বেশি সমাদৃত ও গৃহীত হয়েছেন প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামের প্রেরণা বা আদর্শ হিসেবে। তার প্রমাণ শওকত ওসমান সম্পর্কে উল্লিখিত বিশিষ্টজনদের মতামত এবং পাঠ। এই মতামত এবং পাঠই অদ্যাবধি তাঁর সমস্ত শিল্প-কৃতিত্বকে ছাপিয়ে দাপুটে হয়ে উঠেছে। তাঁর শিল্পীসত্তা নিয়ে, দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, কাউকেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে দেখা যায় না। মোট কথা রাষ্ট্র, অধিকাংশ সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তি ও সংগঠন, একাডেমিশিয়ান—প্রায় সবাই তাঁকে সাব্যস্ত করেছেন ‘প্রগতিশীল’ রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রামের উচ্চকণ্ঠ নায়ক হিসেবে।

শওকত ওসমান-সম্পর্কিত রাষ্ট্রের, সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক-একাডেমিকদের এবং বিশিষ্টজনদের উপর্যুক্ত চিন্তাধারণা, মূল্যায়ন এবং পাঠই সময়ের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে নিচের দিকে নেমেছে। ফলে, প্রজন্ম-পরম্পরায় শওকত ওসমানের এই পরিচয়টিই বড় হয়ে উঠেছে। এ কারণে শওকত ওসমান কেবল লেখক-শিল্পী হিসেবে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রগতিশীল রাজনীতি এবং চিন্তাচর্চার হাতিয়ার হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশের প্রগতিশীল চিন্তাচর্চায় শওকত ওসমানের নাম না নিলে সেই চর্চা যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এ কারণে শিক্ষিত সচেতন-অর্ধসচেতন, প্রকৃত এবং নতুন জলে উজান কাটা প্রগতিশীলরা পড়ে-না-পড়ে শওকত ওসমানকে গ্রহণ করে এবং উচ্ছ্বসিত হয়। কারণ, শওকত ওসমান তাদের ঘরের লোক। তিনি তাদের চেতনার বাইরের কোনো নতুন চেতনাজাগানিয়া বিষয়ের কারবারি নন। তিনি প্রচলিত প্রগতিশীলতার বাইরে নতুন কোনো ব্যতিক্রমী প্রগতিশীলতার প্রস্তাবকও নন। সুতরাং তাঁকে না পড়েও খালি শুনেই বন্ধু ভাবা যায়। কিন্তু সেই হিসেবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ অথবা সত্যেন সেনকে শওকত ওসমানের মতো সহজ বন্ধু ভাবা যায় না; ভাবতে পারে না শিক্ষিত মধ্যবিত্ত প্রগতিশীল শ্রেণি। কারণ, এঁদের প্রগতিশীলতা এবং জীবনবীক্ষার মধ্যে অন্যপ্রান্তিক টানের বাস্তবতা রয়েছে। এঁদের অধিকাংশটুকু নেওয়া গেলেও পুরোটুকু নেওয়া যায় না। এ কারণে শওকত ওসমান মূলধারার প্রগতিশীল চিন্তা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির মধ্যে জীবদ্দশাতে এবং এখন পর্যন্ত অতুলনীয় গুরুত্ব, প্রাধান্য, উচ্ছ্বাস-প্রশংসা এবং স্মরণ কুড়িয়ে নিয়েছেন, যা শওকত ওসমানের চেয়ে অনেক বড় শিল্পীর ক্ষেত্রে ঘটেনি।

বাংলাদেশে শওকত ওসমানের এই পাঠ, মূল্যায়ন, গ্রহণযোগ্যতা এবং গুরুত্বের মানদণ্ড ও প্রক্রিয়া থেকে বাংলাদেশের সাহিত্য ও সাহিত্যিক বিবেচনার একটা কাঠামোগত জ্ঞান লাভ করা যায়। তা হচ্ছে, এখানে শিল্পের চেয়ে সংশ্লিষ্টতার গুরুত্ব বেশি; আঁশ এবং রসের চেয়ে আঁটির কদর বেশি; নির্মাণ করে নেওয়ার চেয়ে নির্মিত-সহজের দিকে ঝোঁক বেশি; ড্রামার চেয়ে মেলোড্রামায় আগ্রহ বেশি। আমাদের প্রত্যাশা, শওকত ওসমান আঁটির সঙ্গে সঙ্গে আঁশ ও রসেও বেঁচে থাকুন; শৈল্পিক বিবেচনায়ও বেঁচে থাকুন। কারণ, তিনি প্রথমে শিল্পী তারপর প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মী। সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের অবশ্যই একটা সময়মূল্য থাকে, কিন্তু চেতনা আর শিল্পের সুসমন্বিত সৃজনকর্ম সময়ের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে সময়োত্তীর্ণ হয়। ভাবীকাল শওকত ওসমানকে নিশ্চয়ই তাঁর সৃষ্টিকর্ম দিয়ে বিবেচনা করবে। এ জন্য তাঁর শিল্প ও চৈতন্য নিয়েও কথাবার্তা হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। শওকত ওসমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে এর চেয়ে বড় প্রত্যাশা আর কী হতে পারে!

