গোল্ডলিফ টু ডানহিল

 

ওয়ার্কশপে বাইকটা রেখে মুখ থেকে মাস্ক সরালাম। মাত্র সিগারেট ধরিয়েছি, দীর্ঘ শরীর নিয়ে এক লোক আমার পাশে এসে দাঁড়াল। লম্বায় সাড়ে ছয় ফুটের কম নয়। বিচিত্র তার বেশভূষা। সাদা রঙের লুঙ্গি পরা, ওপরে বটল গ্রিন টি-শার্ট। মাথায় গামছার মতো কিছু একটা পেঁচানো। স্কার্ফও হতে পারে সেটা। জিনিসটা কি ফ্যাশনের অংশ হিসেবে মাথায় বেঁধেছে সে? হতে পারে। সমস্যা হলো, লোকটাকে ঠিক ফ্যাশনসচেতন বলেও মনে হচ্ছে না। ফ্যাশন নিয়ে যারা ভাবে, তারা লুঙ্গি পরে রাস্তায় নামে না।

লোকটার হাতে চায়ের কাপ। আমাকে চোখ দিয়ে কিছুক্ষণ মেপে নিয়ে সে বলল, তুই সায়েম না?

আমি ঘাড় বাঁকা করে তার চেহারাটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম। কালো একটা মাস্ক দিয়ে মুখ ঢাকা। করোনাকালে এই হয়েছে এক জ্বালা। মুখে মাস্ক থাকায় চেনা লোককেও প্রায় অচেনা মনে হয়। অবশ্য আমি যার কথা বলছি, তাকে লোক না বলে ছেলেও বলা যায়। বয়স ২৫ হতে পারে, আবার ৩৫ হলেও বেশ মানিয়ে যাবে। হ্যাংলা-পাতলা নয়। স্বাস্থ্য বেশ ভালো। যতটা ভালো হলে সাড়ে ছয় ফুট লম্বা কাউকে দানব মনে হতে পারে, ঠিক ততটা ভালো।

সে আমাকে তুই বলে সম্বোধন করছে। তার মানে, পরিচিত বন্ধুবান্ধব কেউ। কিন্তু আমার চেনা-পরিচিতের মধ্যে এ রকম ছয় ফুটি দানব কেউ আছে বলে মনে করতে পারলাম না।

সে লুঙ্গি পরে রাস্তায় নেমে এসেছে, হাতে চায়ের কাপ। তার মানে, বাসা আশপাশেই কোথাও হবে। বিকেলবেলা ঘরের পোশাকে ক্যাজুয়ালি বাসা থেকে বেরিয়েছে। মোড়ে দাঁড়িয়ে চা-সিগারেট খাচ্ছে। স্মৃতি হাতড়ে বের করার চেষ্টা করলাম বাংলামোটর এলাকায় আমার কোন বন্ধুর বাসা।

নাকের ওপর থেকে মাস্কটা নামিয়ে সে চায়ের কাপে সুড়ুত সুড়ুত করে দুটো চুমুক দিয়ে বলল, সায়েম, চিনতে পারতেছিস না আমাকে?

এবার চিনলাম। এ হলো শিবু। ওয়ান অ্যান্ড অনলি শিবুতি রায়।

সাধারণত গল্প-উপন্যাসে এ রকম ছেলেবেলার বন্ধুর সাথে রাস্তাঘাটে দেখা হয়ে যায়। তখন সেই উপন্যাসের ক্যারেকটাররা বাড়াবাড়ি রকমের আবেগ দেখায়। আমি সেই লাইন ফলো করলাম। গলায় যথাসম্ভব আবেগ ফুটিয়ে তুলে বললাম, শিবু, তুই! মাই গড! দাঁড়া দাঁড়া...। কোথা থেকে? ক্যামনে কী? কান্ট বিলিভ!

সামাজিক দূরত্বের তোয়াক্কা না করে শিবু আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোর সমস্যাটা কী? আমার সাথে ইংলিশে কথা বলতেছিস ক্যান? মাই গড, কান্ট বিলিভএইগুলো কী কথা! থাপ্পড় খাবি কিন্তু!

আমি আন্তরিকভাবে হাসার চেষ্টা করে বললাম, ভালো আছিস?

সে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আমি ভালো। তুই কেমন আছিস, তা-ই বল।

ভালোই। কত বছর পর দেখা হলো বল তো?

মিনিমাম ১৫ বছর, শিবু বলল।

আমি মনে মনে হিসাব করে দেখলাম, ১৫ বছরের কম নয়। ক্লাস নাইনের শুরুতেই আমার বাবার ট্রান্সফার হয়। কুষ্টিয়া ছেড়ে আমরা জামালপুর চলে যাই। ২০০৩-এর কথা। মাঝখানে ১৭-১৮ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু শিবুর চেহারা খুব বেশি বদলায়নি। সরল দুষ্টুমিতে ভরা মুখটা একই রকম আছে।

শিবু বলল, এই দিকে কোথায় আসছিলি?

