সুগন্ধি পুরাণ 

 

আবেদ মুন্সি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ায় এলাকায় চাঞ্চল্য’।      
দৈনিকের ভেতরের পাতার নমঃশূদ্র এলাকা—মফস্বল বিভাগের কোণায় এক কলামের স্লিমদেহী শিরোনামটা দেখে আমার আগ্রহের অঙ্কুরোদগম ঘটে। মাথা তুলে দাঁড়ায়। তাই নিউজটার প্রতি ঝুঁকি। 
দ্যাখি, মুন্সিসাব দেশের পশ্চিমের যে অঞ্চলের লোক, সেখানকার জেলা সদর থেকে নিউজটা পাঠানো। গোড়াতেই তার প্রতিনিধির নাম। তার তলা দিয়া খাঁটি ও নির্ভেজাল নিউজের পা ফেলা—‘জেলার সবগুলো ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে সরকারি দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হলেও একমাত্র আদমতলায় জিতেছেন গোলাপফুল মার্কার আবেদ মুন্সি। তিনি সরকারি দলের প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেছেন। তাই এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।’
হ্যাঁ, চাঞ্চল্য হবারই কথা। কেননা আজকাল সরকারি দলের প্রার্থীদের যে দুর্দান্ত প্রতাপ। তার সাথে আবার সই পাতানো—ভোট ডাকাতি, আগের রাতে ব্যালটবাক্স ভরা, কারচুপি, জালভোট, আরো কতো কিছু। তার সবগুলোরে মুন্সিসাব হারালেন কোন কৌশলে? কুপোকাত করলেন কোন কায়দায়? 
তা জানার জন্য আমার কৌতূহল আরো প্রবল হয়ে ওঠে। চার হাতপায়ে যেন ঝাপটে ধরে। আমি তাই তড়িঘড়ি নিউজের নিচে যাই—‘খোঁজ নিয়া জানা গেছে, তিনি এলাকায় থাকেন না। নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা হওয়ার পর গ্রামের বাড়িতে এসে ভোটের লড়াইয়ে নেমে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছেন।’
হ্যাঁ, আবেদ মুন্সির বসবাস রাজধানীতে। শুধু তা-ই নয়, একেবারে আমাদের পাড়াতেই তার আস্তানা। কেবল নির্বাচনি ডামাডোল, তার গুরুগুরু ডাক শুরু হলে তবেই তিনি গ্রামমুখো হয়েছেন। এখন দ্যাখছি বিজয়ও ছিনিয়ে নিছেন। এভাবে আকস্মাৎ ঝাঁপায়ে পড়ে জেতা তো বীরের লক্ষণ। একেবারে ইতিহাসের বখতিয়ার খিলজির স্টাইল। কিন্তু আজকালকার জমানায় এ রকম বীরপুরুষ, যিনি আগাম কোনো প্রস্তুতি না নিয়া, গ্রাউন্ড ওয়ার্ক না করে সরকারি দলের লোকজনরে হারায়ে দিতে পারেন, তার সন্ধান পাওয়া বিরলপ্রজাতের ঘটনা। আমি তাই আরো খোঁজখবর পানে ছুটি। দ্যাখি, নিউজের একেবারে তলদেশে লেখা—‘এলাকাবাসী জানায়, আবেদ মুন্সিকে কোনো ধরনের নির্বাচনি প্রচারণা চালাতে দেখা যায়নি। এমনকি পুরো এলাকার কোথাও তাঁর একটা পোস্টার কিংবা লিফলেট কারো নজরে পড়েনি।’
ব্যস, নিউজ শেষ, পুরাটাই যেন এক ছোটোগল্প। শেষ হইয়্যাও হইলো না শেষ। রয়ে গেল অতৃপ্তি। তাই পত্রিকা ছেড়ে মোবাইল হাতে নেই। ফোন করলেই আবেদ মুন্সির নিজের মুখে জানা যাবে গোড়ার খবর—পোস্টার লিফলেট ছাড়া, প্রচার-প্রচারণা ব্যতিরেকে তার বিজয় মুকুট লাভের কলা-কৌশল।
কিন্তু কন্ট্রাক্ট লিস্টের এমাথা ওমাথায় বার দুই সায়ের করেও তার নম্বর খুঁজে পাই না। তাহলে কি তা কখনো নেয়া হয়নি? তার সাথে কখনো কথা হয়নি বিনা তারের যন্ত্রে? মোবাইলে তাই সেভ করা নাই। হিসাব করে দ্যাখি—তা-ই। তার সাথে আমার যত আলাপ, লেনদেন, তার সবটাই মুখোমুখি। একেবারে উপস্থিত সাক্ষাতে।
তার মধ্যে প্রথমবার এক জুমার দিন। আমরা যারে শুক্রবার বলে পবিত্রতার মোচায় বেঁধে রাখি। মনে আছে, সেদিন বাসায় পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে জুমার নামাজের জন্য তৈরি হয়ে দ্যাখি আতরের শিশিটা নাই। কোথায় গেল? দিনারারে ডেকে জিজ্ঞেস করি।
—ওটা তো শেষ হয়ে গেছিল। তাই ফেলে দিছি।
