অ্যাসক্লেপিয়াসের মোরগ

 

অ্যাসক্লেপিয়াসের মোরগ হাতে দাঁড়িয়ে আছি। মোরগের রং লাল, কিন্তু ঝুঁটি নেই। ডাকছে দূরে ধুতুরার বন। বনের ধারে পাহাড় আনমন। পাহাড়ের পাড়ে তুমি হাতছানি। বর্ষা নামছে আমিও জানি...

একদিন ভোরবেলা দাঁত ব্রাশ করতে করতে এমন সব কবিতার লাইন তার মাথায় আসতে লাগল। কেন হঠাৎ করে এই সব কথা আসছে সে বুঝতে পারছে না। এইখানে কে অ্যাসক্লেপিয়াস? সেকি নিরাময়? কে মোরগ, কে তুমি?

মহল্লার রাস্তায় হাঁটছিল সে। তাকে দেখে একটা পাগল দৌড়ে এলো, তার হাঁটা রোধ করে সামনে এসে দাঁড়াল। আর হিহি হিহি হিহি করে হাসল। তারপর একদম মুখের কাছে এসে হিসহিস করে বলল, দাঁতে শাণ দিতেছস? দে দে, শক্ত কইরা দে, নিজের হাত কামড়াই খাওন লাগবে, খাওন লাগবে...

এই একই কথা বলতে বলতে পাগলটা পাশ কেটে দুহাত দুপাশে ডানার মতো প্রসারিত করে নাচতে নাচতে চলে গেল।

ফযরের আজান হয়ে গেছে অনেকক্ষণএখনো আঁধার কাটেনি। হাঁটতে হাঁটতে সহসা সে থমকে দাঁড়াল। আলো-আঁধারির ভিতর দেখতে পেল রাস্তায় পড়ে আছে মানুষের একটা হাত, কবজি থেকে কাটা। সে সামনে আর গেল না। পেছন ফিরে বাসায় ফিরে গেল। বাসায় ফিরে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে নানা ভাবনা তার মাথায় আসতে থাকল। আর মাথায় চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভূত হলো, ঝিঁঝিপোকা ডাকছে কোথাও, সে স্পষ্ট শুনতে পেল। হাতটা কার হতে পারে? রোজার মাস। দাঙ্গা-ফ্যাসাদ লেগেই আছে।

সে ভাবে, হাতটা কার হতে পারে? সে যে-মহল্লায় থাকে তার পাশেই হিন্দুপাড়া। মহল্লার সীমানা ঘেঁষে হিন্দুপাড়ায় জনৈক হিন্দুর একটা চায়ের দোকান ছিল। গত বছর এই দিনে করিম মেম্বারের ছেলে কলিমুল্লা দলবল নিয়ে গিয়ে ওই দোকান ভাঙচুর করে এবং দোকানদারসহ দুজন কাস্টমারকে আহত করে। এবং কাস্টমারের একজন তার পাশের রুমে থাকে।

কলিমুল্লাকে সে প্রায় সময় মদ খেয়ে সন্ধ্যার পর বড় রাস্তায়, বাজারে মাতলামি করতে দেখেছে। একদিন সে তার হাতে চুমু খেয়েছিল। তা সে আবার ডায়েরিতে লিখেও রেখেছে এইভাবে

একদিন সন্ধ্যাবেলা চা খেয়ে রাস্তায় হাঁটছিলাম। হঠাৎ এক মাতাল আমার পথ আটকে দাঁড়াল। এবং খুবই বিনয়ের সঙ্গে আমার হাতটি টেনে নিল। তারপর ভক্তিভরে হাতে চুমু খেল। আমি তার মাথায় হাত রেখে আদর করে দিলাম। সে আশীর্বাদ ভেবে আমাকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করল। আর আমি তাকে ছেড়ে এলাম।

সে ভাবে, হাতটা কোনো হিন্দুর নয় তো?