আসলে এই দিকে আসি নাই, বললাম আমি, মিরপুর যাচ্ছিলাম। রাস্তার মধ্যে বাইকের স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল বারবার। তাই ভাবলাম, ঠিক করায়ে নিয়ে যাই।

ভালো হইছে বাইকে প্রবলেম হয়ে।

ভালো হইছে!

প্রবলেম হইছে বলেই তো তোর সাথে দেখা হয়ে গেল? কোনটা তোর বাইক?

এই গ্যারেজে যে বাইকটা দেখে তোর মনে হবে, এই অখাদ্য জিনিসটা কে চালায়, সেটাই আমার বাইক। খুঁজে বের কর। তোর জন্য এটা একটা পরীক্ষা।

শিবু তীক্ষ্ণ চোখে বাইকগুলো দেখল কিছুক্ষণ। আমি মুখে একটা হাসি ধরে রেখে শিবুর চোখ দুটো অনুসরণ করলাম। পরপর দুটো বাজাজ পালসার। গায়ে গা লাগানো। তার পাশে একটা ইয়ামাহা এফ জি। লাল গেঞ্জি পরা এক মেকানিক সেই বাইক ঠিক করছে। এরপর দুটো সুজুকি জিক্সার। একদম পেছনে একটা হোন্ডা সিবিআর-১৫০। আমার ভাঙাচোরা হিরো স্প্ল্যান্ডার একদম ডান দিকের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো। মেকানিক কার্বুরেটরের ময়লা পরিষ্কার করছে। শিবু সেদিকে তাকিয়ে বলল, ওই লাল রঙেরটা?

হুম্‌, আমি বললাম।

বাইকের অবস্থা তো খুবই খারাপ!

খুবই!

সময় লাগবে তো মনে হয় ঠিক করতে!

তা একটু লাগবে।

চা খাবি?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, না রে। গরম লাগতেছে। এখন খাব না।

হুম্‌, শিবু বলল, হেব্বি গরম পড়ছে। চল, আমার সাথে চল।

কোথায়?

কোথায় আবার? আমার বাসায়। এই গ্যারেজে দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি গরমের মধ্যে?

আজ না দোস্ত। পরে একদিন। আমার একটা দরকারি কাজ আছে মিরপুরে। বাইকটা ঠিক হলেই চলে যাব।

শিবু আমার দিকে একবার তাকাল। বাইকের কাছে হেঁটে গিয়ে মেকানিককে জিজ্ঞেস করল, কতক্ষণ লাগবে ঠিক করতে?

ঘণ্টাখানেক তো লাগবেই, মেকানিক বলল, কার্বুরেটর পরিষ্কার করে নতুন প্লাগ লাগাব। সাইলেন্সার পাইপেও ময়লা জমছে। তেলের লাইন একবার চেক করতে হবে।

শিবু গ্যারেজের মাঝখানে দাঁড়ানো পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা এক লোককে গিয়ে বলল, কামাল ভাই, এ হলো আমার দোস্ত সায়েম। ওই লাল বাইকটা ওর। ঠিক হয়ে গেলে কাউকে পাঠায়ে আমার বাসার ইন্টারকমে ফোন দিয়েন। কেমন?

লোকটা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই শিবু আমার হাত ধরে টান মারল, চল।