আতর না পেয়ে তাই পারফিউম পানে ফিরি। দ্যাখি, ড্রেসিং টেবিলে তারা সার দিয়া খাড়া। আমার ও দিনারার, বন্ধুদের ভাষায় বাতিক, আমরা বলি শখ, তার নিদর্শন হিসাবে প্রায় ডজনখানেক কনটেইনারের সমাবেশ। তারা গায়ে গায়ে লেগে থাকলেও তাদের চেহারা-সুরত যেমন ভিন্ন ভিন্ন, নানান রকম আকার-আকৃতি, তেমনি সকাল ও রাত, অফিস ও পার্টি, নারী ও পুরুষদের হিসাবে জাত-গোত্রও আলাদা আলাদা। স্বভাব ধর্মেও তাদের রয়েছে ভিন্নতা। কিন্তু তার কোনোটাই আল্লাহর দরবারের জন্য উপযোগী নয়। তাই সুরভিমণ্ডিত না হয়েই সেদিন বাসা থেকে বার হই।
মসজিদ, কারো কারো মতে ধর্ম নিয়া কারবারিদের আড়তখানা, নগদ নারায়ণের উৎস, তার নগরী হিসাবে অহংকারে মাটিতে পা না পড়া ঢাকার সাথে একই শয্যায় শোয়া মিরপুরের মোড়ে মোড়েও তার একতালা দোতলা ঘরের ছড়াছড়ি। আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ডাইনে একখান আবার বায়ে আরেকখান। তবে দু মোড় ওপারের খান গায়ে-গতরে থানার বড়ো দারোগার মতো মোটাতাজা—আকার-আয়তনে বড়ো। আবার চেহারা-সুরতেও রূপসি—দরজা-জানালা ও ফটকে বাহারি কারুকাজ। আর সবচেয়ে গুরুত্ববাহী—তার অভ্যন্তরভাগ, বারান্দা বাদে ভেতরের অংশ, যেনবা আল্লাহর নিয়ন্ত্রণের বাইরে, বরং শীততাপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্রের হাতের মুঠোয় পোরা। ফলে বেশ আরামদায়ক। সে অন্দরমহলের আরাম ভোগের লোভে, ঘরের দুয়ারের দুখান বাদ দিয়া, সে নামাজাগার পানে পা বাড়াই।  
তার সামনে গিয়া দ্যাখি—ওমা! রাস্তার ওপারেই তো আস্তো একটা আতরের দোকান। দূর থেকে তার ভেতরের শোকেসে সাজানো ছোটো ছোটো শিশির বহর চোখে পড়ে। তবে এতোদিন দরকার হয়নি তাই হয়তো খেয়াল করিনি। নামাজ শুরুর আগের সময়টা তার বেচা-বিক্রির সবচেয়ে উর্বর মৌসুম, বাম্পার ফলনের কাল। তাই আশপাশের আর সব ব্যবসাগার মুখে কুলুপ এঁটে, ঝাপ ফেলে দিয়া থাকলেও আতরের দোকানখান হাঁ-মুখ করা। আপাদমস্তকে খোলা। 
কিন্তু বাসার যতো সুগন্ধি, পারফিউম, আতর বা বডিস্প্রে সে যে গোত্রেরই হোক না কেন, সবই কেনা হয় রাজধানীর অভিজাত মহল হিসাবে গাল ফুলানো গুলশানের একটা শোরুম থেকে। আমার অফিসের কাছের সে বিদেশি ভাণ্ডারের লোকজন এতোদিনে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। তাই আমার কিছু বলতে হয় না বরং ঢুকতে দেখলেই প্রিয় ব্র্যান্ডগুলা হাজির করে। নতুনগুলা দেখায়।
তাই হাজারো গলি-ঘুপচির দাগে কলঙ্কিত চেহারার কারণে লজ্জায় মূল রাজধানী নগর থেকে এক সাইডে এসে গা এলায়ে দেয়া মিরপুরের তস্যগলিতে নাম-পরিচয়হীন, সাইনবোর্ড-টোর্ডবিহীন আতরের দোকান পানে কদম ফেলতে আমার পা ইতস্ততার কবলে পড়ে। এক কদম ফেলে থমকায় আবার আরেক কদম ফেলে। শেষে নাই মার চেয়ে কানা মা দিয়া কাজ চালানোর আশায় ভেতরে পা দেই।
ঢুকে দ্যাখি ছোট্ট দোকান। দশ বাই পাঁচ ফিটের মতো হবে। তবে ফাইভ স্টার হোটেলের রিসিপশনের মতো ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার। সবার আগে চোখে পড়ে জুয়েলারি হাউজের মতো সামনের কাচের কাউন্টার। তার ভেতরে ছোটো ছোটো অবয়বের শিশি। বোঝা যায় সবগুলাই আতরের আধার। পিছনের দেয়ালে সাঁটা সেলফেও তাদের সমগোত্রীয়, সুরভিজলে গর্ভধারীদের সারিবন্ধ অবস্থান।
কাউন্টারের ওপারে দ্যাখি সাদা-কালোয় গা জড়াজড়ি দিয়া থাকা চাপদাড়ি ও সাইজ করা গোঁফে সমৃদ্ধ এক লোক। তার মাথায় লম্বা কিস্তি টুপি। আর গায়ে এমন ফিনফিনে সাদা ধকধবে পাঞ্জাবি যে তা ভেদ করে সহজেই ভেতরের স্লিভসমেত গেঞ্জির পুরাটাই চোখে পড়ে। এক নজরেই তারে আদি ও অকৃত্রিম আতরঅলা হিসাবে চেনা যায়। আমারে দেখে তিনি হাসিমুখে আমন্ত্রণ জানান—আসুন, মিনহাজ সাহেব আসুন।
সাথে সাথে তার মুখের ওপর আমার চোখ থির হয়ে যায়—অ্যাঁ! আমার নাম জানে কীভাবে? আগে তো কখনো দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। গুরু-সন্ন্যাসী নাকি?  