টীকা
১.    এই চার প্রকার মূল্যায়নের মধ্যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মূল্যায়ন—যাকে আমরা আংশিক ‘গণ-মূল্যায়ন’ বলতে পারি; যদিও বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি শোচনীয়ভাবে কখনোই গণসম্পৃক্ত ছিল না—বোধ করি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন। কারণ, ‘গণ-মূলায়নের’ বাইরে একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যিক-নান্দনিক-তাত্ত্বিক-একাডেমিক পাঠ থাকতে পারে। কিন্তু সেটা কোনো কাজের কথা নয়। সেটা একাডেমিক কথা। বড় সাহিত্যিক বেঁচে থাকেন মানুষের প্রয়োজনে, মানুষের মুখে, মানুষের প্রতিদিনের যাপনে। এর বড় প্রমাণ বোধ করি চণ্ডীদাস, ভারতচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদ্‌দীন, এমনকি লালন শাহ। এর বিপরীতের উদাহরণের জন্য এমন অনেক সাহিত্যিকের উল্লেখ করা যাবে, যাঁদের গুরুত্ব একাডেমির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। বড় সাহিত্যিককে তাঁর জনগোষ্ঠী জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে লালন, যাপন এবং ব্যবহার করে। সেই বিচারে শওকত ওসমানের একটি ব্যবহারিক মূল্যায়ন আছে কি না, থাকলে তার শ্রেণিচরিত্র এবং স্বরূপ বের করা খুবই জরুরি। তবে, স্মরণ রাখা দরকার যে, সাহিত্যিক-নান্দনিক-তাত্ত্বিক-একাডেমিক পাঠ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাঠ-বিবেচনাকে বা ‘গণ-বিবেচনা’কে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করে।
২.    জননী উপন্যাসটিকে অন্য অনেক গবেষকও সার্থক মহৎ শিল্পকর্ম না বললেও উচ্চাভিলাষী বলে মন্তব্য করেছেন—‘উপন্যাসটিতে প্রথম একজন বাঙালি মুসলমানের মহৎ শিল্পসৃষ্টির ব্যাকুলতা, সম্ভাবনা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা অভিব্যঞ্জিত হয়েছে। জননী প্রকৃতপক্ষে বাঙালি মুসলমানের প্রথম উচ্চাভিলাষী উপন্যাস-প্রয়াস।’ [কুদরত-ই-হুদা ২০১৩ : ৬৬]
৩.   কারণ, বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাস মাথায় রেখে দেখলে দেখা যাবে যে, শওকত ওসমান সওগাত পত্রিকায় যখন চল্লিশের দশকে জননী ছাপছেন অথবা ষাটের দশকে যখন ক্রীতদাসের হাসি লিখছেন, তখন বাঙালি মুসলমানের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র মতো দু-একজন ছাড়া আর তেমন কোনো মহৎ কথাসাহিত্যিক নেই, যাঁর সঙ্গে শওকত ওসমানের তুলনা চলে। এ ছাড়া ষাটের দশকে বাংলা উপন্যাসের আঙ্গিক নিয়ে যে বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা শওকত ওসমান করেছেন, তা শুধু ষাটের দশকের বিকাশোন্মুখ বাংলাদেশের উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিরল নয়; বর্তমানের বাংলাদেশের উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতেও বিস্ময়কর এবং প্রাগ্রসর বৈকি!
৪.     শওকত ওসমানের এই ঢাকাই পাঠের সঙ্গে সম্ভবত হুমায়ুন আজাদ  [১৯৪৭-২০০৪]-এর ঢাকাই পাঠের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের সাহিত্যে স্বল্প পঠিত অথবা অপঠিত    থেকেও হৃদয়ে ও মুখে লালিত ও উচ্চারিত হয়েছেন বহুল পরিমাণে—এ রকম সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বের উদাহরণ বেশ দেয়া যাবে। তবে, সহজে বোঝার জন্য বোধ করি সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হুমায়ুন আজাদ। বাংলাদেশে এমন লোকের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়, যাঁদের নানা কারণে হুমায়ুন আজাদকে পড়া হয়নি, অথচ হুমায়ুন আজাদকে তাঁরা লালন করেন এবং আজাদ প্রসঙ্গে তাঁরা খুবই উচ্ছ্বসিত। অনেকের হয়তো এমন শ্রুতি-অভিজ্ঞতাও আছে যে, হুমায়ুন আজাদের কোনো রচনা না পড়েই হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে কেউ হয়তো অনর্গল বলে যাচ্ছেন এবং হয়তো ভুল বলছেন না, ঠিকই বলছেন। তবে হুমায়ুন আজাদের বিষয়টি বাহ্যিক নানা কারণে কিছুটা অন্য রকম। কারণ, তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় নানা আচরণ-উচ্চারণের দ্বারা এবং মৃত্যুর ঘটনাধারার দ্বারা আমাদের মনোযোগ একটু বেশিই আকর্ষণ করেছিলেন। তা ছাড়া তাঁর কাজের ধারা বহুবিচিত্রও বটে। সেই তুলনায় শওকত ওসমান ব্যক্তিগত জীবনে অতটা ঘটনা-দুর্ঘটনা-বিতর্কের জন্ম না দিলেও, দুজনের প্রগতিশীল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার ও লালিত হওয়ার দিক থেকে অন্তর্গত মিল রয়েছে। সাধারণ সচেতন অর্ধসচেতন মধ্যবিত্ত প্রগতিশীল, যাঁরা শওকত ওসমানকে যতটা না পড়ে, জেনে ও বুঝে পেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি প্রগতিশীলতার শ্রেণিগত উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। শিক্ষিত সচেতন-অর্ধসচেতন প্রগতিশীল মধ্যবিত্তের কাছে শওকত ওসমানের গুরুত্ব এবং গ্রহণযোগ্যতার যে ঘটনাটি বাংলাদেশে ঘটে গেছে, তাকে শুধু রাধার কৃষ্ণানুরাগ বা কৃষ্ণপ্রেমের সঙ্গেই তুলনা করা যেতে পারে। নাম শুনেই প্রেম জাগে, দেখতে হয় না। তবে রাধার কৃষ্ণানুরাগের সঙ্গে মধ্যবিত্তের এই শওকত ওসমান অনুরাগের একটি পার্থক্য আছে। রাধার ভেতরে কৃষ্ণ সম্পর্কে অদ্বৈতের ভাবতরঙ্গ খেলে যেত। রাধা নিজেই কৃষ্ণের উপলব্ধিকর্তা। আর শওকত ওসমানকে শিক্ষিত সচেতন-অর্ধসচেতন ‘প্রগতিশীল’ মধ্যবিত্ত পেয়েছে উত্তরাধিকারসূত্রে, কিংবদন্তিসূত্রে। আর একথা কে না জানে যে, উত্তরাধিকারসূত্রে এবং শ্রুতিসূত্রে প্রাপ্তির মধ্যে নিজের চেয়ে অপরই বেশি থাকে।