এরপর না গিয়ে আর উপায় নেই। শিবু আমার হাত ধরে একপ্রকার টানতে টানতেই রাস্তা পার হলো। শিবু বরাবরই এ রকম। যখন যা মনে হবে, সেটা করেই ছাড়বে।

~~~

কুষ্টিয়া ইউনাইটেড হাইস্কুলে আমি ক্লাস সেভেনে এসে ভর্তি হই। এর আগে থাকতাম সিরাজগঞ্জ। আমার বাবার ছিল বদলির চাকরি। দু-এক বছর পরপরই আমাকে স্কুল বদলাতে হতো।

শিবু বয়সে আমার দুই বছরের বড়। শুধু যে বয়সে বড়, তা-ই নয়, সে আমাদের ক্লাসের সবার থেকে এক হাত লম্বা। আমরা মুখটা ওপরের দিকে তুলে ওর সাথে কথা বলতাম। তিন বছর ধরে ক্লাস সেভেনে পড়ছিল শিবু। স্কুলের পরীক্ষায় যে ফেল করা যায় এবং ফেল করলে একই ক্লাসে দু-তিন বছর কাটাতে হয়, এটা ছিল আমার জন্য এক নতুন আবিষ্কার। অবশ্য শিবুকে দেখে কখনো মনে হয়নি যে ফেল করায় সে খুব একটা অসন্তুষ্ট। সব সময় আমোদে থাকত এবং দুহাতে পয়সা খরচ করত।

আমি ওই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম মার্চের মাঝামাঝি। পরে ভর্তি হওয়ায় আমার রোল ছিল একেবারে শেষের দিকে৬৩। আর শিবু ফেল করে একই ক্লাসে থেকে যাওয়ায় ওর রোল ছিল ৬২। ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষায় আমার সিট পড়ল শিবুর পাশে। আমার খাতা দেখে লিখে তার কিছুটা উন্নতি হলো। ইংরেজি আর অঙ্ক ছাড়া সব সাবজেক্টে পাস করে গেল। আর আমি ৬৩ জনের মধ্যে সেকেন্ড হলাম।

তখন আমাদের মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি হয়ে গেল, আমরা পরস্পর পরস্পরের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সাহায্য করব। কী রকম সাহায্য?

যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময়ে আমাদের বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের হাতে কাঁচা পয়সা তুলে দিতেন না। মনের ভুলেও না। আমাদের যা লাগবে, তারা নিজেরা দোকানে গিয়ে কিনে আনতেন। জ্যামিতি বক্স লাগবে, বাবা বলতেন, আমি অফিস থেকে ফেরার সময় নিয়ে আসব।

গল্পের বই লাগবে, তিনি বলতেন, আউট বই পড়ে সময় নষ্ট করতে হবে না। কাজের জিনিস পড়ো।

তো এই ছিল আমার অবস্থা। টিফিনের জন্য আলাদা কোনো হাতখরচ পেতাম না। মা বাড়ি থেকে রুটি আর আলুভাজি ভরে টিফিন বক্সে দিয়ে দিতেন। ওগুলো খেতে আমার একটুও ভালো লাগত না।

স্কুলের গেটে বেলায়েত ভাই বিক্রি করত ঘটি গরম। স্তূপ করে রাখা চানাচুর, ঢিবির মতো মাঝখানে বেশ উঁচু। দুপাশে পিরামিডের ঢাল। সেই পিরামিডের শীর্ষে একটা ঘটি বসানো। ঘটিতে কাঠকয়লার আগুন জ্বালানো থাকে সব সময়। ঘটির আশপাশের চানাচুরও তা-ই গরম থাকে। চারদিকে গোল করে সাজানো পেঁয়াজ আর টমেটো। মরিচগুলো চানাচুরের মাঝে খানিকটা দূরত্ব মেপে খাড়া করা। সবুজ এবং লালদু ধরনের মরিচই আছে। মোহনীয় দৃশ্য।

সরিষার তেলে মসলা, মরিচ, পেঁয়াজ দিয়ে সেই চানাচুর ঢালা হতো একটা প্লাস্টিকের পাত্রে। আমরা পাত্রটাকে বলতাম ঝামানি। এরপর শুরু হতো বেলায়েত ভাইয়ের আসল খেলা। চামচ দিয়ে প্রথমে দিতেন একটা ঘোঁটা। তারপর এক হাতে ঝামানি ধরে অন্য হাতের তালুতে বাড়ি মারতেন শব্দ করে। ঝামানির ভেতরে চানাচুর বাড়ি খাওয়ার পর চুরচুর শব্দ হতো। আমরা ক্লাসরুম থেকে সেই শব্দ শুনতে পেতাম। টিফিনের ঘণ্টা বাজতেই ছুটে যেতাম স্কুলগেটে।

শিবু পকেট থেকে খুচরা টাকাপয়সা বের করে দিত। আর আমি ঝামানো চানাচুর খেতাম। ঝালে যখন জিহ্বা বের হয়ে যেত, তখন যেতাম কুলফি মালাইয়ের ভ্যানের কাছে। প্রচণ্ড ঝালের পর সেই মালাই মনে হতো অমৃত। শিবুতি কিন্তু এগুলো কিছু খেত না। চিপায় দাঁড়িয়ে সিনিয়র ক্লাসের ভাইদের সাথে গোল্ডলিফ টেনে আসত।

শিবুর পকেটে সব সময় টাকা থাকত। অন্তত দশ-বিশ টাকা। ঝাউতলা বাজারে ওদের একটা বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোর ছিল। দোকানের নাম সবুজ সম্ভার। কখনো পকেটের টাকা শেষ হয়ে গেলে সে এক দৌড়ে দোকান থেকে টাকা নিয়ে আসত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এর বদলে শিবুকে পরীক্ষার সময় খাতা দেখাতে হবে। আমি দেখাতাম। ক্লাস সেভেন থেকে এইটে ওঠার ফাইনাল পরীক্ষায় শিবু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সব সাবজেক্টে পাস করে গেল।