—এ এলাকায় বিশ-পঁচিশ বছর হয়ে গেছে। তারপর ব্যবসা করে খাই। তাই পাড়ায় নতুন কে এলো, পুরানা কে গেলো সব খবরই রাখতে হয়। ব্যাংকের বড় পোস্টে আছেন। দ্যাখি তো আপনার গাড়ি এ রাস্তা দিয়া আসা-যাওয়া করে। 
হ্যাঁ, এ এলাকায় আমরা নতুন এসেছি। মাস তিনেক হলো মাত্র। বাট, আমার অফিসের গাড়ি তো ওদিকের মেইন রোড দিয়া আসা-যাওয়া করে। এদিকের গলি-ঘুপচিতে সাধারণত পা দেয় না। কেবলমাত্র ওদিকের জ্যাম কোমর বেঁধে বসলে, জমজমাট হয়ে উঠলে তবে এদিকে পানে ফেরে কিন্তু সে তো একেবারেই কালেভদ্রে। সে দুএকদিন আসা-যাওয়াতেই নাম-ধাম, পোস্ট-পদবীসমেত চিনে ফেলেছে?
—তাছাড়া আপনার মিসেস সেদিন এসেছিলেন। তখন সব আলাপ হয়। তিনি তসবিহ ও জায়নামাজ নিয়েছেন।
বাহ! ভদ্রলোকের ব্যবসা-বুদ্ধি তো বেশ টনটনে। আল্লাহর প্রিয় সুগন্ধির সাথে তারে ডাকাডাকির যাবতীয় সাজসরঞ্জাম—নামাজের আসন, জপমালা ও মাথা ঢাকার কাপড়ের টুকরো— সব বিক্রিবাটা করে টুপাইস কামিয়ে নিচ্ছেন। দ্যাখি, ওদিকের হ্যাঙারে সব ঝোলানো।  
তবে দিনারা বাসায় নামাজ পড়ে ঠিক আছে, বাট একেবারে দাদি-নানিবুড়িদের মতো তসবিহ ধরল কবে? আবার নতুন জায়নামাজ নিল ক্যান? কই! আমারে তো তার কিছুই বলেনি। 
আমার এতোসব হিশাব-নিকাশের ফাঁকে তিনি চোখের সামনের কয়েকশ’ শিশি বাদ দিয়া ভেতরের কোনো বাক্স থেকে একটা বার করে আমার দিকে আগায়ে দেন—এ্যাই নিন আপনার আতর। একেবারে খাঁটি। আমার কারখানায় বানানো। 
অ্যাঁ! আমি তো কিছুই চাই নাই। কেবল চারদিকে তাকায়ে দেখে যাচ্ছি। তাহলে বুঝল কীভাবে যে আমার আতর চাই। তা কিনতে এসেছি। এ লোক মনের খরবও পড়তে পারে নাকি? নাকি মাতুব্বরি, কেদরানি দেখানো? আমার ওপর এ রকম বাহাদুরি ফলানোয় আমার রাগ হয়। দু কথা শুনায়ে দিতে ইচ্ছা করে। তার জন্য মুখ তুলে তার পানে তাকায়ে দ্যাখি চেহারা জুড়ে অপরূপ আত্মবিশ্বাসের জৌলুস। হাসি মুখের খেলা—এগুলা বিজনেস ট্রিক।
আরে, আমিও তো ব্যাংকে বিজনেস করে খাই। হাজারো কাস্টমার হ্যান্ডেল করি। বাট, কই! কেউ কিছু চাওয়ার আগে তার মনের খবর জেনে তা পুরণ করার আজিব কোনো ট্রিক তো জানা নাই। 
—এ্যাই শিশিটার দাম একটু বেশি পড়বে। একেবারে নিজ হাতে স্পেশাল ফরমুলায় বানানো। 
শিশিটা হাতে নিয়া দ্যাখি, লেবেল-টেবেল কিছু নাই। কোনো ব্র্যান্ডের সিল-ছাপ্পরও অনুপস্থিত। কেবল একটা সাদা কাচাধারের ভেতরে কয়েক ফোঁটা হলদে জল। তাছাড়া দামটা গুলশানের ব্র্যান্ডের শোরুমের তুলনায় কম হলেও তস্যগলির দোকানের জন্য অনেক। বেশ চড়াই বলা যায়। তাই আপত্তি জানাতে মুখ তুলে তাকায়ে দ্যাখি তার চেহারাজুড়ে সেই আত্মবিশ্বাসের আরেক রূপ। ইস্পাতের মতো অনড় আবার পালকের মতো মোলায়েম। তারে ধরা যায় না, ছোঁয়াও অসম্ভব যেনবা। তা কেবল দেখে দেখে বিস্মিত হতে হয়। তাছাড়া কিছু বললে যদি আবার নতুন কোনো ট্রিক হাজির করে। তাই আর দামাদামির পথ না ধরে পুরো দাম দিয়া শিশিটা হাতের মুঠোয় পুরে অনেকটা তাড়াহুড়ো করে দোকান থেকে বার হয়ে রাস্তার ওপারের মসজিদমুখী হই। 
