জন-অজ্ঞানতা

 

ইনফরমেশন টেকনোলজির যুগে কেউ আর কোনো কিছু জানতে চায় না। সবাই ভাবে, সবকিছুই সে জানে। ফলে সমাজে জ্ঞানচর্চার ভাটা পড়ছে। তৈরি হচ্ছে জন-অজ্ঞানতা। স্বৈরশাসকদের এটা একটা বড় হাতিয়ার। জন-অজ্ঞানতা স্বৈরশাসকদের প্রচার করা যেকোনো বক্তব্যকে যাচাই করা ও চ্যালেঞ্জ করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়। মনে হয়তো অসন্তোষ জমে, কিন্তু অজ্ঞানতা সেটাকে দাবিয়ে রাখে বিভিন্ন অহেতুক কারণ দেখিয়ে।

জন-অজ্ঞানতা জনগণের সবচেয়ে বড় কারাগার। মানবজাতির পিঠে তৈরি হওয়া সবচেয়ে বড় কুঁজ। এর জন্য সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, পারে না স্বাধীনভাবে চলেফিরে বেড়াতে। যে প্রাচীন এপ একদা সোজা হয়ে দাঁড়াতে এবং যত্রতত্র চলতে ফিরতে শিখেছিল, এই কুঁজ যে তার জন্য কত বড় বেদনারসোজা পিঠের যে কেউ এটা বুঝবে। বুঝবে না কেবল তারা, যারা এই স্বৈরাচারের আঁতুড়ঘরে জন্মেছে, বড় হয়েছে এবং জন-অজ্ঞানতার রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এরা জন-অজ্ঞানতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, ফলে এদের যে এ রকম একটা রোগ আছেসেটা এরা ভুলেই গেছে। অভ্যাস সবকিছু ভুলিয়ে দেয়, এমনকি রোগযন্ত্রণাও।

মানুষের একটা মৌলিক অভ্যাস হলোসে সামনের দিকে যেতে চায়। সেটা নতুন ভবিষ্যৎ থেকে শুরু করে গাড়িবাড়ি কেনার মতো তাৎক্ষণিকতায় আক্রান্ত বিষয়ও হতে পারে। এই অভ্যাসের ফলে সে প্রতিদিন ওই দিনটাকে নতুন করে তৈরি করতে চায় আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্য, আরেকটু স্থিতিশীলতা ও শান্তির প্রয়োজনে। এটা করতে গিয়েই সে দ্বারস্থ হয় জ্ঞানের। কেননা জ্ঞানই সেই হাতিয়ার, যা তাকে বুঝতে এবং কাজ করতে শেখায়। শেখায় অভিজ্ঞতার গহনতর রূপ। জন-অজ্ঞানতা এই জায়গাটাতে আক্রমণ করে ভাইরাসের মতো। নিয়মিত সমাজশরীর এর ফলে অনিয়মিত হয়ে পড়ে। কর্মক্ষমতা হারায়। নির্ভরশীল হয়। এ রকম একটা সমাজশরীরের মনে তখন তৈরি হয় স্থবিরতা। কিছু নিয়তিনির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া তার আর আঁকড়ে ধরার কিছুই থাকে না। এ রকম পরিস্থিতিতে ধর্মকে লেলিয়ে দেওয়া সহজ। শিকারি কুকুরের পেছনে পেছনে বন্দুকধারী শিকারির মতো তখন সহজে দৌড়াতে পারে স্বৈরাচার। পৌঁছাতে পারে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে, কোণঠাসা ভীত শিয়ালের ডেরায়।

জন-অজ্ঞানতার আরেকটা বড় কারণ ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতাবাদ। নিয়তিবাদের আঁতুড়ঘর ধর্মের প্রকারগুলো তাদের সমর্থকদের অন্ধ বানিয়ে হাতে ধরিয়ে দেয় হিংসা, বিবাদ আর বিভেদের লাঠি। মুখে বলে, এটা অন্ধের সাদাছড়ি! কিন্তু এর সারা শরীরে মাখিয়ে দেয় বিষ। ফলে অন্ধ তার হাঁটার সময় যেখানেই এই লাঠি ছোঁয়ায়, সেখানেই ঘা হয়ে যায়। দোষ হয় অন্ধের দৃষ্টিহীনতার। আর ধর্ম একজন অন্ধের হাতে লাঠি তুলে দিয়ে পুরস্কার পায় সামাজিক মহত্ত্বের। কী আশ্চর্য!

ধর্মের অপব্যবহারে মানবসমাজ যতটা বিচ্ছিন্ন হয়েছে, আর কোনো কিছুই এতটা বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি মানুষকে। এত টুকরা, এত জানালা শেষ পর্যন্ত কম্পিউটারের মতোই হ্যাং করে ফেলে সমাজকে। রিস্টার্ট দিয়ে হয়তো সেই হ্যাংওভারকে সাময়িকভাবে ভুলে থাকা যায়, কিন্তু হ্যাংওভারের পৌনঃপুনিকতাকে ঠেকানো যায় না কোনোভাবেই। একবার হ্যাং হওয়া কম্পিউটার বারবার হ্যাং হবেই।