সে খুশি হয়ে আমাকে দুটো বই গিফট করল। মাসুদ রানা সিরিজের হ্যালো সোহানা ১ ও ২। সে-ই প্রথম আমার অ্যাডাল্ট বই পড়া। তখনো জানতাম না, সামনে কত কী অপেক্ষা করছে আমার জন্য। বিকিনি পরা সোহানার জন্য মনটা কেমন কেমন করত সব সময়।

তখন আমার যে বয়স, সে বয়সে মেয়েদের ব্যাপারে একটু কৌতূহল মনের মধ্যে জমে। শিবু আমার সে কৌতূহল মেটায়। এর মধ্যেই সে নাকি এক মেয়েকে চুমু খেয়েছে। চুমু কীভাবে খায়, তা আমি জানি। কাজটা খুবই সহজ। ঠোঁটের মধ্যে ঠোঁট রাখতে হয়। সিনেমায় দেখেছি। কিন্তু সেটা খেলে কেমন লাগে জানি না। শিবু আমাকে বিস্তারিত বলে আর আমি শুনে শিহরণ বোধ করি। মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। আমি কখনো মেয়েদের নগ্ন শরীর দেখিনি শুনে সে হাসতে হাসতে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। সবিস্তার বর্ণনা করে। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি।

একদিন শিবু ক্লাসে এসে আমাকে বলল, তোর সাথে কথা আছে। পেছনের বেঞ্চে আয়।

আমি সামনের বেঞ্চ থেকে উঠে পেছনের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। পণ্ডিত স্যারের ক্লাস তখন। বাংলা ব্যাকরণ। শিবু তার শার্টের নিচ থেকে একটা নিউজপ্রিন্টের পত্রিকা বের করল। ভাঁজ করা পত্রিকা। আমি ফিসফিস করে বললাম, কী এটা?

শিবু ইশারায় আমাকে কথা বলতে নিষেধ করে পাতা ওল্টাতে বলল। ভাঁজ খুলে পাতা ওল্টালাম। প্রচ্ছদে এক ফর্সা মেয়ে দুপা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীরে একটা সুতাও নেই। তার কোমর বরাবর দুটো নিগ্রো ছেলের মুখ। ছেলে দুটোর চিবুক সামান্য টিল্ট আপ করা। চোখ দুটো মেয়েটার বুক বরাবর। মা কালীর মতো তাদের জিভ বের করা। মেয়েটার দুই ঊরুর মাঝখানে কী আছে, তা দেখা যাচ্ছে না ছবিতে। তৃতীয় আর একটা ছেলের মাথা সেই জায়গাটা আড়াল করে আছে। পত্রিকার ভেতরে আরও ছবি আছে। একটার থেকে আরেকটা বেশি ভয়ংকর।

কিছু গল্প আছে সেই পত্রিকায়। শিরোনামগুলো একবার পড়লে সারা জীবনে ভোলা সম্ভব না। বউদিকে স্নানঘরে একা পেয়ে, বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট, পুজোর ছুটিতে রমলার সাথে...।

আমার সামনে এমন এক জগতের দরজা খুলে গেল যে জগতে আমি কখনো যাইনি। ধীরে, অসাবধানে পা বাড়ালাম। মাথার নাটবল্টু একটা একটা করে ঢিলা হতে শুরু করল। বোধশক্তি লোপ পেয়েছে ততক্ষণে। কী করছি আমি জানি না। কী ভাবছি ঠিক নেই। মনে হলো, ঝেঁপে জ্বর এসে গেছে শরীরে। দুই ঊরুর মাঝে আশ্চর্য এক শক্তি টের পাচ্ছিলাম। সেই অনুভূতি এতটাই তীব্র যে পৃথিবীর বাদবাকি অনুভূতিগুলো সব এক করলেও তার সমান হবে না।

আমার ক্ষুদ্র জীবনে আমি এ রকম মজার পত্রিকা আগে কখনো পড়িনি। শিবু পত্রিকাটা মাঝামাঝি ছিঁড়ে দুই ভাগ করল। এক ভাগ সে নিল, আরেক ভাগ আমি। আমি ডুবে গেলাম। না ডুবে কোনো উপায় ছিল না আমার।

বেতের বাড়িতে ভেসে উঠলাম আমরা। পণ্ডিত স্যার ঠিক আমার পাশে দাঁড়ানো তখন। হাতে জোড়া বেত লকলক করছে। সাপের মতো ফণা তুলে দ্বিতীয়বার ছোবল মারার জন্য তৈরি। পড়াতে পড়াতে স্যার কখন যে পেছনের বেঞ্চে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন টের পাইনি। পরবর্তী ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। ক্লাসেই আমাদের এক দফা বেতানো হলো। আমার মনে আছে, একটুও ব্যথা পাইনি। দুই ঊরুর মাঝে যে শিহরণ তা আমার ব্যথার সব অনুভূতি অবশ করে দিয়েছিল।

পরদিন হেডস্যার আমার বাবাকে ডাকলেন স্কুলে। সবিস্তার আমার কীর্তি বললেন। বাবা পুরো স্কুলের সামনে পায়ের জুতো খুলে আমাকে পেটালেন। বিশেষ বিবেচনায় আমাকে স্কুলে রাখা হলেও শিবুকে টিসি দেওয়া হলো।

এরপর বছরখানেকের মতো কুষ্টিয়া ছিলাম। শিবুকে দু-চারবার দূর থেকে দেখেছি। সে তখন পড়াশোনা বাদ দিয়ে নিয়মিত ডিপার্টমেন্ট স্টোরে বসতে শুরু করেছে। পারিবারিক ব্যবসা সামলায়। ওই বয়সেই সে গম্ভীর মুখে সবুজ সম্ভারের গদিতে বসে। আমার ইচ্ছা ছিল একদিন দোকানে ঢুকে তার সাথে কথা বলব। সাহস অর্জন করতে পারিনি।

ক্লাস নাইনে যখন উঠলাম, বাবা বদলি হয়ে গেলেন জামালপুরে।