তবে আল্লাহর ঘরে পা দেবার আগে শিশি খুলে তার জলের পরশ ঠিকই বুলায়ে নেই। তারপর বারান্দায় পা দিয়া দ্যাখি ভরা। পুণ্যলোভী মুসল্লিতে ভরপুর। ওহ! দেরি করে আসা খুচরা ব্যবসায়ী—শর্টকাটে আল্লাহর সাথে পুণ্যের কারবার করে নেয়াদের জায়গার যদি হয় এই অবস্থা তাহলে পাইকারী বেপারী, আগেভাগে আসা অধিক মুনাফালোভীদের এলাকা অন্দরমহল নিশ্চয়ই টইটুম্বুর। তাতে পা রাখারও জায়গা হবে না হয়তো। ব্যাটা আতরঅলা, বকবক করে দেরি করায়ে দেয়ায় আজ তার সুখভোগ করাও হবে না তাহলে। 
তারপরও দরজা পথে ভেতরে উঁকি দেই। দ্যাখি, পরম করুণাময়ের এক টুকরো করুণা যেন হাজির—ডানপাশের কাতারে একটু খালি। একজন দাঁড়াবার মতো জায়গা ফাঁকা। ব্যস, আর দেরি না করে, আর কেউ এসে হাজির হবার আগেই, দুটো কাতার ডিঙ্গিয়ে সেখানটা দখল করে নেই।
তখন যেন আমার সদ্য কেনা আতরের প্রথম সুরভি, আনকোরা সুবাস এসে নাকে হাজির হয়। দ্যাখি, একেবারে তরতাজা টাটকা সুগন্ধ। আমি থির হয়ে তার জাত-পরিচয় চেনার চেষ্টা করি। স্বভাব-ধর্ম বুঝতে চাই—বাহ! দারুণ খুশবু। বাহারি সুঘ্রাণ। যেমন মিহি মোলায়েম, তেমন মন-প্রাণ জুড়ানো।
পারফিউমের সাথে আমার বসবাস দীর্ঘদিনের। বছরের পর বছর ধরে তাদের পরশ নিয়া আসছি। বাট, তাদের কেউ-ই আমারে এমন মনোহর সুঘ্রানে মোহিত করতে পারে নাই। আমি বিমুগ্ধ হয়ে তার গন্ধ-সুধা পান করতে থাকি। মনে হয় এ যেন একেবারে বেহেস্তি খুশবু। স্বর্গীয় সুগন্ধি।  
এক সময় সে যেন আমার পুরো শরীরের ছড়িয়ে পড়ে। দেহের দখল নিয়া নেয়। ফলে আপাদমস্ত কেমন হালকা হালকা লাগে। যেন কাগজের ভেলা, ইচ্ছে করলেই বাতাসে ভর দিয়া উড়ে যেতে পারি। কিন্তু জুমার আসল নামাজ—দু রাকাত ফরজ—তখনো বাকি। তাই শুরুর সুন্নত শেষ করে কাতারবন্দী শত শত মুসল্লির সাথে ফরজের অপেক্ষায় গ্যাট হয়ে বসে থাকি।
শেষে ইমাম সাহেবের সাথে যখন তা শুরু করি, ফরজ নামাজে দাঁড়াই, আর তিনি উচ্চকণ্ঠে আল্লাহর বাণী, কোরানের কালাম পাঠে নামেন, সুললিত কণ্ঠ ছড়িয়ে দেন, তখন আমার সুরভি যেন তার শেষ ক্যারিসমায় মেতে ওঠে। আখেরি খেলায় পা দেয়। প্রথমে সে আমার মস্তিষ্কে গিয়া বসতি নেয়। পুরোটা হাতের মুঠোয় পোরে। তারপর সুরভির ইরেজার দিয়া দিন-দুনিয়া, জগত-সংসার,—সব কিছু ধুয়েমুছে যেন সাফ করে ফেলে। আমি তার কিছুই আর খুঁজে পাই না। বরং দ্যাখি আমার চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা জুড়ে কেবলমাত্র আল্লাহর নাম ও তাঁর গুণাবলী গুঁজে দেয়া। ফলে নামাজের পুরোটা সময় জুড়ে আমি কেবল পরম করুণাময়ের অপার গুণাবলীতে মুগ্ধ হয়ে থাকি। রুকু-সিজদায় নত ও অবনত হয়ে তাঁর প্রশংসায় মেতে উঠি। আর সালাম ফেরানোর পর মনে হয় এমন আল্লামগ্ন, আত্মবিমোহিত ইবাদাত আমার এতো বছরের জীবনে যেন এই প্রথম। তাই মসজিদ থেকে বার হয়ে আতরঅলার খোঁজে উল্টোদিকে তার দোকান পানে তাকাই। দ্যাখি, তা বন্ধ। মুখের উপর আপাদমস্তকজুড়ে ঝাপ ফেলা। সে এখনো বোধ হয় নামাজে। কখন তা শেষ হয় বলা যায় না। তাছাড়া এখন অনেক লোকজন, তাদের সামনে কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না। তার চেয়ে আরেকদিন এসে নিরিবিলিতে খোঁজ নিতে হবে। 
আমি তাই আর কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা বাসার পথ ধরি। পাঁচতলা পাড়ি দিয়া ঘরে পা দিতেই দিনারা আমারে পাকড়ায়—তুমি আতর পেলে কোথায়?
