রেনেসাঁ যুগের বিস্মৃত নারী শিল্পীগণ
ইউরোপ ভ্রমণে যেকোনো শিল্পপ্রেমীর আগ্রহের কেন্দ্র ফ্লোরেন্স। রেনেসাঁর জন্মভূমি এই ফ্লোরেন্সকে ঘিরে রচিত হয়েছে শিল্পের ইতিহাস। তাই ফ্লোরেন্সকে ঐতিহাসিকেরা ‘মধ্যযুগের অ্যাথেন্স’ বলেন। আর এই শিল্পের পুণ্যভূমি ইতালির ফ্লোরেন্সের উফিজি গ্যালারিতে রয়েছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলো, রাফায়েলের মতো বিখ্যাত শিল্পীদের শিল্পকর্ম; যা নিঃসন্দেহে দর্শককে বিমোহিত করে। তবে বিমোহিত হওয়ার সময় যে চিন্তায় ভ্রু কুঁচকে আসে, তা হলো উফিজি গ্যালারির বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলোর শিল্পী কেউই নারী নন। ফ্লোরেন্সের অন্যান্য মিউজিয়াম ও গ্যালারিতে নারী শিল্পীদের শিল্পকর্ম তেমন একটা চোখে পড়ে না। তাহলে কি রেনেসাঁর সময়কালে উল্লেখযোগ্য কোনো নারী শিল্পী ছিলেন না? নাকি নারী শিল্পীরা নিজেদের সৃষ্টিকর্মসহ ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে গেছেন?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে ২০০৯ সালে অ্যাডভান্সিং উইমেন আর্টিস্ট [এডব্লিউএ] নামক একটি নন-প্রফিট সংগঠন অনুসন্ধান শুরু করে। সংগঠনটির পরিচালক লিন্ডা ফেলকন এই বিষয়ে বলেন, ‘আমি নারী শিল্পীদের কোনো শিল্পকর্ম আছে কি না, তা দেখার জন্য মিউজিয়ামের স্টোরেজ ও ছাদের ঘরগুলোতে খুঁজতে শুরু করলাম। তবে বিস্ময়ের বিষয় রেনেসাঁ যুগের নারী শিল্পী কিংবা তাঁদের শিল্পকর্মগুলো কোথায় গেল, তা নিয়ে এত দিন কেউ তেমন একটা জানতেই চায়নি।’ যাহোক, সংগঠনটির আন্তরিক চেষ্টায় ইতালির পাবলিক মিউজিয়াম এবং চার্চের স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার স্টোরেজ থেকে পাওয়া যায় নারী শিল্পীদের আঁকা দুই হাজারের মতো শিল্পকর্ম, যেগুলোর মধ্য থেকে ৭০টি শিল্পকর্ম পুনরুদ্ধারের জন্য এডব্লিউএ কাজ শুরু করে। শিল্পকর্মগুলোর অধিকাংশই ১৬ থেকে ২০ শতকে আঁকা।
রেনেসাঁর নারী শিল্পীরা সময়ের সঙ্গে ইতিহাসের মধ্যে এতটাই বিস্মৃত যে, ১৯১৭ সালে উফিজি গ্যালারিতে যখন রেনেসাঁর বিখ্যাত নারী শিল্পী প্লাতিলা নেলির প্রথম একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী হয়, তখন জনসাধারণের মতো শিল্প ঐতিহাসিকেরাও বিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিলেন, প্লাতিলা নেলি কে?