অফিসে যাবে বলে বেরিয়েছে সে। প্রতিদিন বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত হেঁটেই যেতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে ভোরবেলার সেই জায়গাটায় থমকে দাঁড়াল। এবং মনে মনে হাসলরাস্তায় পড়ে আছে একটা কালো হাতমোজা।

এর মধ্যে একদিন ঝুপ করে শীত নেমে এলো মহল্লায়। এর মধ্যে আরও একদিন ভোরবেলা দাঁত ব্রাশ করতে করতে মহল্লার রাস্তায় হাঁটছিল সে। মাথায় কোনো কবিতা নাই, পুরা মাথা ফাঁকা। তার বাম হাত জ্যাকেটের পকেটে। ফযরের আজান হয়ে গেছে অনেকক্ষণএখনো আঁধার কাটেনি। তার ওপর কুয়াশা। হাঁটতে হাঁটতে সহসা সে থমকে দাঁড়াল। আলো-আঁধারি আর কুয়াশার ভিতর দেখতে পেল রাস্তায় পড়ে আছে মানুষের একটা হাত, কবজি থেকে কাটা। সামনে আর গেল না সে। পেছন ফিরে বাসায় চলে গেল।

বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে সে জ্যাকেটের পকেট থেকে দুই হাত বের করে চোখের সামনে ধরলতার বাম হাতটা কবজি থেকে কাটা।

সেদিন রাতের বেলা সে প্রতিদিনের মতো বাড়ি ফিরছিল একা। রাত এমন কালো আর কখনো মনে হয়নি। গুমোট পরিবেশ। যেন একটুও হাওয়া নেই পৃথিবীতে। ভুলে টর্চলাইট ফেলে এসেছে অফিসের ড্রয়ারে। চেনা পথ। তারপরও খুব সন্তর্পণে হাঁটছিল। উঠান পর্যন্ত এসে পা বাড়াতে গিয়ে সহসা থমকে দাঁড়াল, ভয় পেল নাকি? স্তূপাকৃতি অন্ধকার সামনে। ডান পা বাড়িয়ে একটু নাড়া দিল। শুকনো ঝরাপাতার স্তূপ। সে এগিয়ে গেল সামনে। পড়ার আগে জানতেই পারল না পাতার তলে লুকানো গর্তের কথা। সে নিঃশব্দে এসে পড়ল তার নড়বড়ে চৌকিটাতে। পড়েই ঘুমিয়ে পড়ল কী এক ক্লান্তিতে। আর ঘুমের ভিতর স্বপ্ন এলো। স্বপ্ন নয় ঠিক, দুঃস্বপ্ন হতে পারে সে দেখল সে একটা খোলা মাঠে দুপুরবেলা চিত হয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। আর একটা বিশালাকার ষাঁড় এসে তাকে গিলে ফেলল। আর সব অন্ধকার হয়ে গেল। চারপাশে কেবল ঘাসের গন্ধ আর জাবর কাটার শব্দ। তার মনে হলো, ষাঁড়টা এইভাবে চিরদিন অতীত কোনো স্মৃতির রোমন্থন করে যাবে।

তার একদিন মনে হলো, মাথার ভিতর একটা পোকা ঢুকেছে। পোকাটার রং বেগুনি। যেকোনোভাবে হোক এটা ঢুকেছে। এখন সে পোকাটাকে বের করে মেরে ফেলতে চায়। কিন্তু কেমন করে? সে ভাবে। কোনো কিনারা করতে পারে না। ডাক্তারের কাছে গেলে তাকে পুরো বৃত্তান্ত দিতে হবে। সে তা চায় না। কী হবে এখন? সে ভাবে। বৃত্তান্ত দিতে আর ভালো লাগে না। সব নড়বড়ে হয়ে গেছে, এমনকি তার চৌকিটাও। চৌকিটার জন্য হলেও সমাজতন্ত্র দরকার। একটা ক্রোনি-ক্যাপিটালিস্ট রাষ্ট্র টিকে থাকার জন্য সবকিছুকেই পুঁজি করে, সবকিছুকেই ব্যবহার করে। আর ব্যবহার করে অনেকটা কনডমের মতোই, কাজ শেষে কমোডে ফেলে ফ্লাশ টেনে দেয়। হোক তা মায়ের মমতা বা অন্য কিছু। শুধু ধর্মটাকে রেখে দেয়। কারণ, ধর্মই একই সঙ্গে পুঁজিবাদের ঢাল আর তলোয়ার। এখন তো এই সব খুবই স্বাভাবিক বিষয়, তাই না? আগে একটু কম ছিল, এখন একটু বেড়েছে, এই যা। কিছুদিনের মধ্যে গা সওয়া হয়ে যাবে।

কিন্তু এই মড়ার দেশে আর কিছুতেই সে কোনো আগ্রহ পায় না। নৈরাজ্যের রাজ্যে কখনো তারও অ্যানার্কিস্ট হতে ইচ্ছে করে। সে ভাবে, এই বিতৃষ্ণার ভার নেবে, এমন তৃষ্ণা জলের বুকেও নাই।