সহায়ক গ্রন্থ ও প্রবন্ধপঞ্জি

 ১.    অজয় দাশগুপ্ত [২০০৮]। ‘দুর্দিনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়’। ব্যক্তি ও সাহিত্যিক শওকত ওসমান [সম্পা. বুলবন ওসমান], দীপ্তি প্রকাশনী, ঢাকা।
২.    আখতারুজ্জামান ইলিয়াস [১৯৯১]। ‘শওকত ওসমানের প্রভাব ও প্রস্তুতি’। শওকত ওসমান সংখ্যা, নিসর্গ [সরকার আশরাফ সম্পাদিত], ঢাকা।
৩.    ইয়াফেস ওসমান [২০০৮]। ‘জাতীয় শোক সভায় ভাষণ’। ব্যক্তি ও সাহিত্যিক শওকত ওসমান, প্রাগুক্ত।
৪.    মুনতাসীর মামুন [২০০৮]। ‘শওকত ওসমান’। ব্যক্তি ও সাহিত্যিক শওকত ওসমান, প্রাগুক্ত।
৫.    মুস্তাফা নূরউল ইসলাম [২০০৮]। ‘শওকত ভাই তিনি শওকত ওসমান’। ব্যক্তি ও সাহিত্যিক  শওকত ওসমান, প্রাগুক্ত।
৬.    রফিকুন নবী [২০০৮]। ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’। ব্যক্তি ও সাহিত্যিক শওকত ওসমান, প্রাগুক্ত।
৭.    শওকত ওসমান [২০০১]। শওকত ওসমান : উপন্যাসসমগ্র, প্রথম খণ্ড, সময় প্রকাশন, ঢাকা।
৮.    শওকত ওসমান [২০০১]। শওকত ওসমান : উপন্যাসসমগ্র, দ্বিতীয় খণ্ড, সময় প্রকাশন, ঢাকা।
৯.    শামসুর রাহমান [২০০৮]। ‘একজন অসামান্য রাহানুমা’। ব্যক্তি ও সাহিত্যিক শওকত ওসমান, প্রাগুক্ত।
১০.    হাসান আজিজুল হক [১৯৯৪]। কথাসাহিত্যের কথকতা, সাহিত্য প্রকাশ, দ্বিতীয় সংস্করণ,  ঢাকা।
১১.    হুমায়ুন আজাদ [২০০৯]। সাক্ষাৎকার, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।