মিতালিকে লেখা চিঠিগুলো

 

মিতালির কাছে চিঠিটা তখনো পৌঁছায়নি। পৌঁছাবার কথাও নয়, চিঠিটা লেখা শেষ করেনি চৈতালি। চৈতালি এখনো লিখছে। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে মিতালি অপেক্ষা করছে।

চৈতালি দরজা খুলছে না। রাতেও খোলেনি। তখন অবশ্য মিতালি ওকে দরজা খুলতে জোর করেনি। বন্ধ দরজার পাশে মিনিট পনেরো দাঁড়িয়ে ছিল। চৈতালির নাম ধরে ডেকেছে মিনিটে অন্তত দশবার। একটা সময়ে ওর পা জোড়া আর দাঁড়ানোর ভার নিতে পারছিল না। তাই অন্য ঘরে চলে গিয়েছিল। অন্য ঘর বলতে ওর মায়ের ঘর। মিতালির বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই ওটা ওর মায়ের ঘর। মিতালির মা মিনারা ঘরে থাকেন না বেশিক্ষণ। রান্নাঘরেই তার সময় কাটে। নিজের শোবার ঘরে কারও অযাচিত প্রবেশ নিয়ে বিরক্ত না হলেও কেউ হুট করে রান্নাঘরে ঢুকে পড়লে মিনারা বিরক্ত হয়। আজও হবে হয়তো।

নন-স্টিক ফ্রাইপ্যান থেকে কাঠের চামচ দিয়ে তরকারির ঝোল তুলে তালুতে রেখে লবণ পরখ করছেন মিনারা। কারও পায়ের শব্দ পেয়েছেন বলে মিনারা মাথা না ঘুরিয়েই বলেন, চৈতালি, কী খাবি দুপুরে?

মায়ের প্রশ্ন শুনে মিতালির ভ্রু কুঁচকে ওঠে। এখনো মা আগের মতো পক্ষপাতিত্ব করেন। মা খুব ভালো করেই জানেন, এভাবে স্বেচ্ছায় কখনোই চৈতালি রান্নাঘরে আসবে না, তবু ওর নামটা উচ্চারণ করতেই হবে তার! কেন! মা কি বলতে পারতেন না, কে? মিতালি? এত দিন পরে এলি, কী খাবি বল।

প্রিয় মিতালি

অনেক দিন পরে এসেছিস। চৌদ্দ দিন পর। তুই এলে আমি টের পাই। ঘরের দরজা বন্ধ থাকলেও বাতাস তোর শরীরের সুগন্ধি ফ্লাওয়ার বোম্ব আমার ঘর অব্দি ঠিকই টেনে নিয়ে আসে। আজ সুগন্ধি কয়েক ফোঁটা বেশিই পড়েছিল বুঝি, তুই চলে যাওয়ার পরেও তোর সুঘ্রাণ আমার ইন্দ্রিয়সকল ঘায়েল করে বসে আছে। অবশ্য তুই যেখানেই যাস এভাবেই তোর রূপ, ঘ্রাণ, কথা, ব্যক্তিত্ব সবার মস্তিষ্কের কোষে কোষে গেঁথে যায়।

মনে আছে তোর? বাবা মারা যাওয়ার দিনের কথা? তুই বাবার ঘড়িটা হাতে নিয়ে ঠোঁট চেপে চেপে কাঁদছিলি? আমি আর মা-ও কাঁদছিলাম। আমাদের আকুল করা কান্নার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছিল না কেউ। ওদিকে তোকে কতভাবে যে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছিল সবাই। যেন তুই কাঁদলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অহেতুক প্লাবন আসবে। তাই হয়, তুই কাঁদলে জগৎ ডুবিয়ে প্লাবন হয়, তুই হাসলে মরাটে মেঘ সরে আকাশে সাতরং ভাসে।

হাসছিস মিতালি? ভাবছিস চিঠি লেখার নাম করে এত সব আগডুম-বাগডুম শোনাচ্ছি কেন?