এর মধ্যেই একদিন তার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল। ঠিক দেখা হলো না, মানে তাকে দেখলাম, এই যা। আমি যখন তাকে প্রথম দেখিতার বাঁ গালে একটা কাটা দাগ ছিল। আমার দিকে বিষণ্ন চোখে একবার তাকিয়ে জ্যাকেটের হাতায় মুখ মুছল।

আমি তাকে দ্বিতীয়বার যখন দেখি প্ল্যাটফর্মের সিমেন্টের বেঞ্চিতে চোখের কোনায় পিছুটি নিয়ে বসে আছেতার বাঁ গালে কোনো কাটা দাগ ছিল না। দুই দিনের এই অদ্ভুত অমিল আমাকে তার প্রতি তাড়িত করল। আমি পরবর্তী দুই দিন তাকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করলাম। সে বোবা ও কালা, বাম হাত থাকে জ্যাকেটের পকেটে।

তাকে দেখলাম একটা ভাঙা আয়নার ভিতর তাকিয়ে আছে। আমি তার পেছনে গিয়ে বসলাম। আয়নার ভিতর তার ডান গালে একটা একটা কাটা দাগ দেখতে পেলাম, যেটা আসলে তার বাঁ গালে দৃশ্যমান। এর মধ্যে ধস্ ধস্ ধস্ ধস্ একটা দীর্ঘ ট্রেন এসে থেমে থেমে প্ল্যাটফর্ম পার হয়ে গেল। সে দৌড়ে পেছনের একটা মাল বগিতে উঠে পড়ল, সহসা হাসলআমি অবাক; আমার হাতে একটা ভাঙা আয়না ধরা। আমার বাঁ গালে একটা কাটা দাগ। আমি পকেট থেকে বাম হাতটা বের করে জ্যাকেটের হাতায় দাগটা মোছার চেষ্টা করলাম। কিন্তু রইল তেমনই। ট্রেনটা তখন ভ্যানিশিং পয়েন্টেযেন বা ঠাকুরঝির মাথায় পিতলের কলসির ঝলক হয়ে গেছে। 

একদিন পুরোনো বইয়ের দোকানে গিয়ে তার মাথায় আইডিয়াটা আসে। সে একগাদা ডাক্তারি বই কিনে, ক্ষুর-কাঁচি, ওষুধ এই সব কিনে। অনেকগুলো আয়না কিনে। টানা এগারোটা দিন পড়াশোনা করে। তারপর সে ঠিক করে পোকাটা সে নিজেই বের করবে। চারপাশ থেকে মাথার চারটা এক্স-রে করে। কিন্তু পোকাটা সেখানে দেখা যায় না। তার মনে হয় মেশিনে সমস্যা ছিল। মাথার তালুর নিচেই পোকাটা আছে সে নিশ্চিত।

একটা দিন ঠিক করে। তেরো তারিখ দুপুরবেলা সে পাড়ার সেলুনে গিয়ে সুন্দর করে মাথাটা কামিয়ে আসে। তারপর বাবু হয়ে বসে আয়নাঘরে, তার নড়বড়ে চৌকিটাতে। চারপাশে আয়না, মাথার ওপরেও আয়না। অনেক প্রতিবিম্ব দেখে মুহূর্তের জন্য বিভ্রম তৈরি হয় তার মধ্যে। ভাবে এই সব আসলেই বিভ্রম, মনের ভুল। সে রক্তবর্ণ অডিকোলন দিয়ে ক্ষুরটা ধুয়ে নেয় এবং সেটা দিয়ে মাথার ওপর আড়াআড়িভাবে একটা টান দেয়।

ভোর রাতে বাবাকে স্বপ্নে দেখলাম। দেখলাম, বাবা এরম ইন্টারন্যাশনালের গেটের ভিতরে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। আমি চমকে উঠলাম, আমার প্রবল অস্বস্তি হলো। বাবা বলল, মদ কিনতে এসেছিস?

নতমুখে অস্ফুট কণ্ঠে বললাম, হয়।

তোকে দেবে না। দাঁড়া, আমি নিয়ে আসি।

যেতে যেতে আবার ফিরে এলো, কোনটা আনব?

কেরুর ভদকাটা।

বুঝতে পেরেছি। বলে বাবা একদৌড়ে উঠে গেল। মিনিট দুয়েকের মধ্যে নিয়ে নেমে এলো। বলল, আঠারো শো টাকা দে।

আমি টাকাটা দিলাম। বলল, বেশি খাস না। দেখলি না তোর এক বন্ধু মরে গেল, কী যেন নাম...