—ওই তো মসজিদের সামনের একটা দোকানে।
—ওহ! তাহলে তুমি আবেদ মুন্সির দোকানে গেছিলে। জানো, পাশের বাসার ভাবি বলছিল, লোকটা নাকি অদ্ভুত অদ্ভুত আতর বানায়। দোকানের পিছনেই তার কারখানা। বিয়ে-শাদি কিছুই করেনি। জীবনভর আতর নিয়া পড়ে আছে। নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবন করছে। তাই দোকানে কোনো সাইনবোর্ড-টোর্ড না থাকলেও দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এসে তার আতর নিয়া যায়।
—বাট, তুমি তো গেছিলে শুনলাম তসবিহ-জায়নামাজ কিনতে।
—হ, আম্মুর আগের সেট পুরানা হয়ে গেছে। তাই নতুন এক সেট কিনে পাঠায়ে দিছি। 

 

দুই

সকালে ঘুম ভাঙার পর তখনো বিছানা ছাড়িনি। তার ওমের হাতে গা-গতর ছেড়ে দিয়া চোখ বন্ধ করে আছি। দিনারা তখন আমার কানের কাছে ফিসফিসায়—জানো, স্ট্রিপের টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে। 
—অ্যাঁ! বলো কী? আমি চমকে গিয়া শোয়া থেকে উঠে বসি।
—হ্যাঁ, সকালে বাসি ইউরিনে টেস্ট করেছি। দ্যাখি দুটোই লাল দাগ।
—তাহলে চলো ডাক্তারের কাছে গিয়া কনফার্ম হই। আজ আর অফিসে যাব না। ফোন করে বলে দেই ফ্যামিলি ইমার্জেন্সি।
—ওহ! এখন তো দ্যাখি তোমার উৎসাহের জোয়ার। বান বইছে। বাট, সেদিন তো আতরটা একটু নিতেও চাওনি।
হ্যাঁ, তা ঠিক। আমাদের বিয়ের বয়স পাঁচ পার হয়ে গেছে। তার প্রথম তিন বছর গেছে হেসে খেলে, ঘুরেফিরে। অনেকেই যারে হানিমুন পিরিয়ড বলে তাতে। তারপর আমরা বাচ্চা নেবার পথে পা দেই। হিসাব করে, রীতিমতো কর গুনে গুনে দিনারার ডেঞ্জার পিরিয়ডগুলোতে জোর কসরত চালাই। রাতে একাধিকবার মিলনের পথে নামি। ছুটির বারগুলাতে দিনের বেলাতেও। কিন্তু কোনো কাজ হয় না। বরং দিনারার মাসের রক্তপ্রবাহ নির্দিষ্ট দিনেই বইতে শুরু করে।
শেষে আমরা দুজনে মিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। দিনারা তো রীতিমতো তাদের হাত চেপে ধরে—‘আমাদের একটা ব্যবস্থা করে দেন। আমি যে বান্ধা না ও যে আটকুঁড়া না তা প্রমাণ করার সুযোগ করে দিন।’ তারা তখন এ টেস্ট দেন, প্রেসক্রিপশনে সে টেস্টের নাম লেখেন। একবার ফরেনইন ট্যুরে বিদেশি ডাক্তারের চেম্বারেও ধরনা দেই। কিন্তু তারপরও দিনারার দেহে এতোটুকু পরিবর্তনের আলামত ফুটে ওঠে না। 
সে তখন টোটকা চিকিৎসার পথ ধরে। নানা ধরনের ছাল-বাকল খায়। কখনো কখনো তাবিজ-কবজেরও আশ্রয় নেয়। আর তার বিছানার পার্টনার হিসাবে মাঝেমধ্যে আমারও তার পিছু ছুটতে হয়। অংশ নিতে হয় তার প্রয়াসে। কিন্তু একদিন এক শিশি আতর নিয়া এলে আমি বেঁকে বসি—অ্যাঁ! এই হলুদ জলে কী হবে?
—আবেদ মুন্সিসাব দুইমাস ধরে অনেক চেষ্টা-চরিত্র, রিচার্স করে এটা বানাইছেন। বলেছেন, এটা মহৌষধের কাজ দেবে।
—কীভাবে?
—আমার ডেঞ্জার পিরিয়ডের রাতগুলাতে পারফিউমের বদলে এটা তোমার ইউজ করতে হবে।
—তাতেই হয়ে যাবে?
—না, আমার জন্য আলাদা শিশি আছে। সেটা আমার ইউজ করতে হবে। মুন্সিসাব বলেছেন, দুই শিশির মিলনে কাজ হবে।
—বাহ! তোমার মুন্সিসাব তো আতর বেচার দারুণ ধান্দা বার করছেন। এক চান্সে দুই শিশি। তার জন্য তোমার কাছ থেকে কতো খসাইছেন। নিশ্চয়ই মোটা দাঁও।
—বলছি না, তার তেমন কোনো চাহিদা নাই। আমার অনেক বলা-কওয়ার পর বানাইয়্যা দিছেন। তোমার এক ফরেইন কনটেইনারের দামেই তার সব চাহিদা মিটে গেছে। 
রাজা-বাদশাহরাও রানি-বেগমের আবদার ফেলতে পারেন নাই। বরং তাদের কথায় পাশের দেশে হামলা চালাইছেন। মরণ যুদ্ধে ঝাঁপাইয়্যা পড়ছেন। আর আমি তো তুচ্ছ এক ব্যাংক কর্মকর্তা মাত্র। সুতরাং আমার আর বউয়ের কথায় সামান্য আতর, ফলের গতর পেষা জল মাখতে সমস্যা কোথায়? আমি তাই দিনারার ডেঞ্জার পিরিয়ড শুরুর রাতে আবেদ মুন্সির নিজ হাতে বানানো, তার ভাষায় মহৌষধির পরশ নিয়া বিছানায় যাই। 
দ্যাখি, তীব্র ও কড়া তার ঘ্রাণ। নাকের পথে সে দুর্দান্ত প্রতাপে, হৈ হৈ রবে গিয়া মস্তিষ্কে হানা দেয়। গোলার আঘাতের মতো ধাক্কা মারে। আমার মাথা যেন ঝাঁকি খায়—অ্যাঁ! নরম-কোমল ফুলের রসের এতো বিক্রম? কামানের গোলার শক্তি? কই! এতো বছর ধরে এতো সুগন্ধি ব্যবহার করছি, তাদের কারো তো এতো বিপুল জোস দ্যাখিনি।
দিনারা বলছিল, আবেদ মুন্সি নাকি অদ্ভুত লোক, আজিব আজিব ধরনের আতর বানায়। তার কোনটা যে দিছে আল্লাহ মালুম। আমি ভয় পেয়ে যাই। মস্তিষ্কে তার দাপুটে আনাগোনা চলতে থাকায় শঙ্কা জাগে—অ্যাঁ! আমার মাথাটারে তছনছ করে ফেলবে নাকি? পাগল করে তুলবে শেষে? 