সমাজ যখন হ্যাং করে, জন-অজ্ঞানতা তখন উর্বরতা পায়। কেননা হ্যাং হওয়া সমাজ যুক্তিবোধ হারিয়ে ফেলে। আর জন-অজ্ঞানতার জন্য যুক্তিহীনতার চেয়ে উপাদেয় পথ্য আর নেই। এই পথ্য পেয়ে জন-অজ্ঞানতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং সমাজের চারদিকে গজিয়ে ওঠে জনশত্রুর দল। এরা বিভেদ তৈরির ইন্ধন দেয় এবং মানুষকে বোঝায় সম্প্রদায়ই তার শেষ লক্ষ্য, তার শক্তি, তার ঐক্য। আর যুক্তিহীন সমাজে ডুবে যাওয়া দিশাহারা মানুষ চিন্তা করবার ক্ষমতার অভাবে সেটাকেই ধরে নেয় খড়কুটার মতো। ভুলে যায় তার আসল লক্ষ্য, শক্তি ও ঐক্যের কথা। খুব সহজভাবে দেখলে মানুষও তো রোবটইসমাজের ফ্যাক্টরিতে জন্ম নিয়ে, সমাজের শেখানো বিদ্যায় অভ্যস্ত হয়ে যে জীবন সে যাপন করে, সেটা রোবটের চেয়ে আলাদা কিসে? তাই যুক্তিহীন সমাজে জনশত্রুর ইন্ধনই তার প্রোগ্রাম হয়ে দাঁড়ায়, এই অনভ্যস্ত পথে সে হাঁটতে থাকে টলমল পায়ে এবং যেখানে-সেখানে, যার-তার শরীরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। যুক্তিহীন সমাজে জনশত্রুর ইন্ধনে চলা মানুষের চেয়ে অসহায় বোধ হয় আর কেউ নেই।

অথচ মানুষের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র তার চিন্তাশক্তি এবং যুক্তিবোধ। আজকে আমরা যেখানে এসে পৌঁছেছি, বিমূর্ত চিন্তা এবং যুক্তিবোধের এটাই মূর্ত রূপ। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হলো, মানুষের সব অর্জন ছিনতাই হয়ে গেছে কিছু দুর্বৃত্ত আর তাদের চ্যালাপ্যালাদের হাতে। এই ছিনতাই জন্ম দিয়েছে দুটি নতুন শব্দেরমালিক ও শ্রমিক, যা মানবসমাজে অপরিচিত ছিল। যেকোনো মালিকানাকে ব্যবচ্ছেদ করলে অপশক্তি, খণ্ডজোট এবং দুর্নীতির জীবাণু বেরিয়ে আসে। পাশাপাশি শ্রমিক মানেই ক্ষমতাহীন, নিঃসঙ্গ এবং পরাজিত একটা স্তূপের ছবি, যা মুখ দেখায় অভিধানের পাতায় পাতায়। ভয়ংকর এই বিভাজন আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে জনতা একে বিশ্বাস করছে বলে। ফলে মালিক হয়ে উঠছে ঈশ্বর আর শ্রমিক নরকের কীট। স্বর্গ দখল হয়ে গেছে।

প্রাচীন মহাকাব্য বা মাইথোলজি, যা-ই বলি না কেন, সেখানে স্বর্গ দখলের কথা বলা হয়েছে অনেকবার। হয়তো সেটা ছিল অনার্যদের হাতে আর্যদের পরাজয়ের দলিল কিংবা কবিদের রাজার পক্ষে ঝুঁকে পড়ার ফলে মিথ্যার রঙিন ছবি। সে যা-ই হোক, স্বর্গও যে হাতছাড়া হয়এই সত্য তো মুছে যায় না দলিল কিংবা কবিতার রং বদলের কারণে। এখন আবার সেই ঘটনাটা ঘটছে  ফাইভস্টার হোটেল, বিএমডব্লিউ গাড়ি, সুন্দরীদের দল, মদ, মাংস, নাচগান, সুখ, বিলাসস্বর্গের যাবতীয় ডিটেইল চলে যাচ্ছে পাল্লার একদিকে; আরেক দিকে ঝিমাচ্ছে অ্যাডিক্ট অন্ধকার, ড্রাগ না পাওয়ায় যার গাত্রোত্থানের শক্তি নাই, তাই গেড়ে বসেছে অন্যদিকের জীবনে। উদাহরণটা হয়তো স্থূল হয়ে গেল কিন্তু যুক্তিহীনতায় আক্রান্ত সমাজে স্থূলতার হাতুড়িই যে দরকার।
জনশত্রুর মিথ্যাবচনে স্বর্গের দরজা খোলে না।

 

নোট

তর্ক বাংলার মেইলে [অকাল প্রয়াত] অমিতাভ পাল গদ্যটি পাঠিয়েছিলেন মাস তিন/চার আগে। লেখাটি প্রকাশের জন্য বিবেচনাধীন ছিল। কিন্তু বলা-কওয়া ছাড়া তাঁর হঠাৎ চলে যাওয়া, সত্যিই বড় বেদনাদায়ক! তর্ক বাংলার সঙ্গে অমিতাভ পালের ছিল অটুট বন্ধন। তাঁর অপ্রকাশিত গদ্যটি যে কোনো সময়ের জন্য পাঠযোগ্য।

সম্পাদক