আমি কিছু বললাম না। আমার মনে পড়ে গেল যখন আমি ইশকুলের হোস্টেলে থাকতাম বাবা আমাকে দেখতে আসত। আর এক্সট্রা কিছু টাকা দিয়ে বলত, মাঝে মাঝে সিনেমা দেখিস, মন ভালো থাকবে...

বাবা আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল কিছুক্ষণ। ঘাড়ে নাক রেখে গায়ের ঘ্রাণ নিল। আমার বুকের ভিতর হু হু করে উঠল। সেই হু হু আমি গলায় আটকে রাখলাম। বাবা আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, যা, সাবধানে যাস।

আমাকে ছেড়ে দেওয়ার পর দেখলাম, বাবার দুহাতে কালো গ্লাভ্স পরা কনুই পর্যন্ত। আমি এরমের গেট দিয়ে বের হতে হতে পেছন ফিরে দেখলাম, বাবা পকেট থেকে ব্যাটম্যানের একটা মুখোশ বের করে মুখে পরে নিল।

ভোর হয়েছে অনেকক্ষণ। ট্রেন চলছিল সাপের মতো করে, হেলে দুলে এঁকেবেঁকে, অপস্রিয়মাণ, যেন চাকায় নয়, বুকের ওপর ভর দিয়ে চলছে। কারণ, সবে স্টেশন ছাড়ছে। তাই গতি কম। গতি বাড়ছে ক্রমশ। এই ট্রেনে নৌকোয় চড়ার মজা আছে। তবে কীটনাশকের গন্ধে ভরে আছে চারপাশ। আমি ট্রেনের জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছি বাহিরে, রাস্তায় বড় বড় সসপ্যানে বিরিয়ানি বিক্রি হচ্ছে। কত দিন খেয়েছি! গরু-ছাগলের লেজ, ভুঁড়ি, কান, অণ্ডকোষ, শিশ্ন ইত্যাদি বাতিল অংশ ভালো করে ধুয়ে-টুয়ে করে ছোট ছোট করে কেটে তা দিয়ে বিরিয়ানি বানানো হয় বলে এত সস্তায় বিক্রি করা যায়। পাঁচ টাকা ছোট প্লেট, দশ টাকা বড় প্লেট। আমরা বলতাম কাউয়া বিরিয়ানি। ঘ্রাণটা অসাধারণ, যেনবা ঘ্রাণ তার শাদা।

একটা দোকানে তন্দুর রুটি বানাচ্ছে। আহা, কোনো দিন ছোটবেলায় আট আনায় এই রুটি কিনে খেতাম। বলতাম নানরুটি। এখন সেই রুটি দশ টাকা, কোথাও কুড়ি টাকা, কোথাও আরও বেশি। আমি জানালা থেকে মুখ সরিয়ে ট্রেনের ভিতরে তাকালাম। দেখলাম আমার বয়সী একজন এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তাকে দেখে আমার দালির কথা মনে পড়ে গেল। অনেকটা তার মতো গোঁফের স্টাইল। সালভেদর দালি। তার ছবি আমার তেমন ভালো লাগে না কেন, তা এইখানে বলব না। তারপরও সে একদিন স্বপ্নের ভিতর দুপুরবেলা আমাকে ডেকে বলেছিল, শোন পাগলা, আমি মদ খাই না। আমি নিজেই মদ।

সেদিন মনে আছে, আমি ঘুমের ভিতর, স্বপ্নের ভিতর, দুপুরের রোদের ভিতর দালির গাণ্ডীবসদৃশ গোঁফের দিকে তাকিয়ে নীরবে হেসেছিলাম। কথাটা খুবই মনে ধরেছিল আমার। সেই থেকে আমিও মনে হয়, মদ হওয়ার চেষ্টাতেই আছি।

আমার বয়সী সেই একজনের সঙ্গে আমার নিচের কথাগুলো হলো

সে: দূর থেকে আপনাকে দেখে আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে এলাম।

আমি: আপনি আমাকে চেনেন?

