কিবরিয়া স্যার ও তাঁর ছবি সংগ্রহ
আজ এটা ভাবতে অবাক লাগে, বাংলাদেশের একজন প্রধান শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া-কিবরিয়া স্যার আমাদের ড্রয়িং শিক্ষক ছিলেন। তখন ১৯৫৩ সাল। তিনি ঢাকা নবাবপুর গভমেন্ট হাইস্কুলের ড্রয়িং টিচার। আমি তখন সেই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। দু-তিন বছর আমি তাঁকে ড্রয়িং শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম। একই স্কুলে আমার বড় দুই ভাই লুৎফর রহমান ও রেজাউর রহমান তখন সপ্তম ও পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তেন।
আমি স্কুলে কখনোই মনোযোগী ছাত্র ছিলাম না। ড্রয়িং ক্লাসে মোটেও না। তবে বড় ভাইয়েরা ভালো ছাত্র ছিলেন। খুব ভালো ড্রয়িংও করতেন দুজনই-দশে দশ নম্বর পেতেন স্যারের কাছে। তাঁদের ড্রয়িং খাতায় কিবরিয়া স্যারের নম্বরসহ স্বাক্ষর দেখতাম। বিশেষ করে বড় ভাই লুৎফর রহমানের সঙ্গে কিবরিয়া স্যারের একটা বিশেষ সখ্য গড়ে উঠেছিল। স্যার তাকে বীরভুমের দুমকায় আঁকা দুটি স্কেচ উপহার দিয়েছিলেন। সে দুটো দীর্ঘদিন আমাদের বাড়ির দেয়ালে টাঙানো ছিল। ’৭১ সালের পর ঢাকার বাড়িতে ফিরে কিবরিয়া স্যারের স্কেচ দুটি আর পাইনি।
সব সময় ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা ও কোলাপুরি স্যান্ডেল পরে স্কুলে আসতেন স্যার। গৌরবর্ণ এই মানুষটি স্কুলজীবনে আমাদের সামনে হাজির হয়েছিলেন এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে। আমরা তিন ভাই-ই তাঁর ব্যক্তিত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম। এমনকি তাঁর দেখাদেখি পরে আমরা সেই রকম পাঞ্জাবি, পায়জামা আর কোলাপুরি স্যান্ডেলও পরতাম পরে।
আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, ক্লাসে এসে কিবরিয়া স্যার ব্ল্যাকবোর্ডে আমাদের জন্য একটা কিছু এঁকে সেটা আঁকতে বলতেন। তারপর হাঁটতেন ক্লাসের ভেতর। কখনো কখনো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতেন। তবে কেউ দুষ্টুমি করলে হাতের চকটা দুই আঙুলের মধ্যে ধরে মাথায় ঠুকে দিতেন। আমি নিজেও এ শাস্তি পেয়েছি কখনো-সখনো।
আজকে এটা ভাবতে খুব অবাক লাগে যে পঞ্চম শ্রেণিতে থাকতে [১৯৫৫ সালে] কিবরিয়া স্যার আমাদের স্কুল ছেড়ে চলে গেলে ড্রয়িং টিচার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন আরেক খ্যাতিমান শিল্পী মুর্তজা বশীর। তিনি চটপট ক্লাসে ঢুকতেন, কথা বলতেন এবং সারাক্ষণ নিজের ড্রয়িং খাতায় ছবি আঁকতেন বসে বসে। এর প্রায় দুই বছরের মধ্যে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান সুদূর ইতালিতে। তারপর ড্রয়িং টিচার হয়ে আসেন আরেক বিখ্যাত শিল্পী কাজী আব্দুল বাসেত।
বাংলাদেশের তিনজন সেরা শিল্পীকে সেই স্কুলজীবনে কাছে পাওয়া—এটি আমাদের জন্য এক অসম্ভব স্মৃতিময় ঘটনা। মূলত পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন থেকে শুরু করে আনোয়ারুল হক, সফিউদ্দীন আহমেদ প্রমুখ এবং কিছু সময় পর মোহাম্মদ কিবরিয়া, দেবদাস চক্রবর্তী, মুর্তজা বশীর প্রমুখ ঢাকার বিভিন্ন স্কুলে ড্রয়িংয়ে শিক্ষকতা করেছেন।