লাস্ট সাপারের অংশবিশেষ, শিল্পী প্লাতিলা নেলি, ১৫৭০, ক্যানভাসে তেল রং, সান্তা মারিয়া নোভিলা মিউজিয়াম, ফ্লোরেন্স © www.khanacademy.org
১৬ শতকে ফ্লোরেন্সের একজন বিখ্যাত শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও নেলি কীভাবে, কী কারণে ইতিহাসে হারিয়ে গেলেন? শিল্প-সমালোচক ও ঐতিহাসিকেরা কেন কিছু জানেন না? আসলেই বিস্মিত করে। তবে কি এখানেও লিঙ্গবৈষম্য, যা রেনেসাঁ থেকে বর্তমান পর্যন্ত নারী শিল্পীদের সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। এ বিষয়ে ফেলকনি বলেন, ‘রেনেসাঁ সময়ে নারীদের কোনো নাগরিকত্ব ছিল না। তাই নারীরা নিজ থেকে কোনো মূল্যতালিকা বা রসিদ চালান করতে পারতেন না। আবার পেশা হিসেবে নারীদের শিল্পচর্চার সুযোগ ছিল না। নারীরা শিল্পচর্চা করলেও নুড স্ট্যাডি ছিল তাঁদের জন্য নিষিদ্ধ।’
বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে নারীবাদী সংগঠন গেরিলা গার্লস শিল্পচর্চায় যে বৈষম্যে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, ‘শিল্পের গণ্ডি সব সময়ই পুরুষশাসিত।’ ইন্টারসেকশনাল নারীবাদী এই সংগঠন তাদের উক্তির সমর্থনে বৈষম্যকে তুলে ধরে বেশ কিছু পোস্টার প্রকাশ করে। সব সময়ই পুরুষশাসিত সমাজের মধ্যে নারীদের শিল্পকর্ম প্রশংসিত ও খ্যাতি অর্জন করেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে নারীদের শিল্পকর্ম প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ ও গবেষণার অভাবে ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
রেনেসাঁয় শিল্পের চর্চা শুধু স্টুডিওতে আটকে ছিল না; বরং প্রাচীন গ্রন্থের বর্ণনা, দর্শন, শারীরসংস্থান বিদ্যা, গণিতবিদ্যাসহ নানামুখী জ্ঞানকে নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল। তবে শিল্পচর্চাসহ সব জ্ঞানচর্চায় নারীদের তেমন কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। নারীরা ততটুকু শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পেতেন, যতটুকু হলে একজন মা ও স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা যায়।
এত বাধা সত্ত্বেও রেনেসাঁয় বেশ কিছু নারী নিজেকে শিল্পী হিসেবে প্রমাণ করেছেন। সে সময় ধর্মীয় উপাসনালয় ও মঠে এক প্রকার শিল্পচর্চা বিকাশ লাভ করে। যা নান শিল্প নামে পরিচিত। আর এই নান শিল্পচর্চার মাধ্যমে শিল্পী প্লাতিলা নেলি ফ্লোরেন্টাইনদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। এই সময়ে সম্ভ্রান্ত পরিবারের কয়েকজন নারী অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে শিল্পী হিসেবে বেশ খ্যাতি পান। যাঁদের মধ্যে সোফানিস্বা অ্যাঙ্গুইসোলা, লুসিয়া অ্যাঙ্গুইসোলা উল্লেখযোগ্য। আবার কয়েকজন নারী তাঁদের বাবা শিল্পী হওয়ার কারণে স্টুডিওতে শিল্পচর্চা করার সুযোগ পান। যাঁরা সে সময় বেশ প্রসংশিত হন। এঁদের মধ্যে শিল্পী ওরাজিও জেন্টিলেশির কন্যা আর্তেমিসিয়া জেন্টিলেশি ছাড়াও রয়েছেন লেভিনা টেরলিংক, ক্যাটরিনা ভ্যান হেমসেন, এলিসাবেতা সিরানি, লাভিনিয়া ফন্টানা প্রমুখ। সে সময়ও টিকে থাকার জন্য নারীকে তাঁর সমাজ, পরিবার, স্বামী, ধর্মীয় অনুশাসনসহ সবকিছুর প্রতি অনুগত থাকতে হয়েছে। অনুগত না থাকলেই তাঁদের ক্যরিয়ার ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যার উদাহরণ নারী ভাস্কর প্রোপজিয়া দে’রোসি।