সে: হ্যাঁ, ফেসবুকে আমি আপনার লিস্টে আছি। আপনার কবিতা পড়েছি, মহিষের হাসি বইটা আছে আমার কাছে।

আমি: ও আচ্ছা।

সে: কার চঞ্চুতে রোদ লেগে ছাই হয়ে গেল গান! ও পাখি, তুমি সূর্যের আত্মীয় নাকি? কোনো দিন ঘুমের অনাচারে জেগে দেখি ভোর এসে জানালার ফাঁক গলে মেঝেতে গড়িয়ে পড়েছে। ভোর সেও এক পাখিআমার মেঝেতে এসে ডানা ভেঙে পড়ে থাকে। তোমাদের শহরে আমার রাতগুলি ভস্মগানের সুর ধরে প্রলম্বিত হয় রাস্তায়, আর আমার গায়ে ধানের গন্ধ। প্রতিরাতে রাস্তায় হেডলাইটের তীব্র আলো খুলে নিতে চায় আমার চোখ, আমি বাম হাতে আলো মুছে তাকাই ধীরে, পাশ কেটে চলে যায় নিঃশব্দ অ্যাম্বুলেন্সপেটের ভিতর তোমার মৃতদেহ।

আমি: কার কবিতা? চেনা লাগছে।
সে: আপনার মহিষের হাসি বইটার প্রথম কবিতা।
আমি: অহ্। আমার নিজের কবিতা মনে থাকে না।
সে: শুভ জন্মদিন।
আমি: আজকে আমার জন্মদিন জানলেন কী করে?
সে: কেন? ফেসবুক জানাল!
আমি: বহু ধন্যবাদ, আপনাকে।
সে: একটা কথা।
আমি: কী?
সে: আপনি যে সিটে বসে লিখছেন, ওই মাথায় বাথরুমের সঙ্গে লাগোয়া ঠিক একই সিটে বসে আরেকজন আপনার মতো একটা খাতায় কিছু একটা লিখছে।
আমি: কো-ইনসিডেন্স।
সে: হ্যাঁ।

আমি দেখলাম, হ্যাঁ, আমার মতোই একজন কিছু লিখছে। এমনকি তার মাথায়ও চুল নাই, আমার মতোই তার মাথায় একটা দীর্ঘ কাটা দাগ। হঠাৎ করে সে মুখ তুলল আর আমি বিস্ময়ে থ। সে। এই নিয়ে আমি তাকে তৃতীয়বার দেখলাম। এই প্রথম মনে হলো সে সুন্দর। তার মানে কি আমিও সুন্দর?

আমার বয়সী যে আমাকে শুভ জন্মদিন বলতে এসেছিল সে চলে গেল। আমার কলমের কালি শেষ। লোকটা আমাকে একটা কলম দিয়েছিল। আমি তার কলম দিয়েই বাকিটা লিখছি। আমি কন্যা রাশির জাতক। শরতের এক বৃষ্টির দিনে আমার জন্ম হয়েছিল। আর হ্যাঁ, ব্যাপারটা ঠিক কো-ইনসিডেন্স নয়, কাকতাল মানে ক্রো-ইনসিডেন্স হওয়া উচিত। কারণ, কাক মানে তো কো নয়, কাক মানে ক্রো।

ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে এসেই পেটে বাতাসের ছোঁয়া পেলাম। চমকে তাকিয়ে দেখি আমার শার্টের তলা থেকে তিন নম্বর বোতামটা নাই। কোথায় পড়ল? ভাবতে গিয়ে দেখি পায়ের কাছেই একটা ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল হাঁ করে তাকিয়ে আছে অন্ধকার চোখ মেলে, ম্যানহোলের পেটে একটা বাঁশ পোঁতাআমি কী মনে করে নেমে পড়লাম তার মধ্যে। ম্যানহোলের নাম ম্যানহোল কেন হলো এই ভাবনা আমার মাথার ভিতর আবর্তিত হচ্ছিল অকারণেই।

ম্যানহোলের ভিতরটা বেশ প্রশস্ত। আমার পা পচা কাদাজলে ডুবে গেল। আমি সামনের অন্ধকারের দিকে হাঁটতে থাকলাম। মনে হলো সামনে কোথাও নদীতে এই পথ শেষ হয়েছে। মনে হলো কোথাও একটা মোরগ ডেকে যাচ্ছে সমানে, কুক্কুরুউ কুক, কুক্কুরুউ কুক, কুক্কুরুউ কুক...আমি শৈশবে বন্যার পর কাদাগন্ধের ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। হঠাৎ করে বিকট শব্দে ঘোর কেটে গেল, মনে হলো সামনে থেকে ট্রেন আসছে। আর আমি জলের গন্ধ পেলাম।