পথের পাঁচালী এশিয়ার মুখ

 

পথের পাঁচালী যে নব বাস্তববোধ দর্শক ও সমালোচকদের হতবাক করেছিল, তাই একদিন সত্যজিৎ রায়কে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করে তুলল। পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রটি একটা প্রবল ভূমিকম্পের মতো ভারতীয় চলচ্চিত্রের গৃহীত কাঠামোকে চূর্ণ করল। চলচ্চিত্র নিয়ে অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা পছন্দ করতেন সত্যজিৎ রায়। সেই অনুসন্ধিৎসু মনের পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায় তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর ভাব, ভাষা এবং বিষয়ের বৈচিত্র্যে। বিশেষ করে যেসব চলচ্চিত্রে তিনি মৌলিক চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করেছেন, সেগুলোতে তার স্বাতন্ত্র্য এবং মৌলিকত্ব আরও যেন বেশি স্পষ্টরূপে প্রকাশ পেয়েছে।

সত্যজিতের চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান ও পুনরাবৃত্ত উপাদান ছিল এর মানবতাবাদ। তাঁর ছবিগুলো আপাতদৃষ্টিতে সরল, কিন্তু এই সরলতার গভীরে লুকিয়ে আছে জটিলতা। তাঁর চলচ্চিত্রের বর্ণনাভঙ্গি ও চরিত্রায়ন নিখুঁত বলে অনেকবার প্রশংসিত হয়েছে। আকিরা কুরোসাওয়া বলেছিলেন, সত্যজিতের চলচ্চিত্র না দেখা আর পৃথিবীতে বাস করে চন্দ্র-সূর্য না দেখা একই কথা। অন্যদিকে সত্যজিতের নিন্দুকেরা মনে করেন, তাঁর ছবিগুলো অত্যন্ত ধীর গতির, যেন ‘রাজকীয় শামুকের’ চলার মতো। কুরোসাওয়া সত্যজিতের পক্ষ নিয়ে বলেন যে সত্যজিতের ছবিগুলো মোটেই ধীরগতির নয়। বরং এগুলোকে শান্তভাবে বহমান এক বিরাট নদীর সাথে তুলনা করা যায়।

সত্যজিৎ রায় নিজে মনে করেন যে ফিল্মের গঠন সাহিত্যের চেয়ে সংগীতের সঙ্গেই বেশি ঘনিষ্ঠ। বিশেষ করে পাশ্চাত্য মার্গসংগীত সিম্ফনির সঙ্গে। আর তাই ছবিগুলোয় একটা নির্মেদ সাংগীতিক গঠন—‘পথের পাঁচালী’, ‘শতরঞ্জ ক্যে খিলৌড়ি’। এর বাইরে কিছু নেই। পাশ্চাত্য সোনাটা ফর্ম বা সিম্ফনি সংগীতের মতোই। তাঁর ছবিগুলোতে খুব মন দিলে দেখা যায়, যেকোনো ড্রামাটিক মোমেন্টের পরপরই একটা স্লো মোশান। ইউরোপীয় সংগীতের ভাষায় অ্যালেগ্রোর [allegro] পরে অঁদঁ [andante]। আর তাই ইউরোপীয়রা সত্যজিতের সিনেমাকে তেমন পছন্দ করেননি। হয় তারা অনুধাবন করতে পারেননি বা জানেন না সময়ের গতি সংস্কৃতি থেকে সংস্কৃতিতে ভিন্ন হয়। প্যারিস বা নিউইয়র্কের সময়ের যা গতি, গ্রামবাংলায় তা এক নয়। ‘ক্র্যামার ভার্সাস ক্র্যামার’-এর টাইম-পেসের সঙ্গে ‘পথের পাঁচালী’-র টাইম-পেস মিলবে না সঙ্গত কারণেই এবং তা রায়ের বাস্তববোধেরই পরিচায়ক।