আমি তাই থির হয়ে বসে থাকি। বিছানায় গা এলায়ে দেবার সাহসে কুলায় না। তবে কিছুক্ষণ পর মাথা সুস্থির হয়। তার সব অস্থিরতা কাটে। মনে হয়, মস্তিষ্ক সব ঝামেলা সামলে নিছে। এতো বড়ো ধাক্কাও কবজা করে ফেলেছ, মারহবা।
এবার আমি বিছানায় গা এলায়ে দেই। তখন এক অনাস্বাদিতপূর্ব অপরূপ অনুভূতি এসে জড়ো হয়। সে আমার মাথা জুড়ে হাত-পা বিছায়ে থাকে। তখন মনে হয়—বাহ! এতো ভারি চমৎকার মনোরম আস্বাদ। 
আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে তারে তড়িয়ে তড়িয়ে উপভোগ করতে থাকি। তখন সে তার আসল ক্যারিসমা, আদত উদ্দেশ নিয়া হাজির হয়—আমারে একেবারে কামনায় ডুবায়ে ফেলে। দেহজুড়ে তা থৈ থৈ করে ওঠে। এক‚ল ওক‚ল সব ভাসায়ে দেয়। ফলে আমার তখন একমাত্র চাহিদা হয়ে ওঠে উর্বরক্ষম এক নারীদেহ। তার পাপড়ি ঠোঁট, বুকের টিলা আর নাভিমূলের তলার ত্রিকোণ ভুঁই। দলনে-পীড়নে, চাষে-বাসে তারে ফলবতী করে তোলার জন্য আমি মরিয়া হয়ে উঠি।
তার খোঁজে পাশে তাকায়ে দ্যাখি দিনারা, বছর পাঁচেক আগে চাহিবামাত্র দেহদানে বাধ্য থাকিবে চুক্তিবদ্ধা নারী, ততোক্ষণে এসে হাজির। তার শিশির ক্যারিসমায় সেও যেন উম্মুখ। তাই দ্যাখি তার পাতলা ঠোঁটে তিরতির কাঁপন, অনাবৃত্ত বুকের টিলা দৃঢ়তায় দাঁড়ানো। তাহলে নাভীমূলের নিচের ত্রিকোণ ভূঁইয়ের গুহ্যগুহায়ও নিশ্চয়ই জলের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং আমার আর ঝাঁপায়ে পড়তে অসুবিধা কোথায়। আমি তাই যেন ব্যাঘ্র গর্জনে তার ওপর চড়াও হই। সে হরিণি স্বরে সাড়া দেয়, চঞ্চল হয়ে ওঠে।
পরদিন সকালে নাশতার টেবিলে বসতেই মা আমার কাছে কৈফিয়ত তলব করে—কাল রাতে তুই আবার বউমারে বকেছিস?
—কই, না তো।
—তাহলে অতো রাতে তোদের রুম থেকে বউমার গলার গোঙরানির আওয়াজ পেলাম যে?
ওহ! তাই। আমি সাথে সাথে টেবিলে মুখোমুখি বসা, সদ্য স্নান করা সজীব মুখের দিনারার পানে তাকাই। দ্যাখি, তা নিচু করা। আমারো তাই করতে হয়। কেননা, মারে কীভাবে বলি—তোমার বউমা যে দাওয়াই এনেছে তাতে আরো সপ্তাহখানেক তোমার এ রকম গোঙরানি, মতান্তরে শীৎকার ধ্বনি শুনতে হতে পারে।

 

তিন

আবেদ মুন্সির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবার খবর পড়ার সপ্তাহ দুই পর একদিন অফিস শেষে একটু রাত করে বাসায় ফিরে দ্যাখি খাবার-দাবারের এলাহি কারবার। ডাইনিং টেবিলজুড়ে মাছ-মাংস, শাকসবজি, মিষ্টি-দইয়ের ডজন দেড়েক আইটেম সাজানো। তার প্রতিটা থেকে কেবল এক লোকমা করে কোনো পেটে গেলে তাতে আর এতোটুকু ফাঁকা থাকার কথা নয়। 
তারপরও যেন আইটেমের শেষ হয়নি। রান্নাঘরে আরো যেন কিছুর আয়োজন চলছে। দিনারা তাই একবার ডাইনিংরুম একবার রান্নাঘরে মাকুর মতো আসছে-যাচ্ছে। আমারে দেখে একটু থামে।
কিন্তু আমাদের তিনজনের, সরি, এখন বোধ হয় চারজন বলা শ্রেয়, কেননা মাত্র কিছুদিন আগে যে এসেছে, আকার-আয়তনে এতোটুকু হলেও সেও তো সর্বাঙ্গযুক্ত একজন, সুতরাং চারজনের সংসারে চল্লিশজনের খাবারের আয়োজন দেখে আমার বিস্ময় তখনো কাটেনি। তাই মুখে কথা সরে না। কেবল ইশারা-ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করি—অ্যাঁ! ব্যাপার কী?
