গোলাপের নাম: রহস্য উপন্যাসের চেয়েও বেশি কিছু!
বইয়ের মঙ্গল নিহিত সেটা পড়ার মাঝে। একটি বই এমন কিছু চিহ্ন দিয়ে তৈরি, যেগুলো আবার অন্য কোনো চিহ্নের কথা বলে, অন্য নানা জিনিসের কথা বলে। যে বইয়ের মাঝে এই কথাগুলো আছে সেই বইটি নিজেই সাহিত্য, চিহ্নবিজ্ঞান, ইতিহাস, খ্রিস্টধর্মের নানা ব্যাখ্যা, নন্দনতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, ভেষজবিদ্যা, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও দর্শনের নানা উপাদানে ভরপুর। সেই বইটি নিয়েই আজ বলব।
বইকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য গ্রন্থাগার তৈরি করা হয়। মানুষের ধর্মান্ধতা, ক্ষমতাবানদের অস্তিত্ব হারানোর চিন্তা থেকে হাজার বছর ধরে সাধারণ মানুষের মাঝে ভয়ের যে ধারণা টিকিয়ে রাখা হয়েছে, সেই ভয়কে তারা যেন উপহাস করতে না পারে, হালকা চোখে দেখা বা অন্যভাবে ভাবতে না পারে, প্রশ্ন করতে না পারে, সে জন্য গ্রন্থাগার থেকে দূরে রাখা হয় সাধারণজনকে। কারণ, জ্ঞান অনুসন্ধান করা ভীতিকর ও উদ্বেগজনক। জ্ঞানকে সংরক্ষণ করতে হবে, অনুসন্ধান নয়। ঐশী বস্তু হিসেবে জ্ঞানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি সম্পূর্ণ আর প্রথম থেকেই সংজ্ঞায়িত, ঈশ্বরের কথার নিখুঁতত্বে, যে কথা নিজেকে নিজের কাছে প্রকাশ করে। সেসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করাই উত্তম। এসব কারণেই গ্রন্থাগার পরিণত হয় জ্ঞান ও বইয়ের সমাধিক্ষেত্রে। বেনেডিক্টীয় মঠে এমনই এক গ্রন্থাগারকে কেন্দ্র করে ঘটে গেছে অনেক রহস্যজনক মৃত্যু। মৃত্যুর সেই রহস্য উদ্ঘাটন নিয়ে সাত দিনের বর্ণনায় রচিত ঐতিহাসিক রহস্য উপন্যাস গোলাপের নাম।
বইটি শুরু হয় একজন নামহীন লেখককে দিয়ে, যিনি তার পাওয়া একটি পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে কথা বলেন। তিনি নিশ্চিত নন এই পাণ্ডুলিপি সত্যি নাকি মিথ্যা। তবু এর বর্ণনাকারী ঐতিহাসিক প্রমাণ উপস্থাপন করেন বিভিন্ন চরিত্র ও ঘটনা দ্বারা, যা পাণ্ডুলিপিটাকে সত্য বলে ভাবতে বা বিশ্বাসযোগ্য করতে বাধ্য করে।
পাণ্ডুলিপির রচয়িতা একজন জার্মান সন্ন্যাসী। নাম আদসো। যিনি চতুর্দশ শতাব্দীতে বা কাছাকাছি সময়ে তাঁর জীবনসায়াহ্নে এসে ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার স্মৃতিচারণামূলক বর্ণনা দেন। ধারণা করা হয়, সেই সময়টাতে রচয়িতার বয়স ১৮ বছর ছিল। মূল পাণ্ডুলিপিটি ছিল ল্যাটিনে। পরে ১৯৬৮ সালে জনৈক অ্যাবে ভ্যালে ল্যাটিন পাণ্ডুলিপির একটা ফরাসি প্রতিলিপি করেন। তিনি বইটির নাম দেন Le Manuscrit de Adson de Melk। এরপর ফরাসি অনুবাদটি ১৯৮০ সালে উমবের্তো একো ইতালীয় ভাষায় Il nome de la rosa নামকরণে বই আকারে প্রকাশ করেন। ইতালীয় থেকে ইংরেজি ভাষায় ১৯৮৩ সালে উইলিয়াম উইভার The Name of the Rose নামে ইংরেজিতে ভাষান্তর করেন। আর ইংরেজি ভাষান্তর থেকে বাংলা তরজমা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ও অনুবাদক জি এইচ হাবীব। তিনি বাংলায় বইটির নামকরণ করেন গোলাপের নাম। বইটি প্রকাশ করেছে বাতিঘর, প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০২০। প্রচ্ছদ করেছেন সোমনাথ ঘোষ ও অলংকরণে নীল প্যাকার। মুদ্রিত মূল্য ১ হাজার ৩৩৪ টাকা।