~~~

আমি সায়েম। পুরো নাম সায়েম মুরাদ। ১৭ বছর পর বসে আছি শিবুতি রায়ের ড্রয়িংরুমে। আমার উল্টো দিকের সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে আমাদের শিবু। পা দুটো সোফার ওপরে তোলা। লুঙ্গি হাঁটুর ওপরে উঠে গেছে। বিপদসীমার খুব কাছাকাছি তার অবস্থান। লুঙ্গির ফাঁক দিয়ে তার বাদামি আন্ডারওয়্যারের আভাস দেখা যাচ্ছে। কিন্তু শিবুর সেদিকে খেয়াল নেই। সে বিয়ারের গ্লাসে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে।

বাংলামোটর বিয়ামের গলিতে ঢুকে তিন নম্বর বিল্ডিংয়ের ৬ তলায় শিবুর অ্যাপার্টমেন্ট। আমার সামনে টেবিলে রাখা চারটা বিয়ারের ক্যান। দুটো হ্যানিকেন, আর দুটো ফস্টার। হ্যানিকেনের ক্যানগুলো খালি হয়ে গেছে। আমাদের গত ১৭-১৮ বছরের জীবনের সারমর্ম আমরা হ্যানিকেন টানতে টানতে জেনে গেছি। এবং তারপর অবাক হয়ে লক্ষ করেছি, আমাদের কথা শেষ। আর কিছু বলার নেই। রুমজুড়ে নীরবতা এই মুহূর্তে। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। সেটাই একমাত্র শব্দ। বাইরে থেকে হঠাৎ কেউ যদি এসে পড়ে তো ভাববে, আমরা বোধ হয় মৃত কোনো বন্ধুর স্মরণে একটা শোকসভার আয়োজন করেছি। পরিবেশটা আসলে তেমনই।

শিবু একটা ফস্টারের ক্যান টেনে নিল। ফ্রিজ থেকে বের করায় ক্যানের গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। ক্যানের মুখ খোলার সময় ঠাস করে একটা শব্দ হলো। মনে হলো, রুমের মধ্যে কেউ গ্রেনেড ছুড়ে মেরেছে। আমি টেবিলের ওপর রাখা ডানহিলের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালাম। শিবুতি এখন আর গোল্ডলিফ খায় না। তার ব্রান্ড ডানহিল।

ক্লাসে আমি বরাবরই ফার্স্ট-সেকেন্ড হতাম। বাবা গর্ব করে বলতেন, আমার ছেলে অনেক বড় হবে। সেই পথেই এগোচ্ছিলাম। কিন্তু ২০০৬-এ আমাদের পরিবার একটা বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলো। দুম করে একদিন আমার বাবা মরে গেলেন। সুস্থ, সবল এক মানুষ। দুদিনের জ্বরে শেষ, দ্য এন্ড। জন্ম নিলে মরে যেতে হয়, এই সত্যটা আমরা সবাই জানি। ধর্মগ্রন্থগুলো প্রতিদিন আমাদের মৃত্যুর ভয় দেখায়। মনে মনে তাই একধরনের প্রস্তুতিও হয়তো আমাদের থাকে। কিন্তু সত্যিই যখন ঘটনাটা ঘটে যায়, সেই প্রস্তুতি কোনো কাজে আসে না। আমরা মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাই।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যখন মারা যায়, তখন কীভাবে সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে আমাদের জানা ছিল না। আমি বুঝতে পারলাম, যে বইগুলো এত দিন ধরে মন দিয়ে পড়েছি, সেগুলো না পড়লেও চলত। আমি যদি আদৌ কোনো পড়াশোনা না করতাম, তাতেও পৃথিবীর তেমন কোনো উনিশ-বিশ হতো না। আমি শূন্যে এসে দাঁড়ালাম। আমার বয়স তখন ১৭। ধাক্কাটা আর সামলে ওঠা হয়নি। এইচএসসির রেজাল্ট হলো যাচ্ছেতাই।