—আবেদ মুন্সিসাবরে দাওয়াত দিছি। তিনি একা একা থাকেন। একা একা খান। কী খান না খান তার ঠিক নাই। তাই তারে বলছি আজ রাতে আমাদের সাথে খেতে। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো, এক সাথে বসবে।
ওহ! তাই। তবে দিনারা যা-ই বলুক, আমার বুঝতে বাকি থাকে না যে, এটা আসলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দাওয়াত। ও আগেই বলেছিল, ওদের ফ্যামিলিতে এ কালচার, উপকারীরে ভূরিভোজে তুষ্ট করে কৃতজ্ঞতা জানানোর বনেদি রেওয়াজ নাকি এখনো বেশ ঘটা করে আসন গেড়ে আছে। ও তার প্র্যাকটিস করছে মাত্র। সুতরাং আমার এখানে আপত্তি করার কিছু নাই। আমি তাই আট সিটের বিশাল ডাইনিং টেবিলের এমাথা থেকে ওমাথা জুড়ে বাটি-বৌল, প্লেট-পিরিচে সাজানো আইটেমগুলার পানে আরেকটা লুক দিয়া ভেতরে পা দেই। আমাদের বেডরুমমুখী হই।
মুন্সিসাব আমাদের, বিশেষ করে দিনারার মস্তো, দুই হাতে আগলানো অসম্ভব এমন বিশাল আকারের উপকার করেছেন। কেননা তার দেয়া দাওয়াই, আজিব কিসিমের কুদরতি আতর, তার একটু একটু পরশ নিয়া দিনারার ডেঞ্জার পিরিয়ডের রাতগুলা পার করার পরের মাসেই তার দেহের নিয়মিত রক্তপ্রবাহে কুলুপ আঁটে। বন্ধ হয়ে যায়। আর টেস্টে পজিটিভি রেজাল্ট আসে। তার মাথায়, মাস দশেক পর একেবারে আস্তো একটা প্রাণ, ফুটফুটে মেয়ে নিয়া সে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরে। সে সজীব প্রাণ এখন দিনারার জ্যান্ত, হাত-পা নাড়তে পারা পুতুল। তার সর্বক্ষণের সাথি। আমি বেডরুমে গিয়া দ্যাখি সে আমাদের বিছানা দখল করে আছে। মাঝবরাবর শুয়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে আছে।
জামা-কাপড় পাল্টে হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিংকাম ড্রয়িংরুমে ফিরে গিয়া দ্যাখি মুন্সিসাব তখনো আসেননি। ফলে দিনারারে খোঁচা মারার চান্স আর ছাড়ি না—কই! তোমার মহামান্য গেস্ট কোথায়?
—আসবেন, কথা হয়েছে। তুমি বসো। দোকান-পাট বন্ধ করে তার আসতে আরেকটু সময় লাগবে।
চেয়ারম্যান হয়ে গ্রামদেশ থেকে ফেরার পর তার সাথে আমার দেখা হয়নি। তাই ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে একটা বিনোদন ম্যাগাজিন, যার পাতায় পাতায় নায়ক-নায়িকাদের রঙিলা ছবির সমাহার, তা ওল্টাতে ওল্টাতে ওত পেতে থাকি। মুন্সিসাব এলেই পাকড়াও করব। জিজ্ঞেস করব— ছলে-বলে কৌশলে সরকারি দলের নির্বাচনে জেতার এই রমরমা মৌসুমে আপনি তাদের কুপোকাত করলেন কীভাবে? কোনো দল-মতের সহায়-সমর্থন এমনকি স্পর্শটুকু না নিয়া ভোটারদের প্রলুব্ধ করার কলা-কৌশলটা ছিল কী আপনার?
তবে আমার বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। কিছুক্ষণ পরই তিনি কলিংবেল টেপেন। আমি দরজা খুলে দ্যাখি তার হাতে একটা গোলাপ। তার পানে অবাক চোখে তাকাই—অ্যাঁ! একটা গোলাপ কেন? দাওয়াত খেতে এসেছেন নাকি প্রেম নিবেদন করতে?
ভালো মতো তাকায়ে দ্যাখি তাও আসল না, নকল। প্লাস্টিকের তৈরি। তবে দেখতে একেবারেই সদ্য ফোটা তরতাজা গোলাপের মতোই। তখন আমার মনে পড়ে— আরে এটা তো তার নির্বাচনি প্রতীক—গোলাপ ফুল। যে মার্কা দিয়া বাঘা বাঘা খেলোয়াড়দের হারায়ে দিছেন এখনো তার মায়া ছাড়তে পারেন নাই। তাই সাথে সাথে নিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছেন, বাহ।
তারে স্বাগত জানায়ে ড্রয়িংরুমে নিয়া এলে তিনি গোলাপটা সোফার সামনের টি-টেবিলের ফুলদানিতে সযতনে রাখেন। তারপর পকেট থেকে একটা আতরের শিশি বার করে তাতে দু-এক ফোঁটা ঢেলে দেন। সাথে সাথে আমাদের পুরো ড্রয়িং-কাম-ডাইনিং রুমে গোলাপের সৌরভ এসে হাজির হয়। আশপাশের রুমেও হাত-পা ছড়ায়। দিনারা তাই ওঘর থেকে ছুটে আসে—বাহ! দারুণ সুগন্ধ তো। একেবারে অন্য রকম সৌরভ।
—হ্যাঁ, তাজা গোলাপের নির্যাস দিয়া বানানো।