মোহাম্মদ কিবরিয়ার জন্ম বীরভুমের সিউড়িতে—সেখানেই বেড়ে ওঠা, স্কুল ও ম্যাট্রিক পাস। তাঁর স্বপ্ন ছিল, তিনি শিল্পী হবেন। সে সময় তাঁর বীরভুম জেলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ওয়াজেদ আলী চৌধুরীর উৎসাহে তিনি কলকাতায় এসে আর্ট কলেজে ভর্তি হলেন। পাস করার আগেই ভারত ভাগ হয়ে গেছে। কলকাতায় শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করলেন, ১৯৫০ সালে।
১৯৫১ সালে দুজন বন্ধু শিল্পী সৈয়দ শফিকুল হোসেন ও বজলে মওলার সঙ্গে ঢাকায় বেড়াতে আসেন এবং সিউড়ি স্কুলের সেই প্রধান শিক্ষক ওয়াজেদ আলী চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। তখন তিনি সরকারি মুসলিম হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। ওয়াজেদ আলী চৌধুরী তাঁকে চাকরির প্রস্তাব দেন। তিনি সম্মতি জানান। তাঁর সাহায্যেই কিবরিয়া স্যার নবাবপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে শিক্ষকতায় যুক্ত হন। আর এভাবেই পশ্চিমবঙ্গের সিউড়ির মোহাম্মদ কিবরিয়া ঢাকার শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া হয়ে গেলেন এবং এখানেই তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়ের শুরু।
আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, ক্লাসে এসে কিবরিয়া স্যার ব্ল্যাকবোর্ডে আমাদের জন্য একটা কিছু এঁকে সেটা আঁকতে বলতেন। তারপর হাঁটতেন ক্লাসের ভেতর। কখনো কখনো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতেন। তবে কেউ দুষ্টুমি করলে হাতের চকটা দুই আঙুলের মধ্যে ধরে মাথায় ঠুকে দিতেন। আমি নিজেও এ শাস্তি পেয়েছি কখনো-সখনো
মনে পড়ে, কিবরিয়া স্যার চলে যাওয়ার পর ১৯৫৬ সালে [তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র] মুর্তজা বশীর স্কুলে ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা করেছিলেন। বিচারক হিসেবে এসেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া, দেবদাস চক্রবর্তী প্রমুখ। এটা বিস্ময়কর যে অনেক লজ্জা ও কুণ্ঠা নিয়ে প্যাস্টেলে আঁকা আমার ‘ক্রিকেট খেলার মাঠ’ ছবিটি স্কুলের সেরা ছবি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল।
অনেক কিছুর মধ্যে দুটি ঘটনা আজও আমার মধ্যে বিস্ময় জাগায়। একটি হলো, ১৯৫৬ সালে প্রেসক্লাবে তিন শিল্পী-সৈয়দ জাহাঙ্গীর, মুর্তজা বশীর ও কাইয়ুম চৌধুরীর ছবির প্রদর্শনী চলছিল। সেটি দেখতে গিয়েছিলাম। ১৯৫৭ সালে তখনকার বর্ধমান হাউসে [বর্তমানে বাংলা একাডেমি] সারা পাকিস্তানের সেরা শিল্পীদের ছবি নিয়ে একটি জাতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনী হয়েছিল। সেই প্রদর্শনীতে আমাদের শিল্পীদের পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানের এম এম চুঘতাই, আল্লা বক্স, শাকির আলি, জোবায়দা আগা প্রমুখের শিল্পকর্মও ছিল। সেটিও দেখতে গিয়েছিলাম, মনে পড়ে। এভাবে এত অল্প বয়সে শিল্পকলার সঙ্গে আমার মধ্যে একটি সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে এবং নিশ্চয়ই এর পেছনে কিবরিয়া ও বশীর স্যারদের প্রভাব ছিল।