মায়ের স্বপ্ন ছিল, আমি ডাক্তার হব। হতে পারিনি। হয়েছি মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। শুক্রবার বিকেলেও আমাকে বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। ফার্মেসি আর ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে কোম্পানির ওষুধ গছানোর চেষ্টা করি। বাইকের পেছনে একটা বিশাল কালো ব্যাগ বাঁধা থাকে নাইলনের দড়ি দিয়ে। আমি ঘুরে ঘুরে ওষুধের স্যাম্পল সাপ্লাই করি। এর ওপর কমিশন পাই। মাস গেলে যে কটা টাকা হাতে আসে, তাতে ঢাকা শহরে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে জান বেরিয়ে যায়। বিয়েশাদি করার কথা স্বপ্নেও ভাবি না। রাতে মরার মতো ঘুমাই। শান্তির ঘুম? নাকি অশান্তির? জানি না। জানতে চাইও না। জেনে কিছু হয় না। জীবন বদলায় না।

বদলে গেছে শিবুর জীবন। ক্লাসে ফেল করতে থাকা শিবু আজ একজন সার্থক এন্ট্রাপ্রেনিউর। কুষ্টিয়া থেকে সে ব্যবসা বাড়াতে বাড়াতে ঢাকা শহর পর্যন্ত চলে এসেছে। কুষ্টিয়া, খুলনা ও ঢাকায় তার আলাদা আলাদা অফিস। এ জন্য তাকে এসএসসি, এইচএসসি পাস দিতে হয়নি। বই পড়ে বিদ্বান সে নয়। সিনেমার মতো গল্প। কিশোর ইলিয়াস কাঞ্চন স্কুলের চিপায় দাঁড়িয়ে গোল্ডলিফ টানছে। একটা গান শুরু হলো। গানের শেষে ইলিয়াস কাঞ্চন তরতাজা যুবক। হাতে ডানহিল।

নিচে গ্যারেজে একটা ঝকঝকে কালো টয়োটা প্রিমিও দেখিয়ে শিবু আমাকে বলেছে, সেটা তার গাড়ি। ব্যাটা বিয়েও করেছে। বউয়ের নাম নীতু। নীতু এই মুহূর্তে বাসায় নেই। পারলারে গেছে। যেকোনো সময় ফিরে আসবে।

ইন্টারকমে কিছুক্ষণ আগে খবর এসেছে, আমার বাইকের কাজ শেষ। কিন্তু শিবু আমাকে অনুরোধ করেছে, যেন তার বউ ফিরে আসা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করি। পরিচয় করিয়ে দেবে। এ জন্যই বসে আছি। না হলে অনেক আগেই উঠে চলে যেতাম। একটুও ভালো লাগছে না এভাবে বসে থাকতে। জীবনে পথ চলতে গিয়ে যে সিঁড়ি বেয়ে শিবু উঠে গেছে অনেক ওপরে, আমি সেই সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেছি। কেউ ওঠে। কেউ নামে। এতে পৃথিবীর ভারসাম্য ঠিক থাকে।

শিবু কিছুক্ষণ আগে লুঙ্গি পরে রাস্তায় নেমেছিল। মোড়ের দোকানে চা খাচ্ছিল। তখন তাকে দেখে আমার ভালো লেগেছে। স্বস্তি পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, সে আমারই মতো এক হেরে যাওয়া লোক। ভুল ভেবেছিলাম। সেই ছোটবেলায় তার সাথে কথা বলতে হলে আমাকে মুখটা ওপরের দিকে তুলতে হতো। এখনো তাই করতে হয়। বিষয়গুলো একই আছে। কিছু বদলায়নি।

বাসায় ঢুকে শিবু জিজ্ঞাসা করেছিল, তুই এখন কী করছিস?

আমি বলেছি, একটা ওষুধ কোম্পানিতে আছি।

ও ভেবেছে, আমি বোধ হয় ফার্মাসিস্ট। নতুন নতুন ওষুধের ফর্মুলা নিয়ে ল্যাবে গবেষণা করি। আমার সে রকমই কিছু একটা হওয়ার কথা ছিল। ২০০৩-এ আমাকে যারা চিনত, তাদের পক্ষে এ রকম ভাবাই স্বাভাবিক। একবার ইচ্ছে হলো, ভুলটা ভেঙে দিই। ভেঙে দিয়ে শিবুকে বলি, সে যেন তার ঢাকার অফিসে আমাকে একটা ছোটখাটো কাজ জোগাড় করে দেয়। এত বড় ব্যবসা সামলায়। একা নিশ্চয়ই পারে না। বিশ্বস্ত মানুষের সাহায্য লাগে। আমি তার অনেক পুরোনো বন্ধু। আমার চেয়ে বিশ্বস্ত আর কে আছে?