এ তো গেল বইটি রচনার ইতিহাস, এবার আসা যাক বইয়ের ভেতরের আলোচনায়। বৃহৎ কলেবরের এই বই পাঠের পর পাঠ অভিজ্ঞতার টুকরো-টাকরা জোড়া লাগিয়ে মূল সারাংশ তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
আগেই বলা হয়েছে, পাণ্ডুলিপির রচয়িতা শিক্ষানবিশ আদসো একটি বেনেডিক্টীয় মঠে তার দেখা সাত দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার স্মৃতিচারণা করেন। সেই সাথে তিনি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও উপস্থাপন করেন। এবং পাঠককে জানান, সে সময়ে পোপ ও সম্রাটের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। বিরোধের মূল কারণ যিশুর দারিদ্র্য নিয়ে অর্থাৎ যিশু দরিদ্র ছিলেন কি না সেটা নয়, গির্জাকে দরিদ্র হতে হবে কি না, সেটাই প্রশ্ন। আর ‘দরিদ্র’ কথাটার মানে আসলে কোনো প্রাসাদ থাকা বা না থাকা নয়; কথাটার মানে হলো, বরং পার্থিব ব্যাপারে গির্জার আইন প্রণয়ন করার অধিকার না রাখা। এসব বিষয় নিয়ে পরিস্থিতি এতটাই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে যে সে সময়ে পোপ সম্রাটকে বহিষ্কার করেন। অন্যদিকে ফ্রান্সিসকানরা ছিল সম্রাটের পক্ষে। বাস্কারভিলের উইলিয়াম তেমনি একজন ফ্রান্সিসকান সন্ন্যাসী। যিনি একজন দক্ষ গোয়েন্দা আর তার গোয়েন্দাগিরির মূল হাতিয়ার ছিল অ্যারিস্টটলের যুক্তি, অ্যাকুইনাসের ধর্মতত্ত্ব, রজার বেকনের অভিজ্ঞতামূলক অন্তর্দৃষ্টি। তিনি তার নবীন শিষ্য মেলকের আদসোকে নিয়ে উত্তর ইতালির একটি বেনেডিক্টীয় মঠে উপর্যুক্ত বিষয়ে বিতর্কে যোগ দিতে এসে কয়েক দিন আগে সেখানে ঘটে যাওয়া একটি দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর তদন্তভার পেয়ে যান মঠের প্রধান বা মোহান্ত অ্যাবোর নির্দেশে।
উমবের্তো একো গ্রন্থাগারের যে গঠন দেখিয়েছেন, তা হলো মধ্যযুগীয় বিশ্বমানচিত্রের পুনর্নির্মাণ। যেটিকে বলা হয় T-O মানচিত্র। সেই সাথে এটি একটি মধ্যযুগীয় গোলকধাঁধাও। গোলকধাঁধা ও T-O মানচিত্রের ধারণা একো আপুলিয়াতে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তৈরি ‘ক্যাসেল দে লা’ মন্তের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ একটা স্ট্রাকচারের ওপর স্থাপন করেন। অতএব বলা যায়, গ্রন্থাগার নির্মাণের অনুপ্রেরণা তিনি লাভ করেছেন মধ্যযুগীয় নানান মানচিত্র ও গোলকধাঁধা থেকে আর সেই সাথে আর্জেন্টিনার প্রবাদপ্রতিম লেখক হোর্হে লুইস বোর্হেসের কাছ থেকে