১৯৫৭ সালে কিবরিয়া স্যার পাকিস্তানের সেরা শিল্পীর পুরস্কার পেয়েছিলেন। ছবিটি ছিল ‘গার্ল উইথ ফ্লাওয়ার [ফুলওয়ালী]’। কিবরিয়া স্যারের ‘জ্যোৎস্নালোকে অশ্বদল’ ছবিটি ১৯৫৯ সালে টোকিওর ইয়াং এশিয়ান আর্টিস্ট প্রদর্শনীতে বিশেষভাবে পুরস্কৃত হয়। ওই বছরই তিনি জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে টোকিওতে চলে যান।
টোকিওতে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সময় কিবরিয়া স্যারের শিল্পভাবনায় বড় পরিবর্তন আসে। বাস্তব শিল্পকলার জগৎ থেকে তিনি বিমূর্ত চিত্রকলার দিকে সরে যান। সেখানেই স্পেনীয় শিল্পী আন্তোনিও ক্লাব ও আন্তোনিও তাপিজের ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে যান কিবরিয়া স্যার এবং টোকিওতে থাকতেই তিনি বিমূর্ত রীতিতে ছবি আঁকতে শুরু করেন।
স্পেনীয় শিল্পীদের পাশাপাশি কিবরিয়া স্যারের চিন্তাজগৎ ও চিত্রকলার ভুবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল জাপানি বাগানগুলোর রং, রূপ ও তার অপূর্ব বিন্যাস। কিবরিয়া স্যার সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছিলেন, কিয়োটো শহরের কয়েক শ বছরের পুরোনো পাথর ও শেওলার বাগান তাঁর ভাবনাজগৎ, ছবির বিষয় ও ছবিতে রং প্রয়োগের ওপর ভীষণভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘ওই বাগানগুলোর কথা মনে হলে আজও আমি অন্য জগতে চলে যাই। পাথরের বাগানের অসীমের দিকে যাত্রা আর শেওলার বাগানের নৈঃশব্দ্য আমার ছবিতে ফিরে ফিরে আসে।’
ষাটের দশকের শুরু থেকে আমরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। সেই সুবাদে আমাদের পরিচয় ঘটে বৃহত্তর শিল্পীসমাজের সঙ্গে। এ সময় নানাভাবে নিজেদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আমরা অগ্রজ-অনুজ শিল্পীদের যুক্ত করি। এভাবে শিল্পী কামরুল হাসান, ইমদাদ হোসেন, রশীদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু, আবদুল মুকতাদির, মুস্তাফা মনোয়ার, প্রাণেশ কুমার মণ্ডল, রফিকুন্নবী, হাসান আহমেদ, আনোয়ার হোসেন, আবদুল মান্নান, বীরেন সোম প্রমুখ, এমনকি শিল্পী জয়নুল আবেদিনের সাহায্যও আমরা একাধিকবার পেয়েছিলাম।
১৯৬৪ সাল থেকে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে একুশের সংকলন প্রকাশের জন্য প্রচ্ছদ, কিছু ড্রয়িং বা অলংকরণ যুক্ত করতে আমরা শিল্পীদের কাছে গিয়েছি। যাঁদের প্রচ্ছদ পেয়েছিলাম, তাঁদের মধ্যে ছিলেন দেবদাস চক্রবর্তী, কাইয়ুম চৌধুরী, আবদুল মুকতাদির, প্রাণেশ কুমার মণ্ডল, হাশেম খান, হাসান আহমেদ প্রমুখ। এ ছাড়া সম্মেলনের পোস্টার ও আমন্ত্রণপত্র তৈরি, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মঞ্চ সাজানো ইত্যাদি নানা কাজের জন্য নিয়মিত যেতাম শিল্পীদের কাছে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কামরুল হাসান, ইমদাদ হোসেন, রশীদ চৌধুরী, নিতুন কুন্ডু, মুস্তাফা মনোয়ার, রফিকুন্নবী, গোলাম সারোয়ার প্রমুখের সাহায্য পেয়েছি। বিশেষ করে ১৯৬৯ সালে কাইয়ুম চৌধুরীর প্রস্তাবে দেশের সেরা ১১ জন শিল্পীর ড্রয়িং দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে একুশের স্মরণে নামে একটি সংকলন প্রকাশ করেছিলাম আমরা। পরের বছর আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের পক্ষ থেকে সেরা ১৪ জন শিল্পীর কাজের সঙ্গে সেরা ১৪ জন কবির কবিতাও ছাপা হয়েছিল একুশের সংকলনে। এই উদ্যোগের পেছনেও ছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী।