পথের পাঁচালী ছবিটার গুরুত্ব কী? সত্যজিৎ রায় কিন্তু বাংলা সিনেমার পথিকৃৎ নন। তার ছবি করার আগেও বাংলা সিনেমা হয়েছে। সত্যজিৎ রায় বাংলা সিনেমায় আধুনিকতার পথিকৃৎ। এমনকি চলচ্চিত্র নতুন ভাষার পথিকৃৎ। কেন এ কথা বলছি? তার কারণ, সত্যজিৎ রায় হলেন প্রথম চলচ্চিত্রকার যিনি উপন্যাসের পুরোটা দেখাতে চাননি। আপনারা যারা পথের পাঁচালী পড়েছেন এবং সিনেমাটার সাথে যদি মিলিয়ে দেখেন তাহলে দেখবেন উপন্যাসের তিনভাগের একভাগ মাত্র দেখানো হয়েছে। তিনি আসলে এখানে উপন্যাসটি দেখাতে চাননি। সত্যি বলতে এই ছবিটিতে তিনি গল্পটাকে একটা কমলালেবুর মতো দুই ভাগে ভাগ করেছেন যার দুদিকে দুটো মৃত্যু। একদিকে দুর্গার মৃত্যু এবং অপরদিকে ইন্দিরা ঠাকরুনের মৃত্যু। আগে কেবলমাত্র চরিত্রের মধ্যে দিয়েই গল্প বলা হতো। অর্থাৎ এতদিন ধরে আমরা গল্পনির্ভর এবং চরিত্রনির্ভর সিনেমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলাম; যদিও তার ভালো বা খারাপের মধ্যে যাচ্ছি না, আপনি যদি আজকে পথের পাঁচালী ছবিটা চোখ বন্ধ করে দেখেন, তাহলে বুঝবেন যে এটি প্রায় হাফ সাইলেন্ট মুভি অর্থাৎ খুব বেশি কথা নেই। যা আছে, তা হলো নয়েজের ব্যবহার।  মাত্র পাঁচটা মূল চরিত্র অর্থাৎ অপু, দুর্গা, হরিহর, সর্বজয়া, পিসিমা। এই পাঁচটা চরিত্র নিয়ে তিনি পুরো গল্পটা বলেছেন। এখানে নয়েজ বলতে ইন্সিডেন্টাল নয়েজের কথা বলা হচ্ছে। গানের ব্যবহার একেবারেই নেই, ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল’কে যদি গান বলেন, তাহলে আছে। তাছাড়া আর কিছুই নেই। আর বাকি ছবিটা নিসর্গকে অসাধারণভাবে ধরেছে। নিসর্গ আর মানুষ যে এক—সেটা বোঝানো হয়েছে।