প্রথম দিকে উইলিয়াম মনে করেন, খুনি পরিকল্পনা করে বুক অব অ্যাপক্যালিপ্সের সাতটি তুরীয় পরম্পরা বা ক্রমানুসারে খুনগুলো করেছে। কারণ, ঘটনার প্রথম মৃত্যুটি ঘটেছে আকাশ থেকে পড়া শিলাবৃষ্টির প্রতীকীরূপে; যেখানে দেখা যায় মঠের ওস্তাদ হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠা আলংকারিক আদেলমোর লাশটি খাড়া পাহাড়ের পাদদেশে শিলাবৃষ্টিসদৃশ তুষারের মাঝে, দ্বিতীয় মৃত্যুর ঘটনা রক্তের সমুদ্রের প্রতীকীরূপে যেখানে মঠের গ্রিক ও আরবি ভাষার অনুবাদক ভেনানশিয়াশের মৃতদেহটি পাওয়া যায় রক্তভরা পিপার মাঝে, তৃতীয় মৃত্যুর ঘটনা পানির প্রতীকীরূপে যেখানে মঠের সহকারী গ্রন্থাগারিক বেরেঙ্গার লাশটি পাওয়া যায় স্নানাধারে, মুখটা ছিল পানিতে ডুবে মরা মানুষের মতো, চতুর্থ মৃত্যুর ঘটনা আকাশের তৃতীয় অংশের নক্ষত্রের প্রতীকীরূপে যেখানে ভেষজবিদ সেভেরিনাস আর্মিলারি দ্বারা মাথায় আঘাত পেয়ে মারা যান, পঞ্চম মৃত্যুর ঘটনা কাঁকড়াবিছের শক্তিকে প্রতীকীরূপে যেখানে মঠের গ্রন্থাগারিক মালাকির মৃত্যুর সময় জিহ্বা কালো ছিল এবং উইলিয়ামের বুক খামচে ধরে তার মুখটা নামিয়ে শেষ কথাটি বলেছিলেন, এক হাজার কাঁকড়াবিছের শক্তি আছে ওটার।
এভাবেই একের পর এক রহস্যজনক পাঁচটি খুন হয় ছয় দিন ধরে। এ রহস্যের সমাধানে একটি বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে আদসোর স্বপ্ন। স্বপ্নের রূপকতা উইলিয়ামকে সাহায্য করছে সত্যের কাছাকাছি যেতে, যা উইলিয়াম অকপটে শিষ্য আদসোর কাছে এভাবে স্বীকার করেছেন, ‘আমি ছয় দিনে জাগ্রত অবস্থায় যা যা বুঝেছি, তোমার ঘুমন্ত আত্মা তার চাইতে অনেক বেশি কিছু বুঝতে পেরেছে’ এবং স্বপ্নের গুরুত্ব বোঝাতে উইলিয়াম বলেন, ‘একটা স্বপ্ন একটা ধর্মীয় পুস্তক, আর অনেক ধর্মীয় পুস্তকই স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়’। এরপর তিনি আদসোকে নিয়ে মোহান্তের সাথে দেখা করতে যান সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে। অ্যাবোকে বলেন, এই অপরাধগুলো কোনো কলহ বা সন্ন্যাসীদের মধ্যে কোনো প্রতিশোধের ঘটনা থেকে ঘটেনি, বরং এমন সব কর্মকাণ্ড থেকে ঘটেছে, যেগুলোর সূত্রপাত ঘটেছিল মঠের দূর কোনো ইতিহাসে। কিন্তু মোহান্ত উইলিয়ামের সাথে এ নিয়ে আলোচনায় আগ্রহ দেখান না। সেই সাথে তখন তিনি উইলিয়ামের ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেন। আরও বলেন, যদি বাইরের ইনকুইযিটরা এই ঘটনাগুলো না জানতেন, তবে মঠের একজন প্রধান হয়ে তাদের কাছ থেকে লজ্জা এড়ানো যেত। এ কথা বলার কারণ মোহান্ত এসব ঘটনার তদন্তভার তদন্তকারী বার্নার্ড গুইয়ের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন ডোমিনিকান সন্ন্যাসী ও তদন্তকারী। মঠে এসেছিলেন ফরাসি পোপ কূটনীতিক ও কার্ডিনাল দেল পোজ্জেত্তো এবং অন্যদের সাথে বিতর্ক সভায় অংশগ্রহণের জন্য। কিন্তু বার্নার্ড গুই মৃত্যুর রহস্য সমাধানের চেয়ে অতীতে ধর্মদ্রোহিতার সাথে জড়িত মঠের ভান্ডারী রেমেজিও আর রেমেজিওর সহযোগী