সিসটার ক্যাথরিন উইথ লিলি, শিল্পী প্লাতিলা নেলি, ১৫৫০-১৫৬০, ক্যানভাসে তেল রং, উফিজি গ্যালারী, ফ্লোরেন্স © khanacademy.org
রেনেসাঁর পর শিল্পের ইতিহাস নিয়ে একাডেমিক অধ্যয়নের শুরুটা হয় অষ্টাদশ এবং উনিশ শতাব্দীতে। সে সময়ের শিল্প সমালোচক ও ঐতিহাসিকেরা শিল্পীদের নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে পুরুষ শিল্পীদেরই প্রাধান্য দিয়েছেন। যার কারণে মিউজিয়ামগুলো যেমন পুরুষ শিল্পীদের হাইলাইট করেছে, তেমনি বই ও গবেষণার বিষয় হিসেবে পুরুষ শিল্পীরাই আলোচিত হয়েছে। আর নারীদের শিল্পচর্চাকে দেখা হয়েছে সমাজের প্রচলিত ধারার ব্যতিক্রম হিসেবে। নারী শিল্পীদের নিয়ে কোথাও তেমন একটা আলোচনা না থাকায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস থেকে তাঁরা হারিয়ে যান। আর নারী শিল্পীদের মানসম্মত শিল্পকর্মগুলো প্রদর্শনের পরিবর্তে স্থান পায় মিউজিয়াম ও গির্জার স্টোরেজে। অনেক শিল্পকর্ম সময়ের সঙ্গে স্টোরেজের স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হয়ে গেছে।
অতীতকে পরিবর্তন করা যায় না। কিন্তু সমকালীন লিঙ্গ ভারসাম্যের জন্য রেনেসাঁর নারী শিল্পীদের নিয়ে পুনরায় আলোচনার শুরু হয়েছে। তার ধারাবাহিকতায় যদি রেনেসাঁর বিখ্যাত শিল্পী প্লাতিলা নেলি সম্পর্কে আলোচনায় আসি, তবে প্রথমেই যে শিল্পকর্মটি সামনে চলে আসে, তা হলো ‘সিসটার ক্যাথরিন উইথ লিলি।’ রেনেসাঁয় অভিজাত সমাজে প্লাতিলা নেলীর শিল্পকর্ম এত বেশি সংগৃহীত যে বিশিষ্ট শিল্পী, ঐতিহাসিক জর্জিও ভাসারির ভাষায় সে সম্পর্কে আলোচনা ক্লান্তিকর। তবে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, নানা প্রতিকুলতার মাঝেও প্লাতিলা নেলী কীভাবে আয়ত্ত্ব করলেন নান শিল্প। যতটুকু জানা যায়, চৌদ্দ বছর বয়সে প্লাতিলা নেলিকে তাঁর পরিবার খ্রিস্টান চার্চে পাঠিয়ে দেয়। সামাজিকভাবে মেয়েকে চার্চে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিয়ের খরচের চেয়ে অনেক বেশি সাশ্রয়ী। সান্তা ক্যাটারিনা দ্যা সিয়ানা চার্চের সন্ন্যাসীদের থাকার পরিবেশ নেলিকে ছবি আঁকা শিখতে বেশ সহায়তা করে। ধর্মীয় পরিবেশের মধ্যে নান শিল্পের চর্চা তাঁর জন্য ধর্মীয় উপাসনা না হয়ে ছবি আঁকতে শেখার উপায় হয়ে যায়।