সেই সংকলনের জন্য বহু বছর পর প্রাক্তন স্কুলছাত্রের পরিচয় দিয়ে আমি কিবরিয়া স্যারের কাছে ছবি সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম। ১৯৬৯ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির সংকলনের জন্য কিছু না দিতে পারলেও ১৯৭০ সালের সংকলনের জন্য একটি লিথোগ্রাফ দিয়েছিলেন তিনি। তখন থেকেই কিবরিয়া স্যারের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ শুরু হয় এবং সেটা অব্যাহত ছিল তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত।
কিবরিয়া স্যার তখন থাকতেন নিউমার্কেটের পেছনে ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্রাবাসের দোতলা একটি ঘরে হাউস টিউটর হিসেবে। আরও একজন শিক্ষক শামসুল ইসলাম নিজামী থাকতেন তাঁর সঙ্গে একই ঘরে। সেই ঘরেই তাঁর থাকা-খাওয়া এবং ছবি আঁকা।
১৯৬৯ সালের সংকলনের জন্য কিবরিয়া স্যার আমাদের একটি ড্রয়িং দিলেন—একটা সাদার ওপর কালো প্রিন্টের মাঝে লেখা ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। এর পর থেকে আমি মাঝেমধ্যেই আর্ট কলেজের সেই হোস্টেলে যেতাম। নানা বিষয়ে গল্প হতো আমাদের। বিশেষ করে তখন স্যারের গভীর আগ্রহের ব্যাপার ছিল দেশজুড়ে চলমান ছাত্র আন্দোলন ও রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়। অনেক সময় বই নিয়েও কথা হতো। সেই ১৯৬৭ সালে বলিভিয়ায় গেরিলাযুদ্ধে চে গুয়েভারার মৃত্যুর পর আমরা গভীরভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। কিবরিয়া স্যারের মধ্যেও একটি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। আমার কাছ থেকে জলপাই রঙের কভারে চে গুয়েভারার বলিভিয়ান ডাইরি বইটি নিয়ে পড়েছিলেন স্যার। মনে পড়ে, সে সময় তিনি আমার কাছ থেকে আবু সয়ীদ আইয়ুবের আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ [প্রকাশকাল ১৯৬৮] বইটি পড়তে নিয়েছিলেন। কিবরিয়া স্যারের দৃঢ় অভিমত ছিল যে আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলার দুই প্রধান ব্যক্তি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অমৃতা শেরগিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতের পর ২৭ ও ২৮ তারিখে কিছু সময়ের জন্য কারফিউ তুলে দেওয়া হলে ২৮ মার্চ সকালে আমি কিবরিয়া স্যারের খোঁজে হোস্টেলে যাই। তারপর আজিমপুরে নিতুনদার বাসায় যাই। কাউকেই খুঁজে পাইনি। পরে কাইয়ুম ভাইয়ের বাসায় গিয়ে জানতে পারি কীভাবে অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে কিবরিয়া স্যার বেঁচে গিয়েছিলেন সে রাতে। সেই ২৫ মার্চ রাতে কিবরিয়া স্যার হোস্টেলেই ছিলেন।
১৯৬৯ সালে স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ ও যাওয়া-আসা শুরু হলেও তখনো ছবি সংগ্রহের বিষয়টি তেমন মনের মধ্যে ছিল না। সে সময় একদিন আমাকে বিস্মিত করে তেলরঙে আঁকা একটি ছবি উপহার দিয়েছিলেন কিবরিয়া স্যার। নিতুনদার অফিস থেকে সেটি একটি ফ্রেমে বাঁধাই করে বাসায় নিয়ে আসি। সেটাই ছিল আমার প্রথম ছবি সংগ্রহ। সেই ‘বসন্ত’ চিত্রকলাটাই এখনো আমার একটি সেরা সংগ্রহ।