সালভাতেরোর শাস্তি নিশ্চিতের ব্যাপারে তৎপর ছিলেন। এরপর মোহান্ত উইলিয়াম ও আদসোকে তদন্ত বন্ধ করে চলে যেতে নির্দেশ দেন। কিন্তু নাছোড়বান্দা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উইলিয়াম শেষ সময়ের সুযোগটা কাজে লাগান, গুরু-শিষ্য এই সমস্যার সমাধানে তিনটি হাইপোথিসিস নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনার একপর্যায়ে ভূত দেখার মতো উইলিয়াম বলে ওঠেন, ‘গ্রন্থাগারের Finis Africae-তে ঢুকতে হবে; কারণ, শেষ উত্তরটা নির্ঘাত ওখানেই আছে।’
গোলাপের নামে এডিফিকুয়ামের নির্মানশৈলী দেখানো হয়েছে মিথ, দর্শন ও সংখ্যাতত্ত্বের সমন্বয়ে। এডিফিকুয়ামের আকার আয়তন নূহের নৌকার স্বর্ণসূত্র মেনে করা হয়েছে। আর দুর্গটি তিনতলাবিশিষ্ট। তিন সংখ্যাটি যে সব মিথকে নির্দেশিত করে তা হলো—ইব্রাহিমের কাছে আসা দেবদূতের সংখ্যা ছিল তিন, মাছের পেটে ইউনুসের অবস্থান, শবাধারে যিশু ও ল্যাযারাসের কাটানো দিনের সংখ্যাও তিন, ধর্মতাত্ত্বিক সদ্গুণের সংখ্যা তিন। শব্দও আছে তিন প্রকার vox, flatus, pulsus আর মানব ইতিহাসের রয়েছে তিন যুগ—অনুশাসনের ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।
উমবের্তো একো গ্রন্থাগারের যে গঠন দেখিয়েছেন, তা হলো মধ্যযুগীয় বিশ্বমানচিত্রের পুনর্নির্মাণ। যেটিকে বলা হয় T-O মানচিত্র। সেই সাথে এটি একটি মধ্যযুগীয় গোলকধাঁধাও। গোলকধাঁধা ও T-O মানচিত্রের ধারণা একো আপুলিয়াতে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তৈরি ‘ক্যাসেল দে লা’ মন্তের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ একটা স্ট্রাকচারের ওপর স্থাপন করেন। অতএব বলা যায়, গ্রন্থাগার নির্মাণের অনুপ্রেরণা তিনি লাভ করেছেন মধ্যযুগীয় নানান মানচিত্র ও গোলকধাঁধা থেকে আর সেই সাথে আর্জেন্টিনার প্রবাদপ্রতিম লেখক হোর্হে লুইস বোর্হেসের কাছ থেকে।
এ রকম ঐতিহাসিক, গুরুগম্ভীর ইন্টারটেক্সচুয়ালিটির রহস্য উপন্যাসে পাঠককে প্রেমে উজ্জীবিত করতে আর হাসির খোরাক থেকে একেবারে বঞ্চিত করেননি একো। সন্ন্যাস জীবনে ব্রত হয়েও আদসো জীবনে প্রথম ও শেষবারের মতো প্রেমের গহ্বরে ডুবে গিয়েছিলেন। সে গহ্বর থেকে নিজেই নিজেকে উদ্ধার করেছিলেন, তবু জীবনের অন্তিমে এসে ভেতরে পুষে রাখা অনুভূতির স্মৃতিচারণা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে চাননি বা পারেননি। সে সময়ে প্রেমের অনুভূতির তীব্রতা এতটাই ছিল যে গোলকধাঁধার গ্রন্থাগারে অনেক বইয়ের মাঝে যে বইটি নজর কেড়েছিল, সেটির নাম ছিল Speculum amoris বা প্রণয়ের আয়না। বইটি দেখামাত্রই তাঁর ভেতরে যে পরিবর্তন টের পেয়েছিলেন, তা আদসো এভাবেই বলেছেন, ‘যতটা মনে করেছিলাম, তার চাইতেও বেশি প্রেমরোগাক্রান্ত আমি।’ একই সাথে এই মধুর অনুভূতির পাশাপাশি পাপবোধও তাকে কুরে খেয়েছিল। বার্নার্ড গুইয়ের তদন্তের সময়ে আদসোর ভালোবাসার মেয়েটি অভিযুক্ত হয় আর মেয়েটিকে যখন পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দেওয়া হয় তখন ‘সাধারণ মানুষই সবকিছুর জন্য দাম দেন’ ভান্ডারীর এই মূল্যবান কথাটি আদসো জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। এমন নির্দেশে আদসো নির্লজ্জের মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন, নিজেকেই দায়ী ভাবছিলেন আর তিনি স্বীকার করেছিলেন এটাই তাঁর একমাত্র পার্থিব প্রেম, এবং তখন বা তার পরেও তিনি কখনোই সেই প্রেমকে নাম ধরে ডাকতে পারেননি।
এই উপন্যাসে অন্ধ প্রবীণ ইর্য়গে চরিত্রটির মাধ্যমে বলা হয়েছে, ‘হাসি’ বিষয়টি অনুমিত নয়। যিশু কখনোই হাসতেন না; কারণ, হাসি সন্দেহকে উসকে দেয়। কিন্তু পাঠক মাঝে মাঝে মুচকি হাসবেন যখন উইলিয়াম তাঁর শিষ্য আদসোকে ইঙ্গিতে বা সরাসরি কোনো ব্যঙ্গার্থক মন্তব্য করছেন। আর আমার মতো যাদের বই পড়ে খিক খিক করে হাসার অভ্যাস, তারা ট্রাফল (কন্দ) খোঁজার বর্ণনায় নিশ্চয়ই হেসে উঠবেন। মূলত এই হাস্যরস তৈরি হওয়ার পেছনে ছিল একেক জায়গার ভাষার অর্থের ভিন্নতার কারণ। আর গোলাপের নামে ভাষার বিষয়টিকে অনেক গুরুত্বের সাথে দেখানো হয়েছে। ভাষা নিয়ে উইলিয়াম তাঁর গুরু বেকনের দুটি বক্তব্য তুলে ধরেন এভাবে,
১. ‘ভাষাজ্ঞানের মাধ্যমে বিদ্যার্জনের পথে বিজয় অর্জিত হয়।’
২. ‘পণ্ডিতের প্রথম কাজ ভাষা শেখা।’
একটি রহস্য উপন্যাসে যে এত দর্শনের দেখা পাওয়া যাবে, তা বইটি শেষ অবধি না পড়লে সেই স্বাদ আস্বাদন করা যাবে না। বইটি পড়তে গিয়ে মনে পড়েছে ইয়েস্তেন গার্ডারের পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসের ওপর লেখা উপন্যাস সোফির জগৎ এর কথা। যেখানে অ্যালবার্টো সোফির উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘সোফি, এই কোর্সে-এর মাধ্যমে তোমাকে আমি যদি মাত্র একটা জিনিসও শেখাতে চাই, তো সেটা হলো হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া।’
ঠিক তেমনি গোলাপের নাম উপন্যাসটিতেও উমবের্তো একো একই বিষয় উল্লেখ করেছেন। শিষ্য আদসো উইলিয়ামের কাছে জানতে চান, বিশুদ্ধতায় কোন জিনিসটা উইলিয়ামকে সবচেয়ে আতঙ্কিত করে। উইলিয়াম বলেছিলেন, ‘তাড়াহুড়ো।’
সেই সময়ে সাধারণজন এবং যাজকদের নারীর প্রতি ভাবনা কেমন ছিল, তা এ উপন্যাসে দেখানো হয়েছে। যেমন আদসো উইলিয়ামের কাছে এসে তার আর মেয়েটির মাঝে যে ঘটনা ঘটেছিল, সে বিষয়ে স্বীকারোক্তি করছিলেন তখন সব শুনে উইলিয়াম বলেছিলেন, ‘প্রলোভনের উৎস হিসেবে নারীর কথা বাইবেলে যথেষ্টই বলা হয়েছে। যাজকেরা নারীর সম্পর্কে বলেন, তাদের কথাবার্তা হচ্ছে প্রজ্বলিত আগুনের মতো’, তারা আরও বলেন, ‘নারীকে আমি মৃত্যুর চাইতেও তেতো বলে মনে করি; কারণ, তার মন ছলচাতুরী জালে ভরা আর তার হাত যেন শৃঙ্খল।’ এ ছাড়া অন্যরা বলেছেন, ‘নারী হলো শয়তানের বাহন’। যদিও উইলিয়াম নারীবিষয়ক এ ধরনের মতবাদ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি তিনটি যুক্তি দেখিয়েছেন এই সংশয়ের পেছনে। বলেছেন, নারী যদি এতই নিকৃষ্ট সত্তা হবে, তাহলে কেন নারীকে উচ্চতর মানবীয় উপাদান দিয়ে অর্থাৎ আদমের পাঁজর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, যিশু কেন সরাসরি সাকার না হয়ে নারীর গর্ভবাসই বেছে নিলেন, আর পুনরুজ্জীবনের পরে তিনি কেন একজন নারীর সামনেই উপস্থিত হলেন। তবে মজার বিষয় হলো, উইলিয়াম গোয়েন্দাগিরিতে যার যুক্তিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন, সেই অ্যারিস্টটলেরও নারীর প্রতি ছিল নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। এবং মধ্যযুগে নর-নারী সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের ভ্রান্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি আরও বেশি মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছিল; কারণ, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিরই একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল পুরো মধ্যযুগ ধরে, প্লেটোর নয়। এভাবেও গির্জা নারী সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করে।
এ উপন্যাসে একটি শক্তিশালী বাক্য দিয়ে একো যুদ্ধ বিরোধিতার কথা তুলে ধরেছেন। বাক্যটি ছিল এমন, ‘পবিত্র যুদ্ধও শেষ পর্যন্ত একটা যুদ্ধই।’
বয়স, সময় ও অভিজ্ঞতা—এই তিনটি উপাদান মানুষের চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে। যুবক বয়সের ধ্যান-ধারণা, ধর্মবিশ্বাস বৃদ্ধ বয়সে এসে পুরো ৩৬০ ডিগ্রি কোণে বদলে যেতে পারে। এর ব্যতিক্রম ঘটেনি আদসোর বেলাতেও। এই দ্বৈততার বিষয়টি একো সুনিপুণভাবে উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের শেষে যুবক আদসো ঈশ্বরের অনস্তিত্ব নিয়ে একটি ধর্মতাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন আবার তিনিই বার্ধক্যে এসে যখন ঘটনার স্মৃতিচারণা করছেন তখন বলেছেন, ‘যতই বুড়ো হচ্ছি এবং নিজেকে ঈশ্বরের ইচ্ছের কাছে সমর্পণ করছি।’
এ রকম একটি ইতিহাস-সম্পর্কিত রহস্যে উপন্যাসের নাম গোলাপের নাম কেন রাখা হলো? এর উত্তর ধরে নেওয়া যায় উপন্যাসের শেষেই আছে, আদসো স্মৃতিচারণার শেষে লিখেছেন ক্লুনি বার্নার্ডের লেখা লাইনটি, ‘stat rosa pristina nomine, nomina muda tenemus [গতকালের গোলাপ সেটার নামেই রয়ে যায়; আমাদের কাছে থাকে কেবল রিক্ত ফাকা নাম]’ এই লাইনটি রবিশংকর বলে’র উপন্যাস দোজখনামায় লেখা একটি গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়—একবার এক নবাবের ইচ্ছে হয়েছিল, তিনি এমন একটা আংটি পরতে চান, যার ভেতরে এমন কিছু লেখা থাকবে, যা দেখে নবাব বিষণ্নতার সময়ে লেখাটি পড়ে খুশি হয়ে যাবেন আর সুখের সময় লেখাটি পড়ে বিষণ্ন হয়ে যাবেন। এর সমাধান দিয়েছিলেন এক জ্ঞানী দরবেশ। তিনি নবাবের উজিরকে চিঠিতে লিখে দিলেন কী লিখতে হবে। উজির সেইমতো লিখে আংটি বানিয়ে নবাবকে উপহার দিলেন। কয়েক দিন ধরে নবাবের যখন মন খারাপ, তখন সে আংটির দিকে হতাশভাবে তাকালেন আর আংটির গায়ের লেখাটি পড়ে হা হা করে হেসে উঠলেন। লেখাটি ছিল ‘এ-ও একদিন চলে যাবে।’ ঠিক একোও যেন গোলাপের নাম নামকরণের ভেতরে এই ক্ষণস্থায়িত্বের বার্তা দিয়েছেন।