ছবির শুরুতে একটা বাচ্চা মেয়ে তার হাতে একটা পেয়ারা, যখন জঙ্গলে লুকাচ্ছে আলোর রিফ্লেক্টর পাতায় ও তার গালে পড়ে। একটা পাতা আর একটা মানুষ যেন এক হয়ে যায়। বা ধরুন বিরাট একটা মাঠের মধ্যে দিয়ে অপু-দুর্গা গরু খুঁজতে যাচ্ছে, সেখানে লং-শটে অপু ও দুর্গাকে খুব ছোট ছোট লাগছে। এখানে পুরো ধানখেতটা আর আকাশটা পরস্পর দিগন্ত চুম্বন করছে—সেখানে চরিত্র কিন্তু শুধু এই দুটো মানুষ নয়। বাংলাদেশ যে এত সুন্দর তা আমরা আগে জানতাম না। যেমন ধরুন পথের পাঁচালীর বৃষ্টি। বৃষ্টি আমরা কমবেশি সবাই দেখেছি কিন্তু সত্যজিৎ রায় যে বৃষ্টি দেখালেন সেটা একেবারেই অন্যরকম। একজন মানুষ মাছ ধরছিলেন, প্রথম ফোটাটা তার টাকের ওপর পড়ল এবং আমরা দর্শক হিসেবে হেসে ফেললাম। তার পরমুহূর্তেই বাংলার আকাশ-বাতাস ঝেঁপে বৃষ্টি শুরু হলো। এবং এই যে বৃষ্টি শুরু হলো এর শব্দটা সত্যজিৎ রায় মুছে দিয়েছিলেন। তার বদলে রবি শঙ্করের তৈরি করা একটা তিন মিনিটের দেশ রাগ প্রয়োগ করেছিলেন। পৃথিবীর কোনো দেশের বৃষ্টিতেই সেতার বাজে না কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের বৃষ্টিতে সেতার বাজলো। পথের পাঁচালীকে যারা বাস্তব ছবি বলেন, তারা আসলে বলতে চান সেটা আক্ষরিক অর্থে বাস্তবতা নয়। দুর্গা যখন জলে ভিজে তার চুলটাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে বা আকাশের দিকে যখন তাকাচ্ছে, তখন দেখবেন ফ্রেমের নম্বার বেড়ে যাওয়ায় ছবিটা স্লো হয়ে যাচ্ছে। উপন্যাসে রয়েছে দুর্গার আশ্বিনের বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর হয় এবং তাতে মারা গিয়েছিল। কিন্তু সিনেমায় এটা হয়ে গেল গরমের বৃষ্টি। এই যে আকাশে মহাপ্রলয় এবং তা থেকে দুর্গার মৃত্যু, একে আমরা আলাদা একটা গল্প বলে মনে করতে পারি। কিন্তু তা করবো কি করবো না, সেটা অন্য কথা। এবং তারপর যে দুর্গা মারা গেল, এটা এমন একটা মৃত্যুর দৃশ্য যা বলা যায় আজ পর্যন্ত বাংলা সিনেমায় সবচেয়ে হৃদয় বিদারক মৃত্যু দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি। দুর্গাকে শুধু বলা হয়েছিল যে তুমি শুয়ে পড়ো আর তোমাকে কিছু করতে হবে না। শুধু যখন বলব তখন জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলবে। চড়া একটা লাইট, তাই দুর্গার মুখটা ঘেমে যাচ্ছে। দুর্গা বারবার নিঃশ্বাস ফেলছে এবং মাথা নাড়ছে। ক্যামেরার ক্লোজ শট দুর্গার মুখের দিকে তাক করে আছে। আর পাশে একটা ফ্যান চালিয়ে জানালার পর্দাগুলোকে নাড়ানো হচ্ছে। আমরা আজও যখন সেই দৃশ্যটা দেখি তখন মনে হয়, দুর্গার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে অর্থাৎ তাঁর শেষ মুহূর্ত সমাগত। ফ্যানের হাওয়ায় পর্দা নড়ছে, তাতে মনে হচ্ছে ঝড় ঢুকে পড়ছে ঘরে। এরপর একটা আলোর ঝলকানি হলো মানে বাজ পড়ল, তারপরেই দুর্গা চলে গেল। এই যে অসাধারণ দৃশ্য এটা সত্যজিৎ রায় করেছিলেন খুব অল্প পয়সায়। এমনকি তারপরের দিনের দৃশ্য করতে সত্যজিৎ রায়ের হয়তো আরও বেশি খরচা হয়েছিল। কারণ চারিদিকে জল জমে আছে, নানারকম আবর্জনা তার মাঝে একটা ব্যাঙ মরে উল্টো হয়ে পড়ে আছে। সত্যজিৎ রায় জানতেন যে এই যে মরা ব্যাঙটা পড়ে আছে, এটা দেখাতে গেলে ব্যাঙটা কিনতে হবে আর কিনতে গেলে পয়সার দরকার। এবং এই দাম যেটা লাগে সেটা কিন্তু খরচা করতে হয় সিনেমায়। এটা সত্যজিৎ রায় শিখলেন।