ঐতিহাসিক ভাসারি ১৫৫০ সালে ‘লাইভস অব দ্য আর্টিস্ট’ নামের একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। যেখানে সেই সময়কার এক শ শিল্পীকে নিয়ে আলোচনা করা হয়। তাঁদের মধ্যে চারজন নারী শিল্পী রয়েছেন। এই নারী শিল্পীর মধ্যে প্লাতিলা নেলি অন্যতম। ভাসারি শিল্পী প্লাতিলা নেলিকে নিয়ে বলতে গিয়ে ‘নান অ্যান্ড নাউ প্রিয়োরেস’ বলে আখ্যায়িত করেন। বইয়ে সে বর্ণনা থেকে জানা যায়, নেলি তাঁর ছবি আঁকার শুরুটা করেন বিখ্যাত চিত্রকরদের ড্রইং ও পেইন্টিং অনুকরণের মাধ্যমে। ভাসারির মতে, প্লাতিলা নেলি যদি গণিত ও অঙ্গসংস্থানবিদ্যায় শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পেতেন, তবে তাঁর খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ধর্মীয় উপাসনালয়ে থাকা নারীদের জন্য গণিত ও অঙ্গসংস্থানবিষয়ক শিক্ষা ছিল নিষিদ্ধ।
এত সমস্যার মধ্যেও নেলি গির্জা ও বিভিন্ন ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য বড় আকারের কিছু ধর্মীয় চিত্রকর্ম এবং পাণ্ডুলিপির অঙ্গসজ্জা করেন। যেগুলোর মধ্য থেকে মোটামুটি ১২টি বড় আকারের চিত্রকর্ম সম্পর্কে আমরা এখন জানাতে পারি। চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে একুশ ফুট দৈর্ঘ্য ও সাড়ে ছয় ফুট প্রস্থের বিশাল আকৃতির ‘লাস্ট সাপার’ চিত্রটিও রয়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এই লাস্ট সাপার চিত্রকর্মটি প্রথম কোনো নারীর আঁকা। রেনেসাঁ-পরবর্তী এই প্লাতিলা নেলির কথা সবাই ভুলেই গিয়েছিল। তবে বর্তমানে এই শিল্পকর্মটি অ্যাডভান্সিং উইমেন ইন দ্য আর্টস ফাউন্ডেশন [এডব্লিউএ] রেস্টোরেশন করার পর তা ফ্লোরেন্সের সান্তা মারিয়া নোভিলা মিউজিয়ামে সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত হচ্ছে।
দ্যা লাস্ট সাপার (এ ডব্লিউ এ কতৃক রেস্টোরেশনের পর), শিল্পী প্লাতিলা নেলি, ক্যানভাসে তেল রং, সান্তা মারিয়া নোভিলা মিউজিয়াম, ফ্লোরেন্স, এটি শিল্পী প্লাতিলা নেলির স্বাক্ষরকৃত একমাত্র শিল্পকর্ম © khanacademy.org
প্লাতিলা নেলির করা ‘লাস্ট সাপার’ নিয়ে এডব্লিউএর লিন্ডা ফেলকন বলেন, ‘ফ্লোরেন্সের শিল্পীদের কাছে লাস্ট সাপারের ছবি আঁকা রীতিমতো ঐতিহ্যের মতো। আর প্লাতিলা নেলির আঁকা “লাস্ট সাপার” শিল্পকর্মটিও বেশ উচ্চ মানের। যিশু যখন তাঁর বিশ্বাসঘাতক অনুসারীর নাম বলবেন ঠিক সেই মুহূর্তের আবেগ চিত্রটিতে অনুভব করা যায়। যেহেতু নেলি এমন এক মুহূর্ত সুনিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন, সেহেতু ধরেই নেওয়া যায়, তাঁর মানুষের প্রতিক্রিয়া বোঝার এবং মনস্তাত্ত্বিক আচরণ চিত্রে ফুটিয়ে তোলার মতো ক্ষমতা ছিল।’
লিন্ডা আরও বলেন, ‘চিত্রটিতে অন্যান্য পুরুষ শিল্পীর তুলনায় ব্যতিক্রমভাবে খাবারের ছবি আঁকা হয়েছে। খাবার টেবিলে লেটুস, চিমনি, ওয়াইনের সারি, শিমের বীজ, রুটি থেকে শুরু করে ছুরি-কাঁটাচামচ প্রভৃতি দেখা যায়। সাধারণভাবে খাবারের টেবিলে যে পরিবেশ থাকে তাকেই যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেলি আঁকতে চেয়েছেন। আর এই সমস্ত সারল্যের জন্যই চিত্রটি অন্য সকল “লাস্ট সাপার”-এর চিত্র থেকে ভিন্ন।’