স্বাধীনতার পর কিবরিয়া স্যারের সঙ্গে আমার যখন যোগাযোগ ঘটে, তখন তিনি বিয়ে করেছেন। থাকতেন ধানমন্ডির লেকের পাড়ে গাছগাছালির ছায়াঘেরা এক সুন্দর বাড়িতে। সেখানেও প্রায়ই যেতাম। সে সময় কিবরিয়া স্যার তেলরং, লিথোগ্রাফ ও এচিং, মিশ্র মাধ্যমে নানামুখী কাজ করতেন। তখন কোলাজও করেন।
আশির দশকের শুরুতেও তিনি আমাকে নিজে থেকে আরেকটা প্রিন্ট উপহার দিয়েছিলেন, যেটি জাপানে প্রদর্শিত হয়েছিল—‘অ্যাম্বার অ্যান্ড ইয়েলো’ শিরোনামে একটি লিথোগ্রাফ। মনে পড়ে, করাচির এক ক্রেতা ছিলেন, যিনি প্রতিবছর কিবরিয়া স্যারের আঁকা ছবি সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন। স্যারের শুরুর জীবন থেকেই সব পর্বের ছবি তাঁর রয়েছে। দেশে ও বিদেশে বাঙালিদের মধ্যেও এমন অনেকে ছিলেন।
মনে পড়ে, আশির দশকের মাঝামাঝিতে কলকাতায় যাওয়ার সুযোগ হয় আমার। সেখানেও অনেক চিত্রশিল্পীর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। এই সময়কালেই আমি বাংলাদেশ বা কলকাতার অনেক শিল্পীর কিছু কিছু ছবি সংগ্রহের উদ্যোগ নিই। একবার কলকাতা থেকে ফিরে আসার সময় কিবরিয়া স্যারের জন্য সেখানকার বিখ্যাত জেসি লাহার রঙের দোকান থেকে কিছু তেলরং ও এক রোল ক্যানভাসও এনে দিয়েছিলাম।
সেই সময় থেকেই স্যারের বাসায় যাওয়া-আসা বাড়ে। সেই সুবাদে স্যারের ছোট-বড়-মাঝারি নানা ধরনের পরীক্ষামূলক কাজ দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেসব থেকে কখনো কখনো স্বল্প মূল্যে বা কোনো একটা নির্ধারিত মূল্যে কিছু ছবি আমি সংগ্রহ করেছি। আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল স্যারের ছোট ছোট পরীক্ষামূলক কাজগুলোর দিকে। বেশি বড় ছবি অথবা তেলরঙের ছবির মূল্য বেশি ছিল বলে তাঁর কাছ থেকে সেগুলো সংগ্রহ করার তেমন সৌভাগ্য হয়নি। তেমন চেষ্টাও করিনি।
এখানে স্যারের দুটি বড় ছবি সংগ্রহের ঘটনা স্মরণ করতে পারি। ২০০৫ সালে আমি ফিলিপাইন থেকে সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও সৃজনশীল যোগাযোগের স্বীকৃতি হিসেবে র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পাই। ঢাকায় ফিরে একদিন দেখা করতে যাই আমার খুবই ঘনিষ্ঠজন নাভানা শিল্প ও বাণিজ্য গ্রুপের চেয়ারম্যান শফিউল ইসলাম কামালের সঙ্গে। তিনি আমাকে দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন সেদিন। তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘকালের সখ্য-যখন আমি ভিক্টোরিয়া ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট খেলি, সে সময় থেকে।
সেদিন তাঁর অফিসে অনেক গল্প হয়। তাঁর অফিসকক্ষে কিবরিয়া স্যারের আঁকা বড় দুটি ছবি দেখি। আমার আগ্রহ দেখে কামাল ভাই ছবি দুটি আমাকে উপহার হিসেবে দেন। এভাবে কিবরিয়া স্যারের দুটি বড় ছবি আমার সংগ্রহে আসে—একটি তেলরং, আরেকটি অ্যাক্রেলিকের কাজ।
