নারীবাদ মানেই পুরুষ বিদ্বেষ নয়
‘নারীবাদ’ বা ‘Feminism’ শব্দটির সঙ্গে বর্তমান সময়ে সবাই-ই কমবেশি পরিচিত। ফরাসি শব্দ ‘Feminisme’ থেকে ‘Feminism’ এর উৎপত্তি হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ফ্রান্সে নারীবাদের সূচনা হয়। নারীর অধিকার রক্ষা, সবক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই নারীবাদের উত্থান। যুগে যুগে বিভিন্ন ধাপ বা পরিক্রমার মাধ্যমে নারীবাদ ধারণাটি পূর্ণতা পেয়েছে সারা বিশ্বে।
নারীবাদের জন্ম ও বিকাশ পাশ্চাত্য-বিশ্বে ঘটলেও বর্তমানে পুরো বিশ্বে এই ধারণা পরিচিত এবং আলোচিত। তাই ভৌগোলিক অবস্থান, পারিপার্শ্বিকতা এবং প্রেক্ষাপট ভিন্নতার কারণে নারীবাদের সংজ্ঞায়ও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। তবে একটি বিষয় সবখানেই প্রতিষ্ঠিত, সর্বক্ষেত্রে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিতকরণ।
এশিয়ায় নারীবাদ নিয়ে চর্চা হচ্ছে বহুদিন ধরেই। কিন্তু একটু লক্ষ করলেই দেখা যায়, এশিয়ার ফেমিনিজম বা নারীবাদের সঙ্গে পাশ্চাত্য বিশ্বের নারীবাদের বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। পাশ্চাত্যবাসীরা এশীয় অঞ্চলের নারীবাদকে সাধারণত একটু অবজ্ঞার চোখে দেখে। তাদের ধারণা, যেখানে পারিবারিক সহিংসতা অহরহ ঘটছে, পণপ্রথা সমাজের একটা অঙ্গ, অসংখ্য নারী শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, সেখানে আবার নারীবাদ কী! অথচ এশিয়ার ইতিহাস পড়লে দেখা যাবে, পাশ্চাত্য-নারীবাদকে অনুকরণ না করলেও নারীদের অ্যাকটিভিজম বা সক্রিয় ভূমিকার বহু উদাহরণ এ মহাদেশে রয়েছে এবং বহু আগে থেকেই রয়েছে।
কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতীয় উপমহাদেশে নারীর মুক্তির বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তৎকালীন সময়ে তিনিই প্রথম নারীর শিক্ষা, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমান মর্যাদা ও অধিকার দাবি করেন। সেসব দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন।
প্রবন্ধগ্রন্থ মতিচূর-এ তিনি লিখছেন, ‘যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না; সে কেবল একই স্থানে (গৃহকোণেই) ঘুরিতে থাকিবে। তাই ভারতবাসী উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছে না।’ প্রায় একই ধরনের বক্তব্য তিনি দিয়েছেন ‘সুগৃহিণী’ নামের প্রবন্ধে। এখানে তিনি বলেছেন, ‘একচক্ষুবিশিষ্ট ব্যক্তিকে লোকে কানা বলে।’
নারীবাদের সূচনালগ্ন থেকেই ‘নারীবাদ’ ও ‘নারীবাদী’ উভয়ই বহু আলোচিত এবং সমালোচিত একটি বিষয়। নারীরা বর্তমানে শিক্ষা-দীক্ষায়, কর্মক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি কাজ করছে। এমন কোনো সেক্টর নেই, যেখানে নারীর উপস্থিতি লক্ষ করা যায় না। কিন্তু তারপরেও নারীর নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা বিভিন্নভাবে বাধার সম্মুখীন হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যান্য দেশের তুলনায় নারী নির্যাতনের হার অনেক বেশি। তাই পুরুষের মাধ্যমে নারীর এই হেনস্তার কারণেই হোক বা পুরুষতান্ত্রিক অনুশাসনের যন্ত্রণা থেকেই হোক, তৃতীয় বিশ্বের নারীবাদের মধ্যে পুরুষকে আদর্শ ধরে সেই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নারীবাদের মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে এসে পুরুষের সকল কাজের এক অন্ধ অনুকরণকেই বর্তমানে ‘নারীবাদ’ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পুরুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধূমপান করতে পারলে একজন নারী কেন পারবে না? একটি ছেলে সারা রাত বাইরে কাটাতে পারলে কোনো মেয়ে কেন পারবে না? পুরুষ মানুষ ক্লাবে ফুর্তি করতে পারলে মেয়েরা কেন নয়? অথচ কোনো সুশৃঙ্খল জীবনের মানে কিন্তু এ রকম হতে পারে না। যেখানে আমাদের দাবি করার কথা ছিল ধূমপান-মদ্যপান সকলের জন্যই নিষিদ্ধ করা হোক, যেখানে আমাদের জোর গলায় দাবি করার কথা ছিল, রাত হলে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসুক, সেখানে আমরা সেই অনৈতিক বিশৃঙ্খল জীবনকে আদর্শ বানিয়ে সে লক্ষ্যের দিকে ছুটে যাচ্ছি। এ যেন পিপীলিকার আগুনের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ, যার অনিবার্য ফলাফল ধ্বংস হয়ে যাওয়া। পুরুষকে আগুন মনে করা নিজেকে পিপীলিকা গণ্য করারই শামিল। এই ধরনের মানসিকতা পোষণ করার কারণে ফ্রি মিক্সিং, মাদকাসক্তি, এইডস এবং আরও নানা ধরনের অপকর্মে নারীরা জড়িয়ে পড়ছে নারীবাদের মোড়কে। এহেন উচ্ছৃঙ্খলতাকে ‘আধুনিকতা’ নামাঙ্কিত করে অনেক মানুষকেই এসব অপকর্মের সাফাই গাইতে দেখা যায়।
সৃষ্টিজগতের সকল সৃষ্টিরই একটা স্বাভাবিকতা আছে। সেই স্বাভাবিকতাকেই আমরা সৌন্দর্য বলে থাকি। সৃষ্টির স্বাভাবিকতাকে অগ্রাহ্য করলে তাতে তার সৌন্দর্য নষ্ট হয় এবং তা সকল সৃষ্টির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য...
মেয়েরা ডাক্তারি করছে, প্লেন চালাচ্ছে, শিক্ষকতা করছে, মাঠেঘাটে ক্যামেরা হাতে ছুটে সাংবাদিকতা করছে, পুরুষের সঙ্গে গলা মিলিয়ে রাস্তায় স্লোগান দিচ্ছে রাজপথে, দেশ শাসন করছে। নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে সর্বদাই যদি মনে ঘুরপাক খায়, ‘আমার সহকর্মী পুরুষটা কী করছে’, ‘আমাকে নিয়ে কী ভাবছে’, ‘কেন আমি তার মতো হতে পারছি না’—এসবই তো নিজের সত্তাকে ছোট করে দেখা। নারীসত্তাকে সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসলে পুরুষের প্রতি এই অন্ধত্ব কেন? নারীসত্তার প্রতি ভালোবাসা থাকে মানে এই নয় তাকে ঘরে থাকতে হবে, হেঁশেল সামলাতে হবে, সন্তান উৎপাদন আর তার লালন-পালনই হবে একমাত্র কাজ। কর্মক্ষেত্রে কাজের প্রতি ভালোবাসা এবং নিজস্ব প্রতিভার যত্ন ও লালনই হলো নিজ সত্তার প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন। এটা শুধু নারী নয়, সব মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কোনো নারী, যে ঘরে থেকে রান্নাবান্না করেই আনন্দ পায়, সেখানে তার কাজকে ছোট করে বলা যাবে না। তাই যদি হয় তবে বলতেই হবে, তার নারীমুক্তি হয়নি। মুক্তির আনন্দ একেকজনের কাছে একেক রকম এটা মানতে হবে। যদি বাইরে কাজ করা, আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারাকেই শুধু নারীবাদ বলা হয়, সেখানে নারীবাদের গণ্ডি খুব ছোট হয়ে যায়। তাহলে ফেমিনিজম সব নারীর কথা বলবে না, কেবল আধুনিকতার স্পর্শে আসতে পেরেছে তাদের জন্যই ‘নারীবাদ’ নামের মিথ্যা প্রহসন।
নারী স্বাধীনতায় এখন আর স্বাধীনতার সৌন্দর্য পাওয়া যায় না। তাই অনেকেই ফেমিনিজমের প্রতি ভুল ধারণা পোষণ করে বলে ‘Feminism is cancer’!