প্লাতিলা নেলির পর যে নারী শিল্পীর কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন সোফানিস্বা অ্যাঙ্গুইসোলা। যিনি উত্তর ইতালির ক্রিমোনা অঞ্চলের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মেছিলেন। শিল্পী সোফানিস্বা আত্মপ্রতিকৃতি ও পারিবারিক ছবি আঁকার জন্য বেশ সুপরিচিত ছিলেন। রেনেসাঁ সময়ে নারীদের কোনো নামকরা শিল্পীর অধীনে থেকে স্টুডিওতে ছবি আঁকা অনুশীলনের সুযোগ ছিল না। এই ক্ষেত্রে সোফানিস্বা অনেকটাই সৌভাগ্যবান। কারণ, সোফানিস্বা তাঁর বাবার সহযোগিতায় শিল্পচর্চার সুযোগ পান। সোফানিস্বা শিল্পী বার্নাডিনো ক্যাম্পি এবং বার্নাডিনো গাট্টি-র কাছে প্রাথমিকভাবে চিত্রকলা ও নকশা করা শেখেন।
সোফানিস্বা অ্যাঙ্গুইসোলার চিত্রকলা শিক্ষা সম্পর্কে আরও জানতে গিয়ে ৭ মে ১৫৫৭-এর একটি চিঠির কথা বলা প্রয়োজন। যা পাওয়া গেছে ফ্লোরেন্সের মাইকেলেঞ্জেলো বুওনারোতি আর্কাইভ থেকে। চিঠিটির একটি অংশে সোফানিস্বার বাবা মাইকেলেঞ্জেলোর প্রতি লিখেছেন, ‘আপনি আমার কন্যা সোফানিস্বাকে শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে চিত্রকলা অনুশীলনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে যে শ্রদ্ধাজনক ও চিন্তাশীল স্নেহ প্রকাশ করেছেন, তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই ‘ যা থেকে বোঝা যায় সোফানিস্বা রেনেসাঁ সময়কালের কিংবদন্তি শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলোর কাছে শিল্পশিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন। সোফানিস্বার সহজাত প্রতিভা, দূরদর্শী চিন্তাধারা ও শৈল্পিক দক্ষতার কারণে স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের কোর্টে প্রথম কোনো নারী শিল্পী হিসেবে যোগদানের সুযোগ পান। সে সময় কোর্টে সবচেয়ে ভালো মানের শিল্পীদের নিয়োগ দেওয়া হতো। তবে সময়ের পরিক্রমায় সোফানিস্বার অনেক শিল্পকর্ম ভুলবশত অন্য পুরুষ শিল্পীদের শিল্পকর্ম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। যেমন ১৫৬৫ সালে সোফানিস্বার আঁকা রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের একটি প্রতিকৃতি কোর্ট শিল্পী জুয়ান পেন্টোজা দেলা ক্রুজ-এর আঁকা বলেই সবাই জানত। তবে ১৯৯০ সালে প্রতিকৃতিটি যে শিল্পী সোফানিস্বা অ্যাঙ্গুইসোলার আঁকা, তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়।
সোফানিস্বাই রেনেসাঁ সময়ের প্রথম একজন শিল্পী, যিনি আত্মপ্রতিকৃতিকে শিল্পচর্চার বিষয় হিসেবে বেছে নেন। সে সময়ে তাঁর আঁকা ১২টির মতো আত্মপ্রতিকৃতি সম্পর্কে বর্তমানে জানা যায়। পরবর্তী শতকে আরও অনেক শিল্পী আত্মপ্রতিকৃতি নিয়ে কাজ করেছেন।’ যেমন ষোলো শতকে ডাচ শিল্পী রেমব্রান্টকে আত্মপ্রতিকৃতি নিয়ে প্রচুর ছবি আঁকতে দেখা যায়।
সোফানিস্বা তাঁর জীবদ্দশায় বিখ্যাত হয়েছিলেন। তারপরও অজানা কারণে শিল্পের ইতিহাসে তাঁকে নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। তবে এই শিল্পীকে নিয়ে পুনরায় আলোচনা শুরু হয় ১৯৭০ সালে নারীবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে। বর্তমানে সোফানিস্বা অ্যাঙ্গুইসোলা প্রাক মডার্ন সময়ের শিল্পী হিসেবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন।