আমাদের বন্ধু মুনীর ও জহীর ‘গ্যালারি চিত্রক’-এর ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করেন। তাঁরা কিছু প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। সেখান থেকেও আমি কিবরিয়া স্যারের কিছু ছবি সংগ্রহ করেছি। একবার একটি ড্রয়িং এবং আরেকবার একটি জলরঙের প্রদর্শনীতে কিবরিয়া স্যারকে অংশ নিতে উৎসাহিত করেছিলাম। সেই দুই প্রদর্শনী থেকে সংগ্রহ করেছিলাম স্যারের দুটি স্টিল লাইফ ও একটি ড্রয়িং। প্রদর্শনী থেকে কিবরিয়া স্যার ছাড়াও শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ, কাইয়ুম চৌধুরী ও রফিকুন্নবীর স্টিল লাইফ ও ড্রয়িং সংগ্রহ করেছিলাম।
১৯৫৭ সালে কিবরিয়া স্যার পাকিস্তানের সেরা শিল্পীর পুরস্কার পেয়েছিলেন। ছবিটি ছিল ‘গার্ল উইথ ফ্লাওয়ার [ফুলওয়ালী]’। কিবরিয়া স্যারের ‘জ্যোৎস্নালোকে অশ্বদল’ ছবিটি ১৯৫৯ সালে টোকিওর ইয়াং এশিয়ান আর্টিস্ট প্রদর্শনীতে বিশেষভাবে পুরস্কৃত হয়। ওই বছরই তিনি জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে টোকিওতে চলে যান। টোকিওতে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সময় কিবরিয়া স্যারের শিল্পভাবনায় বড় পরিবর্তন আসে। বাস্তব শিল্পকলার জগৎ থেকে তিনি বিমূর্ত চিত্রকলার দিকে সরে যান
আরেকটি ব্যাপারে কিবরিয়া স্যারের খুব আগ্রহ আছে দেখতাম। সেটি হলো ছোট-বড় নানান ধরনের কোলাজ। কাজগুলো যেকোনো বিবেচনায় খুব উচ্চ মানের ছিল। কোলাজগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের দুঃখ-বেদনা বা সামাজিক ক্ষয়—এগুলোকে সামনে নিয়ে আসতেন। ১৯৯৬ সালে আককু চৌধুরীর এক প্রদর্শনীতে আমি স্যারের প্রথম কোলাজ সংগ্রহ করেছিলাম। সর্বশেষ ২০০৮ সালে স্যারের বাসা থেকে পুরোনো কাগজ ছিঁড়ে ছিঁড়ে শক্ত বোর্ডে লাগিয়ে তৈরি করা দুটি বড় কোলাজ Decay [ক্ষয়] সংগ্রহ করেছিলাম।
কখনো কখনো স্যারের বাসায় গিয়ে দেখতাম, তিনি কোনো একটি ছবি আঁকছেন, যেটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে। স্যারকে বলতাম যে এটা আমি নিতে চাই। আঁকা শেষ হয়ে গেলেই সঠিক মূল্য দিয়ে ছবিটা নিয়ে আসতাম। অনেক সময় নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও হয়তো কিছু কম অর্থ রেখেছেন স্যার। আবার এমনও হয়েছে যে দু-একটা ছবি নেওয়ার পর মনে হয়েছে এটা ঠিক ভালো লাগছে না, আরেকটু কাজ করলে ভালো হতো। অনুরোধ করলে স্যার সেটা আমার জন্য করে দিয়েছেন নতুনভাবে। মনে পড়ে, এই সময়কালে, বলা যায়, শেষ কয়েক বছর স্যার নানা ধরনের ছোট ছোট নিরীক্ষামূলক কাজ করেছেন। সেগুলো বাইরে কোথাও প্রদর্শিত হয়নি বলে আমার ধারণা। তেমন কিছু কাজ আমি সংগ্রহ করতে পেরেছি স্বল্প মূল্যে। সেগুলো আমার কাছে স্যারের সেরা কাজগুলোর অন্যতম বলে মনে করি। এটা আমার সৌভাগ্য।
ছবির অর্থমূল্যের ব্যাপারে কিবরিয়া স্যারের খুব একটা আকর্ষণ কাজ করত না। এমন মনে হতো যে বিষয়টিতে লজ্জা পান। দুই সন্তান বিদেশে পড়াশোনা করছে, এমন নানা কারণে তাঁর জীবনেও অর্থের প্রয়োজন ছিল—কিন্তু অর্থটাকেই তিনি জীবনের প্রধান লক্ষ বলে দেখেননি। প্রয়োজনে হয়তো প্রদর্শনী করেছেন। সরকারি পর্যায়ে বিদেশে প্রদর্শনীর জন্য ছবি নিয়ে গেছে, যা তিনি অনেক সময় ফেরত পাননি, কোনো টাকাও পাননি। তবু এ নিয়ে কখনো অনুশোচনা করেননি স্যার। কোনো সময় আর্থিক সমস্যায় পড়লে আমি স্যারের বেশ কিছু তেলরং, লিথোগ্রাফ বা এচিং বিক্রি করে দিয়েছি বন্ধু বা পরিচিতজনদের কাছে।