শিবু এখন দূরের দেয়ালে তাকিয়ে আছে। এখনই বলে ফেলা যায় কথাটা। ওর বউ চলে এলে আর সুযোগ পাব না। আমি সিগারেটে টান দিতে গিয়ে দেখলাম, বেশ খানিকটা ছাই জমে আছে ডগায়। সাবধানে অ্যাশট্রেতে ছাই ফেলতে গিয়ে হঠাৎ খুব রাগ হলো আমার। ডানহিলের আগুন জোরে ঠেসে ধরলাম টেবিলের ম্যাটে। কাচের টেবিলের ওপর কটন কাপড়ের ম্যাট। বাহারি ডিজাইন। শৌখিন জিনিস বোঝা যায়। শিবুর বউ নিশ্চয়ই শখ করে কিনেছে।

সুতি কাপড়ে পয়সার সাইজের একটা কালো গর্ত হলো প্রথমে। আগুন ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। পয়সাটা সাইজে বাড়ছে। আর বাড়তে দেওয়া যায় না। এরপর ধোঁয়া ছড়াতে শুরু করবে। আমি ম্যাট থেকে সিগারেট তুলে নিলাম।

কাজটা আমি করলাম খুব ক্যাজুয়ালি। কেউ ভাবতেও পারবে না ঠাণ্ডা মাথায় এসব করা যায়। শিবু খেয়াল করার আগেই পোড়া জায়গাটার ওপরে অ্যাশট্রে এনে রাখলাম। এবার আর বোঝার উপায় নেই।

শিবু হঠাৎ দেয়াল থেকে আমার দিকে চোখ ফেরাল। বলল, তুই কিন্তু চুমুক দিচ্ছিস না।

আমি বললাম, এসব খেয়ে অভ্যাস নাই দোস্ত।

আরে ধুর ব্যাটা, খা। বিয়ার খেলে কিছু হবে না। কোল্ড ড্রিংকস মনে করে খেয়ে ফেল।

বাইক চালায়ে মিরপুর যেতে হবে। অ্যাকসিডেন্ট-ফ্যাকসিডেন্ট করলে!

কলবেল বাজল। শিবু বলল, নীতু চলে আসছে মনে হয়। দাঁড়া।

নীতু আসতে পারে এই সম্ভাবনায় আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। এবার তাহলে ওঠা যাবে। শিবু উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই কানে মাস্ক ঝুলতে থাকা এক ঝকঝকে চেহারার তরুণীকে দেখতে পেলাম। সাজগোজ করা। কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে মেয়েরা এ রকম সাজে। সিল্কের একটা শাড়ি পরে আছে। ক্যানকেনে গলায় সে শিবুকে বলল, কী ব্যাপার! তুমি এখনো রেডি হও নাই? কতবার বললাম, আমাদের সন্ধ্যার মধ্যে যেতে হবে। মাসিমা অপেক্ষা করে থাকবে।

শিবু বলল, আমার রেডি হইতে দুই মিনিট লাগবে। এত চিল্লায়ো না তো! এদিকে আসো, একজনের সাথে পরিচয় করায়ে দেই।

নীতু যেন এতক্ষণে লক্ষ করল আমাকে। মুখে জোর করে একটা হাসি ফোটাল। আমিও হাসলাম।

শিবু বলে গেল, এই হলো আমার বন্ধু সায়েম। জিগরি দোস্ত। তাই বলে আবার ভাইবো না, ও আমার মতো ফাউল। খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিল। ছোটবেলায় ওর পরীক্ষার খাতা দেখে পাস করছি সব সময়। আর সায়েম, এই হলো নীতু। খ্যাঁচখাঁচ করতেছে দেখে ভাবিস না আবার ঝগড়াটে মেয়ে বিয়ে করছি। নীতু খুব ভালো মেয়ে।

নীতুর মুখে তখনো হাসি ঝুলে আছে। বলল, সরি, আপনাকে খেয়াল করি নাই। পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগল। কেমন আছেন?

আমি হেসে বললাম, ভালো। আপনি কেমন আছেন?