লেডি ক্যাথরিনের মিনিয়েচার প্রতিকৃতি, শিল্পী লেভিনা টেরিলিংক, ১৫৫৫-১৫৬০, ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়াম, লন্ডন © khanacademy.org
রেনেসাঁ সময়ে মিনিয়েচার চিত্রের জন্য যে নারী শিল্পী বেশ পরিচিতি পেয়েছিলেন, তিনি হলেন শিল্পী লেভিনা টেরিলিংক। বেলজিয়ামের ব্রুজেসে জন্মগ্রহণকারী এই শিল্পী প্রায় ত্রিশ বছর ধরে ইংল্যান্ডের টিউডর কোর্টে শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। সেই সময় কোর্টে টেরিলিংক ছিলেন সর্বোচ্চ বেতনভুক্ত শিল্পী। বর্তমানে এই বিখ্যাত শিল্পীর মাত্র পাঁচ থেকে ছয়টি চিত্র সর্ম্পকে আমরা জানতে পারি। যার সব কটিই বেশ উন্নত মানের মিনিয়েচার প্রতিকৃতি, আর প্রতিকৃতিগুলোর আকার চার থেকে ছয় সেন্টিমিটার। রেনেসাঁয় উপহার কিংবা সংগ্রহের বস্তু হিসেবে মিনিয়েচার প্রতিকৃতির বেশ প্রচলন ছিল। অনেক সময় যা অলংকার কিংবা কানের দুল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। আলোকচিত্র আবিষ্কারের পূর্বে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজেদের মিনিয়েচার প্রতিকৃতি ঘনিষ্ঠ মানুষদের উপহার দিতেন। মিনিয়েচার প্রতিকৃতি উপহার দেওয়া সে সময়ে বেশ মর্যাদাপূর্ণ বিষয় ছিল। যে কারণে টিউডরের কোর্টের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গের চেয়েও সমাজের বিত্তশালীরা বেশি প্রতিকৃতি আঁকিয়ে ছিলেন। যে কয়েকটি মিনিয়েচার টেরিলিংকের আঁকা বলে জানতে পারা যায়, সেগুলোর মধ্যে লেডি ক্যাথরিন গ্রে-র প্রতিকৃতিটি বেশ বিখ্যাত।
টেরিলিংক তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ মিনিয়েচার শিল্পী ও পাণ্ডুলিপি আলংকারিক ছিলেন। আর এই দক্ষতা অর্জনে তিনি পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা পেয়েছিলেন পিতা ফ্লেমিশ চিত্রশিল্পী সাইমন বেনিং-এর কাছে। বাবার স্টুডিওতেই টেরিলিংকের চিত্রকলা চর্চার সূচনা ঘটে। লেভিনা টেরিলিংক ১৫৪৬ সালে ‘রয়েল পেইন্ট্রিক্স’ হিসেবে ইংল্যান্ডের অষ্টম হেনরির কোর্টে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীকালে ষষ্ঠ এডওয়ার্ড, প্রথম মেরি ও প্রথম এলিজাবেথের শাসনকালেও একই পদে বহাল ছিলেন। টেরিলিংক যে শুধু রয়েল পরিবার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের প্রতিকৃতি এঁকেছেন, তা কিন্তু নয়। তাঁর আরও অন্যান্য শিল্পকর্ম সম্পর্কে আমরা কোর্টের নথিবদ্ধ তালিকা থেকে জানতে পারি।