গোলাপের নাম বাংলায় তরজমা করতে অনুবাদক জি এইচ হাবীব সময় নিয়েছিলেন ১৬টি বছর। পড়ার সময় তাঁর এই অক্লান্ত পরিশ্রম পাঠক অবশ্যই অনুভব করবেন। এটি এমন একটি উপন্যাস, যা পাঠ করতে গিয়ে পাঠককে টিকা-ভাষ্যের দ্বারস্থ হতে হবে। উমবের্তো একোর বইটিতে অবশ্য এই ব্যবস্থা ছিল না। সেই একই ধারাবাহিকতা ইংরেজি অনুবাদক উইলিয়াম উইভারও বজায় রেখেছিলেন। একো চেয়েছিলেন পাঠক তাঁদের পাঠক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তাকে চ্যালেঞ্জ করুক। তবে বাংলাভাষী পাঠকেরা এদিক থেকে ভাগ্যবান যে তাঁদের পাঠক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তাকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়নি। সবটুকু চ্যালেঞ্জ অনুবাদক নিজেই নিয়ে সহজবোধ্য করার চেষ্টা করেছেন শুধু শেষ অব্দি পাঠ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জটুকু পাঠকের হাতে। এই বইটিকে একদিকে বলা যায় একের ভেতর দেড়; কারণ, দ্য কি টু দ্য নেইম অব দ্য রোজ বইয়ের সাহায্য নিয়ে অনুবাদক টীকা-ভাষ্য, কালপঞ্জি, লাতিন, ফরাসি ও জামার্ন শব্দ, শব্দবন্ধ, বাক্য ও অনুচ্ছেদ ইত্যাদির বঙ্গানুবাদ সংক্ষিপ্তাকারে যোগ করেছেন।
অনুবাদের ভাষা যে খুব সহজ, তা বলব না তবে যথোপযুক্ত যা একজন বোদ্ধা পাঠককে পাঠে আগ্রহী করে তুলবে। সব বইয়ের ভাষা যদি সহজ আর সরলই হয়, তবে জটিলের তুলনা কার সাথে কেমন করে হবে? বইয়ে কোথায় কোথাও এমন বর্ণনা রয়েছে, যা একটানা পড়তে গিয়েও পাঠক ক্লান্ত হবেন না বরং একধরনের ছন্দোবদ্ধ দোলাচলের স্বাদ পাবেন। এ বইয়ে বাড়তি আরেকটি পাওনা হলো বইয়ের ভেতর আটটি রঙিন চিত্র, যার মাধ্যমে নীল প্যাকার ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলেকে রংতুলির ভাষা দিয়েছেন। বইয়ে বেশ কিছু ছাপাজনিত ভুল রয়েছে, আশা করি পরবর্তী এডিশনে অনুবাদক মনোযোগী হবেন।
গোলাপের নাম পড়ার পর যদি কোনো পাঠক চান তাঁর কল্পনাকে দৃশ্যমান রূপে দেখতে, সে ক্ষেত্রে দেখতে পারেন এই উপন্যাস নিয়ে বিখ্যাত পরিচালক জাঁ-জাক আনু পরিচালিত চলচ্চিত্রটি। যেখানে প্রধান চরিত্রের ভূমিকায় দেখা মিলবে শ্যন কনারির মতো ভুবনজয়ী তারকার।
পরিশেষে বলা যায়, গোলাপের নাম এমন একটি ইতিহাসনির্ভর রহস্য উপন্যাস, যা মূলত রহস্য উন্মোচিত হওয়ার পরও পাঠকের কাছে এর আবেদন কিংবা প্রয়োজন ফুরাবে না। কারণ, এটা উপন্যাসের পাশাপাশি চিহ্নবিজ্ঞান, ইতিহাস ও ভাষাতত্ত্বের অভিধানও বটে। আর অভিধানের প্রয়োজন কখনোই ফুরায় না, বারবার ফিরে আসতে হয়।
চমৎকার রিভিউ।বস্তুনিষ্ট নান্দনিক।
তোজাম হোসেন
নভেম্বর ০২, ২০২২ ০৮:৪৮