ধীরে ধীরে সে সৌরভ আরো সুদৃঢ় হয়ে আসন গাড়ে। পুরো ঘর-দুয়ার সব দখল করে নেয়। আর আমাদের নাকের ডগায় অবাধে ঘুরে বেড়ায়। আমরা থির হয়ে বসে তার মৌতাতে ডুবে থাকি।
কিন্তু তার স্বভাব-চরিত্র ধরতে পারি না। তার জাত-গোত্র চেনাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। কেননা এমন মিহিন-মোহন সৌরভের সাথে আমার আগে কখনো জানা-পরিচয় হয় নাই। ফলে সে যেন অবাধ স্বাধীনতা পায়। আপন গতিতে আগাতে থাকে।
শেষে সে আমাদের যেন একেবারে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলে। আমাদের অতীত-বর্তমান মুছে দেয়। বরং সে যা ভাবায় আমরা তাই ভাবি, সে যা দেখায় আমরা তাই দ্যাখি। দিনারা তাই চিৎকার করে ওঠে—আমার খাবার-দাবার কই? দুপুর থেকে এতো যতœ করে এতোগুলা আইটেম বানালাম, সব দ্যাখি ভেনিস। টেবিলজুড়ে কেবল গোলাপের ছড়াছড়ি।
আমি ঘাড় ঘুরায়ে ডাইনিং টেবিল পানে ফিরি—হ্যাঁ, তাই তো। তাতে এতোসব খাবার-দাবারের বদলে শুধু গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপ সাজানো। হাতের ম্যাগাজিনটার দিকে তাকাই—দ্যাখি তার পাতায় পাতায় কেবল তার ছবি। নায়ক-নায়িকাদের এতো সব ভঙ্গি সব হাওয়া। চোখ তুলে দ্যাখি রুমের আলো-বাতাসেও যেন গোলাপের আনন্দ-বিহার। গা ছেড়ে দিয়া তারা যেন চারিদিকে ভেসে বেড়ায়। 
শেষে সবকিছু ছেড়ে নিজের দিকে মনোযোগী হবার চেষ্টা করি। কিন্তু কই! তার কবজা থেকে মুক্তি মেলে না। সে যেন আমারে আষ্টেপিষ্ঠে বেঁধে ফেলে। এমনকি আমার মনে হয় এখন যদি কেউ আমারে নাম জিজ্ঞেস করে তাহলে হয়তো অনায়াসে বলে বসব গোলাপ। কেউ যদি কোনো মার্কায় ভোট দিতে বলে সে মার্কা ছাড়া আর কিছুতে সিল মারাও হয়তো আমার পক্ষে আর সম্ভব হবে না। 
ঠিক তখন কানে এসে বাজে মুন্সিসাবের গলা—এভাবেই আমি ইলেকশনে জিতেছি।
—তা কীভাবে?
—ইলেকশনের ডামাডোল শুরু হতেই আমি দোকানপাট বন্ধ করে গ্রামের বাড়িতে গিয়া উঠি। আমাদের এলাকায় যেহেতু গোলাপের বিপুল সমাহার। ঘরে ঘরে খেতে-খামারে তার চাষ। তাই তার নির্যাস নিয়া নতুন ধরনের একটা আতর তৈরি করি। একেবারে নিজস্ব ঘরানার অভিনব জাতের সে সুগন্ধিই আমারে নির্বাচনে জিতায়ে দিছে।
—অ্যাঁ! সামান্য হলদে জলের এতো ক্ষমতা?
—হ্যাঁ, তাই। দ্যাখেন আমি কোনো ক্যাম্পেইন করি নাই। কারো কাছে গিয়া ভোটও চাই নাই। আর টাকা-পয়সা খরচ করে পোস্টার-লিফলেট ছাপানোর সাধ্যও আমার ছিল না। তবে মার্কাটা নিছি গোলাপ। আমাদের এলাকার ঘরে ঘরে তার চাষ। সবাই তারে চেনে-জানে। ব্যস, ভোটের দিন মাত্র জনপঞ্চাশেক লোক জোগাড় করছি। তারা একেকজন আমার এজেন্ট হইছে। প্রতিটা বুথে তারা একেকজন করে গেছে। আর তাদের প্রত্যেকের পকেটে গুঁজে দিছি আমার আতর মাখানো একেকটা গোলাপ। তার সুবাসে পুরো বুথ ভরে গেছে। ফলে যে ভোটার বুথে ঢুকেছে, সে আসল হোক আর নকল, আদত কিংবা জাল ভোটার, যে-ই হোক না কেন তার নাকেই সুগন্ধ জায়গা করে নিছে। আসন গেড়ে বসেছে। তার মগজ থেকে আর সবকিছু মুছে দিয়া তারে গোলাপে বিভোর করে তুলেছে।  সে তখন ব্যালট পেপার হাতে নিয়া তা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনি। অন্য কোনো মার্কা দ্যাখেনি। তাই তার পক্ষে তখন গোলাপ ছাড়া আর কিছুতে ভোট দেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে মুহূর্তে মুহূর্তে তাতে সিল পড়ে। বাক্স ভরে ওঠে। আর দিন শেষে আমি বিপুল ভোটে জিতে যাই। 
—বাহ! তাহলে এখন আপনি পুরোদস্তুর চেয়ারম্যান?
—ধুর! কে যায় এই বেহেস্তি সুগন্ধির জগত ছেড়ে দুর্গন্ধির রাজনীতিতে। তাই তো সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়া, রিজাইন-টিজাইন করে এসেছি। সে কারণেই ফিরতে একটু দেরি হলো। আমি তো গেছিলাম কেবল আমার নতুন জাতের সুগিন্ধটার পরীক্ষা করতে। আপনারা যারে টেস্ট বলেন আর কি। একেবারে হাতে-নাতে হাজারো লোক দিয়া হার্ন্ডেড পার্সেন্ট সাকসেক্সফুল টেস্টটা সেরে আসলাম।