এডব্লিউএর শিল্পকর্ম পুনরুদ্ধারের কারণে আরেকজন নারী শিল্পী বর্তমানে বেশ আলোচনায় এসেছেন, তিনি হলেন ভিওলান্তে ফেরোনি। ভিওলান্তে জন্মেছিলেন ১৭২০ সালে, যে সময় ইতালির মেদিচি যুগের সমাপ্তি রচিত হচ্ছিল এবং ফ্লোরেন্সে ব্যাপক সমাজতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটছিল। এই সময়টা নারীদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এডব্লিউএর স্বেচ্ছাসেবী লেখক ও গবেষক অ্যান গোলবের মতে, সতেরো শতকের মধ্যবর্তী সময়ে নারীরা আগের চেয়ে বেশি মাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছিল এবং স্বল্প পরিসরে নিজেদের মেধা ও কাজের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করছিল। পরিবর্তনের এই সময়ে শিল্পী ফেরোনি তাঁর শৈল্পিক প্রতিভার কারণে মাত্র ষোলো বছর বয়সে ফ্লোরেন্সের একাডেমিয়া দেলা আর্টি দেল ডেসেজনো [একাডেমি অব দ্য আর্টস অব ড্রইং]-এ শিল্প শিক্ষার সুযোগ পান। এর কয়েক বছর পর ১৯৪০ সালে সান জিওভান্নি ডি ডিও হাসপাতালের আর্টিয়ামের জন্য সাড়ে ১১ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৮ ফুট প্রস্থের ওভাল আকৃতির দুটি চিত্র আঁকেন। চিত্র দুটির শিরোনাম যথাক্রমে, The Saint Heals Plague Victims ও Saint Jhon of God gives bread to the poor। চিত্রে পূর্ণাঙ্গ ফিগারের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতা এবং ঐতিহাসিকতা বর্ণিত হয়েছে, যা হাসপাতালে আসা রোগীদের মানসিকভাবে সাহস জোগায়।
শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলো, লিওনার্দো, রাফায়েল প্রমুখ রেনেসাঁ সময়ের অন্যতম কিংবদন্তি। কিন্তু রেনেসাঁ সময়ের শিল্পকলাকে জানতে ও বুঝতে শুধু পুরুষ শিল্পীদের সম্পর্কে জানলে হবে না। নারী শিল্পীদের বাদ দিয়ে সে জানা হবে রেনেসাঁ শিল্পকলা সম্পর্কে অর্ধেক জ্ঞান। রেনেসাঁর নারী শিল্পীদের অধিকাংশ শিল্পকর্ম মিউজিয়াম, গ্যালারি ও চার্চের অবহেলায় হারিয়ে গেছে। ঐতিহাসিকেরাও নারী শিল্পীদের নিয়ে বেশ উদাসীন। তারপরও সে উদাসীনতা থেকে বেরিয়ে এসে নারী শিল্পীদের শিল্পকর্মের যে পুনরুদ্ধার চেষ্টা চলছে, তা রেনেসাঁ সম্পর্কিত জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করবে।
তথ্যসূত্র
১. Advancing Women Artists Foundation. (2019, October 17). Plautilla Nelli’s Last Supper, restored [Video]. YouTube. https://www.youtube.com/watch?v=-vog8hqWNAY
২. Golob, A. (2019, October 1). The art of healing. The Florentine.https://www.theflorentine.net/2019/10/01/violante-ferroni-awa/
৩. MacDonald, D. D. & Khan Academy. (n.d.). Female artists in the renaissance. Www.Khanacademy.Org. Retrieved March 5, 2021, from https://www.khanacademy.org/humanities/art-history-for-teachers/xeaa3470a:teaching-with-images/xeaa3470a:go-deeper-where-are-the-women-artists/a/female-artists-in-the-renaissance
৪. Poggioli, S. & NPR. (2021, January 2). “Where Are The Women?”: Uncovering The Lost Works Of Female Renaissance Artists. Www.Npr.Org. https://www.npr.org/2021/01/02/951479764/where-are-the-women-uncovering-the-lost-works-of-female-renaissance-artist