ভালো, নীতু বলল, এমন দিনে আসলেন, যেদিন আমাদের বের হতে হবে। কিছু একটা যে চট করে রান্না করে খাওয়াব, সে উপায় নাই। আসলে আজ আমার মাসিমার বাসায় একটা প্রোগ্রাম আছে। তাদের ম্যারেজ ডে। মাসিমা বারবার ফোন দিচ্ছে। আপনি সামনে শুক্রবার আসেন না আবার। দুপুরে আমাদের সাথে খাবেন।

আমি একটু বিব্রত ভঙ্গিতে বললাম, না না ঠিকাছে। কোনো সমস্যা নাই। আমি আপনার সাথে পরিচিত হব বলেই এতক্ষণ ওয়েট করতেছিলাম। এখন উঠব।

আসবেন কিন্তু সামনে শুক্রবার। শিবুর কোনো বন্ধুবান্ধব নাই সে রকম। কারও সাথে বনে না ওর। আচ্ছা, আপনি আমাদের বিয়েতে আসেন নাই কেন?

শিবু হাসতে হাসতে বলল, আসবে কী করে? আজই তো মাত্র দেখা হইছে। বহু বছর পর? না রে?

তাই! নীতু বলল।

আমি বুঝতে পারলাম, তাই শব্দটা আলাদা কোনো অর্থ বহন করে না। বলার জন্যই বলা। নীতু অপেক্ষা করছে আমি কখন চলে যাব। আমি শিবুর দিকে তাকিয়ে বললাম, বাথরুমটা কোন দিকে দোস্ত? মুখে একটু পানি দিয়ে নেই। বের হব।

শিবু আমাকে বাথরুমের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিল। বাথরুমে ঢুকে কোনো কারণ ছাড়াই আমার খুব বমি পেয়ে গেল। হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা কমোডে ফেলে ফ্ল্যাশ করে দিলাম। সিগারেট ডুবল না। ভেসে রইল। কিছু কিছু জিনিস ডোবে না। ডুবতে চায় না।

বেসিনের সামনে এসে দাঁড়ালাম। মুখে পানির ছিটা দিলাম। এ বাথরুমে সম্ভবত গরম পানি, ঠাণ্ডা পানির ব্যাপার আছে। মনে হলো, ফুটন্ত পানি মুখে এসে ছ্যাঁকা দিয়ে গেল। আয়নায় নিজের চেহারা দেখা যাচ্ছে। সকালে শেভ করেছিলাম। এখন মুখ সামান্য অন্ধকার। এই আয়নায় কি শিবুও মুখ দেখে কখনো? আয়নায় নিজের মুখটাকে শিবুতি রায়ের মুখ ভাবতে খুব ইচ্ছে হলো।

আমারও একটা গোছানো সংসার থাকতে পারত। সে প্রতিশ্রুতি আমার কৈশোর আমাকে দিয়েছিল। শিবুতিকে কেউ প্রতিশ্রুতি দেয়নি কখনো। কিন্তু সে পেরেছে। ঠিক পেরেছে। আমি পারিনি।

একটা কাচের বোতলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা। বোতলের মুখ ধরে মোচড় দিলাম। খুলল না। আড়প্যাঁচ লেগে গেছে। জোর করে খুলতে গেলে ভেঙে যেতে পারে। আমার মনে হলো, জীবনে চলার পথে কোনো এক মুহূর্তে আমি গোটা জীবনটা ধরে এক আড়প্যাঁচ দিয়েছি। এখন আর কিছু ঠিক হবে না। কখনো না। আচ্ছা, সব অস্বীকার করলে কেমন হয়?

বাথরুম থেকে বের হয়ে এসে শিবুকে বললাম, আসি দোস্ত...।

শিবু বলল, আবার কবে আসবি? আমার ফোন নম্বরটা রাখ। জিরো ওয়ান থ্রি ডাবল ওয়ান...

আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তোর কার্ডটা দে। আমি নরওয়ে থেকে ফোন করব।

নরওয়ে!

হ্যাঁ। নেক্সট উইকে আমি অসলো যাচ্ছি। অফিস থেকে পাঠাচ্ছে। আমাদের কোম্পানিটা নরওয়েজিয়ান। গত বছর ওরা একটা ট্রেনিংয়ের আয়োজন করেছিল। সেই ট্রেনিংয়ে আমি খুব ভালো করেছি। তাই ওরা এখন আমাকে পুরস্কার হিসেবে নরওয়ের হেড অফিসে পাঠাচ্ছে। টেস্ট বেসিসে প্রথমে এক বছরের জন্য। পরে কন্ট্রাক্ট আরও বাড়তে পারে।

শিবু অবাক হয়ে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার দিল, নীতু, নীতু...এদিকে আসো। দেখে যাও। কী ভয়ংকর ঘটনা!

আমি মুখে মিটিমিটি হাসি নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শিবু আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি জানতাম, আমি জানতাম, তুই অনেক বড় হবি!

~~~

আমিও জানতাম, আমি বড় হব। কত ভুলই না জানতাম!