মনে আছে মিতালি? কে তোকে প্রথম চিঠি লিখতে শিখিয়েছিল? ডিসেম্বরের ছুটির আনন্দের কথা জানিয়ে বন্ধুর কাছে একটি চিঠি লিখোএই ছিল তোর বাড়ির কাজ। আমি পুরো চিঠিটা একটানা বলে গেছি, তুই লিখেছিস। বানানে ভীষণ রকম সমস্যা ছিল তোর। ষ-ত্ব বিধান, ন-ত্ব বিধান কিছুই মানার চেষ্টা ছিল না। মনে আছে তোর? তুই সব সময় হ্রস্ব ই-কারের জায়গায় দীর্ঘ ই-কার আর দীর্ঘ ই-কারের জায়গায় হ্রস্ব ই-কার দিতি? আর এখন তুই সব কিছুতে পারফেক্ট। আর বানানে-ব্যাকরণে পারফেক্ট থাকা চৌকস আমি কিছুতেই পারফেক্ট থাকতে পারলাম না।

 

শাড়ির কুঁচিগুলো আজ এত বিচ্ছিরি হয়েছে, রায়হান কিছুতেই কুঁচি গোছাতে পারছিল না। সময় নেই বলে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এসেছে মিতালি, কুঁচি আর ঠিক করা হয়নি। ভেবেছে, আজকের দিনটা এভাবেই যাক। কিন্তু এইচ আর ডেস্কের ফাহমিদার কিনা আজই ছবি তোলার এমন তাল উঠল, গাদি গাদি ছবি তুলল। তুলবেই তো, নিজে যে বেশ সেজেগুজে এসেছে আজ। মিতালি যতই বলে, অর্ধেকটা ছবি নাও ফাহমিদা, কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত সে পূর্ণাঙ্গ ছবিই তুলে চলে। এরপর বেছে বেছে যেই ছবিগুলোতে মিতালিকে অপেক্ষাকৃত অসুন্দর দেখাচ্ছে, সেই ছবিগুলোই কিনা ফেসবুকে পোস্ট করেছে। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে মিতালির। ফাহমিদার ওপর থেকে রাগ সরে এখন রায়হানের ওপর রাগ হচ্ছে। এত বছর হয়ে গেল, এখনো ঠিক করে কুঁচি ধরতে শিখল না লোকটা।

শিখবে কী করে, মন দিলে তো শিখবে। এসব নিয়ে কিছু বলাও যাবে না, সারাক্ষণ ন্যাকা ন্যাকা ভাব ধরে থাকতে হবেভাবলেই মিতালির মেজাজ আরও চড়া হয়ে ওঠে। এর চেয়ে বরং ওয়াশরুমে গিয়ে শাড়িটা ফের পরে আসা ভালো। কিন্তু কুঁচিতে ভাঁজ পড়ে গেছে, এখন যতই ঠিক করো কিছুতেই ঠিক হবে না। ভাবনাটার দার্শনিক গভীরতা মেপে মিতালির ন্যুড লিপস্টিক ছোঁয়ানো ঠোঁটজোড়া বিস্তৃত হয়ে ওঠে। হু, একবার কিছুতে ভাঁজ পড়ে গেলে, পরে যতই ঠিক করো কিছুতেই ঠিক হবে না!

প্রিয় মিতালি

আজ তোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। হলুদ-সাদা তাঁতের শাড়ির আলিঙ্গনে তোর হলুদ বরণ ত্বক আরও হলুদ হয়ে উঠেছিল। দুধে কাঁচা হলুদ বাটা গুলে যেই রংটা তুই ঘাড়ে-মুখে লাগাতি, ঠিক সেই রং। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে তোকে পলকহীন দেখেছি, তুই আমাকে দেখিসনি। এমনও হতে পারে, দেখেও দেখিসনি। জানিস, তোর কাছ থেকে এমন গা ছাড়া অভিব্যক্তি শিখতে ইচ্ছে করে খুব। কিন্তু আয়োজন করে কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গেলেই আমার কণ্ঠস্বর কর্কশ হয়ে ওঠে। যাকে বোঝাতে চাই সে ভ্রু কুঁচকে দূরে সরে যায়। রায়হানও সরে গেছে।