শিক্ষিত হয়ে পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমাজ গঠনে অবদান রাখবে, নারীর মর্যাদা এবং নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না এবং সবক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের সমান অগ্রাধিকার পাবে—এটাই ছিল নারীবাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যকে পাশ কাটিয়ে বর্তমানে তথাকথিত নারীবাদীরা ছুটেছে অনুকরণের দিকে। তাদের জীবনবৃত্তের কেন্দ্রে বসে আছে পুরুষ। যেখানে একজন নারী মানসিকভাবেই পুরুষের কাছে বন্দি, সেখানে কীভাবে তারা মুক্তির বুলি আওড়াতে পারে? অথচ প্রান্তিক অঞ্চলে বসবাসরত মেয়েশিশুদের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া, বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা, নারী নির্যাতনসহ ইত্যাকার সমস্যাগুলো সম্পর্কে তাদের আওয়াজ তুলতে দেখা যায় না। আর তুললেও সেটা সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্যেই ঘুরপাক খায়। মাঠপর্যায়ে সেটি অসারের তর্জনগর্জন ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা নারীমুক্তির কথা বলে ঠিকই কিন্তু সেই মুক্তির পরিধি কেবলই শহরের হাতে গোনা কজন নারীর মাঝেই সীমাবদ্ধ। তারা প্রান্তিক অঞ্চলের মেয়েদের দুর্দশার খবর জানে না, খবর জানলেও তা ভাইরাল না হলে কানের ধুলো পরিষ্কার করার মতোই উড়িয়ে দেন বাতাসে।
‘উত্তর আধুনিক নারীবাদ’ বলে, নারী বলে কিছু হয় না। এটা কেবলই একটা শব্দমাত্র। নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, ক্রমশ নারী হয়ে ওঠে। এ নিয়ে বেশ তর্কবিতর্ক থাকলেও নারীবাদের বর্তমান ধারণা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি ছাড়া আর কোনো কাজ করতে পারছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থেকেই যায়। নারীর চলার পথকে কঠিন করতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তাই বলে সকল পুরুষকে একই ছাঁচে ফেলে তাদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে বিভাজন সৃষ্টি করা কোনো কাজের কথা নয়। নারীবাদ মানেই পুরুষবিদ্বেষ নয়। নারী-পুরুষ একযোগে একটি মানবিক সমাজ গঠনে অবদান না রাখলে কেবল নারীরা কি একা পারবে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে?
‘পুরুষ ন্যায়-অন্যায় যা-ই করুক, নারীকেও তাই করতে দিতে হবে’ বলে বিদ্বেষ তৈরি করে তাদেরই ‘মতো’ হতে চাইলে সেখানে নারীর স্বকীয়তা কোথায়? যা অন্যায় তা সকলের জন্যই অন্যায়—এটা বোঝার মতো বুদ্ধি প্রত্যেকেরই থাকা জরুরি।
রোকেয়া সাখাওয়াত বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা [faculty] দিয়াছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি [develop] করাই শিক্ষা।...আমরা কেবল ‘পাশ করা বিদ্যা’কে প্রকৃত শিক্ষা বলি না।’
সৃষ্টিজগতের সকল সৃষ্টিরই একটা স্বাভাবিকতা আছে। সেই স্বাভাবিকতাকেই আমরা সৌন্দর্য বলে থাকি। সৃষ্টির স্বাভাবিকতাকে অগ্রাহ্য করলে তাতে তার সৌন্দর্য নষ্ট হয় এবং তা সকল সৃষ্টির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
নারীদের পুরুষকে কেন্দ্র করে, পুরুষের মতো জীবন গঠন করতে চাওয়ার যে-আকুতি, সেই খোলস থেকে নারীবাদকে মুক্ত করতে না পারলে নারীদের জীবনমানের উন্নতি অসম্ভব। পুরুষকেন্দ্রিক মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে চিন্তার মুক্তি এবং তার চর্চাই পারে নারীকে স্বাধীন এবং সুন্দর করে তুলতে।
অসাধারণ একটি লেখা ।পড়ে খুব ভালো লেগেছে । তাই লেখক ও সম্পাদকের কাছে এই ধরণের আরও লেখা প্রত্যাশা করি ।
মোহাম্মদ আতাউর রহমান, প্রধান শিক্ষক, কিশোরগঞ্জ মডে
জুন ০৫, ২০২১ ২০:২৯
চমৎকার লেখনী। ফেমিনিজমের সঠিক তথ্য তুলে ধরেছেন। খুব ভাল লাগল। ভবিষ্যতে এ ধরনের আরও লেখা আশা করি। আর বাংলা বানানের প্রতি খুবই সতর্ক আপনি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ডাঃ মোহাম্মদ আব্দুল আওয়াল ভূইয়া, উপজেলা প্রাণিসম্প
জুন ০৪, ২০২১ ০৯:৪২