আরেকটা বিষয় হল স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের কিন্তু কিছু ভুল হয়েছিল। যেমন পথের পাঁচালীর কথাই বলা যায়। পথের পাঁচালীর প্রথম দৃশ্যের কথা ভাবুন। সত্যজিৎ রায় নিজেই বলেছিলেন। দুর্গাকে কাশবনে দেখে সত্যজিৎ রায়ের খুব ভালো লেগেছিল। তিনি অনেক ক্লোজ-শট নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন পরে এগুলোকে জুড়ে দেবেন। ফলে সেদিন অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যায়। যে ছবি তিনি একদিনে তুলবেন ভেবেছিলেন, সেটা পরের সপ্তাহে তোলার প্রয়োজন পড়ে গিয়েছিল। যেহেতু তখন তিনি চাকরি করতেন তাই প্রতিদিন শ্যুটিং করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই পরের সপ্তাহে তিনি গেলেন কিন্তু গিয়ে আর জায়গাটা খুঁজে পাচ্ছেন না। জায়গাটা ছিল বর্ধমানের পালসিট, যেখানে আমরা ল্যাংচা খাই অর্থাৎ শক্তিগড় তার ঠিক আগে। সে যায়গাটা ছিল পালসিটের রেল লাইনের ধারে একটা কাশবন। তিনি তো জায়গাটা খুঁজছেন, তখন এক বৃদ্ধ সেখানে ঘোরাঘুরি করছিলেন। জানতে চাইলেন, আপনারা কি কাউকে খুঁজছেন? তারপর নিজেই বললেন যে, আপনারা তো গত রবিবার এখানে এসেছিলেন অনেক ছবি তুললেন। তখন ওই বৃদ্ধকে সত্যজিৎ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, এখানের কাশবনটা গেল কোথায়? বুড়ো তখন হেসে বললেন আপনারা তো শহরের লোক, তাই জানেন না। কাশ তো সিজেনাল ফ্লাওয়ার। সে তো কবেই গরু-মোষ খেয়ে গেছে। সে কি আর এতদিন থাকে! এর ফলে ছবিটা এক বছর পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলো, কারণ কাশ তো আর কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যাবে না। হিন্দি সিনেমা হলে হয়তো কৃত্রিম কাশ করে নেওয়া হতো কিন্তু তাতে তো আর এই ইফেক্ট আসতো না। কিন্তু সত্যজিৎ রায় একগুঁয়ে। তিনি ‘এ লং টাইম অন আ লিটিল রোড’ নামে একটি লেখা লিখেছিলেন এবং তাতে নিজেই ব্যাখ্যা করেছিলেন যে শহরের মানুষ হওয়ায় এবং জীবন সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকায় কোথায় কোথায় তার সমস্যা হয়। এ ছবিতে তিনি সংলাপ খুব কম রেখেছিলেন, কারণ তার উদ্দেশ্য ছিল পিকটরিয়ালকে চূড়ান্ত মর্যাদা দেওয়া। পরবর্তীকালে পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের কনভোকেশনে তিনি বলেছিলেন, ফিল্ম ইজ টু ন্যারেট উইথ ইমেজেস, নট ইন আইডিয়াস। অর্থাৎ ফিল্ম ইমেজ দিয়ে কথা বলবে, ধারণা দিয়ে নয়। একটা গল্প আছে যাকে মুখে বললেই হলো না বা পাত্র-পাত্রী দিয়ে বলে গেলেই হলো না,তাকে দৃশ্য দিয়ে বোঝাতে হবে। কীভাবে দৃশ্য দিয়ে বোঝাতে হবে, সেটা সম্পর্কে নিশ্চয়ই তার ধারণা ছিল।

একটা জিনিস স্পষ্ট,, সংলাপ অত্যন্ত ঝামেলার জিনিস। সংলাপ যদি স্টুডিওর বাইরে নেওয়া হয়, তাতে অনেক নয়েজ আসে আর এই নয়েজের জন্য যদি সংলাপ ঠিক ঠিক ভাবে বোঝা না যায়, তাহলে সেই দৃশ্যগুলো স্টুডিওতে রিটেক করতে হয়। সাউন্ড রিরেকর্ডিং অত্যন্ত খরচের ব্যাপার। তিনি চাইছিলেন যত কম খরচে সরাসরি এই শব্দকে তোলা যায়। কারণ অত্যন্ত কম খরচে তিনি ছবিটা তৈরি করেছিলেন। এমনকি সত্যজিৎ রায়ের যিনি আজন্মসঙ্গী মানে পথের পাঁচালী থেকে আগন্তুক পর্যন্ত তার প্রতিটি ছবি এডিট করেছেন অর্থাৎ দুলাল দত্তের একটি বড় ইন্টারভিউ এখনও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে। এই ছবিতে শটের সংখ্যা কম ছিল সেটা দুলালবাবু পয়েন্ট আউট করেছিলেন সত্যজিৎ রায়কে। কিন্তু ছবিটা নিউইয়র্কে দেখানোর জন্য এতই তাড়াহুড়ো যে আর ছবি রিশুট করা সম্ভব হয়নি, তাই ওই কম শট নিয়েই ছবিটা তৈরি হয়ে যায়। এবংিএই ছবি হয়ে ওঠে এশিয়ার মুখ। তবে গর্বের কথা, পৃথিবীর সিনেমার যে ইনস্টিটিউটেই যান না কেন, তার দেওয়ালে কাশবনের মাঝে অপু-দুর্গার মুখ এবং এই ছবিটাই এশিয়ার ছবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।