শাড়ি পরলে তোকে সুন্দর দেখায়এ কথা নিশ্চয়ই রায়হান রোজই বলে তোকে। রায়হান কিন্তু খুব ভালো করে শাড়ির কুঁচি ধরতে পারে। প্রথম যেদিন শাড়ি পরে ভার্সিটিতে গিয়েছিলাম, রায়হান বলেছিল, অমন জবুথবু করে রেখেছ কেন কুঁচিগুলো? কুঁচি দিতে জানাও একটা শিল্প, জানো? এ কাজ যেমন-তেমন করে হয় না।

আষাঢ় পালানো শ্রাবণের প্রথম দিন ছিল সেটা। সেদিনের সেই মোলায়েম দুপুরে রায়হানের মেসে প্রথমবারের মতো এই শিল্পের হাতেখড়ি হয়েছিল আমার। কী? এ কথা শুনে রাগ হচ্ছে? হতেই পারে, রায়হান এখন তোর শাড়ির কুঁচি ঠিক করছে ভাবলে আমারও এমন রাগ হয়।

 

চৈতালির শ্যামলা রঙা ত্বক দুধসাদা হতে শুরু করায় ওকে বিয়ে করেনি রায়হান। মিতালি জানে এর পেছনে ওর কোনো ভূমিকা নেই। তবু বড় বোনের সাবেক প্রেমিকের সঙ্গে মিতালির বিয়ে হওয়ায় মা থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশীরা কদিন ওর দিকে বেশ আড়চোখে তাকিয়েছে। মিতালি ওসব পরোয়া করার মেয়ে নাতা অন্য সবার মতো চৈতালিও জানে। সব জেনে-বুঝেও ওকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করায় রোজ। মিতালি এই বাড়িতে এসেছি টের পেলে ও ঘরের দরজা পর্যন্ত খোলে না। কথাটা ভুল হলো। চৈতালি এখন কারও জন্যই দরজা খোলে না।

মা টেবিলে খাবার দিতেই মিতালি আরও একবার ওকে ডেকে এসেছে। এর মধ্যে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেছে। বিশ্রী একটা গ্রাম্য অন্ধকার জুড়ে বসেছে ঘরে। বাতাসও ছুটেছে আচমকা। ঝড়-বৃষ্টির এমন অন্ধকার রাতে চৈতালির ভয় করে। একবার বেশ্যা ভেবে রাস্তায় পুলিশ আটকেছিল ওকে। হন্যে হয়ে ছুটেও কোনো রিকশা না পেয়ে একটা দোকানের শেডের নিচে ও সেই রাতে আশ্রয় নিয়েছিল। সরকারি পোশাক পরা বিশালদেহী লোকটাও আশ্রয় নিয়েছিল। চৈতালিকে দেখে বিশ্রী সব প্রশ্ন করতে শুরু করেছিল লোকটা। সেদিন এক বন্ধুর বাসা থেকে ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছিল ওর, বন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দাওয়াত ছিল। অনুষ্ঠানে যাচ্ছে বলে সেজেছিল চৈতালি। ঠোঁটে গাঢ় শেডের লিপস্টিক দিয়েছিল, চুমকি-পুঁতির কাজ করা জমকালো কামিজে ওকে নাকি অপূর্ব দেখাচ্ছে, বলেছিল বাবা। আর ওই লোকটা বলেছিল, বেশ্যার সাজ। ওর চেহারাও নাকি বেশ্যার মতো।

চৈতালি এমন ঝড়-বৃষ্টির রাতে ভয় পায় জানে মিতালি। আজ মিতালিরও ভয় ভয় করে। ঘরের জানালার পাল্লা চৌকাঠে বাড়ি খেতেই শিরদাঁড়া শিরশির করে ওঠে ওর। পরক্ষণেই ভয়-শঙ্কা সব উধাও হয়ে দুই ভ্রুর মাঝখানে একরাশ বিরক্তি এসে জমা হয়। আজকাল চৈতালি বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি শুরু করেছে, পোশাকি ভদ্রতাটা আর চালু রাখা যাচ্ছে না।