আসলে কিবরিয়া স্যারের জীবনের শেষের দিকে তাঁর সঙ্গে আমার অনেক বেশি যোগাযোগ, মেলামেশা ও একসঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। সে সময় স্যার তেমন ছবি আঁকতেন না। তখন নানা সময়ে জমে থাকা স্যারের কিছু পুরোনো ছোট পরীক্ষামূলক কাজ আমি তাঁর কাছ থেকে সংগ্রহ করি। এই সময়কালে স্যারকে মাঝেমধ্যেই হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হতো। একবার চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যেতে সহযোগিতা করেছিলাম, মনে পড়ে। বাসায় থেকেও অক্সিজেন নিতে হতো। এ ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করত আমার ছোট ভাই ডা. জাকিউর রহমান। হাসপাতালে থাকাকালেও স্যারের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। সে সময় শিল্পকলা ও শিল্পীদের নিয়ে অনেক কথা হতো আমাদের মধ্যে। একটা বিষয় লক্ষ করেছি, আলোচনায় জয়নুল আবেদিন তো অবশ্যই, কামরুল হাসানের শিল্পকলা, রশীদ চৌধুরীর কাজে লোকশিল্পের প্রভাব, রফিকুন্নবীর জলরং ও কাঠ খোদাইয়ের কাজ এবং শিশির ভট্টাচার্য্যের ড্রয়িংয়ের খুব প্রশংসা করতেন স্যার।
সুস্থ থাকাকালে বা যখন একটু একটু করে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন—কখনোই কাজ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখেননি কিবরিয়া স্যার। ছোট নানা মাধ্যমে নানা ধরনের পরীক্ষামূলক কাজ করে গেছেন। একদম শেষ দিকে ভেষজ তেলরং বা প্লাস্টিক রঙে কিছু কাজ করতে দেখেছি তাঁকে। ছোট ছোট কিছু দারুণ কোলাজ বা জলরঙে কাজ করেছেন। কী যে ভালো সেসব কাজ, কী যে অপূর্ব! কিছু কাজের নমুনা আমি সংগ্রহ করেছিলাম।
এক দশকের বেশি সময় ধরে কিবরিয়া স্যার আমাদের মধ্যে নেই। তারপরও স্যারের কথা বা কোনো না কোনো স্মৃতি প্রতিদিন ফিরে ফিরে আসে মনের গভীরে। কত কিছু যে মনে হয়! শুরুর স্কুলজীবনের স্মৃতি যেমন মনে পড়ে, তেমনি পরের দশকের সময়গুলো, বিশেষ করে শেষের কয়েক বছরের কথা আর গল্পগুলো বা ছোট-বড় কোনো না কোনো ছবি সংগ্রহের সময়ের স্মৃতিগুলো বড় বেশি করে বাজে হৃদয়ে। একজন মানুষ কতটা নরম, কতটা স্বল্পভাষী, কতটা সৌজন্যবোধসম্পন্ন বা কতটা আধুনিক চিন্তার মানুষ হতে পারেন, কিবরিয়া স্যার ছিলেন এসবের মিলিত প্রতীক। আজীবন অবিশ্বাস্য একজন স্নেহশীল শিক্ষক পেয়েছিলাম, যিনি ছিলেন বন্ধুর মতো, আবার অগ্রজ অভিভাবকের মতো। স্যারের স্মৃতি কোনো দিন সামান্য একটুও ম্লান হবে না, দূরে সরে যাবে না। কিবরিয়া স্যারকে নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ইংরেজি আর্ট অব বাংলাদেশ সিরিজের মোহাম্মদ কিবরিয়া বইটি স্যার নিজে আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘আমার প্রিয় ভক্ত/ মতির জন্য এই বইটি’। সত্যি, স্যারের ভক্ত ছিলাম, ভক্ত আছি, আমৃত্যু ভক্ত থাকব।
Splendid narration. Very well written memory on painting collection of artist Mohammad Kibria.
Nasir Ali Mamun
এপ্রিল ০৩, ২০২২ ১০:২২