প্রিয় মিতালি

জানিস মিতালি, অন্ধকারে আমিও এখন আলো হয়ে ফুটে থাকি, তুই যেমন করে ফুটে থাকতি ঠিক তেমন। বোন বলে লজ্জায় কাউকে বলতাম না, ছোটবেলায় তোর অমন দুধ ধোওয়া গায়ের রং দেখলে এত কষ্ট হতো আমার। ইচ্ছে করত তোর অমন সুন্দর মুখটা আগুনে পুড়িয়ে দিই।

মনে আছে তোর? একবার পড়ার ঘরের জানালা দিয়ে তোর গায়ে কেউ জ্বলন্ত কাঠ ছুড়ে দিয়েছিল? তুই কি জানিস, কাজটা কে করেছে? জানবি কী করে, টিভির সামনে বসলে তো তোর হুঁশ থাকত না। সেদিনও তুই ওই চৌকো বাক্সের রঙিন দৃশ্যাবলিতে মগ্ন ছিলি। বিজ্ঞাপন বিরতি না হলে হয়তো ওই মুহূর্তে তুই বসার জায়গা ছেড়ে উঠতিই না, আর আগুনটা ঠিক ঠিক উড়ে গিয়ে তোর চোখে-মুখে লাগত।

তুই না জানলে কী হবে, বাবা জানত। সেদিন বাবা তোকে রেখে বিকেলে আমাকে নিয়ে বেরিয়েছিল। যা যা খেতে চেয়েছিবাবা সব কিনে দিয়েছে। আমি প্রথমে বুঝতেই পারছিলাম না কেন বাবা এত আদর করছে আমাকে। ফেরার সময় রিকশায় বসে আছি, রোদের তাপে হাওয়ায় আগুন লেগে যাচ্ছে। বাবা হুড টেনে আমার হাতে হাত রেখে কোমল স্বরে বলল, আর এমন করিস না মা। কে বলেছে তুই সুন্দর না? তুই-ও সুন্দর। এই সৌন্দর্য অন্তরের।

বাবার কথা শুনে এত লজ্জা পেয়েছিলাম আমি, জানিস মিতালি, বারবার মনে হচ্ছিল, আমার জন্য বাবা কী নির্লজ্জের মতো মিথ্যাই না বলছে!

 

সবাইকে অবাক করে দিয়ে একদিন চৈতালি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সময়টা তখন রাত, আষাঢ়ের বৃষ্টির সঙ্গে রিলে রেসে হাওয়া ছুটছে। হাওয়ার ঝাপটায় অন্ধকার গহ্বরের মুখ খোলার মতো আচমকা চৈতালির ঘরের দরজার কপাট দুধারে সরে যায়। মিতালি, মিনারাকে আরও অবাক করে পেছনে অন্ধকার ফেলে আলোর মতো এগিয়ে আসে চৈতালি। ভুল দেখছে ভেবে মিনারা ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে যেতে গিয়ে শাড়িতে পা বেঁধে হোঁচট খেতে খেতে দরজার পাল্লায় মাথা ঠুকে দেয়। মিতালি থির দাঁড়িয়ে থাকে। অবাক হয়ে দেখে, চৈতালির মাথায় হিজাব নেই, গায়ে বোরকাও নেই। ওর পরনে ফিনফিনে সাদা শাড়ি। ওর শ্বেতশুভ্র দেহে পরিপাটি কুঁচি পরা শাড়িটা মোলায়েম মেঘের মতো লেগে আছে। যেন রায়হানের হাত পড়েছে কুঁচিতে।

হঠাৎ বিহ্বল হয়ে ওঠে মিতালি, যেন প্রমত্ত ঢেউয়ের ধাক্কায় মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে। নিজেকেই পুনঃপুন প্রশ্ন করে, আজ কি এই বাড়িতে রায়হান এসেছিল?

মিতালিকে আরও অপ্রস্তুত করে ওর দিকে এগিয়ে এসে এক তোড়া কাগজ এগিয়ে দিয়ে চৈতালি বলে, এই নে। মিতালি হাত বাড়াতে না বাড়াতেই দুরন্ত হাওয়া এসে চিঠিগুলোকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়। চৈতালি হাওয়ার সঙ্গে ভাসতে ভাসতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ওদিকে হতবিহ্বল মিতালি উড়ন্ত চিঠিগুলোর পিছু পিছু ছুটতে থাকে।